মালকোষ

মালকোষ

বরদা বলিল, ‘ওস্তাদ কাফি খাঁর সেতার শুনেছ?’

ক্লাবের পাঠাগারে আমরা কয়েকজন নীরবে বসিয়া সাময়িক পত্রিকার পাতা উল্টাইতেছিলাম। অমুল্য পত্রিকা হইতে চোখ তুলিয়া কিছুক্ষণ ভ্রূকুটি করিয়া রহিল, তারপর বলিল, ‘মতলবটা কি? নতুন আষাঢ়ে গল্প তৈরি করেছ, তাই শোনাতে চাও?’

বরদা কর্ণপাত করিল না, গল্প আরম্ভ করিয়া দিল— পূজোর ছুটিতে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম। আমার ছোট শালা শুভেন্দুর ভারি গান বাজনার শখ, একদিন আমাকে বলল—‘জামাইবাবু, ওস্তাদ কাফি খাঁর সেতার শুনতে যাবেন? ওস্তাদজি আমাকে খুব ভালবাসেন; কয়েকদিনের জন্য শহরে এসেছেন, ডাকবাংলোতে আছেন। আমি খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছিলাম; তিনি বললেন, ‘আজ রাত্রে যখন আর কেউ থাকবে না তখন বাজনা শোনাবেন। যাবেন আপনি আমার সঙ্গে?’

নেই কাজ তো খই ভাজ। উচ্চাঙ্গ গান-বাজনার প্রতি আমার বিশেষ আসক্তি নেই; ধ্রুপদ চৌতাল ধামার দশকুশী বুঝি না; রবীন্দ্র-সঙ্গীতেই আমার আত্মা পরিতুষ্ট। কিন্তু বিনা মাশুলে যখন এতবড় একজন ওস্তাদের বাজনা শোনার সুযোগ হয়েছে তখন ছাড়ি কেন। বললাম— ‘আচ্ছা যাব।’

রাত্রি আন্দাজ নটার সময় খাওয়া-দাওয়া সেরে ডাকবাংলোতে উপস্থিত হলাম। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি, পাঁচিল-ঘেরা উঁচু ভিতের বাড়ি, বাড়ির সামনে চার ফুট উঁচু চাতাল। এই চাতালের ওপর আলোয়ান গায়ে দিয়ে একটি বৃদ্ধ বসে আছেন, তাঁর পাশে একটি সেতার শোয়ানো রয়েছে।

পরিষ্কার চাঁদের আলোয় ওস্তাদজিকে দেখলাম। লম্বা একহারা চেহারা, মাথায় পাকা বাব্‌রি চুল, চিবুকে ত্রিকোণ দাড়ি। বয়স অনুমান করা শক্ত, তবে সত্তরের কাছাকাছি। শ্যালক ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করল। ওস্তাদজি স্নিগ্ধ স্বরে বললেন— ‘এস বাবা। সঙ্গে ওটি কে?’

শালা পরিচয় করিয়ে দিল, আমিও হেঁট হয়ে প্রণাম করলাম। ওস্তাদজিকে দেখে তিনি হিন্দু কি মুসলমান এ কথা মনে আসে না। মনে হয় তিনি একটি প্রশান্তচিত্ত সাধক। সাধকের জাত নেই।

শালা জিজ্ঞেস করল— ‘আজ কেউ আসেনি?’

ওস্তাদজি একটু ম্লান হেসে বললেন— ‘এসেছিল কয়েকজন রঈস্ লোক, আধঘণ্টা বাজনা শুনে বাহবা দিতে দিতে চলে গেল।— কেউ কিছু বোঝে না।’

গুণিজনের পক্ষে অরসিকেষু রসস্য নিবেদনম্ কতখানি পীড়াদায়ক তা জানি বলেই নিজের কথা ভেবে মনে মনে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলাম। ওস্তাদজি যাতে আমার অজ্ঞতা ধরতে না পারেন সে বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার।

ওস্তাদজি সেতারের ওপর হাত রেখে শালাকে বললেন— ‘কী শুনতে চাও বল।’

শালা হাত জোড় করে বলল— ‘অনেকদিন আপনার মালকোষ শুনিনি।’

ওস্তাদজি আস্তে আস্তে সেতারটি কোলে তুলে নিলেন, আঙুলের মেরজাপ্‌ পরে তারের ওপর মৃদু স্পর্শ করলেন; তারগুলি রণ্‌রণ্‌ করে উঠল। তারপর তিনি সেতারের কানে মোচড় দিয়ে তারগুলি বেঁধে নিতে নিতে বললেন— ‘এখন হেমন্ত কাল, রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরও আরম্ভ হয়ে গেছে। মালকোষ বাজাবার উপযুক্ত সময় বটে।’

চারিদিকে জ্যোৎস্না ঝিমঝিম করছে; দূর থেকে শহরের যেটুকু শব্দ আসছে তাও যেন দূরত্বের দ্বারা মোলায়েম হয়ে আসছে। ওস্তাদজি যন্ত্র বেঁধে নিয়ে বললেন—‘মালকোষ বাজাচ্ছি। একটা কথা বলে রাখি, যদি কিছু দেখতে পাও ভয় পেয়ো না।’

ওস্তাদজি নিতান্ত সহজভাবেই কথাটা বললেন, কিন্তু আমি সচকিত হয়ে উঠলাম। ওস্তাদজি আমার দিকে চেয়ে বললেন— ‘মালকোষ যদি শুদ্ধভাবে বাজানো যায় তাহলে জিনও আসে। ওরা মালকোষ রাগ শুনতে বড় ভালবাসে।’

জিন্! আরব দেশের দৈত্য বিশেষ। আমি ভূত-প্রেত নিয়ে অনেক নাড়াচাড়া করেছি, কিন্তু জিন্‌ জাতীয় জীবের সঙ্গে কখনো মূলাকাৎ হয়নি। ওরা আরব্য রজনীর কাল্পনিক প্রাণী, এই ধারণাই ছিল। এখন মালকোষ শোনবার জন্যে তারা আসতে পারে এই কথা ভেবে মনটা বেশ উৎসুক হয়ে উঠল।

ওস্তাদজি বাজাতে শুরু করলেন। লক্ষ্য করলাম, তাঁর হাতের আঙুলগুলো লোহার তারের মতো বাঁকা-বাঁকা, কঠিন; কিন্তু সেতারের তারের ওপর তাদের স্পর্শ কি নরম! যেন ফুলের বাগানে মৌমাছি গুঞ্জন করে বেড়াচ্ছে। তিনি প্রথমে খুব ঠায়ে বাজতে শুরু করলেন, তারপর আস্তে আস্তে তালের গতি দ্রুত হতে লাগল। আমি উচ্চসঙ্গীতের সমঝদার নই কিন্তু শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে গেলাম। কে যেন ওই সুরের মধ্যে ডুক্‌রে ডুক্‌রে মাথা কুটে কুটে কাঁদছে, যেন অব্যক্তকণ্ঠে বলছে—হামারি দুখের নাহি ওর—

আমার শালা সত্যিকারের রসজ্ঞ লোক। সে মাথা নাড়ছে না, ঊরুতে তাল ঠুকছে না, ঘাড় নীচু করে স্থির হয়ে বসে আছে। আমিও একটা নিবিড় অনুভূতির মধ্যে ডুবে গেছি। এই ভাবে কতক্ষণ কেটে গিয়েছে জানি না, বোধহয় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট হবে। এক সময় অনুভব করলাম, নাকে একটা গন্ধ আসছে। স্থান কাল বিবেচনায় গন্ধটা স্বাভাবিক নয়।

শুকনো তামাক পাতার কড়া গন্ধ! এতক্ষণ অর্ধনিমীলিত নেত্রে বাজনা শুনছিলাম, এখন চোখ আর একটু খুলে এদিক ওদিক তাকালাম। কই, তামাক পাতা তো কোথাও নেই। ওস্তাদজি ঘাড় গুঁজে বাজিয়ে চলেছেন, শালা নিবাত নিষ্কম্প বসে আছে। অন্য মানুষও কেউ আসেনি। তবে?

হঠাৎ নজর পড়ল চাতালের নীচে মাটির ওপর। বুকটা একবার গুরগুর করে উঠল—

আমি বসেছিলাম চার ফুট উঁচু চাতালের কিনারা ঘেঁষে, নীচে নজর পড়তেই বুঝলাম গন্ধটা কোথা থেকে আসছে। ঠিক চাতালের নীচেই একটা প্রকাণ্ড মানুষ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। চাঁদের আলোয় তার চেহারা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, নিকষের মতো কালো গায়ের রঙ, আট হাত লম্বা তাগড়া শরীর, সর্বাঙ্গে লোহার শলার মতো রোঁয়া খাড়া হয়ে রয়েছে। দুই বাহু দিয়ে মাথাটা বেড়ে নিয়ে দৈত্য পড়ে আছে।

ভূত-প্রেত দেখে ডরিয়ে ওঠার দিন আমার নেই, কিন্তু সাষ্টাঙ্গ প্রণামরত বিরাট দৈত্যটাকে দেখে বুকের রক্ত হিম হয়ে আসতে লাগল। তারপর ঘাড় বেঁকিয়ে দেখি, আমার ঠিক পিছনে আর একটা দৈত্য লম্বা হয়ে শুয়ে মালকোষ শুনছে।

আর একটু হলেই হাউমাউ করে উঠেছিলাম আর কি! অতি কষ্টে সামলে নিলাম। তারপর চোখ বুজে বসে রইলাম। চোখ খুলে তাকাবার সাহস নেই, হয়তো দেখব আরও অনেকগুলি আট হাত লম্বা জিন্ ভূমিষ্ঠ হয়ে মালকোষ শুনছে।

ভাই, আমি নানা জাতের ভূত দেখেছি, কিন্তু ভূতের গা দিয়ে তামাক পাতার গন্ধ বেরোয় এবং তারা উপুড় হয়ে শুয়ে মালকোষ শুনতে ভালবাসে এ কথা জানা ছিল না। আরব্য উপন্যাসেও কিছু লেখেনি। হয়তো আরব দেশের ভূত এমনিই হয়। মালকোষ সুরটা কিন্তু খাঁটি ভারতীয় সুর, তার আদি নাম মল্লকৌষিক।

ওস্তাদজির বাজনা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছে। যেন একটা মর্মন্তুদ বিলাপ ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ল। ওস্তাদজি কিছুক্ষণ সেই ভাবে বসে রইলেন, তারপর আস্তে আস্তে সেতার নামিয়ে রাখলেন।

আমি চোখ বুজে বসে বসে অনুভব করলাম তামাক পাতার গন্ধটা মিলিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকালাম, কাউকে দেখতে পেলাম না। জিনেরা চলে গেছে।

ওস্তাদজি আমার দিকে সপ্রশ্ন চোখে চাইলেন— ‘ওরা এসেছিল নাকি?’

বললাম— ‘এসেছিল।’

তিনি তৃপ্তস্বরে বললেন— ‘আজ বাজানো ভাল হয়েছে; মন বসে গিয়েছিল। তোমরা ভয় পাওনি তো?’

এতক্ষণে শালার ধ্যানভঙ্গ হল। সে পকেট থেকে একটি রুমাল এবং একটি গিনি বার করল; গিনি রুমালের ওপর রেখে রুমাল ওস্তাদজির পায়ের কাছে রাখল। তারপর লম্বা হয়ে তাঁকে প্রণাম করল।

তার ভূমিষ্ঠ প্রণামের ভঙ্গি দেখে মনে হল সেও একটি ছোটখাটো জিন্।

৯ আগস্ট ১৯৬২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *