মাস্টার প্রিন্স – দুলেন্দ্র ভৌমিক

মাস্টার প্রিন্স – দুলেন্দ্র ভৌমিক

জগতের যাবতীয় জন্তুজানোয়ারদের নিয়ে মানুষদের মাত্রাছাড়া কৌতূহল কবে থেকে শুরু হয়েছে, সেটা আমি বলতে পারব না। মানুষ তার বিনোদনের জন্য পশুশালা বানিয়ে তাতে বাঘ, সিংহ, হাতি, জলহস্তী সব আটকে রাখে। ছুটিছাটায় টিকিট কেটে মানুষরা সেইসব দেখতে যায়। যদি কখনো এর উলটোটা ঘটে? বাঘ, সিংহ, হাতি এরা সকলে মিলে জঙ্গলের মধ্যে একটা মনুষ্যশালা তৈরি করল। দামাল হাতির দল আশপাশের গ্রামে গিয়ে শুঁড়ে করে মানুষ তুলে এনে ঢুকিয়ে দিল মনুষ্যশালায়। ছোটো ছোটো বাচ্চাদের পুরে দিল খাঁচায়। আমরা যেমন পাখি কিনে খাঁচায় পুরে তাকে পরম যত্নে পুষি, বড়ো বড়ো পাখিরাও তেমন করে কচিকাঁচা ছেলে-মেয়েদের ধরে-ধরে খাঁচায় ঢুকিয়ে পুষতে লাগল। তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? খুবই মারাত্মক ব্যাপার হবে সন্দেহ নেই। তবে একটাই রক্ষা যে, জন্তুজানোয়াররা তো আমাদের মতো বুদ্ধি ধরে না। ওরা কেবল খাওয়ার জন্যই যা করবার, তাই করে। মানুষকে তো শুধু খেতে দিলেই চলে না, তার আরও অনেকরকম প্রয়োজন আছে। বহুবিধ বায়না এবং বাসনা আছে।

আমি যখন এইসব কথা ভাবছি, তখন আমার ভাগ্নে এসে সগৌরবে আমাকে জানাল, ‘মামু, আমরা সুন্দরবন যাচ্ছি। সজনেখালি টুরিস্ট লজে থাকব। তোমার কে এক বন্ধু আছেন ফরেস্টে থাকেন, তাঁকে একটু বলে দিতে হবে।’

আমি বললাম, ‘কী বলে দেব?’

ভাগ্নে খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল, ‘আমরা বাঘ-টাঘ দেখতে যাচ্ছি। উনি যদি ব্যবস্থা করেন।’

আমি ভাগ্নের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘সুন্দরবনের বাঘগুলো তো ক্রিকেট মাঠের ফিল্ডার না, আর আমার বন্ধুও আজহারউদ্দিন নয় যে, সে বললেই বাঘগুলো ড্রেসিংরুম থেকে দলবেধেঁ মাঠে নামবে তোদের দেখা দিতে।’

ভাগ্নে একটু দমে গেল বটে, কিন্তু হাল ছাড়ল না। ওর ভাবসাব দেখে মনে হল, বাঘ যেন কলকাতার শহিদ মিনার, হাওড়া ব্রিজ অথবা জাদুঘর। একই জায়গায় আছে, তুমি গেলেই দেখতে পাবে।

আমি ধমক দিয়ে বললাম, ‘বেড়াতে যাচ্ছিস বেড়াতে যা, বাঘ দেখার বায়না করিস না। যতক্ষণ না দেখছিস ততক্ষণ ভালো থাকবি। দেখার পর ভালো থাকা তো দূরের কথা, আদৌ থাকবি কিনা সেটাই বলা কঠিন।’

ভাগ্নের বয়স মোটে চব্বিশ। এই বয়সে মনে বাড়তি সাহস থাকে। আর ঘরের মধ্যে, নিরাপদ আশ্রয়ে বসে বাড়তি সাহসটা টগবগিয়ে ফুটতে থাকে। ভাগ্নে আমায় প্রশ্ন করল, ‘তুমি তো অনেকবার সুন্দরবন গেছ। বাঘ দেখেছ?’

আমি উত্তর দিলাম, ‘বারচারেক গেছি। বাঘ দেখিনি, দেখবার চেষ্টা করিনি। যেবার মধ্যরাতে বাঘের গর্জন শুনেছিলাম এবং শুনেই লেপ-তোশক জড়িয়ে যেভাবে খাটের নীচে ঢুকে পড়েছিলাম, সেটা দেখলে বাঘ নিজেই করুণা করে আমাকে ছেড়ে দিত। ওই গর্জন শোনার পর আর কখনো ওমুখো হইনি।’

আমার সাহসী ভাগ্নের গলায় আফশোস উপচে উঠল। সে বলল, ‘তুমি দারুণ মিস করেছ। বাঘের ডাক শুনে তোমার বেরোনো উচিত ছিল। একবার মুখোমুখি হলে তোমার যে অভিজ্ঞতা হত সেটা তো তোমার লেখার একটা বিষয় হতে পারত। পারত কি না বলো?’

এবার আমি সোজা হয়ে বসলাম। ভাগ্নের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললাম, ‘অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই হত, কিন্তু সেটা কি লেখার আর সুযোগ পেতাম! বরং লিখতে পারলে বাঘই লিখে দিত আমার ঘাড় মটকাবার অভিজ্ঞতার চমকপ্রদ কাহিনি।’

ভাগ্নে হতাশ গলায় বলল, ‘তার মানে, এতবার সুন্দরবনে গিয়েও তুমি বাঘ দেখতে পাওনি! আশ্চর্য লোক। তোমার ভাগ্যটাই খারাপ।’

আমি বলি, ‘হয়তো ভাগ্যটা বেজায় ভালো বলেই তাদের মুখোমুখি হতে হয়নি। দর্শন মানে কী, একেবারে মুখোমুখি, যাকে বলে ফেস টু ফেস।’ বাঘের সঙ্গে দেখা হয়েছে একবার।

ভাগ্নে বলে, ‘কোথায়? ওটা কি সুন্দরবনের বাঘ?’

আমি উত্তর দিই, ‘বাঘের গায়ে তো তার নিবাস লেখা ছিল না। অতএব তা বলতে পারব না। তবে তেনাকে দেখেছিলাম ঝিকিরা গ্রামে। আর সময়টা ছিল পৌষ মাস। যা কিছু সর্বনাশ তা ওই পৌষ মাসেই হয় তো।’

ভাগ্নে যেন আহ্লাদে লকলকিয়ে উঠল। আমায় বলল, ‘ওই বাঘ কি তোমায় অ্যাটাক করেছিল? না কি তুমিই…’

আমি বললাম, ‘অত তড়বড় করলে ব্যাপারটা বুঝতে পারবি না। অ্যাটাকের আগেই কেসটা, সেটল হয়ে গেল।’

আমি জানতাম ভাগ্নে কিছুই বুঝতে পারবে না। সে শুধু অবাক চোখে আমাকে দেখতে লাগল। ভাগ্নের কৌতূহল মেটাতে আমার ব্যাঘ্র দর্শনের কাহিনি বলতেই হল। সেই কাহিনিটা এইভাবে শুরু করা যেতে পারে:

তখন আমার বয়স ছাব্বিশ আর সাতাশের মাঝামাঝি। পাকাপাকি কোনো চাকরি তখনও জোটেনি। একটা কাগজে এটা-ওটা লিখে কিছু পয়সা রোজগার করি। এই এটা-ওটা লেখার মধ্যে একটা কাজ ছিল যাত্রা দেখে তার সমালোচনা লেখা। পুজোর পর থেকেই বায়না নিয়ে যাত্রা দলগুলো শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ত গ্রামের দিকে। দলের ম্যানেজারের সঙ্গে গাড়িতে করে আমাকেও যেতে হত কাটোয়া, কালনা, হালিশহর, মৌড়িগ্রাম অথবা ক্ষ্যামাশুলি গ্রামে। যাত্রা দেখে সেই রাত্রেই রওনা দিয়ে ভোরের দিকে বাড়ি ফিরে আসতাম। সেবার এক পার্টির সঙ্গে তাঁদের নতুন পালা ‘সুন্দরবনের সুন্দরী’ দেখতে যেতে হল। ঝিকিরা গ্রামে। সময়টা ছিল পৌষের মাঝামাঝি। সন্ধ্যার মুখে-মুখেই হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে আসতে-আসতে বুঝলাম, বাইরের হাওয়াতে শীতের বেজায় দাপট। গাড়ির কাচ তুলে দিতেই ম্যানেজার গৌরহরি গুছাইত বললেন, ‘চাদরটা গায়ে জড়িয়ে রাখেন। যত ভিতর পানে যাব, ততই দ্যাখবেন শীত কেমন জমিয়ে জম্পেশ হয়ে আছে।’

এসব অভিজ্ঞতা অবশ্য আমারও আছে। অতএব, শীতবস্ত্র সঙ্গে নিয়েই আমি গাড়িতে উঠেছি। কলকাতার যাত্রায় তখন একটা অন্য ধরনের চমক আমদানির চেষ্টা চলছে। কোনো দল আসরে উট আনছেন, কোনো দল হাতি। সুন্দরবনের সুন্দরী-তে আছে সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। কাগজে সেই রয়্যাল বেঙ্গলের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপনও ছাপা হয়েছে। আমি গৌরহরিবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাঘকে কি সত্যি-সত্যি আসরে এনে ছেড়ে দেন?’

গৌরহরিবাবু নস্যি নিচ্ছিলেন। রুমালে নাক মুছে বললেন, ‘একেবারে প্রথমেই ছেড়ে দেওয়া তো একটু রিস্কি। তাই প্রথমে খাঁচায় করে একবার আসরে ঘুরিয়ে নিয়ে যাই। দর্শকরা দেখে আশ্বস্ত হয় যে, সত্যি-সত্যি বাঘ আছে। তারপর নাট্যপালার প্রয়োজনে তাকে তো আসরে আসতেই হয়।’

আমি নিজে আশ্বস্ত হওয়ার তাগিদে জিজ্ঞেস করি, ‘তখনও কি খাঁচায় থাকে?’

আমার প্রশ্ন শুনে গৌরহরিবাবু হো-হো করে এমন অট্টহাস্য করে উঠলেন যে, চিৎপুরের ভাড়াটে ড্রাইভার আকস্মিক এই অট্টহাস্যে ঘাবড়ে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়ে পেছনের সিটের দিকে সভয়ে তাকিয়ে রইল। আমি অবশ্য ঘাবড়াইনি। আমি জানতাম গৌরহরিবাবু যাত্রাদলের ম্যানেজার হওয়ার আগে অভিনেতা ছিলেন। ‘শ্রীচৈতন্য’ পালায় জগাই সেজে প্রভূত নাম করেছিলেন। জগাইকে আসরে এসে প্রত্যেক দৃশ্যে দুবার করে মোট ষোলো দৃশ্যে বত্রিশবার হাসতে হত। প্র্যাকটিস করে সেই যে হাসিটা গলায় বসে গেছে সেটা অভিনয় ছাড়ার পরও গৌরহরিবাবুর গলা ছেড়ে যায়নি। এই হাসির জন্যই তাঁকে সারাজীবন কংস, যমরাজ, কালু সর্দার—এই ধরনের রোল করতে হয়েছে। গৌরহরিবাবুর অট্টহাস্য একদা এমনই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল যে, নায়েকরা দলের বায়না করতে এসে জিজ্ঞেস করতেন, ‘গৌরহরির ক-খানা অট্টহাস্য আছে?’

যদি শুনতেন তিনখানা, তাহলে তাঁরা ব্যাজার মুখে বলতেন, ‘খান পাঁচেক রাখুন না!’

দলের ম্যানেজার বলতেন, ‘ওই হরেদরে পাঁচখানা অট্টহাস্য তো রাখতেই হয়। ভাববেন না, হয়ে যাবে।’

গ্রাম-গঞ্জে যেসব পোস্টার আর হ্যাণ্ডবিল প্রচারের জন্য দেওয়া হত তাতেও উল্লেখ থাকত ‘অট্টহাস্যের সম্রাট গৌরহরির একাধিক পিলে চমকানো অট্টহাস্য’।

অতএব, আমার পিলে না চমকালেও ড্রাইভারের পিলে যে চমকেছে, সেটা আমার বুঝতে অসুবিধে হল না। আগে অট্টহাস্যের পরই সংলাপ বলতেন, কিন্তু এখন বয়েস হয়ে যাওয়ার ফলে একবার অট্টহাস্য করলে একটু দম নিতে হয়। দম-টম নিয়ে গৌরহরিবাবু বললেন, ‘সুন্দরবনের সুন্দরী-তে আসল হিরো হচ্ছে ওই বাঘ। যেখানে অত্যাচার, অন্যায় আর শোষণ, সেইখানেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে ওই বাঘ। অতএব, খাঁচায় রাখলে চলবে কেন? বাঘকে তো আমরা স্রেফ দর্শনধারী, মানে শো-পিস হিসেবে রাখছি না। ওকে দিয়ে অ্যাকটিং করাচ্ছি।’

গৌরহরিবাবুর অট্টহাস্যে আমার পিলে চমকায়নি, কিন্তু বাঘ আসরে অ্যাকটিং করছে, অন্যায় দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, এটা শোনার পর আমার পিলে মুহুর্মুহু চমকাতে লাগল। কারণ, আমি জানি সমালোচক বলে আমাকে খাতির করে বসতে দেবে আসরের পাশে বাজনদারদের কাছাকাছি। অন্যায় দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে যদি আমার ওপরই পড়ে, তাহলে আমায় বাঁচাবে কে?

আমি বললাম, ‘গৌরহরিবাবু, আপনাদের গ্রিনরুম থেকে যাত্রা দেখা যাবে না?’

গৌরহরিবাবু বললেন, ‘ওখান থেকে দেখবেন কেমন করে! আপনাকে তো আসরের পাশেই বিস্তারা পেতে দেব।’

আমি বললাম, ‘তা দেবেন জানি। কিন্তু ঝাঁপাঝাঁপি করতে গিয়ে বাঘটা যদি…’

গৌরহরিবাবু আবার হো-হো করে অট্টহাস্য করে উঠলেন।

আমাদের গাড়িটা একটু লাফিয়ে উঠল বটে, কিন্তু এবার আর থামল না। দম নিয়ে গৌরহরি গুছাইত গুছিয়ে বসে বললেন, ‘ট্রেনিংপ্রাপ্ত বাঘ। একজন ট্রেনার আসরেই থাকে। অন্যজন গ্রিনরুমে। দুজন ট্রেনারের মাইনে কত জানেন?’

আমি বললাম, ‘আজ্ঞে, না।’

গৌরহরিবাবু বললেন, ‘মাসে তিন হাজার টাকা, প্লাস খোরাকি। পার ডে ফিফটি রুপিজ খোরাকি। বাঘের খোরাকিও ফিফটি, ট্রেনারেরও ফিফটি।’

ট্রেনারের মাইনে আর খোরাকি জেনে তো আর বাঘের ভয় যায় না। তাই বললাম, ‘অনেক সময় তো অঘটন ঘটে! কাগজে দেখেননি, যে লোকটা রোজ বাঘকে খেতে দেয় সেই লোকটাকেই বাঘ একদিন খেয়ে ফেলল।’

গৌরহরিবাবু আবার নস্যি নিয়ে বললেন, ‘হতে পারে, তেমন অঘটন হতে পারে। গেল হপ্তায় আমাদের পালা ছিল ক্ষ্যামাশুলিতে। জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসান যাচ্ছিল। ভাসানে দোদমা ফাটানো হয়েছে, চকোলেট বোমা ফাটছে আর তার শব্দ শুনে প্রিন্স তো চঞ্চল হয়ে এমন হুঙ্কার ছাড়ল যে, মা জগদ্ধাত্রীকে রোডে ফেলে সবাই পালাল।’

আমি একটা ঢোক গিলে প্রশ্ন করলাম, ‘প্রিন্স কে?’

গৌরহরিবাবু বললেন, ‘একটা নাম তো দরকার। বাঘ বললে আর কতটুকু বলা যায়। তাহলে তো বলা চলে নায়িকা চরিত্রে একজন মেয়ে। আমরা কি তাই বলি? আমরা বলি সর্বজনস্নেহধন্যা, কিন্নরকন্ঠী মন্দাকিনী দেবী। অবশ্য ওর আসল নাম মঙ্গলা। হিরোইনের নাম মঙ্গলা, এটা চলে না। তাই মন্দাকিনী নাম দিয়ে দিয়েছি। নামের তো মশাই কপিরাইট নেই। তাই বাঘের নাম দিয়েছি মাস্টার প্রিন্স।’

আমি প্রশ্ন করি, ‘মাস্টার কেন? বাঘটা কি কচি?’

গৌরহরিবাবু বললেন, ‘বাঘের আবার কচিকাঁচা। ওই ট্রেনার বলল, ওর এখনও দুধের দাঁত রয়ে গেছে, অতএব ওকে মাস্টার বলতে পারেন। তা ছাড়া শুধু প্রিন্স বললে প্রচারে জোর আসে না। তাই আগে একটা মাস্টার মারলাম। আমাদের নতুন হ্যাণ্ডবিল দেখেননি? চলুন, আপনাকে দেখাব। সেখানে বাঘের ছবি দিয়ে লেখা আছে, জগতে এই প্রথম খোলা আসরে জ্যান্ত বাঘ। বাঘ অভিনয় করবে, গান গাইবে, নাচবে এবং অট্টহাস্য করবে।’

আমার ঢোক গেলার আর বিরাম নেই। আমি বলি, ‘একটু বুঝিয়ে বলবেন? বাঘ গান গাইবে, নাচবে, আবার অট্টহাস্যও করবে?’

গৌরহরিবাবু ব্যাগ থেকে ফ্লাস্ক বের করতে করতে বললেন, ‘আগে একটু চা খান, তারপর সব বুঝিয়ে দিচ্ছি।’

চায়ে চুমুক দেওয়ার পর গৌরহরিবাবু বললেন, ‘গানটা ভেতর থেকে ক্যাসেটে বাজবে। বাঘ শুধু ঠোঁট নাড়ছে। গানটা খুব হিট করছে। গানটা হচ্ছে হালের র‌্যাপ সং। নাচটা তো বাঘকে শিখিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাংলা গানে তো নাচ জমে না, তাই ওখানে হিন্দি ফিল্মের মিউজিক বাজবে, প্রিন্স টাইগার তার সঙ্গে ব্রেক ডান্স দেবে। পনেরো দিন লেগে গেছে প্রিন্সকে নাচ তোলাতে। আর অট্টহাস্যটা আমার। টেপ বাজবে।’

আমার তো ঝিমিয়ে পড়ার অবস্থা। একটা রিভিউ লিখলে মাসখানেক পরে তার বিল পাব। টাকার অঙ্ক মোটে পঞ্চাশ। তার জন্য আজ আমাকে বাঘের মুখে পড়তে হচ্ছে। কিন্তু এখান থেকে তো পালিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। অগত্যা মনে সাহস সঞ্চয় করে বললাম, ‘আপনিও আমার সঙ্গে আসরে বাজনদারদের সঙ্গে বসবেন। দু-জনে মিলে বাঘের গান আর নাচ উপভোগ করব।’

গৌরহরিবাবু বললেন, ‘তা কেমন করে হবে? আমাকে তো গ্রিনরুমে টাকাপয়সা নিয়ে বসতে হবে। দল চালানোর অনেক ঝামেলা।’

একটা বাজারের পাশ দিয়ে আমাদের গাড়িটা যাচ্ছিল। গৌরহরিবাবু গাড়ি থামিয়ে কাঁচাগোল্লা আর জিবেগজা কিনলেন। আমার দিকে সেটা বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘জায়গাটার নাম রসগঞ্জ। রসের মিষ্টির জন্য এটা বিখ্যাত। একবার জিবেগজাটা খেয়ে দেখুন, সাতজন্ম জিভে লেগে থাকবে। আর কাঁচাগোল্লা তো…’

আমি গৌরহরিবাবুকে থামিয়ে দিয়ে বললুম, ‘যতদূর জানি চাঁদপাড়া আর বনগাঁর কাঁচাগোল্লাই তো বিখ্যাত!’

গৌরহরিবাবু জিবেগজা চিবুতে-চিবুতে বললেন, ‘সবই ওয়ানস আপন এ টাইম। এই যে বর্ধমানের মিহিদানা আর সীতাভোগ, এর চেয়ে ভালো জিনিস কলকাতায় পাবেন। কিন্তু বর্ধমানের নাম হয়ে গেছে। ঠিক আমাদের বঙ্গলক্ষ্মী অপেরার মতো। একসময় দারুণ-দারুণ পালা দিয়েছে। ওঁদের ‘রক্তের আলপনা’, ‘সতী পেল না পতি’, ‘মা-হারা সন্তান’, ‘দস্যু কালীরাম’ আর ‘যমের পরাজয়’ এসব তো বিখ্যাত হিট পালা। কিন্তু আজ কী করছে? সব বোগাস! তবুও নামে কাটছে। নাম ভাঙিয়েই পালা পিছু তিরিশ কামাচ্ছে। আমরা বাঘ নাচিয়েও পঁচিশ হাজার পাচ্ছি। ওদের ‘দস্যু কালীরাম’ আর ‘যমের পরাজয়’ পালার বক্স কে ছিল জানেন?’

আমি বললাম, ‘আজ্ঞে না।’

গৌরহরিবাবু বললেন, ‘এগুলো জানুন, জানবার চেষ্টা করুন। এগুলো তো বঙ্গ সংস্কৃতির ইতিহাস। ‘যমের পরাজয়’ পালায় আমি যম সাজতাম। আসলে ওটা সাবিত্রী-সত্যবানের গল্প। তাতে আমার একটা অট্টহাস্য চলত ঘড়ি ধরে তিন মিনিট। গাজোলের ও. সি. ঘড়ি নিয়ে আসরে বসেছিলেন। সেদিন অট্টহাস্য করেছিলাম তিন মিনিট চোদ্দো সেকেণ্ড। ও. সি. তো হতভম্ব! আমায় রুপোর মেডেল দিয়েছিলেন। একটু শুনবেন সেই ঐতিহাসিক অট্টহাস্য?’

আমি উত্তর দেওয়ার আগেই ড্রাইভার বললেন, ‘ওটা গ্রিনরুমে গিয়ে দেখাবেন। আমার ব্রেকটা একটু কমজোরি আছে। যদি ফেল করে!’

রসগঞ্জ পেরিয়ে গিয়ে আমরা ঝিকিরাতে ঢুকলাম। দেখতে পেলাম হেঁটে, সাইকেলে এবং রিকশাভ্যানে বিস্তর লোক যাচ্ছে। গৌরহরিবাবু গাড়ির কাচ নামিয়ে সেটা দেখলেন এবং কাচ তুলতে তুলতে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে জানালেন, ‘সবাই যাচ্ছে ‘সুন্দরবনের সুন্দরী’ দেখতে। আজ নির্ঘাত ব্ল্যাক হবে। ক্ষ্যামাশুলিতে দশ টাকার টিকিট পঁচিশ টাকায় ব্ল্যাক হয়েছে। আজ তিরিশে পৌঁছোবে।’

গৌরহরিবাবু যত কথাই বলুন আমার কিন্তু মনে শান্তি নেই। বাঘ বলে কথা! কখন মেজাজ বিগড়োবে কে জানে! গৌরহরিবাবুর পেছন-পেছন প্রথমে গ্রিনরুমে এসে বসলাম। দলের অন্যান্যরা হাত তুলে আমায় নমস্কার জানাল। খাতির করে উচ্চ আসনে বসতেও দিল। উচ্চ আসন মানে টিনের বড়ো বড়ো কালো বাক্স থাকে না, যাতে যাত্রা দলের সাজপোশাক থাকে তেমনই একটা বাক্সের ওপর মোটা-মোটা দুটো চাদর ভাঁজ করে পেতে দিল। কিন্তু আমার তো বসেও সুখ নেই, দাঁড়িয়েও স্বস্তি নেই। খালি এদিক-ওদিক তাকিয়ে ‘তাঁকে’ সন্ধান করি। গ্রিনরুম মানে যেটাকে সাজঘর বলে তার মধ্যে দুটো ভাগ থাকে। বড়ো ভাগটা পুরুষ শিল্পীদের আর ছোটোটা মহিলা শিল্পীদের। বাঘের মেক-আপ রুম নিশ্চয় এদের সঙ্গে হবে না। ওর জন্য অবশ্যই আলাদা ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু বাঘকে মেক-আপ দেয় কে? আর তার মেক-আপটাই বা কেমন?

এই সময় একটা ছেলে আমার জন্য এক কাপ গরম চা আর দুটো শিঙাড়া নিয়ে এল। ছেলেটি বেজায় বিনয়ী। গ্রিনরুমে ফাইফরমাশ খাটে আর দরকার হলে কোনো কোনো দৃশ্যে জনতা বা পথচারী সেজে আসরে ঢুকে যায়। ছেলেটার ভালো নাম আমি জানি না। ডাকনাম প্যালা। প্যালার জীবনকাহিনিও বড়ো অদ্ভুত। দশ বছর বয়সে সখীর দলে নাচত। তারপর যাত্রা থেকে সখীপর্ব উঠে যাওয়ার পর এই চাকরি করে। এইসব করতে করতেই প্যালা প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল পাশ করে ফেলেছে। পড়াশোনার ব্যাপারে গৌরহরিবাবু ওকে খুবই সাহায্য করেন। স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর দলে ওর মাইনে বাড়ার কথা ছিল। তাই প্রথমেই প্যালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হ্যাঁ রে, তোর মাইনে বেড়েছে?’

প্যালা বলল, ‘পঞ্চাশ টাকা বেড়েছে। এই পালায় ছোটো একটা রোলও করছি।’

আরও দু-চারটে খুচরো কথা বলার পর আসল কথায় এলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘হ্যাঁ রে প্যালা, বাঘের গ্রিনরুম কি আলাদা?’

প্যালা উত্তর দিল, ‘নিশ্চয়ই। ওটা একেবারে পেছন দিকে। ওখানে আমাদের যাওয়া বারণ। দুজন ট্রেনার আর গৌরহরিদা ছাড়া কেউ ওখানে ঢুকতে পারেন না। গেটের সামনে তাই ‘নো অ্যাডমিশন’ লেখা আছে।’

কোনও সংবাদেই কণামাত্র শান্তি পাচ্ছি না। হয়তো আসরে গিয়ে আজ পর্যন্ত শ্রীমান প্রিন্স অঘটন ঘটায়নি, তার মানে তো এই নয় যে, কোনোদিন ঘটবে না। জন্তুজানোয়ারদের মেজাজ যেকোনো সময় বিগড়ে যেতে পারে। আর আজই যদি সেটা হয়! আমি ভেতর ভেতরে ঘামতে লাগলাম।

গৌরহরিবাবু এলেন। হাতজোড় করে বললেন, ‘কনসার্ট শুরু হয়ে গেছে। পয়লা বেলও বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার আসরে চলুন।’

আমি বললাম, ‘আসরে যেতেই হবে, তাই না?’

গৌরহরিবাবু বললেন, ‘আসরে না গেলে দেখবেন কেমন করে! না দেখলে তো লিখতে পারবেন না। চলুন।’

দাঁড়াতে গিয়ে বুঝলাম আমার হাঁটু কাঁপছে। গ্রিনরুমের দরজা পেরোতেই দ্বিতীয় বেল, মানে ঘণ্টা বাজানো হল। তিন নম্বর ঘণ্টার পরই পালা শুরু হবে। আমি যেতে-যেতে বললাম, ‘মাস্টার প্রিন্সের মেক-আপ হয়ে গেছে?’

গৌরহরিবাবু বললেন, ‘ওর মেক-আপ বিশেষ নেই, শুধু গলায় একটা লালরঙের স্কার্ফ বেঁধে দেওয়া হয়।’

আমাকে বসানো হল বাঁশিওয়ালার পাশে। যদি তবলা বা হারমোনিয়ামের পাশে বসতে দিত তাহলেও না হয় বিপদকালে ওর মুখে ডুগিটা পুরে দিয়ে পালাবার চেষ্টা করতে পারতাম। কিন্তু বাঁশি দিয়ে কী হবে?

গৌরহরিবাবু বললেন, ‘ভয় নেই। আপনার উলটো দিকেই ট্রেনার বসে আছে।’

ট্রেনারকে দেখলাম কিন্তু ভরসা পেলাম না। ট্রেনার বিপদকালে আমাকে দেখবে না নিজেকে সামলাবে! কিন্তু কী আর করব! এখন তো আসর ছেড়ে পালাতে পারব না। চুপ করে বসে ওই কনসার্টের বাজনার মধ্যেও নিজের বুকের শব্দ শুনতে লাগলাম। ইতিমধ্যে তিন নম্বর অর্থাৎ ফাইনাল বেল পড়ে গেল। আসরের বাতি মৃদু হল। মাইকে ঘোষণা শোনা গেল, ‘নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার। জনার্দন অপেরার প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। এখন শুরু হচ্ছে এ-বছরের শ্রেষ্ঠতম পালা সু-ন্দ-র ব-নে-র সু-ন্দ-রী-ই ই ই।’ সুন্দর থেকে সুন্দরী পর্যন্ত সবকটা শব্দকে টেনে-টেনে এমন দীর্ঘ করে উচ্চারণ হল যে, পালার নাম উচ্চারণেই প্রায় এক মিনিট গেল। এর পর আরও কিছু ঘোষণার পর গম্ভীর গলায় ঘোষণা করা হল, ‘দর্শক সমাজের কাছে একটি নিবেদন, আমাদের নিবেদনটি মন দিয়ে শুনুন। পালার প্রথম দৃশ্যেই আসরে অবতীর্ণ হবে মাস্টার প্রিন্স। সুন্দরবনের বিখ্যাত রয়াল বেঙ্গল টাইগার। আপনারা ওকে দেখে চায়ের ভাঁড়, ইটের টুকরো কিংবা অন্য জিনিস ওকে লক্ষ্য করে আসরে ছুড়বেন না। তাতে অঘটন ঘটতে পারে। বিপদ এড়াবার জন্য মাস্টার প্রিন্সকে কোনোভাবেই উত্তেজিত করার চেষ্টা করবেন না। ধন্যবাদ। শুরু হচ্ছে…’

আবার সেই টেনে টেনে ‘সুন্দরবনের সুন্দরী’ বলা হল।

একটু পরেই সবাই দেখি মাথা তুলে গ্রিনরুমের দিকে তাকাচ্ছে। গ্রিনরুমের দিক থেকে কোরাসে ভেসে এল, ‘জয় বাবা দক্ষিণ রায়।’

নীচে চাকালাগানো একটা খাঁচা ঠেলতে ঠেলতে দু-জন আসরে এলেন। খাঁচার মধ্যে বেশ বড়োসড়ো একটা বাঘ। এই চেহারাতেও যদি দুধের দাঁত রয়ে যায়, তাহলে ভাতের দাঁত আর কবে গজাবে! বাঘ অবশ্য ভাত খায় না, অতএব ভাতের বদলে মাংসের দাঁত বলাই ভালো। চাকাওয়ালা খাঁচাটাকে দুই ট্রেনার আসরের মধ্যে ঘোরাতে লাগলেন। আর বাঘ খাঁচার মধ্যে বসে হাতজোড় করে দর্শকদের নমস্কার জানাতে লাগল। তাই দেখে দর্শকদের সে কী হাততালি! আমিও তালি বাজালাম। পরে আর কখনো তালি বাজাবার সুযোগ পাব কিনা জানি না। যেহেতু আসরে আমি আজ সম্মানিত অতিথি, তাই বাঘের খাঁচাটা আমার সামনেই এসে দুই ট্রেনার দাঁড় করালেন এবং বাঘ আমাকেও হাতজোড় করে নমস্কারের ভঙ্গি করল। এবার তালি না বাজিয়ে আমিও হাতজোড় করে প্রতি-নমস্কার জানালাম। আমাকে খাতির দেখাবার এই পরামর্শ যদি গৌরবাবু দিয়ে থাকেন, তাহলে সেটা মোটেই ভালো কাজ হয়নি। নাকের ডগায় বাঘ এনে কেউ কি কোনও অতিথিকে আপ্যায়ন করে? কিন্তু এখন রাগ দেখাব কার ওপর! একটু পরে খাঁচাসুদ্ধু বাঘকে নিয়ে যাওয়া হল। শুরু হয়ে গেল মূল পালা। চারটি দৃশ্য শেষ হতেই পঞ্চম দৃশ্যের গোড়ায় নায়িকা এসে কাঁদতে-কাঁদতে গান ধরল। গানটা দক্ষিণ রায়ের বন্দনাগীতি গোছের। জোতদার, মহাজনের অত্যাচার থেকে এই অভাগিনীকে কে বাঁচাবে? এই বন্দনাগীত শেষ হতেই অত্যাচারী মহাজনের প্রবেশ। নায়িকার শিশু ভাইটিকে মহাজন গলা টিপে জলে ফেলে দিতে উদ্যত, নায়িকার বিলাপ, ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই পিলে-চমকানো অট্টহাসি শোনা গেল। আমি জানি, এই কথাটি গৌরহরিবাবুর দ্বারাই সম্পাদিত। প্লে-ব্যাক সিঙ্গারের মতো উনি নেপথ্য থেকে বাঘের হয়ে অট্টহাস্য হেসেছেন। এখন টেপে সেটাই বাজছে। একটা নব্বই মিনিটের ক্যাসেটে নাকি শুধু নানাধরনের অট্টহাস্য তুলে রাখা আছে। অট্টহাস্য শুনে ভিলেন মহাজন থমকে পড়ে যেই না এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, তখন খোলা আসরে লাফ দিয়ে পড়ল মাস্টার প্রিন্স। মহাজনের সামনে এসে একবার গর্জন ছাড়ল, আর তাতেই আমার চক্ষুস্থির এবং আশপাশ থেকে কচি কন্ঠে কারা যেন কেঁদে উঠে বলল, ‘মা, বাড়ি যাব।’

আমারও তখন একই আর্তি। বাঁশিওয়ালা বাঁশি হাতে একটু পিছিয়ে গেল। অভিনেতারা প্রয়োজনে রাগ দেখায়। সেটা অভিনয়। কিন্তু বাঘ কি অতশত ভেবে রাগ দেখাবে? সত্যি-সত্যি রেগে গেলে…

আমি ঘেমে যাচ্ছি, কিন্তু পকেটে হাত ঢুকিয়ে রুমাল বের করার সাহস নেই। আমি সমালোচনা লিখব বলে অন্যরা খাতির করতে পারে, বাঘের তো সেসব বালাই নেই। বাঘ তো কাগজই পড়ে না!

কোনোরকমে দৃশ্যটা শেষ হল। কচি শিশুটিকে পিঠে নিয়ে বাঘ আসর ছেড়ে গ্রিনরুমের দিকে চলে যেতেই আসর জুড়ে প্রবল করতালিধ্বনি উঠল। এতক্ষণ তো সবাই হাতই তুলতে পারছিল না। আমি ছাপানো প্রোগ্রামে দেখলাম মাস্টার প্রিন্স আবার আসবে অষ্টম দৃশ্যে। মানে দুটো দৃশ্য একটু নিশ্চিন্তে দেখা যাবে। অষ্টম দৃশ্য শুরু হওয়ার আগে আসরে আলো আর শব্দের সাহায্যে ঝড় ওঠার পূর্বাভাস দেখানো চলছে। ওরই মধ্যে টেপে বেজে উঠল অট্টহাস্য। তার মানে মাস্টার প্রিন্স আসছে। আমি যথাসম্ভব গুটিয়ে বসলাম। হাসিটা চলতে চলতেই আসরের একদিক থেকে এবং গ্রিনরুমের ভেতর থেকে প্রবল চিৎকার উঠল, ‘আগুন, আগুন…’

আমি তাকিয়ে দেখলাম, যেদিকে গ্রিনরুম সেইদিক থেকে দাউদাউ করে আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছে দু-পাশে। আসরের চারপাশে রঙিন কাপড়ে মোড়া যে বাঁশগুলো, তাতেও আগুন ধরে গেছে। আসরের মধ্যে, দর্শকদের ভেতর চিৎকার, আর্তনাদ আর হুড়োহুড়ি। আমার পাশ থেকে বাজনদাররা ‘ওরে বাবা রে’ বলে কোন দিকে যে ছুট মারল, সেটা বুঝতেই পারলাম না!

এই অবস্থায় দলের কাউকে কিংবা গৌরহরিবাবুকে খুঁজে পাওয়ার চিন্তা করাটাই বোকামি। আমিও লাফ দিয়ে নামলাম এবং ভিড়ের ঠেলাঠেলি যেদিকে নিয়ে গেল সেই দিকে যেতে লাগলাম। যাত্রার প্যাণ্ডেলটা থেকে খানিকটা দূরে এসে দেখি প্যাণ্ডেলটা জ্বলছে। কেউ কেউ চেষ্টা করছেন বলতি বালতি জল এনে আগুন নেভাতে। একটু পরেই দুটো দমকল এল। দমকলের ঘণ্টা শুনে অনেকে কিছু স্বস্তি পেল বটে কিন্তু যা কিছু পোড়বার তা ততক্ষণে পুড়ে শেষ হতে চলেছে।

এরই মধ্যে স্বেচ্ছাসেবকরা হাতে চোঙা ফুঁকে সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, ‘সবাই দলবদ্ধভাবে নিজ-নিজ বাড়িতে ফিরবেন। কারণ জর্নাদন অপেরার বাঘটি আগুন দেখে পালিয়ে গেছে। কোথায় আছে তা এখনও জানা যায়নি। সদর থেকে পুলিশ ফোর্স এলে অনুসন্ধানকার্য শুরু হবে। আপনারা সতর্ক থাকবেন।’

আমার অবস্থাটা এবার সহজেই অনুমেয়। দলের কাউকে পাচ্ছি না। এ-জায়গায় আমি একেবারেই নতুন। রাস্তাও চিনি না। সবাই না হয় দলবেধেঁ নিজ-নিজ বাড়িতে গিয়ে দরজা দেবে। আমি যাব কোথায়? তা ছাড়া মাঝপথে যাত্রা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে খোরাকির টাকাটাও তো প্রিন্স পায়নি। ও তো টাকার জন্য গৌরহরিবাবুকে খুঁজে বেড়াবে না! খিদে পেলে যাকে সামনে পাবে, তাকেই খাবে। তার মানে আমি। এই মুহূর্তে জঙ্গলের মধ্যে একা-একা আমিই তো আছি। আমার পেটে-পিঠে ব্যথা শুরু হল।

আমি ভাবলাম এই জঙ্গলে দাঁড়িয়ে না থেকে বরং প্যাণ্ডেলের দিকে যাই। দমকলকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক সকলেই ওখানে আছেন। কিন্তু প্যাণ্ডেলের দিকটা এখন অন্ধকার। সুন্দরবনের বাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা জানার পর প্যাণ্ডেলের আশপাশে কী বেশি লোক থাকবে? কিন্তু কোথাও তো আমার যাওয়া দরকার। জঙ্গলের মধ্যে একা-একা দাঁড়ানো আদৌ নিরাপদ নয়। মরতে হলে লোকালয়ে গিয়ে মরাই ভালো। আমি পায়ে-পায়ে এগোতে লাগলাম, কোনদিকে এগুচ্ছি সেটা জানি না, তবুও পা চালাতে লাগলাম। রাসের আগে আকাশে যেমন চাঁদের আলো থাকে এখন সেইরকম আলো। দু-দিন পরেই তো রাসপূর্ণিমা। অন্ধকারটা চোখে সয়ে এসেছে। এবার বুঝলাম, যেখানে এসে পড়েছি সেটা একটা ঝোপঝাড়ের জঙ্গল। ওর মধ্যে দিয়ে বড়ো নর্দমার মতো খাড়ি। বর্ষাকালে জল যাওয়ার জন্য এই অবস্থা। পায়ের নীচে শুকনো পাতা, হাঁটু অব্দি ঝোপ, মাঝে মাঝেই লম্বা-লম্বা গাছ। কীসের গাছ কে জানে! পথ চলতে এত কষ্ট হচ্ছিল যে, বাঘ, আগুন এসব আতঙ্ক আর তেমন করে মনে পড়ছিল না। তবে কোনো শব্দ শুনলেই কান খাড়া করছিলাম। বাঘের ভয় তো সহজে যাওয়ার নয়। তার ওপর রাতের খোরাকি না-পাওয়া পলাতক বাঘ। এরকম জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলা কোনো অসম্ভব ব্যাপার নয়। এবার চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, আমার বাঁ-দিকে মনে হচ্ছে জঙ্গল অপেক্ষাকৃত কম ঘন। দূর থেকে কয়েক বিন্দু আলো দেখে বুঝতে পারলাম ওইদিকে জনবসতি আছে। ওইদিকে যেতে হলে বড়ো নর্দমাটা পেরোতে হবে। আর ভাববার সময় নেই। পেরোবার আগে বুঝতে পারিনি, লাফ দিতে গিয়ে বুঝলাম আমি ওপারে না পৌঁছে শুকনো নর্দমার মধ্যেই পড়ে গেছি। গায়ে তেমন চোট লাগেনি। নর্দমাটা শুকনো পাতায় বোঝাই। এবার ওপরে ওঠার পালা। সেইটি করতে গিয়ে বিপদ ঘটল।

আমি যখন ওপরে ওঠার চেষ্টা করছি তখন ওই নর্দমার ভেতর খসখস আওয়াজ পেয়ে ডানদিকে তাকিয়েই আমার শরীর হিম হয়ে গেল এবং আমি কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লাম। আমার ডানদিকে হাতচারেক দূরত্বে মাস্টার প্রিন্স। আমার শুধু একবারের জন্য মনে পড়ল, ‘মা বলেছিল, সকাল-সকাল ফিরিস। আজ গলদা রাঁধব।’

হায় গলদা! এখন রাতের খোরাকি না-পাওয়া মাস্টার প্রিন্স খাড়ির মধ্যে বসে আমাকেই গলদার মতো খাবে। আমি কিছুই করতে পারব না। খুব আস্তে আস্তে মাস্টার প্রিন্স আমার দিকে এগিয়ে এল। আর এগোবার দরকার কী! থাবাটা বাড়ালেই তো আমার ঘাড়টা ধরতে পারে। একবার টানলেই আমি তোমার দুধের দাঁতের নাগালে চলে যাব।

বাঘটা বোধ হয় খাবার আগে খাদ্যবস্তুটাকে দেখে নিতে চায়, তেমন করেই আমার সামনে এসে পড়ে বলল, ‘দাদা, আপনি?’

আমার মনে হল, আমি মরে গেছি। মরে গিয়ে দেখছি বাঘ আমাকে দাদা সম্বোধন করছে। বাঘ একটা হাত আমার হাতে রেখে বলল, ‘দাদা, আমি প্যালা।’

‘প্যালা!’ আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

প্যালা বলল, ‘সবাই তো মানুষ সেজেছে, তাই দৌড়ে সবাই কোনো-না-কোনো বাড়িতে গেছে। আমি তো বাঘ সাজি, তাই আমার আর যাওয়ার জায়গা নেই। ক্লাব ঘরের জানালা দিয়ে ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সবাই ক্লাব ছেড়ে পালাল। ওখানে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে জঙ্গলের দিকে এলাম।’

আমি প্যালার শরীর টিপে টিপে দেখতে থাকি। তারপর বলি, ‘তুই বাঘ সাজিস, সত্যির বাঘ নয়?’

প্যালা উত্তর দিল, ‘সত্যির বাঘ আনা হয়েছিল, কিন্তু বাঘ নিয়ে খোলা আসরে যাত্রা করার পারমিশন পুলিশ দেয়নি। এদিকে তো প্রচার হয়ে গেছে, নাটক তৈরি, বায়নাও অনেক। তখন ভেবেচিন্তে গৌরহরিদা বললেন, ‘প্যালা, দলে তোর প্রমোশন হল, একেবারে হিরো পার্ট। তোকে বাঘ সাজতে হবে। খোরাকি পঞ্চাশ টাকা। মাইনে তিন হাজার। তুই তো কিছুদিন সার্কাস দলে কাজ করেছিস, বাঘের ব্যাপারটা তুই ভালো বুঝবি।’

আমি বলি, ‘তোর ট্রেনার?’

প্যালা বলে, ‘ওগুলো লোক-দেখানো। ওরা বাক্স বয়। শুধু পালার আগে ট্রেনার সাজে। এই কথাটা গৌরহরিদা, ওই দুই ট্রেনার, আমি আর পুলিশ ছাড়া কেউ জানে না। বিপদ না ঘটলে আপনি জানতে পারতেন না। সমালোচনা লেখবার সময় দয়া করে এটা লিখবেন না যেন! তাহলেই গৌরহরিদা খোরাকির টাকা কমিয়ে পাঁচ করে দেবে। বিধবা মা আর পাঁচ ভাইবোনকে নিয়ে থাকি। দু-বেলা খাওয়ার জন্য না হয় বাঘই সাজলাম! কী বলেন?’

আমি তখন ভাবছি অন্য কথা। প্যালা না হয় সাজা বাঘ। তবু তো দেখতে বাঘই। ওকে নিয়ে এবার কোন পথে, কোন আশ্রয়ে যাব? বাঘ নিয়ে তো ট্রেনে-বাসেও উঠতে পারব না! এদিকে বাঘ খুঁজতে বেরিয়ে গ্রামবাসী যদি আমাদের দু-জনকে এখানে দেখে ফেলে, তাহলেও দুর্ভোগ নিতান্ত কম হবে না! প্যালার সঙ্গে কী মানুষ সাজার কোনো পোশাক নেই? সত্যি, আমাদের কারো কাছেই সেটা এখন নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *