মা ও সন্তান

মা ও সন্তান

সচরাচর হাইকুগুলোতে হিগুরাশি ঝিঁঝিপোকার আগমন দ্বারা শরতের সময়টাকে বোঝায়। সেজন্যেই বোধহয় হিগুরাশি শব্দটা শোনা মাত্র মনের পর্দায় ভেসে ওঠে গ্রীষ্মের শেষ সময়ের ছবি। বাস্তবে কিন্তু গরমের শুরু থেকেই তাদের ঝিঁঝি রবে মুখরিত হয় চারপাশ। আবুরা এবং মিন-মিন প্রজাতির ঝিঁঝিপোকার ডাক শুনে যেমন গনগনে সূর্য এবং তাপদাহের কথা মনে পড়ে যায়, তেমনি হিগুরাশি ঝিঁঝিপোকার সংগীত আমাদের মনে করিয়ে দেয় পড়ন্ত বিকেল এবং গ্রীষ্মের শেষভাগের কথা। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার সাথে সাথে হিগুরাশিদের একটানা ঝি-ঝি-ঝি শুনে বিষণ্ণতায় ছেয়ে ওঠে মন। বাড়ি ফেরার তাড়া অনুভব করে সবাই।

শহরে অবশ্য ইদানীং হিগুরাশি ঝিঁঝিপোকার ডাক শুনতে পাওয়া মুশকিল। হিগুরাশিদের মূলত ছায়ায় আচ্ছন্ন জায়গা বেশি পছন্দ; সূর্যালোকের প্রবেশাধিকার নেই যেখানে। ঝোপঝাড় কিংবা সাইপ্রেস ঝাড় হলে তো কথাই নেই। এই দিক থেকে আবুরা কিংবা মিন-মিন ঝিঁঝিপোকাদের তুলনায় তারা আলাদা। শহরের সীমান্তে মাঝে মাঝে অনেক দূর থেকে ভেসে আসে হিগুরাশিদের ঝিঁঝি ডাক। ফানিকুলি ফানিকুলা ক্যাফেটা বেইজমেন্টে হলেও ভালো করে কান পাতলে খানিকটা শোনা যায় সেই শব্দ।

আগস্টের সেরকমই একটা দিন। বাইরে আবুরা ঝিঁঝিপোকার দল ডেকে চলেছে একঘেয়ে সুরে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে আজ বছরের উষ্ণতম দিন। তবে ক্যাফেটায় কোনো এয়ার কন্ডিশনার না থাকলেও ভেতরের পরিবেশ বেশ ঠান্ডা। নাগারের মোবাইলে হিরাই একটা ই-মেইল পাঠিয়েছে, সেটাই পড়ছিল কায়ু।

দুই সপ্তাহ ধরে তাকাকুরাতে আছি। এত নতুন নতুন জিনিস শিখতে হচ্ছে…ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করে প্রতিদিন।

“বেচারি…ঝামেলাতেই পড়ে গেছে।”

কোহতাকে আর নাগারে মনোযোগ দিয়ে শুনছে কাযুর কথা। কেই কিংবা কায়ু, কেউই মোবাইল ব্যবহার করে না বিধায় ক্যাফের কারো উদ্দেশ্যে কোনো ইমেইল পাঠাতে হলে নাগারের ফোনই একমাত্র ভরসা। কাযু ফোন ব্যবহার করে না কারণ বাইরের কারো সাথে সম্পর্ক রক্ষায় বরাবরই অপটু। তাছাড়া, ফোন জিনিসটা ভালোও লাগে না তার, মনে হয় যেন ব্যক্তিস্বাধীনতায় আঘাত হানছে কেউ। কেই বিয়ের পর ফোন ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছে। তার যুক্তি-” বিবাহিত দম্পতিদের একটা ফোন থাকলেই যথেষ্ট।” অন্যদিকে, হিরাইয়ের মোট তিনটা ফোন। একটা কাস্টমারদের জন্য, একটা পরিবারের সদস্যদের জন্য আর অন্যটা নিজের ব্যক্তিগত কাজের জন্য। পারিবারিক ফোনটায় কেবল বাড়ির ল্যান্ডলাইনের নম্বর আর কুমির নম্বর সেভ করে রেখেছিল সে। তবে এখন নাগারে আর ক্যাফের নম্বর দুটোও যোগ হয়ে তালিকায়। (এই তথ্যটা অবশ্য সে বাদে অন্য কেউ জানে না)। ই-মেইলের বাকি অংশটুকু পড়তে শুরু করলো কায়ু।

মা-বাবার সাথে অবশ্য পুরোপুরি সহজ হতে পারিনি এখনো, কিন্তু ফিরে আসার সিদ্ধান্তটা ঠিকই ছিল। কুমি মারা যাওয়ায় আমরা তিনজনই প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু শুধু এই শোককেই পাথেয় হিসেবে মেনে নিলে চলবে না।

এজন্যেই আমি এখানে এমন কিছু করতে চাই, যা কুমি দেখলে খুশি হতো। আমাদের সবার আনন্দের মাঝেই বেঁচে থাকবে ও, কষ্টে নয়। তোমরা কেউ বোধহয় ভাবতেও পারোনি যে আমার দ্বারা এসব সম্ভব হবে, তাই না?

যাইহোক, আমি ভালো আছি। তোমরা সুযোগ পেলেই চলে আসবে কিন্তু। তানাবাতা উৎসবের সময় এলে বেশি মজা পাবে। এবছর অবশ্য উৎসব শেষ। আগামী বছর চেষ্টা কোরো।

সবাইকে ভালোবাসা জানাবে।

ইয়াইকো হিরাই

রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সব শুনলো নাগারে। ভ্রু-জোড়া কোঁচকানো ক্যাফে মালিকের। পুরো চিঠিটা শোনার পর কপালে ভাঁজের পরিমাণ আরো বাড়লো। মনে মনে ভীষণ খুশি হলে এমনটাই করে সে।

“চমৎকার!” হেসে বললো কোহতাকে। কাজের বিরতিতে ইউনিফর্ম পরেই ক্যাফেতে এসেছে সে, ইউনিফর্ম খোলেনি।

“ছবিও আছে,” ই-মেইলের সাথে অ্যাটাচ করে দেওয়া ছবিটা কোহতাকে’কে দেখালো কায়ু। ভালো করে দেখার জন্য ফোনটা হাতে তুলে নিলো কোহতাকে।

“বাহ! ওনাকে কিন্তু মানিয়েছে ওখানে…” কোহতাকের কণ্ঠে বিস্ময়।

“তাই না?” কায়ুর মুখে উজ্জ্বল হাসি।

ছবিতে সরাইটার সামনে দাঁড়িয়ে হিরাই। পরনে গোলাপি কিমোনো, মাথার চুলগুলো খোপায় বাঁধা। বেশভূষা দেখে যে কেউ দেখে বুঝতে পারবে যে তাকাকুরা সরাইয়ের পরিচালনার দায়িত্ব এখন তার।

“খুশি মনে হচ্ছে ওকে দেখে।”

“আসলেই।”

হিরাইয়ের হাসি হাসি মুখটায় দুশ্চিন্তার কোনো বালাই নেই। ই-মেইলে সে লিখেছে যে বাবা-মা’র সাথে এখনো পুরোপুরি সহজ হতে পারেনি, কিন্তু ছবিতে মা-বাবার মাঝেই দাঁড়ানো সে।

“কুমিও খুশি…” পেছন থেকে উঁকি দিয়ে ছবিটা দেখে বিড়বিড় করে বললো নাগারে।

“হ্যাঁ, সে-ও নিশ্চিত উপর থেকে হাসিমুখে দেখছে সবকিছু,” সায় দিলো কোহতাকে।

শান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো কায়ু। কাউকে অতীতে পাঠানোর সময় সাধারণত মুখটা শক্ত করে রাখে সে। কিন্তু এখন কাঠিন্যের কোনো চিহ্ন নেই সেখানে। বরং কোমল দৃষ্টি খেলা করছে দুই চোখে।

“আচ্ছা, একটা বিষয়,” কায়ুর হাতে ফোনটা ফেরত দিলো কোহতাকে। সাদা পোশাক পরা মহিলার দিকে সন্তর্পণে একবার তাকালো সে। “উনি এখানে কী করছেন?”

কাযু ঠিকমত খেয়াল করে দেখলো যে বই হাতে বসে থাকা ভদ্রমহিলা নয়, বরং ফুমিকো কিয়োকাওয়ার দিকে নজর কোহতাকের। ভদ্রমহিলার ঠিক উলটোদিকের চেয়ারটায় বসে আছে সে।

গত বসন্তে অতীতে পাড়ি জমিয়েছিল ফুমিকো। ক্যাফেতে বেশির ভাগ সময়ই অফিস ড্রেস পরে আসে সে, কিন্তু আজ তার পরনে লম্বা হাতার কালো টিশার্ট আর সাদা লেগিংস। পায়ে কর্ড স্যান্ডেল।

হিরাই ই-মেইলে কী লিখেছে, সেদিকে কোনো আগ্রহ নেই ফুমিকোর। বরং বেশ অনেকক্ষণ ধরেই সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলার চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে সে। কী উদ্দেশ্যে, সেটা একটা রহস্য। কায়ু এই বিষয়ে কিছু জানে না।

“আমিও সেটাই ভাবছিলাম,” বললো সে।

এই বসন্তের পর বেশ কয়েকবার ক্যাফেতে এসেছে ফুমিকো। আর প্রতিবারই ঠিক এই সিটটাতেই বসেছে। হঠাৎই কায়ুর দিকে তাকালো সে। “এক্সকিউজ মি।”

“জি?”

“একটা কথা জানতে চাচ্ছিলাম।”

“বলুন।”

“এই যে সময় পরিভ্রমণের ব্যাপারটা…কেউ কী চাইলে ভবিষ্যতেও যেতে পারবে?”

“ভবিষ্যতে?”

“হ্যাঁ, ভবিষ্যতে।”“

ফুমিকোর প্রশ্নটা শুনে কৌতূহল ফুটলো কোহতাকের চেহারায়। “হ্যাঁ! আমিও জানতে চাই।”

“অতীত কিংবা ভবিষ্যতে যাওয়া-দুটোই তো সময় পরিভ্রমণের অংশ। তাই ভাবলাম এটাও হয়তো সম্ভব হবে,” ফুমিকো বললো।

সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো কোহতাকে।

“আসলেও কী সম্ভব?” আবারো জানতে চাইলো ফুমিকো।

“হ্যাঁ, অবশ্যই সম্ভব,” উত্তাপের ছিটেফোঁটাও নেই কায়ুর কণ্ঠে।

“তাই?” গলার স্বর কিছুটা চড়ে গেছে ফুমিকোর। অতি উৎসাহের চোটে ভদ্রমহিলার কফির কাপে ধাক্কা দিয়ে বসলো সে। কিছুটা কফি ছিটকে পড়লো টেবিলে। কপালে ভাঁজ পড়লো মহিলার। ভয়ে অজ্ঞান হবার জোগাড় ফুমিকোর। দ্রুত টিসু দিয়ে কফিটুকু মুছে নিলো সে। আবারো অভিশাপের সম্মুখীন হতে চায় না।

“বাহ!” ভবিষ্যতে যাওয়া সম্ভব, এটা শুনে কোহতাকেও খুশি।

“কিন্তু কেউ যায় না,” পালা করে দুজনের দিকে তাকিয়ে বললো কায়ু।

“কী?!” ফুমিকো অবাক। “কেন যায় না?” কাযুর দিকে কিছুটা ঝুঁকে এল সে। ভবিষ্যতে যাওয়ার বিষয়টা নিশ্চয়ই আমার একার মাথাতেই আসেনি, ভাবে ফুমিকো। কোহতাকের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সে- ও ভাবছে বিষয়টা নিয়ে। চোখ বড় বড় করে কায়ুর দিকে তাকালো সে।

একবার নাগারের সাথে চোখাচোখি হলো কায়ুর।

“আচ্ছা…যদি ভবিষ্যতে যাওয়ার সুযোগ হয়, তাহলে কত বছর সামনে যেতে চান?”

কায়ু অকস্মাৎ প্রশ্নটা করলেও ফুমিকো যেন আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল। “তিন বছর!” উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো সে। মনে মনে বোধহয় এই প্রশ্নটারই অপেক্ষায় ছিল। চেহারা কিছুটা লাল হয়ে উঠলো বেচারির।

“আপনি আপনার বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে চান?” আবারো সেই নিস্পৃহতা ফিরে এসেছে কায়ুর কণ্ঠে।

“হ্যাঁ… কোনো সমস্যা?” কিছুটা রুক্ষ স্বরেই বললো ফুমিকো।

“আরে…লজ্জার কিছু নেই,” এই পর্যায়ে মুখ খুললো নাগারে।

“লজ্জা পাচ্ছি না তো!” বললো ঠিকই ফুমিকো। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে ভুল কিছু বলেনি নাগারে। একবার কোহতাকের সাথে চোখাচোখি হলো ক্যাফে মালিকের। দু’জনের মুখেই হাসির আভাস।

কায়ু অবশ্য এসবে কোনো মজা পাচ্ছে না। বরাবরের মতোনই শীতল দৃষ্টিতে ফুমিকোর দিকে তাকিয়ে আছে সে। ফুমিকোর অভিব্যক্তিও গম্ভীর।

“এটা কী সম্ভব না?” কিছুক্ষণ পর ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করলো সে।

“না, সম্ভব…” আগের ভঙ্গিতে বললো কায়ু

“কিন্তু?”

“আপনি কীভাবে নিশ্চিত হবেন যে তিন বছর পর এই ক্যাফেতে আসবেন আপনার বয়ফ্রেন্ড?”

ফুমিকোর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে প্রশ্নটা ঠিক বোধগম্য হয়নি তার।

“বুঝতে পারছেন তো আমি কী বলছি?” কায়ু বললো।

“ওহ!” অবশেষে ধরতে পারলো ফুমিকো। সে যদি সিটটায় বসে তিন বছর পরে চলেও যায়, গোরো ঠিক তখনই এই ক্যাফেতে আসবে সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

“এটাই হচ্ছে মূল সমস্যা। অতীতে যা ঘটেছে, তা তো আমাদের মনে থাকে। সেই মুহূর্তটা কল্পনা করে চাইলে ফিরেও যাওয়া যায়। কিন্তু…”

“ভবিষ্যতের সবকিছু একদম অনিশ্চিত!” একবার হাত তালি দিয়ে বললো কোহতাকে, যেন কোনো কুইজ প্রতিযোগিতায় এসেছে সে।

“আপনারা অবশ্যই ভবিষ্যতে যেতে পারবেন। কিন্তু যে মানুষটার সাথে দেখা করার জন্য যাবেন, সে ওই দিন ক্যাফেতে আসবে কি না সেটা জানার কোনো উপায় নেই।’”

কার নিরুত্তাপ অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছে যে এর আগে বহুবার একই প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে তাকে।

“সুতরাং, একান্তই কাকতালীয় কিছু যদি না ঘটে, সেই অল্প সময়ে নির্দিষ্ট কারো সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ,” নাগারে বললো। “কফি ঠান্ডা হবার আগেই কিন্তু ফিরে আসতে হবে।” ক্যাফে মালিকের দৃষ্টি ফুমিকোর দিকে। বুঝতে পারছেন তো আমি কী বলছি?

“তার মানে ভবিষ্যতে যাওয়া সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু নয়,” বিড়বিড় করে বললো ফুমিকো।

“হ্যাঁ।”

“বেশ…” বোকার মতো কথা বলায় অন্য সময় হলে কিছুটা লজ্জা পেত ফুমিকো। তার ভবিষ্যতে যাওয়ার উদ্দেশ্যটা আসলেও ঠুনকো শোনাচ্ছে এখন। কিন্তু ক্যাফের সময় পরিভ্রমণ সংক্রান্ত কঠোর নিয়মাবলি সম্পর্কে ধারণা আছে তার। তাই কায়ুর বলা কথাগুলো মেনে নিলো চুপচাপ

অতীতে ফিরে গিয়ে যা-ই করা হোক না কেন, বর্তমানে সেটার কোনো প্রভাব পড়বে না। ভবিষ্যতে পাড়ি জমানো সময় নষ্ট বই কিছু নয়। প্রতিবেদনে এই ক্যাফের সময় পরিভ্রমণের ব্যাপারটাকে ‘অর্থহীন’ কেন বলা হয়েছিল, সেটা বুঝতে পারছি এখন, মনে মনে ভাবে ফুমিকো। কথার বিষয়বস্তু ঘোরানোর চেষ্টা করলেও এত সহজে রেহাই মিললো না তার। সরু চোখজোড়া আরো সরু করে প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাগারে।

“ভবিষ্যতে যেতে চান কেন? আপনাদের বিয়ে হয়েছে কি না, সেই বিষয়ে নিশ্চিত হবেন?” ইচ্ছা করে তাকে খ্যাপানোর চেষ্টা করছে ক্যাফে মালিক!

“মোটেও না!” আরো লাল হয়ে উঠলো ফুমিকোর চেহারা।

“আমি জানতাম!”

“বললাম তো! ওরকম কিছু না! উফ!”

যতই অস্বীকার করার চেষ্টা করছে, নিজের খোঁড়া গর্তে ততই দেবে যাচ্ছে ফুমিকো।

তবে তার পক্ষে ভবিষ্যতে পাড়ি জমানো কখনোই সম্ভব হতো না। কারণ ক্যাফের আরেকটা বিরক্তিকর নিয়ম তার ভবিষ্যৎ যাত্রার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতো। একজন ব্যক্তি একবারই চেয়ারটায় বসে সময় পরিভ্রমণের সুযোগ পাবে, দ্বিতীয়বার নয়।

কিন্তু ফুমিকোকে সেই বিষয়ে কিছু না বলাই উত্তম, মনে মনে ভাবে কাযু। এই মূহুর্তে হাসিমুখে কোহতাকের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত সে। তবে কাযু যে ফুমিকোর কথা ভেবে চুপ থাকছে, এমনটা নয়। বরং নিয়মটা বলার পর একটা উপযুক্ত ব্যাখা জানতে চাইবে ফুমিকো।

এখন এত কথা বলতে ইচ্ছা করছে না, কায়ু ভাবে।

.

“হ্যালো! স্বাগতম!”

ফুসাগি এসেছে ক্যাফেতে। একটা পোলো শার্ট, বাদামি ট্রাউজার আর সেত্তা স্যান্ডেল তার পরণে। কাধ থেকে ব্যাগ ঝুলছে। আজকে বছরের উষ্ণতম দিন। এক হাতে তাই রুমাল নয়, ছোটখাটো একটা তোয়ালে ধরে রেখেছে সে। কিছুক্ষণ পরপর ঘাম মুছছে।

“ফুসাগি!” তার নাম ধরেই ডাকলো নাগারে। অন্য কেউ হলে অবশ্য কাযুর মতোনই “হ্যালো! স্বাগতম!” বলতো।

প্রথমে কিছুটা বিভ্রান্ত মনে হলো ফুসাগিকে, এরপর নাগারের ডাকের জবাবে একবার আলতো করে মাথা নেড়ে দরজার কাছাকাছি নিজের পছন্দের সিটটায় গিয়ে বসলো। দুই হাত পেছনে বেধে ধীরে ধীরে তার টেবিলটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো কোহতাকে।

“হ্যালো, ডার্লিং!” হেসে বললো সে। এখন আর তাকে ফুসাগি বলে ডাকে না কোহতাকে।

“সরি, আমি কী আপনাকে চিনি?”

“আমি তোমার স্ত্রী।”

“স্ত্রী?…আমার স্ত্রী?”

“হ্যাঁ।”

“আপনি নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছেন?”

“না। আমি আসলেও আপনার স্ত্রী।”

কোন প্রকার দ্বিধাবোধ ছাড়াই ফুসাগির উলটোদিকের চেয়ারটায় বসে পড়লো সে। অপরিচিত একজন মহিলার এরকম ব্যবহারে বিচলিত হয়ে উঠলো বেচারা।

“আপনি এখানে না বসলেই আমি খুশি হবো।”

“আরে, কোনো সমস্যা নেই…আমি তো তোমার স্ত্রী।”

“না, সমস্যা আছে। আমি আপনাকে চিনি না।”

“বেশ তো, তাহলে সময় নিয়ে চিনবে। এখন থেকেই শুরু করা যাক।”

“মানে?”

“বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে শুরু করা যায়।”

ফুসাগির চোয়াল ঝুলে পড়লেও কোহতাকেরর মুখ থেকে হাসিটা মুছে যায়নি। শেষমেশ কায়ুর শরণাপন্ন হতে বাধ্য হলো সে। তাকে এক গ্লাস পানি দিতে সেখানে এসেছিল কায়ু।

“আপনি কী এই ভদ্রমহিলার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারবেন?”

যদি অপরিচিত কেউ এই মুহূর্তে ফুসাগি-কোহতাকে দম্পতিকে একনজর দেখে, তাহলে হয়তো ভাববে যে খুনসুটি চলছে দুজনের মাঝে। কিন্তু একটু ভালো করে খেয়াল করলেই ফুসাগির চেহারায় উদ্‌বেগটুকু স্পষ্ট বোঝা যাবে।

“ওনাকে দেখে একটু বিচলিত মনে হচ্ছে,” ফুসাগির পক্ষই নিলো কায়ু।

“তাই নাকি?” কোহতাকে যেন পণ করেছে এসব আজ আমলে নিবে না সে।

“আজকে আপাতত এটুকুই থাক, নাকি?” কাউন্টারের পেছন থেকে নাগারে বললো কথাটা।

গত সপ্তাহেও বেশ কয়েকবার একই ঘটনার অবতারণা ঘটেছে ক্যাফেতে। মাঝে মাঝে কোহতাকে যখন বলে যে সে ফুসাগির স্ত্রী, বেচারা হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বিশ্বাসই করতে চায় না। কখনো কখনো অবশ্য, “তাই বুঝি?” বলে চুপচাপ মেনে নেয়। দুই দিন আগেও এই টেবিলে বসে বেশ খোশগল্প করছিল দু’জনে। বেশির ভাগই স্মৃতিচারণ কাজের খাতিরে কোথায় কোথায় গিয়েছে এসব ব্যাপারে কথা বলার সময় বড্ড প্রাণবন্ত দেখায় ফুসাগিকে। কোহতাকে তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে, “আমিও ওখানে গিয়েছিলাম কিন্তু।” এরপর আলাপ হয়ে ওঠে আরো জীবন্ত। এরকম মুহূর্তগুলো ভালো লাগে কোহতাকের।

“আচ্ছা, ঠিক আছে। আজকে তাহলে আর কিছু বলবো না এখানে। বাসায় গিয়ে আলাপ করা যাবে,” বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে কাউন্টারের উলটোদিকে গিয়ে বসলো সে।

“আপনাকে দেখে কিন্তু বেশ খুশিই মনে হচ্ছে,” কিছুক্ষণ পর মন্তব্য করলো নাগারে।

“অখুশি না অন্তত।”

ক্যাফের ভেতরটা যথেষ্ট ঠান্ডা হওয়া সত্ত্বেও ফুসাগির কপালে মুক্তোদানার মতোন চিকচিক করছে ঘাম।

“কফি, প্লিজ,” ব্যাগ থেকে ট্রাভেল ম্যাগাজিন বের করে টেবিলে রেখে অর্ডার দিলো সে।

“আনছি,” হেসে জবাব দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল কায়ু। সাদা পোশাক পরিহিতা ভদ্রমহিলার দিকে এখনো তাকিয়ে আছে ফুমিকো। থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে সামনে ঝুঁকে একদৃষ্টিতে ফুসাগিকে দেখছে কোহতাকে। লোকটা অবশ্য জানে না যে তার উপরে নজর রাখছে কেউ।

আদ্যিকালের একটা গ্রাইন্ডিং মেশিনে কফি গুড়ো করতে ব্যস্ত নাগারে। সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলার হাতে বরাবরের মতোনই শোভা পাচ্ছে একটা উপন্যাস। সদ্য গুঁড়ো করা কফির সুবাস ক্যাফেতে ছড়িয়ে পড়া মাত্র পেছনের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো কেই। ক্যাফে মালিক থমকে গেল তাকে দেখে।

“এ কী?!” কোহতাকের চোখ যেন বেরিয়ে আসবে কোটর ছেড়ে। আগের থেকেও ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেই কে। ত্বকের নীলাভ আভা দেখেই যে কেউ বুঝতে পারবে কিছু একটা ঠিক নেই। জ্ঞান হারাতে পারে যেন যে- কোন মুহূর্তে

“তুমি ঠিক আছো?” নাগারে বলে উদ্‌বিঘ্ন স্বরে। স্ত্রীকে এই অবস্থায় দেখে বেচারার চেহারা থেকেও রক্ত সরে গেছে।

“আপু, তোমার আজকে পুরোপুরি বিশ্রাম নেওয়া উচিত,” রান্নাঘর থেকে বলে কাযু।

“না, আমি ঠিক আছি,” যতটা সম্ভব সাহসী ভঙ্গিতে বলার চেষ্টা করলো কেই। কিন্তু তার অসুস্থতা গোপন করার ব্যাপারটা একরকম শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতোনই।

“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে শরীর খারাপ,” কেইয়ের অবস্থা দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে বললো কোহতাকে। “একটু বিশ্রাম নিন নাহয়?”

আবারো মাথা ঝাঁকালো কেই। “না, আমি আসলেও ঠিক আছি।”

কিন্তু যে কেউ দেখে বুঝবে তার শারীরিক অবস্থা ভালো না।

জন্ম থেকেই হৃদরোগে ভুগছে কেই। ডাক্তাররা ভারী কাজ করতে নিষেধ করায় অন্যান্য বাচ্চাদের মতোন কখনো স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেনি সে। তা সত্ত্বেও উৎসাহ উদ্দীপনার কোনো কমতি ছিল না। জীবনকে উপভোগ করতে হবে—এই মতবাদে বিশ্বাসী সে। “কেই তো সবসময় হাসিখুশি থাকে”-হিরাই ভুল বলতো না।

আমার যেহেতু ভারি কাজ করা যাবে না, আমি করবো না। তাই বলে মুখ গোমড়া করে রাখতে হবে, এমনটা নয় নিশ্চয়ই? এভাবেই ভাবে কেই।

ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিন একপাশে দাঁড়িয়ে না থেকে এক বন্ধুকে নিয়ে হুইলচেয়ারে ঘুরে বেড়াতো সে। মাঝে মাঝে এভাবেই দৌড়ে অংশ নিত। জেতার সম্ভাবনা যে নেই, তা সবার মতো কেই নিজেও জানতো। তবে নিজেদের সেরাটা দিতে ছাড়তো না। হারার পরে আবার মন খারাপও করত বেচারি। নাচের ক্লাসে অন্যান্য সবার মতোন ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুত পা ফেলা সম্ভব হয়নি কখনো কেইয়ের। আসলে চেষ্টাও করত না সে। আস্তে ধীরে পা ফেলতো।

এখানে কেইয়ের জায়গায় অন্য কেউ থাকলে তার প্রতি হয়তো বিরাগভজন হতো বাকি সবাই, কিন্তু কেইয়ের সাথে কেউ কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি। সবার বন্ধু ছিল সে; আসলে সবাইকে আপন করে নেওয়ার গুণটা তার জন্মগত, অসুখটার মতোনই

এত হাসিখুশি থাকা সত্ত্বেও প্রায়ই হাসপাতালে সময় কাটাতে হতো কেইকে। হুটহাট শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতো, তখন জরুরি বিভাগে দৌড়াদৌড়ি। আর হাসপাতালেই একদিন তার সাথে পরিচয় হয় নাগারের।

সতেরো বছর বয়সি কেই তখন সিনিয়র হাই স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। হাসপাতালে থাকাকালীন পুরোটা সময় বিছানাতেই কাটাতে হতো তাকে। তাই একঘেয়েমি কাটানোর জন্য ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য দর্শনার্থীদের সাথে আলাপ করত। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতেও ভালো লাগতো কেইয়ের। এরকমই একদিন জানালা দিয়ে হাসপাতালের বাগান দেখার সময় পা থেকে মাথা অবধি ব্যান্ডেজে মোড়ানো একজনকে দেখতে পায় সে।

কেইয়ের চোখই সরছিল না দৃশ্যটা থেকে। একে তো ছেলেটার পা থেকে মাথা অবধি ব্যান্ডেজ, তার উপর ভীষণ লম্বা সে। এরকম বিশালদেহী কাউকে আগে কখনো দেখেনি কেই। ছেলেটার পাশ দিয়ে এক স্কুলে পড়া মেয়ে হেঁটে গেলে মনে হয় যেন গালিভারের পাশ দিয়ে লিলিপুটদের কেউ হেঁটে যাচ্ছে। মজা করে ছেলেটাকে মমি-মানব ডাকতো কেই। তাকে দেখেই সারাদিন কাটিয়ে দিত মাঝে মাঝে।

এক নার্স কিছুদিন পর কেইকে বলে যে সড়ক দুর্ঘটনায় এই অবস্থায় হয়েছে মমি-মানবের। চৌরাস্তার মোড় হেঁটে পার হবার সময় ছেলেটার সামনেই সংঘর্ষ হয় একটা ট্রাক আর গাড়ির মধ্যে। অল্পের জন্য সংঘর্ষ এড়াতে পারলেও ট্রাকটা প্রায় বিশ মিটার ছেঁচড়ে নিয়ে যায় তাকে। গাড়ির যাত্রীদের কেউ আহত হয়নি, কিন্তু ট্রাকটা উল্টে যায়। অন্য কোনো পথচারীও ব্যথা পায়নি। একই ঘটনা যদি সাধারণ কারো সাথে ঘটতো, তাহলে মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। কিন্তু নিজের শক্তপোক্ত গড়নের জন্যই বেঁচে যায় নাগারে। এমনকি দুর্ঘটনার একটু পরই এমন ভঙ্গিতে রাস্তা থেকে উঠে দাঁড়ায় যেন কিছুই হয়নি। অথচ তার পুরো শরীর তখন রক্তাক্ত। এই অবস্থাতেই ট্রাকের জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি মেরে বলে, “আপনি ঠিক আছেন?” পেট্রোল চুইয়ে পড়ছিল ট্রাকটা থেকে। ড্রাইভার অজ্ঞান। নাগারে তাকে গাড়ির ভেতর থেকে বের করে জড়ো হওয়া সবার প্রতি হাঁক ছাড়ে, “অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন!” অ্যাম্বুলেন্স এসে তাকে শুদ্ধ নিয়ে যায় হাসপাতালে। পুরো শরীরে অসংখ্য স্থানে কেটে-ছিলে গেলেও কোনো হাড্ডি ভাঙেনি।

মমি-মানবের হাসপাতালে আসার কাহিনি শোনার পর তার প্রতি আগ্রহ আরো বেড়ে যায় কেইয়ের। কেমন যেন অন্যরকম একটা অনুভূতি। পেট গুড়গুড়, বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যাওয়া। এই অনুভূতিটা ভালোবাসায় রূপ নিতেও খুব বেশি সময় নেয়নি। একদিন নাগারের সাথে দেখা করতে যায় কেই। সামনাসামনি আরো বিশাল দেখায় তাকে। মনে হয় যেন একটা পর্বত দাঁড়িয়ে আছে। “আমি আপনাকেই বিয়ে করতে চাই,” কোনো প্রকার ভণিতা ছাড়া বলে কেই। এটাই ছিল মমি-মানবের প্রতি তার বলা প্রথম কথা।

কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে মমি-মানব। এরপর অদ্ভুত একটা কথা বলে। তবে সবকিছু বিবেচনায় বাস্তবিকই ছিল জবাবটা। “তাহলে আপনাকে বাকি জীবন একটা ক্যাফেতে কাজ করতে হবে।”

এর পরের তিনটা বছর ভাবের আদানপ্রদানেই কেটে যায়। অবশেষে কেই যখন বিশে পা দেয়, রেজিস্ট্রি অফিসে স্বাক্ষর করে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলে দুজনে। নাগারের বয়স তখন তেইশ।

.

কাউন্টারের পেছনে গিয়ে সদ্য ধুয়ে রাখা বাসনগুলো মুছে নির্ধারিত স্থানে গুছিয়ে রাখতে শুরু করলো কেই, তার নিত্যদিনের কাজ এটা। রান্নাঘর থেকে পানি ফোটার শব্দ ভেসে আসে কিছুক্ষণ পর। কোহতাকে এখনো উদ্‌বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কেইয়ের দিকে। কাযু ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে, নাগারে আবারো কফি গুঁড়ো করার কাজে মন দেয়। কোনো এক অজানা কারণে, সাদা পোশাক পরিহিতা ভদ্রমহিলাও এখন তাকিয়ে আছে কেইয়ের দিকে।

“আহ-হা!” কাঁচ ভাঙার শব্দটা কানে আসার আগে কেবল এতটুকুই বলতে পারে কোহতাকে।

কেইয়ের হাত থেকে পড়ে গেছে গ্লাসটা।

“আপু! তুমি ঠিক আছো?” সদা ধীরস্থির কায়ুর এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ। রান্নাঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসে সে।

“সরি,” ভাঙা কাচের টুকরো তুলতে তুলতে বলে কেই।

“তুমি রাখো, আমি পরিষ্কার করছি,” বলে কেইকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কায়ু। আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল ক্যাফে মালিকের স্ত্রী।

কিছু না বলে দৃশ্যটা দেখছে নাগারে।

এই প্রথম কেইকে এতটা সঙ্গিন অবস্থায় দেখছে কোহতাকে। নার্সের চাকরির খাতিরে সারাদিন অসুস্থ মানুষদের সাথেই সময় কাটাতে হয় তাকে। কিন্তু কাছের একজন বন্ধুকে এই দশায় দেখে মুখ থেকে রক্ত সরে যায় বেচারির।

“কেই,” আর্দ্রকণ্ঠে বলে কোহতাকে।

“আপনি ঠিক আছেন তো?” জানতে চায় ফুমিকো।

এমনকি ফুসাগিও মাথা তুলে তাকিয়েছে।

“সরি।”

“কেইকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত,” কোহতাকে বলে কিছুক্ষণ পর।

“না, দরকার নেই কোন…”

“আমার কিন্তু মনে হচ্ছে…’”

একগুঁয়ে ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে কেই। কিন্তু নিঃশ্বাসের তালে তালে হাপরের মতোন উঠছে আর নামছে তার বুক। অবস্থা আসলেও বেগতিক।

নাগারে চুপ করে আছে এখনো। গম্ভীর দৃষ্টিতে স্ত্রী’কে দেখছে।

লম্বা একটা শ্বাস নিলো কেই। “আমার একটু শুয়ে থাকা উচিত,” বলে পেছনের ঘরের দিকে এগোলো। নাগারের চেহারায় ফুটে ওঠা শঙ্কাটুকু নজর এড়ায়নি তার। ওর শারীরিক অবস্থা নিয়ে আসলেও চিন্তিত সে।

“কাযু, ক্যাফের খেয়াল রাখো,” বলে স্ত্রীর পিছু নেয় নাগারে।

“ঠিক আছে,” অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলে কাযু।

“কফি, প্লিজ।”

“ওহ…দিচ্ছি, দাঁড়ান।”

ফুসাগি এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল কথাটা বলার জন্য। তার কণ্ঠ শুনে ঘোর কেটে যায় কার। কেইকে নিয়ে এতটাই দুশ্চিন্তা করছিল সে যে ফুসাগিকে কফি দেওয়ার কথা একদম ভুলে গেছে।

দিনটা এভাবেই শেষ হয় সেদিন।

.

গর্ভবতী হবার পর থেকেই অবসর সময়ে বাচ্চার সাথে কথা বলে কেই। চার সপ্তাহ হয়েছে কেবল, তবে সেসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই তার। নাগারেকে ‘পাপা’ ডেকে সারাদিন যা যা ঘটেছে সব খুলে বলে। বাবুর সাথে কাল্পনিক এই কথোপকথনই তার পুরো দিনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত।

“দেখতে পাচ্ছো? ওই তো তোমার পাপা।”

“আমার পাপা?”

“হ্যাঁ!”

“কত বড়!”

ওর হৃদয়টাও অনেক বড়, জানো তো? খুবই ভালো একজন মানুষ তোমার পাপা!”

“কবে যে তোমাদের সাথে দেখা হবে।”

“মা আর পাপারও তোমাকে দেখার জন্য তর সইছে না।”

এরকমই চলে তাদের আলাপচারিতা। দুই পক্ষের কথা কেই নিজেই বলে। কিন্তু বাস্তবতা বরাবরই নিষ্ঠুর। সময়ের সাথে সাথে শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে কেইয়ের। গর্ভাবস্থার পঞ্চম সপ্তাহে বাচ্চার হৃৎস্পন্দন প্রথম বোঝা যায়। এরপর ধীরে ধীরে রূপ নিতে শুরু করে বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। চোখ, কান, মুখ, পাকস্থলী, ফুসফুস, অগ্ন্যাশয়, স্নায়ুতন্ত্র গঠনের পর হাত এবং পা দৃশ্যমান হয়। জরায়ুতে চলমান এই জটিল কার্যক্রম কেইয়ের শরীরে প্রভাব ফেলতে শুরু করে।

হুটহাট শরীর গরম হয়ে যায় তার, যেন জ্বর এসেছে। শরীরের যে হরোমনগুলো নাড়ি গঠনের জন্য দায়ী সেগুলোর কারণে অবসন্নতা ভর করে কেইয়ের শরীরে, সারাক্ষণ যেন ঘুম পায়। মেজাজের ওপরেও নিয়ন্ত্রণ হারায় সে। এই ভালো তো এই খারাপ। মাঝে মাঝে তার মনে হয় যে খাবারের স্বাদও বুঝি বদলে গেছে।

এত কিছু সত্ত্বেও কখনো অভিযোগ করেনি কেই। হাসপাতালে দীর্ঘ সময় কাটানোয় একটা বিষয় উপলব্ধি করেছে সে। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই, যা হবার সেটাই হবে।

কিন্তু গত কয়েক দিনে একটু বেশিই অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে। দুই দিন আগে তার এই দশার সুযোগ নিয়ে ডাক্তারের সাথে কিছুক্ষণ একা একাই কথা বলে নাগারে। আর তাকে সব জানিয়ে দিয়েছে ডাক্তার।

“সত্যি বলতে, আপনার স্ত্রী’র এখন যেরকম দশা, বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ঝক্কিটুকু তার হৃদযন্ত্র সামলাতে পারবে কি না সেই বিষয়ে সন্দেহ আছে। যদি তার অবস্থা বেশি খারাপ হয়, তাহলে হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ থাকবে আমার পক্ষ থেকে। আর তিনি যদি আসলেও বাচ্চাটাকে জন্ম দিতে চান, তবে তাকে এটা বুঝতে হবে যে তাদের দুজনেরই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। জীবন ঝুঁকি আছে জেনেও তিনি কাজটা করতে চাচ্ছেন।”

এই পর্যায়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন ডাক্তার। এরপর বলেন, “সাধারণত ছয় থেকে বারো সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত ঘটানো নিরাপদ। কিন্তু আপনার স্ত্রী’র ক্ষেত্রে কাজটা যত তাড়াতাড়ি করা হবে, তত ভালো।”

বাসায় ফিরে স্ত্রীর মুখোমুখি হয় নাগারে। ডাক্তারের বলা কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করে। তার কথা শেষ হলে একবার মাথা নাড়ে কেই।

“জানি আমি,” কেবল এটুকুই বলে সে।

.

ক্যাফে বন্ধ করে একা একা কাউন্টারে বসে আছে নাগারে। গোটা ক্যাফেতে আলোর উৎস বলতে কেবল দেওয়ালে ঝোলানো ল্যাম্পগুলো। কাউন্টারে কাগজ ভাঁজ করে বানানো কতগুলো বক পাখি শোভা পাচ্ছে। নাগারের কাজ। হাত দুটো অনবরত চলছে তার। দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়ি তিনটার কাঁটাগুলোর মতোন।

বেলের শব্দ কানে এলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না নাগারে। সদ্য বানানো পাখিটা আগের পাখিগুলোর পাশে নামিয়ে রাখে নিঃশব্দে। কোহতাকে এসেছে ক্যাফেতে। কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিল সে। সকালে কেইকে অসুস্থ দেখে গিয়েছিল, তাই যাবার বেলায় খোঁজ নিতে এসেছে।

কাউন্টারের উপরে রাখা পাখিগুলোর দিকেই নজর নাগারের। আলতো করে একবার মাথা নাড়লো কেবল।

“কেই কেমন আছে?” দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো কোহতাকে। নাগারের স্ত্রী যে গর্ভবতী, সেটা কয়েকদিন আগেই জেনেছে সে। কিন্তু এই কারণে যে তার শারীরিক অবস্থার এত দ্রুত অবনতি ঘটবে, এমনটা ভাবতে পারেনি। সারাদিন দুশ্চিন্তা করেছে কেইকে নিয়ে।

সাথে সাথে কোনো জবাব দিলো না নাগারে। আরেকটা পেপার ন্যাপকিন নিয়ে ভাঁজ করতে শুরু করলো সে। “আছে কোনোরকম,” বেশ খানিকক্ষণ পর বললো।

নাগারে যে সিটে বসেছে, সেটার এক সিট পাশে এসে বসলো কোহতাকে।

“আপনাকে চিন্তায় ফেলে দেওয়ার জন্য দুঃখিত,” নাক চুলকে বললো ক্যাফে মালিক। ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে রেখেছে।

“এসব বলবেন না, প্লিজ…কিন্তু কেইয়ের তো এখন হাসপাতালে থাকা উচিত, তাই না?”

“আমি বলেছি, কিন্তু ও শুনবে না।”

“হ্যাঁ, কিন্তু…”

পেপার ন্যাপকিন দিয়ে আরেকটা পাখি বানিয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে নাগারে। “আমি বাচ্চা নিতে চাইনি,” বিড়বিড় করে বললো সে। ক্যাফেটা এত ছোট আর নৈঃশব্দে মোড়া না হলে কোহতাকে বুঝতেও পারতো না যে কী বলা হয়েছে। “কিন্তু এখন ওর মতো বদলানো সম্ভব নয়,” মৃদু হেসে কোহতাকের দিকে তাকিয়ে বললো ক্যাফে মালিক, এরপর মাথা নিচু করে নিলো।

সে শুধু কেইকে ‘বাচ্চাটা নেওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না’—এই কথাটাই বলেছিল। ‘আমরা বাচ্চা নিব’ বা ‘বাচ্চা নিব না’-এই ধরনের কিছু বলা সম্ভব নয় তার পক্ষে। মা এবং বাচ্চার মধ্যে কাউকে বেছে নিতে বলা হলে একজনকে রেখে আরেকজনকে কখনোই বাছতে পারবে না নাগারে

কোহতাকে বুঝতে পারছে না যে তার কী বলা উচিত। কিছুক্ষণ পর মাথা উঁচিয়ে সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে বললো, “আসলেও কঠিন সমস্যায় পড়েছেন।”

এসময় কায়ু ফিরে এলো পেছনের ঘরটা থেকে।

“কাযু…” ফিসফিসিয়ে বললো কোহতাকে।

কিন্তু কায়ু তার দিকে না তাকিয়ে নাগারের দিকে মুখ ফেরালো। স্বভাবসুলভ নিস্পৃহতার ছিটেফোঁটাও আর নেই তার মধ্যে। বরং কমনীয় চেহারাটার আনাচকানাচে বেদনার ছাপ

“কেমন আছে ও?” নাগারে জানতে চাইলো।

পেছনের ঘরটার দিকে একবার তাকালো কায়ু। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে নাগারে সেদিকে তাকিয়ে দেখলো যে কেই হেঁটে আসছে। চেহারা এখনো আগের মতোনই ফ্যাকাশে, চলাফেরাও অবিন্যস্ত, তবে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছে ক্যাফে মালিকের স্ত্রী। কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ালো সে, নাগারের ঠিক উলটোপাশে। কিন্তু নাগারে মুখ তুললো না। বরং কাগজ দিয়ে বানানো পাখিগুলোর গুরুত্বই যেন তার কাছে বেশি। দুজনের কেউই মুখ না খোলায় ঘন মেঘের মতোন অস্বস্তি জমাটবাঁধতে লাগলো আশপাশে। কোহতাকে’কে দেখে মনে হচ্ছে যেন নড়াচড়ার শক্তিটুকুও হারিয়েছে।

রান্নাঘরে গিয়ে কফি বানাতে শুরু করলো কায়ু। ফানেলে ফিলটার রেখে কেতলি থেকে ফ্লাস্কের মধ্যে গরম পানি ঢাললো প্রথমে। ক্যাফের ভেতরটা নিশ্চুপ হওয়ায় সে কী কাজ করছে সেটা শব্দ শুনেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফুটতে শুরু করলো ফ্লাস্কের ভেতরকার তরলটুকু। কয়েক মিনিট পর তাজা কফির ঘ্রাণে ভরে উঠলো চারপাশ। সেই গন্ধটা নাকে আসতেই যেন মুখ তুললো নাগারে।

“সরি, নাগারে,” জড়ানো কণ্ঠে বললো কেই।

“কেন?”

“কালকে হাসপাতালে যাবো আমি।”

“কী?”

“হাসপাতালে ভর্তি হবো,” কেইয়ের কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে যেন নিজের সাথেই সন্ধিচুক্তি করছে। “সত্যি বলতে, এখন যদি একবার হাসপাতালে যাই আমি, ফিরে আসার সম্ভাবনা একদমই ক্ষীণ। এজন্যেই সিদ্ধান্তটা নিতে পারছিলাম না…”

“ওহ,” হাত দু’টো মুষ্ঠিবদ্ধ করে বলে নাগারে।

শূন্যদৃষ্টিতে একবার ক্যাফের ছাদের দিকে তাকায় কেই। “কিন্তু এখন আমার যেমন অবস্থা, খুব বেশিদিন এখানে থাকতে পারবো বলে মনে হয় না।” তার আয়ত চোখজোড়ায় ছলছল করছে অশ্রু।

চুপচাপ শুনছে নাগারে।

“আমার শরীর আর কতদিন সহ্য করতে পারবে, জানি না…” পেটে হাত রাখলো কেই। “ওকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসতে চাইলে আমার নিজেকেই বিসর্জন দিতে হবে…” মৃদু হাসি ফুটলো তার মুখে। সত্যটা অজানা নয় কারোই। এখনো অবশ্য ফুলতে শুরু করেনি কেইয়ের পেট। তবে তার শরীর কতটা ধকল সইতে পারবে তা ভালো করেই জানে।

“এজন্যেই…”

এবারে নিজের সরু চোখজোড়া কেইয়ের উপরে নিবদ্ধ করলো নাগারে। “আচ্ছা…কেই, ডার্লিং…”

এই প্রথম কেইকে এরকম মনমরা দেখছে কোহতাকে। নার্সের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে যে হৃদযন্ত্রের এরকম অবস্থায় বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্ত কতটা সাহসী। সবে চার সপ্তাহ, এর মধ্যেই শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছে তার। সে যদি বাচ্চা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতো, তবুও কেউ দোষ দিতো না তাকে। কিন্তু বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্তে কেই অনড়

“আমার কিন্তু অনেক ভয় লাগছে,” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো কেই। “আমার বাবুটা সুখী হবে তো? মা’কে ছাড়া একা একা থাকতে পারবে তো? নাকি আমাকে না পেয়ে কাঁদবে তুমি?” শেষের কথাটা বাচ্চার উদ্দেশ্যে বললো সে। “আমি হয়তো তোমাকে কেবল জন্ম দিতে পারবো। তুমি কী পারবে আমাকে ক্ষমা করতে?”

কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো সে, কিন্তু কোনো জবাব এলো না। আসার কথাও না।

দু’চোখ বেয়ে পানি ঝরছে কেইয়ের।

“খুব ভয় লাগে আমার…যখন ভাবি আমার বাচ্চাটা আমাকে ছাড়া বড় হবে,” নাগারের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো সে। “কী করবো, বলো? আমি চাই ও সুখী হোক। এরকম একটা চাওয়াও কীভাবে ভয় ধরায় মনে?”

নাগারে কোনো কথা বললো না। মাথা নিচু করে রেখেছে সে।

হাতের বইটা সদ্য বন্ধ করেছে সাদা পোশাক পরিহিতা ভদ্রমহিলা। এখনো অবশ্য বইটা পুরোপুরি পড়া শেষ হয়নি তার। লাল ফিতে বাঁধা সাদা রঙের একটা বুকমার্ক দেখা যাচ্ছে বইয়ের পাতাগুলোর মাঝখানে। বই বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনে সেদিকে তাকালো কেই। সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলাও পালটা তাকিয়ে আছে তার দিকে।

এভাবেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর একবার চোখের পলক ফেললো সে। যেন কিছু একটা বোঝাতে চাইছে। এরপর স্বাভাবিক উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়ালো টয়লেটের দিকে।

তার সিট, মানে ক্যাফের বিশেষ সিটটা এখন খালি।

সেদিকে হাঁটতে লাগলো কেই, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি টেনে নিচ্ছে তাকে। অতীতে ফিরে যাওয়ার সিটটার সামনে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো সেটার দিকে। “কাযু…তুমি কী একটু কফি বানাতে পারবে?” দুর্বল কণ্ঠে বললো একটু পর।

কেইয়ের অনুরোধ শুনে রান্নাঘর থেকে মাথা বের করে কায়ু দেখলো যে ক্যাফের বিশেষ সিটটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। কেই কী ভাবছে, তা ঠিক বোধগম্য হলো না ওর।

নাগারে ঘুরে তাকালো এবারে। “আহ-হা…কি করছো এসব?”

কায়ু খেয়াল করলো সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলাটা এখন ক্যাফেতে নেই। সেই সাথে সকালবেলা ফুমিকোর করা প্রশ্নটা মনে পড়লো তার। “ভবিষ্যতেও কী পাড়ি জমানো সম্ভব?”

ফুমিকোর মাথায় কী চলছিল, তা বুঝতে সমস্যা হয়নি কারোই। সে জানতে চায় ভবিষ্যতে গোরো আমেরিকা থেকে ফিরে তাকে বিয়ে করে কী না। কায়ু জবাব দেয় যে ভবিষ্যতে যাওয়া সম্ভব, কিন্তু কেউ যায় না কারণ কাজটা সময় নষ্ট রই কিছু নয়। কিন্তু এখন কেই কাজটা করতে চাইছে।

“আমি শুধু একবার দেখতে চাই।”

“দাঁড়াও।”

“একবার যদি দেখি, অল্পক্ষণের জন্য, তাহলেই যথেষ্ট…”

“তুমি কী আসলেও ভবিষ্যতে যেতে চাও?” অন্যান্য সময়ের তুলনায় এখন নাগারের কণ্ঠস্বর আরো গম্ভীর শোনাচ্ছে।

“এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

“তুমি তো নিশ্চিত হতে পারবে না যে দেখা হবেই।”

“আমি…”

“আর যদি দেখাই না হয়, তাহলে গিয়ে লাভ কী?”

“আমি বুঝতে পারছি তোমার কথা। কিন্তু…” অনুনয়ের দৃষ্টিতে নাগারের দিকে তাকালো কেই।”

কিন্তু নাগারের মুখ দিয়ে কেবল একটা শব্দই বেরুলো। “না।’ আবারো কাউন্টারের দিকে সোজা হয়ে বসলো সে।”

এর আগে কখনো কেইকে কোনো কাজে বাধা দেয়নি নাগারে। স্ত্রী’র ব্যক্তিত্বের প্রতি যথেষ্ট সম্মান আছে তার। এমনকি বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও কেইয়ের সাথে তর্কে জড়ায়নি সে। কিন্তু এবারে আর কিছু না বলে পারলো না।

কেই তাদের বাচ্চাটাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসতে পারবে কি না, শুধু এই বিষয়টা নিয়েই চিন্তিত নয় সে। বরং নাগারে ভাবছে কেই যদি ভবিষ্যতে গিয়ে দেখে বাচ্চাটার কোনো অস্তিত্বই নেই, তাহলে এখন যে মনোবলের উপর ভর করে নিজেকে সামলে রেখেছে, সেটাও ভেঙে পড়বে।

এখনো চেয়ারটার সামনে মরিয়া ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে কেই। ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না। সিদ্ধান্তও বদলানোর কোনো ইচ্ছা নেই তার।

“তোমাকে প্রথমে ঠিক করতে হবে যে কত বছর সামনে যেতে চাও,” হঠাৎই বললো কায়ু। টেবিলটা থেকে ভদ্রমহিলার রেখে যাওয়া কাপটা উঠিয়ে নিলো সে। “মাস, তারিখ আর সময়ও ঠিক করে নিবে, ঠিক আছে?” কেইয়ের চোখে চোখ রেখে একবার মাথা নাড়লো।

“কাযু!” যতটা সম্ভব কর্তৃত্বপরায়ণ কণ্ঠে বললো নাগারে। কিন্তু তার কথা আমলে নিলো না কায়ু। নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো, “আমি মনে রাখবো তারিখটা। চেষ্টা করবো যেন তুমি দেখা করতে…”

“ওহ, কায়ু,” মমতামাখা কণ্ঠে বললো কেই।

কাযু আসলে বলতে চাইছে যে দিন তারিখটা ঠিকঠাক মনে রাখবে সে, যেন কেই ভবিষ্যতে গিয়ে সন্তানের সাথে দেখা করতে পারে। “তুমি বেশি চিন্তা কোরো না,” বললো মেয়েটা।

তার দিকে তাকিয়ে একবার মাথা নাড়লো কেই।

কাযুর গত কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছিল যে কেইয়ের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতির পেছনে তার হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা ছাড়াও অন্য কোনো কারণ আছে। গর্ভবতী হওয়ার দরুন শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তন তো হচ্ছেই, সেই সাথে কেইয়ের মানসিক অশান্তির পরিমাণও বাড়ছে। মৃত্যুকে ভয় পায় না কেই। তার বেদনা এবং দুশ্চিন্তার মূল কারণ, নিজের সন্তানকে বেড়ে উঠতে দেখার সুযোগ না পাওয়া। বিষয়টা তার হৃদয়ে চাপ ফেলছে। সহ্যক্ষমতাও কমে যাচ্ছে দিনদিন। শরীর যতই দুর্বল হচ্ছে, দুশ্চিন্তার পরিমাণও বাড়ছে। মানুষের মনোবল ভেঙে গেলে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে। কাযুর ভয় হয়, কেই যদি এরকম দুশ্চিন্তা করতে থাকে তাহলে আসন্ন দিনগুলোয় শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হবে তার। তখন মা কিংবা সন্তান কাউকেই বাঁচানো যাবে না।

তবে এই মুহূর্তে কিছুটা আশার আলো দেখতে পেয়েছে কেই।

আমার বাচ্চাটাকে দেখতে পারবো।

আশার সলতেটা অবশ্য এই মুহূর্তে টিমটিম করে জ্বলছে। ঘুরে কাউন্টারে বসে থাকা নাগারের দিকে তাকালো কেই।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর একবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিশালদেহী ক্যাফে মালিক বললো, “তোমার যা ইচ্ছা করো।” আবারো মুখ ফিরিয়ে নিলো সে।

“ধন্যবাদ,” কেইয়ের মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি।

কেই সিটটায় একাই বসতে পারবে, এটা নিশ্চিত হবার পর ভদ্রমহিলার ব্যবহৃত কাপটা নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল কাযু। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ধীরেসুস্থে চেয়ারটায় বসলো কেই। চোখ বন্ধ। প্রার্থনার ভঙ্গিতে দুই হাত সামনে জড়ো করে রেখেছে কোহতাকে। নাগারের দৃষ্টি কাগজের পাখিগুলোর দিকে।

এই প্রথম কায়ুকে নাগারের কথার অবাধ্য হতে দেখলো কেই। ক্যাফের বাইরে অপরিচিত কারো সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে সবসময়ই অস্বস্তিতে ভোগে কায়ু। টোকিও চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সে। কিন্তু কেই কখনো তার সাথে এমন কাউকে দেখেনি যাকে বন্ধু বলা যায়। খুবই চাপা স্বভাবের মেয়ে। ক্লাস বা অন্যান্য কোনো কাজ না থাকলে ক্যাফের কাজে সাহায্য করে। আর এখানে ডিউটি শেষ হলে বাড়ি ফিরে আঁকতে বসে যায়।

কাযুর আঁকা ছবিগুলো হাইপার-রিয়েলিস্ট ধরনের। শুধু পেনসিল ব্যবহার করে এমন সব ছবি আঁকে, যেগুলো দেখে বোঝা দুঃসাধ্য যে ক্যামেরায় তোলা হয়েছে নাকি হাতে আঁকা। তবে সে শুধু এমন দৃশ্যই আঁকতে পারে, যেগুলো নিজের চোখে দেখেছে। কখনো কাল্পনিক কিছু কাযুকে আঁকতে দেখেনি কেই।

প্রতিটা মানুষের পৃথিবীকে দেখার, শোনার বা বোঝার আলাদা আলাদা ধরন আছে। আমরা কোনো দৃশ্য দেখে বা শব্দ শুনে কী উপলব্ধি করছি তা প্রভাবিত হয় পূর্বঅভিজ্ঞতা, চিন্তা, পারিপার্শ্বিকতা, ব্যক্তিপছন্দ কিংবা কুসংস্কার দ্বারা। এরকম আরো হাজারো বিষয় প্রভাব ফেলে আমাদের মনের ওপরে। আট বছর বয়সে একটা স্কেচ এঁকেছিলেন পাবলো পিকাসো। ছবিটার বিষয়বস্তু ছিল নগ্ন একজন পুরুষ। সবাই বাহবা করেছিল ছবিটার। আবার চৌদ্দ বছর বয়সে তাঁর আঁকা ক্যাথোলিক কমিউনিয়ন সেরেমনির ছবিটা ছিল অনেকটাই বাস্তব ঘেঁষা। সেটাও কম প্রশংসা কুড়ায়নি। সবচেয়ে কাছের বন্ধুটা আত্মহত্যা করার পর লম্বা একটা সময় নীল রঙের আঁচড়ে সবকিছু আঁকতেন পিকাসো। সেই সময়টাকে ‘ব্লু পিরিয়ড’ বলা হয়। আবার এক নতুন প্রেমিকার সাথে দেখা হবার পর উজ্জ্বল রঙে আঁকতে আরম্ভ করলে শুরু হয় ‘রোজ পিরিয়ড’। আফ্রিকান ভাস্কর্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কিউবিস্ট মুভমেন্টের সাথে জড়িয়ে যান তিনি। এরপর নিওক্লাসিকাল ধাঁচে আঁকতে শুরু করেন। তখনকার ছবিগুলোয় প্রাধান্য পায় পরাবাস্তববাদ। বিখ্যাত ছবি ‘দ্য উইপিং ওম্যান’ এবং ‘গ্যুয়েরনিকা’ এই সময়ে আঁকা।

অর্থাৎ, এই ছবিগুলো পিকাসোর চোখে দৃশ্যমান জগৎটা আমাদের সামনে ফুটিয়ে তোলে। অন্যভাবে বললে ছবিগুলোয় যে ফিল্টারটার মাধ্যমে আমরা জগৎটা দেখছি, সেটা হচ্ছে পিকাসো। এখন অবধি কায়ু কখনো অন্য কাউকে কোনোভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেনি। কারো মতের বিরুদ্ধে কিছু বলেনি আবার কাউকে কোনো প্রকার ইন্ধনও জোগায়নি। এর কারণ হিসেবে বলা যায় ফিলটারের যে অংশের মাধ্যমে সে বাইরের সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে, সেটুকুর সাথে তার ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলোর কোনো যোগাযোগ নেই। চারপাশে যা-ই ঘটুক না কেন, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলে। কায়ুর জীবনবোধটাই এরকম।

সবার সাথেই এরকম ব্যবহার করে সে। অতীতে ফিরতে চায় যারা, তাদের সাথে ওর নিরুত্তাপ আচরণের হেতুও এটা। ‘অতীতে ফিরে গিয়ে আপনি যা ইচ্ছা করুন, আমার তাতে কিছু আসে যায় না’-এরকমটাই বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এবারে ব্যাপারটা একদম ভিন্ন। কথা দিয়েছে সে। কেইকে ভবিষ্যতে যাওয়ার জন্য নিজের মুখে বলেছে এবং তার কথাগুলোর দ্বারা কেইয়ের ভবিষ্যৎও প্রভাবিত হবে। কেই বুঝতে পারছে যে কাযুর এরকম স্বভাববিরুদ্ধ আচরণের পেছনে নিগূঢ় কোনো কারণ আছে। কিন্তু সেই কারণগুলো নিয়ে এখন আলাপ না করলেও চলবে।

“আপু।” কায়ুর কণ্ঠস্বর শুনে চোখ খুললো কেই। একটা রুপালি ট্রে হাতে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে কায়ু। ট্রে’র উপরে সাদা রঙের কফি কাপ আর ছোট্ট একটা রুপালি কেতলি রাখা।

“তুমি ঠিক আছো?”

“হ্যাঁ।”

কেই সোজা হয়ে বসলে তার সামনে কফির কাপটা নামিয়ে রাখলো কাযু।

কত বছর সামনে যাবো, মাথা কাত করে ভাবতে লাগলো কেই।

“দশ বছর পর ২৭ আগস্টে যেতে চাই আমি,” কিছুক্ষণ পরে ঘোষণার সুরে বললো সে।

তারিখটা শুনে একটা হাসি ফুটলো কায়ুর মুখে। “ঠিক আছে।” ২৭ আগস্ট হচ্ছে কেইয়ের জন্মদিন। কায়ু কিংবা নাগারে, কেউই তারিখটা সহজে ভুলবে না। “আর সময়?”

“বিকেল তিনটা,” জবাব দিতে দেরি করলো না কেই।

“দশ বছর পরে, ২৭ আগস্ট, বিকেল তিনটা।”

“হ্যাঁ,” হাসি ফুটলো কেইয়ের মুখে।

একবার আলতো করে মাথা নেড়ে রুপালি কেতলিটার হাতল আঁকড়ে

ধরলো কায়ু। “ঠিক আছে তাহলে,” নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললো।

নাগারের দিকে একবার তাকালো কেই। “কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার দেখা হবে,” স্পষ্ট সুরে বললো সে।

ক্যাফে মালিক অবশ্য ফিরে তাকালো না। “আচ্ছা, ঠিক আছে”

কেই আর নাগারের কথোপকথনের মধ্যে কাপের উপরে কেতলিটা নিয়ে এসেছে কাযু।

“ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার আগেই কফিটুকু শেষ করতে হবে,” ফিসফিসিয়ে বললো সে।

নিশ্চুপ ক্যাফের সবাই শুনতে পেল কথাটা। ঘরে জমাটবাঁধা উত্তেজনাটুকু টের পাচ্ছে এখন কেই।

কফি ঢালতে শুরু করেছে কায়ু। কালচে বাদামি কফির সরু একটা ধারা নেমে আসছে কেতলির মুখ থেকে। ধীরে ধীরে ভরে উঠছে কাপটা। কেইয়ের দৃষ্টি অবশ্য কায়ুর উপরে নিবদ্ধ। কফি ঢালা শেষ হলে কেইয়ের দৃষ্টিটা টের পেল কাযু। একটা উষ্ণ হাসি ফুটলো তার মুখে। যেন বোঝাতে চাইছে, “তুমি যাতে তোমার সন্তানকে দেখতে পাও, সেটা নিশ্চিত করবো আমি…”

কফিতে পূর্ণ কাপটা থেকে ধোঁয়া উঠছে এখন। কেইয়ের মনে হলো তার পুরো শরীরই বুঝি সেই ধোঁয়ার অংশ। কাঁপছে থেকে থেকে। মেঘের মতোন হালকা লাগছে নিজেকে। কিছুক্ষণ পর আশপাশে সবকিছু ঘুরতে লাগলো, যেন রিমোটের ফাস্ট ফরোয়ার্ড বাটনে চাপ দিয়েছে কেউ।

অন্য সময় হলে কৌতূহলী চোখে আশপাশের দৃশ্য দেখতো। কিন্তু এখন মানসিক অবস্থা এমন যে এরকম অভূতপূর্ব একটা অভিজ্ঞতাও উপভোগ করতে পারছে না। নাগারে চায়নি ও ভবিষ্যতে পাড়ি জমাক, কিন্তু কাযু উৎসাহ দিয়েছে। এখন নিজের সন্তানের সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছে কেই। চোখ একটু লেগে ঝিমুনি কাটানোর জন্য আসতেই নিজের ছোটবেলার কথা মনে করার চেষ্টা করলো।

.

কেইয়ের বাবা, মিশিনোরি মাতসুযাওয়াও হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগতেন। কেই যখন এলিমেন্টারি স্কুলের থার্ড গ্রেডের শিক্ষার্থী, একদিন অফিসে কাজ করতে করতে জ্ঞান হারান তিনি। এরপর হাসপাতালে যাওয়া-আসা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। এক বছরের মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভদ্রলোক। কেইয়ের বয়স তখন নয় বছর। ভীষণ হাসিখুশি, সদালাপী একটা বাচ্চা বলেই তাকে চিনতো সবাই। সেই সাথে ভীষণ আবেগপ্রবণ। বাবার মৃত্যু নাড়া দিয়ে যায় ছোট্ট কেইকে। অচেনা সব দুঃখেরা জেঁকে বসে চিত্তে। এর আগে কখনো এত কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখেনি সে। বাবার মৃত্যুকে কেই তুলনা করে অন্ধকার একটা বাক্সের সাথে। একবার সেই বাক্সে কেউ ঢুকলে, আর বেরুতে পারে না। ওর বাবা সেখানে আটকে আছে সারাজীবনের মতোন। প্রচণ্ড নিঃসঙ্গ এবং ভীতিকর একটা জায়গা। বাবার কথা মনে হলে চোখ থেকে ঘুম দূর হয়ে যেত ছোট্ট কেইয়ের। একসময় মুখ থেকে হাসিটাও মুছে যায়।

ওর মা, তোমাকো’র প্রতিক্রিয়া ছিল অবশ্য একদম বিপরীত। স্বামীর মৃত্যুর পর মুখে সবসময় একটা হাসি ঝুলিয়েই রাখতেন তিনি। অথচ খুব কাছের বন্ধুরাও তাকে এর আগে কখনো খুব বেশি হাসতে দেখেনি। তার এবং মিশিনোরির দাম্পত্য জীবন ছিল একদমই সাদামাটা। মিশিনোরির মৃত্যুর দিন খুব কাঁদে তোমাকো, কিন্তু এর পরে তার চেহারায় দুঃখের কোনো ছাপ খুঁজে পায়নি কেউ। বরং আগের তুলনায় অনেক বেশি হাসতেন। কেই কিছুতেই বুঝতে পারতো না যে তার মা হাসছে কেন। “বাবা মারা গেছে, তাও তুমি হাসছো? তোমার কষ্ট লাগে না?”

তোমাকো জানতেন যে তার মেয়ে মৃত্যুকে একটা অন্ধকার বাক্সের সাথে তুলনা করে। “তোমার বাবা যদি ওই বাক্সটা থেকে আমাদের দেখে, তাহলে কী ভাববে, বলো তো?”

মেয়ের ‘বাবা মারা গেছে, তাও তুমি হাসছো?’ অভিযোগের প্রেক্ষিতে যতটা সম্ভব কোমল গলায় কথা বলার চেষ্টা করেন তোমাকো। সেই সময়েও মিশিনোরির সাথে কাটানো সুখের মুহূর্তগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল তার মনে।

“তোমার বাবা কিন্তু ইচ্ছা করে বাক্সটার ভেতরে পা রাখেনি। এর পেছনে একটা কারণ আছে। তাকে যেতেই হতো ওখানে। এখন, সে যদি বাক্সের ভেতর থেকে দেখে যে তার কেই বাবু প্রতিদিন কাঁদছে, তাহলে কী ভাববে বলো তো? আমার তো মনে হয় খুব কষ্ট পাবে। প্রিয় মানুষদের মুখে কষ্টের ছাপ দেখতে কী কারো ভালো লাগে? তুমি হাসলে যদি ওখানে তোমার বাবাও খুশি হয়, তাহলে হাসবে না, বলো? আমাদের আনন্দতেই তো তোমার বাবার আনন্দ।”

মা’র কথাগুলো শুনে চোখে পানি চলে আসে কেইয়ের।

মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তোমাকো। তার চোখেও ছলছল করছিল অশ্রু। এই অশ্রুবিন্দুগুলোই হয়তো শেষকৃত্যের দিনটা থেকে লুকিয়ে রেখেছিল সে।

এরপর আমার পালা ওই বাক্সে পা রাখার…

প্রথমবারের মতোন কেই উপলব্ধি করে যে তার বাবা কতটা খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। নিজের সময় ফুরিয়ে আসছে, খুব তাড়াতাড়ি প্রিয় মানুষগুলোকে ছেড়ে যেতে হবে…এই ভাবনাটা যে কোনো সুস্থ মানুষকেও নিয়ে যাবে হতাশা এবং অবসাদ নামের অরণ্যে।

বাবার শেষ সময়ের অনুভূতিগুলো বুঝতে পারে কেই। সেই সাথে তার মা’র কথার মাহাত্ম্যটুকু ধরতেও সমস্যা হয়নি।

স্বামীকে খুব ভালোভাবে চিনতেন এবং ভীষণ ভালোবাসতেন বলেই ওই কথাগুলো বলেছিলেন তোমাকো।

.

কিছুক্ষণ পর কমে এলো চারপাশের ঘূর্ণন। ধোঁয়া থেকে আবারো নিজেকে আলাদাভাবে অনুভব করতে পারছে কেই। খানিক বাদে নির্ধারিত সিটটায় বসে থাকা অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করলো সে।

কাকে ধন্যবাদ, দশ বছর ভবিষ্যতে চলে এসেছে ও। প্রথমেই একবার ক্যাফের চারধারে নজর বুলালো। পুরু থাম এবং সিলিংয়ের চেস্টনাট রঙা বিমগুলো আগের মতোনই আছে। একপাশে তিনটা বড় বড় দেওয়ালঘড়ি ঝোলানো। ক্যাফের ভেতরে মৃদু বাদামি আলোর কারণে দিনের বেলাতেও সময় আন্দাজ করা যায় না। মনে হয় যেন ইতিহাসের পাতা ফুড়ে বেরিয়ে আসা কোনো ছবি। দেওয়ালের মেটে রঙের প্লাস্টার প্রায় শতবর্ষ পুরানো। কাঠের সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে নিঃশব্দে। মোদ্দা কথা, ক্যাফের কোনো কিছু দেখে বোঝার উপায় নেই যে দশ বছর ভবিষ্যতে পাড়ি জমিয়েছে ও।

তবে ক্যাশ রেজিস্টারের পাশে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটা মোতাবেক আজ ২৭ আগস্ট। কায়ু, নাগারে এবং কোহতাকেও উধাও হয়ে গেছে।

তাদের জায়গায় অপরিচিত একটা লোক বসে আছে কাউন্টারের পেছনে, দৃষ্টি ওর দিকে।

লোকটাকে দেখে কিছুটা বিভ্রান্ত কেই। একটা সাদা শার্ট, বো-টাই আর কালো ওয়েস্টকোট তার পরনে। চুলগুলো ছোট করে ছাটা। এটা পরিষ্কার যে ক্যাফেতে কাজ করে সে। এখানকার কর্মী ছাড়া কারো কাউন্টারের পেছনে যাওয়ার অনুমতি নেই। তাছাড়া কেইকে দেখে খুব একটা অবাক হয়নি সে, অর্থাৎ এই সিটটার বিশেষত্বের ব্যাপারেও জানা আছে।

এখন অবধি ওর উদ্দেশ্যে কিছু বলেনি লোকটা। এই সিটে হঠাৎ উদয় হওয়া লোকেদের সাথে ক্যাফের কর্মীরা কখনোই আগ বাড়িয়ে কথা বলে না। কিছুক্ষণ পর পুনরায় হাতের গ্লাসগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করলো সে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বয়স চল্লিশের আশপাশে। সাধারণ দর্শন একজন ওয়েটার। ডান চোখের উপর থেকে কান অবধি একটা পোড়া দাগ। প্রথম দেখায় থমকে যাবে কেউ।

“এক্সকিউজ মি…”

কারো সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে কখনো পিছপা হয়নি কেই। এমনভাবে আলাপ শুরু করে দেয় যেন তারা দীর্ঘদিনের বন্ধু। কিন্তু আজ সবকিছু কেমন যেন বিভ্রান্তিকর ঠেকছে। ওর কথার ভঙ্গি শুনে মনে হবে যেন বিদেশি কোনো পর্যটক স্থানীয় কারো সাথে আলাপ জমাতে চাইছে।

“আপনাদের ম্যানেজার কোথায়?”

“ম্যানেজার?”

“ক্যাফে ম্যানেজার, উনি আছেন এখানে?”

পরিষ্কার গ্লাসটা কাউন্টারের পেছনে নির্দিষ্ট শেলফে সাজিয়ে রাখলো লোকটা।

“আসলে…আমিই ম্যানেজার…”

“কী?”

“সরি, কোনো সমস্যা?”

“আপনিই ম্যানেজার?”

“হ্যাঁ।”

“এখানকার?”

“হ্যাঁ।”

“এই ক্যাফের?”

“হ্যাঁ।”

“আসলেই?”

“হ্যাঁ।”

এমনটা তো হওয়ার কথা না! চেয়ারে হেলান দিয় বসে ভাবলো কেই।

কাউন্টারের পেছনের লোকটা ওর কথা বলার ভঙ্গিতে ভড়কে গেছে। হাতের কাজ থামিয়ে বেরিয়ে এলো সে। “কী সমস্যা? বলুন তো।” সে ক্যাফের ম্যানেজার, এই কথা শুনে এর আগে হয়তো কখনো কেউ এরকম প্রশ্ন করেনি। কিন্তু কেইয়ের অভিব্যক্তি দেখে কিছু বোঝার জো নেই।

পরিস্থিতি ঠাওর করার চেষ্টা করছে সে। এই দশ বছরে ঠিক কী ঘটেছে? এমন কী ঘটতে পারে যাতে ম্যানেজার বদলে যাবে? এরকম হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। কিন্তু সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে এই অপরিচিত মানুষটার সামনে। দেখা যাবে এসব ভাবতে ভাবতেই কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে আসার পুরো উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হবে তখন।

নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলো কেই। এরপর উদ্‌বিগ্ন মুখে চেয়ে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো, “আচ্ছা…” নিজেকে শান্ত করতে হবে আমাকে।

“জি?”

“আপনাদের আগের ম্যানেজার…?”

“আগের ম্যানেজার?”

“অনেক লম্বা, সরু চোখ…”

“ওহ, নাগারে…”

“হ্যাঁ!”

লোকটা নাগারেকে চেনে অন্তত। নিজের অজান্তেই সামনে ঝুঁকে বসলো কেই।

“নাগারে এখন হোক্কাইদোতে।”

“হোক্কাইদো…”

“হ্যাঁ।”

কেই এতটাই অবাক হয়েছে যে আবারো জিজ্ঞেস করলো লোকটাকে, “কী? হোক্কাইদো?”

“হ্যাঁ।”

কেইয়ের মাথা চক্কর দিলো একবার। কোনো কিছুই পরিকল্পনা মোতাবেক এগোচ্ছে না। নাগারেকে আজ অবধি কখনো হোক্কাইদোর ব্যাপারে কিছু বলতে শোনেনি সে।

“কিন্তু কেন?”

“এই ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না, সরি,” ডান ভ্রুর উপরে হাত বুলিয়ে বললো লোকটা।

দমবন্ধ লাগছে কেইয়ের। হিসেব মিলছে না কিছুতেই।

“ওহ, আপনি কী নাগারের সাথে দেখা করতে এখানে এসেছেন?” কেইয়ের আসার উদ্দেশ্য সম্পর্কে লোকটা কিছু জানে না, তাই অনুমান ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জবাব দেওয়ার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেছে ও। পুরো বিষয়টা অর্থহীন ঠেকছে। কোনো কিছু করার আগে খুব বেশি ভাবে না সে; ঝোঁকের বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তাই হুটহাট এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে হতবুদ্ধি হয়ে যায়। কী ভুল হলো সেটা আর মাথায় আসে না। ভেবেছিল, ভবিষ্যতে আসতে পারলে বাচ্চাটার সাথে দেখা হবে। মন খারাপের ছাপটা ওর চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ইচ্ছা

“আপনি কী কায়ুর সাথে দেখা করতে এসেছেন?” লোকটা জিজ্ঞেস করলো এবারে।

“ওহ!” আশার ক্ষীণ আলো যেন খুঁজে পেয়েছে কেই।

এই কথাটা কীভাবে ভুলে গেছে ও! লোকটাকে এতক্ষণ কেবল ম্যানেজারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু আসল ব্যাপারটাই ভুলে বসে আছে। ওকে ভবিষ্যতে পাড়ি জমানোর ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছিল কায়ু। সে-ই কথা দিয়েছে যে ভবিষ্যতে তার সন্তানের সাথে দেখা করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। নাগারে হোক্কাইদো থাকুক, কোনো সমস্যা নেই। কায়ু যদি আশপাশে থেকে থাকে, তাহলে আর চিন্তা নেই। উদ্দীপনা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলো কেই।

“কাযুর কী খবর?”

“জি”

“কাযু! ও আছে এখানে?”

লোকটা যদি ওর সামনে থাকতো, তাহলে হয়তো তার শার্টটাই আঁকড়ে ধরতো কেই।

ওর দৃষ্টির সামনে যেন কুকড়ে গেল লোকটা। পিছিয়ে গেল কয়েক পা।

“ও এখানে আছে নাকি নেই?”

“আসলে, দেখুন…” দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো লোকটা। কেইয়ের প্রশ্নবাণে খেই হারিয়ে ফেলেছে।

“ইয়ে মানে…কাযুও এখন হোক্কাইদোতে,” সাবধানে কথাটা বললো সে।

শেষ আশাটাও গেল… লোকটার জবাব শুনে মিইয়ে গেল কায়ুর সমস্ত উৎসাহ উদ্দীপনা।

“কাযুও নেই!”

উদ্‌বিগ্ন দৃষ্টিতে কেইয়ের দিকে তাকালো লোকটা। ওকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সমস্ত জীবনশক্তি শুষে নেওয়া হয়েছে।

“আপনি ঠিক আছেন?”

দেখতেই তো পাচ্ছেন ঠিক আছি কিনা, এমন দৃষ্টিতে মুখ তুলে তাকালো কেই। তবে লোকটার কোনো দোষ নেই। সে তো আর জানে না কেইয়ের এখানে আসার হেতু। তাই রূঢ় কিছু বলাটা একদমই উচিত হবে না।

“হ্যাঁ, ঠিক আছি…” কোনমতে বললো ও।

বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে একবার মাথা কাত করে আবারো কাউন্টারের পেছনে চলে গেল লোকটা।

পেটের উপরে হাত নিয়ে এলো কেই।

ওরা দুইজন হোক্কাইদোতে কী করছে, জানি না। কিন্তু ওরা যদি আসলেই ওখানে থেকে থাকে, তাহলে আমার বাচ্চাটাও ওখানেই আছে…আমার আর তার সাথে দেখা হলো না।

হতাশ ভঙ্গিতে নুয়ে পড়লো কেইয়ের কাঁধজোড়া। সত্যি বলতে, দেখা যে না-ও হতে পারে এই আশঙ্কা সবসময়ই ছিল। পুরো বিষয়টাই অনেকটা জুয়ার মতোন। ভাগ্য সহায় হলে হয়তো দেখা হতেও পারতো। ভবিষ্যতে এসে নির্দিষ্ট কারো সাথে দেখা করা যদি এতই সহজ হতো তাহলে আরো অনেক বেশি মানুষ চেষ্টা করত ভবিষ্যতে পাড়ি জমানোর।

উদাহরণস্বরূপ, ফুমিকো কিয়োকাওয়া এবং গোরো যদি তিন বছর পর এই ক্যাফেতে দেখা করবে বলে একে অপরকে কথা দিত, তাহলে একটা সম্ভাবনা ছিল তাদের দেখা হবার। কিন্তু এজন্যে গোরোকে ফিরতে হতো আমেরিকা থেকে। আবার নানাবিধ কারণে হয়তো প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা সম্ভব হয়ে উঠতো না তার পক্ষে। আসার পথে ট্র্যাফিক জাম কিংবা ছোটখাটো দুর্ঘটনায় দেরি হয়ে যেতে পারে, রাস্তা হারিয়ে ফেলতে পারে। এমনকি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাগড়া দিতে পারে পরিকল্পনা। কিংবা এটাও সম্ভব যে সময়টা গুলিয়ে ফেলেছে সে। অর্থাৎ, খুব সামান্য সব কারণে দুজনে মানুষের দেখা না হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ভবিষ্যৎসংক্রান্ত সবকিছুই এরকম অনিশ্চিত

নাগারে এবং কায়ুর হোক্কাইদোতে থাকার পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। হোক্কাইদো এখান থেকে প্রায় হাজার কিলোমিটার দূরে।

তারা টোকিওতে নেই, এটা শুনে কেই অবশ্যই অবাক হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে এক মাইল দূরে থাকলেও কেইয়ে সাথে দেখা হতো না তাদের। আসতে আসতে কফি ঠান্ডা হয়ে যেত।

আর ও যদি বর্তমানে ফিরে নাগারে আর কাযুকে ঘটনাটা বলে, তবুও কোনো লাভ হবে না কারণ ভবিষ্যতে এসে যা-ই করা হোক না কেন, বর্তমানে সেটার কোনো প্রভাব পড়বে না। ওর ভাগ্যটাই খারাপ, আর কিছু না। বুকে চেপে থাকা পাথরটা একটু হালকা মনে হচ্ছে এখন। নিয়তির সাথে লড়াই করে কোনো লাভ নেই। কফির কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিলো একবার। এখনো বেশ গরম আছে। খুব তাড়াতাড়ি মনমেজাজ বদলে যায় কেই এর, এটা তার একটা গুণ। আর এই কারণেই সবসময় হাসিখুশি থাকতে পারে সে। হ্যাঁ, জীবনে উপর-নিচ থাকবেই। তাই বলে সারাক্ষণ সেটা নিয়ে পড়ে থাকা চলবে না। বাচ্চাটার সাথে দেখা হলো না, কিন্তু ওর কোনো আফসোস নেই। নিজের ইচ্ছায় ভবিষ্যতে এসেছে ও। নাগারে কিংবা কাযুর প্রতিও কোনো প্রকার বিরূপ মনোভাব নেই। এখানে না আসার পেছনে তাদের যুক্তিযুক্ত কোনো কারণ আছে। দুই ভাই-বোনকে কেই যতটা চেনে, ওর সাথে দেখা করার জন্য নিশ্চয়ই সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে তারা।

আমার কাছে হয়তো মনে হচ্ছে যে কয়েক মিনিট আগেই কথা দিয়েছিল কায়ু, কিন্তু আদতে এখানে ওদের জীবনের দশ বছর কেটে গেছে। যে-কোনো কিছু ঘটতে পারে এই সময়ের মাঝে। কিছু করার নেই। ফিরে গিয়ে নাহয় ওদেরকে বলবো যে দেখা হয়েছিল…

চিনি রাখার পাত্রটার দিকে হাত বাড়ালো কেই।

.

সবে কফিতে চিনি ঢালার কথা ভাবছে এমন সময় ঘণ্টার সময় কানে এলো। অভ্যাসবশত কেই ‘স্বাগতম!’ বলে উঠতে যাবে তার আগেই লোকটা ওর মুখের কথা টেনে নিলো

ঠোঁট কামড়ে ধরে প্রবেশপথের দিকে তাকালো কেই।

“ওহ, তুমি,” লোকটা বললো।

“হ্যাঁ, চলে এসেছি,” যে মেয়েটা জবাব দিলো তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বয়স চৌদ্দ বা পনেরো। জুনিয়র হাইস্কুলে ছাত্রী বোধহয়। গ্রীষ্মকালীন পোশাক পরনে। হাতাকাটা সাদা শার্ট, ক্রপড ডেনিম ট্রাউজার আর স্যান্ডেল। চুলটা খুব সুন্দর করে পনিটেইল স্টাইলে বাঁধা।

আরে…এই মেয়েটাকেই তো দেখেছিলাম সেদিন ক্যাফেতে।

তাকে চিনতে কোনো অসুবিধে হলো না কেইয়ের। ভবিষ্যৎ থেকে এসে ওর সাথে ছবি তুলতে চেয়েছিল মেয়েটা। তখন অবশ্য শীতকালীন পোশাক পরে ছিল সে। চুলটাও ছোট ছিল বিধায় একটু অন্যরকম দেখাচ্ছিল। কিন্তু কেইয়ের নজর কেড়েছিল মেয়েটার মিষ্টি চোখ জোড়া।

এখানেই তাহলে দেখা হয়েছিল আমাদের।

আনমনে মাথা নেড়ে বুকের উপরে হাত ভাঁজ করে করে বসলো কেই। মেয়েটা তাকে কীভাবে চেনে সেটা ভেবে ওইদিন অবাক হলেও, এখন আর ব্যাপারটা রহস্যজনক মনে হচ্ছে না।

“আমরা একসাথে একটা ছবি তুলেছিলাম, তাই না?” মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে কেই।

জবাবে বিস্মিত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো মেয়েটা। “সরি, আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”

ওহ… ভুল করেছে কেই।

মেয়েটা এখনো অতীতে ফেরেনি। সেজন্যেই ওর প্রশ্নটা বুঝতে পারছে না।

“না, কিছু না। ভুলে বলেছি,” হেসে বললো কেই। কিন্তু মেয়েটাকে বিচলিত মনে হচ্ছে। আলতো করে একবার মাথা ঝুঁকিয়ে পেছনের রুমে চলে গেল সে।

এখন ভালো লাগছে।

কিছুক্ষণ আগের তুলনায় আসলেও কিছুটা খুশি কেই। নাগারে এবং কাযুর সাথে দেখা করতে এসে কাউন্টারের পেছনে ওই অচেনা লোকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গিয়েছিল সে। চেনা কারো সাথে দেখা না করেই বর্তমানে ফিরে যেতে হবে ভাবতেই মন খারাপ লাগছিল। কিন্তু মেয়েটা আসায় সমীকরণ বদলে গেছে। চকিতে একবার কাপ ছুয়ে দেখলো যে কফিটা গরম আছে কি না।

কফি ঠান্ডা হবার আগেই মেয়েটার সাথে বন্ধুত্ব পাতাতে হবে।

এই কথাটা ওর মাথায় আসতেই হঠাৎ হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। দশ বছর পরে একটা পরিচিত মুখের দেখা পেয়েছে ও।

মেয়েটা পেছনের রুম থেকে ফিরে এলো এই সময়।

ওহ…

একটা লাল রঙের অ্যাপ্রন মেয়েটার হাতে।

এটা তো আমার অ্যাপ্রন!

ভবিষ্যতে আসার মূল উদ্দেশ্যটা ভুলে যায়নি কেই। কিন্তু যা সম্ভব না, সেসবের পেছনে সময় নষ্ট করার মতো বান্দা নয় ও। ইতোমধ্যে পরিকল্পনা বদলে ফেলেছে। মিষ্টি মেয়েটার সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে।

রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে একবার মেয়েটাকে দেখলো সেই লোকটা।

“আজকে তোমাকে সাহায্য করতে হবে না। কাস্টমার বলতে…কেবল একজন।”

কিন্তু কোনো কথা না বলে কাউন্টারের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো মেয়েটা। লোকটা কথা না বাড়িয়ে আবারো মনোযোগ দিলো নিজের কাজে। মেয়েটা কাউন্টার মুছতে শুরু করলো।

ক্যাফের কাজে সাহায্য করে সে, তাহলে কী এই লোকটার মেয়ে? মনে মনে বিভিন্ন সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে শুরু করলো কেই।

বিপ-বুপ বিপ-বুপ…বিপ-বুপ বিপ-বুপ

পেছনের ঘরটা থেকে ফোনের শব্দ ভেসে এলো এসময়

“আমি…” ফোনের জবাব দেওয়ার অদম্য ইচ্ছাটা আবারো দমিয়ে ফেলতে বাধ্য হলো কেই। দশ বছর হয়তো কেটে গেছে, কিন্তু ফোনটার শব্দ বদলায়নি।

আরেকটু হলেই বিপদে পড়ে যেতাম।

ফোন ধরার জন্য চেয়ার ছেড়ে ওঠা মাত্র বর্তমানে ফিরে যেত কেই।

“আমি ধরছি,” রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললো লোকটা। কপাল থেকে ঘাম মোছার ভঙ্গি করে স্বস্তির নিঃশ্বাসটা গোপন করলো কেই। লোকটার কথা শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট।

“হ্যাঁ, হ্যালো? ওহ আপনি! হ্যাঁ, আছে তো…আচ্ছা। দাঁড়ান, দিচ্ছি।” পেছনের ঘর থেকে হঠাৎই বেরিয়ে এলো সে।

কী হয়েছে?

ফোনটা কেইয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরেছে লোকটা। “ফোন,” বলে হ্যান্ডসেটটা ওর হাতে তুলে দিলো।

“আমার জন্য?”

“নাগারে ফোন করেছেন।”

নাগারের নাম শুনে দ্রুত হ্যান্ডসেটটা কানে ঠেকালো কেই।

“হ্যালো! তুমি হোক্কাইদোতে কী করছো?” পুরো ক্যাফেতে গমগম করে উঠলো কেইয়ের কণ্ঠস্বর।

বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে আবারো রান্নাঘরে ফিরে গেল লোকটা। কী ঘটছে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।

মেয়েটার মধ্যে অবশ্য কোনো বিকার নেই, যেন কেইয়ের কথাগুলো কানেই ঢোকেনি তার। একমনে নিজের কাজ করে যাচ্ছে।

“কী বললে? বেশি সময় নেই তোমার হাতে? আমার হাতে বেশি সময় নেই!” কফিটা ঠান্ডা হয়ে আসছে খুব দ্রুত। “তোমার কথা তো ঠিকমতো বোঝাই যাচ্ছে না! কী?” হ্যান্ডসেটটা বাম কানে চেপে ধরে আরেক হাত ডান কানের উপরে নিয়ে এলো কেই। কেন যেন লাইন বড্ড বেশি অস্পষ্ট।

“কী? স্কুলে পড়া একটা মেয়ে?” নাগারের বলা কথাগুলোই পুনরাবৃত্তি করছে ও। “হ্যাঁ, মেয়েটা আছে এখানে। দুই সপ্তাহ আগে ক্যাফেতে আমার সাথে ছবি তুলতে এসেছিল কিন্তু মেয়েটা। হ্যাঁ, হ্যাঁ। কী হয়েছে?” মেয়েটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো কেই। দেখে মনে হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে চোখ নামিয়ে রেখেছে সে। কাজ করতে করতে হঠাৎই হাত থেমে গেল তার।

এত নার্ভাস দেখাচ্ছে কেন ওকে? কেই ভাবলো। বিষয়টা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই খোঁচাচ্ছে ওকে। কিন্তু আপাতত নাগারের কথায় মনোযোগ দেওয়াই শ্রেয়।

“তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি না। কী? হ্যাঁ? এই মেয়েটা?”

আমাদের মেয়ে।

ঠিক এই মুহূর্তে দেওয়ালে ঝোলানো মাঝখানের ঘড়িটা বেজে উঠলো। ডং…ডং…ডং… দশবার।

প্রথমবারের মতো কেই বুঝতে পারলো যে এখন সময় কত। দুপুর তিনটায় নয়, বরং সকাল দশটায় ক্যাফেতে পা রেখেছে ও। হাসিটা মুছে গেল মুখ থেকে। “আচ্ছা, ঠিক আছে,” দুর্বল কণ্ঠে বলে হ্যান্ডসেটটা নামিয়ে রাখলো টেবিলে।

এতক্ষণ মেয়েটার সাথে কথা বলার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ছিল ও। কিন্তু এখন সেই উৎসাহে ভাটা পড়েছে। বরং সদা সদীপ্ত দু’চোখে ভর করেছে অবসাদ। মেয়েটা কাজ থামিয়ে চোখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাকেও অন্যরকম দেখাচ্ছে। কাপে হাত রেখে কেই খেয়াল করলো যে কফি এখনো খানিকটা গরম। পুরোপুরি ঠান্ডা হয়ে যেতে সময় লাগবে আরো কিছুক্ষণ।

আবারো মেয়েটার দিকে তাকালো ও।

আমার সন্তান…

এই উপলব্ধির সামনে বোবা হয়ে গেছে সব অনুভূতির দল। ফোনে নাগারের কথা পুরোপুরি শোনা না গেলেও সারকথাটা ঠিকই বুঝেছে কেই।

তুমি দশ বছর ভবিষ্যতে যেতে চেয়েছিলে, কিন্তু কোনো একটা ভুলের কারণে পনেরো বছর সামনে চলে গেছ। দশ বছর পর ১৫.০০ ( বিকেল তিনটা) এবং পনেরো বছর পর ১০.০০ এই সময় দু’টোর মধ্যে তালগোল পাকিয়ে গেছে। তুমি ভবিষ্যৎ থেকে ফেরার পর কথাটা বলেছিলে আমাদের। এখন আপাতত হোক্কাইদোতে আছি আমি, কারণটা বলতে পারছি না সময়ের অভাবে। যে মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছো তুমি, সে আমাদের মেয়ে। তোমার হাতে খুব বেশি সময় নেই। তাই একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বর্তমানে ফিরে যাও।

এটুকু বলার পর ইচ্ছা করেই লাইন কেটে দিয়েছে নাগারে যাতে ওর সময় নষ্ট না হয়। সামনে দাঁড়ানো মেয়েটাই ওর সন্তান, এটা জানার পর কথা খুঁজে পাচ্ছে না কেই।

বরং বিভ্রান্তি আর উদ্‌বেগ ছাপিয়ে এখন আফসোস কাজ করছে মনে।

আফসোসের কারণটা অবশ্য একদমই সাধারণ। মেয়েটা যে ওর পরিচয় জানে, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কেই ধরে নিয়েছিল মেয়েটা অন্য কারো সন্তান। অবশ্য, বয়সের পার্থক্যটা এই ভুলের জন্য দায়ী। এতক্ষণ খেয়াল না করলেও ঘড়ির কাঁটাগুলোর আওয়াজ স্পষ্ট হয়ে কানে বাজছে এখন। ‘টিক-টক টিক-টক’। কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। একদমই সময় নেই।

মেয়েটার গোমড়া মুখে নিজের অব্যক্ত প্রশ্নটার জবাব খুঁজে নিয়েছে কেই। আমি যে তোমাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসা বাদে আর কিছু করতে পারিনি, এজন্যে আমাকে কী ক্ষমা করা যায়? মনে হচ্ছে যেন একটা অচেনা ছায়ায় ঢাকা পড়েছে ওর হৃদয়টা। মুখ খুলতে বেশ কসরত করতে হলো। “তোমার নাম কী?”

“জবাব না দিয়ে মাথা আরো নিচু করে নিলো মেয়েটা।

ওর সন্তান যে ওকে ক্ষমা করেনি, সেটার সপক্ষে আরো একটা প্রমাণ পেয়ে গেল কেই। নীরবতাটুকু সহ্য করতে না পেরে নিজেও মাথা নিচু করে নিলো সে। ঠিক তখন…

“মিকি….” ক্ষীণ কণ্ঠে নিজের নাম বললো মেয়েটা।

অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল কেইয়ের। কিন্তু মেয়েটার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে কথা বলার ইচ্ছা নেই তার।

“মিকি…সুন্দর নামটা…” এটুকুই বলতে পারলো কেবল।

মিকি কিছু বললো না। বিষণ্ন ভঙ্গিতে মুখ তুলে একবার ওর দিকে তাকালো, এরপর ছুটে গেল পেছনের রুমে। সেই মুহূর্তে আবারো রান্নাঘর থেকে মাথা বের করে উঁকি দিলো লোকটা।

“মিকি, তুমি ঠিক আছো তো?” জিজ্ঞেস করলো সে।

কিন্তু তার কথারও কোনো জবাব দিলো না মিকি।

.

“স্বাগতম!”

লোকটার কথা শেষ হতে না হতেই এক মহিলা পা রাখলো ক্যাফের ভেতরে। ছোট হাতার সাদা ব্লাউজ, কালো ট্রাউজার আর লাল রঙের একটা অ্যাপ্রন তার পরনে। এতক্ষণ নিশ্চয়ই রোদের মধ্যে দৌড়াচ্ছিল সে, পুরো শরীর নেয়ে উঠেছে ঘামে।

“আহ!” কেই চিনতে পেরেছে তাকে।

হাঁপাতে থাকা মহিলার দিকে তাকিয়ে কেইয়ের উপলব্ধি হলো যে আসলেও পনেরো বছর পরের ক্যাফেতে পা রেখেছে। মহিলাটা আর কেউ নয়, ফুমিকো কিয়োকাওয়া। আজকে সকালেই সে ওকে জিজ্ঞেস করেছিল যে শরীর ঠিক আছে কি না। ছিপছিপে শরীরের সেই ফুমিকোর ওজন এখন অনেকটা বাড়তির দিকে।

ফুমিকো খেয়াল করলো যে মিকি নেই কাউন্টারের পেছনে। “মিকি কোথায়?” লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো।

সে নিশ্চয়ই জানতো যে কেই আজকে আসবে ক্যাফেতে। এজন্যেই দৌড়ে এসেছে। ফুমিকোকে এভাবে কথা বলতে শুনে অস্থিরতা ফুটে উঠলো লোকটার হাবভাবে।

“পেছনের রুমে,” জবাব দিলো সে। কী ঘটছে তা এখন অবধি বুঝতে পারছে না।

“কেন?” কাউন্টারে সশব্দে চাপড় মেরে জিজ্ঞেস করলো ফুমিকো।

“কী?”

“তোমাকে নিয়ে আর পারি না!” চোখ পাকিয়ে লোকটার উদ্দেশ্যে বললো ফুমিকো। তবে এসব কথাবার্তায় খুব বেশি সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই, সে নিজেও দেরি করে ফেলেছে আসতে।

“তাহলে, আপনারা ক্যাফের খেয়াল রাখছেন?” কেই দুর্বল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।

“হ্যাঁ,” ফুমিকো ওর দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো। “মিকির সাথে কথা হয়েছে আপনার?”

ফুমিকোর সরাসরি প্রশ্নে থমকে গেল কেই। মাথা নামিয়ে নিলো সে।

“ঠিকমতো কথা হয়েছে?” ফুমিকো নাছোড়বান্দা।

“আসলে…” কথা আটকে যাচ্ছে কেইয়ের।

“আমি ডেকে আনছি ওকে।”

“না, দরকার নেই!” আগের তুলনায় স্পষ্ট কণ্ঠে বললো ফুমিকো, ইতোমধ্যে পেছনের ঘরটার দিকে এগোতে শুরু করে দিয়েছিল সে।

“কেন?”

“যেটুকু হয়েছে, সেটুকুই যথেষ্ট,” কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে ওর। “চেহারাটা দেখে নিয়েছি।”

“উফ, আপনি না…”

“আমার সাথে কথা বলার ইচ্ছা নেই বোধহয় ওর…”

“কে বলেছে? একশোবার আছে!” কেইয়ের কথা উড়িয়ে দিয়ে বললো ফুমিকো। “আপনার সাথে দেখা করার জন্য উদ্‌গ্রীব মিকি। আজকের দিনটার জন্য অপেক্ষা করে আছে অনেক দিন ধরে…’”

“আমার কারণে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে ওকে।”

“সব মানুষের জীবনেই খারাপ সময় আসে। মিকির জীবনও এর ব্যতিক্রম নয়।”

“যেমনটা ভেবেছিলাম…”

কফির কাপের দিকে হাত বাড়ালো কেই। ফুমিকো খেয়াল করলো ব্যাপারটা।

“তাহলে আপনি এভাবেই ফিরে যাবেন?” হতাশ সুরে জিজ্ঞেস করলো সে, যেন কেইয়ের এভাবে চলে যাওয়াটা তার নিজের ব্যর্থতা।

“কষ্ট করে ওকে বলে দিবেন যে আমি অত্যন্ত দুঃখিত…”

কেইয়ের মুখে কথাগুলো শুনে আঁধার ঘনালো ফুমিকোর চেহারায়। “কিন্তু আপনি কী এটা মন থেকে বলছেন? মিকিকে জন্ম দিয়ে আফসোস হয় আপনার? আপনার এভাবে দুঃখ প্রকাশ করার অর্থ হচ্ছে ওর জম্মটাই ভুল!”

আমি ওকে এখনো জন্ম দেইনি। আর ওকে পৃথিবীতে নিয়ে আসার বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহও নেই।

কেইকে না-সূচক মাথা ঝাকাতে দেখে ফুমিকো বললো, “মিকিকে ডাকি!”

এর জবাবে কিছু বলা সম্ভব হলো না ওর পক্ষে।

“নিয়ে আসলাম ওকে।”

এবারে আর কেইয়ের জবাবের অপেক্ষা করে না ফুমিকো। পেছনের রুমে চলে যায় দ্রুত, সময় যে একদমই নেই তা ভালো করেই জানে সে।

“এই, ফুমিকো,” লোকটাও তার পেছন পেছন ভেতরে ঢুকে গেল।

কী করবো আমি।

ক্যাফেতে এখন একা কেই। টেবিলে রাখা কফির কাপটার দিকে তাকালো।

ফুমিকো ভুল কিছু বলেনি। কিন্তু এখন তো আমি আরো বুঝতে পারছি না যে কী বলা উচিত!

এই সময় মিকি বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ফুমিকোর হাত তার কাধে। তবে এখনো সরাসরি কেইয়ের দিকে তাকাচ্ছে না মেয়েটা।

“মা, এরকম সুযোগ কিন্তু আর পাবে না তুমি,” ফুমিকো বললো মিকির উদ্দেশ্যে।

মিকি…

চেষ্টা করেও মেয়ের নাম মুখে আনতে পারলো না কেই।

“আমরা আছি পেছনের রুমে।” বলে চলে গেল ফুমিকো। সে যাওয়ার পরেও চোখ তুললো না মিকি।

কিছু একটা বলতে হবে আমাকে।

কাপ থেকে হাত সরিয়ে লম্বা শ্বাস নিলো কেই। “কেমন আছো তুমি? ভালো?”

“হ্যাঁ,” মুখটা সামান্য উঁচিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দিলো মিকি।

“ক্যাফের কাজে হাত লাগাও?”

“হ্যাঁ।”

এক কথায় সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে মিকি। এভাবে কারো সাথে আলাপ চালানো কঠিন।

“নাগারে আর কায়ু, দু’জনই কী হোক্কাইদোতে?”

“হ্যাঁ।”

মায়ের চোখে এখনো চোখ রাখছে না মেয়েটা। ধীরে ধীরে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে কণ্ঠস্বর। আসলে কথা বলার আগ্রহ নেই তার।

“তুমি এখানে থেকে গেলে কেন?” সাতপাঁচ না ভেবেই জিজ্ঞেস করে বসলো কেই। কিন্তু প্রশ্নটা মুখ থেকে বের হওয়া মাত্র ভীষণ আফসোস হলো। আসলে ও মনে মনে আশা করছিল যে মিকি হয়তো বলবে ওর সাথে দেখা করার জন্যই হোক্কাইদো যায়নি সে। কিন্তু প্রশ্নটা যে মিকির জন্য মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, সেটা নিয়ে ভাবেনি। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো কেই

“আসলে,” হঠাৎ নীরবতা ভেঙে বললো মিকি। “এই সিটটায় বসতে যারা ক্যাফেতে আসে, তাদের জন্য আমিই কফি বানাই।”

“তুমি বানাও?”

“হ্যাঁ, কাযুর মতোন।

“ওহ।”

“এটা এখন আমার দায়িত্ব।”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ।”

এখানেই থেমে গেল মা-মেয়ের আলাপ। কথা বলার মতো আর কিছু খুঁজে না পেয়ে আবারো চোখ নামিয়ে নিলো মিকি। কেইও বুঝতে পারছে না যে কী বলা উচিত্ত।

একজন মা হিসেবে কেবল তোমাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসা ছাড়া আর কিছু করতে পারিনি। আমাকে কী ক্ষমা করা যায়?

কিন্তু ও ক্ষমা আশা করে কীভাবে? মেয়েটার জীবনে নিশ্চয়ই অনেক দুঃখ, যার জন্য দায়ী একমাত্র সে।

মিকির আচরণ দেখে এখন কেইয়ের মনে হচ্ছে যে ভবিষ্যতে এসে আসলে ভুলই হয়েছে। চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না নিজের সন্তানের দিকে। অগত্যা টেবিলে রাখা কফি কাপের উপিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো ও।

এখন আর ধোঁয়া উড়ছে না। হাত দিয়ে কাপের তাপমাত্রা অনুভব করে কেই বুঝতে পারলো যে খুব বেশি সময় হাতে নেই।

এখানে কী করতে এসেছিলাম আমি? এসে কী আদৌ কোনো লাভ হয়েছে? পুরোপুরি অনর্থক। বরং মিকি কষ্ট পাচ্ছে। আমি অতীতে ফিরে গেলে বেচারির দুঃখের পরিমাণ আরো বাড়বে। এই বিষয়টাকে তো কোনভাবে প্রভাবিত করা সম্ভব নয়। কোহতাকে যেমন অতীতে ফিরে গিয়েও ফুসাগির অসুখ ঠিক করতে পারেনি। আবার হিরাইও বাঁচাতে সক্ষম হয়নি বোনকে।

কোহতাকে ওর আরাধ্য চিঠিটা পেয়েছে। হিরাই দেখা করেছে বোনের সাথে। কিন্তু বর্তমানের ফুসাগির শরীর খারাপ হচ্ছে ক্রমশ আর হিরাইয়ের বোন পাড়ি জমিয়েছে জীবনের ওপারে।

ভবিষ্যতে আসার ইচ্ছাটা পূরণ হলেও, প্রচণ্ড খারাপ লাগছে কেইয়ের।

“কফি ঠান্ডা হওয়ার আগেই ফিরে যেতে হবে আমাকে,” বলে কফির কাপটা তুলে নিলো কেই।

ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে।

কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে পদশব্দ কানে এলো ওর। মিকি এসে দাড়িয়েছে টেবিলটার সামনে।

মিকি।

মিকির মাথায় কী ঘুরছে কে জানে। কিন্তু তার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না কেই।

লম্বা শ্বাস নিলো মিকি। “একটু দাঁড়ান…” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো মেয়েটা। “ফুমিকো ভুল বলেনি।”

মনোযোগ দিয়ে প্রতিটা কথা শুনছে কেই।

“সবসময়ই আমি চেয়েছি যাতে আপনার সাথে একবার হলেও দেখা হয়। কী বিষয়ে কথা বলবো সেটাও ঠিক করে রেখেছিলাম।”

কেইয়েরও বলার মতো অনেক কিছু আছে।

“কিন্তু বাস্তবে আপনাকে দেখে বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না।”

কেই নিজেও কিছু বলতে পারেনি। মিকির মনে কী চলছে, সেই বিষয়ে নিশ্চিত ছিল না ও। তাই বেফাঁস কিছু বলে বসতে চায়নি।”

“তবে হ্যাঁ…মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়েছে বেশ কিছু ব্যাপারে।”

কেই বুঝতে পারছে মিকির কথা। কিছু বিষয়ে মায়েদের সাথে কথা না বললে হয় না মেয়েদের। কিন্তু মিকি বঞ্চিত হয়েছে এরকম সব অভিজ্ঞতা থেকে।

আমি চাইলেও তোমার জীবন থেকে কষ্টের মুহূর্তগুলো মুছে ফেলতে পারবো না।

“কিন্তু…” এতক্ষণে হাসি ফুটেছে মেয়েটার মুখে। আরো এক পা সামনে এগিয়ে এলো সে। “আমাকে আপনি যে জীবনটা দিয়েছেন, সেটার জন্য আমি অনেক খুশি।”

মায়ের সাথে সদ্য দেখা হয়েছে মিকির। এত অল্প সময়ের পরিচয়ে এরকম কিছু বলতে সাহস লাগে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কথাগুলো বললেও, এগুলো যে তার মনের কথা, সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু …

কেইয়ের চোখ থেকে ফোঁটায় ফোটায় গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।

কিন্তু তোমাকে একমাত্র জন্ম দেওয়া ছাড়া তো কিছু করতে পারিনি আমি।

মিকিও কাঁদছে। কিন্তু একটু পরেই দুই হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে হেসে উঠলো সে।

“মা।”

মিকির কণ্ঠে দ্বিধা।

একটা মাত্র শব্দ যে পুরো শরীরে এমন শিহরন জাগাতে পারে, তা জানতো না কেই।

কিন্তু আমি তো তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি।

দুই হাতে মুখ চেপে কাঁদতে লাগলো কেই। কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে পুরো শরীর।

“মা।”

আবারো মেয়ের মুখের ডাক শুনে ঘোর কেটে গেল ওর। বিদায় জানাতে হবে এখন।

“হ্যাঁ, মা,” হেসে বললো কেই।”

“ধন্যবাদ,” দরাজ হেসে বললো মিকি। এখন আর আত্মবিশ্বাসের কোনো কমতি নেই তার মধ্যে। “আমাকে জন্ম দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

“মিকি।”

“মা।”

খুশিতে ভরে উঠলো কেইয়ের মন। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার মা ও। মা। নিজের অজান্তেই আবারো টপটপ করে পানি গড়াতে লাগলো ওর গাল বেয়ে।

এখন বুঝতে পারছি।

কোহতাকের বর্তমান জীবনে সেরকম কিছু বদলায়নি ঠিকই, কিন্তু সে সবাইকে তার কুমারী নাম ধরে ডাকতে নিষেধ করেছে। ফুসাগির প্রতি তার ব্যবহারেও পরিবর্তন এসেছে। স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই একসাথে থাকছে দু’জন। যদিও ফুসাগি পুরোপুরি ভুলে গেছে তাকে। হিরাই তার জনপ্রিয় ইজাকায়াটা ছেড়ে দিয়ে আবারো পারিবারিক ব্যবসায় সাহায্য করছে। নিজের বাবা-মা’র সাথে ফাটল ধরা সম্পর্কটা ঠিক করে তোলার পাশাপাশি নতুন নতুন কাজও শিখছে তাদের কাছ থেকে।

বর্তমানে কিছু বদলাবে না।

ফুসাগির কোনো পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু কোহতাকে এখন আর আগের মতোন হতাশ হয়ে পড়ে না তার সাথে কথা বলতে গেলে। হিরাই নিজের বোনকে হারিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ই-মেইলে পাঠানো ছবিটায় আবার হাসিমুখে বাবা-মা’র সাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে তাকে।

চোখ বন্ধ করে ফেললো কেই।

যে জিনিসগুলোর নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নেই, সেসব নিয়ে ভাবতে এত ব্যস্ত ছিলাম যে সবচেয়ে জরুরি ব্যাপারটাই ভুলে গেছি।

গত পনেরো বছর ধরে ফুমিকো পাশে আছে মিকির। নাগারেও বাবার দায়িত্ব পালন করছে। মেয়ের প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি নেই তার মধ্যে। আবারো কাযুও কেইয়ের অনুপস্থিতি নিশ্চয়ই কোনোদিন বুঝতে দেয়নি মিকিকে। একই সাথে মা আর বড় বোনের ভূমিকা পালন করছে সে। গত পনেরো বছর ধরে এত ভালো ভালো মানুষগুলো মায়ার বাঁধনে বেঁধে রেখেছে মিকিকে।

ওর দেখভাল করার জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞ আমি। আদরযত্ন না পেলে নিশ্চয়ই এভাবে প্রাণবন্তভাবে বেড়ে উঠতে পারত না। গভীর প্রশান্তিবোধে ছেয়ে উঠলো কেইয়ের মন।

“মিকি…” চোখ না মুছেই হেসে বললো কেই। “তোমার মা হতে পেরে আমি গর্বিত।”

.

ভবিষ্যৎ থেকে যখন বর্তমানে ফিরে এলো কেই, তখনও তার চোখে পানি। তবে সেটা যে আনন্দাশ্রু, তা বুঝতে অসুবিধে হলো না কারোই।

অনেকক্ষণ ধরে শ্বাস চেপে রেখেছিল নাগারে। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছুটলো তার।

কান্নায় ফেটে পড়লো কোহতাকে।

কাযু অবশ্য কাঁদলো না। কিন্তু তার মুখের হাসিটা দেখে মনে হবে যেন পুরো ঘটনাটাই তার চোখের সামনে ঘটেছে।

পরদিন, একটা হাসপাতালে ভর্তি হলো কেই। পরের বছর বসন্তে তার কোলজুড়ে এলো একটা ফুটফুটে মেয়ে।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটায় বলা হয়েছিল, “সিটটায় বসে অতীত কিংবা ভবিষ্যতে পাড়ি জমাতে পারবেন আপনি, কিন্তু দিনশেষে বর্তমানের কিছুই বদলাবে না। সেক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, সিটটার কার্যকরিতা কী?”

কিন্তু কায়ু এখনো বিশ্বাস করে যে কেউ যত বড় সমস্যাতেই পড়ুক না কেন, যদি মনের জোর থাকে, তাহলে কোনো সমস্যাকেই আর সমস্যা মনে হবে না। আর চেয়ারটা সেই কাজেই সাহায্য করে সবাইকে।

তবে কাউকে অতীত বা বর্তমানে পাঠানোর আগে প্রতিবার একইরকম নিস্পৃহ কণ্ঠে সে বলবে, “ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার আগেই কফি শেষ করতে হবে আপনাকে।”

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *