মাসি

মাসি 

মস্ত বড় দোতলা বাড়ি। বাইরের মহলটা আলাদা। ভিতরে দুইটি মহল, রান্নাবাড়িটা ধরিলে তিনটা। বাড়ির এক কোণ থেকে ডাক দিলে অন্য কোণে সব সময় আওয়াজ পঁহুছায় না। 

এত বড় বাড়িটাকে জিয়াইয়া রাখিয়াছে দুইটি শিশুতে। 

কেমন ধারা একটু শোনায় বটে; প্রশ্ন উঠে, তবে আর সবাই গেল কোথায়?

আর সবাই সংসারটাকে বাঁচাইয়া রাখিতে ব্যস্ত—আজকের সংসার আবার ভবিষ্যতের সংসারও। ঠাকুরমা, দিদিমা, মাসি, পিসিতে অনেকগুলি বৃদ্ধা,—তাঁহারা পুষ্পে নৈবেদ্যে ঠাকুরদের তুষ্ট করেন,—তোমরাও খাও-দাও ঠাকুর, এদেরও খাওয়া—দাওয়ার দিকে একটু নজর রেখো। 

যাঁরা গিন্নির দলের তাঁহাদের তো উদয়াস্ত দম লইবার সময় থাকে না; রান্নার দিকে নজর রাখো, বাজারের দিকে নজর রাখো, আপিস-ইস্কুলের ব্যবস্থায় যেন এতটুকু না গাফিলতি হয়, আরও সব নানানখানা; এদের পরে যাঁরা, তাঁদের এতদুভয়ের ফাই-ফরমাশ খাটিতে খাটিতে দম বন্ধ হইয়া আসে—পূজার চন্দন ঘষা থেকে পান সাজা, স্কুলগামী ছোট দলের ধোয়ানো-মোছানো জামা-কাপড়-পরানো পর্যন্ত। অর্থাৎ সংসারের বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত। 

কর্তারা সংসার বাঁচাইয়া রাখার একেবারে গোড়ার ব্যাপার লইয়া ব্যস্ত—অর্থাৎ রোজগারের ব্যাপার। সকাল থেকে মক্কেল, রোগী—একটু ডাইনে-বাঁয়ে চাহিবার ফুরসত থাকে না। বৈকালে হয়তো একটু ক্লাব, সেখানেও উদ্দেশ্য ওই একই—অর্থাৎ সংসারটিকে জিয়াইয়া রাখা। তাহার জন্য নিজের নিজের প্রাণশক্তিকে অটুট রাখিতে হইবে তো?—তাই ক্লাব, অথবা অন্যভাবে একটু চিত্তবিনোদন। 

কিন্তু সংসার বাঁচাইয়া রাখা আর বাড়ি বাঁচাইয়া রাখা এক কথা নয়। বিধাতা পুরুষ যে মন্ত্রে বাড়ি বাঁচাইয়া রাখেন, সে মন্ত্রের সংগীত একটু অন্য ধরনের। তাহার জন্য বাছিয়া লন শিশুর কণ্ঠ। এ বাড়িতে আছে মিটু আর তুলতুল, বয়স আড়াই থেকে তিনের মধ্যে; তুলতুলটি মেয়ে, সেই ছোট। 

সত্যই তুলতুল; এত নরম যে চলা-ফেরার মধ্যে কেন এলাইয়া পড়ে না, সেইটাই আশ্চর্য বলিয়া মনে হয়। যেখানেই হাত দাও—কাঁধে, হাতে, পিঠে, গাল দুইটিতে, আঙুলগুলি যেন খানিকটা মাখনের তালে বসিয়া যায়। চোখ দুইটি স্বপ্নালু, মাথায় কোঁকড়া-কোঁকড়া এক-মাথা কালো কুচকুচে চুল—রেশমের মতো হালকা আর মসৃণ। পাতলা ঠোঁট দুইটি যখন নড়ে, মনে হয়, ওইটুকুতেই যেন রক্ত ফাটিয়া পড়িবে। স্বভাবটিও বড্ড নরম; কিন্তু মিটুর সংসর্গে নরম থাকা দিন-দিনই নাকি কঠিন হইয়া উঠিতেছে। 

মিটুটি অতিরিক্ত দুষ্ট, চঞ্চল আর ধূর্ত। কথাগুলায় জিবের একটুও জড়তা নাই; মনে হয় পাঁচ-ছয় বছরের ছেলে কথা কহিতেছে। কথার বাঁধুনির বিষয় যদি ধরা হয় তো যে কোনও বয়সের লোকের মুখেই বেশ মানায়। কিছু বলিলে বুড়োদের মতো ভু দুইটি কুঞ্চিত করিয়া চোখে চোখ রাখিয়া শোনে, একটু ভাবে, তাহার পর উত্তর দেয়। 

বারান্দার ও-দিককার ঘরে প্রবল উৎসাহে মাতামাতি করিতেছে; একটু কড়া গলায়ই ডাকিলাম, মিটু, একবার এদিকে আসতে হবে। 

এখানে বলিয়া রাখা ভালো যে, অপরিচিত না হইলেও অনেকটা নূতন আমি মিটুর পক্ষে। উহাদের লইয়া যাইবার জন্য উহাদের মামার বাড়ি আসিয়াছি। মিটু দাপাদাপি স্থগিত রাখিয়া দুই পা অগ্রসর হইয়া আবার থামিয়া গেল। মা আর ভাইদের কাছে শুনিয়াছে আমি নাকি একটু কড়া প্রকৃতির মানুষ; ডান হাতের চারিটি আঙুল দাঁতে চাপিয়া আমার পানে চোখ তুলিয়া প্রশ্ন করিল, কেন মেজকাকা, একটা কথা বলবে? 

অর্থাৎ সামান্য কোনও একটা কথাই তো?—মারধোর করিবার উদ্দেশ্য নয়? তাহা হইলে সে দূর হইতে আপন পথ দেখে। দাদুরা আছে, দিদিমারা আছে, মামার বাড়িতে নিরাপদ স্থানের অভাব নাই। 

ছেলেটি ইংরাজিতে যাহাকে বলে প্রডিজি তাই, অবশ্য দুষ্টামির দিক দিয়া; ওর সাহচর্যে তুলতুল যদি কাঠিন্য লাভ করে তো তাহাতে বিস্মিত হইবার কিছুই নাই। 

দুইটির সঙ্গে ভালো করিয়া পরিচয় হইল সকালে জল-খাবারের সময়। কুটুমবাড়ির আয়োজন—ডিশে প্লেটে সাজানো ফল, মিষ্টান্ন, টোস্ট, কেক্, ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম। মিটুর দিদিমা সামনে একটি কৌচে বসিয়া গল্প করিতেছেন। একটা উদ্দেশ্য নিশ্চয় এই যে, কিছু ফেলিয়া না রাখিয়া গল্পের ফাঁকে ফাঁকে একটি একটি করিয়া সমস্তগুলির সদ্‌ব্যবহার করি। বেশ একটু অস্বস্তিজনক অবস্থা দাঁড়াইয়াছে। গল্পের মধ্যেই অনুরোধ—উপরোধও আসিয়া পড়িতে লাগিল; একটি রাখিতে হইল, একটি কাটাইলাম, তৃতীয়টি লইয়া টানাটানি চলিতেছে, এমন সময় ওঁর একটা জরুরি তলব আসিল। সমস্তগুলি শেষ করিবার একটা পাইকারি হুকুম রাখিয়া উনি উঠিয়া গেলেন। 

একে লড়াইয়ের বাজার, কিছু পাওয়া যায় না, সামান্য পাওয়া গিয়াছে তাহা হইতে ফেলিয়া রাখিলে তিনি শুনিবেন না। বলিয়া গেলেন কাহাকেও পাঠাইয়া দিতেছেন!

বলিলাম, তা হলে এমন কাউকে পাঠিয়ে দেবেন না, যিনি এই এতগুলো জিনিসকে কিছু পাওয়া গেল না বলে না ধরেন। 

না বাবা, বাজে কথা শোনা হবে না—বলিয়া চলিয়া গেলেন। 

উনি যাইবার একটু পরে পিছনে শিশুকণ্ঠে অল্প একটু গলা-খাঁকারি দেওয়ার শব্দ হইল; ফিরিয়া দেখি, পিছনের দোরের চৌকাঠে দাঁড়াইয়া মিটু। একবার দেখাটা হইয়া যাইতে চক্ষুলজ্জাটা ভাঙিয়া গেল বোধহয়, আসিয়া সোফার পিছনটিতে দাঁড়াইল। 

আর এক কাপ চা ঢালিতে ঢালিতে প্রশ্ন করিলাম, কি মনে করে।

খাবারগুলির দিকে চাহিয়া ছিল, একটি দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল, বলিল, এমনি। 

বড়োদের মতো এই কথাটি খুব রপ্ত করিয়া রাখিয়াছে মিটু। সর্বদাই কিছু না কিছু উদ্দেশ্য লইয়া থাকে বলিয়া ওই কথাটি দিয়া অনাসক্তির ভাবটা ফুটাইয়া রাখিবার চেষ্টা করে; ওর সঙ্গে একটু বেপরোয়া ভাব মিশাইবার অভিপ্রায় হইলে বলে, এমনি—ইচ্ছে। 

একটি কেক্ ভাঙিয়া মুখে দিলাম, নিজের মনেই বলিলাম, বাঃ চমৎকার কেটি দিয়েছে তো, কী মিষ্টি! 

মিটু একবার আড়চোখে কেটির পানে চাহিল, আর একটি দীর্ঘশ্বাস পড়িল। প্রথম গ্রাসটি শেষ করিয়া আবার তুলিয়াছি কেক্‌টা, মিটু প্রশ্ন করিল—মেজকাকা, বাড়িতে কে কে আছে? আছেন বলতে হয়, না? 

বলিলাম, হ্যাঁ। তোমার দাদু আছেন, জেঠামশাইরা আছেন, জেঠাইমারা, কাকারা, খুড়িমারা, দাদারা, দিদিরা— 

মিটু বলিল, জানো মেজকাকা? তুলতুল বড্ড হ্যাংলা, আমি তাড়িয়ে দিয়েছি।

বাড়িতে পাঁচ-ছয়টি হ্যাংলা-পরিবৃত হইয়া আহার করা অভ্যাস, মিটুর দিদিমা বর্তমানে সেই অভাবটাই এতক্ষণ সব চেয়ে বেশি অনুভব করিতেছিলাম! যাই হোক একটিকে পাওয়া গেছে আপাতত; তাহারই লোভটুকু ভালো করিয়া উপভোগ করিবার ইচ্ছা দমন করিতে পারিলাম না। বলিলাম, আহা, ও ছেলেমানুষ কিনা; ছেলেমানুষ একটু হ্যাংলা হয়। তুমি তো বড় হয়ে গেছ মিটু, না? 

কোনও উত্তর পাইলাম না, মিটু শুধু চারিটি আঙুল মুখে পুরিয়া ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া স্থির দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়া রহিল। 

একখানি চায়ের রেকাবিতে একটু কেক্, দুইখানা বিস্কুট, কিছু কমলালেবুর কোয়া, একটি সন্দেশ, একটা রসগোল্লা আলাদা করিয়া রাখিলাম। মিটু স্থির লুব্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া আছে। বলিলাম, যাও, ডেকে নিয়ে এস তুলতুলকে এবার। আহা, ছেলেমানুষ, একটু হ্যাংলা হবে না? ও তো আর মিটুর মতন বড় হয়নি, হবে না হ্যাংলা একটু? যাও, ডেকে নিয়ে এস। 

মিটু ভ্রু দুইটা চাপিয়াই পরম অভিনিবেশের সহিত আমার কথাগুলো শুনিতেছিল। বেশ দেখিতেছি, ওর মনের গভীরে একটি আলাদা চিন্তার ধারা বহিয়া চলিয়াছে। যাইবার কোনও লক্ষণই দেখা গেল না,—সোফাটার পিঠ ধরিয়া বার দুয়েক একটু দোল খাইল, বার দুয়েক তুলতুলের রেকাবিটার পানে চাহিল, তাহার পর বলিল, আমিও তো বড় হইনি। 

আমি কপালে ভ্রূ তুলিয়া বলিলাম, সে কী কথা—তুমি বড় হওনি! মস্ত বড় হয়েছ যে, তুলতুলের চেয়ে বড়, খোকার দাদা! খোকা যেই ভাত খেতে শিখবে, ‘দাদা দাদা’ বলে কোলে উঠবে তোমার 

বেচারা একটু প্রবঞ্চিত হইল, বড় হওয়ার গুমরে আরও বার দুয়েক দোল খাইয়া বলিল, খোকা ঝিনুকে দুধ খায়, ন্যাংটো; আমি তো প্যান্ট পরি, খোকা তো খোকা; আমি তো মিটুবাবু। 

বলিলাম, তা বই কী। আর খোকা তো হ্যাংলা, মাটি খায়। যাও, ডেকে আনো তুলতুলকে। 

মিটু পিছনের দুয়ারের দিকে চাহিল, ঘুরিয়া দেখি তাহার দিদিমার দীর্ঘ অনুপস্থিতির সুযোগে তুলতুল কখন আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। ডাকিলাম, এই যে, এস তুলতুল, কখন থেকে তোমার জন্যে খাবার নিয়ে বসে আছি। 

তুলতুল একবার পিছন দিকে চাহিল, ঘুরিয়া খাবারের পানে চাহিল, তাহার পর ঠোঁট ফুলাইয়া ট, ড, ড—এই রকম গোছের কতকগুলো অক্ষর সংযোগে এক অদ্ভুত উচ্চারণে কী একটা বলিল। মিটুর যেমন পরিষ্কার, এর গুলা তেমনি অস্পষ্ট; একেবারেই জিবের আড় ভাঙে নাই। লোকে যে টপ করিয়া ধরিতে পারে না এটা নিশ্চয় মিটুর জানা, বুঝাইয়া দিল, বলছে, ও হ্যাংলামি করবে না। 

তুলতুলের দিকে চাহিয়া বলিলাম, না, তুমি এস, হ্যাংলামি হবে না, তোমার জন্যে তো খাবার রয়েছে; আলাদা থাকলে হ্যাংলামি হয় না; এস তো। 

তুলতুল একবার পিছনে দেখিয়া লইয়া প্রবেশ করিল, তবে আমার কাছে না আসিয়া পাশটিতে গিয়া দাঁড়াইল। দুয়ারের দিকে আরও একবার চাহিয়া লইয়া খাবারের উপর ঢুলঢুলে লুব্ধ চোখ দুইটি রাখিয়া স্বকীয় উচ্চারণে আবার কী বলিল; এবার একটু বেশি। 

মিটু বুঝাইয়া দিল, খাবারের দিকে একবার চাহিয়া লইয়া একটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া বলিল, বলছে, শুধু বড় জেটুর কাছে হ্যাংলামি করব। বড় জেটু বকেন না। 

হ্যাংলামি কথাটা তাহা হইলে তত আপত্তিজনক নয় তুলতুলের কাছে, যদিও মিটু অর্থটা অনেকখানি বোঝে। জিনিসটা যে দোষের সেদিকে না গিয়া বলিলাম, আমিও বকব না, বড় জেটুর চেয়ে আমি বেশি ভালোবাসি হ্যাংলাদের। বড্ড ভালোবাসি, এই দেখ না আলাদা করে খাবার রেখে দিয়েছি। কেউ যদি বকে তোমাকে, তার সঙ্গে খুব ঝগড়া করব, মিটু যদি তাড়িয়ে দিতে যায়, ওকে মারব। 

তুলতুল একবার আড়চোখে মিটুর পানে চাহিয়া লইয়া পায়রার মতো গলা নাচাইয়া কী বলিল, মিটু একটু টানিয়া উত্তর দিল, হোস নে, অমি তো বলিও না। 

জিজ্ঞাসা করিলাম, ব্যাপারটা কী? 

মিটু বলিল, বলছে, মিটুর মাসি হক না। আমি তো ডাকিও না ‘মাসি’ বলে।

বলিলাম, আচ্ছা, মাসি-বোনপোর বোঝাপড়া পরে হবে। তুমি এস তো খেতে।

নিজেই উঠিলাম, সঙ্গে করিয়া আনিয়া রেকাবির সামনে বসাইয়া বলিলাম, খাও। তুলতুল বড্ড লক্ষ্মী। ও তো কারুর কাছে হ্যাংলামি করে না, শুধু বড় জেটুর কাছে আর আমার কাছে করে। ওবেলা আবার খাবার খাব, তুলতুল এসে খাবে। কমলালেবুটা কি চমৎকার মিষ্টি, না তুলতুল? 

তুলতুল মাথাটা দোলাইয়া কী বলিল; আমি টীকার জন্য মিটুর পানে চাহিতে মিটু ঠোঁট-দুইটা জড়ো করিয়া বলিল, আমি বলব না, যাও। 

আহার্যের প্রশংসায় আরও একটু রং চড়াইলাম, সাক্ষী পাইয়া সুবিধাও হইয়াছে। মিটু পিছন থেকে সামনে আসিয়া সোফাটায় হাত-পা ছড়াইয়া বসিল। একবার শুইয়া পড়িল, একবার সোফার উপর ডিগবাজি খাইবার চেষ্টা করিয়া নির্লিপ্তভাবটা জাগাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিল, তাহার পর হঠাৎ একবার সোজা হইয়া বসিয়া ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া প্রশ্ন করিল, মেজকাকা, তুমি হ্যাংলা মেয়েদের ভালোবাস? 

বলিলাম, হ্যাঁ, খুব। 

ছেলেদের?—ভ্রূ নামাইয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়া আছে। 

ভাইপোর ওকালতি বুদ্ধিতে পেটে হাসি সুড়সুড় করিয়া উঠিতেছে। গম্ভীর ভাবে অল্প একটু মাথা নাড়িয়া বলিলাম, হুঁ, বাসি। তবে বড় ছেলেদের নয়। 

মিন্টু আবার পরাভবের ভাবটা সোফায় মাখাইয়া ফেলিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু বেশ বুঝিতেছি, আর পারিতেছে না বেচারা। নিষ্ঠুর খেলায় আমারও মনটা ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিতেছে, ভাবিতেছি, ডাকিয়া লইব; এমন সময় মিটু ডিগবাজি দেওয়ার জন্য মাথাটা গুঁজিয়া উল্টা চোখে আমার পানে চাহিয়া বলিল, মেজকাকা, কানে কানে একটা কথা শুনবে? 

উলটা দৃষ্টিতে লজ্জাটা বোধ হয় একটু আড়ালে পড়িয়া যাইতেছে। 

বলিলাম, শুনব, কথাটা কী? 

কাউকে বলবে না?—কারুক্কে—কারুক্কে নয়—তুলতুলকেও না? 

তুলতুল বিস্কুট চিবাইতেছিল, বোধহয় শুনিবার অধিকার সাব্যস্ত করিবার জন্য মুখটা ভার করিয়া বলিল, আমি টো টোর মাটি ওই। 

ইস, মাসি!—বলিয়া মিটু সোজা হইয়া বসিল, তাহার পর আমার মতামতের অপেক্ষা না করিয়াই উঠিয়া আসিয়া আমার কানে মুখ দিয়া বলিল, আমি তো কচি ছেলে মেজকাকা, বড় নয় তো! 

‘হ্যাংলা’ কথাটা ঊহ্য রাখিল। ওইটুকু মেজকাকা কি বুঝিয়া লইতে পারিবে না? এতটা বড় হইয়াছে কী করিতে। অর্থাৎ, হার মানিতেছে, তবে যতটা সম্ভব মর্যাদা বজায় রাখিয়া। 

.

দ্বিতীয় পর্যায়ে একটু গোল বাধিল। 

মিটুকে একটা রেকাবিতে করিয়া খাবারগুলো সাজাইয়া ডাকিতেই তুলতুল হাত গুটাইয়া মুখটা তোলো-হাঁড়ি করিয়া বসিল। 

একটু ব্যস্ত হইয়া প্রশ্ন করিলাম, কী হল?—তোমার আবার কী হল, তুলতুল?

সামান্য একটু মাথা নাড়ার সঙ্গে উত্তর হইল—আমি ঠাবুই না, ডেকো টো!

ওর আবার ‘দেখো তো’ কথাটা প্রয়োজনের গুরুত্বে ব্যবহার করা অভ্যাস।

প্রশ্ন করিলাম, কেন খাবে না? বেশ তো দুজনে হলে… 

আবদারের কণ্ঠে উত্তর হইল, আমি টো মাটি ওই। 

বলিলাম, তা হও বইকি, তাই তো বলছি—দিব্যি মাসি-বোনপোতে… 

তুলতুল অভিমানের স্বরে গর-গর করিয়া খানিকটা কী বলিয়া গেল, একবর্ণও বুঝিতে পারিলাম না। 

অনেক তপস্যায় পাওয়া খাবার, অনেক পিছাইয়াও আছে, আবার বিপদ ঘনাইয়া আসিতেও দেরি না হইতে পারে, মিটু খুব তাড়াতাড়ি হাতমুখ চালাইতে শুরু করিয়া দিয়াছিল, ঘুরিয়া একবার তুলতুলের পানে চাহিয়া নাক সিঁটকাইয়া বলিল, ই-স্! তাহার পর আমার প্লেটের রাজভোগ দুইটার পানে একবার চাহিয়া লইয়া প্রশ্ন করিল, দিদিমণি আবার আসবেন; মেজকাকা? 

ভবিষ্যতের দিকেও নজর আছে। বলিলাম, না; তুলতুল কী বললে রে মিটু?

মিটু দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল, না, আমি কখনও ‘মাসি’ বলব না—বলবই না।

তুলতুল মুখটা আরও অন্ধকার করিয়া বলিল, আমি ঠাবুই না, ডেকো টো।

মিটু ঠোটটা উলটাইয়া বলিল, বয়ে গেল। 

একবার তুলতুলের রেকাবির পানে চাহিয়া লইয়া বলিল, আমি খাব’খন, অ্যা মেজকাকা? 

বলিলাম, তা খাস, মা-মাসির পাতের পেসাদ খেতে হয়। 

মিটু ভ্ৰূ দুইটা খুব চাপিয়া সন্দিগ্ধভাবে আমার মুখের পানে চাহিয়া লইয়া একটু, তাহার পরে নিঃশব্দে নিজের রেকাবিতে মনঃসংযোগ করিল। কথার মধ্যে কিছু মারপ্যাচের গন্ধ পাইলে ও এইরকম করে, পরে ওই যে নিঃশব্দে আহার বা দোলা ডিগবাজি খাওয়া, ওই সময়টা ভাবিয়া লয় ও একটা কাটান্ ঠিক করিয়া ফেলে। একবার মুখ তুলিয়া বলিল, মাসির তো কাপড় পরে মেজকাকা, তা জানো না বুঝি? আবার ইঙ্গিত বোকা বানায়। বলিলাম, এখন ছোট, তাই ইজের আর পেনি পরে আছে। বড় হয়ে পরবে কাপড়। 

আবার একটু নিঃশব্দে আহার; তাহার পর একটা কমলালেবুর কোয়া চিবাইতে চিবাইতে বলিল, বড় হলে বলব ‘মাসি’। 

রাগিয়া বলিলাম, বড় বেয়াড়া তো তুই! আচ্ছা, ও ‘মাসি’ না বলে, আমি ‘গিন্নি’ বলে ডাকব তোমায় তুলতুল, তুমি খাও। 

তুলতুল গলাটা দুলাইয়া বলিল, আমি টো ডিন্নি নয়, আমি টো মাটি ওই। 

আচ্ছা এক ফ্যাসাদে পড়া গেল তো; এমনি তো দুটি প্রজাপতির মতো বেশ উড়িয়া ফিরিয়া সমস্ত বাড়িটা এক করিয়া বেড়াইতেছে, দুইজনে একরত্তি আলাদা নয়। আমার এখানে আসিয়াই এ কী এক আদরে জিদ ধরিয়া বসিল! বলিলাম, মাটিরা ভিন্নিও হয়, সে বরং আরও ভালো, খুব আদর করব, ক-ত্তো জিনিস দোব। নড়চড় নাই, মানময়ী গৃহিণীর মতো মুখ ভার করিয়া অল্প একটু ঘুরাইয়া বসিয়া আছে। বলিলাম, শুনছ, তুলতুল? খাও। অনেক খাবার দোব—অনেক। 

আদায়ের সুরেই ঘাড় বাঁকাইয়া একটু আড়ে চাহিয়া প্রশ্ন করিল, টাপোড্ডেবে?

বুঝিতে না পারিয়া মিটুর পানে চাহিতে মিটু প্রশ্নটারই দ্বিরুক্তি করিল, কাপড় দেবে?

এতক্ষণ কোনওরকমে চাপিয়া ছিলাম, একেবারে ডুকরাইয়া হাসিয়া উঠিলাম। এবার আবার মিটুর চেয়েও সেয়ানা! এক সঙ্গে গৃহিণীত্ব আর মাসিত্বের ব্যবস্থা করিয়া লইতে চায় যে! গৃহিণী-রূপে কাপড় আদায়, তাহার পর সেটি পরিয়া মাসি হইয়া বসা। 

বলিলাম, যা সম্বন্ধ দাঁড়াল, কাপড় তো দেওয়ারই কথা তুলতুল। কিন্তু বাজারে তো পাওয়া যাবে না, আর একটু বড় হও। নাও, এবার খাও দিকিন। 

মুখটা শুধু আর একটু ঘুরিয়া গেল। 

বোধহয়, আমার হঠাৎ হাসিয়া উঠাতেই মিটুর দিদিমা দুয়ারের বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রাগের ভান করিয়া বলিলেন, ওমা, একী কাণ্ড! একটু সরেছি আর দুটোতে এসে ভাগ বসাতে আরম্ভ করেছে? একে কিচ্ছু পাওয়া যায় না! 

মিটু হাত গুটাইয়া লইল, হঠাৎ এ রকম হাতে-নাতে ধরা পড়িয়া যাওয়ায় বুদ্ধি খুলিতেছে না। এদিকে একে অভিমান ছিলই, তাহার উপর এই গঞ্জনার সূচনা, তুলতুলের ঠোট দুইটি একটু কাঁপিয়া উঠিল। আমি হাসিয়া বলিলাম, আপনাকে একটু স’রে যেতে হবে, মা। যা সমস্যা নিয়ে পড়েছি, তাতে যদি দুটো খাবারের ওপর দিয়েই রেহাই পাই তো বুঝব… 

আগাইয়া আসিলেন, একটু হাসিয়াই বলিলেন, ব্যাপারখানা কী? পাত থেকে খাবার তুলে দিতে হবে, আবার সমস্যাও? এসে জুটল কোন দিক দিয়ে? নাও, খেয়ে নাও, দখল যখন করেই বসেছে… 

বলিলাম, ওকে মিটু ‘মাসি’ না বললে খাবে না। 

সেই মাসি-বোনপোর ব্যাপার? ও সমস্যা আজ পর্যন্ত কেউ মেটাতে পারলে না তো তুমি একদিনের জন্যে এসে কোথা থেকে পারবে, বাপু? কম শয়তান তোমাদের ওই বাঁটকুলটি? এতটুকু দেখতে হলে কী হয়? কাপড় না পরলে কোনওমতে ‘মাসি বলবে না; সমস্ত বাড়ি এক দিকে, ও এক দিকে। এখন, অতটুকু মেয়ের কাপড় কোথায় পায় বল দিকিন লোকে? 

মিটুর পানে চাহিয়া বলিলেন, বল না ‘মাসি’ একবারটি না হয়—মেজকাকা বলছেন। না বললে, তুমি ওকে নিয়ে যেয়ো না, এইখানে ফেলে রেখে যেয়ো, জব্দ হবে। 

বললাম, হ্যাঁ, তাই যাব, ওর বদলে বরং তুলতুলকে নিয়ে যাব! তুমি খাও তুলতুল; লক্ষ্মীটি! সেখানে ‘মাসি’ বলবার মতো কত লোক আছে—গোপাল, মন্টু, ছবি, গৌরী, মৈয়া, কোঁদন—আরও কত্তো সব—তুমি উত্তুর দিয়ে উঠতেই পারবে না! নাও, খেয়ে নাও, থাকবে মিটে এখনে একলা পড়ে। 

রসগোল্লাটি তুলিয়া মুখের কাছে ধরিলাম। তুলতুল মুখটা ঘুরাইয়া বিড়বিড় করিয়া কী একটু বলিল। মিটুর দিদিমা চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন, শোনো!— শুনলে তো? 

বলিলাম, ধরতে পারলাম না তো! 

বলছে, মিটুও সেখানে যাবে, ‘মাসি’ বলবে। ওকে যদি একশোটা ছেলেমেয়ে চারদিক থেকে ‘মাসি’ বলে ডাকতে থাকে, তবু মিটু না ডাকলে সে সব কিছু নয় ওর কাছে! কাকে রেখে কাকে দুষব বল—ও-ও কি কম দজ্জাল মেয়ে? মিটুকে ঘাড় ধরে ‘মাসি’ বলাবে, তবে ওর সোয়াস্তি। 

আর একটু চেষ্টা করিয়া তাঁহাকে চলিয়া যাইতে হইল; কন্যার আজই যাত্রার দিন, তাঁহার দম লইবার অবসর নাই। আমার এমন কিছু তাড়া নাই, ওদের সমস্যা লইয়াই আরও কাটাইলাম খানিকটা; এবং অবশেষে আধাআধি একটা সমাধানও হইল; বলিলাম, বেশ, আজ বাজার থেকে তোমার কাপড় এনে দেব তুলতুল, তুমি খাও। আজই এনে দোব কেমন ঝকমকে শাড়ি। এইবার বল ‘মাসি’, মিটু। 

মিটু সন্দেশে একটা কামড় দিয়া একটু গলা দোলাইয়া ওর বুড়ুটে ভাষায় বলিল, কাপড় পরুক না, তাড়াতাড়ি কীসের? 

আধাআধি সমাধান এইজন্য বলিতেছি যে, তুলতুল শেষ পর্যন্ত খাবারগুলি খাইল। অবশ্য শুধু ঝক্‌মকে শাড়ির লোভ দেখাইয়া ফল হইল না, তাহার সঙ্গে একটু ঝাল—মশলা মিশাইতে হইল!—মিটু ভয়ংকর বদমাইশ—মিটুকে সেখানে লইয়া গিয়া বেত মারিয়া ‘মাসি’ বলাইতে হইবে,—সেখানে তো দাদুও নাই, দিদিমাও নাই যে বাঁচাইবে— মিটু সবই খাইয়া ফেলিল, তুলতুল তাড়াতাড়ি না খাইয়া ফেলিলে ওর ভাগটাও কাড়িয়া খাইবে—এখানে কিছু বলা যাইবে না কিনা, দাদু-দিদিমা রহিয়াছেন যে— 

.

আমাদের প্রতিদিনের জীবনে একটি অতি সূক্ষ্ম প্রবঞ্চনা থাকে শিশুদের লইয়া জীবনের যে অংশটি, তাহাতে। এত সূক্ষ্ম যে আমরা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনি না, ওদের ভুলাইয়া—ভালাইয়া প্রতিজ্ঞা করিয়া ভাঙিয়া, আমাদের যাত্রার পথ মসৃণ করিয়া লই। বোধহয় ভাবি, এত ছোট সমাচারগুলো ভগবানের কাছে পৌঁছোয় না। পৌঁছায়ই, কেননা এক-এক সময় এক-একটি এমন ধাক্কা আসিয়া বুকে লাগে যে, সে আর ভোলা যায় না। 

শিশু যে ভগবানের একেবারে বুকের কাছটিতে থাকে—এ কথা আমরা ভুলিয়া বসিয়া থাকি। 

তুলতুলের শাড়ির কথা এমন কিছু বড় কথা নয় যে, মনে করিয়া বসিয়া থাকিতে হইবে। আহার শেষ করিয়া দুটিতে মাসি-বোনপোর আড়াআড়ি ভুলিয়া, নাচিয়া-কুঁদিয়া আবার সমস্ত বাড়িটা পূর্ণ করিয়া তুলিল—কোথাও ভাঙা, কোথাও গড়া—ওদের নিজ প্রথায়—কোথাও বকুনি, কোথাও আদর; যদি একটু নীরবতা তো, কণ্ঠকাকলি পরমুহূর্তে দ্বিগুণ উচ্ছ্বাসে বিরাট দেউড়ির দেয়ালে আঘাত হানিয়া উঠে। 

আমি একটু ঘোরাঘুরি করিলাম, খানিকটা গল্পে মাতিলাম, দরকারি আলোচনাও ছিল—আজই বৈকালে যাইতে হইবে, এতগুলি লোককে লইয়া গাড়িতে যাওয়া, যা অবস্থা আজকাল! 

ওরই মধ্যেই তুলতুল আসিয়া একবার হাঁটুটা জড়াইয়া গলা তুলিয়া আবদারের সুরে বলিল, আমাট্টাপোর আনটে অবে; আমি মাটি অবো। 

বলিলাম, নিশ্চয়, আনব বইকি। 

আবার ঠোঁট কুঞ্চিত করিয়া বলিল, আমি ডিন্নি ওই। 

আমাদের নূতন-পাতা সম্বন্ধটা লইয়া বোধহয় বাড়িতে একটা আলোচনা হইয়াছে, মিটুর মারফত খবরটা প্রচারিত হইয়াছে; তুলতুল টের পাইয়াছে গিন্নির দর অনেক— শাড়ি পায়, গয়না পায়, আরও কত কী পায় মনে করাইয়া দিল। 

ঠিক করিয়াছিলাম বাজারে গিয়া গজ দুয়েক রঙিন রেশম বা মলমল-জাতীয় কাপড় কিনিয়া জরির পাড় বসাইয়া শাড়ি-সমস্যা মিটাইব। উঠিতেও যাইতেছিলাম— বলিয়াছি ছেলেমানুষকে, ওটুকু সারিয়াই নিশ্চিন্ত হইয়া বসি। গল্পটা একটু দিক—পরিবর্তন করিয়া নূতনভাবে জমিয়া উঠিল। গল্পের মজলিশে লোক বাড়িল, শাখা—প্রশাখায় গল্প নূতন নূতন পথে ছুটিল, একটি মেয়ের শিশুসুলভ আবদার দুইটি চঞ্চল ঠোটের স্মৃতি মাঝে মাঝে জাগাইতে জাগাইতে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হইয়া কখন মিলাইয়া গেল। 

মনে পড়িল যখন মধ্যাহ্ন-আহারের ডাক পড়িল। অবশ্য, বড় প্রয়োজনের কাছে ওই সামান্য কথাটা আমলই পাইল না; আগে এটা তো সারিয়া লই, তাহার পর না হয় বাজারে চাকর-বাকর কাহাকেও পাঠাইয়া আনাইয়া লওয়া যাইবে। 

ভাত খাওয়ার সময়ে কাছে আসিয়া দাঁড়ানোটা হ্যাংলামির পর্যায়ে পড়ে না; তুলতুল বেশ সপ্রতিভ এবং খোলখুলি ভাবেই সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। আমি একটু পুরাতনও তো হইয়াছি; হ্যাংলামির ধার মরিয়া যায় ওতে। একবার মিটুও আসিল; খানিকক্ষণ থাকিয়া কী যেন একটা খুব জরুরি কাজে বন্ করিয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। টাকার-ডকারের বাঁধ খুলিয়া দিয়া অনর্গল গল্প করিয়া চলিয়াছে তুলতুল; মাঝে মাঝে শুনিতেছি, আবার মাঝে মাঝে নিজেদের গল্পে ডুবিয়া যাইতেছি। মিটুর দিদিমা রহিয়াছেন, দাদুরা আহার করিতেছেন। শেষ পাতে দই-মিষ্টির সময় তুলতুলকে পাশে আসিয়া বসিতে বলিলাম। তুলতুল একবার জেঠাইমার পানে চাহিল; তিনি একটু হাসিয়া বলিলেন, বসো, ওই উদ্দেশ্যেই তো এসে দাঁড়ানো গুটি-গুটি করে! তুলতুল দুই পা অগ্রসর হইয়া বসিতে গিয়া আবার দাঁড়াইয়া পড়িল, তাহার পর ঘুরিয়া উপরের সিঁড়ির দিকে ছুটিল। প্রশ্ন করিলাম, কী হল তুলতুল? 

সকলেই তাহার এই হঠাৎ ভাবপরিবর্তনে একটু বিস্মিত হইয়া চাহিয়া আছেন! তুলতুল ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া একটু গিন্নিপনার ভাবে তর্কের সুরে বলিল, ডাঁড়াও, মিটু ঠাবে না? ডেকো টো! 

তাহার বলিবার ধরনে সকলকেই একটু হাসিয়া উঠিতে হইল; মিটুর দিদিমা কতকটা তাহারই ভঙ্গী নকল করিয়া বলিলেন, ডেকো টো। বোনপো শুকোচ্ছে, আমার মুখে কখনও অন্ন-জল উঠতে পারে? কী রকম বেয়াক্কেলে কথা আবার! 

মিটু আসিয়া অবশ্য ‘মাসি’ বলিল না, তবে এবার আর উল্লেখযোগ্য কোনও হ্যাঙ্গামা হইল না। মিটুর দাদু একবার প্রশ্ন করিলেন, মিটু, তা হলে বলছ ‘মাসি’? 

মিটু উত্তর করিল, কাপড় পরুক না, তাড়াতাড়ি কীসের? 

তুলতুল বলিল, টাপোপ্পোব্বো; ডেকো টো! 

এইতেই আপাতত কাজ চলিয়া গেল। 

সমস্ত রাত গাড়িতে অকথ্য কষ্ট গিয়াছে, তাহার উপর মিটু-তুলতুল সত্ত্বেও কুটুমবাড়িরই আহার। একটু শয্যা আশ্রয় করিতে হইল; ওরা দুইজন সঙ্গে রহিল। বলিলাম, একটু গড়িয়ে নিই মিটু; তারপর আমি উপরে গিয়ে বাক্স খুলে পয়সা দিচ্ছি তুই পঞ্চকে ডেকে দিবি, তুলতুলের কাপড় এনে দেবে। 

তুলতুল মুখটা ভার করিয়া গড়গড় করিয়া কী খানিকটা বলিয়া গেল; দুই চারটা কথা ধরিতে পারিতেছি, অতগুলা আয়ত্ত হয় না। মিটু বলিল, বলছে, পঞ্চ আনলে আমি পারব না,—পঞ্চ, কালো, বিচ্ছিরি। 

হাসিয়া তুলতুলকে বলিলাম, তা বেশ, আমি হাতে করে আনলেই যদি তোমার কাপড় রাঙা টুকটুকে থাকে, আমিই যাব। সে তো ভাগ্যির কথা। একটু গড়িয়ে নিই, কি বলো? 

কাপড়ের আলোচনা চলিল; রাঙা টুকটুকে শাড়ি আসবে তুলতুলের—ফিনফিনে জমি, মাঝে মাঝে চুমকি বসানো, এতখানি চওড়া জরির পাড়, এই আঁচলা— এইরকম করে পরে, পিঠে এইরকম করে আঁচলা দুলিয়ে যেই দাঁড়াবে তুলতুল, অমনি মিটু এসে বলবে—ও তুলতুল মাসি! ও তুলতুল মাসি! 

আনন্দে একবার ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিয়াই তুলতুল সঙ্গে সঙ্গে মুখটা ভার করিয়া কী বলিল। মিটু বুঝাইয়া দিল, বলছে, শুধু ‘মাসি’ বলব। 

মর্যাদাজ্ঞান দেখিয়া একটু বিস্মিতই হইতে হইল, অর্থাৎ সঙ্গে নাম জুড়িয়া দিলে তো ওরই মধ্যে একটু ছোট করা হইল; তুলতুল ও-খাদটুকু চায় না। বলিলাম, হ্যাঁ, নাম ধরে আবার নাকি ‘মাসি’ বলে? মিটুর যেমন কাণ্ড? তা হলে তো নাম ধরে দাদু বলবে, নাম ধরে দিদিমা বলবে, আমারও নাম ধরে মেজকাকা বলবে।—মিটু ছুটে এসে বলবে : ও মাসি! ও মাসি! তুমি যে কাপড় পরেছ গো! ও মাসি! ও মাসি! ও মাসি! 

কী সাধ লইয়া যে ওরা জন্মায় কে জানে, কথাগুলা তুলতুলকে যেন সুড়সুড়ি দিয়া উঠিল। হঠাৎ আমার দক্ষিণ হস্তটা টানিয়া লইয়া নিজের বুকে চাপিয়া ধরিল এবং চোখ-মুখ কুঞ্চিত করিয়া একেবারে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। হাসি থামিলে বলিল, আবাল বলো না, আবাল বলো। টি বোঝে মিটু? 

.

শাড়ি আনা হয় নাই। খুবই ক্লান্ত ছিলাম, কখন গল্পের মধ্যেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছি টের পাই নাই। উঠিলাম একেবারে যাওয়ার আয়োজনের ব্যস্ততার মধ্যে। পাশে তুলতুল শুইয়া আছে একটি পুষ্পস্তবকের মতো। ওর মুখের উপর যখন নজর পড়িল, ঠোঁটের এক কোণে একটি হাসি ধীরে ধীরে মিলাইয়া যাইতেছে; বোধহয় রঙিন শাড়ি আর ‘মাসি ‘ ডাকের স্বপ্ন দেখিতেছিল। 

মিটুর দাদু বলিলেন, আমিই তোমাকে উঠোতে বারণ করে দিয়েছিলাম, কাল ওই অবস্থা গেছে, আজ রাত্তিরেও ঘুম হবে না। নাও, মুখ হাত ধুয়ে একটু চা-টা খেয়ে নাও, স্টিমারের আর মোটে আধ ঘণ্টাটাক আছে। 

নিজেকে প্রস্তুত করিয়া লইবার মিনিট দশেক যা সময় পাওয়া গেল, তাহাতে ডাইনে-বাঁয়ে চাহিবার ফুরসত পাওয়া গেল না, শিশু-ভোলানো হালকা আলাপের মধ্যে একটি রাঙা শাড়িও প্রলোভন ছিল—এ কথা আর কী করিয়া মনে থাকিবে? ক্ষতিই বা কী, যদি না রহিল মনে? বড় বাড়িতে কন্যা-বিদায়ের ব্যাপার—ওদিকেও বেশ একটা তাড়াহুড়ো পড়িয়া গেছে, কে কাহার খোঁজ রাখে? উপর থেকে নামিয়া আসিয়া যখন বিদায় লওয়ার পালা ছোটদের স্তরে নামিতে তুলতুলের কথা মনে ‘পড়িল। তুলতুল ছিল না। 

কেহ সন্ধান দিতে পারিল না। মনে ধক্ করিয়া একটা বড় আঘাত লাগিল; কিন্তু সে ক্ষণিক; তখনই অদূরে স্টিমার-ঘাটে স্টিমারের ভোঁ বাজিয়া উঠিল, ওপার হইতে উপস্থিতির সূচনা। যাত্রার তাড়ায় মোটরে গিয়া উঠিতে হইল। 

গেটের দিকে মুখ করিয়া মোটর দাঁড়াইয়া আছে। হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও বিদায়ের শেষ লগ্নটুকু মেয়েরা একটু লয়ই টানিয়া বাড়াইয়া; মিটুর মায়ের ওঠা তখনও হয় নাই। হঠাৎ আমার দৃষ্টি সামনে এক জায়গায় নিবদ্ধ হইয়া গেল। 

সুমুখেই যে দোতলার ঘরটি, তাহার সামনে রেলিঙে-ঘেরা ছোট্ট একটি বারান্দা বা ব্যালকনিতে দাঁড়াইয়া একা তুলতুল। একটি বোধহয় বারো হাতের শাড়ির বেষ্টনীতে ক্ষুদ্র শরীরটির বুক পর্যন্ত একেবারে অবলুপ্ত, তাহারই আঁচলের একটা কোণ মাথার উপর তোলা। ছোট্ট বুকের যত আশা, যত উৎকণ্ঠা তুলতুলের সেই স্বপ্নময় চোখ দুইটিকে যেন অস্বাভাবিক রকম তীক্ষ্ণ করিয়া তুলিয়াছে। মিটু আমার পাশে বসিয়া মুখটা ঘুরাইয়া বিদায়-দৃশ্য দেখিতেছে; তুলতুলের দৃষ্টি তাহারই উপর ন্যস্ত, কখন একবার ফিরিবে সেই প্রতীক্ষায়! 

বোধহয় হঠাৎ চোখ পড়ার জন্যই মনটা আমার প্রথমে হাসিতেই উদ্‌বেল হইয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি মিটুর মুখটা ঘুরাইয়া লইয়া বলিলাম, ওই দেখ, এক-কাপড় মাসি তোর! ডাক একবার ‘মাসি’ বলে! 

সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটুকুর মর্মান্তিকতা আমার বুকে যেন একটা মোচড় দিয়া উঠিল। ততক্ষণে আবার কথার সূত্র ধরিয়া সবার দৃষ্টি ব্যালকনির উপর গিয়া পড়ায় বিদায়ের অশ্রুর মধ্যেও একটু হাসি ছলছল করিয়া উঠিয়াছে। তুলতুলের মুখটা যেন কী রকম হইয়া গেল, কচি ঠোঁট দুইটি নাড়িয়া কী একটা বলিতে গিয়া জড়াইয়া ফেলিয়াই দুই হাতে মুখটা ঢাকিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। 

একবার ইচ্ছা হইল, ডাকিয়া লই। তখন কিন্তু স্টিমারের বাঁশি আর একবার বাজিয়া উঠিল; মিটুর মা তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিলেন; মোটর ছাড়িয়া দিল! ব্যালকনির নিচে দিয়া যাইবার সময় চোখ তুলিয়া দেখিলাম, অপর্যাপ্ত বস্ত্রের নিষ্ঠুর পরিহাসের মধ্যে তুলতুলের শরীরটুকু যেন ভাঙিয়া পড়িতেছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

মাসি
1 of 2

মাসি

মাসি

দু-হাতের দুটো বুড়ো আঙুল নেই বলে ফটকের আটকায় কীসে? কিছুতেই না। কেবল মাঝে মাঝে মাসি দুঃখ করে বলে–আহা, আমার ফটকের যদি দুটো বুড়ো আঙুল থাকত।

মাসি হচ্ছে কড়ে রাঁড়ি। ফটকেই তার ধ্যান জ্ঞান। বর্ধমানে ফটকের অপদার্থ বাপ এক ভুসিওলার আড়তে দাঁড়িপাল্লা সামলায়, বাদবাকি সময়টা হয় দিশি মাল গেলে, নয়তো বোকা মুখে সুখসুখ ভাব ফুটিয়ে পায়ের একজিমা চুলকোয়। ছেলেপুলেগুলো রাস্তার ধুলোকাদা মেখে ভূত সেজে বাউণ্ডুলেপনা করে বেড়ায়। ওই ভূতের দল থেকে মাসি বেছেছে ফটিককেই তুলে এনেছিল একদিন। দুটো বুড়ো আঙুল না থাকায় সে ছিল মা-বাপের কমতি ছেলে। পুরো ছেলে নয় বলে বাপ তাকে পুষ্যিপুত্ত্বর দিতে আপত্তি করেনি, মা কিছু কান্নাকাটি করেছিল, তা সে হচ্ছে মায়েদের ধাত, মনোমাসির বিষয়সম্পত্তি একদিন যে ফটিকই পাবে তা বুঝতে না পেরে। এক ভাগীদার ভাগনে মাঝে-মাঝে এসে হামলা করে। নইলে মাসির খোলার চালের বাড়ির আর তিন বিঘে ধানী জমি, কিছু সোনাদানা-এসব ফটকেই পাবে। মাসি ধর্মভীরু লোক, স্বামীর ব্যাঙ্কের টাকা-পয়সার সুদ থেকে সংসার চালায়। ইচ্ছে করলে মাসি টাকাটা বাইরে চড়া সুদে খাটাতে পারত। খাটায় না। সন্ধেবেলা ভাগবত পড়ে বারান্দায় বসে। সেই ভাগবত শুনতে মাঝে-মাঝে দু-চারজন বুড়ি বিধবা এসে বসে। তাদের কাছেই দুঃখ করে মাসি-আহা আমার ফটকের যদি দুটো বুড়ো আঙুল থাকত।

বুড়িরা সায় দিয়ে বলে–আঙুল থাকলে ও ছেলের আর দেখতে হত না। বুড়ো আঙুল ছাড়াই বা ওর আটকায় কীসে?

ঠিক কথা। ফটিকের আটকায় না। মাসি তাকে বসে থাকতে দেয় না। সাইকেল চালানো। শিখতে পাঠায়। তবলা বাজানো শিখতে পাঠায়। গাড়ি চালানো শিখতে পাঠায়। তার ধারণা, ফটিককে দিয়ে সব হবে। দিব্যি সাইকেল চালায় ফটিক, চাটুজ্জেদের ড্রাইভার মদনার সঙ্গে ভাব জমিয়ে গাড়ি চালাতেও শিখে গেল প্রায়। ভরসা আছে, মাসি একটা লরি কিনে দেবে ওকে। লম্বা লম্বা ট্রিপ মেরে দেদার কামাবে ফটিক। বুড়ো আঙুল ছাড়াই ও সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখাবে একদিন।

পাড়ার ফাংশানে সেদিন রেডিয়ো আর্টিস্ট অনিলবরণ গাইতে এসে ফটিককে দেখে চোখ কোঁচকাল, বলল –তুই পারবি?

ফটকে তবলায় পাউডার মাখাতে–মাখাতে বলল –তুমি গান ধরো না।

অনিলবরণের চাকরি ভালো নয়। হাওড়া মিউনিসিপ্যালিটির জমাদারদের কাজ দেখে বেড়ায়। কিন্তু তার চুল ফাঁপানো, পোশাক হালফিলের প্যান্ট–শার্ট, পায়ে চোখা জুতো, কণ্ঠে সর্বদা গুনগুনানি। একবার রেডিয়োতে চান্স পেয়েছে। গায়ক অনিলবরণের ডাঁটই আলাদা। এ অঞ্চলের সব ফাংশানে সে বাঁধা আর্টিস্ট। ফটকেকে তাই নীচু নজরে দেখে। অবহেলায় ফাংশানমারা একখানা সাপটা মেরে মৃদু স্বরে ফুলপ্রজাপতি–তুমি–আমি–মার্কা আধুনিক ধরে ফেলল। টপাটপ টুম টপাটপ টুম আওয়াজে তবলায় বোল তুলে ফেলে ফটিক। শ্রোতারা অনিলবরণকে ছেড়ে ফটিকের আট আঙুলের কাজ দেখে, আর বাহবা দেয়। সামনে বাচ্চারা চেঁচাচ্ছে–ফটিকদা, চালিয়ে যাও।

অনিলবরণ হারমোনিয়ামে সুর ধরে রেখে নীচু স্বরে বলল –ফটকে, ঘিঁষে মার।

তা ফটিক ঘিঁষে মারল। বাঁয়াতে দিব্যি পরিপাটি কাজ দেখায় সে। মুখে হাসি। অনিলবরণ গেয়ে উঠে তার পিঠ চাপড়ে দিল–বেশ বাজিয়েছিস।

তা ফটিকের আটকায় না। মাসির ছানি কাটার পর আজকাল সে-ই জামাকাপড়ের ফাটাফুটো উঁচ সুতোয় সেলাই করে,  ছেঁড়া বোতাম বসিয়ে নেয়। বুড়ো আঙুল ছাড়াই সে দিব্যি উলও বুনতে পারে। তর্জনী আর মাঝের আঙুলে কলম চেপে ধরে সে গোটা–গোটা অক্ষরে লেখালেখি যা চালায়, কে বলবে সেই হাতের লেখা বুড়ো আঙুল ছাড়াই লেখা হয়েছে। পাড়ায় সে হচ্ছে একটা উদাহরণ। দু-আঙুল কমতি ফটকে যা পারে তা বাড়তি দু-আঙুলের লোকেরা পারে না।

উদাহরণ আরও আছে। পঞ্চাননতলার হারাধন। কোমরের নীচের অংশটুকু শুকিয়ে কুঁকড়ে এইটুকু। হারাধন হাঁটে হামাগুড়ি দিয়ে। হাঁটুতে দড়ি দিয়ে বাঁধা চামড়ার একটু গদি, দুহাতে একজোড়া কাঠের খড়ম, ভিড়ের রাস্তায় এঁকেবেঁকে অনায়াসে চলে যায় সে। আটকায় না। কুকুর বেড়াল যদি চার পায়ে বিশ্বসংসার চষতে পারে তবে হারাধনই বা পারবে না কেন? হারাধন। বাজার করে, দোকানে সওদা করে, দোতলার সিঁড়িও দরকার মতো ভাঙতে পারে। বেঁচে থাকা মানেই হচ্ছে কম্পিটিশন।

নানা ধান্ধায় ঘুরেটুরে অবশেষে হারাধন গত বারো বছর যাবৎ তার বাড়িতে এক কালীমন্দির দিয়েছে। ভারী জাগ্রত কালী। হাফ প্যান্টপরা হারাধন গায়ে একটা পাটের চাদর জড়িয়ে পুজো করতে বসে। বেলা দশটায় শুরু হয় তার জনসংযোগ। একটা একসারসাইজ বুক খুলে পেনসিল হাতে বসে থাকে। খাতায় কয়েকটা খোপ কাটা। সেইসব খোপে বিচিত্র অঙ্ক লেখা আছে। তার রোগা–টোগা বুড়োমানুষ বিধবা মা ছেলের পিছনে এসে হাতজোড় করে বসে থাকে তখন।

লোকজন এলে তাদের সমস্যার কথা শুনে টুনে হারাধন গম্ভীরভাবে চোখ বুজে ধ্যানস্থ হয়, এক সময়ে হঠাৎ আস্তে-আস্তে ডাকতে থাকে–মা, মাগো, ও মা। সে ডাক তার আসল মাকে নয়, কালীকে। হাতের পেন্সিল যেন স্বপ্নের ঘোরে সরতে–সরতে একটা ঘরে গিয়ে স্থির হয়। এসেছে, মা এসেছে। হারাধন তখন এমনভাবে কথাবার্তা শুরু করে যেন টেলিফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছে। বলে–তা হ্যাঁ মা, এই জয়চরণদার বড় বিপদ, একবার এদিকে বেড়াতে–বেড়াতে আসবেন নাকি? সময় কি হবে মা? ওপার থেকে কালী কী বলেন, তা এ পাশের সাধারণ শুনতে পায় না, কিন্তু হারাধন শোনে ঠিকই। বলে–এই ধরুন কাল রাত দশটা–এগারোটা নাগাদ মিনিট পনেরোর জন্য কি সময় হবে মা! হবে আচ্ছা মা, তবে ওই কথাই রইল। এবং তখন চোখ খুলে আসল মার দিকে চেয়ে হারাধন গম্ভীর হয়ে বলে–শুনলে তো? কাল রাত দশটা এগারোটার মধ্যে মা আসবেন। তার মা তখন ভারী আতঙ্কিত হয়ে বলে–তাহলি তো পুজোর জোগাড় করতি হয়। হারাধন অবজ্ঞাভরে জয়চরণের দিকে চেয়ে বলে–তাহলে, খরচাপাতি ইত্যাদি।

আট-আঙুলের ফটকের সঙ্গে হারাধনের ভারী ভাব। যাতায়াতের পথে ফটকে হারাধনের জাগ্রত কালীর স্থানে একবার মাথা ঠুকে যায়। সময় থাকলে বসেও পড়ে। হারাধন তার দুটো কমতি আঙুলের হাতদুখানার দিকে চেয়ে বলে–জন্মের দোষ বুঝলি?

ফটকে মাথা নাড়ে–আর তোমারটা?

–এ হচ্ছে ক্ষণের দোষ। টাইফয়েড না হলে–একটা শ্বাস ফেলে বলে–সবই মায়ের ইচ্ছে। তিনিই পা ভেঙে আটকে রেখেছেন তাঁর কাছে, নইলে হয়তো পিছলে যেতুম।

তবু কারও কিছু আটকে থাকে না। হারাধনেরও দিন চলে। ফটিকেরও। হারাধন মাঝে-মাঝে ডেকে বলে–মন্তর নিবি নাকি, ও ফটিক?

ফটিক রাজি। কিন্তু মাসি রাজি নয়। অল্পবয়স থেকে ব্রহ্মচর্য করে-করে মাসি ভারী জেদি আর তেজি হয়ে গেছে। বলে–পঞ্চাননতলার হারু দেবে মন্তর! ওম্মাগো! ঠাকুরদেবতার নামে। কিছু বলতে নেই, হারাধনের কালীমায়ের পায়ে গড়। কিন্তু ও কি মন্তর দেবে খ্যাপা? ন্যালাহাবলা, কুচুটে। খবরদার, ও কথা মনেও ঠাঁই দিবি না। সব নিংড়ে নেবে।

ফটিক তাই রাজি হয় না। হারাধন দুঃখ করে বলে–শেষতক লরি চালাবি ছোট লোকদের মতো! আমারই হয়েছে বিপদ! আমার সব মন্তরতন্তর, তত্বের সব গুহ্যকথা, মন্ত্রগুপ্তি–এগুলো কাকে দিয়ে যাই!

–তোমার তো অনেক শিষ্য!

কথাটা মিথ্যে। বস্তির কিছু হাঘরে, কয়েকটা রেলকুলি, আর দু-চারজন ছাতুওয়ালাকে ধরে মন্তর দিয়েছে বটে হারাধন, কিন্তু সংখ্যায় তারা বড়জোর পঁচিশ–ত্রিশ হবে কুড়িয়ে বাড়িয়ে। তবু হারাধন কথাটা শুনে খুশি হয়। বলে–তা অনেক শিষ্য বটে, কিন্তু মানুষ কটা? এই তো সেদিন লালুবাবু মন্তর নিতে এল, পয়সাওয়ালোক, বড়বাজারে পাইকারি রুমালের কারবার–কিন্তু হলে কী হয়! পলকা গেলাসে কড়া মদ ঢাললে যেমন ফেটে যায় চড়াক করে, এও হচ্ছে তাই। আধার দেখে বুঝলুম চলবে না। মন্তর কানে ঢুকতে–না-ঢুকতেই দড়াম করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। আর উঠবে না। একটা কমজোরি মন্তর জপ করতে দিলুম, আসল মন্তর নেওয়ার লোক কই রে? তোকে দেখেই বুঝেছি, এই হচ্ছে আসল আধার। আমার সব সাধনটাধন ধরে রাখতে পারবে।

ফটিককে ভালোবাসে সবাই। মদনাও। চাটুজ্জেদের গাড়িটায় মদনাই তাকে সুযোগ বুঝে তুলে নেয়, এটা ওটা শেখায়। বলে–আট আঙুলে তোর যা এলেম। বুঝলি, আমার ইচ্ছে একটা গাড়ি সারাইয়ের কারখানা করি। কাঁচা পয়সা। তোর মাসি যদি কিছু ছাড়ত, কদমতলায় রাস্তায় মোড়ে একটা ভালো স্পট দেখে রেখেছি। দুজনে মিলে কারখানা চালাতাম। চাকরি করে আর কটা পহা?

সে ফাঁদে পা দেয় না ফটিক। পিছলে বেরিয়ে যায়। কিন্তু আশ্বাস দিয়ে রাখে। ফাঁকতালে মোটরের ইঞ্জিনটা মদনার কাছ থেকে ভালোমতো চিনে নিতে থাকে।

ফটিকের আসল জায়গা হচ্ছে তার মাসি। সারাদিন শুদ্ধাচার আর শুচিবাই। ঘরে গুরুর ছবি আছে–দিনের বেশিরভাগ সেখানে বসে থাকে। ভাগবত, রামায়ণ, মহাভারত এ সব হচ্ছে। মাসির সারাদিনের সঙ্গী। তবু ফটিক হচ্ছে মাসির বুকের পাঁজর। সারাদিন ফটিকের কথা ভেবে ভেবে সারা। ফটিক তাই নিশ্চিন্ত আছে।

কিন্তু নিশ্চিন্তে থাকতে দেয় না মাসির ভাগনে শ্রীপতি। কালো মতো ক্ষয়া চেহারা, বয়স চল্লিশ–টল্লিশ হবে, একসময়ে ঠিকাদারি করত, এখন কী করে কে জানে। অভাবী লোক, বড়। বদমেজাজি, বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে একদা আত্মহত্যা করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। হাঁটতে-হাঁটতে সেই রামরাজাতলা পর্যন্ত চলে যায়। তারপর একটা নির্জন জায়গা দেখে রেল লাইনে গলা দিয়ে শুয়ে থাকে। কিন্তু কপাল খারাপ। আগে থেকে শুয়ে থাকার ফলে একটু ঘুমভাব এসে গিয়েছিল বুঝি। হঠাৎ ট্রেনের হুইশিলের শব্দে আঁতকে উঠে আঁ–আঁ করতে-করতে কেমন। হয়ে গেল, লাইন থেকে আর গলা তুলতে পারে না। বিশ গজ দূরে গাড়িটা থামিয়ে বদরাগি ড্রাইভারটা তেলকালি মাখা ভূতের মতো নেমে এসে ঘেঁটি ধরে যখন তুলল তাকে তখন সে বিড়বিড় করে বলছে, হ্যাঁ মরে গেছি। হ্যাঁ-হ্যাঁ নিশ্চয়ই মরে গেছি! ড্রাইভার সাহেব মুগুরের মতো হাতে দু-চারটে থাপ্পড় বসাতেই শ্রীপতি সজ্ঞানে আসে। তারপর সে কী দৌড়! তাই শ্রীপতির আর মরা হয়নি। জ্যান্ত শ্রীপতি তাই এসে মাঝে-মাঝে ফটিককে শাসায় কবে কাটছ বলো দেখি ফটিকচাঁদ? আমাকে জানো তো, সালকের এক নম্বর মস্তান হচ্ছে এই শ্রীপতি সমাদ্দার। ঘাড়ে ধরে বের করব যদি নিজে থেকে না-যাও। মাসির ওপরেও টং করে যায় সে-মামি, আমি কিন্তু উকিল মোক্তার করব না। ওই ফটকের যদি ভালো চাও তো ওকে পাঠিয়ে দাও দেশে। আমার মামার ভিটেয় কাউকে চেপে বসতে দেব না।

ফটিক এসব অবস্থায় ভারী অসহায় বোধ করে। ভাবে, এমন সুখের জায়গা ছেড়ে আবার বুঝি সত্যিই তাকে বর্ধমানের বাড়িতে ফিরে যেতে হয়। কিন্তু মাসির মুখের রেখায় নড়চড় হয় না। শ্রীপতি যেন সামনে নেই, এমনভাবে মাসি তাকে অগ্রাহ্য করে, ঘরের কাজ সারে। শ্রীপতি পাড়া মাত করে ফিরে যায়। ওই রোগা, ফরসা ছোট্ট, বুড়ি মাসির কোথায় যেন একটা ভারী জোর আছে। সেই জোরটা যেন সব সময়ে ঘিরে রাখে ফটিককে। তাই একদিন শ্রীপতি এলে ফটিক তাকে উলটে শুনিয়ে দেয়–ভারী তো মাস্তান, ইঞ্জিনের ড্রাইভার চড়িয়ে ঠান্ডা করে দিয়েছিল। আবার মাস্তান!

–তবে রে আট আঙুলে, অলক্ষুণে। বলে তেড়ে আসে বটে শ্রীপতি, কিন্তু সহসা উদ্যত হাত থামিয়ে কেবল তড়পাতে থাকে। মারে না। ঠিক সাহস পায় না বোধ হয়।

মাসির কী বা আছে! অল্প কিছু জমি, সামান্য টাকা, কিছু সোনাদানা। তার ওপরেই সকলের চোখ। মাসিই কেবলমাত্র উদাসীন। এ তত্বটা বুঝতে পারে ফটিক। নিজের ওপর ঘেন্না হয় মাঝে মাঝে। সেও তো ওই ভরসায় আছে।

হারাধনের কালীর স্থানে সেদিন প্রণাম সেরে বেরিয়েই যদু মোক্তারের সঙ্গে দেখা। বুড়ো হাড়ে হারামজাদা, রোগা খিটখিটে চেহারা, চোখে বুদ্ধির চিকিমিকি। ফটিককে দেখে বলে কী বাবা ফটিক, শুনেছ?

–কী?

–তোমার বাড়া ভাতে ছাই। মাসি যে সম্পত্তি সব দেবোত্তর করে দিল। কথাটা বিশ্বাস হয় না ফটিকের। চেয়ে থাকে। বুড়ো তার মুখের দিকে ভারী খুশি–খুশি ভাবে চেয়ে থাকে। কারও কোনও গর্দিশ হলে যদু মোক্তারের ভারী আনন্দ। বলে–তোদের বাড়ি থেকেই আসছি উইলে সাক্ষী দিয়ে। তোর মাসির ভিটেয় গুরুর মঠ হবে। এবার নিজের রাস্তা দ্যাখ।

কথাটা মাসিকে মুখোমুখি জিগ্যেস করতে লজ্জা পায় ফটিক। মাসিও যেচে কিছু বলে না। মনটা ভারী দমে যায় তার। চার বছর বয়স থেকে মাসির কাছে সে এত বড়টি হল। সবাই জানে, সে মাসির ছেলের চেয়েও বেশি। আট আঙুলের ফটিককে মাসি কত স্নেহে ভালোবাসায় দশ আঙুলের মানুষের মতে সবকিছু শিখিয়েছে। তবে মাসির এটা কীরকম ব্যবহার?

হারাধনের কাছে দুঃখ করে ফটিক–এমনটা হবে জানলে কোনও শালা এসে এতকাল পড়ে থাকত!

–দুঃখ করিস না ফটিক। মঠ যদি হয় তো, মাসিকে বল আমায় যেন সেবাইত করে। তোরটা পুষিয়ে দেব।

মদনা ফটিককে ধরে বলে–তখনই বলেছিলুম, কদমতলার জায়গাটা দুজনে নিই আয়, কাঁচা পয়সা লুটে নিতাম।

খবর পেয়ে শ্রীপতিও আসে। ফটিকের সঙ্গে দেখা হয় চৌরাস্তায়। নরম গলায় বলে–বুড়ির মাথাটাই গেছে বিগড়ে। দেবোত্তর আবার কীরে! না হয় তোর নামেই থাকত সম্পত্তি, আমরা দু ভাইয়ে ভোগ করতুম? হাজার পঞ্চাশেক নগদ, সোনাদানা মিলে আরও ধর হাজার ত্রিশ-চল্লিশ ইস ভাবা যায় না!

ভাবতে-ভাবতে নিজের আট আঙুলের ওপর ভরসা হারিয়ে ফেলে ফটকে। দিনরাত লোকজন তার কানমন্তর দিচ্ছে। মাথা ক্রমে গরম হয়ে যায়। বুঝতে পারে, মাসি তাকে সবচেয়ে বড় ধাপ্পাটা দিয়েছে। ফটিক তাই রাগে–রাগে বাসাতেই থাকে না বড় একটা। সকালে বেরোয়, রাত করে ফেরে। মনের মধ্যে একটা পাখি কেবল কু-ডাক ডাকে।

.

বারান্দায় একা বসে ভাগবত পড়ছে মাসি। সামনে পিদিম। ননীচোরা কৃষ্ণের মুখ ফাঁক করে মা যশোদা দেখছেন সত্যিই খেয়েছে কি না কৃষ্ণ। ওমা কোথায় ননী! মা যশোদা দেখেন, কৃষ্ণে মুখের মধ্যে বিশ্বরূপ। রাত হয়েছে। ফটিক এইবার ফিরবে। মাসি টের পায়, চরাচর নিঝুম। ভাগবত পাঠের শব্দ যতদূর যায় ততদূর বড় পবিত্র। কত পোকামাকড় কাছে আসে, কত সাপখোপ। ওই শব্দ সবাইকে টেনে আনে কাছে। আজও এসেছে। চোখ না তুলেও টের পায় মাসি। সিঁড়ির মুখে উঠে এসেছে দুটি দীর্ঘ দেহ। নিস্পন্দ পড়ে আছে। শুনছে। কারও ক্ষতি করে না। কিন্তু গায়ে পা পড়লে? ফটিক এ সময়েই ফেরে। পিদিমের আলোয় যদি দেখতে না পায় সাপ দুটোকে? আজ কৃষ্ণপক্ষ, বাইরেটা বেজায় অন্ধকার।

মাসি শোনে, আগল ঠেলে ফটিক ঢুকল উঠোনে। সোজা সিঁড়ির দিকে হেঁটে আসছে। অধ্যায় শেষ না হলে পাঠ শেষ করা চলবে না। মাসি ঝুঁকে থাকে বইখানার ওপর। ঠাকুর! চোখ থেকে এক ফোঁটা জল পড়ে। ফটিক আসছে।

ঠিকাদারদের লরি একটু আগেই মাটি ফেলছিল সাঁইদের মজা পুকুরে। তারই একটা হেডলাইট জ্বালল। সমস্ত বাড়ি, উঠোন ধাঁধিয়ে একটা আলো এসে পড়ে। ফটিক থেমে যায়। মাসি ঝুঁকে পড়ে বইয়ের ওপর। ঠাকুর।

ফটিক চিৎকার করে ওঠে–মাসি পালাও।

মাসি একখানা হাত তুলে করতলখানা তাকে দেখাল। উঠল না, নড়ল না। শুধু হাতখানা তুলে ফটিককে অভয় দিল। অনেক ভেবে–ভেবে ফটিকের আজকাল মনে হয়না, মাসি তাকে বঞ্চিত করেনি। কী যেন একটা দিয়েছে, যার হিসেবনিকেশ করতে ফটিকের এ জন্মটা চলে যাবে বোধহয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *