মা
জানলার পরদাটা সরিয়ে দিল দীপ।
সকাল থেকেই ঝুরুঝুরু বরফ পড়ছে। বাড়ির সামনের রাস্তার ওপারেই পার্ক।
ওয়াশিংটন স্কোয়ার। এর মধ্যেই পার্কটা প্রায় সাদা হয়ে এসেছে তুষারে।
শুরু হল সুদীর্ঘ শীতকাল। কঠিন শীতকাল। সব সময়ে একগাদা পোশাকে জবরজং হয়ে থাকতে হবে।
এই সোমবারটাও ছুটি ছিল। শুক্কুরবার বিকেল থেকে সোমবার রাত্তির পর্যন্ত টানা ছুটি, ভাবাই যায় না। লং উইক এন্ড। যেন এক অত্যাশ্চর্য উপহার।
কিন্তু সোমবার বিকেল হতেই মনে হয়, ছুটি ফুরিয়ে এল। কাল থেকে আবার কাজ। কাজ। কাজ
আর কাজ। ধরা বাঁধা রুটিন। ভাবলেই জ্বর আসে।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে খানিকটা দেখল দীপ। তারপর জানলার কাচের একটা পাল্লা খুলে দিল। একঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে লাগল তার বুকে। সে বাইরে হাত বাড়িয়ে দিল পেঁজা তুলোর মতন তুষারের স্পর্শ অনুভব করার জন্য। প্রত্যেক বছরই প্রথম। তুষারপাতের দিনটায় খানিকটা উত্তেজনা আসে। দেখতে-দেখতে বারো বছর কেটে গেল, তবু। এখনও এই দিনটাকে একটা বিশেষ দিন বলে মনে হয়। এখন মোটে সাড়ে চারটে, হিসেব। অনুযায়ী বিকেল, কিন্তু এর মধ্যেই আলো কমে এসেছে খুব। শীতকালের বিকেলটা টেরই পাওয়া যায় না দুপুরের পরেই সন্ধে।
কাপের চা পুরো শেষ হয়নি, দীপের হঠাৎ ইচ্ছে হল সবসুদু রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিতে। সে প্রায় ছোঁড়ার মতন করে তুলে ধরেও কেঁপে উঠল।
এ কী করছে সে?
তার অ্যাপার্টমেন্ট সাততলায়। এখান থেকে রাস্তায় একটা কাপ ছুড়ে ফেলার কথা কেউ কল্পনাই করতে পারে না। ব্রুকলিনের একটা ব্যস্ত রাস্তা। এদেশের রাস্তা দিয়ে লোকজন প্রায় হাঁটেই না, সবাই গাড়িতেই যায়। কিন্তু কাছেই কিছু দোকান-পাট রয়েছে, কেউ-কেউ খানিক দূরে গাড়ি পার্ক করে এখানে হেঁটে আসে, দীপ দেখতে পাচ্ছে ছাতা মাথায় কিংবা রেন কোট গায়ে কয়েকজন যাওয়া-আসা করছে।
তবু দীপের অদম্য ইচ্ছে হতে লাগল কাপটা জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলার।
দীপ যেন নিজের ওপর প্রবল জোর খাঁটিয়ে সরে এল সেখান থেকে। কাপটা রাখল রান্নাঘরের টেবিলে। একটা সিগারেট ধরাল। তার হাত কাঁপছে।
বাথরুমের দরজাটার পেছনে একটা মানুষ-সমান আয়না লাগানো। আগে থেকেই ছিল। এই অ্যাপার্টমেন্টটা দীপ কিনেছে দেড়বছর। আগে এখানে থাকত দুবার বিয়ে-ভাঙা এক ইটালিয়ান মহিলা। দীপের বন্ধু বাল্লু বলেছিল, তুই ওই অ্যাপার্টমেন্টটা যার কাছ থেকে কিনেছিস, সে মেয়েটার তো মাফিয়া কানেকশান আছে শুনেছি। সে বেচল কেন, কোনও গোলমাল নেই তো?
সে যাই হোক, মহিলাটি এই আয়নাটা লাগিয়েছিল? স্নান করার সময় সে কি নিজের সর্বাঙ্গ দেখতে ভালোবাসত? কিংবা অন্য কিছু উদ্দেশ্য ছিল?
সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দীপ জিগ্যেস করল, কী ব্যাপার তোমার? হঠাৎ কাপটা রাস্তায় ছোঁড়ার ইচ্ছে হল কেন?
আয়নার ভেতরের দীপ একটু হাসল।
তারপর বাঁকা সুরে বলল, আজকাল প্রায়ই তো দেখছি, তোমার এরকম এক-একটা উদ্ভট ইচ্ছে হচ্ছে। পরশুদিন কী করেছিলে? পরশু মানে গত শনিবার। দীপ তার পাড়ার সুপার মার্কেট থেকে সপ্তাহের বাজার করতে গিয়েছিল?
ট্রলিটা নিয়ে ঘুরছে। এক প্যাকেট মাখন তুলতে গিয়ে আর-একটা মাখনের প্যাকেট পড়ে গেল মাটিতে। কোনও কিছু চিন্তা না করেই দীপ সেই প্যাকেটটা জুতো দিয়ে মাড়িয়ে দিল। চেপে পিষে দিল প্রায়। তারপর ঠেলে র্যাকের নীচে।
সে তো চুরি করেনি। একটা মাখনের প্যাকেটের ওপর পা পড়ে যাওয়া কোনও অপরাধ নয়। কেউ দেখতে পেলেও কিছু বলত না। কিন্তু ইচ্ছে করে সে কেন একটা প্যাকেট মাখন নষ্ট করল? কোনও যুক্তি নেই এর।
আয়নার ভেতরের দীপ বলল, আরও বলব?
খোলা জানলাটা দিয়ে হুহু ঠান্ডা হাওয়া আসছে এখন। ঘরের হিটিং চালু আছে, তার মধ্যে এই হাওয়া ঢুকে একটা বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার হচ্ছে। বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে দীপ দৌড়ে গেল জানলার কাছে।
সেটা তক্ষুনি বন্ধ করে দীপ মাথা বাড়িয়ে দেখল।
কাপটা ছুড়লে রাস্তা পর্যত পড়ত না। তাদের এই অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর সামনের দিকে একটা চত্বর রয়েছে। এক চিলতে বাগান।
ওখানেই পড়ত, এমন কী ক্ষতি হত তাতে? ওখানে তো সে মাঝে-মাঝে বীয়ার ক্যান পড়ে থাকতে দেখে। সিগারেটের প্যাকেট, পেপার গ্লাস। বাইরে জিনিস ফেলা এমনকিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এদেশে এদের পরিষ্কার-বাতিক আছে বটে, আবার কেউ-কেউ ইচ্ছে করে নোংরাও করে। গাড়ির জানলা দিয়ে রাস্তায় বোতল ছুড়ে দেয়।
নীচে কেউ নেই। এখন কাপটা ছুঁড়ে ফেললে মন্দ হয় না, কেউ দেখবে না। তাহলে ফেলাই যাক না।
দীপ আবার কাপটা আনবার জন্য ফিরেও থমকে গেল। সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি? আস্ত একটা কাপ, চারখানার সেটের মধ্যে একটা, এটা শুধু-শুধু সে ভাঙবে কেন? এই চিন্তাটা আসছে কোথা থেকে?
লম্বা উইক-এন্ডের ছুটিতে অনেকেই বাইরে যায়। বীরেনদা সুরূপা-বউদিরা গেল ওয়াশিংটন ডি.সি.। দীপকেও সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করেছিল। চয়ন আর বাল্লু গেল হারভার্ড, ওদের গাড়িতে জায়গা ছিল। জুডিও গেল কানেটিকাট, ওর দিদির কাছে। দীপকে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুব ঝুলোঝুলি করেছিল, কিন্তু সে রাজি হয়নি। সবাইকে সে বলেছিল, এই ছুটিতে সে তার ঘরগুলোর ওয়াল পেপার পালটাবে।
কিছুই করেনি দীপ। শুক্রবার সন্ধে থেকে স্রেফ শুয়ে-শুয়ে কাটিয়ে দিল ছুটিটা। কারুর সঙ্গে দেখা হয়নি। এদেশে এমন একাকিত্ব অতি মারাত্মক।
কাল থেকে অফিস। আজ সন্ধের মধ্যে সবাই ফিরবে। আজ রাত্তিরে কেউ আর আড্ডা দেবে না। তবু দীপ একটু পরেই ফোন করল বাল্লুকে। পেয়েও গেল। গম্ভীরভাবে জিগ্যেস করল, বাল্লু, আমার আজ রাত্তিরে রান্না করতে ইচ্ছে করছে না, তোর ওখানে গেলে খেতে দিবি? কিংবা, ডাউন-টাউনে আমার সঙ্গে খেতে যাবি কোথাও?
বাল্লু বলল, আমার এখানেই চলে আয়! দীপ এইরকম একা থাকে বলে সবাই অবাক! অত ভালো একটা অ্যাপার্টমেনট কিনেছে কেন তবে? বিয়ে করবার ইচ্ছে যদি তার নাও থাকে, একজন। সঙ্গিনী তো পেতেই পারে। জুডি নামের মেয়েটির সঙ্গে দীপ স্টেডি যাচ্ছে অনেকদিন। জুডির ভারী মিষ্টি স্বভাব। অন্য সবাই পছন্দ করে তাকে।
দীপ বিয়ের কথা একেবারেই ভাবে না।
জুডিকে সে পছন্দ করে খুবই, জুডির ব্যবহারে কোনও মালিন্য নেই, জুডি তার মন বোঝে। শারীরিক সম্পর্কও বেশ পরিষ্কার। কিন্তু জুডির সঙ্গে লিভ টুগেদার করার ইচ্ছে নেই দীপের। জুডির মনে-মনে ইচ্ছে আছে তা সে বোঝে, কিন্তু জুডি মুখ ফুটে কথাটা বলেনি। জুডিকে অন্য একটি মেয়ের রুম শেয়ার করে থাকতে হয় কুইনসে, দীপ একবার বললেই সে চলে আসবে।
দীপ একবার বললেই সে চলে আসবে।
কিন্তু দীপ সর্বক্ষণ জুডিকে চায় না।
জুডি তার এখানে এসে একসঙ্গে থাকলে অন্য বাঙালিরা বা তার বন্ধুরা কী বলবে, তা গ্রাহ্য করে নাদীপ। যেদিন ইচ্ছে করবে, সেদিনই সে জুডিকে ডাকবে। কিন্তু এখনও তার একা থাকতে ভালো লাগে মাঝে-মাঝে।
পরদিন সকালবেলা পুরো সাজপোশাক করে অফিসে বেরুতে গিয়ে দীপ একবার ভাবল, গাড়ি নেবে, না সাবওয়েতে যাবে? বরফের মধ্যে গাড়ি চালানো এক ঝকমারি। দীপের বাড়ির কাছেই স্টেশন, তিন মিনিটে হেঁটে যাওয়া যায়।
তারপর মনে পড়ল, জুডি গাড়ি আনে না, ওদের অফিসের কাছে পার্কিং-এর কোনও জায়গাই পাওয়া যায় না। তিনদিন পর দেখা হবে, আজ জুডিকে নিয়ে কোথাও খেতে যাওয়া এবং তারপর তার নিজের বাড়িতে ওকে কিছুক্ষণের জন্য আনা কিংবা জুডিকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া তার উচিত।
গাড়ির চাবিটা সে নিয়ে নিল।
আজই ব্রুকলিনে ব্রিজের ওপর সাংঘাতিক জ্যাম।
এখান থেকে নিউইয়র্ক শহরটা অপূর্ব দেখায়, এতবার দেখে-দেখেও দীপ মুগ্ধতা হারায়নি, কিন্তু আজ তার সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, কেন সে গাড়িটা আনতে গেল?
রেডিওটা খুলে সে ট্রাফিক পোজিশান জানার চেষ্টা করল।
বিশ্রী খবর, সামনের তিন-চার জায়গায় গাড়ির জটলা। কখন ঠিক হবে, তার কোনও ঠিক নেই। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছটফট করতে লাগল দীপ। অফিসের দেরি হয়ে যাবে, এটা সে সহ্য করতে পারবে না! অথচ ট্রাফিক জ্যাম কি নতুন কিছু? অফিসের লোকরাও জেনে যাবে ব্রুকলিন ব্রিজের অবস্থা!
দীপের ইচ্ছে হল, গাড়ির দরজা খুলে নেমে চাবিটা জলে ছুড়ে ফেলে দিতে। তারপর সে হেঁটে চলে যাবে। গাড়িটা থাক এখানে পড়ে। পেছনের লোকগুলো চেঁচামেচি করুক।
পুলিশ এসে গাড়িটা টো করে নিয়ে যাক, যত ইচ্ছে ফাইন হোক, যা খুশি হোক, তবু দীপ কিছুতেই এখানে বসে থাকতে পারবে না।
গাড়ি থেকে নেমে দীপ আবার ধাতস্থ হল। এটাও পাগলামির লক্ষণ। এভাবে গাড়ি ছেড়ে যাওয়াটা চলে না।
দীপ অফিসে পৌঁছল ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিট দেরিতে।
বিভিন্ন সহকর্মীদের দিকে তাকিয়ে সে হাই ল্যারি, হাই বার্ট, হাই লিন্ডা এইসব বলতে-বলতে এগোল। তার দেরি বিষয়ে কেউ কোনও প্রশ্ন করল না। সে পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে এসেছে। ছুটির পর আরও পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে যাবে, এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার! নিজের ঘরে ঢুকে দীপ তার ওভারকোট, জ্যাকেট এমনকি সোয়েটার পর্যন্ত খুলে ফেলল। ভেতরটা বেশ গরম, কে বলবে যে বাইরের তাপমাত্রা এখন শূন্যের নীচে সাত ডিগ্রি। হঠাৎ শীত এসেছে। অথচ শীতকালেই অফিসের মধ্যে দীপের বেশি গরম লাগে।
কাজে ডুবে রইল তিন ঘণ্টা। এর মধ্যে দুবার বসের ঘরে যেতে হল, টেলিফোন ধরল এগারো বার। দু-কাপ কফি খেল, দুজন সহকর্মী ও একজন সহকর্মিনী গল্প শোনাল উইক-এন্ডের ছুটিতে কী-কী মজা হয়েছে।
দীপ কীভাবে ছুটি কাটিয়েছে তা অন্যরা জানতে চাইলে সে অম্লানবদনে বলল, তিনখানা ঘরের ওয়ালপেপার বদল করেছি, খুব খাটুনি গেছে।
এরপর সামান্য একটা ঘটনা ঘটল।
টেবিল থেকে একটা পেপার ওয়েট পড়ে গেল নীচে। সেটা তোলার বদলে দীপ প্রায় যেন নিজের অজান্তেই সেটাকে একটা শট লাগাল। খুব জোরে। এত জোরে যে ফাইবার গ্লাসের পার্টিশানে। সেটা লেগে বোমা ফাটার মতন দড়াম করে একটি শব্দ হল।
পাশের ঘর থেকে তার সহকর্মী ল্যারি উঠে এসে উঁকি মেরে জিগ্যেস করল, হোয়াট হ্যাপনড?
দীপ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, নার্থিং।
ল্যারিও বিনা বাক্যব্যয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফিরে গেল।
পেপার ওয়েটটার দিকে তাকিয়ে দীপ দাঁতে দাঁত চেপে খুব খারাপ একটা গালাগালি দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, এনাফ ইজ এনাফ! ঠিক পরের মুহূর্তেই তার ঘরে এলো বার্ট লিন্ডা।
বার্ট দীপেরই সমবয়সী, লিন্ডা বছর দু-একের ছোট। কিন্তু পদ-মর্যাদায় লিন্ডা একটু ওপরে। লিন্ডা বিয়ে করেনি, তার মন-প্রাণ সবকিছু সে অফিসের কাজে ঢেলে দেয়।
তেমন লম্বা নয় লিন্ডা, একটু ভারীর দিকে গড়ন, কিন্তু মুখে একটা শ্ৰী আছে। সে কেন বিয়ে করেনি, সেটা একটা রহস্য, তার কোনও বয়ফ্রেন্ডও নেই। লিন্ডার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনও প্রশ্নও করা যায় না, কখনও সেরকম প্রসঙ্গ উঠলেই সে এড়িয়ে যায়। বার্ট বেশ। খোলামেলা, হাসিখুশি ধরনের মানুষ। শুধু সে দীপের সহকর্মী নয়, তার সঙ্গে সম্পর্কটা অনেকটা বন্ধুর মতন। বার্ট বিবাহিত, লিন্ডার সঙ্গে তার হৃদয়-ঘটিত কোনও গোলযোগ নেই।
লিন্ডা বসল একটা চেয়ার টেনে, বার্ট বসল টেবিলের এক কোণে। দীপের সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে বলল, আবার তুমি সিগারেট খাচ্ছ? বলেছিলে যে অফিসে একটাও খাবে না? দীপ ক্লিষ্ট ভাবে হেসে বলল, ছাড়তে পারছি না যে!
লিন্ডা বলল, সিগারেট ছাড়ার প্রথম স্টেপ হল, কাছাকাছি সিগারেট না রাখা। চোখের সামনে একদমই প্যাকেট রাখবে না। যাই হোক, তুমি আজ লাঞ্চ খেতে কোথায় যাচ্ছ? যদি কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট না থাকে, আমাদের সঙ্গে চলো। তোমার মিনিয়াপোলিস ট্রিপটা সম্পর্ক সব কিছু ব্রিফ করে দেব!
দীপ অবাক হয়ে বলল, মিনিয়াপোলিস ট্রিপ মানে?
বার্ট বলল, তোমাকে মিনিয়াপোলিস যেতে হবে। মনে নেই? গত সপ্তাহে কথা হয়েছিল। মিঃ জ্যাকসন তোমাকেই পাঠাতে চাইছেন।
একটা ইনস্টলেশানের ব্যাপার আছে। বোধহয় দিনচারেক লাগবে তোমার।
দীপ দূরের পেপার ওয়েটটার দিকে আবার তাকাল।
যেমনভাবে পেপার ওয়েটটা আচমকা মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল, সেই রকমই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে দীপ বলল, আমি তো মিনিয়াপোলিস যেতে পারব না। আমি বাড়ি যাব, ইন্ডিয়ায়।
বার্ট বলল, হোম, সুইট হোম। বাড়ি যেতে কার না ইচ্ছে হয়। কিন্তু মাই ডিয়ার, তুমি তো জানুয়ারির আগে তোমার অ্যানুয়াল ছুটি নিতে পারছ না। জর্জ আর জিমি দুজনেই ছুটিতে। লিন্ডা বলল, তুমি জানুয়ারিতে চার-পাঁচ সপ্তাহ ছুটি নিতে পারো। তখন ইন্ডিয়ার ওয়েদার কী রকম?
দীপ বলল, অ্যানুয়াল ছুটি নয়। আমি একেবারে দেশে ফিরে যাব। লক স্টক অ্যান্ড ব্যারেল! বার্ট ভুরু তুলে বলল, হোয়াট? আর ইউ কিডিং? দীপ দু-দিকে ঘাড় নাড়ল।
না, সে ঠাট্টা করছে না। একবার মুখ ফসকে যখন কথাটা বেরিয়ে গেছে, তখন আর নড়চড় হবে না সে কথার। এনাফ ইজ এনাফ। তার আর ভালো লাগছে না। সেসব কিছু ছেড়ে দেশে চলে যাবে।
সারা অফিসে রটে গেল যে ডীপ রে মিনিয়াপোলিস যেতে হবে শুনে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে। সেখানকার একটা ফ্যাকট্রিতে কয়েকটা মেশিন ইনস্টলেশান নিয়ে ঝঞ্চাট হচ্ছে কিছুদিন ধরে। একটা বয়লার বাশঁ করে দুজন লোক আহত হয়েছে পর্যন্ত।
আসল নাম ছিল দীপক রায়চৌধুরী। ও নাম উচ্চারণ করতে এখানকার লোকের দাঁত ভেঙে যায়। তাই দীপক হয়েছে ডীপ। আর যে পদবিটা এদের অনেকেরই চেনা।
একটু পরে দরজায় নক করে আবার ঘরে এসে ঢুকল লিন্ডা।
হাসিমুখে বলল, ওকে ডীপ, তোমার মিনিয়াপোলিস যেতে হবে না। মিঃ জ্যাকসনকে আমি কনভিনস করিয়েছি, তোমার বদলে ল্যারি যেতে পারে।
দীপ খানিকটা চটে উঠে বলল, হোয়াট? কে তোমাকে বলেছে যে ওখানে যাওয়ার ভয়ে আমি। চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি! ওখানে যেতে আমার কোনও আপত্তি ছিল না। আমার মনে হয় না, কাজটা খুব ডিফিকাল্ট! আমি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি, তার কারণ, দু-একদিনের মধ্যেই আমি দেশে ফিরে যেতে চাই!
লিন্ডা খুব নরম ভাবে জিগ্যেস করল, দেশে ফেরার জন্য তোমার এত আর্জেন্সি কীসের তা কি জানতে পারি? এই কোম্পানির কেউ তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে? তুমি কি কোম্পানির কাছ থেকে আরও কিছু আশা করেছিলে?
লিন্ডা নিজের ব্যক্তিগত কারণ কারুকে বলে না। তবে সে দীপের ব্যক্তিগত কারণ জানতে চায়। দীপের মতন একজন অশ্বেতাঙ্গ ইঞ্জিনিয়ার চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে, তাতে কোম্পানির কী আসে। যায়? তার বদলে আরও অনেককে পাবে। তবু লিন্ডার মতন মেয়ে এরকম একটা প্রশ্ন করেছে। বলেই একটা উত্তর দিতে হয়।
দীপ লিন্ডার চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, কারণটা শুনলে বোধহয় তোমরা হাসবে! এদেশে কেউ এরকম কথা বলে না। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক পুরোনো ট্র্যাডিশান, পুরোনো ভ্যালুজ রয়ে গেছে। আমি ফিরে যাচ্ছি আমার মায়ের জন্য! তোমার মায়ের জন্য?
হ্যাঁ। কয়েকদিন ধরে আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। আমাকে ছেড়ে থাকতে আমার মায়ের খুব কষ্ট হয়। প্রায়ই কান্নাকাটি করেন। চোখে ভালো দেখতে পান না। তাই আমার ইচ্ছে হচ্ছে, শেষের কয়েকটা বছর মায়ের কাছে গিয়ে থাকতে!
লিন্ডা যেন এরকম কথা কখনও শোনেনি।
সেকথায় হাঁ করে চেয়ে রইল বেশ কয়েক মুহূর্ত।
তারপর আস্তে-আস্তে বলল, চাকরি ছেড়ে দিয়ে তোমার মার কাছে থাকবে? কোথায় থাকে তোমার মা?
কলকাতা শহর থেকে কিছুটা দূরে। একটা গ্রামে একা।
উনি কোনও কাজ-টাজ করেন?
না, লিন্ডা। আমার মা এখন কোনও কাজ করেন না। করতে পারেন না। তবে প্রায় সারা জীবন একটা স্কুলে পড়িয়েছেন। এখন চোখে ভালো দেখতে পান না বলে রিটায়ার করেছেন।
তোমার মা সম্পর্কে আরও কিছু বললা, ডীপ। তোমার বাবা বেঁচে নেই নিশ্চয়ই।
না, আমার যখন পাঁচ বছর বয়েস, তখন বাবা মারা যান। আমার মায়ের বয়েসও তখন মাত্র ছাব্বিশ।
উনি কি আবার বিয়ে করেছিলেন?
না, লিন্ডা, আমাদের দেশের বিধবারা চট করে বিয়ে করেন না। কোনও বাধা নেই। তবু অনেকেই…আমার মা অবশ্য বিয়ে করতে পারতেন, আমার গ্র্যান্ড ফাদার খুব লিবারাল ছিলেন, মায়ের অত কম বয়েস, দেখতেও সুন্দরী ছিলেন বেশ। কিন্তু মা আমার জন্য সবকিছু স্যাক্রিফাইস করলেন। মা রঙিন পোশাক পরতেন না, সিনেমা-থিয়েটার দেখতে যেতেন না। শুধু। আমাকে মানুষ করে তোলাই ছিল তাঁর একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। মা দুপুরে স্কুলে পড়াতেন, আর সকাল-সন্ধে আমাকে নিয়ে পড়াতে বসতেন। মায়ের জন্যই আমি বরাবর ভালো রেজাল্ট করেছি। ইঞ্জিনিয়ার হয়েছি।
আরও বলো। আরও বলল তোমার মায়ের কথা।
আমি যখন আমেরিকায় পড়তে আসি, তখন প্লেন ভাড়ার টাকা জোগাড় করাই এক সমস্যা হয়েছিল। আমি বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করব ভেবেছিলাম, তার আগেই মা তাঁর গয়না সব বিক্রি করে দিলেন। গয়না বেশি ছিল না, কিন্তু শেষ টুকরোটা পর্যন্ত বিক্রি করে…আমার জন্য মা সব কিছু করতে পারতেন। পরে আমি জানতে পেরেছি, একসময় যখন আমাদের খুবই টাকার। টানাটানি ছিল, তখন মা নিজে না খেয়ে আমাকে সবকিছু ঠিকঠাক দিতেন, অভাব-অনটনের কথা আমাকে টেরই পেতে দিতেন না।
তোমার মাকে এখন এদেশে নিয়ে এসো তাহলে। এখানে ভালো থাকবেন। তুমি চাকরি ছাড়বে কেন, ডীপ। তোমার মাকে এনে তোমার কাছে রাখো।
এখন আর সেটা সম্ভব নয়। অনেক দেরি হয়ে গেছে। মা চোখে দেখতে পান না ভালো, এখন আর ততদূর ট্রাভল করতে পারবেন না। আমাকেই যেতে হবে।
লিন্ডা চুপ করে দীপের দিকে চেয়ে রইল। তার মুখখানি করুণ। দীপ সম্পর্কে লিন্ডার এতখানি
আগ্রহ দেখবার কারণটা যেন দীপ খানিকটা আন্দাজ করতে পারছে। এ-অফিসে আর একজনও অশ্বেতাঙ্গ নেই। কেউ দীপকে কখনও অপমান করেছে কি না, কিংবা দীপের ওপর কোনও অবিচার হয়েছে কিনা, সেসবই বোধহয় লিন্ডা জানতে চায়।
দীপের অবশ্য সেরকম অভিজ্ঞতা অন্য দু-এক জায়গায় হলেও এই অফিসে হয়নি। অফিস সম্পর্কে তার কোনও ক্ষোভ নেই। টাকাকড়ি ভালোই তো দেয়!
লিন্ডা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তাহলে আর তোমাকে বাধা দিতে চাই না দীপ। তুমি যখন মন স্থির
করে ফেলেছ, হয়তো ঠিকই করেছ! অফিস থেকে রিলিজ পেতে তোমার যাতে অসুবিধে না হয়, সেটা আমি দেখব!
ছুটির পর জুডিকে তার অফিস থেকে তুলে নিল দীপ। পার্ক অ্যাভেনিউ-এর এক দামি রেস্তোরাঁয় খেতে গেল। প্রথমে কিছুই জানাল না। জুডি আজ একটা গাঢ় লাল রঙের স্কার্ট পরে এসেছে। তার ব্লন্ড চুলের সঙ্গে দারুণ মানিয়েছে পোশাকটা।
কানেটিকাটে জুডির দিদির বাড়ির গল্প শুনতে-শুনতে একসময় ফস করে দীপ বলল, আমি দেশে ফিরে যাচ্ছি, জুডি। চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি!
অফিসের সহকর্মীদের যা-যা বলেছিল, সবটাই শুনিলে নিল ও জুডিকে।
জুডি ঈষৎ স্নান গলায় বলল, কদিন ধরে কেন যেন মনে হচ্ছিল, আমাদের দুজনের মধ্যে। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। তবু আমি নিজেকে প্রস্তুত করতে পারিনি, ডীপ। অন্য কোনও মেয়েকে তোমার ভালো লেগেছে?
আরে না, না, আমি এ-দেশ ছেড়েই চলে যাচ্ছি। চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি।
কেন ছেড়ে দিচ্ছ?
বললাম যে, আমার মায়ের জন্য। মায়ের কাছে গিয়ে থাকব।
তোমার মায়ের কথা আগে আমাকে কখনও বলোনি তো। একবার উল্লেখ করোনি!
বান্ধবীর কাছে মায়ের গল্প করে নির্বোধরা। তা ছাড়া এমনভাবে মায়ের কথা মনেও পড়েনি আগে।
তোমার মায়ের সঙ্গে তো আমার প্রতিযোগিতা চলে না। একমাত্র এই কারণটার জন্যই আমি তোমাকে বাধা দিতে পারি না। অন্য কোনও কারণ হলে বলতাম, তুমি চলে যেও না। থাকো।
আমি মনস্থির করে ফেলেছি, জুডি। আমার মন আর এখানে টিকছে না। আর বেশিদিন থাকলে আমার মাথার গোলমাল হয়ে যাবে। আমাকে যেতেই হবে।
আজ রাত্তিরটা আমি তোমার সঙ্গে থাকতে পারি? তোমার বাক্স গুছিয়ে দেব?
দুদিনের মধ্যেই ম্যানহাটন, ব্রুকলিন, নিউ জার্সির সমস্ত পরিচিতরা জেনে গেল যে দীপ হঠাৎ এদেশের পাট চুকিয়ে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে দেশে। বুড়ি মায়ের কাছে গিয়ে থাকবে শুনে হাসাহাসি করতে লাগল অনেকে। কেউ-কেউ বলল, আহা দুধের বাছা রে! মায়ের আঁচলের হাওয়া খাবে! কেউ-কেউ বলল, ওসব আদিখ্যেতা ঘুচে যাবে দুদিনেই। একবার কলকাতার গরম লোডশেডিং আর মিছিলের মধ্যে গিয়ে পড়ুক না। বাপের নাম পর্যন্ত ভুলিয়ে দেয়। কোনও চাকরি-বাকরি। পাবে না, সবাই খারাপ ব্যবহার করবে, টাকাপয়সা ফুরিয়ে এলে ওর মা-ই আবার বলবেন, যারে খোকা, আমেরিকায় গিয়ে কিছু রোজগার করে নিয়ে আয়! বাল্লু সিনহা অবাঙালি বিহারের ছেলে, কিন্তু দীপের অন্যান্য বাঙালি বন্ধুদের চেয়েও বাল্লু তার সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ। দুজনে এক সঙ্গে অনেকদিন পড়েছে, দেশে ও এখানে।
আরও দু-একদিন বাদে বাল্লু হঠাৎ হাজির হয়ে বলল, সবাই যেটা জানে, সেটা তুই আমাকে বলিসনি কেন রে, রাস্কেল?
দীপ মুচকি হেসে বলল, টিকিটটা কাটার আগে তোকে জানাতে চাইনি। তুই নির্ঘাত বাধা দিতিস। আজই বুকিং কনফার্মড হয়ে গেছে। আমি শনিবার যাচ্ছি!
তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
প্রায় খারাপ হয়ে যাচ্ছিল রে! এখন আবার ঠিক হয়ে গেছে।
যেই ফাইনাল ডিসিশানটা নেওয়া হয়ে গেল, তারপর থেকেই মাথাটা সুস্থির হল।
কেন ফিরে যেতে চাস, আমায় বুঝিয়ে বলবি?
আমার ভালো লাগছিল না রে, একদম ভালো লাগছিল না।
তোর অফিসের লিন্ডা বলে মেয়েটার সঙ্গে দেখা হল ট্রেনে। তার মুখে একটা অদ্ভুত কথা
শুনলাম। তুই নাকি তোর মার জন্য ফিরে যাচ্ছিস? মার কাছে গিয়ে থাকবি?
দীপ এবার কোনও উত্তর না দিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল।
বাল্লু চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে কাবার্ড খুলে একটা স্কচের বোতল খুঁজে বার করল। দুটো গেলাসে খানিকটা করে ঢেলে এনে, নিজে প্রথমে একটা চুমুক দিয়ে বলল, তুই কবে থেকে এরকম গুলবাজ হয়েছিস রে, দীপু? সবাইকে বলেছিস, তোর মায়ের জন্য ফিরে যাচ্ছিস? তোর মা, দাঁড়া, তারিখটা মনে করি, ফোর্থ ডিসেম্বর, চার বছর আগে ওইদিন টেলিগ্রাম এল তোর মা মারা গেছেন।
আমার মনে নেই ভাবছিস? চার বছর আগে তোর মা মারা গেছেন, তুই তাঁর কাছে ফিরে যাবি?
দীপ চুপ করে রইল।
বাল্লু বলল, বীরেনদা, সুরূপাবউদি, রণজয়, স্বপন আরও অনেকেই জানে যে তোর মা বেঁচে নেই, তুই তাদের কী করে ধাপ্পাদিবি?
দীপু তবু কোনও কথা বলল না।
বাল্লু, আর-এক চুমুকে গেলাস শেষ করে বলল, এটা কি ফর অফিস কনজাম্পশন? কেন, অফিসকে এরকম একটা মিথ্যে কথা না বললে কি তোকে ছাড়ত না? এমনিই ছেড়ে দিত। বড় জোর তিন মাসের নোটিশ দিতে বলত! ও বুঝেছি, এটা রটিয়েছিস জুডিকে বোঝাবার জন্য। মা মা বলে কেঁদে ফেলে তুই জুডির কাছ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিস! সে একটা ভালো মেয়ে। তার কাছে এরকম একটা বাজে মিথ্যে কথা বলাটা আমি মোটেই পছন্দ করছি না!
দীপ এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হঠাৎ মায়ের কথাটা মুখে এসে গিয়েছিল, তা ঠিকই। কিন্তু পুরোটাই কি মিথ্যে? মা বেঁচে না থাকলেও কি মায়ের কাছে ফেরা যায় না?
বাল্লু ভুরু কুঁচকে বলল, তার মানে?
দীপ বলল, ভালো করে ভেবে দ্যাখ। দুবার বলতে হবে কেন? আবার খানিকটা হুইস্কি ঢেলে বাল্লু বলল, অ্যাবস্ট্রাক্ট মাদার নিজের মানয়, দেশমাতৃকা! তুই দেশ জননীর কাছে ফিরে যেতে চাস? হঠাৎ তোর এরকম পেট্রিয়টিক ফিলিং কী করে জেগে উঠল রে?
দীপ বলল, না, না, ওসব কিছু নয়। আমি সাধারণ মানুষ, দেশ-টেশ নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি। অতবড় দেশ তোর আমার মতন কয়েকজনকে বাদ দিয়েও দিব্যি চলবে। এখনও তো চলছে। আমি শুধু ভেবেছি আমার মায়ের কথা। আমার মা চাপা স্বভাবের ছিলেন, মুখে কিছু। বলতেন না, চিঠিতেও পীড়াপিড়ি করেননি। কিন্তু মনে মনে খুব চাইতেন আমি ফিরে যাই। মা খুব কষ্ট করে আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন, তারপর তাঁর ইচ্ছে ছিল, বিলেত-আমেরিকা থেকে একটা ডিগ্রি নিয়ে আমি তাঁর কাছাকাছি থাকব। দেশে চাকরি তো একটা পেতামই!
ইডিয়েট, তাহলে তোর মা যখন বেঁচে ছিল, তখন ফিরলি না কেন? তখন তোর এই বোধটা হয়নি! তাহলে তো কিছুদিন অন্তত খুশি করতে পারতিস।
তখন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।
ঘোর মানে? চার বছর আগে জুডির সঙ্গে তো তোর আলাপ হয়নি!
সে ঘোরের কথা বলছিনা। ধর, তুই আর আমি একসঙ্গে এম এস পড়তে এলাম। প্রথম বছরটা আমাদের কী সাংঘাতিক কষ্ট করতে হয়েছিল মনে আছে? গুণে-গুণে পয়সা খরচ করতাম। ভালো করে কিছু খেতাম না পর্যন্ত। তারপর তো এম এসটা হল। তখন তুই-ই বললি, আয় পি এইচ-ডি-টাও করা যাক। আরও তিন বছর। তারপর কী করলাম এতদিন পড়াশুনার কষ্ট করেছি, এবার চাকরি করে সবটা উশুল করা যাক। ঝট করে পেয়ে গেলাম চাকরি। একটা ছেড়ে আর একটা। বেশি টাকা। নতুন গাড়ি। বাড়ি কেনা। বান্ধবী। এইগুলোই তো ঘোর।
কেন, আমরা দেশে টাকা পাঠাইনি? প্রত্যেক মাসে দুশো ডলার, নট আ ম্যাটার অফ জোক। হ্যাঁ, আমি মনে করতাম, টাকা পাঠালেই সব দায়িত্ব চুকে যায়। এটাও একটা ঘোর।
দ্যাখ, দীপু, দেশে ফিরে যাওয়া মানে কি বেকারের সংখ্যা বাড়ানো নয়? তুই বা আমি চাকরি। পেয়ে যেতে পারি, কিন্তু তার ফলে আর দুটো ছেলে তো বেকার হবে। চাকরির সংখ্যা তো বাড়বে না? আমি তো মনে করি, দেশে ফিরে গাদাগাদি না করে, এখান থেকে যে আমরা ফরেন। এক্সচেঞ্জ পাঠাচ্ছি, তাতেই দেশের যথেষ্ট উপকার করা হচ্ছে।
তোর কথা খানিকটা আলাদা রে বাল্লু। তোর আরও ভাই-বোন আছে। মা-বাবা দুজনেই বেঁচে। তুই এখানে বিয়ে করেছিস, তোর একটা বাচ্চা ইস্কুলে যায়। তোর পক্ষে এক্ষুনি ফেরা মুশকিল। না ফিরলেও ক্ষতি নেই। কিংবা তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। কিন্তু আমার এখনও এখানে শেকড় গাড়েনি!
শেকড় আমারও গাড়েনি। আমিই বরংইচ্ছে করলে যে-কোনওদিন ফিরে যেতে পারি। কিন্তু তোর যুক্তিটা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। তোর বাবা-মা কেউ নেই। খুব কাছের আত্মীয় কেউ নেই। তুই ফিরতে যাবি কোন দুঃখে? তুই-ই বরং এখানে মজাসে থাকতে পারিস।
আমার ভালো লাগছে না। ভালো লাগছে না। কিছু ভালো লাগছে না।
সাময়িক ডিপ্রেশন। তুই বরং এক কাজ কর। ছুটি নিয়ে কিছুদিন দেশ থেকে ঘুরে আয়। যাসনি তো অনেকদিন। দেশের অবস্থা দেখলেই তোর এই ঘোরটাও কেটে যাবে। ওখানে কোনও মানুষ থাকতে পারে? যারা বাধ্য হয়ে পড়ে আছে, তাদের কথা আলাদা। ব্লাডি পলিটিশিয়ানরা দেশটার সর্বনাশ করে দিচ্ছে। পরিমলের কথা মনে আছে? দেশে ফিরে গিয়ে নিজের টাকায় একটা কারখানা খুলল। বেশ ভালোই চলছিল, তারপর হঠাৎ কিছু বদমাশ এসে স্ট্রাইক করে। কারখানাটা তুলে দিল। গর্ভনমেন্ট কোনও সাহায্যই করল না। পরিমল আবার ফিরে এসেছে, এখন দেশের নাম শুনলে চটে যায়।
আমার মায়ের হঠাৎ স্ট্রোক হল, আমি যখন খবর পেলাম, তখন সব শেষ! গিয়ে শেষ দেখাটাও হল না।
ডোনট বি সেন্টিমেন্টাল দীপু। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। চার বছর আগে। এখন আর তা নিয়ে আপশোশ করে কী হবে?
মা নেই, কিন্তু মায়ের ইচ্ছেটা তো রয়ে গেছে? মা চেয়েছিলেন…।
আরও তো অন্য মা আছে। আরও কোনও বুড়ি, চোখে ছানি পড়ে গেছে, ভালো দেখতে পায় না। তার ছেলে চলে গেছে কোথায়। সেরকম একটা বুড়ির পাশে বসব, তার গায়ে হাত বুলিয়ে বলব, মা, দ্যাখো, আমি ফিরে এসেছি! দিস ইজ আটারলি রিডিকুলাস। তোর কি সত্যি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি রে, দীপু? বোধহয় তাই!
এরকম তর্ক-বিতর্ক চলল অনেক রাত পর্যন্ত। কিন্তু দীপু গোঁয়ারের মতন জেদ ধরে আছে, সে কিছুতেই মত পালটাবে না। সে যাবেই। সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে যাবে!
বাল্লু খুব রাগ করে চলে গেল!
শনিবার দিন দীপের ফ্লাইট সন্ধেবেলা। সকাল নটার সময় লিন্ডা টেলিফোন করে জিগ্যেস করল, দীপু, তোমার কাছে একবার আসতে পারি? তুমি নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত। আমি বেশিক্ষণ সময় নেব না।
দীপু বলল, অফ কোর্স, অফ কোর্স। ইউ আর ওয়েলকাম। আমি মোটেই ব্যস্ত নই!
টেলিফোন রেখে দীপ গালে হাত দিয়ে বসে রইল।
লিন্ডা হঠাৎ আসতে চাইছে কেন? লিন্ডার সঙ্গে তার কোনওরকম ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা হয়নি কখনও। লিন্ডা সবসময়েই তার সঙ্গে ভদ্র ও ভালো ব্যবহার করেছে, কিন্তু সবটাই ফর্মাল! অফিসের বাইরে কক্ষনো যোগাযোগ হয়নি তাদের। অফিসের সঙ্গে তো সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে দীপ। লিন্ডা অবশ্য সাহায্য করেছে সে ব্যাপারে।
আধ ঘণ্টা পরে এসে উপস্থিত হল লিন্ডা।
দীপ তাকে দরজা খুলে ভেতরে এনে বসাল। শয়নকক্ষ ও বসবার ঘরের চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে লিন্ডা জিগ্যেস করল, তোমার এখানে আর কেউ নেই?
দীপ বলল, না। এখন কেউ নেই। বন্ধুরা আসবে দুপুরে।
এতে যেন বেশ স্বস্তিবোধ করল লিন্ডা।
দীপ তার ওভারকোটটা খুলে দিল। একটা হালকা নীল পোশাক পরে এসেছে লিন্ডা। হাতে সাদা রঙের গ্লাভস। তার মুখে লজ্জা-লজ্জা ভাব।
গ্লাভস দুটো খুলতে-খুলতে লিন্ডা বলল, তুমি নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছ? তোমাকে একটা কথা জানাতে এলাম। সেটা শুনলে তুমি আরও চমকে যাবে। কিংবা অবিশ্বাস করবে? তবু বলি। নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
কী করে শুরু করব, ঠিক বুঝতে পারছি না। প্রথম থেকেই বলি, সেদিন তোমার কথা শুনে আমি বাড়িতে গিয়ে খুব কেঁদেছিলাম!
সে কি! কোন কথা শুনে লিন্ডা? আমি কি কোনও কারণে তোমাকে আঘাত দিয়েছি?
হ্যাঁ, আঘাত দিয়েছ তো বটেই। আমার মনের খুব ভেতরের একটা জায়গায় খুব জোরে আঘাত দিয়েছ! অবশ্য, তুমি না জেনেই—আমি এখনও বুঝতে পারছি না লিন্ডা।
সেদিন তুমি তোমার মায়ের কথা বললে!
আমি জানি, ইন্ডিয়া গরিব দেশ! এখানে তুমি ভালো চাকরি করতে, দেশে গিয়ে এরকম আরামে থাকতে পারবে না! তোমার অনেক কষ্ট হবে। তবু তুমি সব ছেড়ে চলে যাচ্ছ তোমার মায়ের জন্য। তোমার মায়ের কাছে থাকবে বলে। এটা আমার চেতনাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে!
কেন? কেন?
মা আর সন্তানের এইরকম সম্পর্কের কথা আমি জানতাম না। কখনও দেখিনি, শুনিওনি। আমার মা নেই, কোনওদিন ছিলও না!
তার মানে? কোনওদিন ছিল না মানে? বড় বেশি ব্যক্তিগত কথা হয়ে যাচ্ছে, তুমি কিছু মনে করবে না তো?
মোটেই না। তুমি বলো।
আমার জন্মের ছমাস পরেই আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে যায়? আমি আনওয়ান্টেড চাইল্ড। মা অ্যাবরশন করতে চেয়েও শেষপর্যন্ত করেনি। আমি আমার সেই জননীর স্বামীরও সন্তান নই, অন্য একজনের তাই নিয়ে দুজনের ঝগড়া হয়। তারপর সেপারেশন, ডিভোর্স। মা আমাকে ফেলে পালায়। আর কোনওদিন আমার খোঁজ করেনি।
আই অ্যাম সরি টু হিয়ার দ্যাট। ভেরি সরি, লিন্ডা!
আমাকে যে জন্ম দিয়েছিল, সেই স্ত্রীলোকটি আমাকে এই পৃথিবীতে আনতে চায়নি। আমার সম্পর্কে তার কোনও টান ছিল না। আমি তার ছবি দেখিনি। তার মুখ কেমন দেখতে তাও জানি না। যার ঔরসে আমার জন্ম, তার পরিচয়টাও জানাজানি হয়নি। সুতরাং আমার বাবাকেও আমি। চিনি না। আইনত যিনি আমার পিতা, তিনি অবশ্য দয়ালু মানুষ ছিলেন, আমাকে বাঁচিয়ে। রেখেছিলেন, আমার জন্য ওয়েট নার্স রেখেছিলেন, একটু বড় হলে আমাকে হস্টেলে পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর্যন্ত আমার পড়ারও খরচ দিয়েছেন। আমি ভাগ্যিস লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম, তাই এ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছি। নইলে সমাজের অনেক নীচু স্তরে আমার স্থান হত। গোটা মাতৃজাতির ওপর আমার ঘৃণা আছে। নিজে বিয়ে করার কথা ভাবি না সেইজন্য!
তোমার কথায়, ব্যবহারে কোনওদিন সেই তিক্ততা ফুটে ওঠেনি!
পৃথিবীতে আমি একা। সবার সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু একজন মা আমাকে জন্ম দিয়ে ফেলে চলে গেছে, কোনওদিন আমায় আর দেখা দিল না। এটাও ভুলতে পারি না কিছুতে! সেদিন তুমি বললে, তুমি তোমার মায়ের কাছে ফিরে যেতে চাও। তোমার মা তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন। এটা যেন একটা অন্য জগতের কথা। এমন স্নেহের টান, পরস্পরের জন্য ব্যাকুলতা, আমার মনটা হুহু করতে লাগল, ডীপ। আমি এসব কখনও পাইনি। তবু যে আমার ভেতরে একটা হাহাকার ছিল…
লিন্ডা হঠাৎ চুপ করে গেল।
দীপও মাথা নীচু করে রইল।
খানিকটা বাদে রুমাল দিয়ে নাক মুছে লিন্ডা বলল, আমি আর তোমার বেশি সময় নেব না। তোমাকে একটা অনুরোধ জানাব?
দীপ মাথা তুলে বলল, বলো!
লিন্ডা বলল, আমি তোমার মাকে একটা কিছু দিতে চাই। কী দেব, ভেবেই পাচ্ছিলাম না। ফুল দেওয়া যেত, কিন্তু তুমি ইন্ডিয়ায় পৌঁছতে পৌঁছতে ফুল শুকিয়ে যাবে। কিছু খাবারও পাঠাবার কোনও মানে হয় না।
তোমার মা এদেশি পোশাক নিশ্চয়ই পরেন না। তাই ভাবলাম…
লিন্ডা তার হাত-ব্যাগ থেকে একটা সুন্দর বাক্স বার করল। সেটা খুলতেই দেখা গেল, তার মধ্যে একটা মুক্তোর মালা।
দীপ আঁতকে উঠে বলল, এ কী, এত দামি জিনিস? না, না।
লিন্ডা কুণ্ঠিতভাবে বলল, সেদিন তুমি বলেছিলে, আমেরিকায় আসার সময় তোমার টিকিট কাটার পয়সা ছিল না। তোমার মা নিজের সব গয়না বিক্রি করে দিয়েছিলেন। আমার মা নেই, আমি কি আমার দেশের পক্ষ থেকে তোমার মাকে এই গয়নাটা দিতে পারি না? তুমি প্রত্যাখ্যান কোরো না, প্লিজ! যদি নাও, আমার খুব ভালো লাগবে, আমার প্রাণ জুড়াবে! তাঁকে বলল, আমেরিকার এক অনাথিনী মেয়ে এক আদর্শ মাতৃত্বকে এই সামান্য উপহারটুকু দিয়েছে!
দীপ তখনও চুপ করে আছে দেখে লিন্ডা আবার বলল, আমার শিগগির ইন্ডিয়ায় যাওয়ার কথা আছে। তখন তোমার বাড়িতে যাব। তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করব। তোমার মায়ের হাতের রান্না খেতে চাইলে তিনি খাওয়াবেন? দীপ মনে-মনে বারবার বলে যাচ্ছে, না, আমি মিথ্যে। বলিনি, মিথ্যে বলিনি। মিথ্যে বলিনি। লিন্ডাকে ঠকাইনি। আমার মা সত্যিই আমার জন্য এক সময়…হয়তো একটু দেরি হয়ে গেছে আমার, কিন্তু মায়ের ইচ্ছেটা মিথ্যে হয়ে যায়নি।
একটু পরে মুখ তুলে, লিন্ডার দিকে স্পষ্ট চোখে তাকিয়ে দীপ বলল, হ্যাঁ, এসো তুমি ইন্ডিয়াতে। মাকে দেখবে। ভারতীয় মা। গ্রামে, মাটির ঘরে বসে আছেন। চোখে ভালো দেখতে পান না। বসে আছেন তাঁর সন্তানের প্রতীক্ষায়। তুমি এই মালাটা এখন রেখে দাও, যখন যাবে, নিজের হাতে তাঁকে দিও!