মাস্টারমশাই

মাস্টারমশাই

নিত্যরঞ্জনবাবু একজন গানের জগতের লোক। চণ্ডীগড় বোর্ডের একজন পরীক্ষক। বছরের বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষা নিতে যান। এছাড়া বাড়িতে গানের স্কুল আছে। এখনকার পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও বলিউডি গানকে প্রাণভরে ঘৃণা করেন। কোন কোন ছাত্র-ছাত্রীর মা বা বাবা যখন তার কাছে এসে বলে “মাস্টারমশাই বাংলা সিনেমার গান শেখাবেন তো?” তখন বড় কষ্ট পান তিনি। মনে মনে বিড় বিড় করেন “এরা যে কি করবে,আরে ক্ল্যাসিকাল হচ্ছে গানের মূল, তোরা সেটা শিখে নে আগে, তারপর না হয় যা পারবি করবি”।

পুরনো হারমোনিয়াম, তানপুরা ধরে গান না শিখে যারা শুরুতেই গীটার আর কি বোর্ড নিয়ে শিখতে চায় তাদের তিনি করুণার চোখে দেখেন। গানের পরীক্ষার দিন তিনি পাঞ্জাবী পায়জামা পরে পরীক্ষা নিতে বসেন। প্রথম প্রথম ভাল লাগে। তারপর এক গান শুনতে শুনতে বিরক্তি ধরে যায়। শেষের দিকে মনের সুখে নম্বর কাটতে শুরু করেন। তার এই ব্যাপারটা ওয়াকিবহাল মহল জেনে যাওয়াতে তিনি পরীক্ষা নিতে গেলেই সবার মধ্যে মারপিট লেগে যায় কে আগে পরীক্ষা দেবে।

ব্যাপারটা হয় যে কোন একজন মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকে। এলাকার সব গানের শিক্ষকেরা ছাত্র ছাত্রী নিয়ে সেই শিক্ষকের বাড়িতে এসে হাজির হন। নিত্যরঞ্জনবাবুকে দেখলেই তারা চেষ্টা করেন এক টপকে তাকে ধরে পরীক্ষার জায়গায় নিজের ছাত্র ছাত্রীদের বসাতে। কোন শিক্ষকের ছাত্র বা ছাত্রী কম নম্বর পেলে বাজারে সে শিক্ষকের সুনাম আর থাকে না, তাই তারা এ ব্যাপারে জীবন দিয়ে দেন। নিত্যরঞ্জনবাবুও এটা বুঝতে পারেন। তিনি বেশ উপভোগ করেন ব্যাপারটা।

এবছর নিত্যরঞ্জনবাবুকে পরীক্ষা নিতে যেতে হল উত্তর চব্বিশ পরগনার প্রান্তিক এক মফস্বলে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বনগাঁ লোকালে করে পৌঁছলেন তিনি পরীক্ষার সেন্টারে।

গিয়ে অবস্থা দেখে তার মাথায় হাত। কম বেশি একশো জন পরীক্ষার্থীর বিচারের ভার পড়েছে তার উপরে। এই অঞ্চলের নামকরা একজন গানের শিক্ষক অপূর্ববাবু। তার বাড়িতেই পরীক্ষা নিতে হবে তাকে। বেশ বড় দোতলা বাড়ি, যে ঘরে নিত্যবাবুকে পরীক্ষা দিতে হবে, সেটা একটা ছোট ঘর। কিন্তু ভারী সুন্দর করে সাজানো। নিত্যবাবুর দেখে শুনে মন খারাপ হয় গেল। তার ঘরদোর বড় আগছালো। মা মরা মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবার পর এখন আরও খারাপ অবস্থা।

পৌঁছতেই অপূর্ববাবুর গৃহিণী এক থালা মিষ্টি নিয়ে উপস্থিত হলেন, তা দেখে তার মন আবার খানিকটা খারাপ হল। গত মাসে তার মধুমেহ ধরা পড়েছে। তিনি ভীত স্বরে বললেন “মা, এই মিষ্টি আমি খেতে পারব না, আমার ডায়াবিটিস ধরা পড়েছে।তুমি বরং ছাত্র ছাত্রীদের দাও মিষ্টি।“

অপূর্ববাবুর গৃহিণী মাথা নাড়লেন “হ্যাঁ মাস্টারমশাই ওদের জন্য তো থাকবেই, আপনার জন্য আমি বরং অন্য কিছু করে নিয়ে আসি।“

নিত্যরঞ্জনবাবুর মনে পরে গেল প্রথম যখন পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেছিলেন যে বাড়িতেই যেতেন এরকম একটা বড় থালায় মিষ্টি সিঙ্গারা নিয়ে আসত, আর তিনি এসবের জন্যই সোৎসাহে বসে থাকতেন। খেতে বড় ভালবাসতেন তিনি। এই ডায়াবিটিসটা ধরা পরে বড় বিপদ হয়ে গেল।

অপূর্ববাবুকে ডাকলেন তিনি। বললেন “আপনি এক কাজ করুন, প্রারম্ভিক ছাত্রদের পাঠানো শুরু করুন।“

অপূর্ববাবু তাই করলেন। একটি বছর দশেকের কন্যা এল পরীক্ষা দিতে। নিত্যরঞ্জনবাবু খুশি হলেন। এসব অঞ্চলে গানের চর্চাটা এখনও রয়েছে।

মেয়েটি মায়ের সাথে এসছে। সময় কম, তাই তিনি শুরু থেকেই পরীক্ষা নেওয়া শুরু করলেন। আধো আধো গলায় ক্ল্যাসিকাল গান ভালই লাগল তার।

সকাল দশটায় শুরু হওয়া পরীক্ষা দুপুর দুটো গড়ালে দেখা গেল তার প্রায় পঞ্চাশ জনের পরীক্ষা নেওয়া সম্পূর্ণ হয়েছে। তখনও প্রায় পয়তাল্লিশ জন বাকি। এর মধ্যে প্রায় তিরিশবার “সারা জীবন দিল আলো সূর্য গ্রহ চাঁদ”, খান পচিশ বার “তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে”, “নিম ফুলের মৌ পিয়ে” শুনতে হয়েছে। আর যেহেতু এ অঞ্চলে দুজন গানের শিক্ষক, অপূর্ববাবু এবং হারাধন পালিত বলে এক ভদ্রলোক তাই কমবেশি সব পরীক্ষার্থী একই বন্দিশ গেয়ে চলেছে। আর থিওরিতে বেশিরভাগই ফেলের সমধর্মী। ইমন রাগের কোমল স্বর, বা ভৈরব কোন সময়ে গাওয়া হয় এসব সহজ প্রশ্নের উত্তরও অনেকে দিতে পারল না। খানিকটা মুষড়ে পড়লেন তিনি। কানের অবস্থাও তথৈবচ। প্রতিবারই পরীক্ষা নেবার দুদিন পর যে কোন গান বাজনা থেকে দুদিন বিরতি নেন। এবার মনে হচ্ছে বিরতির সময়সীমা বাড়ানো হতে পারে।

অপূর্ববাবু অতিথিবৎসল লোক। প্রচুর খাবারের আয়োজন করেছেন। নিত্যরঞ্জনবাবু খাচ্ছিলেন যখন তখন অপূর্ববাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন বুঝলেন নিত্যবাবু? ছাত্ররা কেমন?”

অপূর্ববাবুর আগ্রহী মুখ এবং চিংড়ি মাছ নিত্যবাবুকে সত্যি কথা বলা থেকে বিরত রাখল। তিনি আর বলতে পারলেন না ছাত্র ছাত্রীদের অনেক গান শেখার আছে। রবি ঠাকুর, নজরুল অনেক গান বানিয়ে গেছেন। তার থেকে শেখা যেতে পারে। একই গান যে পরীক্ষকের কি পরিমাণ বিরক্তি উদ্রেক করতে পারে তা পরীক্ষক মাত্রেই জানেন। তবে তিনি এও জানেন এই এত পরীক্ষার্থীর মধ্যে বেশিরভাগই ক্লাস এইট নাইন অবধি গান বাজনা করবে, তারপর তাদের জীবন থেকে গান বাজনা বন্ধ হয়ে যাবে। এদেশের মেয়েদের অভিভাবকেরা গান শেখান বিয়ের বাজারে একটা এক্সট্রা ক্যারিকুলাম হিসেবে গান বা নাচ রাখার জন্যে। নাচ আবার অনেক ছেলের বাড়ি পছন্দ করে না। জনসমক্ষে শরীর প্রদর্শন মনে করে অনেকে। তাই গানই সই। নাচ শরীরে কুঁড়ি ওঠার আগে অনেক মেয়ের বাবা মা বন্ধ করে দেয়। এখন চিত্রটা কিছুটা বদলাচ্ছে তবে কম বেশি এখনও এই ধারনা মানুষের আছে।

খেয়ে উঠে বাড়িতে আজকাল একটু গড়িয়ে নেন নিত্যবাবু। স্কুল থেকে রিটায়ার করার পর এই বদভ্যাসটা হয়েছে। আজ ঘুম হবে না বুঝে একটু বিরক্ত হলেন।

তিনটে নাগাদ আবার পরীক্ষা নেওয়া শুরু হল। এবার একেবারে ধর তক্তা মার পেরেক। এক্সপ্রেস ট্রেনও বলা যায়। দুটো তিনটে করে গান শুনে ছেড়ে দিচ্ছেন। কারো ক্ষেত্রে একটাও শুনছেন।

বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ চা নিয়ে এলেন অপূর্ববাবুর গৃহিণী।আর দু এক জন বাকি। অপূর্ববাবু পরীক্ষা নেবার সময় পাশেই থাকেন। হারাধন বাবুও থাকেন। কোন প্রশ্ন করলে দুজনই ছাত্রদের ক্লু দেবার চেষ্টা করেন। এসব দেখে দেখে নিত্যবাবু অভ্যস্ত। তাই বিরক্ত হন না। প্রথম প্রথম রেগে যেতেন।

চা খেতে খেতে অপূর্ববাবু বললেন “নিত্যবাবু,একটা অনুরোধ ছিল। আমাদের বিধায়কের মেয়ে আমার ছাত্রী। ওর কলকাতায় আজ একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে। আমাকে একটু আগে ফোন করেছিল। সন্ধ্যে ছ’টা হবে, আপনি যদি অনুমতি দেন তবে ওকে আসতে বলি?”

নিত্যরঞ্জনবাবু অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। ভেবেছিলেন পাঁচটার মধ্যে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারবেন। সেটা না পারায় বাড়ি পৌছতে দেরী হবে। এটা যদি অন্য কোন সাধারন ছাত্রীর ক্ষেত্রে হত তখন কি অপূর্ববাবু এই অনুরোধ করতে পারতেন?

এসময় “না” বলাটা অভদ্রতার সামিল। নিত্যবাবু সেটা পারলেনও না। তাছাড়া বিধায়ক বলে কথা। কত রকম ক্ষমতা এদের হাতে। বিরক্ত হলেও বসে থাকলেন পরীক্ষা নেবার পরে। একটা ছোট খাটে বসে পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। সব শেষে তার মধ্যেই একটু পা টান করে বসলেন। এতক্ষণ ধরে গান শুনে শুনে মাথাটা ঝি ঝি করছিল। পরের দিকে ছিল তৃতীয় বর্ষ থেকে পরীক্ষা। বেশির ভাগই বেসুরো। দু একজন সুরে গাইল। তাদেরই শুনলেন কিছুটা। বাকিদের একটা গড় নম্বরে পাশ করিয়ে দিলেন। যদি দেখেন সিলেবাস ভাল তোলেনি অনেকক্ষেত্রেই ফেলও করিয়েছেন। পরীক্ষার একটা নিয়ম আছে সেটা তিনি কঠিন কঠোর ভাবে বিশ্বাস করেন। তাকে যখন পরীক্ষা নিতে পাঠানো হয়েছে তখন সেই নীতি তো তাকে মেনে চলতেই হবে।

অপূর্ববাবু গল্প করছিলেন তার সাথে। ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিলেন। অপূর্ববাবু আশ্বস্ত করলেন তাকে গাড়ি করে স্টেশান পৌঁছে দেবেন। অপূর্ববাবু এখানকার এক স্কুলের হেড মাস্টার মশাই। আবার একাধারে সঙ্গীতের মাস্টারমশাইও। তিনি এরকম দেখেননি এর আগে। ঘটনাটি বিরল। আর ভি আই পির মেয়ে। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি তো হবেই। দেখা যাবে একেবারেই গান করতে পারে না। দু একটা কোন মতে শুনেই পালানো যাবে।

ছ’টা দশ নাগাদ মেয়েটি এল। সাথে মেয়েটির মা। নিত্যবাবু উঠে বসলেন। মেয়েটি রবীন্দ্রসঙ্গীত পঞ্চম বর্ষের ছাত্রী। তিনি মেয়েটিকে বললেন নিজের পছন্দের একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাতে। মেয়েটি গাইল “এই লভিনু সঙ্গ তব”। নিত্যবাবু অবাক হয়ে গেলেন। এ কি অপূর্ব কণ্ঠস্বর। তার মনে হচ্ছিল স্বর্গে আছেন। চারিদিক এক অপূর্ব স্নিগ্ধতায় ভরে যাচ্ছিল। মেয়েটি যখন গাইছিল “আলোকে মোর চক্ষুদুটি মুগ্ধ হয়ে উঠল ফুটি, হৃদগগনে পবন হল সৌরভেতে মন্থর”… মনে হচ্ছিল চারিদিক এক অপূর্ব মায়ায় ভরে যাচ্ছে। তার চোখে জল ভরে এল। তিনি অপূর্ববাবুকে জিজ্ঞেস করলেন “এই গান কি ওকে আপনি শিখিয়েছেন?”

অপূর্ববাবু মাথা নাড়লেন, “না মাস্টারমশাই, ও নিজে সারাদিন গান শোনে, তার থেকেই গান শোনায়, আমি গেলে খালি ও রোজ নতুন নতুন কি গান তুলেছে, সেগুলিই শোনায়।“

নিত্যবাবু অভিভূত হলেন। তার দীর্ঘদিনের সঙ্গীতজীবনে তিনি এরকম কণ্ঠস্বর আগে শোনেন নি। মেয়েটি বলল “মাস্টারমশাই এর পরে কি গান করবে?” তিনি কিছুই ঠিক করতে পারলেন না। সিলেবাস গুলিয়ে যাচ্ছিল তার। তিনি বললেন “মা, তোমার পছন্দের যা ভাল লাগে, তাই শোনাও, আমি তাই শুনব।“

মেয়েটি একে একে “কোথা বাইরে দূরে”, “রাখো রাখো রে”, “সখী আঁধার একেলা ঘরে” “তোমার দেখা পাব বলে এসেছি”এবং সব শেষে ভানুসিংহের পদাবলী থেকে “মরণ রে তুঁহু মম শ্যামসমান” গাইল। নিত্যবাবু ভেবেছিলেন দুটো গান শুনেই রওনা দেবেন। পারলেন না। মেয়েটি কাচু মাচু মুখে বলল এ বারে তাদের সিলেবাসে যে রাগগুলি আছে, সময়াভাবে কোনটাই তোলা হয় নি তার। তিনি একটুও রাগলেন না। বললেন “মা, তোমার গলায় সাক্ষাৎ মা সরস্বতী বাসা বেঁধেছেন।সিলেবাসে কি আছে না আছে তার বিচার তিনিই করুন। তুমি শুধু গান গাওয়া ছেড়ো না। এত অসাধারন গানের গলা তোমার। আমি কোনদিন ভাবতে পারিনি এমন গান শুনতে পারব এখানে এসে।“
পরীক্ষকের কাঠিন্য ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল নিত্যবাবুর থেকে।

“এবারে আমি আমার পরীক্ষকের নীতি থেকে বিচ্যুত হলাম। কিন্তু আমি নিরুপায়। সঙ্গীতের কাছে আমার নীতি পরাস্ত হয়েছে আজ অপূর্ববাবু। চলুন আমায় স্টেশনে দিয়ে আসবেন।“ মেয়েটি মাথা নিচু করে শুনছিল। এসে প্রণাম করল। নিত্যবাবু অনেক আশীর্বাদ করলেন।অপূর্ব বাবু অভিভূত হলেন নিত্যবাবুর এরকম ব্যবহারে ।

স্টেশনের উদ্দেশ্যে নিত্যবাবু যখন রওনা দিলেন অপূর্ববাবুর বসার ঘরের ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। আজ অনেক দেরী হয়ে গেছে তার। দেরী হলেও এই মেয়েটি তাকে হঠাৎ করে অনেক পুরনো কথা মনে পড়িয়ে দিল। এরকম গান তিনি একবারই শুনেছিলেন একজনের গলায়।বাসর রাত্রে কেউ ছিল না সেদিন। একা একা বিয়ে করে এনেছিলেন। গানের শিক্ষক কোনদিন ভাবতে পারেননি তার স্ত্রী অমন গান করে। সারারাত বাকরুদ্ধ হয়ে গান শুনেছিলেন। অনেকদিন পরে পরীক্ষা নিতে এসে আজ একটা ধাক্কা মত খেলেন। আর কি আশ্চর্য, ট্রেনে উঠেই তার মনে পড়ল আজ তাদের বিবাহ বার্ষিকী ছিল। পুরনো ধুলি ধূসর দিনগুলি এভাবেই বুঝি ফিরে আসে বারে বারে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *