মাসির বাড়ি
নবাবগঞ্জে পৌঁছে সে শুনল, মাদলপুরের শেষ বাস সন্ধেবেলা ছেড়ে গিয়েছে। রাতে ওদিকে যাওয়ার যানবাহন বলতে কিছু নেই।
শুনে অগাধ জলে পড়ল গয়ারাম। ট্রেনটা তিন ঘণ্টা লেট না করলে এতক্ষণে তার মাসির বাড়িতে পৌঁছে বিকেলের ফলার সেরে ওঠার কথা। খিদেও বড় কম পায়নি। মাত্র বাইশ বছর বয়স। গোবিন্দপুর গাঁ থেকে টানা তিন মাইল হেঁটে এসে ট্রেন খারাপ। রাস্তায় একটু বাদামভাজা ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। পয়সা বেশি নেইও সঙ্গে। রাস্তায় চোরে—ডাকাতে কেড়ে নেবে বলে মা রাস্তা খরচটুকু ছাড়া আর মাত্র পাঁচটা টাকা দিয়েছেন। অবশ্য মাসির বাড়ি পৌঁছে গেলে আর চিন্তা নেই। কিন্তু পৌঁছনো নিয়েই চিন্তা।
তার মাসতুতো দাদা কালীশঙ্করের বিয়ে। কাল ভোরবেলা বরযাত্রীরা বর নিয়ে রওনা হয়ে যাবে। কালীদার ভাবী শ্বশুরবাড়ি নাকি একবেলার পথ। খানিকটা নৌকোয় গিয়ে তারপর হাঁটাপথ। অবশ্য বরযাত্রীদের জন্য গোরুর গাড়ি আর বরের পালকিও থাকবে। আর বরযাত্রী যাওয়ার জন্যই তাড়াহুড়ো করে আসা। মাসি পইপই করে আসার জন্য চিঠি লিখেছেন।
কিন্তু গয়ারাম এখন করে কী?
নবাবগঞ্জ জায়গা মন্দ নয়, দোকান—বাজার আছে, স্টেশন আছে, পোস্ট অফিস আছে। মাদলপুর অবশ্য নিকষ্যি গাঁ। নবাবগঞ্জ আর মাদলপুরের মাঝখানে একখানা পেল্লায় জলা জমি আছে। লোকে বলে পেতনির জলা। ভূতপ্রেতের কথা ছেড়ে দিলেও, এই শীতে সন্ধের পর রোজই বাঘ বের হয়। কমলপুরের জঙ্গল থেকে বুনো কুকুরের ঝাঁকও কখনও—কখনও হানা দেয়। তারা বাঘের চেয়েও ভয়ংকর।
বাজারের প্রান্তে অশ্বত্থ গাছটার তলায় বাঁধানো চাতালে বসে যখন গয়ারাম সাত—পাঁচ ভাবছে, তখনই হঠাৎ টের পেল, চাতালের ওদিকটায় অন্ধকারে বসে দু’টো লোক গভীর শলাপরামর্শ করে যাচ্ছে। দু’একবার ‘গুণময় রায়’ আর ‘মাদলপুর’ শব্দ দু’টো কানে এল। সে একটু উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগল।
একজন বলল, ”শোন পচা, বুক ঠুকে কাজটা করে ফেলতে পারলে আমার আর চিন্তা নেই। ধর, যদি গয়না বেচে বিশ—ত্রিশ হাজার টাকা পেয়ে যাই, তা হলে দু’জনে মিলে নবাবগঞ্জে মনোহারি দোকান দেব। কথা দিচ্ছি, আর জীবনে চুরি—জোচ্চুরি করব না, এই একবারটি ছাড়া।”
”দ্যাখ গদা, আমি জীবনে কখনও ওসব করিনি, ওসব করলে ভগবান পাপ দেয়।”
”আহা, বলছি তো এবারকার মতো পাপটা করে ফেলে একটা প্রায়শ্চিত্তির করে নিলেই হবে। ওরে, ভগবান তো পাপীদের জন্যই আসেন। তাই তো বলে ‘পতিতপাবন’।”
”যদি ধরা পড়ে যাই?”
”সে ভয় নেই। বিয়েবাড়ি বলে কথা! লোকজনের যাতায়াত লেগেই আছে। ডেকরেটরের লোক, জেনারেটরের লোক, না হয় তো রান্নার জোগালি, যা হোক একটা ভেক ধরে নিলেই হবে। চার মাইল তো মোটে রাস্তা। টুক করে কাজ সেরে ফিরে আসব।”
এরা তার মাসির বাড়িতে চুরি করার মতলব আঁটছে দেখে গয়ারাম খুশিই হল। এলাকার ছেলে, সুতরাং পথঘাট চেনে, তা ছাড়া পথের সাথীও পাওয়া যাবে।
গয়ারাম একটু গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ”ভায়ারা, একটু আনাড়ি মনে হচ্ছে।”
ছোকরা দু’জন তার দিকে ফিরে চেয়ে বলল, ”তুমি কে?”
গয়ারাম হাতে হাত ঘষে বলল, ”দাশরথী পয়মালের নাম জানা আছে?”
পচা আর গদা তাড়াতাড়ি উঠে এসে তার দু’পাশে জেঁকে বসে বলল, ”না ভাই তিনি কে?”
”এ লাইনে তিনিই শেষ কথা! অত বড় গুণী আর এ লাইনে নেই। কুঞ্জপুরের কাছে থাকেন, একেবারে সাধুসন্তের মতো জীবন! পাপের টাকা ভোগ করেন না, বিলিয়ে দেন। তাঁর ছেলেরা অবশ্য ওই কর্ম করেই খাচ্ছে।”
পচা বলল, বটে! কিন্তু ভাই, তুমি তো এ তল্লাটের লোক নও। কী মতলবে উদয় হয়েছ?”
”আমাদের কি তল্লাট বলে কিছু আছে? পেটের ধান্দায় ঘুরে বেড়াতে হয়। তবে দাশরথী পয়মালের চেলা তো, পেটে বিদ্যেটা আছে বলে অসুবিধে হয় না।”
গদা খুব আহ্লাদের সঙ্গে বলল, ”এই তোমার মতোই একজন সঙ্গীকে আমরা খুঁজছি। আজ রাতে মাদলপুরের এক বিয়েবাড়িতে একটা বড় দাঁও আছে। শুনেছি মেলা গয়নাগাঁটি আর টাকাপয়সার ব্যাপার আছে।”
গয়ারাম খুব একটা আগ্রহ দেখাল না। ভাবখানা ছোটখাটো কাজে তার গা নেই। বলল, ”তা ছেলের বিয়ে না মেয়ের বিয়ে? ছেলের বাড়িতে তো বিশেষ গয়নাগাটি থাকবার কথা নয়। মেয়ের বাড়ি হলেও না হয় কথা ছিল।”
পচা মাথা চুলকে বলে, ”ছেলের বাড়িই বটে। তবে গুণময় রায় ব্যাঙ্ক থেকে পাঁচ লাখ তুলেছে, আর মদন স্যাকরাকে বিস্তর গয়নার বরাত দিয়েছে, এটা পাকা খবর।”
গয়ারাম বলল, ”রাস্তা চেনা আছে? শুনেছি মাদলপুর যেতে বড় একটা জলা পড়ে!”
”ওসব তোমাকে ভাবতে হবে না। রাতবিরেতে আমাদের ওদিকে প্রায়ই যাতায়াত করতে হয়।”
গয়ারাম নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলল, যাক বাবা, চার—পাঁচ মাইল রাস্তা যে এই অন্ধকারে একা ঠ্যাঙাতে হবে না, এটাই যথেষ্ট। গয়ারাম বলে, ”তা না হয় হল, কিন্তু পেটে যে ছুঁচো ডন মারছে, খালি পেটে কি আর হাত—পা সচল থাকে?”
এবার গদা বলল, ”এই বাজারেই আমার পিসেমশাইয়ের পাইস হোটেল, আমিই এবেলা ম্যানেজারি করেছি। খাওয়ার ভাবনা কী?”
গয়ারাম ফের আরামের শ্বাস ছাড়ল। ভগবান একেবারে ছপ্পড় ফুঁড়ে দিচ্ছেন।
খাওয়াটা মন্দ হল না। ডাল, ভাত আর নিরামিষ তরকারি, সঙ্গে এক বাটি মাংস। চেটেপুটে খেয়ে তিনজন রওনা হয়ে পড়ল।
ভূতনির জলা মাঠ ঘোর অন্ধকার। তবে পচা আর গদা পথঘাট ভালোই চেনে। ঝোপ—জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, আঁকাবাঁকা রাস্তায় ডাঙা জমি দিয়ে দিব্যি যাচ্ছে। পিছনে গয়ারাম।
কিন্তু খানিকটা হাঁটার পরই গয়ারাম শুনতে পেল, অন্ধকারে এই নির্জন পথে তারা ঠিক একা নয়। আশপাশে যেন আরও লোকজন চলেছে এবং তাদের ফিসফাস কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে।
গয়ারাম একটু ঠাহর করে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করল এবং একটু বাদেই শুনতে পেল, হাত দশেক তফাতে বাঁ ধারে এক বুড়ো মানুষের কাশির শব্দ। তারপরই ঘড়ঘড়ে গলায় কেশো লোকটা কাকে যেন বলল, ”বুঝলি গাব্বু, এই কাশির জন্যই চুরি করা ছাড়তে হয়েছিল আমাকে। চোর কাশলেই সর্বনাশ। অথচ এমন দাঁওটাই কি ছাড়া যায়, বল তো!”
”আহা, তোমার ভিতরে যাওয়ার কী দরকার? তুমি বাইরে বসে কাজের লোকেদের সঙ্গে গপ্পোসপ্পো কোরো। আমি ভিতরে ঢুকে কাজ সেরে আসব। গুণময় রায়ের বাড়ির আনাচকানাচ আমার চেনা।”
গয়ারাম প্রমাদ গনল, পচা আর গদাই শুধু নয়, আরও নিশিকুটুমরাও তার মাসির বাড়ি যাচ্ছে!
কয়েক কদম এগোতে না—এগোতেই পিছন থেকে কয়েক জোড়া দৌড় পায়ের আওয়াজ পেল গয়ারাম। তার ডান দিক দিয়ে মাত্র চার—পাঁচ হাত তফাতে গোটা কয়েক ছোকরা গোছের লোক ছুটে গেল। পিছনের জন একটু উঁচু গলায় বলল, ”মাদলপুরের শীতলতলায় গুণময় রায়ের বাড়ি, বুঝলি তো? ভুল বাড়িতে ঢুকিস না।”
তারা ছুটতে—ছুটতে এগিয়ে গেল।
পচা থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ”এটা কী হচ্ছে বল তো?”
গয়ারামও অবাক। বলল, ”তাই তো? এরা কারা?”
বুড়োটা পুরনো চোর কাশি, সঙ্গে ওর নাতি গাব্বু, আর যারা ছুটে গেল, তারা পোড়াগাছতলার নন্দকিশোর সংঘের ছেলে, সব ক’টা চোর।
গদা বলল, ”সর্বনাশ! চল চল, পা চালিয়ে চল।”
পচা বলল, ”দৌড়তে হবে, নইলে পারব না।”
তিনজনে যথেষ্ট বেগে দৌড়তে লাগল।
আশ্চর্যের বিষয়, দৌড়তে—দৌড়তে আরও তিনটে দলকে একে—একে ছাড়িয়ে গেল তারা। কিন্তু চতুর্থ দলটাকে পারল না। হঠাৎ পটাপট ল্যাং মেরে তিনজনকেই ফেলে দিল জনাদশেক চোরের একটা দল।
মুখে টর্চ মেরে একটা লোক বলল, ”অ্যাই খবরদার, আমাদের টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করলে লাশ পুঁতে দেব। আমরা গিয়ে আগে চেঁছেপুঁছে নিই, তোরা পরে প্রসাদ পাবি।”
তিনজনে চিঁচিঁ করতে লাগল পড়ে থেকে।
ঘণ্টা দেড়েক বাদে যখন তারা মাদলপুরে পৌঁছল, তখন তাদের দম বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা।
কিন্তু মাদলপুর পৌঁছে তাদের চক্ষু চড়কগাছ। রাত ন’টা বেজে গিয়েছে। এই সময় গাঁ—গঞ্জের লোকের নিশুত রাত। কিন্তু কোথায় কী? গাঁয়ে ঢোকার মুখেই বটতলায় বেশ কয়েকটা হ্যাজাক জ্বলছে। আর সারি—সারি টেবিল—চেয়ার পেতে গাঁয়ের ছেলেছোকরারা বসে কীসের যেন টিকিট বিক্রি করছে। বিভিন্ন টেবিলের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে অনেক লোক টিকিট কাটছে। গয়ারাম অবাক হয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করল, ”এ কীসের লাইন দাদা?”
”ওসব চোরেদের লাইন।”
”কেন, কেন, চোরের আবার লাইন কীসের?”
”আহা, গুণময়বাবুর ছেলের বিয়ে শুনে চার দিক থেকে চোরেরা হাজির হচ্ছিল যে! নানারকম ভেক ধরেই আসছিল। ধরা পড়ে পেটাইও হচ্ছিল। কিন্তু গুণময়বাবুর দয়ার শরীর তো! তাই তিনি বললেন, ‘ওরে বাপু, চোরেদেরও তো করে খেতে হবে। চুরি করতে চায় তো চেষ্টা করুক না। তবে বিশৃঙ্খলা যাতে না হয়, তাও দেখতে হবে। তাই টিকিটের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। দু’টাকার টিকিট কাটলে চুরি করার জন্য এক ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে। তবে চুরির সময় ধরা পড়লে পাঁচ টাকা ফাইন।”
পচা আর গদা করুণ মুখে বলল, ”আমরা কি পারব? কত বড়—বড় নামজাদা সব চোরদের দেখতে পাচ্ছি।”
গয়ারাম দমে গিয়ে বলল, ”তাই তো হে!”
অগত্যা টিকিট কেটেই তারা তিনজন গাঁয়ে ঢুকল। গিয়ে দ্যাখে, গুণময়বাবুর বাড়ির সামনেও বেশ লম্বা লাইন। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই ভালো। পেল্লায় বাগান, দু’মহলা বাড়ি, চার দিকে দাসদাসী, লোকলস্করের অভাব নেই।
চোরেদের সঙ্গে লাইন দিয়ে নিজের মাসির বাড়িতে ঢুকতে গয়ারামের প্রেস্টিজে লাগছিল। কিন্তু উপায় বা কী? সুতরাং পচা আর গদার পিছনে সেও লাইনে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল।
একটা ছোকরা চোর একটা শসা, একটা পাতিলেবু চুরি করে বেরিয়ে এল। একজন আধবুড়ো লোক একটা পুরনো গামছা পেয়ে সেটা পতাকার মতো নাড়তে—নাড়তে বিদেয় হল। একজন একটা নারকেল পেয়ে সেটাকেই চুমু খেয়ে সবাইকে হাত উঁচু করে দেখাল। একজন পেয়েছে একমুঠো কাঁচা লঙ্কা, তার মুখখানা ভারী বেজার। বুড়ো চোর শশীপদ এখন চোখেও কম দ্যাখে, কানেও কম শোনে। সে একগাছা ঝাঁটা হাতে বেরিয়ে এসে বিড়বিড় করতে—করতে খুঁড়িয়ে—খুঁড়িয়ে বাড়িমুখো রওনা হল। তবে এর মধ্যেই এক ছোকরা চোর একখানা তাঁতের শাড়ি বগলে নিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসতেই পচা বলল, ”ওই হচ্ছে পাঁচটা গাঁয়ের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান চোর, ফটিক।”
ঘণ্টাখানেক বাদে তাদের পালা আসতেই তিনজন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল বাড়ি—ঘর—দেওয়ালের মধ্যে।
সামনেই মেসোমশাই গুণময় রায়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গয়ারাম তাড়াতাড়ি গিয়ে প্রণাম করল। কিন্তু গুণময়বাবু তাকে মোটেই পাত্তা না দিয়ে বললেন, ”অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।”
”মেসোমশাই, আমি গয়ারাম।”
”আয়ারাম গয়ারামদেরই তো দেখছি রে বাবু।”
ভাগ্য ভালো, ঠিক এই সময়েই মাসি কী একটা কাজে মেসোকে ডাকতে এসেছিলেন। গয়ারাম চেঁচিয়ে উঠল ”মাসি।”
মাসি হাঁ করে তার দিকে একটু চেয়ে থেকে বলেন, ”মরণ! তুই এই চোরেদের দলে কেন রে মুখপোড়া? তোর চেহারাটাও তো চোর—চোর দেখাচ্ছে। আয় আয়, ঘরে আয় বাবা। মুখখানা একদম শুকিয়ে গিয়েছে।”
পচা আর গদা গয়ারামের কাণ্ড দেখে হাঁ। পচা বলে উঠল, ”সে কী হে ভায়া, তুমি চোর নও?”
ভারি লজ্জা পেয়ে গয়ারাম আমতা আমতা করে বলল, ”ইচ্ছে যে ছিল না তা নয়। তবে এ যাত্রায় আর হয়ে উঠল না। ভায়ারা, তোমরা বরং চেষ্টা করে দ্যাখো।”
পচা আর গদা ভারি দুঃখিত হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল। গদা বিড়বিড় করে বলল, ”নেমকহারাম আর কাকে বলে!”