মালতী

মালতী

এক

গোলমালটা প্রথম হল সুনন্দিনীর অফিসে বেরনোর সময়ে।

সুনন্দিনী ফ্ল্যাটের দরজা টেনে লক করতে যাচ্ছিল। এটা গোলমাল? নাকি ভুল? ভুল বলাই উচিত। নিচে অফিসের গাড়ি চলে এসেছে। সুনন্দিনী ছিল তাড়াহুড়োর মধ্যে। বুকের ভিতর ছ্যাঁৎ করে উঠল।

ঘটনার সূত্রপাত সেই সকালে।

এই পরিবারে দিন শুরু হয় বেশি সকালে। রান্নাঘরে মাছ ধুচ্ছিল মালতীর মা। পরপর তিনবার তার মোবাইল বেজেছে। প্রথম দুবার নিচু গলায় কথা বলে ফোন কেটেছে সে। তার কথা শোনা যায়নি। তৃতীয়বার ফোন ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

সুনন্দিনী ছিল বেডরুমে। তার সামনে ল্যাপটপ খোলা। আজ অফিসে প্রেজেন্টেশন রয়েছে। ঠিক মতো পারলে একটা প্রোমোশনের সুযোগ আছে। সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। নইলে আবার সেই খিটখিটে বসের কাছে ধোতে হবে। তাই কদিন ধরেই টেনশন চলছে। ফাইনাল পরীক্ষার মতো। কাল রাতেও শোবার আগে প্রেজেন্টেশনটা নিয়ে পড়েছিল। দুটো গড়বড় ছিল। সেগুলো ঠিক করেছে। আজ শেষ মুহূর্তে ফের চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। ডেটা, চার্ট, প্রজেকশন সব ঠিক হয়েছে তো? মন দিয়ে দেখা দরকার।

সুনন্দিনী মন দিতে পারছে কই? সংসারে চাকুরে মহিলার ডবল ঝামেলা। কাজের জায়গায় ঝামেলা থাকে মাথায়, ঘরের ঝামেলা থাকে হাতে। অফিসে মাথা খাটাতে হয়, ঘরে হাত চালাতে হয়। দুটো ঝামেলা নিয়ে ব্যালান্স করে চলতে কেরামতি লাগে। সুনন্দিনী সেই কেরামতিতে বেশিরভাগ সময়েই ফেল করে।

খানিক আগে বাঁশরি স্কুলে বেরিয়ে গিয়েছে। মেয়ে ক্লাস টেনে উঠলেও বায়নার শেষ নেই। স্কুলে বেরনোর আগে টিফিন নিয়ে রোজ একটা না একটা গোলমাল পাকাবে। সুনন্দিনীর মনে হয়, আসলে মেয়েটা মাকে ইচ্ছে করে জ্বালাতন করে। এই বয়সটা মাকে জ্বালাতন করবার বয়স। আজও করেছে।

‘মা, টিফিনে কী দিয়েছ?’

‘চাওমিন। তোমার ফেভারিট।’

‘চাওমিন অবশ্যই আমার ফেভারিট মা, কিন্তু ঠান্ডা নয়। ঠান্ডা চাও খাওয়া আর ঘাস খাওয়া এক। ঘাস মনে হয় বেটার। যদি একটু গোলমরিচ ছড়িয়ে নেওয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই।

সুনন্দিনী ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তুমি বরং একটা কাজ কর বাঁশরি। আজ আর তোমার টিফিন নিয়ে কাজ নেই। বাড়ি থেকে গোলমরিচের কৌটোটা নিয়ে যাও। স্কুলের লন থেকে ঘাস নিয়ে নিও। যদি চাও সসও নিতে পারো। নেবে?’

বাঁশরি দমবার মেয়ে নয়। সে এক গাল হেসে বলল, ‘খুবই ভালো বলেছ মা। কাল থেকে তাই করব। তবে আজ ঝটাপট কটা প্যান কেক বানিয়ে ফেল দেখি।’

সুনন্দিনী কঠিন গলায় বলল, ‘অনেক বয়স হয়েছে বাঁশরি, এবার নিজের টিফিন নিজে বানাতে শেখো। তোমার বয়েসে আমি রান্না করতাম।’

বাঁশরি ব্যাগে বই গোছাতে গোছাতে বলল, ‘তোমার সময় রান্নার দরকার ছিল মা, আমার সময় দরকার নেই।’ তারপর হাত নেড়ে সুর করে বলল, ‘তোমার ছিল হাতা খুন্তি, আমার আছে অ্যাপ।’

সুনন্দিনী বলল, ‘তাহলে টিফিনের সময় অ্যাপ চিবিয়ে খেও। আমাকে জ্বালাবে না। আজ আমি ব্যস্ত।’

বাঁশরি উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘আমরা মেয়েরা তো তাই চাই। অনলাইনে টকাটক খাবার এনে খাব। মেয়েদের স্কুলে ডেলিভারি বয়দের অ্যালাও করে না বলেই তো যত ঝামেলা। গার্জেনরা যদি সবাই মিলে প্রিন্সিপালকে চিঠি লেখে…প্লিজ অ্যালাও…তোমাদের হ্যাপা যাবে, আমরাও হ্যাপি হব।’

‘চুপ কর, একদম চুপ কর। দেখছ না জরুরি কাজ করছি?’ বাঁশরি হেসে বলল, ‘সেই জন্যই তো বিরক্ত করছি। আমি স্কুলে বেরনোর সময় তোমার জরুরি কাজ আমার পছন্দ নয়।’

সুনন্দিনী মেয়েকে ধমক দিতে দিতে ল্যাপটপ ফেলে উঠে পড়ে। রান্নাঘরে টিফিন বানাতে ঢোকে। হাতের কাজ থেকে নিস্তার নেই।

এরপর অফিসে গেল কৌস্তভ। তার ঝামেলা টিফিন নয়, তার ঝামেলা ‘খুঁজে না পাওয়া’। অফিসে বেরনোর সময় সে কিছুই খুঁজে পাবে না। রুমাল, টাই, মোবাইল, গাড়ির চাবি সব যেন গা ঢাকা দেবে। সুনন্দিনীকে হাতে তুলে দিতে হবে। আজও হয়েছে।

বিরক্ত সুনন্দিনী বলল, ‘একটা দিন কি নিজের কাজটুকু করে নিতে পারো না? আজ আমার কেমন টেনশন বুঝতে পারছ না।’

কৌস্তভ আমতা আমতা করে বলে, ‘সামান্য রুমাল খোঁজা কী আর এমন কঠিন? কিন্তু সেই সময়টুকুই যে থাকে না। জিনিসগুলো লাস্ট মোমেন্টে হারায় কিনা। যদি আগে হারাত ঠিক বের করে ফেলতাম। এখন খুঁজতে গেলে অফিসে লেট হয়ে যায়। তোমার মতো বেলা করে গেলে তো আমার চলবে না।’

সুনন্দিনী বিরক্ত গলায় বলে, ‘কই, আমিও তো অফিসে যাই, কোনওদিন তো বলিনি এটা পাচ্ছি না, ওটা পাচ্ছি না। বলেছি?’

কৌস্তভ হেসে বলে, ‘ডার্লিং, সংসার তোমার। সংসারের জিনিসগুলোও তোমার। তারা তোমার সঙ্গে বিট্রে করবে কেন? বেরনোর সময় ঠিক তোমার হাতের কাছে হাজির হয়।’

সুনন্দিনী বলে, ‘বাজে কথা বল না। তোমার মোবাইল আমার কেন হতে যাবে? এবার থেকে রাতে শোবার সময় পকেটে রুমাল, মোবাইল, গাড়ির চাবি নিয়ে শোবে।’

‘তাই হবে প্রিয়তমা। তোমার আদেশ শিরোধার্য। রাতেই জুতো মোজা, টাই পরে ঘুমোতে যাব। দরকার হলে বেডরুমে না শুয়ে গ্যারাজে গিয়ে গাড়িতে শোব। গাড়ির চাবি হারাবে না। যাই হোক, নন্দিনী, আজ লাঞ্চ করতে বাড়িতে আসছি কিন্তু। অফিসের ক্যান্টিনে তেল মশলা বেশি শুরু করেছে।’

নিউটাউনে ফ্ল্যাট নেবার পর কৌস্তভের অফিস বাড়ির কাছে হয়ে গিয়েছে। সে লাঞ্চের সময় মাঝেমধ্যে চলে আসে। চাবি খুলে ফ্ল্যাটে ঢোকে। হটকেসে খাবার থাকে। গরম করে রেখে যায় সুনন্দিনী। তারপরেও দরকার হলে মাইক্রোতে একবার ঢুকিয়ে নেয়। তবে ঘন ঘন আসতে পারে না। বেশিরভাগ দিনই হয় না। যেদিন হয়, সেদিন সুনন্দিনীকে আগে জানিয়ে রাখে। মুখে বলে না, তবে হাবেভাবে বুঝিয়ে দেয়, মেনুটা যেন একটু ভালো হয়। স্বামী বাড়িতে লাঞ্চ করলে সুনন্দিনী খুশিই হয়। বয়স তো বাড়ছে। বাইরের খাবার রোজ রোজ না খাওয়াই ভালো। তবে আজ খুশি হল না। আজ টেনশনের দিন। আজ তার রান্নার দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই। কিন্তু কী করা যাবে? স্বামীকে তো বলা যায় না, ‘বাড়িতে খেও না। আজ আমার কাজ রয়েছে।’ সে ঘাড় নেড়েছে।

মালতীর মা সকাল সকাল আসে। আজও এসেছে। সে আসায় টেনশন অনেকটা কমেছে সুনন্দিনীর। তার এই ডোমেস্টিক হেল্পারটি ভাল বললে কম বলা হয়, অন্য গৃহিণীদের হিংসে করবার মতো ভালো। কাজের লোক এতো ভালো পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কোনও কাজে ‘না’ নেই, কামাইও করে না। এখানে কোথায় যেন গ্যারাজ ভাড়া করে ছেলেকে নিয়ে থাকে। স্বামী আর মেয়ে রয়ে গিয়েছে দেশেরবাড়ি। স্বামী জনমজুরের কাজ করে। মেয়ে ছোট, বাঁশরির বয়সি। মোবাইলে তার ফোটো দেখিয়েছে সুনন্দিনীকে। বেশ দেখতে। গায়ের রং ফর্সা, ঘাড় পর্যন্ত কোঁকড়ালো চুল, চোখে মুখে টলটলে ভাব।

‘জানেন দিদি, মালতীর মাথায় বুদ্ধি খুব।’

সুনন্দিনী বলে, ‘বুদ্ধি আছে তো লেখাপড়া করালে না কেন?’

মালতীর মা বলল, ‘আমি কী করাব? নিজেই তো করলে না। ক্লাস এইটে উঠে আর স্কুলেই গেলে না। এখন সাজগোজে মন হয়েছে। আমি আপনার কথা ওকে গল্প করেছি। মালতী বলেছে, একবার নিয়ে যেও মাসির সঙ্গে দেখা করব।’ মালতীর মা একটু থেমে হেসে বলল, ‘আপনাকে না চিনেই মাসি ডাকে।’

সুনন্দিনী উৎসাহ দেখিয়ে বলল, ‘বাঃ, খুব ভালো মেয়ে তো তোমার। অবশ্যই ওকে নিয়ে আসবে। একদিন কেন? পাকাপাকিভাবে মেয়েকে এখানে নিয়ে এসে তোমার কাছে রাখ। আমি ওর লেখাপড়ার ব্যবস্থা করব।’

মালতীর মা বলল, ‘তা হবে না। মেয়েকে ওর বাপে ছাড়বে না। আমি বলেছিলাম, রাজি হয়নি। ওখানে ঘর সংসার করবে কে? আমি এসেছি দু’পয়সা রোজগার করতে। ছেলেও সঙ্গে এসেছে কাজ খুঁজতে। তাতেই মালতীর বাপের কত্ত রাগ! আরে বাপু, রাগ করে কী হবে? জনমজুরির কাজে কটা টাকা পাও তুমি? চারটে পেট ভরে না। না খেয়ে মরব নাকি? আমি তো জোর করেই এসেছি। মেয়েকে ছাড়ে না।’

সুনন্দিনী বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এমন করলে কী করে হবে? এই জন্যই তো মেয়েদের এত দুর্দশা। লেখাপড়া শেখবার যোগ্যতা থাকলেও সবাই মিলে আটকে দেয়।

এসব ‘বড়’ কথা মালতীর মা বোঝে বলে মনে হয় না। সে বলে, ‘এবার মেয়ের বিয়ে দেব ভেবেছি।’

সুনন্দিনী আঁতকে ওঠে। বলে, ‘সেকী! এখন? এতো কম বয়েসে বিয়ে দেবে কী! একেবারে বাঁশরির বয়স তো গো। একেবারে এক।’

মালতীর মা হেসে বলল, ‘বাঁশরি দিদিমণি আর মালতীর বয়স এক হলে কী হবে, তারা দুজন তো এক নয় দিদি। বলুন, তারা কি এক?’

সেদিন মনে মনে ধাক্কা খেয়েছিল সুনন্দিনী। কথা বাড়ায় নি। রাতে কৌস্তভকে বলে, ‘কথাটা শুনে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল

কৌস্তভ ম্যাগাজিন উলটোতে উলটোতে বলেছিল, ‘কী এমন কথা যে একেবারে মন খারাপ করে বসলে! এটাই তো নরমাল। পাড়াগাঁয়ে গরিব মেয়েদের তো কম বয়েসেই বিয়ে হয়। ওদের খাওয়াবে কে? তার থেকে বড় কথা পাহারার ব্যাপার থাকে। তুমি বরং একটু সাবধানে থেকো। মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা চেয়ে না বসে। এসব বাড়ির আলোচনার মধ্যে বেশি ঢুকো না। কাঁদুনি গেয়ে রাখল।’ সুনন্দিনী বলল, ‘ছিঃ, এরকম বলছ কেন? মালতীর মা যথেষ্ট ভালো।’ কৌস্তভ হাই তুলে বলেছিল, ‘ভালো বলেই তো চিন্তার। যাক, আলোটা নিভিয়ে কাছে এসো দেখি। অনেকদিন আদর করিনি।’

সুনন্দিনী কঠিন গলায় বলেছিল, ‘না।’

কৌস্তভ গাঢ় স্বরে বলেছিল, ‘আরে বাবা, রাগ করছ কেন? দেখো, শরীরের সঙ্গে মনও ভালো হয়ে যাবে।’

সুনন্দিনী পাশ ফিরতে ফিরতে বলেছিল, ‘আমার ভালো দরকার নেই।’ স্বামীর ওপর রাগ করলেও, তারপর থেকে মালতীর মায়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত কথা এড়িয়েই চলত সুনন্দিনী। গল্প করবার সময়ই বা কই তার? যতই মালতীর মা ভালো মানুষ হোক এবং আরও একজন রান্নার লোক থাকুক না কেন, যাবতীয় তদারকি তো তাকেই করতে হয়। শুধু তো কৌস্তভের মাঝেমধ্যে এসে লাঞ্চ নয়, মেয়েও স্কুল করে বাড়ি ফেরে। চাবি খুলে ফ্ল্যাটে ঢোকে। ঘরে ঢুকে প্রথমেই বাড়িতে রাখা মোবাইল থেকে মাকে ফোন। তারও টিফিনের ব্যবস্থা করে যেতে হয়। ঘরের ড্রেস বের করে রাখতে হয়। হাতের কাছে না পেলে জামা কাপড় ছাড়বেই না। মেয়ে খুব কুঁড়ে হয়েছে। যেদিন টিউশন থাকে কৌস্তভ গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। অফিসে বসেই সুনন্দিনীকে খেয়াল রাখতে হয়, গাড়ি পাঠাতে কৌস্তুভ ভুলে না যায়। একটু দেরি হলেই মেয়ে ফোন করে চেঁচামেচি শুরু করবে।

‘মা, তোমরা কি জানও মিস্ ভট্টরাই নেভার রিপিটস্। কোনো চ্যাপ্টার উনি সেকেন্ড টাইম পড়ান না। একবার যে দেরি করবে সে গেল। ফিনিশ।’

সুনন্দিনী চাপা গলায় বলল, ‘আমাকে বলছিস কেন? বাবাকে বল। আমি তো কাজ করছি।’

‘বাবা ফোন ধরছে না। মনে হয় মিটিঙে।’

সুনন্দিনী বলে,ড্রাইভারকাকুকে ফোন কর।’

‘করেছিলাম। ফোন বলছে, মোবাইল রিচার্জ করা নেই, তাই ওরা লাইন ঢোকাবে না। মা, আমি ক্যাব ডেকে নিচ্ছি।’

টেলিফোনেই আঁতকে ওঠে সুনন্দিনী। কদিন আগেই কাগজে খবর পড়েছে। কবে যেন একা ক্যাবে উঠে একটা মেয়ে বিপদে পড়েছিল। বাঁশরি তো বাচ্চা।

‘নানা, তোমায় ওসব পাকামি করতে হবে না। আমি দেখছি।’

‘পাকামি কেন মা! আমার বন্ধুরা তো অনেকেই ক্যাবে যাতায়াত করে।’

সুনন্দিনী ধমক দিয়ে ওঠে, ‘করুক। তোমাকে যা বলছি তাই করবে।’

‘কী করতে বলছ?’

সুনন্দিনী বলে, ‘ঘরে বস থাক। টিউশন যেতে হবে না।’

‘তুমি কোন যুগে পড়ে আছো মা?’

সুনন্দিনী বলে, ‘যে যুগেই থাকি, তুমি একা কোথাও বেরোবে না। দিনকাল একদম ভালো নয়।’

আরও পাঁচজনের মতো এসব নিয়েই চলতে হয় সুনন্দিনীকে। চলেও সে। আজ মালতীর মা কাজকর্ম সারছিল, ল্যাপটপে হুমড়ি খেয়েছিল সে। একটা চার্টে সামান্য ভুল ছিল। প্রফিট প্রজেকশন গ্রাফ যতটা ওপরে ওঠবার কথা, তার থেকে একটু আগেই থমকেছে। চার্ট ঠিক করে সুনন্দিনী। আর তখনই মালতীর মায়ের কান্না শুনতে পায়।

দুই

ঘটনাটা ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে কোনোরকমে বলবার পর আবার ডুকরে কান্না।

‘আমি চললাম দিদি…আমি চললাম…।’

এতক্ষণ মালতীর মায়ের সমস্যা নিয়ে চিন্তিত হচ্ছিল, এবার সুনন্দিনীর মাথায় বাজ পড়ল। চললাম মানে! কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট মোছা, মাছ ধোয়া সব কাজই তো পড়ে রইল। এক্ষুনি রান্নারমাসি আসবে। তার আবার সবসময় তাড়া। সময় মেপে চলে। হাতের কাছে সব যোগাড় থাকা চাই। এসে রান্নাটুকু সেরে চলে যাবে। এখন কী হবে? সব নিজের হাতে করতে হবে? অসম্ভব। আর একঘণ্টা পরে অফিসের গাড়িও চলে আসবে। সুনন্দিনী মনে মনে ভেবে নিল, মালতীর মাকে আটকাতে হবে। যে করেই হোক খানিকক্ষণের জন্য আটকাতে হবে। যদিও সে যে ঘটনার কথা বলছে, তারপর তাকে আটকানো মুশকিল। তবু চেষ্টা করতে হবে। ঘর পরিষ্কার না হয় বাদ রাখা যায়, কিন্তু বাকিগুলোর কী হবে? কাপড় কাচা? রান্নার যোগাড়? কৌস্তুভ আজ বাড়িতে লাঞ্চ করবে। তার কী হবে? ঠিকমতো সব হাতের কাছে তুলে না দিলে রান্নারমাসি তো বেঁকে বসবে।

সুনন্দিনী নরম গলায় বলল, ‘কোথায় যাবে?

মালতীর মা ফুঁপিয়ে উঠল, ‘কোথায় আবার? বাড়ি যাব। দশটা দশের লোকাল ধরব।’

সুনন্দিনী এগিয়ে গিয়ে মালতীর মায়ের কাঁধে হাত রাখল।

‘দশটা দশের লোকাল ধরলেও তিন, সাড়ে তিন ঘণ্টার আগে তো পৌছোতে পারবে না। তোমার বাড়ি দূর তো কম নয়’

মালতীর মা মাথা নেড়ে বলল, ‘যখনই পৌছোই, এখনই রওনা দেব।’

সুনন্দিনী গলা আরও নরম করে বলল, ‘তুমি এখন গিয়ে কী করবে মালতীর মা? তোমার ছেলেকে বরং পাঠিয়ে দাও, তুমি এখান থেকেই খোঁজ খবর নাও। সেরকম বুঝলে আমার এখানে আজকের দিনটা থেকে যেতে পারো।’

মালতীর মা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘এখানে থেকে যাব! দেশে আমার অত বড় সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে, আর আমি আপনার কাছে থেকে যাব? এ আপনি কেমন কথা বলছেন দিদি!’

সুনন্দিনী লজ্জা পেল। কথাটা এভাবে বলা ঠিক হয়নি।

‘তা বলছি না। বলছি, তুমি একটু শান্ত হয়ে বিকেলের দিকে রওনা হতে পারো। তোমার দাদাকে বললে, সেও এখান থেকে খোঁজ করতে পারে। তার এক পরিচিত ভদ্রলোক পুলিশে চাকরি করেন। তুমি মাথা ঠান্ডা করে বস মালতীর মা, আমি কৌস্তভকে ফোন করছি।’

এবার মালতীর মা ঝাঁঝিয়ে ওঠে। খেপে ওঠে যেন। প্রায় ধমক দেওয়ার ভঙ্গিতে চিৎকার করে বলে, ‘কিচ্ছু করতে হবে না, কাউকে ফোন করতে হবে না। পুলিশ কী করবে? ওরা সব জানে আড়ালে থেকে পুলিশ‍ই তো এসব করায়।’

শান্ত এই মহিলাকে এমন রেগে উঠতে আগে কখনও দেখেনি সুনন্দিনী। খানিকটা ঘাবড়েই যায় যে। তাছাড়া এসব কী বলছে সে! পুলিশ কী করাবে?

মালতীর মা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,’আমি যাচ্ছি দিদি। জানি না ওখানে গিয়ে কী খবর পাব। এক বছরে আমাদের ওদিক থেকে তিনটে মেয়ে উধাও হয়েছে। ওরা লোভ দেখায়। বিয়ের লোভ, টাকা-পয়সার লোভ, নাচ গানের লোভ। যে যেটায় ধরা দেয়। একবার ধরা দিলে বিপদ। দু’মাস আগে একটা মেয়েকে ক্ষেতে পাওয়া গেল। সে নাকি মাঝপথে সব বুঝতে পেরে বেঁকে বসেছিল। তার হাত মুখ বেঁধে…কাপড় ছিঁড়ে…উফ্ মা গো…।’

মুখে দু’হাত চাপা দেয় মালতীর মা। সুনন্দিনী বোঝে, এই মহিলা অনেক দুর পর্যন্ত ভেবে ফেলেছে। ভয়ও পেয়েছে খুব। আর আটকানো যাবে না। তাও সে শেষ চেষ্টা চালায়।

‘ছিছি। এতসব ভাবছ কেন? এরকম কিচ্ছু হবে না। মালতী বুদ্ধিমতী মেয়ে। তাছাড়া আমরা তো রয়েছি। শান্ত হও। তোমার মেয়ে এসব নোংরা লোভে পা দেবে না।’

মালতীর মা বিড়বিড় করে, ‘বাপটার জন্য এই সর্বনাশ হল। আমি কত্তবার বলেছিলাম, মেয়েটাকে নিয়ে যাই, নিয়ে যাই…কিছুতে ছাড়লে না।’

মালতীর মা বেরিয়ে যেতে সুনন্দিনী খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। এবার তার রাগ হচ্ছে। মালতীর মা বাড়াবাড়ি করল। মেয়ে কোথায় বেড়াতে গেছে তার ঠিক নেই, এ অমনি কাজকম্ম ফেলে পালাল। গালও দিচ্ছে সবাইকে। এমনকি সেও বাদ গেল না। তাকেও গলা তুলে কথা বলেছে। না, কৌস্তভ ঠিকই বলে, এদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করতে নেই।

সুনন্দিনী ফোন তুলে দুটো ফোন করল।

প্রথম ফোনটা রান্নারমাসিকে। আসতে বারণ করল। তাকে মাছ কেটে, মশলা রেডি করে, আনাজপাতি সাজিয়ে কে দেবে? সেই ইচ্ছে বা সময় কোনওটাই তার আজ নেই। রান্নাঘর থেকে অর্ধেক ধোওয়া মাছ এনে ডিপ্ ফ্রিজে তুলে রাখল সুনন্দিনী। তারপর দ্বিতীয় ফোনটা করল কৌস্তভকে।

‘কী হয়েছে? এই তো বাড়ি থেকে এলাম।’

সুনন্দিনী বলল, ‘আজ বাড়িতে আসতে হবে না। অফিসে লাঞ্চ করে নিও।’

কৌস্তুভ বলল, ‘কেন? কুক দিদিমণি আসেননি?’

সুনন্দিনী বলল, ‘আমি আসতে বারণ করেছি।’

কৌস্তভ অবাক হয়ে বলল, ‘বারণ করেছ! কেন?’

সুনন্দিনী বলল, ‘মালতীর মা দুম করে চলে গেল।’

কৌস্তভ বলল, ‘সেকি! কোথায় গেল? কাজ ছেড়ে দিল নাকি?’

সুনন্দিনী বলল, ‘না। দেশেরবাড়ি গেল। সেখান থেকে খবর এসেছে, তার কন্যাটি নাকি সকাল থেকে নিখোঁজ।’

কৌস্তভ বলল, ‘নিখোঁজ!’

সুনন্দিনী বলল, ‘ঠিক নিঁখোজ বলি কী করে? তাকে নাকি সকালবেলা সেজেগুজে ট্রেনে উঠতে দেখা গেছে…মালতীর মায়ের ধারণা, তার মেয়ে পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েছে। লোভ দেখিয়ে মেয়েকে নিয়ে গিয়েছে। ওদের ওখানে এরকম নাকি হয়।’

কৌস্তভ বলল, ‘থামো তো, যতসব গল্পকথা। কোন ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে তার ঠিক নেই। এখন এসব পাচার-টাচারের গল্প ফাঁদছে। মেয়ের নষ্টামি ঢাকবার চেষ্টা করছে।’

সুনন্দিনী একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আমারও তাই মনে হয়েছে। মেয়ে তো লেখাপড়া ছেড়ে সাজগোজে মন দিয়েছিল। পাড়ায় কী করে বেড়াত তার ঠিক আছে? তাছাড়া…তাছাড়া মেয়ের মা বড্ড বেশি রিঅ্যাক্ট করল। এমন একটা ভান করছিল যেন ওর মেয়ের উধাও হওয়ার জন্য সবাই দায়ী। ওর বাবা থেকে পুলিশ কাউকে গাল দিতে বাদ দেয়নি। বোঝাতে গেলে আমাকেও প্রায় ধমক দিয়ে উঠল।’

কৌস্তভ বলল, ‘কত টাকা নিয়েছে?’

‘এক মাসের মাইনে। আমি একশো টাকা বেশি দিয়েছি।’

কৌস্তভ বলল, ‘যাক অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। দেখবে দুদিন পর মেয়েকে নিয়ে এসে হাজির হবে। মাথা ভর্তি সিদূর। মেয়ে ভুল করে বিয়ে করে ফেলেছে, তোমার আশীর্বাদ চাই। আসলে উপহার চাই। তুমি আবার তখন গলে গিয়ে হাত উপুড় করে দিও না। যাই হোক, ইনসিডেন্টটা মাথা থেকে এবার ফেলে দাও নন্দিনী। কাজের মাসির মেয়েকে নিয়ে এতো ভাববার সময় কি আমাদের আছে? নাকি আমাদের মানায়?’

স্নান করতে করতে সুনন্দিনী ভেবে দেখল, কৌস্তভ ঠিক বলেছে। সে বেশি ভেবে ফেলেছে। আজ তার কেরিয়ারের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। সব ছেড়ে সেদিকে মন দেওয়ার উচিত। এরকম একটা নিম্নমানের ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামানোটাই ঠিক হয়নি। কোনওদিনই ঠিক নয়। এই ধরনের মেয়ে কার সঙ্গে পালাল না কে ফুঁসলে নিয়ে গেল তাতে তার কী? কাজ করতে হবে সেই ভয়ে বিশ্রী ঘটনাটার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। আরে বাবা, এখন তো আর সেই যুগ নেই। সংসারের কাজ সামলাতে হাজাররকম গ্যাজেট এসে গেছে। বয়েসে ছোট হলেও বাঁশরি ঠিক বলেছে। একদিন রান্না না হলে কী আসে যায়? কিচ্ছু আসে যায় না। ঘরে বসে খাবার আনিয়ে নিতে কতক্ষণ? একটা ফোন। বলে দিলে তেল ঝালও দেবে না। এটা হল টেকনোলজি আর হেলথ কনসাস যুগ। প্রযুক্তি আর স্বাস্থ্য। বাকি সব তুচ্ছ। এতো চিন্তা কীসের? ধ্যুস্। শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়েই মনে মনে নিজের কাঁধ চাপড়াল সুনন্দিনী।

বাথরুম থেকে ঝরঝরে শরীর আর মন নিয়ে বেরল সুনন্দিনী। মালতীর ঘটনা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। তার মনে হচ্ছে, প্রেজেন্টেশন ভালো হবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে নিজেই কয়েকবার আওড়ে নিল কী বলবে। রিহার্সাল। আচ্ছা, শেষটুকু আগে বলে নিলে কেমন হয়? একটা চমক হবে না? প্রফিট মার্জিনের কথাটা শুনলে সকলে নড়ে চড়ে বসবে। নাকি সেটা বাড়াবাড়ি হবে? ধাপে ধাপে এগোনোটাই ভালো? নিচে অফিসের গাড়ি হর্ন দিল। ফ্ল্যাট দোতলায় বলে এই একটা সুবিধে। সুনন্দিনী তাড়াহুড়ো শুরু করল।

গোলমালটা হল ফ্ল্যাট বন্ধ করে বেরোনোর সময়।

গোলমাল ঠিক নয়, ভুল। দরজায় চাবি লাগাতে গিয়ে মনে হল, কে যেন ফিসফিস করে ডাকল, ‘মাসি।’ ফ্ল্যাটের ভিতর থেকেই ডাকল যেন। ছোট মেয়ের গলা। থমকে দাঁড়াল সুনন্দিনী। তার বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। তবে মুহূর্তের থেকেও কম সময়। তারপরই সম্বিত ফিরে পেল সুনন্দিনী। লজ্জা আর রাগ হল তার। একী করছে! কী একটা হাবিজাবি, ভুল শুনল, তাতে একেবারে দাঁড়িয়ে পড়ল! দরজা আটকে, ল্যাপটপের ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নিচে নামতে লাগল সুনন্দিনী।

তিন

প্রেজেন্টেশন খুব ভালো হয়েছে। সবাই অভিনন্দন জানিয়েছে। এমনকি সুনন্দিনীর খিটখিটে বস পর্যন্ত। নিজের ডেস্কে ফিরে সুনন্দিনী আগে ফোন করল কৌস্তভকে।

খবর শুনে কৌস্তুভ বলল, ‘কনগ্রাচুলেশন ডার্লিং, লাভ ইউ।’

সুনন্দিনী চাপা আহ্লাদি গলায় বলল, ‘লাভ ইউ না কচু। বাড়িতে তো বাবা আর মেয়ে জ্বালিয়ে মারো। তোমরা ডিসটার্ব না করলে আরও ভালো হত। অ্যাই, জানও মনে হচ্ছে, প্রোমোশনটা হয়ে যাবে।’

কৌস্তভ নাটুকে গলায় বলল, ‘আমি গর্বিত, আমি উল্লসিত। পত্নীর গর্বে পতির গর্ব, নইলে ফ্যাচাং বাড়ে।’

সুনন্দিনী ঘন গলায় বলল, ‘ইয়ার্কি মেরো না। আজ বাইরে কোথাও ডিনারে যাব। সকালে মেয়েটাকে একটু বকাবকি করেছি।’

কৌস্তভ বলল, ‘বাঃ একটু বকাবকিতেই ডিনার! এবার থেকে আমাকে বেশি বকুনি দিও তো।’

সুনন্দিনী ফিসফিস করে বলল, ‘রাতে দেব। এখন রাখছি।’

কৌস্তভের ফোন কাটতেই আবার সেই ভুল! এবার আর সামনে নয়, পিছনে দাঁড়িয়ে কেউ যেন নিচু গলায় ডাকল। সেই কন্ঠস্বর। অফিসে বেরোনের সময় যেমনটা শুনেছিল। ছোট মেয়ের গলা। মেয়েটা এবার গোটা একটা বাক্য বলেছে।

‘এই যে শুনছ?’

বুকের ভিতর ধক করে উঠল সুনন্দিনীর। চমকে পিছনে তাকাল। না, কেউ নেই। থাকবার কথাও নয়। কিন্তু এ কী হচ্ছে? কেন বারবার এমন ভুল শুনছে? গলাটা কার?

সুনন্দিনী বুঝতে পারল, অল্পের জন্য হলেও তার ভয় করছে। ঘড়ি দেখল। সে কি এখন বাঁশরির স্কুলে চলে যাবে? মেয়ের ছুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? তারপর একবারে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে? মনে মনে নিজেকে ধমক দিল সুনন্দিনী। এসব কী ভাবছে! একটা ভুল নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করছে! ছিছি। কয়েক মিনিট বসে, একটু জল খেল সুনন্দিনী। যে বাস বাঁশরি স্কুলে যায় সেই বাসের ছেলেটাকে ফোন করল। একবার বাজতেই ফোন ধরল ছেলেটা।

‘বলুন ম্যাডাম।’

সুনন্দিনী নিচু গলায় বলল ‘কণাদ, আজ বাস লেট করেনি তো?’

কণাদ বলল, ‘না ম্যাডাম। একেবার টাইমে গাড়ি ঢুকিয়েছি।’

সুনন্দিনী বলল, ‘ভেরি গুড।’

কণাদ বলল, ‘আপনার মেয়ে তো সবার আগে ছুটে স্কুলে ঢুকে গেল।’

সুনন্দিনী বলল, ‘ঠিক আছে। বাঁশরিকে বল না, আমি ফোন করেছিলাম। রাগারাগি করবে।’

কণাদ হেসে বলল, ‘সাবার গার্জেন করে ম্যাডাম। আমি কাউকে বলি না।’

হালকা মনে বসের মিটিঙে গেল সুনন্দিনী।

রাতে শোবার সময় কৌস্তভকে সব বলল সুনন্দিনী। কৌস্তভ বউয়ের নাইটির ফিতে খুলতে খুলতে বলল, ‘তোমার মাথা থেকে সকালের ঘটনা যায়নি নন্দিনী। তাই এসব ভুলভাল শুনছ।’

সুনন্দিনী কাছে স্বামীর কাছে ঘেঁষে এসে বলল, ‘তাই?’

কৌস্তভ সুনন্দিনীর নগ্ন বুকে হাত রেখে বলল, ‘ভালো করে একটা ঘুম দাও, দেখবে কাল একেবারে ফ্রেশ হয়ে গেছ। সকালে সব ঠিক হয়ে যাবে। কোনো কোনো ইনসিডেন্ট মাথা থেকে সহজে যেতে চায় না। হ্যালুশিনেসন হয়ে ফিরে আসে। হ্যালুশিনেসন জানো তো? ভ্রান্তি। তোমারও তাই হয়েছে। অডিটরি হ্যালুশিনেসন। ভুল শুনছ।’

সুনন্দিনী বলল, ‘ভুল শুনছি!’

কৌস্তভ বউয়ের মুখটা দু’হাতে ধরে বলল, ‘অবশ্যই ভুল। তুমি আসলে ওই মালতী মেয়েটা গলা শুনতে পাচ্ছ। অথচ ওর গলা তুমি কখনও শোনোনি। বুঝতেই পারছ, কত বড় ভুল। দেখো, কাল ঠিক হয়ে যাবে। তবে ভালো ঘুমের জন্য ভালো আদর দরকার।’

বরের ‘ভালো আদর’ পেয়েও সুনন্দিনী রাতে বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখল। তার ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নে সে দেখল, বাঁশরি স্কুল থেকে ফিরছে না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে গড়িয়ে রাত, তাও ফিরছে না। কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে ফোন করল সুনন্দিনী। স্কুল থেকে বলল, মালতী তো আজ স্কুলে আসেনি।’

সুনন্দিনী চিৎকার করে বলল, ‘মালতী নয়, বাঁশরি। আমার মেয়ে বাঁশরি আপনারা প্লিজ খোঁজ নিন। প্লিজ…।’

স্কুল থেকে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি ম্যাডাম। আমার খোঁজ নিয়েছি, ক্লাস টেনের মালতী আজ স্কুলে আসেনি।’

ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে উঠে বসল সুনন্দিনী। সে ঘামছে। সকালে সব ঠিক হয়ে যাবে তো?

সকালে সব ঠিক হয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে সুনন্দিনী বুঝতে পারল, তার মনে আর ভয়, ভুল কিছু নেই। দিনের আলোয় সব কেটে গিয়েছে। আবার সব স্বাভাবিক। বাঁশরি যথারীতি টিফিন নিয়ে বায়না শুরু করেছে। কৌস্তভ আজও অফিস যাওয়ার আগে রুমাল, মোজা, টাই হারিয়ে ফেলেছে। ড্রইংরুমের সোফায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিল সুনন্দিনী। টেবিলে পড়ে থাকা খবরের কাগজটা টেনে পাতা ওলটালো আলগোছে। এ পাতা ও পাতার পর, ছয় না সাত নম্বরের পাতায় ছোট একটা খবরে চোখ পড়ল। খবরের হেডিং ‘পাচার করা কিশোরীকে ধর্ষণ ও খুন।’ সুনন্দিনী কাগজ সরিয়ে রাখে। খবর পড়বার সময় নেই তার। মেয়ের স্কুলের টিফিন করতে হবে। বরের রুমাল, টাই খুজে দিতে হবে। নিজেরও আজ অফিসে যাওয়ার তাড়া রয়েছে। প্রোমোশনের অর্ডার হতে পারে। সোফা থেকে উঠে পড়ে সুনন্দিনী। আর তখনই কানের কাছে আবার সেই কণ্ঠস্বর! চাপা ও জড়ানো। গোঙানির মতো। কথা বোঝা যায় না, তারপরেও সুনন্দিনী এবার মেয়েটির গলা চিনতে পারে। তার অনেকদিনের চেনা।

দশটা দশের ট্রেন ধরতে স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে সুনন্দিনী। সে মালতীর মায়ের গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। কিছু করতে যাচ্ছে না, শুধু মালতীর মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *