মাস্টারমশাই – প্রচেত গুপ্ত

মাস্টারমশাই – প্রচেত গুপ্ত

ঘর থেকে বেরিয়ে ডাক্তারবাবু কাশ্যপকে কাছে ডাকলেন। তার কাঁধে হাত দিয়ে নীচু গলায় বললেন, ”তোমার বাবা আর বেশিদিন বাঁচবেন না কাশ্যপ। আত্মীয়স্বজনকে খবর দাও। তারা শেষবারের মতো এসে মানুষটাকে দেখে যাক। মাস্টারমশাইয়ের নিজের যদি কোনো শেষ ইচ্ছে থাকে সেটাও জেনে নিও। পূরণ করবার চেষ্টা কোরো।”

একটু থামলেন ডাক্তারবাবু। মাথা নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ”আর কী বলব বলো? মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকে না। তাকে একদিন চলে যেতেই হয়। ইচ্ছে করে না তবু যেতে হয়। মানুষ জন্মের এটাই সবথেকে বড়ো দুঃখ। মাস্টারমশাই শুধু তোমাদের বাবা নন, এই চাঁপাডাঙা গ্রামের সকলের প্রিয় মানুষ, শ্রদ্ধার মানুষ। তার কত ছাত্র দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে আছে। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ শিক্ষক বা গবেষক। তুমি দুঃখ করো না, এইসব মানুষের মৃত্যু হয় না। তারা ছাত্রদের মাঝখানে বেঁচে থাকেন।” আর কথা বাড়াতে পারলেন না ডাক্তারবাবু। শোকে তার গলা বুঁজে এল। তিনি বেরিয়ে পড়লেন।

কাশ্যপ চিন্তায় পড়ল। ডাক্তারবাবু বলে গেলেন, সময় আর বেশি নেই। সবাইকে খবর দিতে হবে। তারা বাবাকে শেষবারের মতো দেখে যাবে। কিন্তু কীভাবে খবর দেবে? আত্মীয়স্বজনদের ঠিকানা, ফোন নম্বর সে কিছুই জানে না। দীর্ঘ কুড়ি বছর বিদেশে রয়েছে। সিডনিতে? চাকরি করে। বেশি আসতে পারে না। মাঝে মাঝে আসে। এবার এসেছে তিন বছর পর। বাবার শরীর খারাপ শুনে এসেছে। কারও সঙ্গেই তার প্রায় যোগাযোগ নেই। কাশ্যপ বহুবারই বাবাকে সিডনিতে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। বাবাই রাজি হননি। কেন রাজি হননি কে জানে। কাশ্যপের মা মারা গেছেন অনেকদিন হয়ে গেল। গ্রামের এই ছোট্ট বাড়িতে উনি একাই আছেন। বাইরে যাওয়ার কথা শুনলে বলেছেন, ”অসম্ভব। এই বাড়ি, এই গ্রামের সঙ্গে আমার নাড়ির যোগাযোগ। এসব ছেড়ে যেতে পারব না। তা ছাড়া ওই যে স্কুলটা দেখছিস, চাঁপাডাঙা হাইস্কুল, ওখানে আমি তেত্রিশ বছর মাস্টারি করেছি। এই স্কুলবাড়িটা দিনের মধ্যে একবার না-দেখলে আমি বাঁচব না।”

অনেক বুঝিয়েও লাভ হয়নি। বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে কাশ্যপ। কিন্তু এখন কী হবে? বাবার ঘরেও এল কাশ্যপ। মেঘনাদ সামন্ত চোখ বুঁজে খাটে শুয়ে আছেন। একাশি বছরের বৃদ্ধ। গলা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। মাথাটা দুটো বালিশের ওপর উঁচু হয়ে আছে। কে বলবে মানুষটার আয়ু শেষ হয়ে এসেছে? মাথার ওপরের খোলা জানলা দিয়ে মুখে সকালের আলো এসে পড়েছে। ঝলমল করছে। যারা খুব ভালো মানুষ হন তাদের বেলাতে সম্ভবত এরকমই হয়। মৃত্যুর ছায়া মুখে পড়তে পারে না। সবসময় ঝলমল করে। কাশ্যপ খাটের পাশে রাখা মোড়ায় বসল। মেঘনাদবাবুর গায়ে হাত রেখে বলল, ”বাবা, বাবা।”

মেঘনাদবাবু চোখ খুললেন, ”কিছু বলবি?”

কাশ্যপ একটু চুপ করে থেকে বলল, ”বাবা, তোমার কাছে একটা ডায়েরি ছিল না?”

”ডায়েরি! কীসের ডায়েরি?”

”একটা ছোটো বাঁধানো ডায়েরি। যেখানে বড়োমামা, জেঠুমণি, ন-কাকা, ফুলমাসিদের ফোন নম্বর, ঠিকানা সব লেখা ছিল।”

মেঘনাদবাবু দম টেনে বললেন, ”ওদের ফোন নম্বর, ঠিকানা দিয়ে কী হবে?”

কাশ্যপ একটু থমকে গেল। কী বলবে? কোনো মানুষকে কি বলা যায়, তোমার সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করার জন্য সবাইকে খবর দেব? বলা যায় না। সে বলল, ”তোমার শরীরটা ভালো নেই সেই খবরটাই বলব।”

মেঘনাদবাবু হাসলেন। তার হাসি এখনও উজ্জ্বল। বললেন, ”কী হবে খবর দিয়ে? তারা আমাকে এই অবস্থায় দেখে দুঃখ পাবে। থাক কাউকে খবর দিতে হবে না।”

কাশ্যপ মুহূর্তখানেক চুপ করে রইল। গাঢ় স্বরে বলল, ”তোমার যদি বিশেষ কারও সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করে, তুমি বলতে পারও বাবা। আমি অবশ্যই যোগাযোগ করবার চেষ্টা করব।”

মেঘনাদ মাথা তুলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। উদাস গলায় বললেন, ”যদি মনে আসে বলব।”

দূরের কাউকে খবর দেওয়া না-হলেও, চাঁপাডাঙা গ্রামের অনেকেই ‘মাস্টারমশাই’কে দেখতে এলও। আসাটাই স্বাভাবিক। মানুষটা এই গ্রামের জন্য কম করেননি। একদিন বিকেলে চাঁপাডাঙা হাইস্কুলের মাস্টারমশাইরা সবাই দলবেঁধে এলেন। সঙ্গে এখনকার হেডমাস্টারমশাই বিশ্বম্ভরবাবু। মেঘনাদবাবু খুব খুশি হলেন। মানুষটা চাঁপাডাঙা স্কুলের সঙ্গে জড়িত কাউকে দেখলেই খুশি হন। শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারী সবাইকে ভালোবাসেন। কুড়ি বছরের বেশি হয়ে গেল উনি স্কুলের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, কিন্তু মন থেকে স্কুলকে সরাতে পারেননি। অবসর নেওয়ার পর উনি বহুদিন স্কুলে গিয়ে বিশেষ ক্লাস নিতেন। তার জন্য কখনও একটা পয়সাও নেননি। বিশেষ ক্লাসে অঙ্ক শেখাতেন। মেঘনাদস্যারের কাছে অঙ্ক শেখার জন্য ছেলেরা উন্মুখ হয়ে থাকত। অঙ্কের মাস্টারমশাইরা সাধারণত রাগি হন। মেঘনাদবাবু ছিলেন একেবারে উলটো। অঙ্কের জন্য কোনো ছাত্রকে তিনি কখনও বকাঝকা, মারধোর করেননি। তিনি বলতেন, ”অঙ্ক কঠিন লাগার আসল কারণ ভয়। যুগযুগান্ত ধরে মাস্টারমশাইরা নিয়ম করে দিয়েছেন, অঙ্ক না-পারলেই পিঠে বেত পড়বে। এই কারণেই ছেলে-মেয়েরা ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। অঙ্কে পুরো মন দিতে পারে না। আমি এই নিয়ম মানি না।”

চাঁপাডাঙা স্কুলের মাস্টারমশাইদের বসতে বলে মেঘনাদ সামন্ত বললেন, ”তোমাদের দেখে মনটা ভরে গেল। তোমাদের মধ্যে আমি নিজেকে দেখতে পাই। আমি চলে যাচ্ছি, তোমরা স্কুলটাকে প্রাণ দিয়ে রক্ষা করবে।”

বিশ্বম্ভরবাবু ভারি গলায় বললেন, ”ওভাবে বলবেন না মাস্টারমশাই। আপনাকে আমরা কোথাও যেতে দেব না।”

মেঘনাদ সামন্ত একটু শুকনো হাসলেন। বললেন, ”ঠিক আছে ওসব কথা থাক। স্কুলের খবর বলো। খেলার মাঠটাকে ঠিক করা গেছে? ছেলেদের খাবার জলের জন্য আর একটা ডিপটিউবওয়েল বসানোর কথা ছিল। সেটার কী হল? মাস দুয়েক আগে শুনেছিলাম, ক্লাস নাইন, টেনের বেঞ্চের অবস্থা মোটে ভালো নয়। মেরামত করেছ? নতুন কিনলেই তো ভালো হয়।”

মেঘনাদবাবুর কথায় স্কুলের মাস্টারমশাইরা অবাক হলেন। অসুস্থ অবস্থাতেও উনি স্কুলের ব্যাপারে এত খোঁজখবর নিচ্ছেন! এত উৎসাহ দেখাচ্ছেন! বিশ্বম্ভরবাবু মাথা নামিয়ে বললেন, ”টাকাপয়সার টানাটানি চলছে। এতগুলো কাজ করতে লাখ দুয়েক টাকা লাগবে। তা ছাড়া, ভেবেছিলাম, একটা লাইব্রেরির ঘর বানাব। কিন্তু সবটাই আটকে আছে।”

মেঘনাদবাবু চিন্তিত গলায় বললেন, ”তোমরা সরকারের কাছে আবেদন করছ না কেন?”

বিশ্বম্ভরবাবু বললেন, ”করেছি, এখনও কোনো সাড়া পায়নি। সেই আবেদনের চিঠি হারিয়ে গেছে কিনা তাও জানি না। আপনি তো জানেন মাস্টারমশাই, গাঁয়ের স্কুলের কথা সবার শেষে মনে পড়ে।”

মেঘনাদবাবু বললেন, ”ঠিকই বলেছ। আমার সময়েও এরকম সমস্যায় পড়তাম। একবার ক্লাস এইট বি-এর ক্লাসরুমের ছাদ দিয়ে বৃষ্টির জল পড়তে লাগল। আমি সরকারের কাছে চিঠি পাঠালাম। ছাদ মেরামতের জন্য টাকা চাই। সেই টাকা এল বর্ষা পেরিয়ে শীতের শেষে। আচ্ছা, তোমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু টাকা তুলতে পারো না? আমার সময়ে কিন্তু আমি ঘুরে ঘুরে স্কুলের জন্য টাকা তুলতাম। চাঁপাডাঙা গ্রামের ধনী মানুষদের বাড়িতে যেতাম। অনেকেই টাকা দিত। দোতলাটা তো ওই টাকাতেই হয়েছিল।”

বিশ্বম্ভরবাবু হেসে বললেন, ”মাস্টারমশাই, সেই দিন আর নেই। এখন ধনী মানুষরা আর চট করে স্কুলটুলের জন্য টাকাপয়সা দিতে চায় না। টাকা থাকলে অন্য জায়গায় লাগায়। যাতে টাকা আরও বাড়ে। তা ছাড়া চাঁপাডাঙায় আর ধনী মানুষ কে আছে? যারা ছিলেন বাড়িতে তালা দিয়ে শহরে চলে গেছে।”

মেঘনাদ সামন্ত বিষণ্ণ গলায় বললেন, ”তাও ঠিক। তবু তুমি চেষ্টা করো। সরকারের অফিসে দরবার করো। একটা ভালো লাইব্রেরি ছাড়া স্কুল কী করে চলবে?”

বিশ্বম্ভরবাবু বললেন, ”মাস্টারমশাই আপনার জন্য একটা সামান্য উপহার এনেছি।”

মেঘনাদ সামন্ত অবাক হয়ে বললেন, ”উপহার! এই সময়ে উপহার কী দেবে?”

বিশ্বম্ভরবাবু ব্যাগ থেকে কাগজ মোড়া একটা চৌকো মতো জিনিস বের করলেন। কাগজ খুলতে দেখা গেল, চাঁপাডাঙা হাইস্কুলের একটা হাতে আঁকা ছবি। ভারি সুন্দর। জল রং দিয়ে আঁকা হয়েছে। তবে ছবিটা বেশ কয়েকবছর আগের। সোনালি ফ্রেম দিয়ে যত্ন করে বাঁধানো হয়েছে। মেঘনাদ সামন্ত হাতে ছবিটা নিয়ে অস্ফুটে বললেন, ”বাঃ। অপূর্ব।”

বিশ্বম্ভরবাবু উৎসাহ নিয়ে বললেন, ”মাস্টারমশাই ছবিটা কার আঁকা আপনি কি বলতে পারবেন?”

ছবির গায়ে হাত বোলাচ্ছেন মেঘনাদবাবু। যেন পরমযত্নে তার সন্তানের গায়ে হাত বোলাচ্ছেন। বিড়বিড় করে বললেন, ”কার আঁকা?”

”আমাদের স্কুলেরই এক ছাত্রের। আপনার সময়েই স্কুলে পড়ত। স্কুলের পুরোনো কাগজপত্র পরিষ্কার করতে গিয়ে হঠাৎ পাওয়া গেছে। দোমড়ানো-মোচড়ানো অবস্থাতে পাওয়া গেছে।”

মেঘনাদবাবু উজ্জ্বল চোখে বললেন, ”তাই নাকি! কী নাম?”

”তীর্থঙ্কর রায়। ক্লাস টেনে পড়ত।”

মেঘনাদবাবু চোখ বুজে মনে করার চেষ্টা করলেন। নিজের মনে মনে বললেন, ”তীর্থঙ্কর…. তীর্থঙ্কর…তীর্থঙ্কর…ছবি আঁকত…এখনই ঠিক মনে করতে পারছি না।”

চাঁপাডাঙা স্কুলের ড্রইং স্যার জীবন চক্রবর্তী বসেছিলেন হেডমাস্টার মশাইয়ের পাশে। বললেন, ”মাস্টারমশাই আর আপনাকে কষ্ট করে মনে করতে হবে না। খবর পেয়েছি, সেই ছেলে আর এখন এদেশে থাকে না। বিদেশে গিয়ে খুব বড়ো আর্টিস্ট হয়েছে। ছবি আঁকার স্কুল খুলেছে।”

বিশ্বম্ভরবাবু বললেন, ”মাস্টারমশাই, আমরা কাশ্যপকে বলে যাচ্ছি, সে যেন ছবিটা আপনার সামনে ওই দেয়ালে টাঙিয়ে দেয়। আপনি চোখ খুললেই দেখতে পাবেন।”

মেঘনাদবাবু ধীরগলায় বললেন, ”ভালো করেছো। খুব ভালো করেছো। এখন তো আর নিজে গিয়ে স্কুলটাকে দেখে আসতে পারি না। এই ভালো। যতদিন বাঁচব চোখ খুললেই দেখতে পাব। তবে তীর্থঙ্করকে মনে করতে পারছি না! এত সুন্দর ছবি আঁকত, এই ছেলেকে ভুলে যাওয়াটা আমার ঠিক হয়নি। খুবই অন্যায় হয়েছে।”

কাশ্যপের খুব ভালো লাগল। বাবা কত আনন্দ নিয়ে মাস্টারমশাইদের সঙ্গে কথা বললেন! মনেই হচ্ছিল না, মানুষটা অসুস্থ। আসলে ভালো লাগার বিষয় নিয়ে কথা বললে মানুষ কষ্ট ভুলে যায়। সে দরজা পর্যন্ত সবাইকে এগিয়ে দিল। বিশ্বম্ভরবাবুকে বলল, ”আপনারা যদি মাঝেমধ্যে আসেন খুব ভালো হয়। চাপাডাঙা স্কুলের কাউকে দেখলে বাবা খুব খুশি হন।”

সন্ধেবেলা ছেলেকে কাছে ডাকলেন মেঘনাদ সামন্ত।

”আমার একটা ইচ্ছে আছে।”

কাশ্যপ বাবার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, ”কী ইচ্ছে বাবা?”

”আমি মৃত্যুর আগে আমার এক ছাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই।”

”কে?” কাশ্যপ উৎসাহ নিয়ে বলল।

”তার নাম তীর্থঙ্কর। তীর্থঙ্কর রায়। ওই যে দেয়ালে ছবিটা দেখছ ওটা তারই আঁকা। আমি তাকে মনে করতে পারছি না, এর জন্য আমি ভেতরে ভেতরে ছটফট করছি। যে ছেলে এত সুন্দর ছবি আঁকত, তাকে আমি কেন ভুলে যাব? যে করেই হোক তুমি তার সঙ্গে আমার একবার কথা বলিয়ে দাও। শুনলাম সেও তোমার মতো বিদেশে থাকে। আমেরিকা বা ইউরোপের কোনো শহরে।”

”নিশ্চয় দেব বাবা। তুমি তার টেলিফোন নম্বর বা মেইল আই ডি দিতে পারবে? আমি ল্যাপটপ থেকে আজই তার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিচ্ছি।”

”ওসব কিছুই আমার কাছে নেই। এবার দেখো তুমি যদি কিছু পারো।”

এতটা কথা বলে মেঘনাদ সামন্ত হাঁপিয়ে উঠেছেন। তিনি চোখ বুজলেন। চিন্তিত মুখে কাশ্যপ বলল, ”ঠিক আছে দেখছি।”

কাশ্যপ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল যে করেই হোক তীর্থঙ্কর রায়কে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবে। তার মেইল আইডির সন্ধান পেলে আর সমস্যা হবে না। আধুনিক প্রযুক্তিতে তো এটাই সবথেকে বড়ো সুবিধে। পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় এসে গেছে। কাশ্যপ রাতের খাওয়া সেরে ল্যাপটপ খুলে বসল। ‘আর্টিস্ট তীর্থঙ্কর রায়’ লিখে ‘সার্চ’-এ ক্লিক করতেই একশো ছাপান্নজন তীর্থঙ্কর রায়ের তালিকা ভেসে উঠল পর্দায়। সকলেই শিল্পী! এর মধ্যে বাবার ছাত্র কোন জন? জানতে হলে সকলের পরিচয় ঘাঁটতে হবে। একশো ছাপান্ন জনের পরিচয় দেখা কঠিন বিষয়। তার ওপর আর একটা সন্দেহ আছে। সেই তীর্থঙ্কর রায় কি চাঁপাডাঙার কথা লিখবে। গ্রামের স্কুলের কথা অনেকে চেপে যায়। এড়িয়ে চলে। অনেক সময় বানিয়ে বড়ো কোনো শহরের স্কুলের কথা বলে। এই ছেলেও যদি সেরকম হয়? তাহলে তো কিছুই করা যাবে না। যাই হোক, বাবার এই ইচ্ছে পূরণ করবার চেষ্টা করতেই হবে। নিজে গিয়ে রান্নাঘরে কফি বানাল কাশ্যপ। তারপর কফির মগ নিয়ে বসে একশো ছাপান্নজন তীর্থঙ্করের প্রোফাইল খুঁজতে শুরু করল কাশ্যপ। কিন্তু রাত দুটো পর্যন্ত হাতড়েও কোনো লাভ হল না। চাঁপাডাঙার তীর্থঙ্কর কোথাও নেই। যদি থেকেও থাকে সে ‘চাঁপাডাঙা’র নাম গোপন করেছে। কাশ্যপ হতাশ। এতটা এগিয়েও লাভ হল না। বাবার ইচ্ছেটা মেটানো গেল না। খানিকটা রেগেই কাশ্যপ এবার একটা কাণ্ড করল। নিজে একটা বার্তা লিখল। তারপর ‘সেন্ড’ করে দিল একশো ছাপান্ন জন ‘শিল্পী তীর্থঙ্কর রায়’-এর কাছে। ইংরেজিতে লেখা সেই বার্তার মানে এরকম—

”নমস্কার, আমার নাম কাশ্যপ সামন্ত। আমার বাবার নাম মেঘনাদ সামন্ত। তিনি পশ্চিবঙ্গের এক গ্রামে থাকেন। সেই গ্রামের নাম চাঁপাডাঙা। একসময়ে আমার বাবা চাঁপাডাঙা হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক ছিলেন। সেই সময় ক্লাস টেনের এক ছাত্র খুব সুন্দর ছবি আঁকত। সে জলরং দিয়ে স্কুলের একটা ছবিও এঁকেছিল। সম্প্রতি সেই ছবিটি স্কুলের পুরোনো কাগজপত্রের ভেতর থেকে উদ্ধার করা গেছে। ছেলেটি নাকি এখন একজন বড়ো শিল্পী। বিদেশে আছে। কিন্তু বাবা কিছুতেই তাকে মনে করতে পারছেন না। আমার বাবা অসুস্থ, মৃত্যুশয্যায়। তার খুব ইচ্ছে, ছেলেটির সঙ্গে তার একবার যোগাযোগ হোক। তার ঠিকানা, ফোন নম্বর, ইমেইল আইডি আমরা কিছুই জানি না। আমি আপনার কাছে এই বার্তাটি পাঠাচ্ছি কারণ সেই ছেলের নামও আপনার মতো তীর্থঙ্কর রায়। আপনি যদি চাঁপাডাঙার তীর্থঙ্কর রায় হন. তাহলে দয়া করে আমার মেইলে খুব তাড়াতাড়ি জবাব পাঠান। আমি টেলিফোনে বা কম্পিউটারে বাবার সঙ্গে আপনার একবার কথা বলিয়ে দেব। একজন মৃত্যুপথ যাত্রী মাস্টারমশাইয়ের শেষ ইচ্ছার কথা ভেবে আশা করি আপনি নিশ্চয় সাড়া দেবেন। আমি এখন চাঁপাডাঙায় বাবার কাছেই আছি। আমার মোবাইল ফোন নম্বর সঙ্গে দিয়ে দিলাম।”

একদিন, দু-দিন, তিনদিন কেটে গেল। কাশ্যপ রোজই কম্পিউটারে তার মেইল চেক করে। না, কোনো জবাব নেই। এদিকে মেঘনাদবাবুর অবস্থার অবনতি হয়েছে। শনিবার শরীরটা বেশি খারাপ হল। কাশ্যপ বসে ছিল পাশে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। কে এল! গ্রামের কেউ বাবার খবর জানতে এসেছে? হতে পারে। শুধু সকালে কেন, কেউ কেউ রাত করেও খবরাখবর নিতে আসে। কাশ্যপকে বলে যায়, ”কোনও চিন্তা করবে না, যত রাতই হোক দরকার হলেই আমাদের ডাকবে।” নিশ্চয় সেরকম কেউ। কাশ্যপ উঠোন পেরিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। খুলে চমকে গেল।

না, গ্রামের কেউ নয়। লম্বা চওড়া চেহারার একটি ঝকঝকে ছেলে, দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় তারই বয়সি। ধোপদুরস্ত শার্ট প্যান্টে ঝলমল করছে। পিছনে, বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা চকচকে বড়ো গাড়িও দেখা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে যুবক এই গাড়িতে এসেছে। কাশ্যপ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। ছেলেটি হাত বাড়িয়ে বলল, ”আপনি নিশ্চয় কাশ্যপ? আমি তীর্থঙ্কর। তীর্থঙ্কর রায়। আপনার বাবার ছাত্র। মাস্টারমশাই কেমন আছেন?”

কাশ্যপ প্রায় লাফিয়ে উঠল। ইচ্ছে করল ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরতে। তার মুখের কথা জড়িয়ে গেল।

”আপনি, আপনি তীর্থঙ্কর? উফ আপনাকে যে কীভাবে খুঁজছি।”

তীর্থঙ্কর সামান্য হাসল। বলল, ”আর খুঁজতে হবে না, আমি এসে গেছি। আপনার মেইল পেয়েছি। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মাস্টারমশাইয়ের কাছে আমি যে কতখানি কৃতজ্ঞ উনি নিজেও জানেন না। উনি না-থাকলে আমি আজ শিল্পীই হতে পারতাম না। সকালে কলকাতা থেকে নিজে গাড়ি চালিয়ে চলে এলাম। তবে আমার হাতে সময় খুব কম।”

”ধন্যবাদ। বাবার শরীরটাও খুব খারাপ। আর কতদিন বাঁচবেন জানি না। আপনি যদি দেরি করে ফেলতেন তাহলে হয়তো দেখাই হত না।”

কাশ্যপ আর কথা বাড়াল না। তীর্থঙ্করকে বাবার কাছে নিয়ে গেল। মেঘনাদ সামন্ত চোখ খুললেন। কাশ্যপ ঝুঁকে পড়ে বলল ”বাবা, দেখ কে এসেছে। তোমার সেই ছবি আঁকিয়ে ছাত্র তীর্থঙ্কর। দেখো তো চিনতে পারো কিনা।”

মেঘনাদ সামন্ত চিনতে পারলেন না। তিনি জড়ানো গলায় বিড়বিড় করে বললেন, ”কেন এমন হচ্ছে! কেন আমি তোমাকে চিনতে পারছি না?”

তীর্থঙ্কর মেঘনাদ সামন্তর হাতটা ধরে বলল, ”সেটাই তো স্বাভাবিক মাস্টারমশাই, আপনার তো চিনতে পারার কথা নয়। অনেক বছর আগের কথা। আমার চেহারাও অনেক বদলে গেছে। তখন আমি হাফপ্যান্ট পরতাম। স্কুলের ইউনিফর্ম। কালো হাফপ্যান্ট, সাদা শার্ট।”

বালিশে শুয়েই আক্ষেপে মাথা নাড়লেন মেঘনাদ সামন্ত। বললেন, ”সে তো সবাই পরত। তবু তো অনেক ছাত্রকে চিনতে পারি। তোমার মতো একজন গুণী ছেলের কথা আমার অবশ্যই মনে থাকা উচিত ছিল। আমার খারাপ লাগছে।”

তীর্থঙ্কর তার মাস্টারমশাইয়ের কপালে হাত রাখল। বলল, ”যাদের সঙ্গে আপনার নিয়মিত যোগাযোগ আছে তাদের হয়তো চিনতে পারেন। আপনি দুঃখ পাবেন না, আপনার আমাকে মনে না-থাকুক, আমার তো আপনাকে মনে আছে। মনে আছে, ভূগোল ক্লাসে পড়া না-শুনে, ম্যাপ খাতার পাতায় ছবি এঁকেছিলাম। স্কুলের ছবি। ভূগোলের মাস্টারমশাই ধরে ফেললেন। রেগে আগুন। কান ধরে নিয়ে গেলেন হেডমাস্টার মশাইয়ের ঘরে। আপনি ছবি দেখে কটমট করে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, সঙ্গে রং তুলি এনেছিস? আমি কাঁদোকাঁদো গলায় বললাম, না, রং কেনার পয়সা নেই। আপনি বললেন, ঠিক আছে আমি রং কিনে আনাচ্ছি। আমি দারুণ ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম, মাস্টারমশাই আর কখনও করব না। ছবি আঁকব না। আপনি ধমক দিয়ে বললেন, চোপ। এই ছবি এখনই এখানে বসে রং করবি। এটাই তোর শাস্তি। ভূগোল মাস্টারমশাই তো অবাক! এমন শাস্তির কথা তিনি কখনও শোনেননি। কান ধরে দশবার ওঠবোস নয়, পিঠে দু-ঘা বেত নয় তার বদলে পেনসিলে আঁকা ছবি রং করা! তাও আবার নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে রং তুলি কিনে আনার ব্যবস্থা করলেন। আমিও শাস্তির মাথা মুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলাম না। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। স্কুলের পিয়োনকাকু রং তুলি কিনে আনার পর আপনার ঘরে বসে ছবি রং করলাম চোখের জল মুছতে মুছতে। মাস্টারমশাই, আপনি চলে গেলেন ক্লাস নিতে।”

কাশ্যপ বলল, ”চোখে জল কেন!”

তীর্থঙ্কর হেসে বলল, ”বাঃ, তখনও তো আমি জানি এরপরেই আমার বিরাট কোনো বিপদ আসছে।”

মেঘনাদ সামন্ত নীচু গলায় বললেন, ”তারপর?”

”তারপর আপনি ফিরে এসে আমার ছবি দেখলেন। দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুই একদিন খুব বড়ো শিল্পী হবি। সবার মুখ উজ্জ্বল করবি। এই ছবিটা রেখে দিলাম। এটা চাঁপাডাঙা স্কুলের সম্পত্তি হল। তুই এই রং তুলি রাখ। এটা তোর সারাজীবনের সঙ্গী হবে। আমার যে কী আনন্দ হল আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না।”

কথা শেষ করে তীর্থঙ্কর দেয়ালের দিকে তাকাল। তার চোখে জলের বিন্দু। সেখানে তার আঁকা ছবিটা ঝুলছে। তীর্থঙ্কর এবার তার হাতের ব্রিফকেস খুলে স্কুলের জন্য একটা চেক বের করল। মেঘনাদ সামন্ত বললেন, ”এটা কী!”

”দু-লক্ষ টাকার চেক। চাঁপাডাঙা হাইস্কুলের নামে লিখে এনেছি। এটা আসলে আমার আপনাকে প্রণাম। আমি জানি চাঁপাডাঙা স্কুলকে আপনি কত ভালোবাসেন। এটা আপনি না করতে পারবেন না। আপনাদের আশীর্বাদে বিদেশে ছবি বিক্রি করে, আর ছবি আঁকা শিখিয়ে কিছু টাকাপয়সা রোজগার করেছি। দয়া করে আপনি এটা স্কুলে পাঠিয়ে দেবেন। টাকাটা যদি স্কুলের কোনো কাজে লাগে আমি বড়ো খুশি হব। আজ আমি উঠব।”

মেঘনাদ সামন্ত তীর্থঙ্করের হাত ধরে কিছু বলতে গেলেন। পারলেন না। তার দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

”মাস্টারমশাই, আপনি কি এবার আমাকে চিনতে পারলেন?”

মেঘনাদ সামন্ত এবার চোখ বুজে ফিসফিস করে বলতে লাগলেন, ”না। বড়ো কষ্ট হচ্ছে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল তীর্থঙ্কর। মুহূর্তখানেক ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল তার প্রিয় মাস্টারমশাইয়ের দিকে। তারপর ধীর পায়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। গাড়িতে ওঠবার সময় কাশ্যপ বলল, ”আপনি যে এতদূর এসেছেন এর জন্য কী বলে যে ধন্যবাদ দেব…। কিছু মনে করবেন না। বাবা যে অবস্থায় আছেন, তাতে অনেকদিন আগে দেখা কাউকে মনে করাটা তার পক্ষে কঠিন।”

অন্যমনস্ক ভাবে তীর্থঙ্কর বলল, ”আমি কিছু মনে করছি না। উনি কষ্ট পাচ্ছেন এটাই খারাপ লাগছে।”

তীর্থঙ্করের গাড়ি চলে যাওয়ার পর বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল কাশ্যপ। এমন মানুষ আজও আছে! উঠোন পেরিয়ে বাবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল কাশ্যপ। আজ সারাদিন সে বাবার পাশেই থাকবে। চাঁপাডাঙা স্কুলে একটা খবর দিতে হবে। তীর্থঙ্কর রায়ের চেকটা দিতে হবে। ভাবতে ভাবতে বাবার ঘরের দরজার কাছে পৌঁছে গেল কাশ্যপ। তারপরই থমকে দাঁড়াল।

একি! ঘরে ও কে বসে আছে! কে? ছোটো একটা ছেলে। সাদা জামা, কালো প্যান্ট। স্কুলের ইউনিফর্ম পরেছে যেন! বসে আছে মেঘনাদ সামন্তর মাথার কাছে। মাথায় হাত বোলাচ্ছে পরমযত্নে! পায়ের আওয়াজ পেয়ে দরজার দিকে মুখ ফেরাল ছেলেটা। ঠান্ডা একটা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল কাশ্যপের! মুখটা সে চিনতে পেরেছে। তীর্থঙ্কর রায়!

কাশ্যপের চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। সে দরজা ধরে মেঝেতে বসে পড়ল।

মেঘনাদ সামন্ত মারা গেলেন সেদিন দুপুরেই। মুখে কোনো কষ্টের ছাপ নেই। যেন দীর্ঘজীবন তাকে পরমতৃপ্তি দিয়েছে।

পরদিন সকালে খবরের কাগজে একটা ছোট্ট খবর পড়ল কাশ্যপ। খবরের শিরোনাম ‘শিল্পীর মৃত্যু।’ লণ্ডনে এক ভয়ংকর পথদুর্ঘটনায় তীর্থঙ্কর রায় নামে এক বাঙালি শিল্পীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। চাঁপাডাঙা নামের এক অখ্যাত গ্রামে এই শিল্পী তার বাল্যকাল কাটিয়েছিলেন। তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার দিন তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে হিথরো বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন। কারণটা বড়ো অদ্ভুত। তিনি দু-দিনের জন্য দেশে যাচ্ছিলেন। যাচ্ছিলেন তার পুরোনো চাঁপাডাঙা গ্রামে। সেখানে তার স্কুলের এক শিক্ষক খুব অসুস্থ। তিনি নাকি তাকে দেখতে চান। সেই কারণেই……।’

কাশ্যপ কাগজ ফেলে উঠে পড়ল। আলমারি থেকে চেকটা বের করল। চেকের ওপর দুর্ঘটনার দিনের তারিখ! কাশ্যপের সারাশরীর ঝিমঝিম করে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *