1 of 2

মালাবৌদি – ডাঃ মহাদেব বন্দ্যোপাধ্যায়

মালাবৌদি – ডাঃ মহাদেব বন্দ্যোপাধ্যায়

পাড়ার নীলুদা মানে নীলেন্দ্রনাথ মুখার্জীর আজ বিয়ের বৌ-ভাত। সীমিত মানুষের আয়োজন। আমরা ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি নীলুদাকে। যেমনি সৎ চরিত্র’র, তেমনি সাহসী, প্রগতিশীল চরিত্র আর ধার্মিকতা আর মনে-প্রাণে। ছোটখাটো একটা চাকুরি করেন।

কোন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। মুক্তমনের মানুষ বিয়ে করলেন বড় শহরের একটা সাধারণ মেয়ের সঙ্গে।

আমরা মানে চিনু-পানা রনি-পিন্টু-ভোলা-পদ্মা আর আমি পরিবেশনার দায়িত্ব পেলাম।

নীলুদার বড়মামা কলকাতার যাদবপুরে থাকেন। তিনিই মেয়েটাকে পছন্দ করে দিয়েছেন। খুবই উদার প্রকৃতির মানুষ। আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কিরে গপু, তোদের মালা বৌদি কেমন হোল?”—আমরা সবাই একবাক্যে বললাম,—”আলাপ হয়নি এখনও মামা, এইতো সবে এখানে এসেছেন, পরে আলাপ হবে। তবে নীলুদা যখন বিয়ে করে এনেছে তখন খারাপ নিশ্চয় হবে না।”

পরের দিন নীলুদার এই মামা আমাদের বাড়িতে বাবার সঙ্গে বসে গল্প করছেন। কানে এল–“আমিই দেখে শুনে, নীলুর সঙ্গে বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলাম। রূপে সরস্বতী, গুণে লক্ষ্মী, নীলুর একটু সেবা যত্ন করবে, তাই চাকুরীজীবি বা শিক্ষিত মেয়ে নিলাম না, তবে মাধ্যমিক পাশ। একেবারে আটপৌরে, ঘরোয়া,” বাবা শুনছিলেন সব। আমি বাড়ি থেকে আড্ডায় বেরোলাম।

রকে বসে পাড়ায় আড্ডা দিচ্ছি আমরা। হঠাৎ পান্না বলে ফেলে, যাই বলিস ভাই নীলুদার বৌখানাকে মনে হল না যে বড় শহরের মেয়ে, কিরকম যেন আনস্মার্ট, “–আরে পান্না শোন, নীলুদা যখন চয়েস্ করেছেন তখন নিশ্চয়ই গুণী। আমি বলে ফেললাম।”

“–তবে পড়াশুনা যা শুনলাম তাতে ভাই ভবিষ্যতে কষ্ট দেবে নীলুদাকে, অত ভালো ছেলে নীলুদা,”— দীনু বেশ গম্ভীর ভাবে কথাটা বলে।

মাস ছয়েক এইভাবে চলল, একদিন আমরা পাড়ার সেই রকে বসে গুলতানি করছি, দেখি শৈল পিসি আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে মুখখানা পাচার মত করে বলে, “শুনেছিস কিছু তোরা?”

—”কি শুনব?”

“—দিনরাত বসে বসে রকে গ্যাঁজাবি, তা শুনবি কি করে? ওই যে তোদের ছেলেদের দেবতা, ওই যে নীলু মহারাজ, বৌটাকে যে দিনরাত অত্যাচার করে মারছে, পাড়ায় ছি ছি পড়ে গেছে, বুঝলি?”

আমরা এ-ও সবার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছি, তারপর আমিই শৈল পিসিকে বলি, “ভালোকরে বলতে কি ব্যাপারটা? কিরকম অত্যাচার করছে?”

শৈল পিসি বাল্যবিধবা, পাড়ার সবাই ওকে পিছনে ‘খাস-খবর’ বলে। শৈল পিসি বলে, জানিনা বাবা শুনছি সব পাড়ার বৌদের মুখে। ওই তো ধনঞ্জয়ের বোঁটা সেদিনও আমাকে বলল, “জানো পিসি, নীলু ঠাকুরপো অত্যাচার করে বৌটাকে মেরে না ফেলে বাপু,”—”তোরা বাবা দেখ গোপাল আমার মানিক, আহারে! বৌটার কি কষ্ট, মুখটা শুকিয়ে আমচুর হয়ে গিয়েছে, ভগবান কতদিন যে এইসব সইতে হবে ঠাকুর তুমিই জানো।” বলে পিসি হাতদুটো কপালে ঠেকিয়ে স্বর্গের দিকে তাকায়। আমরা একটু ভাবলাম, কিন্তু সেরকম গুরুত্ব দিলাম না।

.

দিন পনের পর আমার মা আমাকে বললেন, “হ্যারে গপু নীলুটাকে একটু ঠেকা, মেয়েটা মরে যাবেরে? মালাকে শুনছি প্রায় গঞ্জনা শুনতে হচ্ছে। প্রায়ই ওর কান্নার স্বর শোনা যাচ্ছে নীলুর বাড়ি থেকে।”

আমার খুব রাগ হল নীলুদার উপর। প্রায় কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, এটা ঠিক হচ্ছে না নীলুদার। আমি কথাটা তুললাম বন্ধুমহলে। নানা প্রশ্ন উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগে আমাদের মনে। বধু-হত্যা হবে নাতো পাড়ায় একটা? গতকাল দেখেছি নীলুদার শ্বশুর-শাশুড়ি এসেছেন মিষ্টির প্যাকেট হাতে। ব্যাপারটা লক্ষ করতে হবে। গতকাল রাতেও মালাবৌদির বাবা-মা থাকা অবস্থায় নীলুদা বেশ গলা উঁচিয়ে কথা। বলেছে। তবে বুঝলাম নীলুদা অত্যাচারটা ভালো মতই শুরু করে দিয়েছে দেখছি।

আমরা গোপনে আলোচনায় বসলাম নিজেদের মধ্যে। এটা আমরা বুঝতে পারছি যে মালাবৌদির মত একজন ঠাণ্ডা মনের মেয়েকে এত অত্যাচার নীলুদার ঠিক হচ্ছে না। নীলুদার সঙ্গে এতদিন মিশে এটাই মনে হয়েছিল যে উনি সৎ, ধার্মিক, উদার স্বভাবের মানুষ। এখন বুঝছি এসব লোকদেখানো ব্যাপার। এর একটা বিহিত করতেই হবে। বৌটাকে পড়তে দেবে না গান গাইতে দেবে না স্বাধীনতা দেবে না। নারী স্বাধীনতার যুগে একটা মেয়েকে এইভাবে আটকে রাখতে পারে না। এটা অন্যায়। এগুলো মেনে নেওয়া যায় না। নিশ্চয়ই নীলুদা ওগুলো বন্ধ করতে চায়। আমরা তা হতে দেব না।

আজ দেখি মালাবৌদির বাবা-মা মুখটাকে শুকনো করে আমাদের সামনে দিয়েই বেরিয়ে গেলেন। ওঁদের কি ব্যাপার, জিজ্ঞাসা করা উচিত মনে করলাম না।

আমরা তৈরি হলাম। বড় কাগজের রিপোর্টার ভোলার কাকা। তাঁকে গিয়ে সব জানালাম। একটা লিস্ট দিয়ে এলাম, যা-যা অত্যাচার হচ্ছে। নীলুদার বাড়ির প্রতি ওয়াচ রাখলাম চব্বিশ ঘন্টা যেন মালাবৌদিকে না মেরে ফেলে এই উদ্দেশ্যে।

রনি বলে–“দেখ তোরা, আজও একবিংশ শতাব্দিতে এসেও মানুষের বর্বরচিত অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে। একদল মানুষ নারী স্বাধীনতা হরণ করতে চাইছে। সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা। আমি আমার দলকে সমস্ত ব্যাপারটা বলবো। তারপর প্রয়োজনে নীলুদার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামব, পথ অবরোধ হবে। বিচার চাইব। একটা জীবন নিয়ে ছেলেখেলা হতে দেব না।”

স্থানীয় ও.সি.কে রনিদের দল থেকে বলা হয়েছে। সবদিক থেকে আমরা কোমর বেঁধে রইলাম।

দিন সাতেক পর কলকাতার নামী-দামী কাগজের রিপোর্টার, দূরদর্শনের সংবাদ বিভাগ, স্থানীয় ও.সি. আমাদের পাড়ায় এসে হাজির। ভোলাদের বাড়িতেই ওনারা উঠলেন। আমরা সবাই সেখানে গেলাম। আলোচনা করলেন, কি করে এই ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করা যায়। তারপর সবাই নীলুদার বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। আমরা পিছনে পিছনে গেলাম। পাড়ার মা-বৌ-মাসিরা জানলার ভীতর থেকে উৎকণ্ঠা চোখে দাঁড়িয়ে আছেন।

নীলুদা বাড়িতেই ছিলেন। এই রকম ভাবে এত মানুষ সঙ্গে পুলিশ দেখে খানিকটা হতচকিত হয়ে গেলেন। তারপর বললেন–“আসুন আসুন সবাই ভিতরে আসুন। হ্যাঁ, কি ব্যাপার বলুন তো? কোনো দরকার আছে আমার সঙ্গে? আসুন এইঘরে বসুন।” সবাই ঘরে ঢুকলেন। আমরাই চেয়ার টেবিল সরিয়ে ঘুরিয়ে বসার জায়গা করে দিলাম।

ও.সি. ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনিই কি নীলেন্দ্র নাথ মুখার্জী?”

“হ্যাঁ, আমিই, বলুন কি ব্যাপার?” নীলুদার প্রশ্ন।

“আমরা আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কয়েকটি জরুরি কথা বলতে চাই। উনি কোথায়?”

নীলুদা স্ত্রীকে ডাকেন, “মালা, মালা?”

ভিতর থেকে উত্তর এলে— “হ্যাঁ আসছি।”

মালাবৌদি রান্নাঘর থেকে উঠে আসে।

“শোন এনারা তোমার সঙ্গে কি সব জরুরি কথা বলতে এসেছে।”

মালাবৌদি মুখখানা নিচু করে একটা চেয়ারে বসল। নীলুদা দাঁড়িয়ে।

ও.সি, রিপোর্টারদের বললেন–“নিন আরম্ভ করুন।”

ব্যাপারটা কি হতে পারে তা নীলুদা উপলব্ধি করতে পারেননি এখনও।

এবার শুরু হল রিপোর্টারদের প্রশ্ন–“শুনলাম আপনার স্বামী আপনাকে ভীষণ রকম অত্যাচার করছেন?” ভোলার কাকা প্রশ্ন করলেন নীলুদার স্ত্রীকে।

সব রিপোর্টারদের হাতে পেন আর কাগজ। সবাই মালাবৌদির দিকে তাকিয়ে আছেন।

আর একজন প্রশ্ন করলেন–“আপনাকে কি মারধোর করা হচ্ছে?” মালাবৌদি চুপ করে মাথাটা মাটির দিকে রেখে বসে আছে।

আপনি নির্ভয়ে উত্তরগুলো দিন। আপনার উপর আর কোনরকম অত্যাচার হবে। মনে রাখবেন, আইন আপনাদের সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।”

“বাবার বাড়িতে বা বাইরের জগতে আপনাকে মিশতে দেন?” দূরদর্শনের রিপোর্টারের প্রশ্ন।

ঘরের সবাই চুপ করে আছেন।

মালাবৌদি শাড়ির আঁচলটাকে নিয়ে আঙুলে জড়াচ্ছেন। তার চোখ মেঝের দিকে।

এবার নীলুদা মুখ খুললেন— “শোন মালা, এনারা কলকাতা থেকে এসেছে। আমার একটা সম্মান আছে। তুমি ওনাদের প্রশ্নের উত্তরগুলো দাও। তোমাকে কেউ ভয় দেখাচ্ছে না। আমি তোমায় কি কি বলি ওনাদের সামনে জানাও।”

সারা ঘর চুপ। মালাবৌদি চোখটাকে মেঝের দিক থেকে সরিয়ে জানালার দিকে রেখে বলতে শুরু করেন— “উনি মানে আমার স্বামী—”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ এইতো বেশ নির্ভয়ে উত্তর দিন।” ও.সি. হাসিমাখা মুখে উপদেশ দেন।

সবাই প্রস্তুত কলম কাগজ নিয়ে।

“আমার স্বামী আমার পড়াশুনাটা চালিয়ে নিয়ে যেতে চান। কলেজে ভর্তি করাতে চান, কিন্তু আমার পড়াশুনা একেবারে ভালো লাগেনা। আমার মা বাবাও পড়াশুনা একেবারে চান না। বলেন বিয়ে হয়ে গেছে। পড়াশুনার কি দরকার আছে? আমার স্বামী এইজন্য ধমক দেন। আমার স্বামী আমাকে কোনদিন অত্যাচার করেননি। হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছে মাসখানেক হল। গান শুনতে উনি ভালবাসেন। গান গাওয়ার ধৈৰ্য্য আমরা নেই। সেলাই বুনুনি আমি একেবারে জানি না। শাশুড়ি মা রান্না ঘরেই যেতে দেন না। কারণ রান্না করা আমি শিখিনি। আমার ভালো লাগে টি.ভি. দেখতে, ভি.ডি.ও দেখতে। আর ঘুমোতে। সকালে আমি উঠতে পারি না। আমার উঠতে ন-টা বেজে যায়। শাশুড়ি চা করেন, আমার স্বামী খুব ভোরে ওঠেন। কি যে প্রয়োজন অত ভোরে ওঠার বুঝি না। আমার উপর রাগ হয় ওনার। আমাকে বলেন পড়াশুনা কর। সমাজে মেশ। নারী স্বাধীনতার পতাকা তুলে ধর। অর্থনৈতিকভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা কর। ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা করাতে গেলে তোমাকে অন্তত গ্র্যাজুয়েট হতে হবে। কি জানি আমার এই উপদেশগুলো একেবারে পছন্দ হয় না। ওই যে মেয়েগুলো ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলিয়ে চাকুরি করতে যায়। ওদের দেখে আমার গা-পিত্তি জ্বলে ওঠে। ওসব ছেলেদের মানায়। আর গ্র্যাজুয়েট হওয়ার কথা বলে আমার স্বামী। আমি বা আমার মা বাবারা কোনদিন আমাদের এই স্বপ্ন দেখেননি। আপনারা ওনাকে বলুন যে আমার দ্বারা এসব হবে না। ফালতু-ফালতু আমাকে কাঁদাচ্ছে। আমি সিনেমা দেখতে ভালোবাসি। আমাদের বাড়ির উঠোনে ভি.ডি.ও হত। আমার ভাই কাকারা সব ব্যবস্থা করত। আমার ভালো লাগে সোনাদানা পরে স্বামীর সাথে বেড়াতে দোকানে গিয়ে ভালো ভালো খাবার খেতে।” মালাবৌদি একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেল।

সারা ঘর চুপ। প্রত্যেকের হাতেই সাদা কাগজ কলম। একটা অক্ষরও লেখা হয়নি। হাঁ করে বাই শুনছিলেন মালাবৌদির কথা। মালাবৌদি চুপ। নীলুদার মুখে সামান্য হাসির রেখা। ও.সি. সাহেব একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লেন। তারপর বলে ওঠেন— হাও স্ট্রেঞ্জ। নীলুবাবু দেখছি নিপাট একজন ভদ্রলোক। নীলুদার মা চা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আমরা দৌড়ে গিয়ে তাঁর হাত থেকে কেটলি কাপ আর ডিশের বিস্কুটগুলো বিতরণ করতে শুরু করি। মালাবৌদি ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন।

আমাদের খুব খারাপ লাগল। রিপোর্টার ভদ্রলোকেরা নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে বলতে থাকেন–“আজব ধরনের ভদ্রমহিলা। এইরকম বাবা-মা কলকাতায় আছে? খুঁজে বার করতে হবে।”

নীলুদার প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের আরও বেড়ে গেল। বুঝলাম কাগজে যে ধ্ব দাম্পত্য কলহতে বধূর মৃত্যু বেরোয় সেগুলো সবই সত্য নয়। সবই যে স্বামীদের দোষে হয় তা কিন্তু নয়। চা-বিস্কুটের পালা শেষে ও.সি. এবং রিপোর্টাররা একযোগে বলে উঠলেন। “উই আর ভেরি ভেরি সরি, নীলুবাবু আমরা রংলি ইনফর্মড হয়েছি। তার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। উই রিয়ালাইড দ্যাট ইউ আর ভেরি গ্রেট, অ্যান্ড অনেষ্ট। আমরা এলাম, বুঝলাম আর আপনার মত একটা সত্যিকারের মানুষ পেলাম।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *