মার্টিন জনসন : ভ্রমণের জন্যে রাঁধুনি হয়েছিলেন
মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে মার্টিন জনসন পৃথিবী পরিভ্রমণ করেছেন। মার্টিন যখন একটা ছোট্ট ছেলে, তখন পৃথিবীর দূর-দূরান্ত থেকে যে সব বাক্স আসত মার্টিন সেগুলো নিজে খুলতেন। বাক্সের লেবেলের উপরে লেখা রং-বেরঙের দেশের নামগুলো তার মনোযোগ আকর্ষণ করত। তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতেন। ওই সমস্ত দেশে তিনি একসময় গিয়ে সেখানকার ধুলো মাড়াবেনই। অবশেষে সেই ছোট্টবেলায় একদিন বাড়ি ছেড়ে পালালেন জনসন। পায়ে হেঁটে যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি দিলেন এবং একটা জাহাজে করে ইউরোপে এলেন। ইউরোপে এসে যখন যা কাজ পেলেন তাই করতে লাগলেন।
এ অবস্থায় ব্রুসেসে তিনদিন না খেয়ে কাটালেন। ব্রেস্টে এসে গৃহকাতর অন্তরে সুবিশাল আটলান্টিক মহাসাগরের বালুকাবেলায় বসে-বসে একদৃষ্টে নোনা জলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। লন্ডনে তাকে প্যাকিং বাক্সের ভিতর ঘুমাতে হত। তারপরে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে অবশেষে একদিন নিউইয়র্কগামী একটা জাহাজে উঠে লাইফ বোটে লুকিয়ে রইলেন। সেই লুকিয়ে থাকার ঘটানাতেই তার জীবনের সম্পূর্ণ গতিপথের মোড় ঘুরে গেল এবং এক মোহময় দুঃসাহসিতার পথে তার জীবনের যাত্রা শুরু হল। লাইফ বোটে এক ইঞ্জিনিয়ার তাকে একটা পত্রিকা দেখালেন যাতে জ্যাক লন্ডনের লেখা একটা ভ্রমণকাহিনী লিপিবদ্ধ ছিল। জাক লন্ডন লিখেছেন কীভাবে তিনি মাত্র তিরিশ ফুটের একটা নৌকায় করে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে মনস্থ করেছিলেন।
ইনডিপেন্ডেন্সে নিজ বাড়িতে গিয়ে সাথে-সাথে জনসন আট পৃষ্ঠার একটা চিঠি লিখলেন জ্যাক লন্ডনের কাছে। তাতে আবেগময় ভাষায় জ্যাক লন্ডনকে তার পৃথিবী প্রদক্ষিণের সঙ্গী করার জন্য প্রার্থনা জানিয়েছিলেন তিনি। এক জায়গায় লিখলেন, আমি ইতিমধ্যেই বিদেশ ঘুরে এসেছি। শিকাগো থেকে সাড়ে পাঁচ ডলার পকেটে পুরে যাত্রা শুরু করেছিলাম। আর যখন ফিরে এলাম তখনো আমার পকেটে পঁচিশ সেন্ট অবশিষ্ট ছিল।’ চিঠি লেখার পর পুরো দুটো সপ্তাহ তাকে অধীর আগ্রহ ও উৎকণ্ঠায় কাটাতে হল। অবশেষে পেয়ে গেলেন জ্যাক লন্ডনের টেলিগ্রাম। তাতে শুধুমাত্র তিনটি শব্দ লেখা ছিল–“তুমি রাঁধতে পারো? চিন্তায় পড়ে গেলেন জনসন, তিনি যে আসলেই রাঁধতে জানেন না। অবশেষে বুদ্ধি করে টেলিগ্রামের মাধ্যমেই উত্তর পাঠালেন, ‘যাচাই করে দেখুন। টেলিগ্রামটি ডাকে দিয়ে বাড়ি ফেরার পথেই এক রেস্টুরেন্টের রান্না ঘরে বাবুর্চির চাকুরি যোগাড় করলেন তিনি। অবশেষে জ্যাক লন্ডনের সেই ছোট্ট নৌকাটি যখন প্রশান্ত মহাসাগরে পাড়ি জমাল, দেখা গেল মার্টিন জনসন তার একজন অন্যতম আরোহী। তিনি নিয়োজিত হলেন প্রধান বাবুর্চি হিসেবে। তার বাস্তবলব্ধ অভিজ্ঞতার দ্বারা ভালো ভালো ও উন্নতমানের খাবার তৈরি করতে পারতেন। সমুদ্র ভ্রমণকালে প্রয়োজনীয় খাদ্যসম্ভার ক্রয় করার ভার ছিল মার্টিনের উপর। তিনি হিসেব করে দেখলেন যে, যে পরিমাণ লবণ, মরিচ ও মশলা সঙ্গে নিয়েছিলেন তা একটা সাধারণ নাবিক দলের দু’বছর চলে যাবে।
সমুদ্র ভ্রমণকালে জনসন জাহাজ চালাতে শিখে একজন দক্ষ নাবিকে পরিণত হয়ে গেলেন। একদিন বাহাদুরী ফলানোর জন্য তিনি মানচিত্রে জাহাজটির অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার হিসেবে যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে তবুও তিনি নিরুৎসাহী হলেন না এবং তার কৌতূহল ও উৎসাহ নিবৃত করলেন না।
তারপর অনেক বছর কেটে গেল। মার্টিন জনসন সাত সমুদ্র পার হয়ে দক্ষিণ সমুদ্রের প্রবালদ্বীপ থেকে আরম্ভ করে আফ্রিকার গহীন অরণ্য পর্যন্ত সমস্ত জায়গা পরিভ্রমণ করলেন। আমেরিকায় সর্বপ্রথম জনসনই নরখাদকের ছবি প্রদর্শন করেন। তিনি ক্ষুদ্রকায় ও বিরাটকায় মানুষ, জিরাফ, হাতি ও অন্যান্য জীবজন্তু এবং আফ্রিকার জন্য জীবজন্তুর সম্পূর্ণ বন্যজীবনের ছবি তুলেছেন–যেগুলি পরবর্তীতে হাজারো চলচ্চিত্রের পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেছে। শত-শত বিলীন হয়ে যাওয়া বন্যপ্রাণীর যে অদ্ভুত জীবন জনসন সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দি করেছেন তা শতাব্দী ধরে একটা মোক্ষম দলিল হয়ে থাকবে। জনসন হাজার হাজার সিংহের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। কিন্তু মেরেছিলেন সবে দুটো! তিনি বলেছেন যে, আফ্রিকায় শেষ কয়েকটি মাসে অগণিত সিংহ দেখেছিলেন। কিন্তু তিনি একটাও শিকার করেন নি। আসলে তার সঙ্গে কোনো বন্দুকই ছিল না।
ব্যক্তিত্ব অর্জন ও প্রতিভার বিকাশ মার্টিন জনসন বলেছেন, একটি সিংহ যে কোনো দিন মানুষের দ্বারা উত্যক্ত হয় নি। তার যদি ক্ষুধা না থাকে তাহলে মানুষের গন্ধ পেলেও তাকে আক্রমণ করবে না। একবার মোটরগাড়ি চালাতে-চালাতে জনসন পনেরটি সিংহের একটা দলের মাঝখানে পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সিংহগুলো যেখানে ছিল সেখানেই শুয়ে থাকল আর পোষ বেড়ালের মতো পিটপিট করে তাকাতে থাকল। একটা সিংহ তো এগিয়ে এসে তার গাড়ির সামনের চাকার টায়ার চিবানো শুরু করে দিল। আবার এক সিংহীর এত কাছ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেলেন যে সিংহীটা ইচ্ছে করলে থাবা বাড়িয়ে গাড়ি ছুঁতে পারত। কিন্তু সে তার একগাছি গোঁফও নাড়ল না। সিংহ একটা শান্তশিষ্ট জন্তু কিনা সে ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন যে, একটা সিংহকে বিশ্বাস আত্মহত্যার সামিল। একটা সিংহ যে কখন সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে তা আপনি কিছুতেই জানতে পারবেন না, আর পৃথিবীতে একটা আক্রমণোদ্যত সিংহের চেয়ে সাংঘাতিক ও ভয়ঙ্কর আর কিছুই হতে পারে না।
জনসনকে তার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা জানাতে বলায় তিনি বলেছেন যে, তার জীবনের বহু দুর্ঘটনা ঘটেছে তবে সেগুলো খুবই মজার ও রোমাঞ্চকর।
একবার তো তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছিল নরখাদকদের একহাঁড়ি সুরুয়ার মধ্যে। এটা ঘটেছিল যখন তিনি প্রথম একদল নরখাদকের ছবি তুলেছিলেন যা ইতপূর্বে আর কেউ তোলে নি। তখনকার সময়ে শ্বেতাঙ্গরা আফ্রিকার আদিম অধিবাসীদের ধরে এনে দাস হিসেবে বিক্রি করে ব্যবসা করত। তারা হয়ে উঠেছিল শত্রুভাবাপন্ন এবং ক্ষুধার্ত। একদিন তারা মার্টিনের আকৃতি নিরীখ করে ফন্দি আঁটল এ ছোঁকরাকে দিয়ে মজাদার কাবাব বানাবে। তিনি একদিন যখন বুনো সর্দারের সঙ্গে গল্পরত ছিলেন আর উপহার সামগ্রী পেশ করেছিলেন সে সময় একদল নরখাদক এসে তাকে ঘিরে ফেলল। তার সাহায্যকারীরা কেউ কাছে ছিল না। সঙ্গে ছিল মাত্র একটা রিভলভার। কিন্তু তারা ছিল সংখ্যায় শতগুণ। তিনি হতাশ হয়ে জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে, শান্তভাবে কথা বলতে চাইলেন কিন্তু ইতোমধ্যেই চারদিকে ক্ষুধার্ত নরখাদকদের তাণ্ডব নৃত্য শুরু হয়ে গেছে। তারা কল্পনায় চেটেপুটে হবু কাবাবটার আস্বাদ গ্রহণ করছিল। এই প্রথমবারের মতো তিনি ভাবলেন-এসব ভ্রমণ ট্রমন বাদ দিয়ে আগে থেকে বাবার সঙ্গে জুয়েলারি ব্যবসায় নেমে পড়লে নেহাৎ মন্দ হত না। তারপর যেই নরখাদকরা চিৎকার করে ছুটে এসে তাকে ঝাপ্টে ধরতে যাবে তখন একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল। ঠিক তখন অদূরে উপসাগরের তীরে একটা ব্রিটিশপাহারাদার জাহাজ এসে ভিড়ল। নরখাদকরা আশ্চর্যান্বিত হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকল। তখন জনসন আশার আলো দেখতে পেলেন। তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে বুনো সরদারকে বললেন, ওই দেখুন, আমার জাহাজ আমাকে খুঁজতে চলে এসেছে। আপনাদের সবার সঙ্গে মোকাবেলা করে আনন্দিত হলাম। সবাইকে ‘গুডবাই’ জানিয়ে, কেউ তাকে থামবার মতো সাহস সঞ্চয় করার আগেই, ভোঁ দৌড় দিলেন জাহাজের দিকে।