মাৎসন্যায়
প্রকাণ্ড ঝিলে অনেক মাছ বাস করে।
একদল ছোকরা মাছ ঝিলময় খেলিয়া বেড়ায়। তাহারা সবে কৈশোর অতিক্রম করিয়া যৌবনে পদার্পণ করিয়াছে, ওজন তিন পোয়ার বেশী নয়।
ছোকরা দলের মধ্যে একটি তরুণ মাছের মনে কিন্তু সুখ নাই। তাহার বিশ্বাস, তাহার মস্তিষ্কে অন্যদের চেয়ে বেশী ঘি আছে; তাই তাহার খেলাধূলা লাফালাফি ভাল লাগে না। যাহা কিছু আনন্দদায়ক তাহাকেই সে অবজ্ঞার চক্ষে দেখে। সে চায় সত্যের সাক্ষাৎ, বাস্তবের অপরোক্ষ অনুভূতি। সমবয়স্ক সঙ্গীদের ক্রীড়া-কৌতুক, রঙ্গ-রস তাহার অত্যন্ত খেলো বলিয়া মনে হয়।
একদিন সে ভাবিয়া চিন্তিয়া পাকা রুইয়ের কাছে গেল।
পাকা রুইয়ের অনেক বয়স; বিজ্ঞ বলিয়া তাহার খ্যাতি আছে। বেশী নড়িতে চড়িতে পারে না; রাঙা গায়ে শ্যাওলা জমিয়াছে। ঝিলের সব চেয়ে গভীর অংশে পাঁকের উপর বসিয়া পাকা রুই দু’একটি বুদ্বুদ ছাড়িতেছিল এবং পলকহীন চক্ষে তাহাদের ঊর্ধ্বগতি নিরীক্ষণ করিতেছিল; ছোকরা মাছ তাহার কাছে গিয়া বসিল।
চোখ বাঁকাইয়া পাকা রুই ছোকরাকে দেখিল, ল্যাজ একটু নাড়িয়া তাহাকে সম্ভাষণ করিল, ‘কি হে ভায়া, এদিকে কি মনে করে?’
ছোকরা মাছ কয়েকবার কান্কো খুলিয়া জোরে জোরে নিশ্বাস লইল, ‘আপনি এত নীচে থাকেন কি করে? আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসছে।’
পাকা রুই একটু হাসিয়া দুইটি বুদ্বুদ ঊর্ধ্বে প্রেরণ করিল, ‘তোমার এখন বয়স কম, ভায়া, গভীর জলের মর্ম বুঝবে না। —কি চাও বলো?
ছোকরা বলিল, ‘বাস্তবকে জানবার জন্যে আমার প্রাণ বড় ব্যাকুল হয়েছে। আপনি বাস্তবের সন্ধান দিতে পারেন?
ঘোলা চোখ দিয়া পাকা রুই কিছুক্ষণ ছোকরাকে নিরীক্ষণ করিল, ‘যে জল-বাতাসে রয়েছ, তাতে বুঝি আর মন উঠছে না?’
ছোকরা বলিল, ‘না। আমি চাই উলঙ্গ সত্য—কঠিন বাস্তব; এসব ছেলেখেলা আমার ভাল লাগে। আপনি শুনেছি জ্ঞানী, ঝিলে আপনার মতো প্রবীণ আর কেউ নেই। তাই আপনার কাছে। এসেছি।’
‘বেশ করেছ। আমার পরামর্শ যদি চাও, দলের ছেলে দলে ফিরে যাও।’
‘না। আমি বাস্তবের সন্ধান চাই।’
পাকা রুই স্তিমিত নেত্রে কিছুক্ষণ পুচ্ছ স্পন্দিত করিল।
‘আমার ঠোঁটের পাশে একটা কালো চিহ্ন দেখছ?’
‘দেখছি।’
‘ওটা বাস্তবের সীলমোহর। ভাল চাও তো খেলা করো গিয়ে।’
‘না। খেলাতে আমার অরুচি, আমি সত্যিকার জীবন-সাক্ষাৎকার চাই।’
পাকা রুই স্তিমিত একটা নিশ্বাস ফেলিল, কয়েকটি বুদ্বুদ বাহির হইল।
‘বেশ, চলো তবে। আমার কিন্তু দায়-দোষ নেই।’
‘কোথায় যেতে হবে?’
‘পশ্চিম দিকের বাঁধাঘাটে; ঐখানেই বাস্তবের আখড়া।’
‘কিন্তু, সেদিকে যে যাওয়া বারণ। শুনেছি, মৎস্যপুরাণে লিখেছে, ওদিকে গেলে পাপ হয়।’
‘চরম সত্যের সন্ধান পেতে হলে শাস্ত্রের বিধি-নিষেধ পাপ-পুণ্যের কথা ভুলতে হবে।’
‘স্বচ্ছন্দে। আমি ওসব কুসংস্কার ভুলতেই চাই। চলুন, কোথায় নিয়ে যাবেন।’
পাকা রুই তখন ছোকরাকে লইয়া মন্থরগমনে পশ্চিমের বাঁধাঘাটের দিকে চলিল। পথে কয়েকজন ছোকরা মাছের সঙ্গে দেখা হইল; তাহারা সকৌতুকে প্রশ্ন করিল, ‘কিরে, ভূষণ্ডিবুড়োর সঙ্গে কোথায় চলেছিস্?’
সগর্বে পুচ্ছ আস্ফালন করিয়া তরুণ বলিল, ‘বাস্তবের সন্ধানে।’
ঝিলের পশ্চিম দিকে তখন সূর্যের আলো তেরছাভাবে পড়িয়া তল পর্যন্ত আলোকিত করিয়াছে। একটি সূক্ষ্ম সূতা লম্বভাবে স্বচ্ছ জলের মধ্যে ঝুলিতেছে; তাহার প্রান্তে গোলাকৃতি একটি ক্ষুদ্র বস্তু। জলের মৃদু তরঙ্গে সেই ক্ষুদ্র বস্তুটি হইতে একটি অপূর্ব স্বাদ চারিদিকে বিকীর্ণ হইতেছে।
পাকা রুই বেশ খানিকটা দূর হইতে চোখের ঠারে সেই বস্তুটি ছোকরাকে দেখাইয়া বলিল, ‘সুতোর ডগায় ঐ যে ঝুলছে দেখছ, ওটি হচ্ছে জ্ঞানবৃক্ষের ফল। ওটি খেলে আর কিছুই জানতে বাকি থাকবে না।’ —বলিয়াই পাকা রুই পিছু ফিরিল।
ছোকরা মাছ ছুটিয়া গিয়া টোপ গিলিল। সঙ্গে সঙ্গে খ্যাঁচ করিয়া টান! কয়েক মুহূর্ত মধ্যে ছোকরা মাছ ডাঙ্গায় উঠিয়া ধড়ফড় করিতে লাগিল, ‘ওরে বাবারে, গেলুম রে, এ যে নিশ্বাস নিতে পারছি না!’
মানুষের গলা শোনা গেল।
‘আরে দূর, এ যে একেবারে চারা মাছ! ছেড়ে দে, ছেড়ে দে, এখনও অনেক বড় হবে—’
আর একজন বলিল, ‘চারে বড় মাছ এসেছিল, আমি ভাবলুম বুঝি সেইটেই টোপ গিলেছে—’
নির্দয়ভাবে ঠোঁট ছিঁড়িয়া মানুষটা বঁড়শি খুলিয়া লইল। তারপর—ঝপাং! ছোকরা মাছ আবার জলে গিয়া পড়িল।
ঠোঁটের যন্ত্রণা সত্ত্বেও তাহার মনে হইল—আহা, অমৃত! অমৃত! অমৃত!
ছোকরা মাছ দলে ভিড়িয়া গেল।
সকলে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কিরে, এরি মধ্যে ফিরলি যে! বাস্তব-দর্শন হল?’
ছোকরা বলিল, ‘ও কথা যেতে দে। —আয় ভাই, খেলা করি।’
২১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৫১