মা-ভূমি

মা-ভূমি

প্রায় আধঘণ্টা হয়ে গেল মানস মেট্রো সিনেমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অনিমেষদার দেখা নেই। বলেছিল, ঠিক দশটার সময় চলে আসবি। ফার্স্ট আওয়ারেই ধরতে হবে সেনগুপ্তকে। তোর চাকরিটা এবার হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।

চাকরি তো দূর অস্ত, যে যোগাযোগ করিয়ে দেবে, তারই দেখা নেই। যদিও এখন যা অবস্থা মানসের, একটা ছোটখাটো কাজের জন্য চার ঘণ্টাও যে-কোনও জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে রাজি। কিন্তু আজ আর ভাল লাগছে না। নিজেকে কেমন যেন অর্ধনগ্ন ভিখিরি মনে হচ্ছে। কথাটা মোটেই উপমা নয়, ঘোরতর বাস্তব। মা মারা গেছে চারদিন হল। মানসের পরনে অশৌচের ধড়া। গলায় সাদা সরু কাপড়ের মালায় চাবি বাঁধা। কোমরে কম্বলের আসন গোঁজা। ছোট্ট একটা অনিয়ম করেছে মানস, ধুতির তলায় সাদা ড্রয়ার পরেছে। এটা না পরলে হুগলি থেকে হাওড়া স্টেশনে আসার সাহস পেত না। যা ভিড় হয় ট্রেনে।

অনিমেষদা মানসের পিসির ছেলে। কিছু লোক থাকে না, কারুর জন্য কিছু করতে পারলে বর্তে যায়। অনিমেষদা সেরকমই ছেলে। এল আই সি-র এজেন্ট। ব্যাবসা ভালই করে মনে হয়। মধ্য কলকাতায় থাকার কারণে বড় বড় পার্টির পলিসি ওর ব্যাগে। অনেক অফিস কাছারিতে যাতায়াত আছে। মানসের জন্য অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছে অনিমেষদা। দু’-চার জায়গায় নিয়েও গিয়েছিল, কাজগুলো অনিমেষদারই পছন্দ হয়নি। হয় মাইনে কম অথবা কাজটা ভদ্রস্থ নয়। মানস গ্র্যাজুয়েট। একটা ঠিকঠাক চাকরি করে দিতে অনিমেষদা বদ্ধপরিকর।

এদিকে মা যেতে মানস আরও গরিব হয়ে গেল। বাবার মৃত্যুর পর আধখানা পেনশান, যা দিয়ে চলছিল সংসার, তাও এখন বন্ধ। সম্বল বলতে মানসের টিউশানি। নিজের বাড়িতেই পড়ায় গোটা দশেক ছেলেমেয়েকে। গ্রামের দিকে বাড়ি গিয়ে পড়ানোর চল কম। চাষিবাসি লোক, প্রাইভেটে পড়ানোর মতো টাকা দিয়ে উঠতে পারে না। গ্রুপে পড়িয়েও সবার থেকে নিয়মিত মাইনে পায় না মানস, লাউ, কুমড়ো, মাছটাছ পাঠিয়ে কমপেনসেট করে অনেকে।

মায়ের শ্মশানযাত্রায় যেতে যেতে এইসব দুঃখের কথাই অনিমেষদাকে বলেছিল মানস। বেদনাহত চিন্তিত মুখে পাশে পাশে হাঁটছিল অনিমেষদা। দূরে থাকা আত্মীয় বলতে সে-ই একমাত্র এসেছে মায়ের শেষ যাত্রায়। বেচারা অনেক চেষ্টা করেছে মানসের জন্য। ওর মতো জীবনবিমার এজেন্ট হয়ে যেতে বলেছিল। মানস বলেছে, গ্রামের লোক ধার নিয়ে চাষাবাদ করে। এরা করবে বিমা! এক-দু’জন এজেন্ট অলরেডি এখানে আছে। মুখ শুকিয়ে ঘোরে। ওদের দেখলেই লোকে পালায়।

শ্মশান ফেরত অনিমেষদা বলল, নাঃ এবার তোর জন্য কিছু একটা করতেই হবে। অন্য স্টেটে যেতে পারবি তো?। এখন তো মামি নেই। কাউকে দেখার ব্যাপারও থাকল না।

অনিচ্ছে সত্ত্বেও সম্মতি জানিয়েছিল মানস। মা না থাকলেও, ভিটেটুকু আছে, মায়ের হাতে লাগানো গাছপালা, বাবার ইজিচেয়ার। তিল তিল করে পয়সা জমিয়ে পাকা বাথরুম পায়খানা, বাড়ির চাল অবশ্য টালির রয়ে গেছে। মা বাবা জগতে নেই। একমাত্র বোনের বিয়ে হয়েছে দূরে। ভিটেটা ছেড়ে চলে গেলে, এ পৃথিবীতে বড় একা হয়ে যাবে মানস।

চিন্তার মাঝে কাঁধে একটা চাপড় পড়ল। ঘুরে দেখে অনিমেষদা। অপরাধী হাসি নিয়ে বলে, সরি, অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলাম তোকে। কী করব বল, বেরোতে যাচ্ছি ক্লায়েন্ট এসে হাজির। পলিসির এগেনস্টে লোন চাই। কথা বলতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। মানস বলে, না না, কী এমন দেরি। আমি চিন্তা করছি, তোমার সেনগুপ্ত না বেরিয়ে যায়।

বেরোবে না। ফোন করে দিয়েছি। বলেছে, আপাতত ঘণ্টা দুয়েক থাকবে। বলতে বলতে পা চালায় অনিমেষ। মানসকে জিজ্ঞেস করে, কিছু খাবি তো? সেই তো কখন খেয়ে বেরিয়েছিস।

খিদে পায়নি। আগে দেখা করে নিই চলো। দু’জনে এস এন ব্যানার্জি রোডের দিকে মুখ করে হাঁটতে থাকে। হকার, পথচারী মিলিয়ে ফুটপাত থিকথিক করছে। ডজ, ড্রিবলিং করে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। অনিমেষের মুখে মানস শুনেছে, সেনগুপ্তর অফিস ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। অনেকটাই হাঁটতে হবে। খিদে তার সত্যিই পেয়েছে। আশপাশের বাড়ি থেকে দেওয়া একগাদা ফল মিষ্টি বাড়িতে ছিল। ঘুম থেকে উঠে ওসব খাওয়া যায় না। বাথরুমের কাজ সেরে চলে এসেছিল স্টেশন চত্বরে। হাবুদার দোকানে বসে চা-বিস্কুট খাচ্ছিল, কোথা থেকে সামনে এসে দাঁড়াল বিড়াল পাগলি। কোলে সবসময় একটা বিড়াল নিয়ে ঘোরে। হাতের বাটি বাড়িয়ে ধরল হাবুদার দিকে। চা দিতে হবে। চা হাবুদা দেয়, বিস্কুট দিতে হয় খদ্দেরকে। এরকমই একটা অলিখিত ব্যবস্থা করে নিয়েছে পাগলি। নিজের দুটো বিস্কুট থেকে একটা দিতে হয় মানসকে, চা-বিস্কুট নিজে এবং পোষ্যকে খাওয়াতে থাকল পাগলি। মানস উঠে যায় প্ল্যাটফর্মে। বসে থাকলে পাগলি আরও বিস্কুট চাইত। খিদের থেকেও চাকরিটা এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মানসের টেনশান হচ্ছে, সেনগুপ্তবাবু না চলে যান। মায়ের অন্ত্যেষ্টির দু’দিন পর পাশের বাড়িতে ফোন করেছিল অনিমেষদা। মানসদের ফোন নেই। পাশের সামন্তরা ডেকে দিতে বিরক্ত হয় না। ওদেরও বাজার দোকান প্রয়োজনমতো করে দেয় মানস। অনিমেষদা ফোনে বলে, পরশু চলে আয়। চাকরির একটা খবর হয়েছে।

মানস বলেছিল, এই ড্রেসে কী করে যাব। মায়ের কাজটা মিটুক তারপর…

ধুর বোকা! ওই ড্রেসটাই এ সময় কাজে দেবে। চাকরি নাইটি পার্সেন্ট হয়ে গেছে ধরে নে। বাকি টেন কনফার্ম করবে তোর ওই পোশাক। কিছু মনে করলি না তো?

না না, মনে করার কী আছে! বলেছিল মানস। একই সঙ্গে অনুভব করেছিল, মরে যাওয়ার পরেও মায়ের অবদান, এই শোক পরিধানও কত দামি মানসের জীবনের

এবারের চাকরিটার ক্ষেত্রে অনিমেষদা এত শিয়োর কী করে হচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে না।

ফোনে যতটুকু বলেছে, বড় একটা ওষুধ কোম্পানির ডিলার এবং ডিস্ট্রিবিউটার সেনগুপ্ত

বাবু। ওঁর অফিসের নাম আর এস এন্টারপ্রাইজ। মুম্বাইয়ে একটা ব্রাঞ্চ আছে। ভদ্রলোক পালা করে কলকাতা-মুম্বাইয়ে থাকেন। মানসের চিন্তা হচ্ছে, লোকটা মুম্বাইয়ে না ঠেলে দেয়। দিলে অবশ্য কিছু করার নেই, যেতে হবে।

এ গলি, সে গলি ধরে অনিমেষদা এগিয়ে যাচ্ছে। মানস অনুসরণ করে চলেছে মাত্র। ধর্মতলার গলি টলি সে বিশেষ চেনে না। পাশে হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষকে বলে, তুমি কীভাবে আঁচ করছ চাকরিটা হয়ে যাবে। বলছ, নাইনটি পার্সেন্ট চান্স, ওদের কি এক্ষুনি কোনও লোকের দরকার?

ঠিক এক্ষুনিই কিনা জানি না। তোদের ওখান থেকে ফেরার পর ওঁরই কাজে দেখা করেছিলাম। সেনগুপ্ত আমার বড়সড় ক্লায়েন্ট। তখনই বলেছিলাম তোর কথা। প্রথমে বলল, কলকাতার অফিস ছোট। বারোজনে দিব্যি কাজ চলে যাচ্ছে। আমার সব স্টাফই যথেষ্ট এফিশিয়েন্ট, বাধ্য হয়ে মুম্বই অফিসের কথা তুললাম। বলল, ওখানে কি বেকার ছেলে কম? ধরে নিলাম হবেই না। তখন সিমপ্যাথি আদায়ের রাস্তা ধরতে হল, বললাম মামি রিসেন্ট মারা গেল। মামাতো ভাইটা হুগলির বাড়িতে একা পড়ে গেছে। রোজগারপাতি প্রায় নেই। দু’-চারটে টিউশান পড়ায়।

তখন জানতে চাইল, হুগলির কোথায় থাকে? বললাম, কানাগড়ে। শুনে বলল, তোমার সঙ্গে ছেলেটার নিয়মিত যোগাযোগ আছে তো? স্বভাবচরিত্র ভাল করে জানো? খুব করে গুণগান করে দিলাম তোর। অবশেষে রাজি হল। বলল, যত তাড়াতাড়ি পারো ভাইকে নিয়ে এসো, কথা বলে দেখি।

নিউমার্কেটটা চেনে মানস। সামনে দিয়ে যেতে যেতে ভাবে, তার সম্বন্ধে যা যা বলেছে অনিমেষদা, এর মধ্যে কোন পয়েন্টটা সেনগুপ্তকে আগ্রহী করে তুলল, মা মারা যাওয়া গরিব হয়ে যাওয়া, গ্রামে থাকা নাকি ক্যান্ডিডেট সৎ এবং অনিমেষদার ভাই। কোনওটাই তেমন জোরালো মনে হচ্ছে না।

অফিসটা ছোট হলেও, বেশ পরিপাটি। সেন্ট্রাল এসি। রিসেপশানে তন্বী। সেনগুপ্তবাবুর আলাদা চেম্বার, পুশডোর ঠেলে ঢুকল অনিমেষরা। কম্পিউটার থেকে চোখ ফেরালেন বছর চল্লিশেকের রমেশ সেনগুপ্ত। বেশ বনেদি, অভিজাত চেহারা। অনিমেষ বলল, স্যার, এই হল আমার মামাতো ভাই।

মানসের পোশাকের কারণেই বোধহয় সেনগুপ্ত সাহেবের মুখে অপ্রতিভ ভাব। বললেন, বসো, বসো।

গদগদ ভঙ্গিতে অনিমেষ টেবিলের এপারের চেয়ারে বসে। ডেকে নেয় মানসকে। সেনগুপ্ত বলেন, তুমি ওকে এই অবস্থায় নিয়ে এলে কেন? শ্রাদ্ধের কাজ সেরে একেবারে আসতে পারত।

না, মানে। আপনি বলেছিলেন আর্জেন্ট আছে…। বলল অনিমেষ

কী একটু চিন্তা করলেন সেনগুপ্ত। হয়তো ভেবে নিলেন, সত্যিই আর্জেন্ট বলেছিলেন কিনা। এবার মানসকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কী পড়াশোনা করেছ?

কমার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছি। বলল মানস। গুড। তার মানে অ্যাকাউন্টসের কাজ পারবে। পারব স্যার। প্রথমে একটু দেখিয়ে দিলে…

কথার মাঝে সেনগুপ্ত বলেন, স্যালারি কত এক্সপেক্ট করছ? উত্তর দেয় অনিমেষ, ও কী বলবে স্যার, আপনি যা ভাল বুঝবেন, দেবেন।

মানস বুঝতে পারে চাকরিটা প্রায় হয়ে যাচ্ছে। এত সহজে। স্বপ্ন দেখছে না তো? রমেশ সেনগুপ্ত বলেন, বছরের অনেকটা সময় আমি মুম্বইয়ে থাকি। কোম্পানিকে নিজের মনে করে নিয়ে কাজ করতে হবে। এখানে সবাই তাই করে।

বাধ্য স্কুল-ছাত্রের মতো ঘাড় হেলায় মানস। সেনগুপ্ত ফের বলেন, আপাতত তিন হাজার নিয়ে শুরু করো। কাজ স্যাটিসফ্যাকট্রি লাগলে বাড়বে। ঠিক আছে?

মানস ঘাড় হেলাতে ভুলে যায়। তথাকথিত মালিক সম্বন্ধে তার ধারণাই পালটে যাচ্ছে, এত ভদ্র প্রাইভেট কোম্পানি ওনার এখনও হয়! সকালে আজ কার মুখ দেখে উঠেছে মানস? দ্রুত ভাবতে থাকে। একটু নার্ভাস হয়ে আছে বলে হয়তো মনে পড়তে চাইছে না। বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় এসেছিল, দিনের প্রথমে কাক দেখে। ওটাকে রোজ বাসি রুটি দিত মা। কাকের পর সকালে আর কারুর মুখোমুখি হয়নি। চাকরিটার চিন্তায় মগ্ন ছিল। চানটান করে সোজা হাবুদার চায়ের দোকান। হাবুদার দিকে না তাকিয়েই চায়ের অর্ডার দেয়।

হুগলির কোথায় যেন থাকো? প্রশ্ন সেনগুপ্তবাবুর। মানস বলে, কানাগড়ে। একটু গ্রাম সাইডে।

হুগলির আগের স্টেশন তো চুঁচড়ো। বেশ বড় শহর।

হ্যাঁ স্যার, হাসপাতাল, কোর্ট, জেলা সদর অফিস সব আছে। যাওয়া হয় ওদিকে?

যাই স্যার। শহরের দিকে দরকার তো পড়েই।

পিপুলপাতি নামে একটা জায়গা আছে না?

আছে স্যার। হুগলি স্টেশন থেকে কাছে হয়। আপনি কি ওদিকে কখনও গিয়েছিলেন? এটা জানতে চাইল অনিমেষ।

প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে সেনগুপ্তবাবু মানসকে জিজ্ঞেস করলেন, পিপুলপাতি কিন্তু ঐতিহাসিক জায়গা। কেন জানো?

এটা কি ইনফরমাল ইন্টারভিউ? ঠিক বুঝে উঠতে পারে না মানস। বিমর্ষ মুখে বলে, না জানি না। স্যার,

বাংলা ব্যাকরণের প্রথম বই হ্যালহেড সাহেবের ‘A Grammar of the Bengal language’ পিপুলপাতির ছাপাখানায় প্রথম ছাপা হয়। জন অ্যান্ড্রুসের প্রেস ছিল সেটা।

উৎসাহিত হয়ে ওঠে অনিমেষ। বলে, আপনি কী করে জানলেন স্যার।

যেভাবে সবাই জানে। বই পড়ে। বলে, হাসলেন সেনগুপ্ত। মানসের দিকে চোখ ফিরিয়ে

বললেন, যেখানে জন্ম থেকে বসবাস করছ, ইতিহাসটা জেনে রাখা উচিত, তাই না?

নিরীহ ভঙ্গিতে সায় দেয় মানস। চাকরিটা কি কেঁচে গেল? মানস কিন্তু শিয়োর, ওদের এলাকার এইটি পার্সেন্ট লোক এই তথ্যটা জানে না। তারা দিব্যি কলকাতায় এসে চাকরি করে যাচ্ছে।

ঠিক আছে, মায়ের কাজটাজ মিটিয়ে জয়েন করে যাও। আগের দিন আমাকে একটা ফোন করে নেবে কেমন। কথাটা এমন সুরে শেষ করলেন সেনগুপ্ত, ওর মধ্যেই বলা হয়ে গেল, এবার এসো।

মানস, অনিমেষ উঠে পড়ে। গোটা বিষয়টাই অবিশ্বাস্য লাগছে মানসের কাছে। এই বাজারে এরকম অবলীলায় চাকরি হয়? তা হলে এতদিন হচ্ছিল না কেন? কোনও শুভ প্রভাব কাজ করছে কি? মনে পড়ে গেল এলাকার পাগলিটার কথা। ঠিকঠাক বলতে গেলে, ওর মুখটাই আজ স্পষ্ট করে দিনের প্রথমে দেখেছে মানস। পাগলিটা তার মানে বেশ পয়া বলেই মনে হচ্ছে।

পারলৌকিক কাজকর্ম সেরে নেড়া মাথায় অফিস জয়েন করল মানস। স্যার চিনতে একটু সময় নিলেন। অচিরেই তাঁর মুখে ওয়েলকাম এক্সপ্রেশান ফুটে উঠল। নিয়ে গেলেন রায়বাবুর কাছে। রায়বাবু কোম্পানির অ্যাকাউন্টস দেখেন। বস রায়বাবুর সঙ্গে মানসের আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, আজ থেকে আপনাকে অ্যাসিস্ট করবে।

রায়বাবু বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন বস-এর দিকে। চোখে অনেক প্রশ্নও ছিল। সেগুলো অগ্রাহ্য করে চেম্বারে ফিরে গেলেন সেনগুপ্ত। রায়ের প্রশ্নগুলো কিছুক্ষণের মধ্যেই শুনতে হল মানসকে। খানিক থম মেরে বসে থেকে রায় প্রথমে মানসের বায়োডাটা, বাড়ির অবস্থা জেনে নিলেন। তারপর বললেন, কী ব্যাপার বলো তো, তোমাকে হঠাৎ আমার পেছনে জুতে দিল কেন? আমাকে কি এবার তাড়াবে?

কী বলবে ভেবে পায় না মানস। রায় অবশ্য উত্তরের আশায় বসে নেই। বলতে থাকেন, কী এমন কাজ এই অফিসে! হাফবেলায় শেষ হয়ে যায় আমার কাজ, তারপর ব্যাঙ্ক, সেলসট্যাক্স অফিসে ঘোরাঘুরি করি। কোনও কোনও দিন সেসব কাজও থাকে না। ঢুলি বসে বসে।

মানসের মাথায় ঘুরতে থাকে মুম্বাই। এখানে কাজ শিখিয়ে পাঠিয়ে দেবে মনে হচ্ছে। সম্ভাবনার কথাটা মুখে আনে না মানস। আজই অফিস বেরোনোর সময় নিজের হতশ্রী বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ভেবেছিল, মাইনে পেলেই টুকটাক সারাই করে নেবে। বাগানে বাঁশের বেড়া দেবে নতুন করে। বোন জামাইদের বলবে ক’দিন এসে থেকে যেতে। বাড়ির এই হালের জন্য জামাইকে জামাইষষ্ঠীতে ডাকতে লজ্জা পেত মা।

রায়বাবু কাজ কিছুই দেখালেন না। টিফিনটা ভাগ করে খাওয়ালেন। অফিসের নীচে গিয়ে চা খেল দু’জনে। সেই অবসরে রায়বাবু নিজের আর্থিক পরিস্থিতির কথা জানালেন। খুবই টানাটানির সংসার। সাড়ে তিন হাজারে চলে না। ফের একটা ঝাঁকুনি খেল মানস। তার মাইনে তিন ফিক্সড হয়েছে। পাঁচশো টাকা বাঁচাবে বলে একটা কাজ জানা লোককে তাড়িয়ে দেবে কোম্পানি। এটা হতে পারে না। তা হলে কি রায়বাবু কোনও গরমিল করছেন কাজে?

একমাথা চিন্তা নিয়ে মানস হাত গুটিয়ে বসে রইল বিকেল পাঁচটা অবধি। একঘণ্টা পরেই ছুটি৷ ইন্টারকম বেজে উঠল রায়বাবুর টেবিলে। রিসিভার তুলে ওপারের কথা শুনলেন রায়বাবু, ফোন নামিয়ে বললেন, যাও, কর্তা চেম্বারে ডাকছেন।

অজানা আশঙ্কায় বস-এর চেম্বারে যায় মানস। এবার হয়তো জানতে পারবে, কেন তাকে চাকরিতে নেওয়া হয়েছে।

সেনগুপ্ত আগের মতোই হাসিখুশি মুখে বললেন, বসো।

চেয়ারে বসে মানস। বস জানতে চান, কেমন লাগছে কাজ?

লম্বা কথায় যেতে চায় না মানস। আগে বুঝতে হবে, কেন ডেকে পাঠালেন? বলে, ভাল।

বস জিজ্ঞেস করেন, তোমার ওখান থেকে অফিস আসতে কত সময় লাগল? প্রায় দু’ঘণ্টা স্যার।

এতটা দূরত্ব মানসের পক্ষে সমস্যার, বোঝাতে ঠোঁট ওলটালেন সেনগুপ্ত। বললেন, পাড়ায় ফিরে তার মানে আর আড্ডা মারার সময় পাবে না।

প্রসঙ্গটা সেনগুপ্ত কেন তুলেছেন, আন্দাজ করতে পারছে না মানস। কিছু তো বলতেই হয় তাই বলে, আমি আড্ডা তেমন মারি না। কয়েকটা টিউশান করতাম। এবার ভাবছি ছেড়ে দেব।

সে কী, ইয়াং ছেলে আড্ডা মারো না। তোমার বয়সে আমি কত আড্ডা মেরেছি। চুঁচড়োয় ঘড়িমোড়ের কাছে আমাদের ঠেক বিখ্যাত ছিল।

তথ্যটা বেশ অবাক করে মানসকে। বিস্মিত কণ্ঠে বলে, আপনি চুঁচড়োয় থাকতেন? আমাদের এলাকার পাশেই।

ইয়েস। চুঁচড়ায় আমার পৈতৃক বাড়ি। ওখানকার স্কুল কলেজে পড়েছি। এম বি এ করেছি কলকাতায়।

এই সন্দেহটা অনিমেষদা আগের দিন প্রশ্নের আকারে রেখেছিল। সেনগুপ্ত এড়িয়ে গিয়েছিলেন। আজ মানসের সামনে দ্বিধা করলেন না। কেন? মানস জানতে চায়, চুঁচড়োর বাড়িটা কি এখনও আছে?

আছে। তালা দেওয়া। আমারও আর যাওয়া হয় না। অথচ একসময় তোমাদের এলাকাটা বন্ধুরা মিলে সাইকেলে চষে বেড়িয়েছি। তোমাদের কানাগড়ে একটা অন্নপূর্ণা মন্দির আছে না? লোকে বলে খুব জাগ্রত ঠাকুর।

বুকে বেশ একটা বল-ভরসা এসে গেছে মানসের। বস যখন তার এলাকার লোক, চাকরিটা থাকবে মনে হচ্ছে। মানস বলে, ওই মন্দিরটার নতুন করে সংস্কার হচ্ছে এখন। ও, তাই নাকি। আচ্ছা, ওই মন্দিরের চাতালে একটা পাগলি শোয় না?

প্রচণ্ড হোঁচট খায় মানস। এই খবরটা তো জানার কথা নয় স্যারের। পাগলিটা বছর চারেক এসেছে এলাকায়। বস তখন ইয়াং এজ পেরিয়ে গেছেন। প্রথমদিকে পাগলি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিল। লোকে বলত পুলিশের চর। আশেপাশে কোনও বড় অপরাধ চক্র লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই। আর একটা গল্পও চালু হল, বউটার স্বামী বিড়ালের কামড়ে মরেছে।

তাই কোলে বিড়াল নিয়ে ঘোরে। অনেকদিন পর্যন্ত, পাগলির দিকে তাকালে গা ছমছম করত মানসের। ক্রমশ গ্রামের ধুলো কাদায় মিশে এবং মানিয়ে গেল পাগলি। মানস বলে, স্যার পাগলি তো আমাদের এলাকায় বছরখানেক এসেছে। তখন কি আপনারা আড্ডা মারতেন?

না, মারতাম না। আড্ডা ছেড়েছি বছর পনেরো হয়ে গেল। একটু থামলেন সেনগুপ্ত। মানসের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বললেন, ওই পাগলি আমার নিজের পিসি।

ধপ করে অফিসটা যেন ভীষণ নিস্তব্ধ হয়ে গেল, এসি মেশিনের মৃদু আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। খানিক বিরতির পর সেনগুপ্ত বলতে থাকেন, বেশ কয়েকবার হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাড়ি ফিরেছে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে। বাড়ি বলতে চুঁচড়োর কথা বলছি। পিসিকে দেখার মতো নিজের কেউ নেই ও বাড়িতে। কিছুদিন পর আবার বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়।

হঠাৎ চুপ করে গেলেন সেনগুপ্ত। চোখে অনির্দিষ্ট চাউনি। মানস নিজের এক্সপ্রেশান ঠিক কেমন রাখবে, ঠিক করে উঠতে পারছে না। চুলে জট লাগা, নোংরা শাড়ি কাঁথা জড়ানো পাগলিটা যে স্যারের পিসি, মেলাতে পারছে না কিছুতেই।

সেনগুপ্ত চেয়ারের বাঁ পাশ থেকে প্লাস্টিক ক্যারি ব্যাগ মোড়া একটা প্যাকেট তুললেন। মানসের দিকে বাড়িয়ে বললেন, এতে শাড়ি আছে। পিসিকে দিয়ো। জানি, পরবে না। তবু মুড বুঝে দিয়ে রেখো।

মানস প্যাকেটটা নিজের কাছে নেয়। পার্স খুলে কয়েকটা একশো টাকার নোট বার করলেন সেনগুপ্ত, মানসের দিকে এগিয়ে ধরে বললেন, একটু লক্ষ রেখো পিসিকে, ভাল কিছু কিনে খেতে দিয়ো। যদি খাওয়াতে পারো, আরও দেব। সহজে চাকরি পাওয়ার রহস্য মানসের কাছে ক্লিয়ার হয়ে গেল।

বস-এর পিসিকে মিষ্টি চপটপ অল্পবিস্তর খাওয়ানো গেলেও, শাড়িটা পরানো গেল না। ইতিমধ্যে পাঁচদিন কেটে গেছে। রোজ অফিসে এসেছে মানস। রায়বাবু বোধহয় কোনওভাবে বুঝতে পেরেছেন, চাকরিটা এক্ষুনি তাঁর যাচ্ছে না। মানস টেনশানে আছে, এই বুঝি স্যার ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, শাড়িটা পিসি পরেছে কি না? পরেনি শুনলে হয়তো মানসের চাকরিটাই নট হয়ে যাবে।

গত ক’দিন যখনই পাগলিকে একলা পেয়েছে, শাড়িটা দিতে গেছে মানস। মুখ ঘুরিয়ে চলে গেছে সে। মানস পাগলিকে ডেকে ডেকে খাবার দিচ্ছে দেখে, এলাকার মানুষের কপালে ভাঁজ পড়ছে। চায়ের দোকানের হাবুদা তো সেদিন বলেই বসল, কী ব্যাপার রে, চাকরিতে খুব উপরি কামাচ্ছিস নাকি? পাগলিকে খাইয়ে প্রায়শ্চিত্ত করছিস। একথা শোনার পর শাড়িটা সবার সামনে দিতে যায়নি মানস। একলা পেয়েও যখন দেওয়া গেল না, কাল মন্দিরের দালানে ঘুমন্ত পাগলির গায়ে চাপা দিয়ে এসেছে। আজ সকালে অফিস আসার সময় দেখে, সেই শাড়ি ফালা ফালা করে পাগলির গায়ে জড়ানো। সাদা শাড়ির আড়ালে কোলের বিড়ালটাকে আজ প্রায় দেখাই যাচ্ছিল না। মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল মানসের, মা যদি শাড়িটা পেত, খুশি হত খুব। পুজোর সময় আত্মীয়দের দয়া দাক্ষিণ্যে একটা দুটো

অতি সাধারণ শাড়ি পেত মা। পরে দাঁড়াত মানসের সামনে। কিশোরীর মতো হেসে বলত, দেখ তো কেমন লাগছে?… ভাবনায় তলিয়ে গিয়েছিল মানস। রায়বাবু ডাকেন, মানস, সাহেব ডাকছেন তোমাকে। চেম্বারে যাও।

তড়িঘড়ি চেয়ার থেকে উঠে মানস বস-এর ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। রায়বাবুর টেবিলে কখন যে ইন্টারকম বাজল, খেয়ালই করেনি। মানস এখনও ঠিক করতে পারছে না, স্যারকে সত্যি বলবে না মিথ্যে? সত্যি বললে স্যার নিশ্চয়ই খুব রেগে যাবেন।

চেম্বারে ঢুকতেই স্যার চমকে দিলেন। বললেন, কী পরেনি তো শাড়ি?

মিথ্যে বলার প্রস্তুতি নিতে পারল না মানস, দুঃখী মুখ করে মাথা নাড়ে। আরও বড় চমক অপেক্ষা করছিল তার জন্য। স্যার বললেন, শাড়ি ছিঁড়ে খুঁড়ে গায়ে জড়িয়ে ঘুরছে?

বস কি অন্তর্যামী! হ্যাবলার মতো স্যারের দিকে চেয়ে থাকে মানস। বস বলেন, বসো, বসো। এত সহজে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। আজ তোমাকে আরও একটা কঠিন কাজ দেব।

চেয়ারে এসে বসল মানস। এবার আর কোনও পাকেট ফ্যাকেট নয়। একতাড়া নোট এগিয়ে ধরলেন স্যার। বললেন, এতে পাঁচ হাজার আছে পিসিকে যেনতেন প্রকারে এলাকার বাইরে পাঠাতে হবে। আর যেন ফিরে না আসে তোমাদের ওখানে।

তোমাদের ওখানে আমার অজান্তেই মানসের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, কেন স্যার?অনেক বন্ধুবান্ধব রিলেটিভস আছে। তাদের সামনে পিসি ওভাবে ঘুরে বেড়ায়, খারাপ লাগে আমার। তুমি ওঁকে ভুলিয়ে ভালিয়ে লোকাল ট্রেনে উঠিয়ো দিয়ো। অন্য কোথাও গিয়ে ডেরা বাঁধুক। এই কাজটার জন্য তোমাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি দিলাম। এক্সপেনসেস হিসেবে এই টাকাটা রাখো। –

খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা আর পাগলিকে ট্রেনে ওঠানো সমান কঠিন কাজ। খুব ভদ্রভাবে হলেও, চাকরিটা তার মানে গেল। যাওয়ার কারণটা অনিমেষদাকে বলা যাবে না। বোঝাই যাচ্ছে যে দায়িত্বটা স্যার দিলেন, এটা গোপন রাখাও এ কাজের প্রধান শর্ত!

আমি যা টাকার বান্ডিলটা হাতে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে বসেছিল মানস। স্যার বললেন,

বললাম, বুঝতে অসুবিধে হয়নি তো?

মাথা নেড়ে মানস বলে, আমি চেষ্টা করব স্যার।

চেষ্টা নয়। পারতেই হবে তোমাকে। শুকনো মুখে

চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে মানস।

পনেরো দিন হয়ে গেল, মানস আর অফিস যায় না। ছেড়ে দেওয়া টিউশনিগুলো ফিরে এসেছে। ছাত্র বেড়েও গেছে দুটো। সন্ধেবেলা বাড়িতে এখন তাদেরই পড়াচ্ছে। পাঁচ হাজার থেকে মাত্র চারশো টাকা খরচ হয়েছে। একদিন ভরদুপুরে পাগলিকে রিকশাওলার সাহায্যে ওঠাতে পেরেছিল রিকশায়। রিকশাওলার সঙ্গে চুক্তি হয়, যতদূর পারে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে আসতে। যা টাকা লাগে মানস দেবে। মিনিট কুড়ির বেশি পাগলি স্থায়ী হয়নি। রিকশার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে নেমে গেছে। রিকশাওলা গুনাগার নিয়ে গেছে দেড়শো টাকা। বাকি আড়াইশো খরচ হয়েছে পাগলিকে খাওয়াতে। ইদানীং খাওয়ার একটা ঝোঁক হয়েছে।

টাকা স্টেশন রাস্তার ঘোষ সুইটস-এ তার জন্য জিলিপি এখন বাঁধা। পাগলি যে ক’টা খাবে, দেবে মানস। একদিন পাগলির সামনে থেকে মানস জিলিপির ঠোঙাটা নিয়ে নেয়। এগিয়ে যায় স্টেশনের দিকে। পেছন পেছন আসছিল পাগলি। প্ল্যাটফর্মেও উঠল। ট্রেন এসেছিল তখনই। মানস উঠে পড়েছিল কম্পার্টমেন্টে, পাগলি উঠল না, ইশারায় বারবার ডাকল মানস। দৌড়ে পালিয়ে গেল বস-এর পিসি। মানস নামল পরের স্টেশন ব্যান্ডেলে। এর থেকে সুবিধেজনক পরিস্থিতি মানস তৈরি করতে পারেনি। পারবেও না। তাই ঠিক করেছে, খরচ হয়ে যাওয়া চারশো টাকা কোনওমতে জোগাড় করে, সেনগুপ্তবাবুকে পুরো টাকাটাই ফেরত দিয়ে আসবে। একথাও বলে আসবে, এই চাকরি তার পছন্দ নয়।

ছাত্ররা একে একে ‘আসি স্যার’ ‘মাস্টারমশাই আসছি’ বলে, চলে যাচ্ছে। রাত আটটা বাজতে চলল। আজ আর বেরোবে না মানস। কয়েকদিন ধরে বেরোচ্ছিল। পাগলি অন্নপূর্ণা মন্দিরে শুতে আসছে কিনা দেখতে। কিছুদিন হল দেখা যাচ্ছে না তাকে। আবার যেকোনওদিন ফিরে আসতে পারে।

মেঝে থেকে মাদুর গুটিয়ে দরজার কোণে রাখে মানস। রান্নাঘরে গিয়ে ভাত চাপাবে কিনা ভাবে। রুটি তৈরি তার ঠিক আসে না। বাইরে হোটেলেও খেয়ে নেওয়া যায়। আসলে মায়ের বাসন কোসন নাড়াচাড়া করতে ভাল লাগে। যেন সাড়া পাওয়া যায় মায়ের।

রান্নাঘরে ঢুকতে যাবে, গাড়ির আওয়াজ পায় মানস। মনে হচ্ছে তাদের বাড়ির সামনে এসেই দাঁড়িয়েছে। তার কাছে কে আসবে গাড়ি নিয়ে? ইট-ছ্যাতরানো ভাঙাচোরা রাস্তা, রিকশাই ঢুকতে চায় না।

সদরে এসে দাঁড়ায় মানস। গাড়ি থেকে নামতে দেখল বস-কে। খুব একটা অপ্রত্যাশিত দৃশ্য হয়তো নয়, তবু ভীষণ অপ্রতিভ হয়ে পড়ে মানস।

মুখে ক্ষমাসুন্দর হাসি নিয়ে বারান্দায় উঠে এলেন স্যার। বললেন, কী ব্যাপার, একদম ডুব মেরে দিলে যে।

মাথা নিচু করে মানস বলে, না, আসলে এখনও…

জানি কাজটা করতে পারোনি। তবু ফোনে যোগাযোগ রাখবে তো আমার সঙ্গে। আরও কিছু প্ল্যান দিতে পারতাম। এর উত্তর অবশ্য আছে। ফোনে কাজের রিপোর্ট করতে স্যার বলেননি। সেকথা খেয়াল না করিয়ে মানস বলে, ভেতরে আসুন না স্যার।

সেনগুপ্ত আর মানস এখন কানাগড়ের আলো অন্ধকার রাস্তায়। স্ট্রিট ল্যাম্প জ্বলছে অনেক দূর অন্তর। কয়েকটা ল্যাম্পপোস্ট তো বড় গাছের আড়ালে চলে গেছে।

গাড়ি রইল মানসের বাড়ির সামনে। স্যারকে নিজের হাতে চা করে খাইয়েছে মানস। বস-এর এখানে চলে আসার উদ্দেশ্যটাও জানা গেছে, উনি স্বীকার করেছেন। মানসকে দেওয়া কাজটা মোটেই সহজ নয়। মাস পেরিয়ে বছর অবধি টাইম লাগতে পারে। ততদিন মানস অফিস যাবে না, অবাস্তব শর্ত। মানস কাজে আসুক এটাও যেমন বলতে এসেছেন, চোখের দেখা একবার দেখতেও এসেছেন পিসিকে।

মানস বলেছে, ক’দিন হল এলাকায় আপনার পিসিকে দেখা যাচ্ছে না। মন্দির তলাতেও শোন না ইদানীং।

স্যার বললেন, তাও চলো, একবার ঘুরে আসি অন্নপূর্ণা মন্দির থেকে। স্টুডেন্ট লাইফে অন্নপূর্ণা মাকে খুব মানতাম জানো তো। সবাই বলত, ভীষণ জাগ্রত দেবী। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগের দিন চুঁচড়ো থেকে প্রণাম করে যেতাম।

রাস্তায় লোক চলাচল প্রায় নেই। গ্রাম সাইড বলে সন্ধে থেকেই ফাঁকা হয়ে যায়। দূরে অন্নপূর্ণা মন্দিরের আলো দেখা যাচ্ছে। চূড়োতে লাল টুনি বাল্ব। মানসের একটা জিনিস ভেবে ভাল লাগছে, এমনিতে সেনগুপ্তবাবুর সঙ্গে বিত্তে, পদমর্যাদায় তার কত তফাত, জন্মভূমি এক জায়গায়। মানুষটা আশ্চর্য নিরহংকারী অবলীলায় হেঁটে যাচ্ছেন মানসের সঙ্গে… ভাবনার মাঝেই মানসের দৃষ্টি হোঁচট খায় সামনের দৃশ্যে। এ কী দেখছে সে! ফিট দশেক দূর দিয়ে আড়াআড়ি রাস্তা ক্রস করছে বিড়াল পাগলি, স্যারের দেওয়া শাড়িটা এখন আরও ছেঁড়াখোঁড়া কোলে বিড়ালও আছে। যেতে যেতে একঝলক দেখল মানসদের।

মানস বসকে ডেকে দেখাতে যাবে, উনি পাশে নেই। কোথায় গেলেন? পেছন ফেরে মানস, বস-এর পা আটকে গেছে রাস্তায়। চোখ অনুসরণ করছে পাগলি পিসিকে।

রাস্তার পাশের গাছপালায় মিশে গেল পাগলি। মানস বস-এর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে, গাড়িটা নিয়ে আসলে ভাল হত স্যার। দু’জনে ধরে বেঁধে তুলে নিতে পারতাম।

মাথা নাড়েন সেনগুপ্ত। বলেন, আগেও চেষ্টা করেছি। লাভ হয়নি। আঁচড়ে কামড়ে নেমে গেছে। মানসিক হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কলকাতার বাড়িতে রেখেছি। ফাঁকতালে পালিয়ে এসেছে এই এলাকায়। পাগল হয়ে গেলেও নিজের অঞ্চলটাকে ভুলতে পারেনি মা।

ভেতর ভেতর কেঁপে উঠলেও বাইরে সেটা বুঝতে দেয় না মানস। সে একশোভাগ নিশ্চিত, ‘মা’ শব্দটা ভুল শোনেনি। বে-খেয়ালে স্যারের মুখ থেকে সত্যিটাই বেরিয়ে গেছে।

সেনগুপ্ত ঘুরে গিয়ে হাঁটতে থাকেন। মানসও আর বলে না, মন্দিরটা একবার ঘুরে যান। একটু আগে জাগ্রত দেবী মিলিয়ে গেছেন অন্ধকারে।

অলক্ষ্যে আশীর্বাদ করছেন সন্তানকে।

ইহ দিল্লি পুজোসংখ্যা ২০০৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *