মালদহ
কালোপুর
গম্ভীরার আসর বসেছে গ্রামে। ওস্তাদ পরাণ মাঝি সুললিত কণ্ঠে গাইছে, ‘শিব হে, এবার পূজা বুঝি তোমার হইল না। অনেকদিন শুনেছি এই গান, প্রতিবারই শুনেছি। কিন্তু কোনোদিন কি ভেবেছি এমন একদিন আসবে যেদিন সত্যিই শিবের পুজো আর হবে না গ্রামে।
ভীতস্ত আশঙ্কাম্লান একদল লোকের মিছিল চলেছে গ্রাম থেকে বাইরে, কোথায় কেউ জানে না। একা তাদের পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল দোস্ত মহম্মদ–জোয়ান লাঠিয়াল দোস্ত মহম্মদ। বলেছিল, ‘কুণ্ঠে যাবে, যে যাবে তার মাথা লিয়ে লিব। তাকেও পথ ছাড়তে হল। লাঠি ফেলে দিয়ে কেঁদে উঠল দোস্ত মহম্মদ। মালদহ জেলার অখ্যাত কালোপুরে ইতিহাসে আর-একটি নতুন অধ্যায় শুরু হল। দোস্ত মহম্মদ কাঁদছে, দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল দোস্ত মহম্মদ কাঁদছে! কেন? এ প্রশ্নের জবাব নেই। ওপরে নির্বাক আকাশ। পায়ের নীচে পাতাজড়ানো তামাটে রঙের পথ কথা কয় না।
উত্তরবঙ্গের মালদহ জেলার ছোটো একটি গ্রাম কালোপুর। গ্রাম নয়, যেন একটি দ্বীপ। সভ্যজগতের কলকোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন শান্তিপ্রিয় আত্মসুখী জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত সে দ্বীপ। ছোটো ছোটো মানুষ ছোটো ছোটো তাদের আশা-আনন্দ, সুখ-দুখ। প্রাচীন গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ আজও যেখানে দেখা যায়, সেখান থেকে খুব দূরে নয়, মাইল দশেকের মধ্যেই। কিন্তু কী সেকালে, কী ইংরেজ আমলে, ইতিহাসের ওঠাপড়ায়, রাজা-উজিরের আসা-যাওয়ায় কেমন একটা অপরিবর্তনীয়তা গ্রামটিকে পেয়ে বসেছিল! হঠাৎ এল আঘাত-অপ্রত্যাশিত, অভাবিত। বিমূঢ় মানুষগুলো একান্তই গেয়ো, বুঝেই উঠতে পারেনি কত বড়ো ঝড় তাদের আম-জামের ছায়ায় ঘেরা ঘরগুলোর ওপর নেমে এল। সর্বনাশ যখন এল, তখন তারা বুঝল কী তাদের ছিল, কী তারা হারাল।
মালদহ জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের শিবগঞ্জ থানার এলাকায় পড়ে গ্রামটি। আমবাগানের ঘনবিস্তৃত ছায়ায় এলোমোলা ঘরগুলো। খড়ের চালা, মাটির দেওয়াল। ছোট্ট একটুকরো উঠোন। এ গাঁয়ে যাদের বাস–চাষ-আবাদ করেই চলে তাদের জীবিকা। এরা সকলেই প্রায় মুসলমান।
গাঁয়ের দক্ষিণে কয়েক ঘর হিন্দুর বাস। তাদের কেউ কামার, কেউ কুমোর, কেউ তাঁতি। কৈবর্ত আর তাঁতিদের সংখ্যাই বেশি। কেউ কেউ জাতব্যাবসা করে বটে, কিন্তু চাষ সবাইকেই করতে হয়–না হলে চলে না। আমাদের বাড়িটা একেবারে মুসলমান পাড়ায়। ডাইনে-বাঁয়ে তাদের ঘর। সামনে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ধুলোটে রাস্তা। ভোরবেলা থেকেই গোরুর গাড়ির চাকার শব্দে ঘুম ভাঙত গ্রামের। ভিনগাঁয়ের লোকেরা আসা-যাওয়ার পথে এই ছোট্ট গাঁয়ের দিকে কেউ-বা তাকাত–কেউ-বা তাকাত না।
গাঁয়ের পাশ দিয়ে চলে গেছে গঙ্গা নদী। অপ্রশস্ত শীর্ণ। শীতের সময় চর পড়ে–বর্ষায় থইথই করে। উত্তর বাংলার অন্য সব গ্রামের মতোই কালোপুরেও নেই ষড়ঋতুর বিপুল ঐশ্বর্য। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের আভরণহীন প্রকৃতি ক্ষতিপূরণ করে আম-জাম দিয়ে। তারপর বর্ষা। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ধুলোভরা রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে যায়, নীচু জমির জল উপচে ওঠে। কিন্তু তবু গোরুর গাড়িই প্রধান বাহন–নৌকো নয়। নৌকো যা চলে তা গঙ্গায়। বড়ো বড়ো পালতোলা নৌকোগুলো এ গাঁয়ের কাছে ক্কচিৎ নোঙর ফেলে। বর্ষা এ গাঁয়ে আসে অভিসম্পাতের মতো, পুরোনো খড় চুঁইয়ে ঘরে জল ঝরে। বর্ষার পর শরৎ। কত নাম-না জানা ফুল ফোটে–ঝোঁপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে মিঠে রোদ উঁকি মারে। কিন্তু এ সময় প্রকৃতি তার ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেয়। পুজোর আনন্দের হাসি মিলিয়ে যেতে না যেতেই ম্যালেরিয়া দেখা দেয়। হেমন্ত আর শীত কেটে গেলে পর ম্যালেরিয়ার মেঘও কেটে যায়। বসন্তই এ গ্রামে সত্যিকারের ঋতু। আমের পাতায় নতুন রং ধরে–গাছে গাছে থোকা থোকা মুকুলের গন্ধে গ্রাম-পথ মেতে ওঠে। জানা-অজানা পাখির ডাকে গ্রামের আকাশ মুখর। সে কী আকর্ষণ!
কিন্তু আজ সে গ্রাম দূরে–অনেক দূরে। পরিচিত মুখগুলো মনে পড়ে–পরিচিত মাঠ, নদী, বাগান, খেত এমনকী গাঁয়ের সেই খোঁড়া কুকুরটাকে পর্যন্ত। আর আমাদের চন্ডীমন্ডপ। স্বল্পবিত্ত মুসলমান চাষি আদালতে যেত না, এই চন্ডীমন্ডপেই ভিড় জমাত বিচারের জন্যে। বাড়ির কর্তাকে এরা সবাই বলত ঠাকুরমশাই। এমনকী শিবগঞ্জ, কানসাট, মোহদিপুকুর, দেওয়ানজাগীর লোকেরাও চিনত তাঁকে। গাঁয়ের যেকোনো বিবাদ মেটাতে, আনন্দে উৎসবে আর দুঃখের দিনে–সব সময়ই তিনি থাকতেন গাঁয়ের লোকের পাশাপাশি। আর এই চন্ডীমন্ডপ ছিল গাঁয়ের আদালত।
বছরে গ্রামে একবার করে রটন্তী কালীপুজো হত। সে পুজো হয় মাঘ মাসে। তাতে হিন্দু মুসলমান সবাই যোগ দিত। মুসলমান চাষিদের কাছেও এ সময়টা যেন পরবের।
সারারাত জেগে তারা আলকাপ আর গম্ভীরা গাইত।
গম্ভীরার নাচের তালে তালে উদ্ভাসিত হয়ে উঠত সারাগ্রাম। নানারকম গালগল্প অবলম্বন করে যে গান হয় তাকেই এদেশের লোক ‘আলকাপ’ বলে। দু-পক্ষের বক্তব্য বিনিময় গানের মাধ্যমে। নাট্যরসও থাকে তাতে। হাস্যরসেই এর পরিণতি। বিধবা বিবাহ নিয়ে আলকাপ ব্যঙ্গ গানের একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাক। কন্যাদায়গ্রস্ত স্বামী স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়ে বলছে,
আমার কথা শুনেক বামনী চুপ কর্যা থাক… (টে)
জামাই আনব গাড়ি গাড়ি লাখে-লাখ…(টে)
উত্তরে স্ত্রী বলছে,
ঘরে রাখ্যা কুমারী, উদ্ধার করছ কুড়্যার আড়ি–
মাথাতে জ্বালিয়া তুষের আগুন,
বাহিরে বেড়াইছ পটকা চাল্যা–
অর্থাৎ ঘরে কুমারী মেয়ে, মাথায় তুষের আগুন জ্বলছে, আর তুমি কিনা বিধবা উদ্ধার করার চাল মেরে বেড়াচ্ছ। গানগুলো হয়তো অনেকাংশেই স্থূল আর গ্রাম্য–কিন্তু তবু বাংলার লোকসংস্কৃতির ইতিহাসে এই সব বিলুপ্তপ্রায় আলকাপ আর গম্ভীরা একেবারে মূল্যহীন নয়। সেটেলমেন্টের অফিসারকে দেখে গ্রাম্যলোকের ব্যস্ততা, ভয় আর কিছুটা বিদ্বেষের ছবি কি ফুটে ওঠেনি এই গম্ভীরা গানে?
এ দাদু আয়না দৌড়া চট করা,
এ শালার এমন জরিপ এমন তারিখ
মারল মুলুক জুড়্যা।
আমিন বাবু চেনম্যান লইয়া
ঝনমন করা আইসছে,–
খেত-আলার গড় দেখ্যা র্যাগ্যা
যে লাল হইচ্ছে।
এসব গান এদের মুখে না শুনলে বোঝাই যায় না, তীক্ষ্ণ বিপকে কী করে এরা হাস্যরসে রূপান্তরিত করতে পারে। দেশের মুক্তি আন্দোলনে উদ্দীপনাদানে এবং দেশবাসীর ওপর পাশ্চাত্য শিক্ষার কুপ্রভাবের কঠোর সমালোচনায় গম্ভীরা গানের মুখরতা অবিস্মরণীয়। পল্লিকবি মহম্মদ সুফির রচিত একটি গম্ভীরা গানের নিম্ন পঙক্তি কয়টিতে কী আন্তরিক জ্বালাই না ফুটে উঠেছে! কবি লিখছেন—
(আমরা) বিলাসিতায় বাংলাকে হায়
মাটি করলাম ভাই রে!
(আমরা) ছিলাম বা কী, হলাম বা কী
বাকি কিছুই নাই রে!
(আমরা) দু-পাতা ইংরেজি পড়ে
কৃষি-শিল্প তুচ্ছ করে,
বাপ-দাদাদের ব্যাবসা ছেড়ে–
(পরের) মুখপানে চাই রে!
এসব গান আজ মনে পড়ে–আর গ্রামের ছোটো-বড়ো কত ঘটনাই না সারামনকে ঘিরে ধরে। মনে পড়েছে জহর আলি কাকার কথা। আমাদের বাড়িতে একবার চুরি হয়েছিল। সবাই সন্দেহ করল জহর আলিকে। তিনি তো কেঁদেই অস্থির। তিনি যে নির্দোষ!
আলি কাকা চমৎকার গল্প বলতেন। তাঁর ছেলেবেলায় তাঁর মুখে শোনা গৌড়ের জিনের কাহিনি আজও ভুলিনি। গভীর রাতে গৌড়ের পথ ধরে চলেছে গোরুর গাড়ি। গাড়োয়ান গাইছিল কী একটা গান। হঠাৎ থেমে যেতেই অশরীরী জিন পেছন থেকে শুনতে চাইল পরের লাইন। তারপর কী হল বলতে গিয়ে জহর আলি কাকা গাড়োয়ানের সৌভাগ্যের যে চিত্র এঁকেছিলেন তা ভোলবার নয়।
আর দোস্ত মহম্মদ। ফর্সা জোয়ান ছেলে। কখনো আমাদের জমিতে গোরু-বলদ নামিয়ে ধান খাইয়ে দিত, কখনো আখের জমিতে লুকিয়ে আখ খেয়ে যেত। আমরা গ্রাম ছেড়ে চলে যাব শুনে মস্তবড়ো বাঁশের লাঠি আঙিনায় ঠুকতে ঠুকতে চিৎকার করে বলতে লাগল–কুষ্ঠে যাবে, যে যাবে তার মাথা লিয়ে লিব। ভয়ে বাড়ির সবার মুখ শুকিয়ে এল। দাদা বেরিয়ে এসে হাসতে হাসতে বললেন- কী মহম্মদ তুমি, তুমি আমাদের মারবে?
মহম্মদ চোখ তুলে তাকাতেই পারল না। বাঁশের লাঠিটা ফেলে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল। যেদিন গ্রাম ছেড়ে চলে আসি সেদিন তার সে কী কান্না! আশ্চর্য ছেলে।
গাঁ থেকে মাইল খানেক দূরে শিবগঞ্জ থানা এলাকা–সেখানেই পোস্ট অফিস, ইউনিয়ন বোর্ড, স্কুল সব কিছু। আমাদের কালোপুর গ্রামের চোখে প্রায়-শহর সেটি। সেখান থেকেই প্রথম দাঙ্গার খবর এল। মুসলমান চাষিরা আমাদের যেতে দিতে চায়নি। কিন্তু অগ্নিস্ফুলিঙ্গ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের রাখতে ওরাও আর সাহস পেল না।
সেই গ্রাম আজও কি তেমনি আলকাপের দিনে মেতে ওঠে? গম্ভীরায় আজও কি তেমনি হিন্দু-মুসলমান একযোগে চিৎকার করে গান ধরে- ‘শিব হে, এবার পূজা বুঝি তোমার হইল না, হইল না? ধান উঠলে কি তেমনি হাসে– অনাবৃষ্টি হলে তেমনি কাঁদে।
এদের ছেড়ে আসতে ভারি কষ্ট! আমাদের আসার পথে এদের চোখে যে জল দেখেছি তা কী করে ভুলব। আজ আর সে গাঁয়ে ফেরার পথ নেই। ধান উঠুক, জহর আলির জিন আমাদের ডাকুক, দোস্ত মহম্মদ কাঁদুক, তবু, সেই ‘ছেড়ে আসা গ্রাম থেকে আমরা অনেক দূরেই পড়ে থাকব!