মালেকা
মুখভাঙা কলের পাশ দিয়ে বেরিয়ে পিচ-ক্ষয়ে-আসা কঙ্করজর্জরিত পথটা ধরে মিনিট সাতেক হাঁটলেই ইস্কুল। ফিঁকে কমলা রঙের তাঁতের এবং সবুজ পাড়ের মিলের জীর্ণ শাড়ি দুটি অদল-বদল করে প’রে মালেকা আজ ছ-মাস যাবৎ এ-পথে আসা-যাওয়া করছে। প্রথমে পথটা অতিক্রম করতে তার মনে হত অখণ্ড একটা ঘণ্টাই বুঝি কাবার হয়ে গেল। তখন তার পা-দুটো কেমন জড়িয়ে থাকত। খোলা আকাশের তলে উন্মুক্ত রাস্তায় নাবতেই লজ্জাজনিত যে-নিদারুণ জড়তায় সে অভিভূত হয়ে পড়ত, সে-জড়তার জন্যে প্রতি পদক্ষেপই অতিশয় দীর্ঘ মনে হত। ইস্কুলের চাকরিটা নেবার আগে সে কখনো এমন একাকী হাঁটে নাই।
অবশ্য অভ্যস্ত হতে সময় লাগে না, পথের সঙ্গে পরিচয় হতেও দেরি হয় না। তারপর সে বুঝতে পারে, দাইয়ের কথাই ঠিক। দাই বলে, পথটা কেবলমাত্র সাত মিনিটের। দাই অবশ্য ঘড়ি দেখে পথের দূরত্বটা কখনো নির্ণয় করে নাই। তবু তার আন্দাজটা কাঁটায় কাঁটায় নির্ভুল।
ঘড়ির কথায় হাসি আসে। বহু বছর আগে মালেকার স্বামী খন্দের দিনে একবার শখ করে সস্তায় একটা হাতঘড়ি কিনেছিল। দু-দিনের খেলার বা ফ্যাশনের শখ। সে-কথা জেনেই যেন হাতঘড়িটা ক-দিন চক্কর দিয়ে হঠাৎ একরাতে স্তব্ধ হয়ে যায়। এমনিতেই, আছাড় না খেয়ে, আঘাত না পেয়ে। তখন তার স্বামী আনকোরা নতুন জামাই, সরজমিনে হাওয়ার মানুষ। মরা ঘড়িটা ক-দিন তবু হাতে বেঁধে বেড়িয়ে শেষে সেটা তুলে রাখে ফুল-আঁকা টিনের বাক্সে বলে, সারাবে। কিন্তু আর সারানো হয় না।
শখের কথা আলাদা। এদিকে গোটা একটা ইস্কুলই চলছে বিনা ঘড়িতে। ঘড়ি-যে একেবারে নাই, তা নয়। প্রধান শিক্ষয়িত্রীর ঘরে পশ্চিম দেওয়ালে সেকেলে আমলের মস্ত ঘড়ি। তবে ধনী শিকারির বাড়ির দেয়ালে টাঙানো হা-করা বাঘের কল্লা যেন সেটি। ঘড়ির ধড়ে প্রাণ নাই; তার পেতলের গোল হৃৎপিণ্ডটা কয়েক মাস যাবৎ স্তব্ধ। ওপরওয়ালাকে সে-বিষয়ে জানানো কর্তব্য। প্রধান শিক্ষয়িত্রী জানাতেন এবং ঘড়ি মেরামতের জন্যে পয়সা দাবি করতেন, কিন্তু একটি কারণে তা করেন নাই। ঘড়ির বর্তমান অবস্থার জন্যে তিনি নিজেই কি দায়ী নন? ঘড়িটা কেমন গড়িমসি করতে শুরু করলে তিনি পথ থেকে তালা-চাবি মেরামত করার লোকটিকে যদি ডেকে না পাঠাতেন, তবে হয়তো ঘড়িটা এমন বেমক্কাভাবে হরতাল শুরু করত না। অবশ্য তাকে ডাকার পরামর্শটা দাই-ই দিয়েছিল। তার কথা শোনা বুদ্ধিমানের কাজ হয় নাই। ঘড়ির কলকব্জার ব্যাপারে সে কী বোঝে? তালা-চাবির লোকটাও বলতে পারত ঘড়ি-সারানো তার কাজ নয়। আসলে দুনিয়ায় ঠগবাজ জুয়াচোরের শেষ নাই, ভুল পরামর্শ দেবার লোকেরও অভাব নাই। শুধু তাই নয়। কানে কথা তুলবার জন্যেও সবাই সর্বক্ষণ তৈরি। চাকরির জন্যে প্রধান শিক্ষয়িত্রীর বড় মায়া। শখের মায়া নয়, নিতান্তই পেটের মায়া। কী হতে কী হয়ে যায়, সে-ভয়ে তিনি সদা-সন্ত্রস্ত থাকেন। মাগি-ভাতা সমেত মাসে-মাসে পঁচাশি টাকার মতো সামান্য যে-মাইনেটা হাতে আসে, তা সংসার দরিয়ায় বিন্দুবৎ পানি। তবু তা হারাবার কথা ভাবলেই তাঁর বুকটা হিমশীতল হয়ে যায়।
একদিন বিভাগীয় দফতর থেকে একজন মহিলা ইস্কুল পরিদর্শন করতে আসবেন বলে চিঠি এলে তাঁর চিন্তার অবধি থাকে না। বস্তুত কয়েক রাত তাঁর ঘুমই হয় না। মাইনর ইস্কুল ও ইস্কুল, এবং ইস্কুল চালানো সহজ ব্যাপার নয়। দায়িত্ব-তো তাঁরই। এমন দায়িত্ব পালনে এখানে-সেখানে দোষঘাট-গাফিলতি না হয়ে পারে না। নিজের দোষ নিজে কেউ দেখে না, কিন্তু অন্য কেউ চোখ খুলে দেখতে চাইলে অনেক কিছুই দেখতে পারে। অবশ্য বারবার চিন্তা করে দেখেও যখন তাঁর কাজে কোথাও দোষঘাট-গাফিলতি দেখতে পান না, তখন স্তব্ধ ঘড়িটাই তাঁর মানসিক যন্ত্রণার প্রধান সূত্র হয়ে দাঁড়ায়। ইস্কুল পরিদর্শনকারিণী সে-বিষয়ে প্রশ্ন করলে কী উত্তর দেবেন? ঘড়িটার বিষয়ে ভুলে থাকাও সম্ভব হয় না। চোখের সামনেই তার মৃতদেহটি সর্বক্ষণ বিরাজ করে। দেয়ালে ঝুলে থাকলেও তা তাঁর বুকে ভারি হয়ে চেপে থাকে। তারপর একদিন উর্দিপরা চাপরাসি নিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চেপে বিভাগীয় দফতরের মহিলাটি আসেন। আসেন ঝড়ের মতো, ঝড়ের মতোই চলে যান। ঘোড়ার গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেলে ঘাম-দিয়ে-জ্বর-ছাড়া আরামে প্রধান শিক্ষয়িত্রী দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তারপর চমকে উঠে সহকর্মিণীদের বলেন,
—এই যাঃ। ঘড়ির কথাটা তাঁকে বলতে ভুলে গেলাম।
তাঁর উক্তিটা অবশ্য সত্য নয়। তা বুঝেই একজন শিক্ষয়িত্রী বলে,
—বললেও কান দিতেন কি না সন্দেহ। মানুষটা কেমন যেন মনে হল। ফ্যাশন-অলঙ্কারেই কেবল নজর যেন।
প্রধান শিক্ষয়িত্রী কিছু-একটা বলতে গিয়ে থেমে যান। ওপরওয়ালার বিরুদ্ধে কথা বলা নিরাপদ নয়। বললে হয়তো কালই একটা বেনামি চিঠি চলে যাবে তাঁর বিরুদ্ধে।
—বলাটা কর্তব্য ছিল। ভারিক্কি গলায় তিনি বলেন।
ঘড়িটা একটু থেমেছে বলে ইস্কুলটা কি চলছে না? মুখে আস্ত একটা পান ঢুকিয়ে দাই বলে।
কথাটা অবশ্য ঠিক। ঘড়ি ছাড়া ইস্কুলের কাজ চলছে বৈকি। এ-বিষয়ে কারো যদি কোনো অসুবিধা ভোগ করতে হয়, তা প্রধান শিক্ষয়িত্রীই করেন। থানার ঘণ্টার জন্যে তিনিই কানটা সজাগ করে রাখেন। তাঁর কাছ থেকে ইঙ্গিত পেলে দাই ঘণ্টা বাজায়।
সরিয়ে নেয়াই ভালো। ঘড়িতে চড়ুই পাখি বাসা বাঁধল বলে।
শিক্ষয়িত্রীটি আবার বলে।
প্রধান শিক্ষয়িত্রী কেমন শিউরে ওঠেন।
—কালই চিঠি লিখে দেব। ইনেস্পেকট্রেসের সঙ্গে পরিচয় হল, আর লিখতে তেমন বাধো বাধো ঠেকবে না। বয়স কম হলেও মানুষটি ভালোই মনে হল।
এবার শিক্ষয়িত্রীটি সুর বদলায়।
—মনে কলুষতা নেই মনে হল।
দাই হঠাৎ গা-মোড়ামুড়ি দিয়ে হাই তোলে। আজেবাজে কথায় সে কখনো কান দেয় না। তার দিকে তাকিয়ে প্রধান শিক্ষয়িত্রী খনখনে গলায় বলেন,
—তোমার বদ-বুদ্ধিতেই-তো ঘড়িটার এ-দশা হয়েছে।
—আমি অতশত কী বুঝি?
দাই গলা চড়িয়ে উত্তর দেয়। তার কণ্ঠে দোষীর নম্রতা ভাব নাই। দায়িত্বটা আবার প্রধান শিক্ষয়িত্রীর কাঁধেই ফিরে যায়। অবশ্য তিনি এখন বোঝেন, ঘড়ির জন্যে দুশ্চিন্তাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়েছিল। তবু এ-সব বিষয়ে কে-কখন সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হতে পারে?
সাত মিনিটের এইটুকু পথ হাঁটতেই মালেকার বুকে হাঁপানি ধরে। আজ আবার তিন দিন জ্বরভোগের পরে আসছে বলে মাঝপথেই তার চোখ ঘোলাটে হয়ে ওঠে। সকালের কড়া রোদ দেখতে-না-দেখতে কেমন আবছায়া হয়ে যায়। তাছাড়া দুর্বল হৃৎপিণ্ডটা হাতুড় পেটায় শীর্ণ বুকে।
কোনোমতে ইস্কুলে পৌঁছে বারান্দায় একটি টুলে বসে হাঁপাতে থাকে। দেখে দাই আসে। জাতিতে নমশূদ্র হরিমতী নামে শিক্ষয়িত্রীটিও পাশে এসে দাঁড়ায়। তারপর একটি ছাত্রী আসে হাতপাখা নিয়ে। মালেকার গায়ে হাওয়া দিতে শুরু করেই সে তার মুখের ফোয়ারা খোলে। বলে, দু-সপ্তাহ আগে এমনি হাঁপাতে হাঁপাতে তার ফুফুর এন্তেকাল হয়। সেদিন সে-ই তার মুমূর্ষু আত্মীয়াকে হাওয়া করেছিল। তাই সে জানে, মানুষ কীভাবে মরে। বিশেষ কিছু নয়, অমনি হাঁপাতে হাঁপাতেই মরে।
দাই ধমকে বলে, ওসব কথা বলতে নাই।
মালেকা মেয়েটির কথায় কান দেয় না। মৃত্যুর কথায় তার মনে কখনো ভয় আসে না। বরঞ্চ মৃত্যুর কথায় ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের উৎকণ্ঠা ভরা স্নেহ-মমতার নিবিড় উষ্ণতার চিত্রই তার স্মরণ হয়।
সামনে রোদপোড়া তামাটে উঠানের দিকে চেয়ে মালেকা ক্ষীণভাবে হাসে। দাই বলে,
—আরো একটু জিরাও।
যে-মেয়েটি পাখা করে, সে হয়তো একটু নিরাশবোধ করে মালেকা আবার সুস্থবোধ করছে বলে।
পরে প্রধান শিক্ষয়িত্রী বলেন, তোমার তিন দিন কামাই হল কিন্তু
মালেকা চোখ খুলে চেয়ে শোনে, কিছু বলে না। তিন দিন কামাই মানে তিন দিনের মায়না পাবে না। তার অর্থ প্রধান শিক্ষয়িত্রীও ভালো করে বোঝেন। কিন্তু তাঁর কড়া না হয়ে উপায় কী? ইস্কুল চালাতে হলে আইনকানুন মানতে হয় অক্ষরে-অক্ষরে, শাসন করতে হয় দরকার হলে। কর্তব্যে অবহেলা হলে মাগি-ভাতা সমেত পঁচাশি টাকার মায়নায় তাঁর দাবি থাকবে না।
তবে তিনি যখন ক্রোধ প্রকাশ করেন, তখন সে ক্রোধ শূন্য কলসির মতোই ঠনঠন করে বাজে। তাছাড়া রাগটা কখনো খাঁটি নয় বলে তার প্রয়োগটা যথাসময়ে বা যথাস্থানে হয় না।
নির্বাক মালেকার দিকে চেয়ে হঠাৎ তিনি অতিশয় রাগান্বিত কণ্ঠে বলেন,
—দিনদিন যেন কেবল ভেঙেই পড়ছ। ডাক্তার দাওয়াই কর না কেন?
—একটু জ্বর হয়েছিল। ক্ষুদ্র গলায় মালেকা উত্তর দেয়।
অবশ্য যে-বিষয়টি তুলেছেন তা নিয়ে বেশি আলাপ-আলোচনা বিপজ্জনক জেনেই তিনি রাগতভাবেই হঠাৎ অন্য বিষয়ে চলে যান।
—শুনলাম সেদিন নাকি মেয়েদের ‘কুত্রাপি’ শব্দের অর্থ বলতে পার নি।
—ভুলে গিয়েছিলাম। সরল কণ্ঠে মালেকা উত্তর দেয়।—পরদিন ওঁর কাছ থেকে জেনে এসে অর্থটা বলেছি তাদের।
মালেকা অবশ্য বলে না যে তার স্বামীও ঠেকে গিয়েছিল এবং পরে কোথায় একটা অভিধান দেখে এসে শব্দটির অর্থ তাকে বলেছিল।
উত্তর শুনে প্রধান শিক্ষয়িত্রী এবার সত্যিই যেন রেগে ওঠেন
—’কুত্রাপি’ শব্দের অর্থ জান না, কী মাস্টারনিগিরি করছ। মেয়েরা কী হাতি-ঘোড়া শিখবে তোমার কাছে?
মালেকা এবার চুপ করে থেকেই প্রধান শিক্ষয়িত্রীর পানে তাকিয়ে থাকে। তাঁর কথায় রাগও হয় না, অপমানও সে বোধ করে না।
তাঁর সরল দৃষ্টির সামনে প্রধান শিক্ষয়িত্রীর রাগ পড়তে দেরি হয় না। গোপনে একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি। কী করবেন তিনি? দেওয়ালেরও কান আছে বলে শাসন করতে হয়, ধমকাতে হয়। তিনি কি বোঝেন না যে ‘কুত্রাপির’ মতো অকেজো উদ্ভট শব্দের অর্থ শিখে মেয়েদের কী-ই বা লাভ হবে। নেহাত জীবনধারণের প্রশ্ন, নাহলে, সত্যি বলতে কী, ইস্কুলটারই-বা মানে কী হয়? মেয়েদের পড়ানো এক ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চৌদ্দগুষ্ঠিতেও যাদের পেটে একটি হরফ পড়ে নি, তারাও দলেদলে তাদের মেয়ে পাঠাচ্ছে ইস্কুলে! মেয়েটাকে একটু পড়িয়ে দিন। তা বেশ, দিচ্ছি পড়িয়ে। তবে বেশি কিছু আশা কোরো না। ইস্কুলে আসা-যাওয়াই-তো শিক্ষা, আর দশ জনের সঙ্গে বেঞ্চিতে বসে কলতান করাই-তো পঠন-পাঠন। একটি ঘরের ঝিলিমিলিতে একজোড়া কবুতর বাসা বেঁধেছে। তাদের বাকবাকুম শুনলেও হয় লিখন-পড়ন। আসল শিক্ষা হল বয়স্কদের শ্রদ্ধা-ভক্তি করতে শেখা। মাস্টারনিদের শ্রদ্ধা-ভক্তি করতে শেখ, সময়ে অসময়ে গা-মাথাটা টিপে দাও, কখনো স্নেহ-আদরের সঙ্গে বাড়ি থেকে কদুটা-মরিচটা এনে দাও। মাস্টারনিরাও মানুষ। তারা কলযন্ত্র নয়। তাদেরও পরিবার আছে, তাদেরও সমস্যা আছে। চালের দরটার কথা ভেবে দেখ। চল্লিশ-পঞ্চাশের মধ্যেই ওঠা-নাবা করে। নাবলে কাঁকর বাড়ে অথবা ভেঙে ক্ষুদ্র হয়। উঠলে ঘরে এক মুঠো আসে কি আসে না। মানুষের পেটে দানা নেই, ‘কুত্রাপি’ শব্দের অর্থ জেনে কী হবে?
অবশ্য ভারিক্কি কণ্ঠে মালেকাকে তিনি বলেন—শিক্ষকতার কাজ বড়ই দায়িত্বপূর্ণ। তা মনে রেখ। আরেক কথা। ‘কুত্রাপি’ শব্দের অর্থ আমাকে না জিজ্ঞাসা করে তোমার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছিলে কেন? স্বামীরাও স্ত্রীমানুষের মতো গল্প করে বেড়ায়। একবার ইস্কুলের বদনাম উঠলে আর রক্ষা থাকবে না।
মালেকা এবারো কিছু বলে না।
—আরেকটা কথা বলে দিচ্ছি। যাই কর, ছাত্রীদের সামনে আপন মানটা খুইয়ো না। জান দেওয়া যায়, মান দেওয়া যায় না। কোনো শব্দের অর্থ যদি মাথায় না আসে, ঝট করে বলে দিয়ো কিছু। শব্দের অর্থ তারা ছাই মনে রাখে। এখন বলেছ কি তখন গিলে ফেলেছে। কিন্তু একবার তোমার অজ্ঞতা প্রকাশ করেছ কি অমনি সাত-রকম কথা উঠবে। তুমি কিছু বোঝ না। আজকালকার ন্যাংটা মেয়েগুলো শয়তান কম নয়। পড়তে আসে না ছাই। আসে আমাদের বুকটা ঝরঝরে করে দেবার জন্যে।
ছাত্রীদের পানে তাকিয়ে মালেকা নীরব হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চোখে জ্যোতি নাই, হাত দুটি সাদা ফ্যাকাসে। নখগুলো পর্যন্ত বীভৎসভাবে সাদা। দেহে কোথাও এক ফোঁটা রক্ত নাই যেন। একটি ছাত্রী মায়া করে বলে, একটু মাথা টিপে দেই? আরেকজন বলে, চুলে জটা পড়েছে। ছাড়িয়ে দেব?
মালেকা ম্লানভাবে হাসে। না, মাথা টিপতে হবে না, জটাও ছাড়াতে হবে না। ওসবের প্রয়োজন নাই। সে অন্যকথা ভাবে। তার অন্তরের দৃষ্টি একটি উজ্জ্বল স্মৃতিতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যে তার চোখ যেন চকচক করে ওঠে, তার নিশ্বাস-প্রশ্বাস খাটো হয়ে আসে।
দাই বোঝে তার মনের কথা। যে-মানুষ ঘড়ি না দেখেও নির্ভুলভাবে বলতে পারে পথটা ঠিক সাত মিনিটের সে-মানুষ অনেক কিছু বোঝে। একবার আড়চোখে মালেকার দিকে তাকিয়ে সে আপন মনে গজগজ করে। পরে হরিমতীকে বলে, –একবার প্রাণভরে খাবার জন্যে মেয়েমানুষটির বুক খাঁখাঁ করছে।
মেয়েরা যখন নামতা পড়ার অজুহাতে সমস্বরে চিৎকার করে, তখন টেবিলের ওপর রক্তশূন্য হাত-দুটি রেখে খোলা জানালা দিয়ে রোদ-পোড়া উঠানের দিকে চেয়ে মালেকা স্থির হয়ে বসে থাকে। কী দেখে সে। অবশ্য তার ক্ষিদে নাই, খাওয়ারও আকাঙ্ক্ষা নাই। তবু সে দেখে মগরা-মগরা স্তূপাকার করে রাখা ধান, তেলভরা বড়–বড় জ্যান্ত টাটকা মাছ। সে কি কল্পনার জাল বুনছে?
কথাটা কিন্তু একেবারে অসত্য নয়। তবে তাতে আজ আশা-আকাঙ্ক্ষার একটু রং পড়েছে। এমন স্মৃতি নাই যাতে কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয় না।
মালেকা ছোটবেলায় কোরান-হাদিস পড়েছে মৌলবীর কাছে। তারপর মাইনর পাস করে দীর্ঘ ঘোমটা তুলেছে গর্ব ঢাকবার জন্যে। তার বাপ বেদারুদ্দিনেরও গর্বের সীমা থাকে নাই। হাটে-ঘাটে কত ছড়িয়েছে সে-গর্ব। তার ঘরে যেন আস্ত সূর্য উঠেছে। তারপর সে-মেয়েরই বিয়ে হয় তোজাম্মল তরফদারের সঙ্গে। ছেলেটি তখন গ্রামের মাতা বাগ্াদিনী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে বার কয়েক ম্যাট্রিক ফেল করে ঘরে বসে আছে। বসে আছে কথাটা তখন প্রশংসনীয় ব্যাপারই ছিল। যাদের জমিজমা আছে, যাদের আর্থিক সমস্যা নাই, তারাই এমন বসে থাকতে পারত। যুদ্ধ তখনো শুরু হয় নাই, দেশে দুর্ভিক্ষও আসে নাই। পরীক্ষায় ফেল করাটাও তেমন দোষণীয় বা লজ্জার ছিল না। শখের পড়া, ঠেকার পড়া নয়। পাস না করলেও ইস্কুলের শেষ ধাপ পর্যন্ত উঠেছে, মস্ত মস্ত অনেক কেতাব শেষ করেছে। এসব কি কম কৃতিত্বের কথা? তাছাড়া পাস-ফেল খোদারই হাতে। সুতরাং যখন তাদের বিয়ে হয়, তখন মালেকার স্বামী তোজাম্মলের মেজাজই অন্যরকম। স্থূল পৃথিবীতে থেকেও তার বিচরণ ছিল আসমানে, চোখ মাথায় থাকলেও দৃষ্টি ছিল ঊর্ধ্বে। মেজাজ ছাড়া, চেহারাও ছিল অন্য ধরনের। মুখে কাঁচা-কাঁচা দাড়ি, আর ঠোঁটে কেমন-একটা অস্পষ্ট ব্যাখ্যাতীত হাসির রেশ। মাইনর-পাস-করা মেয়েটির মনে এমন স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা জাগতে দেরি হয় নাই। তবে আজ যেমন সে-জমিজমা নাই, সে-ধান সে-মাছ নাই, তেমনি তোজাম্মলেরও সে দাড়িও নাই, সে হাসিও নাই। তাদের সীমা সংকীর্ণ কিন্তু সুখের জীবনের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে, যে-ঝড়ের সমাপ্তিতে কাঁটাগাছ, ঝোপঝাড় ছাড়া আর কিছু থাকে নাই তাদের জন্যে। সে-ঝড়ের ধাক্কাতে অবশেষে তারা একদিন শহরে এসে উপস্থিত হয়। তোজাম্মল জমি বিক্রি করে সামান্য পয়সা হাতে নিয়ে যে-ব্যবসা শুরু করেছিল, সে ব্যবসায় লালবাতি জ্বালিয়ে এখন চাকরির উমেদারিতে চরকির মতো রাতদিন ঘোরে। পাস-ফেলের মতো চাকরি পাওয়া-না-পাওয়াও খোদার হাতে। সে হাত এখনো খোলে নাই।
—স্বামীটা বখাটে। দাই বলে। উক্তিটা মালেকা শুনতে পায়, কারণ তাকে শোনাবার জন্যেই দাই উক্তিটা করে। কিন্তু মালেকা কিছু বলে না। তার বলার কিছু নাই যেন। সে অবশ্য জানে তোজাম্মল বখাটে নয়। তাছাড়া তোজাম্মলের চোখে-যে একটি গভীর ভীতির ছায়া এবং যে-ভীতির কথা সে একবারও মুখ ফুটে বলে না, সে-ভীতির কথা মালেকা জানে। কিন্তু সে-কথাও বলা যায় না।
বারান্দার প্রান্ত থেকে দাইয়ের কণ্ঠ আবার ভেসে আসে,
—বখাটে না হলে রোগাপটকা অসুস্থ বউকে কাজে পাঠিয়ে এমন পার-ওপর-পা-তুলে কেউ বসে থাকে?
এবার হরিমতী দাইকে ইশারায় কিছু বলে। উত্তরে দাই ফোস করে ফণা তোলে,
—সত্য কথার কঞ্জুস আমি নই। বখাটে নয়তো কী? ঘরে বুড়ি মা, দু-দুটি ছেলে-মেয়েও। বখাটে না হলে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কেউ হয়
দাই অনেক কিছু জানে। তবু সকল রক্তমাংসের মানুষের মতো তারও কখনো-কখনো ভুল হয় বৈকি। ঘড়ির কলকব্জার কথা সে যেমন জানে না, তেমনি একথাও সে জানে না যে, একটি মানুষের দুঃখকষ্ট লাঘব হয় না।
কথার ধারা পরিবর্তন করার প্রয়াসে হরিমতী বলে,
—আজ কেমন আছ বোন?
—আজ ভালোই বোধ করছি। বলে মালেকা ম্লানভাবে একটু হাসে।
দাই সজোরে থুতু ফেলে।—ঝুট্ কথা। কাকে ফাঁকি দিচ্ছ? বলে দিচ্ছি একটা কথা। একদিন পথে মুখ থুবড়ে পড়বে, আর উঠবে না। তখন তোমার পেয়ারের স্বামীর টনক নড়বে। সেদিন আত্মশোচনায় তার বুক যেন জ্বলে যাবে।
মালেকা একবার ভাবে, দাইকে বলে তোজাম্মলের চোখের গভীর ভীতির কথা, তার চাকরির উমেদারির কথা। কিন্তু সে নীরব হয়েই থাকে। দাইকে কেন বলবে? প্রতিবাদেরই-বা কী প্রয়োজন? তাছাড়া, তার স্বামী যদি সত্যিই দায়িত্বজ্ঞানশূন্য বদচরিত্র নিষ্ঠুর মানুষ হত, তবেই সে হয়তো প্রতিবাদ জানাত। কিন্তু তোজাম্মল অসহায় মানুষ। তার অসহায়তার কথা সে কী করে বলে? অন্য একটা কিছু বলতে পারলে বলত। ক-দিন ধরে দেশে ফিরে যাবার একটা আকাঙ্ক্ষা তাকে বারেবারে নিপীড়িত করছে। শহরে যে-কয়েদখানায় তারা পড়েছে, সে-কয়েদখানা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে হঠাৎ সে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। ইস্কুল থেকে ঘরে ফিরে যাবার সময় এলে সে-ভাবটি ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠে। ঘর মানে একটি মাত্র কামরা। পাশে একটু বারান্দার মতো। বেড়া দিয়ে সে-বারান্দাকে তারা রান্নাঘরে পরিণত করেছে। ঘরটির পেছন থেকে বস্তির শুরু। তার গা-ঘেঁষেই নালা এবং বস্তির পায়খানা। দুটোর মধ্যে বিস্ময়কর যোগাযোগ। নালা দিয়ে বিষ্ঠা, পাক এবং না-পাক নানাবিধ গলিত-তরল বস্তু প্রবাহিত হয়। কোথায় যায়, সে-বিষয়ে নদীমাতৃক দেশের মানুষের বিন্দুমাত্র কৌতূহল নাই। তবে একটা কথা। ঘরের একমাত্র জানালাটি সে-দেয়ালেই হলেও তা ছাদের কাছাকাছি। তাই নালা-পায়খানা বা বস্তির দৃশ্য চোখে পড়ে না। শুধু কখনো-কখনো ওদিক থেকে হাওয়া বইতে শুরু করলে ঘরটা দুর্গন্ধে ভরে যায়। এখন গ্রীষ্মের দিনে হাওয়ার খাতিরে সে-দুর্গন্ধ সহ্য না করে উপায় থাকে না। বারান্দার দিকটা একটু খোলামেলা ছিল। কিন্তু সেখানে কাঠের গুদামে সর্বক্ষণ মানুষের চলাচল থাকে বলে সে উন্মুক্ততা উপভোগ করা সম্ভব নয়। চতুর্দিক থেকে ঘরটি সত্যই কয়েদখানা। মালেকার মনে হয়, একবার যদি এ-শ্বাসরুদ্ধ-করা নির্মম অস্তিত্ব থেকে উদ্ধার পেয়ে দেশের বাড়িতে তারা ফিরে যেতে পারত, তবে তাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান হত। তার ব্যাধির সমাপ্তি ঘটত। কিন্তু মালেকা জানে, তা সম্ভব নয়। তারা শখ করে শহরে আসে নাই, প্রাণভয়েই পালিয়ে এসেছে। দেশে তাদের আর মগরা-মগরা ধান নাই, পুকুরভরা জলজ্যান্ত টাটকা মাছও নাই। সম্বলের মধ্যে ভিটেবাড়িটা আছে বটে, কিন্তু ভিটেবাড়িতে ধানের ফসল হয় না, মাছও চরে না। দেশে প্রত্যাবর্তন করবার জন্যে সে যে-তীব্র আকাঙ্ক্ষা বোধ করে, সে-আকাঙ্ক্ষা কখনো বাস্তবে পরিণত হবে না। তবে সে-কথাই-বা দাইকে বলে কী লাভ?
একটু নীরব থেকে দাই আবার বলে,
—বখাটে মানুষের এক গুণ থাকে। মেয়েমানুষকে বশ করতে জানে তারা। তারপর মেয়েমানুষেরা তাদের ক্রীতদাসী হয়ে থাকে।
হরিমতী ঠাট্টা করে বলে, তোমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে নিশ্চয়ই।
—ঠিক বলেছ। তবে আমিও কম নই। ঠেঙিয়ে বের করে দিয়েছিলাম। এমন বখাটে নাই যে আমাকে বশ করে।
তারপর দাই উঠে মালেকার দিকে যায়। আঁচল থেকে দুটো ঢেঁড়স খুলে বলে,
—এ দুটি তোমার জন্যে এনেছিলাম। যাও, এবার বাড়ি যাও।
তারপর একদিন সুসংবাদ আসে। প্রধান শিক্ষয়িত্রীর মাইনে বেড়েছে। সেদিন ইস্কুলে হৈ-হুল্লোড় পড়ে। প্রধান শিক্ষয়িত্রীর মেদবহুল প্রশস্ত দেহে আনন্দ-তরঙ্গ জাগে, চোখ বারেবারে ঝাপসা হয়ে আসে।
ইস্কুলের পরে শিক্ষয়িত্রীরা তাঁর ঘরে জড়ো হয়। তারপর তাদের মুখ দিয়ে কথা ঝরে, হাসি ঝরে। চোখে হিংসার রেশ থাকলেও তা-একটা তৈলাক্ত উৎফুল্লতায় ঢেকে থাকে। শীঘ্র প্রধান শিক্ষয়িত্রীর সংযম-গাম্ভীর্য শিথিল হয়ে ওঠে। তিনিও উদ্যমের সঙ্গে কলতানে যোগদান করেন, কারণে-অকারণে হাসতে শুরু করেন। তাতে দোষ কী? আজ খুশির দিন। তাছাড়া তিনিই আনন্দ-উৎফুল্লতার এ-বিস্ফোরণের কারণ। আজ একটু বাচালতা-প্রগলভতা করলে অশোভন হবে না, পদমর্যাদার ক্ষতি হবে না।
কথার আর হাসির ফোয়ারা থামে না; অজস্র কথায় এবং সাবলীল হাসিতে তারা পরস্পরকে নিমজ্জিত করে। আলাপ-আলোচনার বা মন্তব্য-উক্তির বিষয়বস্তু এই ধরা যায়, এই ধরা যায় না; এই আছে, এই নাই।
—থাম থাম। এক সময়ে প্রধান শিক্ষয়িত্রী চিৎকার করে বলেন। কথার স্রোতটা শুধু যে হঠাৎ দৃশ্যগত হয়েছে তা নয়, একটি বিচিত্র মোড়ও নিয়েছে। কিন্তু হাসি বা কথা কেউ থামাতে রাজি নয়। বরঞ্চ এবার সমবেত কণ্ঠের উত্তাল হাসি ফেটে পড়ে আতশবাজির মতো!
—বলি তবে। আজ যখন খুশির খবর এসেছে—অবশেষে প্রধান শিক্ষয়িত্রী ঘোষণা করেন—
কথাটা কী করে উঠেছে তা তিনি জানেন না। খুশির খবরটির সঙ্গে তার কোনো সম্বন্ধ-যোগাযোগও দেখতে পান না। কিন্তু আজ কথার যুক্তি বা অর্থপূর্ণতার কে বিচার করে?
—শোন বলি। কোনোপ্রকারে নিজেকে সংযত করে প্রধান শিক্ষয়িত্রী বলবার জন্যে তৈরি হন। তবে তাঁর ঘর্মাক্ত, কিছু ময়লা সাদা ব্লাউজের নিচে অনাবৃত মেদবহুল অঞ্চলটি কোনো সংযম-না-মেনে থলথল করে কাঁপতে থাকে দুরন্ত হাসির বেগে।
গলার স্বরটা খাটো করে তিনি স্বীকার করেন, একদা একটি পুরুষের হৃদয়বীণায় তিনিও প্রেমের ঝঙ্কার তুলেছিলেন।
—কথাটা তোমাদের বিশ্বাস হবে না হয়তো।
অবশ্য আজ তাঁর স্তূপাকার নাসিকা, চওড়া ঠোঁট, লাবণ্যশূন্য স্থূল-কালো মুখমণ্ডল, চাপা মাথায় একমুঠো ফিনফিনে প্রাণহীন চুল এবং মেদবহুল প্রশস্ত দেহের দিকে তাকিয়ে সে-কথা বিশ্বাস করা দুষ্কর। সে-কথা তারাও জানে, তিনিও জানেন। তবে তিনি এ-কথাও বুঝতে পারেন যে, সৌন্দর্যের ভিত্তিতে স্থাপিত না হলে প্রেমের গল্প নিতান্ত পানসা শোনায়, বিবর্ণ দেখায়। তাছাড়া তাঁর মনের গুপ্ত কোণে পুরুষের রুচির প্রতি একটু-যে শ্রদ্ধা নাই তা নয়।
—আজ খুশির দিন বলেই বলছি। প্রধান শিক্ষয়িত্রী সলজ্জ কণ্ঠে আবার ঘোষণা করেন। তারপর বলেন, কথাটা অবিশ্বাস্য শোনালেও যৌবনকালে তিনি দেখতে-শুনতে মন্দ ছিলেন না।
পর-মহূর্তে শিক্ষয়িত্রীদের মধ্যে একটা রব ওঠে। হাসির নয়, উৎসাহেরই রব।
—তোমাদের বলতে কী, কেউ-কেউ আমাকে সুন্দরীও ভাবত। বিশ্বাস করবে না হয়তো, কিন্তু আমার মাথায় একরাশ চুল ছিল। কোঁকড়ানো ঘন চুল, তবু রেশমের মতোই মসৃণ।
একটু থেমে আভাসে-ইঙ্গিতে তাঁর যৌবনকালের দেহেরও বিবরণ দেন।
অনেকটা হরিমতীর মতো।
এ-আকালের দিনেও হরিমতীর টইটম্বুর যৌবন। মুখে কোমল-উজ্জ্বল লাবণ্য, আঁট-করে-পরা শাড়ির বন্ধনে সুদৃশ্য সুডৌল দেহ। তবে কিছু ছিপছিপে। বয়স কম ছিল। তবে পুরুষরা কী দেখে কে জানে? আমার চুলই নাকি তার বুকে কালবৈশাখীর ঝড় জাগায়।
—সবটা বলুন না শুনি। বালিকার চোখ ঝলসানো ঔৎসুক্যের সঙ্গে শিক্ষয়িত্রীরা তাঁকে উৎসাহ দেয়। তবে ততক্ষণে তাদের চোখে কালো ছায়া নেবে এসেছে। সে-ছায়া ঢাকবার আর চেষ্টা তারা করে না। মনের অন্ধকারে বিচ্ছুও জেগে ওঠে। হ্যাঁ, চুল ছিল-তো ইঁদুরের লেজ ছিল, রূপ ছিল-তো কালো হাঁড়ি ছিল, দেহ ছিল-তো উইয়ের ঢিবি ছিল।
—তারপর? তীক্ষ্ণ গলায় তারা বলে।
প্রধান শিক্ষয়িত্রীর নেশা ধরেছে। তাঁর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম, চোখে-মুখে অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা।
—বলতে যখন বলছ।
দাইয়ের ধৈর্য যেমন সীমাবদ্ধ, তার মুখটাও তেমনি চাঁছাছোলা। তার ভয়ও নাই কাউকে। সত্য কথা গোলার মতো বেরিয়ে আসে মুখ দিয়ে, কোথাও আটকায় না। সে এবার প্রশস্ত হাই তুলে বলে, -পীরিত-টিরিতের কথা কেন বলছেন? পুরুষ আর নারী, তেল আর বেগুন। এক সঙ্গে হলেই ছ্যাৎ করে জ্বলে ওঠে। পীরিতের ফল জিজ্ঞাসা করুন আমেনা বিবিকে। ন-টা ছেলেমেয়ে কি এমনিতে হয়েছে? আসল কথা বলুন। সে-কথা শুনবার জন্যেই এরা বসে আছে।
—আসল কথা আবার কী? একটু সন্দিগ্ধ কণ্ঠে প্রধান শিক্ষয়িত্রী জিজ্ঞাসা করেন।
—মাইনে বেড়েছে, খুশির কথা। কিন্তু একটু মিষ্টি-পানি না হলে চলে কী করে?
শিক্ষয়িত্রীরা চিৎকার করে ওঠে। এমন একটি মজাদার কথা তারা যেন ভুলে গিয়েছিল। এবার মনে পড়তে তারা প্রস্তাবটির সমর্থনে উচ্চকণ্ঠে রব তোলে।
অকস্মাৎ প্রধান শিক্ষয়িত্রীর মেদবহুল দেহে আনন্দ-তরঙ্গ স্তব্ধ হয়ে যায়, চোখের উজ্জ্বল আলোও স্তিমিত হয়। শুষ্ককণ্ঠে তিনি বলেন,
—মাইনে বেড়েছে মোটে পাঁচ টাকা। এমন আর কী বেড়েছে?
—পাঁচ হোক পাঁচ শ হোক, বেড়েছে তো।
—শুধু খবর পেলাম, টাকা হাতে আসে নি।
—না না, ওসব ফাঁকির কথা! সমবেতকণ্ঠে শিক্ষয়িত্রীরা প্রতিবাদ করে। তাদের হিংসা এবার প্রতিহিংসার রূপ ধারণ করে এবং সে-প্রতিহিংসা আগুনের মতো দাউ-দাউ করে জ্বলে ওঠে। তারা ভাবে এবার প্রধান শিক্ষয়িত্রীকে ঘায়েল করা যাবে, তাঁর আনন্দের মুখে চুন দেওয়া যাবে।
প্রধান শিক্ষয়িত্রীর মুখে স্তরের পর স্তর কালো ছায়া নাবে। কিন্তু তাতে তাদের নাছোড়বান্দা ভাব আরো বাড়ে। মনে হয় প্রাণ গেলেও আজ তাঁকে তারা ছাড়বে না। হাতাহাতি হোক, চুল টানাটানি হোক, ছাড়বে না। হাসতে-হাসতেই তারা তাঁকে ক্ষত-বিক্ষত করবে, আবদারের সুরেই তাঁর মনে ত্রাস সৃষ্টি করবে।
—কথা দিচ্ছি, মাইনেটা পেলেই মিষ্টি খাওয়াব
একজন শিক্ষয়িত্রী বলে,
—খুশির দিনেই খুশির কাজ করতে হয়। এসব ব্যাপারে দেরি হলে মজা থাকে না।
দাই আবার বলে,
—রাজি হয়ে যান। ধৈর্য ধরে আপনার পীরিতের গল্প শুনছে, এবার তাদের শখটা মেটান।
কোণঠাসা জন্তুর মতো অসহায়ভাবে এধার-ওধার তাকিয়ে প্রধান শিক্ষয়িত্রী বলেন,
—কাল হবে, কাল। আজ পয়সা নেই।
—চকের দোকানে বাকি পাওয়া যায়। রাজি হয়ে যান, আমি নিয়ে আসি। কথাটা বলে দাই।
ক্ষণকালের জন্যে প্রধান শিক্ষয়িত্রী অন্ধকার দেখেন। তারপর সে-অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ আলো দেখতে পান। উত্তেজনায় কম্পমান কণ্ঠে তিনি বলেন,
—কিন্তু আজ যে মালেকা নাই।
মালেকা আজও আসে নাই। আজ চার দিন ধরে সে অনুপস্থিত।
সহসা ঘরে স্তব্ধতা নেবে আসে। এত হৈ-হুল্লোড়ের পর সে-স্তব্ধতা বিচিত্র ঠেকে।
প্রধান শিক্ষয়িত্রী সহকর্মিণীর দিকে তাকান। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁর মুখে একটা বিজয়িনীর ভাব ছড়িয়ে পড়ে। সন্দেহ থাকে না যে, অবশেষে তিনি তাদের যুক্ত আক্রমণ ঠেকাতে সমর্থ হয়েছেন। তবু নিশ্চিত হবার জন্যে বলেন—
—খুশির ব্যাপার। এ-ব্যাপারে কেউ বাদ পড়বেন কেন?
কেউ উত্তর দেবার আগেই দাই উঠে দাঁড়ায়। মুখে তার বিরক্তির ভাব। ঠোঁট উল্টে সে বলে,
—তবে আর মিষ্টিটা হল না।
—কেন নয়? উষ্ণভাবে প্রধান শিক্ষয়িত্রী প্রশ্ন করেন। —মালেকা আজ আসে নি কাল আসবে। থেকে-থেকে তার জ্বর-জ্বারটা হয়েই থাকে।
—আর আসবে না। এবার সে মরবে।
উক্তিটা হাসির ব্যাপার বলে ভুল করে একজন শিক্ষয়িত্রী চপলকণ্ঠে হেসে ওঠে। কিন্তু ঘরের গভীর স্তব্ধতার মধ্যে সে-হাসি শীঘ্র নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
দরজার চৌকাঠ হেলান দিয়ে উঠানের দিকে তাকিয়ে দাই কয়েক মুহূর্ত আপন মনে বিড়বিড় করে। তারপর অন্যদিকে ফিরে সজোরে বলে,
—একটা কথা বলব? মিষ্টির পয়সাটা মালেকার কাফনের জন্যে তুলে রাখাই ভালো হবে। ঘরের স্তব্ধতা এবার একটা অস্বচ্ছন্দভাবে ভরে ওঠে। কেউ কিছু বলে না। প্রধান শিক্ষয়িত্রীও দাইয়ের কথার কোনো উত্তর দেন না। কিন্তু এবার তাঁর অন্তরে ধীরে-ধীরে একটা ক্রোধের সঞ্চার হয়। দাইয়ের স্পষ্টবাদিতায় তিনি মাঝে-মাঝে বিরক্তিবোধ করলেও কখনো তাকে কিছু বলেন না। তার অতি নির্মম কথারও উত্তর দেওয়া সহজ নয়। কিন্তু এখন তার ব্যবহার তাঁর কাছে অসহনীয় মনে হয়। তিনি জানেন, তাঁর ক্রোধের কারণ পয়সা ব্যয়ের ভয় নয়। শিক্ষয়িত্রীদের মিষ্টি খাওয়াতে তাঁর আপত্তি ছিল না। খুশির খবর পেলে বন্ধুবান্ধবকে মিষ্টি খাওয়ানো একটি চলতি রেওয়াজ। কেন তাদের প্রস্তাবটি সহজে মানতে চান নাই তার কারণ আছে। তিনি নির্বোধ নন। অত হাসি-ঠাট্টার মধ্যে প্রস্তাবটি তারা পেশ করলেও তার পেছনে একটি হিংসার ভাব তিনি অনুভব করেন। সে জন্যেই রাজি হতে তার মন চায় নাই। মালেকার যদি সত্যিই মৃত্যু ঘটে, তার কাফনের জন্যে তিনি খুশি হয়েই পয়সা ব্যয় করবেন। মালেকার জন্যে সকলের মায়া হয়, দুঃখ হয়। রোগব্যাধির জন্যে তার কাজে অহরহ বাধা পড়ে। শিক্ষকতার কাজেও সে তেমন যোগ্য নয়। তবু তার জন্যে মায়া-দুঃখ হয় বলেই তিনি তাকে কিছু বলেন না। বস্তুত, সকলের প্রতি তাঁর অশেষ দয়ামায়া বিবেচনা। দাই যে এমন নির্ভাবনায় ইস্কুলের কাজে বজায় আছে, তার কারণও তাঁর সহৃদয় পরোপকারী চরিত্র। কিন্তু তাঁর প্রতি কে-একটু মায়ামমতা দেখায়, কেই-বা তাঁর মঙ্গলের কথা ভাবে? আজ তাঁর খুশির দিনে একটা অমঙ্গলের ছায়া ফেলতে দাইয়ের একটু প্রতিবাদ করার প্রয়োজনও কোনো শিক্ষয়িত্রী বোধ করে নাই। সেজন্যেই-তো তাঁর মনে ক্রোধের সঞ্চার হয়েছে।
প্রধান শিক্ষয়িত্রীর ক্রোধ পড়তে দেরি হয় না। তিন বুঝতে পারেন, খুশি-আনন্দের কথা দাইয়ের কাছে বড় নয়। সে-সব মায়া, আলেয়ার মতো ভুয়ো। জীবনটা তার চোখে দুঃখকষ্টে সদাছায়াচ্ছন্ন। মালেকার আশু মৃত্যুর ছায়া অন্যেরা পরিষ্কার করে দেখতে না-পেলেও সে দেখে এবং তার কাছে সে-ছায়াই একমাত্র সত্য। মুহূর্তের জন্যে কৃত্রিম হাসি ঠাট্টায় সে-সত্য ভোলা যায়, কিন্তু তাতে তার জয়লাভ হয় না। সে-সত্যকে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। তিনিই-বা কী করে করেন?
প্রধান শিক্ষয়িত্রী নিস্তেজভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকেন। তারপর দুর্বল কণ্ঠে বলেন,
—যাও, বাড়ি যাও।
শিক্ষয়িত্রীরা একে-একে বেরিয়ে যায়। উঠানে তখন শেষ বেলার ম্লান আলো।
প্রধান শিক্ষয়িত্রী শূন্য ঘরে একাকী আরো কিছুক্ষণ বসে থাকেন। তাঁর সমস্ত শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। অন্তরের নিভৃত কোণে একটা কান্নার ভাব জাগে। কিন্তু সে-কান্নার কোনো অর্থ নাই বলেই যেন শীঘ্র তারও সমাপ্তি ঘটে। একবার ভাবেন, মালেকার আরোগ্যের জন্যে খোদার কাছে দোয়া করবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে মালেকার জীবন-মৃত্যু সুখ-দুঃখ তাঁর মনে কোনোই দাগ কাটে না। মালেকা কে?
যে-গভীর ছায়ায় তাঁর মন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, সে-ছায়া নিরাকার। তাই তা-এত ভীতিজনক।
শীঘ্র বারান্দায় দাইয়ের কণ্ঠ শোনা যায়। সে আপন মনে বিড়বিড় করে। ইস্কুল বন্ধ করবার জন্যে সে অধীর হয়ে উঠেছে। চমকিতভাবে প্রধান শিক্ষয়িত্রী উঠে দাঁড়ান। বুঝতে পারেন, দাইয়ের অসন্তুষ্টিও তাঁর মনে ভীতির সঞ্চার করে।
উঠানে নেবে তিনি আবার উঠে আসেন। ময়লা সাদা ব্লাউজের ভেতর থেকে আধাভেজা বহু-ব্যবহৃত একটি এক টাকার নোট উদ্ধার করে, তিনি ক্ষুদ্র সলজ্জিতকণ্ঠে বলেন,
—নাও আজ খুশির দিন।
দাই ভ্রূকুটি করে তাকায় নোটটার দিকে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে মনে হয়, সে যেন টাকাটি প্রত্যাখ্যান করবে। প্রধান শিক্ষয়িত্রীর বুকটা কাঁপতে শুরু করে।
—নাও! এবার ভীতকণ্ঠে ক্ষিপ্রভাবে তিনি বলেন।
নোটটা তারপর দাইয়ের কোমরে শাড়ির ভাঁজে অদৃশ্য হয়ে যায়। সে কিছু বলে না। তার ভ্রূকুটিটা আরো গাঢ় হয়েছে যেন, মুখটাও কেমন বাঁকা হয়ে উঠেছে।
তবু একটা গভীর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে প্রধান শিক্ষয়িত্রী উঠানে নাবেন। মনের ছায়াটা যেন একটু হালকা হয়েছে।