মা কালীর মূর্তি রহস্য

মা কালীর মূর্তি রহস্য

এই জীবনে দুটি পথ। ভোগের পথ। ত্যাগের পথ। মানুষ গুরুকৃপা, শাস্ত্রকৃপা বা তপস্যাবলে শুদ্ধ না হলে ত্যাগের পথের মহিমা বুঝতে পারে না। ভোগের পথে মানুষের মন জগতের দিকে থাকে। মন জগতের নানা জিনিস অহরহ কল্পনা করে। তা কাছে পেলে সুখে এবং আনন্দে থাকবে ভাবে। কিন্তু ভোগ্যবস্তু কিছু ব্যবহার করলেই মনটা আবার শূন্য হয়ে যায়। দিনকতক খুব করে রসগোল্লা খেলে আর মিষ্টি ভালো লাগে না। তখন আলুর দম খোঁজে। মন নিত্য নতুন বৈচিত্র্য চায়। সুখ খোঁজে। এর যেন কোনো শেষ নেই। অধিকাংশ মানুষ এভাবেই জীবন কাটিয়ে দেয়।

তবে যদি ভোগমুখী মনে বিচার ওঠে তাহলে চিন্তার পরিবর্তন হয়। মনে বিচার ওঠে কেন? আঘাত ও দুঃখ বেদনার কারণে। আঘাতের পর আঘাতে হৃদয়ে যন্ত্রণা অনুভব হয়। মিথ্যা অভিনয়টা তখন ভালো লাগে না। ঈশ্বরচিন্তাবিহীন সংসারটা তখন কেবল স্বার্থপূরণের ক্ষেত্র বলে বোধ জন্মায়। আর মনে মনে উপলব্ধি হয় যে, সংসারে সকলের অন্তরে বেদনার ভার। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে কমবেশি সকলেই দুঃখ-দুর্দশায় জর্জরিত। সবাই ভয়, লজ্জায় ও উদ্বেগে সংকুচিত। অনেকের কাছেই বেঁচে থাকাটা বিড়ম্বনা। কেউ কেউ মৃত্যু কামনা করে। কারও জীবন এত যন্ত্রণাময় যে কাতরপ্রাণে দিনরাত যাপন করছে। সমাজের চারিদিকে দুঃখ, বঞ্চনা, বেদনা, না পাওয়ার হতাশা, পীড়নের হাহাকার—এত দুঃখ-দুর্দশা অধর্মের মধ্যে কে মানসিক স্থিরতা ও শান্তি বজায় রাখতে পারে? সাধক রামপ্রসাদ সংসারের এমন ভাব স্ব-চক্ষে দেখে গেয়ে উঠলেন—

অপার সংসার, নাহি পারাপার।

ভরসা শ্রীপদ, সঙ্গের সম্পদ, বিপদে তারিণী, করগো নিস্তার।

যে দেখি তরঙ্গ অগাধ বারি, ভয়ে কাঁপে অঙ্গ, ডুবে বা মরি,

তার কৃপা করি, কিঙ্কর তোমারি, দিয়ে চরণ-তরী, রাখ এইবার।

বহিছে তুফান নাহিক বিরাম, থর থর অঙ্গ কাঁপে অবিরাম,

পূরাও মনস্কাম, জপি তারানাম, তারা তব নাম সংসারের সার।

কাল গেল কালী হল না সাধন, প্রসাদ বলে গেল বিফলে জীবন,

এ ভব বন্ধন, কর বিমোচন, মা বিনে তারিণী কারে দিব ভার।।

রামপ্রসাদ বললেন, এমন ঘোর সংসার মোহে মনটা জর্জরিত—এই মহামূল্যবান মন কাকে দেব? নানা বিচার বিবেচনার পর তিনি মায়ের চরণেই মনটা সমর্পিত করলেন। আর যেই ধীরে ধীরে মনটা মাকে দিতে লাগলেন অমনি মায়ের সঙ্গে তাঁর লুকোচুরি খেলা শুরু হয়ে গেল।

তখন জীবনের অনেকটা পথ সাধক পার করে এসেছেন। সর্বদা জগজ্জননী শ্যামা মায়ের নাম গুনগান করে কেটে যাচ্ছে দিনরাত। সংসার করেছেন অনেকদিন হল। দুটি কন্যাও বেশ বড় হয়ে উঠেছে। মেয়ে দুটিও মায়ের মতো সাধক বাবার পরম প্রিয়। অভাবের সংসার, কিন্তু সকলেই আনন্দে ভাসছেন। শ্যামা মা ফিরে চেয়েছেন কিনা! রামপ্রসাদের মুখকান্তি অপরূপ। কী দিব্য কমনীয় রূপ সর্বাঙ্গ—কী স্নেহপূর্ণ আঁখিযুগল! এক স্বর্গীয় জ্যোতি সর্বাঙ্গে খেলা করে যায়। যে দেখে সেই অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।

সাধকের অবশ্য জগৎ জীবন সম্বন্ধে কোনো হুঁশ নেই। তিনি মাতৃনামে, মাতৃপ্রেমে মাতোয়ারা। গদগদ চিত্ত। এ সংসারে ডরি কারে, রাজা যার মা মহেশ্বরী/আনন্দে আনন্দময়ীর খাস তালুকে বসত করি—এমনই তাঁর সর্বক্ষণের মনের ভাব।

তবে ‘রাজার খাস তালুক’ হালিশহর তখন জঙ্গলে ঘেরা। প্রসাদের ভিটেটা তখন ছিল অতীব নির্জন। বৃক্ষ-লতায়-বনফুলে পরিপূর্ণ চারদিক। তারই মধ্যে বেড়া দেওয়া ঘরে মায়ে-ছেলের একান্ত বাস। হাসি-কান্না-আনন্দ-আহ্লাদ সর্বক্ষণ। লোকসঙ্গ বর্জনকারী মাতৃসাধকের তখন কিছুই ভালো লাগছে না। কেবল মা-মা আর মা, মা—দেখা দাও, দেখা দাও মা—বলে দিনরাত আকুল প্রার্থনা। এরই মধ্যে উদভ্রান্ত প্রসাদ একদিন দেখলেন—ঘরের বেড়াটি ভেঙে পড়েছে। ভালো করে না বেঁধে দিলেই নয়। কিন্তু অর্থাভাব। তেমন বাঁশ বা অন্যান্য ভালো জিনিস দিয়ে যে শক্ত করে বেড়াটি বাঁধবেন তারও সামর্থ্য নেই। আর এটা ফেলে রাখারও কিছু নয়। বাড়িতে গৃহিণী, মেয়েরা বড় হয়েছে। তাই ছোটো মেয়ে জগদীশ্বরীকে একদিন সকালে ডেকে নিয়েই রামপ্রসাদ বেড়া বাঁধতে লেগে গেলেন।

—বাবা! তুমি বেড়ার ওদিকে যাও, আমি এদিকে বসে তোমায় দড়ি গলিয়ে দিচ্ছি। দেখছ বাবা—বেড়ার গাছগুলি কেমন সুন্দর সতেজ ও ঘন হয়ে উঠেছে? জগদীশ্বরী বললে।

—তাই তো মা। সবই মার কৃপা।

বাপ-বেটি বেড়া বাঁধার কাজ করছেন গল্প করতে করতে। কন্যা জগদীশ্বরী অল্প বয়সের বালিকা। সামান্য চঞ্চলা। কখনও বাপের কথা, কখনও আনমনা। বেড়ার অপর পাশে থেকে দড়ি গলিয়ে দিচ্ছে বাবাকে। অনেকক্ষণ এভাবে চলছে। হঠাৎ কী মনে হতে ছোটো কন্যা বাড়ির ভিতরে দিদির কাছে গেল। বহুক্ষণ ফিরল না। আপন ভোলা। মায়ের লীলা আর কী! এদিকে বেড়া বাঁধা যথারীতি চলছে। কাজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। জগদীশ্বরী বেড়া বাঁধার কাজ যেখানে শেষ করে হঠাৎ উঠে গিয়েছিল, ফিরে এসে দেখলে যে, কাজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। কী করে এমন হল! আকাশ থেকে পড়ল মেয়ে। বিস্ময়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করে বসল—বাবা! এতদূর কী করে এগোলো? তোমায় দড়ি কে গলিয়ে দিলে, বাবা?

—কেন! তুমি-ই তো দিলে মা। বিস্ময়ে রামপ্রসাদ বলল।

—না বাবা! আমি তো অনেকক্ষণ এখানে ছিলাম না। দিদির কাছে ঘরে গিয়েছিলাম। একটু খেলছিলাম।

—সে কী বলছ মা! তুমি ছিলে না?

—না, বাবা।

কিন্তু এখানে যে আর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। তবে কি বেটি স্বয়ং এসে এই কাজ করে গেল! ভাবতে ভাবতে মাতৃপ্রাণ সাধকের দু’চক্ষু অশ্রুতে ভরে উঠল। অভিভূত হয়ে পড়লেন তিনি। কৃতজ্ঞতায় হৃদয়খানি উঠল ভরে। মেয়ে দেখল বাবার দু’চোখে জল টপ-টপ করে মাটিতে পড়ছে, গাল ভেসে যাচ্ছে। কাজকর্ম ফেলে আবেগে বাবা তখন গেয়ে উঠল—

মন কেন মায়ের চরণছাড়া।

ও মন, ভাব শক্তি, পাবে মুক্তি, বাঁধ দিয়া ভক্তি-দড়া।।

নয়ন থাকতে দেখলে না মন, কেমন তোমার কপাল পোড়া।

মা-ভক্তে তনয়া রূপেতে বেঁধে গেলেন ঘরের বেড়া।

চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে দু’গাল। তবু প্রসাদ গেয়ে চলেছেন অপরূপ মাতৃসঙ্গীত। কণ্ঠে যেন সুধা ঝরছে। সাধক গাইছেন—

ভাব কি ভেবে পরান গেল (মায়ের)

(যাঁর) নামে হরে কাল, পদে মহাকাল, তাঁর কেন কালরূপ হল।

কালো রূপ অনেক আছে এ বড় আশ্চর্য কালো,

(যাঁরে) হৃদ্মাঝারে রাখলে পরে হৃদয়-পদ্ম করে আলো।।

নামে কালী রূপে কালী কালো হতেও অধিক কালো,

ও রূপ যে দেখেছে সেই মজেছে অন্যরূপ লাগে না ভালো।।

প্রসাদ বলে কুতুহলে, এমন মেয়ে কোথায় ছিল,

(যাঁরে) না দেখে নাম শুনে কানে মন গিয়ে তায় লিপ্ত হল।।

আপামর বাঙালি এই গান শুনেছেন। গানকে ভালোবেসেছেন। কিন্তু যাঁকে কেন্দ্র করে গান রচনা তার হদিশ তেমন কেউ পায়নি। কয়েকজন মাতৃসাধক ছাড়া। তবে সকলেই মাকে ভালোবাসেন। শ্রদ্ধাভক্তি করেন অন্তর দিয়ে। আমরা বাঙালিরা তো ছোটোবেলা থেকেই—দুর্গাপুজোর পর কালীপুজোর জন্য ছটফট করি। কালী মায়ের প্রতি যেন কমবেশি সকলেই একটা আকর্ষণ অনুভব করি। বিশেষত কালী মূর্তির মধ্যে রয়েছে অপার রহস্য কথা—আর তার অন্তর্নিহিত অর্থ জানতে কার মনে না সাধ জাগে? তাই ভাবুক এবং ভক্ত বাঙালির মনে শৈশবকাল থেকেই প্রশ্ন ওঠে—(১) মা কালী কালো কেন? (২) মায়ের আবির্ভাব কী করে হল? (৩) কেন মা বস্ত্রবিহীন এবং গলায় মুণ্ডমালাধারিণী? (৪) কেন তিনি আলুলায়িত কেশ ও রক্তবর্ণা জিহ্বা ধারণ করে রয়েছেন? (৫) মা কালী কেন শ্মশানবাসিনী? (৬) দেবীর ত্রিনেত্র রয়েছে কেন? (৭) শিব কেন পদতলে শায়িত? (৮) মা কেন খড়গ এবং বরাভয়দায়িনী? (৯) বাংলায় কালীপূজার কে প্রবর্তন করেন? (১০) মা কালীর রূপকল্পনায় এত প্রভেদ কেন? (১১) কালীপূজা করলে কী কী ফল পাওয়া যায়? (১২) সাধকদের সঙ্গে মা কালীর সম্পর্ক কী? (১৩) মা কালী প্রত্যেক মানুষের অন্তরে কি বিরাজ করছেন? ইত্যাদি।

এইসব প্রশ্নের উত্তর সম্বন্ধে অনেকেরই কমবেশি ধারণা আছে, আবার কারও কারও কিছুই নেই। অথচ এসব জানলে মনটা বেশ প্রফুল্ল হয় এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম তথা আধ্যাত্মিক জীবন সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানতে পারা যায়। এটা বলা হয় যে, যে কোনো মানুষের মনই স্থূল রূপের চিন্তার মাধ্যমে ক্রমশ সূক্ষ্মরূপ তথা অরূপের রাজ্যে গমন করে। মা কালীর উপরিউক্ত স্থূলরূপের চিন্তাভাবনা করেও সাধকের মন একইভাবে নিরাকারা মায়ের সর্বব্যাপী অনন্ত রূপের রাজ্যে পৌঁছে যায়। শ্রীশ্রীচণ্ডীতেও দেখি মাতৃতত্ববেত্তা মেধস মুনি মায়ামুগ্ধ রাজা সুরথকে একই কথা বলেছেন। তাঁর মতে, ‘বিশ্বরূপিণী মহামায়া মা চিরন্তন সত্য এবং সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃজনকত্রী। তাঁর উৎপত্তি এবং ধ্বংস নেই—তবে সৃষ্টি রক্ষার জন্য প্রয়োজনানুসারে তিনি রূপ পরিগ্রহ করে আবির্ভূতা হন এবং এই আবির্ভাবকেই তাঁর জন্ম হল বলে মনে করা হয়। বস্তুত তিনিই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়ের কারণস্বরূপী। সৃষ্টির পূর্বেও তিনি বিদ্যমান। জগতের মূলাধার রূপে তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করে আছেন। তবে মধ্যে মধ্যে তিনি অতিমাত্রায় প্রকট হন। উপাসকগণের কার্যে সফলতার জন্য, জগতের সার্বিক মঙ্গলের জন্য এবং আসুরিকভাব তথা দানবদলনের জন্য এক ব্রহ্মশক্তি ভগবতী নানা মূর্তি ধারণ করে থাকেন—”দেবানাং কার্যসিদ্ধ্যর্থমাবির্ভবতি যা যদা।” দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্য দেবীর সময়ে সময়ে এমন প্রকট হওয়া বা আবির্ভাবকেই তাঁর জন্ম হল বলে মনে করা হয়।’ অনন্তস্বরূপিণী ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ প্রদায়িনী—দেবী কালী মূর্তির আবির্ভাবের ঘটনাও এই সত্যের বাহক। তবে আবির্ভাবের পূর্বে বা ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পূর্বে মা কোনরূপে থাকেন? এই প্রসঙ্গে মাতৃসাধক যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ অতি সরলভাবে বলেছেন যে, ‘ব্রহ্মাণ্ড উদরা মা জগদ্ধাত্রী। তিনি ব্রহ্মময়ী সিদ্ধিদাত্রী—শক্তিস্বরূপিণী। নির্গুণ নিরাকার হল ব্রহ্ম, তার তরঙ্গ হল শক্তি। শক্তিতেই এই জগৎ সৃষ্টি হচ্ছে। স্থিতির সম্বল শক্তি। শক্তিই ধারণা। এই শক্তিতেই ব্রহ্মের লীলার প্রকাশ। শক্তির দর্পণে ব্রহ্ম প্রতিবিম্বিত। দর্পণাস্বরূপা শক্তি সহায় না হলে ব্রহ্মতত্ব জানা যাবে না। শক্তি বিরাট—মহাকালী সেই শক্তি স্বরূপা। ঈশ্বর নানাভাবে লীলা করেন। তিনিই মহাকালী, নিত্যকালী, শ্মশানকালী, ব্রহ্মকালী ও শ্যামাকালী। মহাকালী ও নিত্যকালীর কথা তন্ত্রে রয়েছে। যখন সৃষ্টি হয়নি, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ ও পৃথিবী ছিল অস্তিত্বহীন—জগৎ ছিল সুনিবিড় আঁধারে মগ্ন—তখন কেবল ”মা”—নিরাকারা মহাকালী মহাকালের সঙ্গে বিরাজ করছিলেন।’ বস্তুত সংহাররূপিণী মা কালিকা প্রলয়কালে জগতের সমস্ত কিছুকেই আপনার চিন্ময় কোলের মধ্যে নিঃশেষে সংহত করে নেন—’স্ব’ অঙ্গে মিলিয়ে নেন—তখন জীব ও জগৎ সমস্ত কিছুই ‘শব’ রূপ ধারণ করে। এই ‘শব’ হল মহাকালের প্রতীক শিব—যিনি মায়ের পদতলে পড়ে আছেন ব্রহ্মরূপে—নির্গুণভাবে, মহাকাল বা অখণ্ড সময়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে। এই শিবরূপী ব্রহ্মেরই শক্তি হল কালিকারূপী দেবীমূর্তি—যিনি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃতিস্বরূপা মহামায়া মা। যেহেতু ব্রহ্মের লীলাবিলাসের জন্যই শক্তির প্রকাশ হয়েছে সেজন্য ব্রহ্মকে উপলব্ধি করতে গেলে শক্তির আরাধনা অপরিহার্য। অর্থাৎ কারণরূপ পরমাত্মাকে সর্বব্যাপীভাবে উপলব্ধি করতে হলে কার্যরূপা মহাশক্তির তথা কালিকার আরাধনা অবশ্য প্রয়োজন এবং ইনি আরাধনায় তুষ্ট হলে সাধকের অন্তর থেকে মায়া বা অজ্ঞানকে অপসারণ করে দেন তখন সাধক সন্তান পরমব্রহ্মকে লাভ করেন বা ব্রহ্মজ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। এজন্যই বোধহয় রূপকছলে কালীমূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্রহ্মরূপী শিবের বক্ষোপরি ভয়ঙ্করী, করুণাময়ী এবং বরাভয়দাত্রী অত্যন্ত মমতাময়ী কালীমাকে স্থাপন করা হয়েছে।

তবে ‘কালী’ শব্দের যথার্থ তাৎপর্য নিয়েও পণ্ডিতগণের মধ্যে নানা মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। অনেকে বলেন, কালকে নিয়ন্ত্রণ করেন বলে ইনি কালী। কাল হল ধ্বংসের প্রতীকস্বরূপ দেবতা। যাঁর ভালো নাম ‘মহাকাল’। ইনি জগতের সমস্ত কিছুকে সর্বদা অবলীলাক্রমে নিজ মুখগহ্বরে প্রবেশ করিয়ে নিচ্ছেন। এঁর কর্মের কোনো বিরাম নেই। সর্বদা সংহার কার্যে রত। কিন্তু যিনি কালকেও গ্রাস করেন বা নিজ মুখবিবরে নিয়ে নেন—তিনিই হলেন কালী। এটি কী রকম ব্যাপার? আসলে পদার্থের রূপ-আকৃতি-প্রকৃতি থাকলেই কালের ক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু যখন পদার্থ নিরাকার ভাবে থাকে, সুষুপ্ত থাকে—তখন কাল কোথায়? সেই সময় সমস্ত কিছু মহাকালীর কোলে আশ্রয় গ্রহণ করে। এটি হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রসূতের পূর্বাবস্থা—একেবারে জন্মলগ্নের আদি অবস্থা—তাই শাস্ত্রে ‘আদ্যাকালী’ বলা হয়ে থাকে। ‘আদি’ থেকে ‘আদ্য’ শব্দ এসেছে। তবে এই আদ্যাশক্তি কালী এবং শিব এক অভেদ। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘যিনি ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি। তাঁকেই মা বলে ডাকি। যখন তিনি নিষ্ক্রিয় তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলি, আবার যখন সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার কার্য করেন, তখন তাঁকে শক্তি বলি। কালী বলি। যেমন স্থির জল, আর হেলে-দুলেও জল।’

পরমাত্মা নির্গুণ। নিরাকার। শক্তিবিহীন থাকলে সাধারণ মানুষের মতো পরমাত্মাও কোনো কর্ম করতে পারেন না। আমাদের দেহ যেমন প্রাণশক্তির সাহায্যে দেহের রক্তচলাচল, খাদ্য হজম, তাপ নিয়ন্ত্রণ, ক্ষতস্থান জুড়ে নেওয়া প্রভৃতি কাজকর্ম করে, তেমনি পরমাত্মাও তাঁর চৈতন্যশক্তির দ্বারা সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডকে পরিচালনা করছেন। আমাদের জন্মের কোটি কোটি বছর পূর্বেই ব্রহ্মাণ্ডের কয়েকবার সৃষ্টি হয়েছে। স্থিতি হয়েছে। আবার লয় পেয়েছে। কত কত প্রলয় ঘটে গেছে। তার কতটুকুই বা আমরা জানি? তাই আমাদের জন্মাবার আগে থেকেই মায়ের ইচ্ছায় সব হচ্ছে, হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। সেজন্য দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ঘরে তাঁর সম্মুখে হাতজোড় করে সদ্য আগত এক যুবক ভক্তকে তর্ক করতে দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ ধমক দিয়ে বলেছিলেন—

—তুমি জ্ঞানচর্চা ছাড়ো—ভক্তি নাও—ভক্তিই সার! আজ তোমার কি তিনদিন হল?

ব্রাহ্মণ যুবক (হাতজোড় করে)—আজ্ঞা হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ—বিশ্বাস করো—নির্ভর করো—তাহলে নিজে কিছু করতে হবে না। মা-কালী সব করবেন। (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, উদ্বোধন কার্যালয়, ৮৮১ পাতা)

‘মা কালী’ সব করবেন। শ্রীরামকৃষ্ণ যুবক ভক্তকে উপলক্ষ করে সকল মানুষকে বললেন। কিন্তু শর্ত রেখে দিলেন, ‘বিশ্বাস’ এবং ‘নির্ভর’ করতে হবে। মায়ের কাছে সন্তানের মতো থাকতে হবে। ‘আমি’, ‘আমার’ করে অহংকারে বদ্ধ হয়ে লাফালাফি করলে চলবে না। এসব ব্যাপারে সচেতন করেই সাধক কবি রামপ্রসাদ বলেছেন—’সকলি তোমার ইচ্ছা/ইচ্ছাময়ী তারা তুমি/তোমার কর্ম তুমি কর মা,/লোকে বলে করি আমি।’ পূর্বে মেধস মুনিও রাজা সুরথকে বলেছিলেন—’বিশ্বরূপিণী মহামায়া নিত্য এবং নিখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃজনকর্ত্রী, তাঁর উৎপত্তি নেই, কিন্তু তিনি সৃষ্টি রক্ষার জন্য প্রয়োজন অনুসারে শরীর পরিগ্রহ করে আবির্ভূত হন এবং এই আবির্ভাবকে তাঁর জন্ম বলে মনে করা হয়।’ মা আবির্ভূতা হন। তন্ত্রশাস্ত্রে আছে মা মহামায়া শিবকে কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী এবং কমলা রূপে দেখা দিয়েছিলেন। যা দশমহাবিদ্যারূপে খ্যাত। তাছাড়া অসংখ্য সাধক যুগে যুগে মা মহামায়ার দর্শন পেয়েছেন ভারত তথা এই বাংলার পবিত্র মাটিতে। রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, বামাক্ষ্যাপা, কৃষ্ণানন্দ, রাজা রামকৃষ্ণ, মেহেরের সর্বানন্দ শ্রীশ্রীঠাকুর, ভবাপাগলা প্রমুখ মায়ের গভীর সান্নিধ্য মনে-প্রাণে অনুভব করেছিলেন। আর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস তো কালীময় হয়ে গিয়েছিলেন। কালীময় শ্রীরামকৃষ্ণ। জীবনের যৌবনকালে তিনি মা কালীর পূজা, ধ্যান ও সঙ্গীতে সর্বদা মাতোয়ারা হয়ে থাকতেন। তাঁর অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, মা হলেন সর্বজ্ঞানপ্রদায়িনী, ভক্তি-মুক্তি-মোক্ষদায়িনী। তিনি অসীম ভক্তবৎসলা। পরম করুণাময়ী। স্নেহ নির্ঝরিণী। ভক্তদের বরাভয় প্রদানকারিণী। তাঁর সৌন্দর্য অপরূপ। প্রেমে তিনি উন্মাদিনী। করুণায় রাজরাজেশ্বরী। এই পূর্ণ আনন্দ, পূর্ণ প্রেম, পূর্ণ জ্ঞানের দীপ্তজ্যোতিতে প্রতিষ্ঠিত থেকে মা কালী অফুরন্ত মাতৃকরুণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে চলেছেন। এরূপ মহাসত্য বিশ্বাস করে যারা তাঁকে ডাকবেন—মা-মা বলে আকুল হবেন—প্রেমময়ী মা তার কাছেই ধরা দেবেন। ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ বিতরণ করে সন্তানের আনন্দ বিধান করবেন।

কিন্তু কালীমূর্তি দর্শনে আমাদের মনে এত ভয় জাগে কেন? আসলে ওই মূর্তির পিছনে যে তত্ব আছে তা বুঝি না বলেই। আমরা লক্ষ করেছি মা শবরূপী শিবের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। আলুলায়িত কেশরাশি। জিহ্বা বাইরে প্রলম্বিতা। তা আবার লাল টকটকে। ঊর্ধ্বে বাম হাতে খড়গ। অধঃ বাম হাতে নরমুণ্ড। ঊর্ধ্ব ডান হাতে বর এবং নীচের ডান হাতটি অভয় মুদ্রায় রাখা। কোমরে মানুষের হাতের মালা। গলায় কাটা মানুষের মাথার মালা। তা থেকে রক্ত ঝরছে। বিবস্ত্রা। গায়ের রঙ ঘোর কালো। চোখ দুটি রক্তবর্ণ। ত্রিনেত্র। সাধারণ মানুষজন মা কালীর এই মূর্তি দেখে প্রচণ্ড ভয় পান। তাই কমবেশি সব বাঙালিই ভয়-ভক্তিতে কালী মায়ের ভক্ত। এজন্য বাংলায় কালী ঠাকুরের এবং কালী মন্দিরের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

প্রশ্ন হল—মা কালী কেন এমন ভয়ঙ্করী? হাতে কাটা মুণ্ড কেন? ওটি কার মুণ্ডু? কেন কাটলেন? গলায় কাটা মুণ্ডুর মালা পড়েছেন কেন? হাতে কেন খড়গ? কেন মা বিবস্ত্রা? এসব প্রশ্নের উত্তর এবং ব্যাখ্যা বিভিন্ন সাধক নানাভাবে দিয়েছেন। তা থেকে চিন্তাভাবনা করে এবং কিঞ্চিৎ উপলব্ধি থেকে যা মনে হয়েছে এবার তাই লিখব।

শ্রীশ্রীচণ্ডীতে কালী মায়ের উৎপত্তির কথা লেখা আছে। মা দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করলে দেবতারা আনন্দে দেবীর স্তব-স্তুতি শুরু করেন—

‘দেবী, তুমি অখিল শাস্ত্র বিদিত হবার মেধা,

দুর্গতিনাশিনী, তুমি দুষ্পার ভব পারাপারের তরণী।

কৈটভভারি বিষ্ণুর হৃদয়ে তুমি লক্ষ্মী,

তুমি গৌরী শশিমৌলী মহাদেবের হৃদয়ে।’

………………………………………………

‘ওগো অম্বিকা, তোমার হাতে যেসব অস্ত্র আছে,

তাই দিয়েই আমাদের রক্ষা করো সর্বতোভাবে।’

গুরু বৃহস্পতির নির্দেশে দেবগণ হিমালয় পাদদেশে নানাবিধ ফুল, গন্ধ চন্দন ও ধূপধূনা সহযোগে এভাবে দেবীর স্তব, স্তুতি ও পূজা করছিলেন। এতে জগন্মাতা দুর্গা খুবই প্রসন্ন হয়ে দেবতাদের বর প্রদান করে বললেন—শুধু একবার স্মরণ করলেই তিনি দেবতাদের সমস্ত আপদ-বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। দেবতারা স্বর্গরাজ্যে ফিরে গেলেন। কিন্তু মহিষাসুর বধ হলেও অন্যান্য অসুরদের অত্যাচার আবার শুরু হল। মহাবলে বলীয়ান হয়ে শুম্ভ ও নিশুম্ভ দেবতাদের সমস্ত অধিকার হরণ করে নিল। অসুরদের অত্যাচারে দেবগণ অধিকারচ্যুত ও পর্যুদস্ত হলেন। তখন ভগবতী দুর্গাকে স্মরণ করলেন। দেবীর আবাহনের জন্য সমবেত দেবতারা স্তুতি শুরু করলেন—

তুমি দেবী, মহাদেবী, মঙ্গলদায়িনী শিবা

তুমি প্রকৃতি, শুভদা, তাই তোমাকে নিয়ত স্মরণ করি।

……………………………………………………………..

যে দেবী সর্বজীবে শ্রদ্ধারূপে অবস্থিতা

তাঁকে আমরা নমস্কার করি। …

যিনি সবার ঈশ্বরী ও মঙ্গল করেন সকলের

আপদ ধ্বংস করেন তিনি মঙ্গল করুন আমাদের।

দেবতাদের এইরূপ স্তব শুনে জাহ্নবীতে স্নান-উদ্যতা দেবী পার্বতী জিজ্ঞাসা করলেন—তোমরা এখানে কার স্তব করছ? দেবগণ উত্তরে শুম্ভ ও নিশুম্ভের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা নিয়ে তাঁর সাহায্যের জন্যই স্তব করছে বলায় দেবী সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধাগ্নিতে ফেটে পড়লেন। আবার অসুরদের অত্যাচার! এই বলেই তিনি স্বীয় শরীর থেকে এক পরমা সুন্দরী দেবীর সৃষ্টি করলেন। পার্বতীর শরীর কোষ থেকে সৃষ্ট এই দেবী হলেন অম্বিকা। কোষ থেকে সৃষ্টি করেছেন বলে অম্বিকা দেবীর নাম হল কৌষিকা। কিন্তু অম্বিকা দেবীর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই ক্রোধে দেবী কৃষ্ণ বর্ণ হয়ে যান। এই কৃষ্ণবর্ণ দুর্গা বা কালো গাত্র বর্ণ দুর্গাদেবীই সংসারে কালিকা নামে বহুল পরিচিতি লাভ করেন।

এরপর অম্বিকা দেবী ও কৃষ্ণবর্ণা দুর্গাদেবী অসুরদের শিবিরে গমন করে বীর বিক্রমে যুদ্ধ শুরু করে দেন। শুম্ভ ও নিশুম্ভ তাদের সেনাপতি ধূম্রলোচন নামক অসুরদের ষাট হাজার সৈন্যসহ দেবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লাগিয়ে দিলেন। মহাসমর চলতে লাগল। দেবীদ্বয়ের বিপুল বিক্রমে ক্রমে ধূম্রলোচন, চণ্ড, মুণ্ড, রক্তবীজ, নিশুম্ভ, শুম্ভ সকলে একে একে নিহত হলেন। দেবী তাঁর ভীষণা ভয়ঙ্করা মূর্তিতে অসুরদের নিজ খড়গ দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিতে লাগলেন। কিন্তু রক্তবীজ নামক অসুরের রক্ত মাটিতে পতিত হওয়া মাত্রই মুহূর্তমধ্যে শয়ে শয়ে আবার অসুর সৃষ্টি হয়ে দেবীর সঙ্গে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকে। দেবী তখন জিহ্বা বের করে রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা গলাধঃকরণ করে নেন। এতে রক্তবীজের বংশ ধ্বংস হয়ে যায় এবং অসুররা দুর্বল হয়ে পড়ে। অপরদিকে রক্তপানের ফলে দেবীর জিহ্বা লাল টকটকে রক্তবর্ণ ধারণ করে।

আমরা মা কালীর এই রণংদেহি মূর্তি দেখেই ভয়ে-বিস্ময়ে আপ্লুত হই। মা অসুর নিধন করছেন। অসুর হল কামনা-বাসনার অমার্জিত রূপ। অত্যন্ত কাম, তীব্র ক্রোধ, সর্বদা মিথ্যাচার, অত্যন্ত মোহ, দারুণ লোভ, পাহাড়-প্রমাণ অহঙ্কার, হিংসা, দ্বেষ, দম্ভ প্রভৃতি অশুভ গুণগুলিই হল অসুরদের মনের বৃত্তি। এসব বৃত্তিসম্পন্ন মানুষ কিংবা প্রাণীরা হল অসুর বা আসুরিক জীব। মা কালী এসব আসুরিক গুণাবলিকে ধ্বংস করে সন্তানদের রক্ষা করেন। অসুর নিধন করতে গিয়েই মা ভীষণা, ভয়ঙ্করা। দেবীর হাতে রয়েছে শুম্ভের মাথা। শুম্ভ হল অত্যন্ত লোভ ও কামনার প্রতীক। সে অম্বিকাদেবীকে বিবাহ করার প্রস্তাব পাঠিয়ে ছিল। কিন্তু তার কামমূর্তি মাথা দেবীর হাতে এখন বদ্ধ। দেবীর গলায় নরমুণ্ডগুলি হল অসুরদের মাথা। এই অসুরের মাথাগুলির এক-একটি নাম আছে যেমন—চামর-চঞ্চলতা, চিক্ষুর-কুটিলতা, অসিলোমা-নির্দয়তা, বাস্কল-দম্ভ, বিড়ালাক্ষ-লোভ ও ধূর্ততা, করাল-নিষ্ঠুর, দুর্ধর্ষ-দুর্নীতি, তাম্র-ক্রোধ, অন্ধক-মোহ ইত্যাদি। দেবী খড়গ দিয়ে অসুরদের মাথা ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছেন। অসুরদের মাথা নষ্ট করে দিলে কী রইল? থাকল—দৈব সম্পদ। সত্য-পবিত্রতা-প্রেম-ক্ষমা-দয়া-নম্রতা প্রভৃতি সাত্বিক গুণ। তাই খড়েগর অপর নাম হল জ্ঞানখড়গ। আর একটি হাত অভয় দিচ্ছেন দেব সন্তানদের—যে ভয় নেই—আমি আছি—সতত তোমাদের রক্ষা করব। অসুররা নিধন হয়ে দেবী অঙ্গে মালা হয়ে শোভা ধারণ করেছিল। মায়ের এমন ভীষণ মধুর করুণা প্রকাশ আর কোথাও দেখা যায় না।

এখন প্রশ্ন—মা বিবস্ত্রা কেন? বস্ত্রের প্রয়োজন মনের ভেতর কামনা-বাসনা, লজ্জা, ভয় ইত্যাদি থাকলে। ভারতের বহু মহাপুরুষ শিবস্বরূপ হয়ে বস্ত্র পরেন না। মা কালী স্বরূপত পরমাত্মার শক্তি। শক্তিরূপিণী মা আদ্যাশক্তি। আদিকাল থেকেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রসব করে চলেছেন। এখনও তাঁর সৃষ্টিকার্যের বিরাম নেই। যিনি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্ট করেছেন স্ব-অঙ্গ থেকে—তাঁর আবার লজ্জা কেন? সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ও তিনি তো এক ও অভিন্ন। দেবী বলেছেন—’একৈ বাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা’—এ জগতে আমি ভিন্ন দ্বিতীয় কেউ নেই। তাই আমার আবার বহু কী? যেখানে বহুত্ব বোধ নেই, সেখানে লজ্জা-শরমও নেই। মা কালীর গায়ের রঙ কৃষ্ণবর্ণা। পূর্বেই বলেছি অসুর বধ করতে গিয়ে ক্রোধে তিনি কালো হয়ে গিয়েছিলেন—তাই নাম হয়েছে কালী। তবে শ্রীরামকৃষ্ণ মনে করেন, অজ্ঞানী মানুষের কাছেই কালী কালো, জ্ঞানী বা তত্বজ্ঞের কাছে কালী কালোও নয়—কিছুই নয়। তাঁর মতে, সমুদ্রের জল দূর থেকেই নীল দেখায়, কাছে গিয়ে হাতে নিয়ে দেখ কোনো রঙ নেই। তাই মায়ের স্বরূপ অনুধ্যান করতে গেলে কালো রঙ চোখে পড়ে না। কালো রূপ তখন জ্যোতির্ময় ভাব ধারণ করে। তাই রামপ্রসাদ গেয়েছেন—

‘কাল রূপ অনেক আছে, এ বড় আশ্চর্য কাল,

(যাঁর) হৃদমাঝারে রাখলে পরে হৃদয়পদ্ম করে আলো।’

তবে এটুকু চিন্তা করা যায় যে, দেবীই মহাবিশ্বে এসব করেছেন। সুতরাং যখন কোনো রঙই ছিল না তখন নিশ্চয়ই কৃষ্ণবর্ণেই সমস্ত রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধময় জগতের সংস্কার নিহিত ছিল। মায়ের ত্রিনেত্র হল—বহির্জগৎ, অন্তর্জগতের এবং জ্ঞাননেত্রের প্রতীক। মানুষ-মন স্বাভাবিকভাবে দু’চোখ ভরে বহির্জগৎই দেখে। আনন্দ উপভোগ করে। কিন্তু পুণ্যকর্মের প্রভাবে, সদগুরুর কৃপায়, বিবেক-বৈরাগ্যের প্রভাবে কারও কারও অন্তর্চক্ষু বা জ্ঞাননেত্র উন্মীলিত হয়। জ্ঞাননেত্র উন্মীলনে মনে সদচিন্তার ঢেউ ওঠে। মানুষ ক্রমে ব্রহ্মজ্ঞ হন। কাজেই মায়ের মধ্যচক্ষুটি হল জ্ঞাননেত্র। আবার মা কেন আলুলায়িত কেশধারিণী? আসলে মায়ের স্বরূপ হল অগম্যা, অনির্বচনীয়। তিনি একদিকে মহাবিশ্বরূপে প্রকটিতা যা আমরা দর্শন করি, আবার অপরদিকে তিনি অগম্যা যাঁর সমস্ত স্বরূপ আমরা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না। আলুলায়িত কেশরাশির মাধ্যমে মায়ের অনন্তরূপের একাংশ চিরকালই আমাদের কাছে ঢাকা থাকে—এরকম ভাবনাই প্রকাশ পায়। এজন্যই মহারাজ শিবচন্দ্র গেয়েছেন—

‘যে অবধি যার অভিসন্ধি হয়, সে অবধি সে পরব্রহ্ম কয়

তৎপরে তুরীয় অনির্বচনীয় সকলি মা তারা ত্রিলোকব্যাপিনী।’

মায়ের পদতলে শিবের শব হয়ে পড়ে থাকা নিয়েও অনেক তত্ব রয়েছে। এ সম্বন্ধে একটি গল্পও প্রচলিত আছে। বলা হয়, ধূম্রলোচন, রক্তবীজ প্রভৃতি অসুরদের বধ করতে করতে মা এতই ক্রোধান্বিতা ও উন্মাদিনী হয়ে পড়েন যে, দেবতারা ভীত হয়ে ভাবেন মা বোধহয় এবার সৃষ্টিকেই ধ্বংস করে দেবেন। এমতাবস্থায় দেবীর হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য দেবতারা মহেশ্বরের শরণাপন্ন হয়। তখন ভূতনাথ মহাশ্মশানে শয়ন করে মহাকালীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। অসুর বিনাশে উন্মাদিনী মা ভাবে বিহ্বল হয়ে শিব বক্ষে চরণ রেখে তাঁকে খড়গ দিয়ে আঘাত করতে গিয়ে চমকে ওঠেন। এ যে তাঁরই স্বামী—পতিদেবতা! তৎক্ষণাৎ দারুণ লজ্জা পেয়ে জিভ কেটে তিনি স্থির হয়ে গেলেন। এই রূপকের অন্তরালে যে মহৎ সত্য রয়েছে তা হল সাংখ্য দর্শনের কারসাজি। সাংখ্য মতে, পুরুষ নিষ্ক্রিয়, সৎ, চিৎ ও আনন্দময়। ধীর-স্থির-শাশ্বত ব্রহ্মস্বরূপ। শিব হলেন ব্রহ্মের প্রতীক। তাঁর থেকে কিনা অভিন্ন চিৎ-শক্তি থেকেই সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড উৎপত্তি হয়েছে। জগতের কার্য-কারণ তথা সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় চলছে। মহাকালী হলেন এই চৈতন্যশক্তির প্রতীকস্বরূপা। তাঁর শক্তির আবরণেই বিশ্ববৈচিত্র্যের লীলাবিলাস। তিনি মহামায়া মা। পরমাত্মারূপী শিবের উপর মায়ের এই সংসার লীলার রচনা। তাই ভবসাগর বা সংসার পার হতে গেলে ভবতারিণীর শরণাগত হওয়া প্রয়োজন। মাতৃসাধক শ্রীরামকৃষ্ণ তাই বলেছেন—’তাঁর কৃপা পেতে গেলে আদ্যাশক্তিরূপিণী তাঁকে প্রসন্ন করতে হয়। তিনি মহামায়া। জগৎকে মুগ্ধ করে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। তিনি অজ্ঞান করে রেখে দিয়েছেন। সেই মহামায়া দ্বার ছেড়ে দিলে তবে অন্দরে যাওয়া যায়। বাইরে পড়ে থাকলে বাইরের জিনিস কেবল দেখা যায়—সেই নিত্য সচ্চিদানন্দ পুরুষকে জানতে পারা যায় না।’

এখন প্রশ্ন হল—মা কেন শ্মশানে বাস করতে ভালোবাসেন? এক্ষেত্রে মাতৃসাধক কবি নজরুল ইসলামের গানটির কথা মনে পড়ে যায়। কবি গেয়েছেন, ‘সুখের গৃহ শ্মশান ক’রে বেড়াস মা তুই আগুন জ্বালি/আমায় দুঃখ দেওয়ার ছলে মা তোর ভুবনভরা রূপ দেখালি।’ কিংবা ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা অন্তিমে সন্তানে নিতে কোলে।’ দুটি গানের অর্থ খুবই ভাবব্যঞ্জক ও গভীর। ‘সুখের গৃহ’ কিনা মনের কামনা-বাসনা যা আমরা সর্বদা চেয়ে থাকি। আমার ধন-সম্পদ, অর্থ-মান-যশ, পুত্র-পৌত্রাদি লাভ হোক—এই যে চাওয়া মনে মনে—এটাই হল মনের গভীরে ‘সুখের গৃহের’ স্বপ্ন রচনা করা। কিন্তু যেখানে ‘আমি কেন্দ্রিক’ চাওয়া-পাওয়া সেখানে মায়ের প্রয়োজন তত থাকে না। মা তখন দূর থেকে দেখে হাসেন এবং পুতুলখেলা সত্বার শেষ করার জন্য ‘রোগ-শোক-দুঃখ-যন্ত্রণা-বিশ্বাসভঙ্গ’ সব দেন। ক্রমে ক্রমে মা আঘাত-অপমানে ‘সুখের গৃহের কল্পনা’র মিথ্যার ছলনাগুলি ভক্তসন্তানে জ্ঞাননেত্রে উদ্ভাসিত করেন। ছেলের তখন বিবেক-বুদ্ধি জাগ্রত হয়। প্রাণটা মাতৃময় হয়ে ওঠে। প্রাণ মাতৃময় হলেই সুখের গৃহের খেলাঘরটি ভেঙে যায়, চিত্তে তখন ‘রাগ-দ্বেষ-হিংসা’ পুড়ে শ্মশানর মতো হয়ে যায়। মা এই সময়েই হৃদয়কন্দরে আবির্ভূত হন বা জেগে ওঠেন—’অন্তিম সময়’ বা জীবনের জাগতিকতার অবসানেই মা হৃদয়গুহায় জ্যোতিচ্ছটায় উদ্ভাসিত হন।

মা কালী ভক্ত-সন্তানদের দেখা দেন, কথা বলেন, পথ দেখান—এমন বিশ্বাস কোটি কোটি মানুষ করেন। তাছাড়া, প্রত্যেক মানুষ আবার নিজ নিজ সংস্কার অনুযায়ী দেবীমূর্তি পছন্দ করেন। কেউ কালীঘাটের মা কালীর খুব ভক্ত, কেউ-বা দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর। কেউ দুর্গা, কেউ লক্ষ্মী, সরস্বতী, জগদ্ধাত্রী রূপের মধ্যেও জীবনের দিশা খুঁজে পান। তবে একথা স্মরণ করা প্রয়োজন দেবী একটিই—চৈতন্যশক্তি—মহামায়া মা। সাধকদের সাধনা বলেই ইনি কোনো কোনো স্থান-কাল-পাত্রতে অধিক প্রকাশিতা বা আবির্ভূতা হন। এখন প্রশ্ন, তাঁর কোনো রূপ আরাধনা করলে মানুষের সহজে মনোবাঞ্ছা পূরণ হতে পারে? দেবীভাগবতে পর্বতরাজ হিমালয় দেবীকে এরূপ একটি প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তরে দেবী বলেছিলেন, ‘হে ভূধর! স্থূলরূপে আমি এই বিশ্বে পরিব্যাপ্ত আছি। সেই সকল স্থূলরূপের মধ্যে দেবীমূর্তিই আরাধ্যতমা। কারণ দেবীমূর্তি আশুফল প্রদায়িনী। আমার শক্তিমূর্তি অনায়াসে ফলপ্রদান করে। তুমি তারই আশ্রয় গ্রহণ কর তাহলে মোক্ষফল লাভ করতে পারবে।’

সাধকেরা বলেন, মূর্তির স্থূলরূপ চিন্তা করতে করতে ধ্যান গভীর হলে মূর্তির তত্বগত ধারণা ভক্তহৃদয়ে উদ্ভাসিত হয়। তখন মূর্তির স্বরূপ ও তাৎপর্য তথা শক্তিরূপিণী মায়ের সূক্ষ্মরূপের ধারণা জন্মায়। ক্রমে ক্রমে সূক্ষ্মতম কারণ ও মহাকারণ রূপিণী মহামায়া মায়ের বিরাট রূপের প্রকাশ সাধক হৃদয়ে ধরা পড়ে। এমতাবস্থায় সাধক মাতৃময় হয়ে ওঠেন। ক্রমশ মহাসাধক রূপে তাঁর উত্তরণ ঘটে।

অনেক সময় মা মহামায়া সাত্বিক নরনারীর হৃদয়ে স্বপ্ন রূপে দেখা দেন। একদা ভোর রাতে রানি রাসমণি স্বপ্নে দেখেছিলেন—মা তাকে বলছেন, ‘ওরে তোর কাশী যাবার দরকার নেই। গঙ্গাতীরে একটি সুন্দরমতো জায়গা ঠিক করে মন্দির তৈরি করে আমায় প্রতিষ্ঠা করে পূজা ও ভোগের ব্যবস্থা কর। আমি নিত্য তোর পূজা নেব।’ ঘুম ভেঙে গেল রানির। আকুল হৃদয়ে ‘মা’ ‘মা’ বলে কেঁদে উঠলেন তিনি—হাতজোড় করে বললেন—’তোমার ইচ্ছামতোই কাজ হবে মা, কেবল তোমার চরণে যেন মতি থাকে।’ রানির এই স্বপ্নের ফসল হল দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর মন্দির। জাগ্রতা মা ভবতারিণী। বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থক্ষেত্র।

মহাসাধক রামপ্রসাদের স্নেহময়ী কালীর নাম ছিল মা জগদম্বা। শোনা যায়, মা জগদম্বা মেয়ে হয়ে প্রসাদের বাড়ির বেড়া বেঁধে দিয়েছিলেন। প্রসাদের মাতৃভজন বাংলার সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ বললে কম বলা হয়।

মাতৃকৃপার জন্য যাঁরা আকুল হয়ে জীবনের একটা সময় আত্মহারা হয়েছিলেন এমন দু’জন বিখ্যাত সাধক হলেন সাধক কমলাকান্ত এবং তারাপীঠের বামাক্ষ্যাপা। সাধক কমলাকান্ত জগজ্জননী মাকে অন্তর থেকে এত ভালোবেসেছিলেন যে আমরা তাঁর কল্পনা করতে পারি না। এই অসামান্য সাধক তাঁর হৃদয়-নির্ঝর সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে ইষ্টদেবী মা কালীর পূজা ও আরাধনা করতেন। তাঁর অমৃত মধুর কণ্ঠস্বর শ্রবণে মা কালী তুষ্ট হয়ে দেখা দেন। এছাড়া, তারাপীঠের তারা মা হলেন বামাক্ষ্যাপার আদরের মা। ইনি দেবীকে ‘বড়মা’ বলে ডাকতেন। মা ও ছেলের এমন আত্যন্তিক সম্পর্ক বিশ্ব মানব সমাজে বিরল ঘটনা। অপরদিকে মাতৃসাধক শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন মায়ের কৃপায় মানুষের জ্ঞানের অভাব থাকে না, মূর্খ বিদ্বান হয়, বোবার কথা ফোটে। তিনি জোড় দিয়েই ভক্তদের বলেছেন, ‘হ্যাঁ, তাঁর কৃপা হলে জ্ঞানের কি অভাব থাকে? দেখ না, আমি তো মুখ্যু, কিছুই জানি না, তবে এসব কথা বলে কে? আবার এ-জ্ঞানের ভাণ্ডার অক্ষয়। ও-দেশে ধান মাপে, ‘রাম রাম, রামে রাম’, বলতে বলতে। একজন মাপে, আর যেই ফুরিয়ে আসে, আর একজন রাশ ঠেলে দেয়। তার কর্মই ওই, ফুরালেই রাশ ঠেলে দেওয়া। আমিও যা কথা কয়ে যাই, ফুরিয়ে আসে আসে হয়, মা আমার অমনি তাঁর অক্ষয় জ্ঞান-ভাণ্ডারের রাশ ঠেলে দেন।’

এই বঙ্গের বাঙালিরা কমবেশি মাতৃভাবের সাধক। মার সন্তান হয়ে—মাকে ভালোবেসেই তাদের বারো মাসের তেরো পার্বণ। বাঙালির গৃহ-প্রাঙ্গণে মায়ের আগমন একটার পর একটা হয়েই চলেছে। মা দুর্গা আসেন, তারপর লক্ষ্মী, কালী, জগদ্ধাত্রী, অন্নপূর্ণা, বাসন্তা, সরস্বতী, আরো কত কী! আবার মা কালী কত জায়গায় কত কত ভিন্ন নামে সন্তানের মনোবাসনা পূরণ করছেন। তিনি কোথাও সিদ্ধেশ্বরী, কোথাও করুণাময়ী মা, আনন্দময়ী মা, কোথাও-বা শ্মশান কালী, দক্ষিণা কালী, উগ্র কালী, বুড়ি কালী, মনস্কামনা মা, রক্ষাকালী প্রভৃতি নানা নামে ভক্তদের কৃপা করেন। কালীর পূজা করলে কী হয়? যা চাওয়া যায়, তাই পাওয়া যায়। কালীতন্ত্রে বলা হয়েছে—’সাধক কালিকার পদ পূজা করে আয়ু, আরোগ্য, ঐশ্বর্য, বল, পুষ্টি, বিপুল কীর্তি, কবিত্ব শক্তি, ভোগ ও মোক্ষ লাভ করে থাকে।’ যিনি মা কালীর চরণে নিজেকে সমর্পণ করেছেন এমন সাধকের প্রকৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে কালীতন্ত্রে আরও বলা হয়েছে—

‘মায়ের সাধক অর্থাৎ যিনি দেবীর সম্যক অর্চনা করেন তাঁর মুখে সরস্বতী ও গৃহে লক্ষ্মী সর্বদা বাস করেন। তাঁর দেহে সকল তীর্থ বিরাজিত। কালীসাধক ধনে কুবের তুল্য, তেজে সূর্য সদৃশ এবং বলে বায়ুতুল্য হয়ে থাকেন। ইনি সঙ্গীতে তুন্ধুরু নামক গন্ধর্ব তুল্য, দানে কর্ণ সদৃশ এবং জ্ঞানে দত্তাত্রেয় তুল্য হয়ে থাকেন। যে সাধক দেবী কালিকার সম্যক অর্চনা করেন তিনি শত্রুনাশে বহ্নিতুল্য, মলিনতা নাশে গঙ্গাতুল্য, পবিত্রতায় অগ্নিতুল্য এবং চন্দ্রের ন্যায় সুখদায়ক হন। তিনি সমতুল্য শাসনকারী, কালের মতো দুর্বার গতি, সমুদ্রের মতো গম্ভীর এবং বজ্রের মতো দুর্ধর্ষ হয়ে থাকেন। তিনি বৃহস্পতির মতো বাগ্মী, পৃথিবীর মতো সহিষ্ণু এবং রমণীগণের নিকট কন্দর্পতুল্য বিবেচিত হয়ে থাকেন।’ মায়ের সন্তানগণ, যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদাদেবী, স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ, কাজি নজরুল, ভক্ত রামপ্রসাদ, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র প্রমুখ মহামানবগণ উক্ত তথ্যের সাক্ষ্য প্রমাণ করছেন বললে অত্যুক্তি হয় না। তাই বলা হয়ে থাকে—

‘ন হি কালী সমা বিদ্যা ন হি কালী সমং ফলম।
ন হি কালী সমং জ্ঞানং ন হি কালী সমং তপঃ।’

অর্থাৎ কালীর তুল্য বিদ্যা নেই, কালীর তুল্য ফল নেই, কালীর তুল্য জ্ঞান নেই, কালীর তুল্য তপস্যাও নেই।

আমরা স্নেহান্ধ। কিন্তু অজ্ঞানবদ্ধ জীব কেন? না—আমাদের অন্তরে রয়েছে ভয়ঙ্কর সব চিত্তবৃত্তি। আসুরিক ভাব। নানা কু-চিন্তা, মলিন ধারণা ও কু-কর্মের জন্য মনে তামসিক ভাব বজায় রয়েছে। একটি খারাপ ভাব অর্থাৎ যদি মিথ্যা কথা বলা দমন করা গেল তো ক্রোধ বেড়ে গেল। অহঙ্কার ও দম্ভ এসে গেল। এই শত শত অশুভ মনোবৃত্তি হল চণ্ডীতে কথিত রক্তবীজ। মা কালিকার গলায় অসুরের কাটা মুণ্ডের মালা হল রক্তবীজের হত্যার প্রতীক। দেবী অসুর নিধন করে তাঁর স্বীয় অঙ্গে শত্রুদের মিলিয়ে নিয়েছেন। অঙ্গের আভরণ করে রেখেছেন। অনেকে বলেন, দেবীর গলায় নরমুণ্ডের মালা হল সংস্কৃতের পঞ্চাশটি বর্ণমালার প্রতীক এবং হস্তধৃত নরমুণ্ড নিয়ে মোট একান্নটি বর্ণমালা। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের নাম-রূপ ও বৈচিত্র্য হল মায়ার প্রকাশ। নাম ও রূপকে আশ্রয় করেই জগৎ লীলা চলে। যখন সাধক মায়ের করুণা লাভ করেন তখন স্নেহময়ী মা সাধকের অন্তর থেকে সমস্ত বস্তুর নামরূপ ভাবনা হরণ করে তাঁকে স্বকীয় অসীম সত্তায় বিলীন করে নেন। আবার মা পরমাপ্রকৃতি। সত্ব, রজঃ ও তমো গুণের আশ্রিতা। এই গুণত্রয় অজ্ঞানের বীজ হিসাবে থাকে এবং নামরূপ সৃষ্টি করে কল্পনার জগৎ তৈরি করে। মা কালিকার সাধক দেবীর কৃপায় এই তিন গুণ অতিক্রম করে পরম ব্রহ্মস্বরূপিণী আদ্যাশক্তির রূপাতীত সত্তার উপলব্ধি করে শিবস্বরূপ হয়ে যান।

একজন শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ বলেছেন, কলিযুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং মা কালী হলেন অধিক ফলপ্রদা। তাই কলিযুগে মা কালী হলেন জাগ্রতা দেবী। কুব্জিকা তন্ত্রে ‘দেবী মাহাত্ম্য’ সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ‘কালিকা মোক্ষদা দেবি কলৌ শীঘ্র ফলপ্রদা।’ মুক্তিদায়িনী মা কালীর আরাধনা করলে এ যুগে শীঘ্র ফললাভ করা যায়।

অপরদিকে বাঙালি জীবনে মাতৃসঙ্গীত তথা শ্যামাসঙ্গীতের কদর করে না এমন বাঙালি পরিবার খুব কম আছে। সঙ্গীতের মধ্যে দেবীর প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার ভাব যেমনভাবে ফুটে উঠেছে তা পূজার ক্ষেত্রেও দেখা যায় না। তাই পশ্চিমবঙ্গের আবালবৃদ্ধবণিতা শ্যামাসঙ্গীত শুনে ভাববিহ্বল হয়ে পড়ে এবং মাকে আপন করে পাবার কামনা করে।

এখন প্রশ্ন হল—ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে কালিকা দেবীর পূজা কখন থেকে প্রচলন হয়েছিল? এর উত্তরে মনে পড়ে যায় দেবীর একান্ন পীঠের কথা। ভারতের বিভিন্ন স্থানে সতীর দেহাবশেষের মাধ্যমে দেবীপূজা হয়ে থাকে। সেই একই দেবী নানা স্থানে বিভিন্ন নামে পূজিত হয়ে আসছেন। তাই ভারতবর্ষে শক্তিপূজার ইতিহাস খুবই প্রাচীন। তবে পশ্চিমবঙ্গে দীপান্বিতা কালীপূজার প্রবর্তনে নবদ্বীপের কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের নাম বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়। ইনি ছিলেন ষোড়শ শতকে বঙ্গের একজন বিখ্যাত মাতৃসাধক। আগমবাগীশ মহাশয় দীর্ঘকাল সাধন-ভজনের পর তাঁর ইষ্টদেবীর এক যথার্থ রূপ দর্শনের জন্য মায়ের কাছে আকুল প্রার্থনা করেন। অসীম নিরাকার মাতৃতত্বে তাঁর মনের পরিপূর্ণতা লাভ হচ্ছিল না। আবার গতানুগতিক দেবীর দর্শনেও যেন অন্তরের বিষাদ কাটছিল না। এমতাবস্থায় তিনি সর্বদা মায়ের রূপ কল্পনা করে চলতেন। ব্যাকুলভাবে মায়ের কাছে তাঁর দর্শনের জন্য প্রার্থনা করতেন। অবশেষে এল একদিন গভীর অমাবস্যার রাত। চারদিক নিঝুম অন্ধকার শ্মশানে সামান্য একটি বাতি জ্বালিয়ে তিনি ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন। ধ্যান শেষে ব্যাকুলভাবে দেবীর কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছেন—’হে মা, একটি রূপে আমাকে দেখা দাও। এমন একটি রূপ দাও যা আমার মতো অনেকে পূজা করে তৃপ্তি পাবে।’ দেবী প্রসন্না হয়ে দৈববাণী দান করলেন—’বৎস, তাই হবে, আমার একটি রূপ তুমি জগতে প্রচার করবে। এই মহা নিশার শেষে ভোরে উঠে—যে নারীমূর্তি আগে দেখবে সেই স্মৃতিতেই আমাকে তুমি পূজা কর।’

মায়ের দৈবাদেশ পেয়ে সাধক হৃদয় আনন্দে ভরে গেল। প্রকৃতির নিয়মানুসারে রাত অতিবাহিত হল। ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মেখে মহাসাধক চললেন গঙ্গাস্নানে। কিছুদূর গিয়েই এক অন্ত্যজ শ্রেণির মহিলাকে তিনি দেখলেন। তাঁর গায়ের রঙ কালো। চুল আলুলায়িত। অবিন্যস্তভাবে শাড়ি পরা। দু’হাতের একটিতে গোবরের তাল, অপরটি ঘুঁটে দেওয়ার জন্য উপরে তোলা। মেয়েটি ঘুঁটে দিচ্ছেন। এক পা মাটিতে, অপর পা একটু সামান্য এগিয়ে ঘরের পোস্তায়। একাকী কর্মে নিমগ্ন। এমন সময় একেবারে কাছাকাছি সাধক কৃষ্ণানন্দকে দেখে তিনি লজ্জায় জিভ কাটলেন। তাঁর সমগ্র আদব-কায়দা ও রক্তিম মুখমণ্ডল দেখে সাধক হৃদয়ে বিদ্যুতের শিহরন বয়ে গেল। তিনি এই তো পেয়েছি বলে—’জয় মা’ ‘জয় মা’ করতে লাগলেন। পরে তাঁর মানস কল্পনা মিশিয়ে কালিকা দেবীর মূর্তি তৈরি করালেন। তবে এ কাহিনি নিছক গল্প বলেই মনে হয়। কারণ এই মা কালীর কোনো বস্ত্র নেই। তিনি দিগম্বরী। তবে বস্ত্রপরিহিত কালীও দেখা যায়। শ্যামাকালীর বরাভয়দায়িনী মূর্তি আগমবাগীশ মহাশয়ের দ্বারা বিস্তার লাভ করতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, মা কালী বা যে কোনো দেবীমূর্তি হল নারীস্বরূপা। মেয়েদের মধ্যেই দেবীশক্তির বেশি প্রকাশ। সর্বজনশ্রদ্ধেয় শ্রীমা সারদামণি, আনন্দময়ী মা, গৌরী মা প্রমুখেরা হলেন সাক্ষাৎ দেবীস্বরূপা। শ্রীশ্রীচণ্ডীতেও বলা হয়েছে—’বিদ্যাঃ সমস্তাস্তব দেবি ভেদাঃ/স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু।’ বেদাদি সমস্ত বিদ্যা এবং সৌন্দর্য ও তারুণ্য গুণযুক্ত সকল নারীই হল আপনার বিগ্রহ। নারীমাত্রই ঈশ্বরীয় অংশ। দেবীর সাক্ষাৎ বিভূতি হল জগতের নারীজাতি। তাই দেবীপূজার সার্থকতা তখনই হবে যখন সাক্ষাৎ দেবীরূপিণী মেয়েদের আমরা যথার্থ শ্রদ্ধা করতে পারব। আর মাতৃজাতিকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মধ্যেই জীবনের পূর্ণতা ঘটে। এজন্য কমবেশি সব মহামানবই দেবীমূর্তি স্বরূপা নারীদের চিরকাল শ্রদ্ধা ও প্রীতির আসনে বসিয়ে গেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ আরও একধাপ এগিয়ে সাক্ষাৎ মাতৃশক্তির চরণ পূজা করেছিলেন। তাই মাতৃজাতিকে অবহেলা করে জীবনের দেবত্ব বিকাশ সম্ভব নয়। আর জগতে মা ছাড়া আপনার আছেটাই বা কী? সেজন্যই ঋষি স্তব করেছেন—

‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *