মালোজি বনাম লাখোজ – রণজিৎকুমার সমাদ্দার
আশমান তখন আলো-আঁধারি৷ ঠিক সকাল হয়নি৷ সদা ব্যস্ত আহমদনগরও তাই অচঞ্চল৷ কিন্তু এর মধ্যে মালোজির বাড়ির সামনে হঠাৎ শোরগোল৷ প্রথমে মালোজি বুঝে উঠতে পারলেন না, কারণটা কী! তিনি কোনোরকমে চোখে-মুখে একটু জল দিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন৷ গুরুতর কিছু ঘটছে এমন একটা আঁচ করলেন৷
সামনেই লাখোজিকে দেখে তিনি অভ্যর্থনা জানাতে গেলেন৷ কিন্তু লাখোজির মেজাজ সপ্তমে চড়ে আছে৷ তাঁর কথায় তখন আগুনের হলকা৷ রীতিমতো কড়া গলায় বললেন, ‘দেখুন মালোজি, আমি আপনার ঔদ্ধত্য বরদাস্ত করব না৷ ভুলে যাবেন না, একদিন আমার অধীনে আপনি কর্মচারী ছিলেন৷ আপনি আমার সমপর্যায়ের নন৷ শুনেছি, শিশোদিয়া রানার বংশধর আপনি৷ উদয়পুর থেকে আপনার ও আমার পূর্বপুরুষরা একসঙ্গে এখানে এসেছিলেন৷ এরজন্য ভালো লাগে৷ আর, আপনি মারাঠিদের ভালো চান, তাদের স্বাধীনতার কথা বলেন; এটা আমার বেশ পছন্দ৷ তবে কোনো ছলছুতোয় আপনি আমার ঘরে ঢুকে পড়বেন, অন্দরে নজর দেবেন, সম্পর্ক চাইবেন, এটা হতে পারে না৷ আপনি একজন সামান্য সৈনিক, বেতনভুক কর্মচারী, মর্যাদার প্রশ্ন তো আছেই৷ আমি আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি৷’-এসব কথা বলেই লাখোজি তরোয়াল উঁচিয়ে ধরলেন৷ অর্থাৎ তীক্ষ্ণ শাসানি৷
লাখোজির কথায় মালোজি আহত হলেন৷ তাঁর মুখ লাল হয়ে উঠল৷ বিশেষ করে ‘সমপর্যায়ের’ ও ‘মর্যাদার প্রশ্ন’ কথা দু-টি তীক্ষ্ণ খোঁচা বলেই মনে হল তাঁর৷ তবুও মালোজি খুব শান্ত থাকলেন৷ তিনি ভাবলেন, লাখোজি তাঁকে বাড়িতে এসে অপমান করছেন৷ তরোয়াল উঁচিয়ে কথা বলছেন৷ এর বদলা নেবেন৷ অন্যভাবে৷
লাখোজি সদর্পে কথাগুলি বলে ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে ফিরে গেলেন৷ তাঁর অনুচর, যারা এতক্ষণ পেশির আস্ফালন দেখাচ্ছিল, তারাও পেছনে পেছনে ফিরে গেল৷
সকালের পরিবেশটি বেশ উত্তপ্ত হয়ে রইল৷ কেননা, বিষয়টি সহজ নয়, অমর্যাদা ও অপমানের৷ আকাশের মেঘের মতোই মালোজির মুখটি এখন থমথমে৷
মালোজির স্ত্রী সুধাবাই এতক্ষণ বাড়ির ভেতরেই ছিলেন৷ তিনি এবার বেরিয়ে এলেন৷ মালোজির পাশে এসে বসলেন৷ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সেদিন আমাদের খুব ভুল হয়েছিল৷ একটু বেশি মেতে উঠেছিলাম আমরা৷’
মালোজি আহত হন, ‘আমরা মেতে উঠেছিলাম?’
সুধাবাই বললেন, ‘তা নয়তো কী! এমনটা না করলেই হত৷’
মালোজির কন্ঠে ক্ষোভ, ‘প্রথমে তো আমরা কিছুই বলিনি৷ ত্র্যম্বকজির কাছে এই প্রসঙ্গ তুলেছিলেন লাখোজি নিজেই৷’
সুধাবাই স্বামীর কথায় সায় দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, বাবাকেও সেদিন দরবারমহলে লাখোজি কথাটা কানে কানে আর একবার বলেছিলেন৷’
এখানে ত্র্যম্বকজির একটু পরিচয় দেওয়া দরকার৷ আহমদনগরের সুলতানের বিশিষ্ট অমাত্য তিনি৷ তাঁর খাতির সর্বত্র৷ তিনি আবার সম্পর্কে মালোজির শ্বশুর৷ সেই সূত্রেই ধনবান ভূস্বামী লাখোজির সঙ্গে মালোজির পরিচয়৷ সুলতানের প্রিয়পাত্র ত্র্যম্বকজিকে লাখোজি খুবই সম্মান করতেন৷
২
দিল্লিতে বাদশাহি তখত প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাদশাহরা দাক্ষিণাত্য অভিযানে বের হতে লাগলেন৷ তার বিরাম ছিল না৷ আসলে দক্ষিণ দেশের রাজ্যগুলি বড়োই দুর্বিনীত৷ এরা স্বাধীন৷ বিজাপুর, গোলকোন্ডা, আহমদনগর, বেরার ও বিদার ইত্যাদি রাজ্যগুলি বাদশাহদের খুবই বেগ দিয়েছে৷ সংকট সৃষ্টি করেছে৷ অধিকার করা সহজ হয়নি৷ এদের মধ্যে আহমদনগরের প্রতাপ ছিল একটু বেশি৷ সদ্য-যুবক সুলতান প্রজাদের খুব প্রিয়৷ কোথাও কোনো গোলযোগ নেই৷ বিজাপুর রাজ্যটির সঙ্গে তাঁর নিকট সম্পর্ক৷ সুলতান রাজ্যরক্ষার কাজে সদা মনোযোগী৷ সুলতানের এই কাজে দক্ষ সৈনিক মালোজির ভূমিকাটিও বড়ো কম নয়৷
একদিন ভাগ্যের অন্বেষণে মালোজি আহমদনগরে এসেছিলেন৷ একসময় সিন্ধখেড়ে লাখোজির প্রাসাদরক্ষকের কাজও নিয়েছিলেন৷ সেটা অবশ্য তাঁর মঃনপূত ছিল না৷ তিনি ছিলেন উচ্চাভিলাষী৷ একদিন তাই সে-কাজ ছেড়েও দিলেন৷ আহমদনগর দরবারে তখন অনেক মারাঠি রাজকর্মচারী ছিলেন৷ তাঁদের একজনের সুপারিশে সেনাদলে ভরতি হন মালোজি৷ নিজের বুদ্ধি ও শক্তির জোরে দক্ষ সৈনিক হিসেবে সুলতানের আস্থাভাজন হন৷ এই শহরে তিনি এক বিশিষ্ট অমাত্যের মেয়েকে বিয়ে করেছেন৷ এসব আজ পেছনে ফেলে আসা অতীত সুখস্মৃতি৷
কিন্তু আজ লাখোজি যেভাবে অপমান করে গেলেন, তা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না৷ বদলা তিনি নেবেন৷ মনে মনে সেটা ভাঁজতে থাকেন৷ এর দিন দুই পর মালোজি লাখোজির বাড়িতে হাজির হলেন৷ তিনি এলেন একা৷ ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন৷ বজ্রকন্ঠে ডাকলেন, ‘লাখোজি, লাখোজি!’ লাখোজি প্রথমে হতচকিত হলেন৷ একটু ঘোর কাটতেই ক্রোধান্ধ মালোজিকে দেখলেন৷
মালোজি তরোয়াল তুললেন৷ ‘যুদ্ধং দেহি’ ভাব৷ বললেন, ‘আসুন জঙের ময়দানে৷’
লাখোজি দ্রুত পায়ে ঘরের মধ্যে গেলেন৷ ফিরে এলেন তরোয়াল হাতে৷ মালোজি বললেন, ‘সত্য নির্ণয় হোক দ্বন্দ্বযুদ্ধে৷’
লাখোজির ক্রোধ ঝরে পড়ল৷ বললেন, ‘তাই হোক!’
মালোজি ঘোড়ায় চেপে বসলেন৷ লাখোজিও মালোজিকে অনুসরণ করলেন৷ দু-জনেরই লক্ষ্য জঙের ময়দান৷
এই জঙের ময়দান নিয়ে একটি গল্প আছে৷ এবার সেটাই বলি৷ বাদশা আকবর দিল্লির সিংহাসনে বসেই সাম্রাজ্য বিস্তারে মন দেন৷ উত্তরের রাজ্যগুলি যত তাড়াতাড়ি তাঁর নাগালে এল, দক্ষিণের রাজ্যগুলি তেমনভাবে এল না৷ বড়োই দুর্ভেদ্য দক্ষিণদেশ৷ দখল করা এক, আর তাকে আগলে রেখে শাসন করা আর-এক কাজ৷ সেটাই সংকট৷ বাদশা তাই অঙ্ক কষে এগোলেন৷ রাজ্যগুলির দিকে দিকে দূত পাঠালেন৷ মুঘল বাদশার আনুগত্য স্বীকার করাবার জন্য৷ সময় ১৫৯১ সাল৷ রাজ্যগুলির মধ্যে ছিল দলাদলি৷ দুর্বল৷ তবুও বিজাপুর, গোলকোন্ডা, খান্দেশ মুঘল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করল প্রবল পরাক্রমে৷ বাদশা রুষ্ট হলেন৷ তাঁর বিশাল বাহিনী করছেটা কী? তিনি হুকুম দিলেন, ‘গোটা দক্ষিণদেশ দখল করো৷’
শেষমেশ বিজাপুর, গোলকোন্ডা, খান্দেশ মুঘল বাদশার আনুগত্য স্বীকার করে নিল৷ কিন্তু আহমদনগরের নাবালক সুলতানের মাতৃসমা চাঁদবিবি মুঘলের আনুগত্য মেনে নিলেন না৷ বিরোধিতা করলেন৷ ফল বিষম হল৷ চাঁদবিবি বিজাপুরের রানি ও আহমদগরের নিজাম হুসেন শাহির কন্যা৷ মুঘল সৈন্য আহমদনগরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ দৌলতাবাদ দুর্গের সামনে প্রকাণ্ড ময়দান৷ সেখানে মুঘল ছাউনি৷ কিন্তু অতর্কিতে আক্রমণ করলেন চাঁদবিবি৷ অবশ্য শেষরক্ষা হল না৷ চাঁদবিবি পরাস্ত হন৷ কিন্তু তাঁর বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের জন্য সে-ময়দান জঙের ময়দান নামে হয়ে গেল৷
একরকম বাধ্য হয়েই চাঁদবিবি মুঘলদের সঙ্গে সন্ধি করলেন৷ বেরার রাজ্যটি দিয়ে দিলেন সন্ধির শর্ত হিসেবে৷ তাতে প্রজারা গেল খেপে৷ চাঁদবিবিকে পালাতে হল৷
কেউ কেউ বলেন, তিনি অপমানে, লজ্জায় আত্মহত্যা করেছেন৷ আবার জনশ্রুতি এইরকম যে, তাঁর ভৃত্যরা খাবারে বিষ মিশিয়ে তাঁকে হত্যা করেছে৷ সত্য-মিথ্যা জানা যায়নি৷
প্রজারা আর-একবার জঙের ময়দানে হাজির হয়ে বেরার থেকে মুঘল সৈন্যদের হটিয়ে দিল৷ সে জয়ের আনন্দ ছিল ক্ষণিক৷
৩
এর পরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ৷ মালোজি-লাখোজি দু-জনেই জঙের ময়দানে হাজির৷ এমন সময় সুলতানের দূত এসে বলল, ‘হজরত আপনাদের হুকুম দিয়েছেন৷ এখনই আপনারা দরবারে হাজির হোন৷’
দূতের মুখে সুলতানের হুকুম শুনে দু-পক্ষই লড়াই থামাতে বাধ্য হন৷ দেরি না করে দু-জনেই ঘোড়া ছোটালেন৷ ভিন্ন পথে৷ দরবার মহলের দিকে৷
সুলতানের সামনে এসে দু-জনেই অভিবাদন জানাল৷ সুলতান বেশ গম্ভীর৷ দরবারকক্ষ বেশ নিস্তব্ধ৷ বোঝা গেল, সুলতানের কানে কথাটি পৌঁছে গেছে৷ তাঁকে খুব অখুশি দেখাচ্ছে৷ সুলতান দু-জনকে বেশ নিরীক্ষণ করে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনাদের দু-জনের মধ্যে বিবাদের কারণ কী?’ মালোজি একবার চোখ ঘুরিয়ে দরবারকক্ষ দেখে নিলেন৷ সুলতানের উজির, উলেমা, পাত্র-মিত্র, অমাত্য প্রায় সকলেই হাজির৷ তবে ঠিক দরবারি মজলিশ এখনও শুরু হয়নি৷
লাখোজি একবার দেখে নিলেন দরবারকক্ষটি৷
সুলতান দু-জনের নীরবতা লক্ষ করে ভর্ৎসনা করলেন, ‘দরবারের কাজে বিঘ্ন ঘটাবেন না৷ প্রথমে আপনাদের বিচার, তারপর অন্য কথা৷’
‘আচ্ছা মালোজি, আপনিই বলুন৷ কী নিয়ে আপনাদের দ্বন্দ্ব?’
মালোজি সুলতানকে আর-একবার অভিবাদন জানিয়ে বললেন, ‘ক-দিন আগে হোলি উৎসব হয়ে গেল৷ সেই উৎসবে লাখোজি আমাদের পরিবারকে আমন্ত্রণ জানান৷ আমার স্ত্রী ও পুত্র শাহজিকে সঙ্গে নিয়ে আমি লাখোজির বাড়িতে উৎসবে অংশ নিতে গিয়েছিলেন৷ সেখানে অতিথি-অভ্যাগত অনেকেই ছিলেন৷ প্রার্থনা সংগীত, নাচগান, রংখেলা এসবই চলছিল৷ খেলা যেমন বয়স্কদের মধ্যে চলছিল, তেমনই আমার পুত্র শাহজি ও লাখোজির পাঁচ বছরের মেয়ে জিজাবাইয়ের মধ্যেও চলছিল৷ এই দু-টি ছোট্টো ছেলে-মেয়ের উজ্জ্বল চোখ-মুখ দেখে লাখোজি বলে উঠেছিলেন, সুন্দর দু-টি জুটি৷ বেশ মানিয়েছে৷ এদেরকে নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন, সম্পর্ক গড়ে তুললে কেমন হয়?
‘এর পর লাখোজি দুই পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে বাগদানের কথা বলেন৷ আমি রাজি হই৷ গত সপ্তাহে, শুভদিন দেখে গুরুবারের সকালে আনুষ্ঠানিক বাগদান পর্ব সমাধা করার জন্য পুরোহিত পাঠাই৷ কিন্তু লাখোজি মাঙ্গলিক উপাচার ফেরত দেন৷ অপমান করেন, শুধু তাই নয়৷ গত পরশু আমার বাড়িতে চড়াও হয়ে আমাকে চূড়ান্ত অপমান করলেন৷ দ্বন্দ্বযুদ্ধে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি৷ তাই জঙের ময়দানে লাখোজিকে আহ্বান জানিয়েছি৷ আমি মনে করি, কারও বাড়িতে চড়াও হয়ে দ্বন্দ্ব শিষ্ঠাচার-বিরোধী৷’
৪
সুলতান একবার অমাত্যদের দিকে তাকালেন৷ সুলতান দেখলেন অমাত্যরা দু-টি ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন৷ কেউ কেউ মালোজিকে নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সমর্থন করছেন৷ কেউ কেউ মালোজির ব্যাপারে নিস্পৃহ থাকতে চাইছেন৷ এটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে৷ সুলতান নড়েচড়ে বসলেন৷ একবার তাঁর উজির-ই আজমের দিকে তাকালেন৷ উজির তসলিম জানালেন৷ এই উজির সুলতানের বাল্যবন্ধু৷ সুলতানের ভালো চিন্তা করেন সর্বদা৷ তাই উজিরের চোখের ইশারায় সুলতানকে সমর্থনের ইঙ্গিত৷ যেন বলতে চাইলেন, সুলতান সভাটি যথার্থই পরিচালনা করেছেন৷
সুলতান লাখোজিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসব কি সত্যি?’
লাখোজি সুলতানকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বললেন, ‘সবই সত্যি৷ তবে সে-কথাটি হয়েছিল উৎসবের মেজাজে৷ একটি আবেগে৷ আবেগের মধ্যে কোনো কথা সত্য বলে ধরা যায় না৷’
সুলতান মৃদু হাসলেন, ‘আবেগের উৎস আনন্দ৷ আনন্দ থাকলে আবেগ থাকবেই৷ তাই না, লাখোজি?’
লাখোজি বললেন, ‘সুলতান বিচক্ষণ৷ তাঁর রসবোধের কথা সকলে জানেন৷ তবুও একটা কথা!’
সুলতান জানতে চাইলেন, ‘সেটা কী?’
লাখোজির সুর নরম হয়ে এসেছে৷ তিনি কোমল কন্ঠে বললেন, ‘জনাব, সামান্য সৈনিকের পুত্রের সঙ্গে আমার কন্যার বিয়ের প্রস্তাব মর্যাদাবিরোধী৷’
সুলতান কৌতুক হাসলেন, ‘ওঃ, এই কথা!’
৫
বিচারের আগে সুলতান যে কঠোর মনোভাবটি দেখিয়েছিলেন, এখন আর তা নেই৷ তাঁর সদাহাস্যময় রূপটি ফুটে উঠল৷ সুলতানের এই যে প্রসন্ন ভাব, তার কারণ, তিনি মনে মনে মালোজিকে পছন্দ করতেন৷ বিজাপুর, গোলকোন্ডা বা খান্দেশের মধ্যে অহরহ অঃন্তকলহ হচ্ছে; তার আঁচ যে এখনও আহমদনগরে লাগেনি তার মূলে আছে মালোজির কৌশল৷ আবার যে আহমদনগর মুঘলদের ঠিক করায়ত্ত হচ্ছে না, তার মূলেও আছে মালোজির উপস্থিত বুদ্ধির চমক ও সুচতুর সৈন্য পরিচালনা৷ সুলতান অনেকদিন ধরেই ভাবছিলেন, মালোজিকে পুরস্কৃত করার৷ এবার তিনি সে সুযোগ পেয়ে গেলেন৷
সুলতান দরবারের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘লাখোজি যাদব রাও একজন সম্ভ্রান্ত আমির৷ আর, মালোজি ভোঁসলে একজন সুদক্ষ সৈনিক৷ দু-জনেই আমার সমাদরের যোগ্য৷ তাই আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে মালোজি ভোঁসলে পাঁচ-হাজারি মনসবদারের পদে উন্নীত হলেন৷’
সুলতান লাখোজির দিকে তাকালেন, ‘এর পর নিশ্চয়ই আপনার কাছে মর্যাদার প্রশ্ন বড়ো হয়ে উঠবে না!’
লাখোজি লাজুক হাসলেন৷
ইতিমধ্যে দরবারে গুঞ্জন উঠল৷ সুলতান হাতের ইশারায় থামিয়ে বললেন, ‘আরও দু-টি ঘোষণা বাকি৷ শুনুন, মালোজির পুত্র শাহজির সঙ্গে লাখোজির কন্যা জিজাবাইয়ের বিবাহ পাকা করে দিলাম৷ দু-টি পরিবার ঠিক সময়ে আনুষ্ঠানিক কাজটি সম্পন্ন করবেন৷ আর, সুলতানের পক্ষ থেকে বিয়ের যৌতুক হিসেবে একটি জায়গির দেওয়া হবে মালোজিকে৷ তবে মনসবদারি প্রথায় যে জায়গির দেওয়ার নিয়ম আছে, তা ছাড়াও এটি উপঢৌকন হিসেবে দেওয়া হবে৷’
আনন্দ ও করতালিতে দরবারকক্ষ ফেটে পড়ল৷
লাখোজি ও মালোজি সুলতানকে দীর্ঘ অভিবাদন জানালেন৷
এই ঘটনার ছ-বছর পর৷ সিন্ধখেড় নামে একটি জায়গায় দুই পরিবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন৷ শাহজি ও জিজাবাইয়ের মধ্যে বিয়ে হল৷ তারিখটি ছিল ৫ নভেম্বর ১৬০৫ সাল৷
ছত্রপতি শিবাজি এঁদেরই সন্তান৷