মার্জার পুরাণ
০১. ভাঙা কাঁসর-ঘণ্টা
ছুটি হয় সেই সাড়ে পাঁচটায়।
আজ বড়বাবুকে বলে আধঘণ্টা আগে অফিস থেকে বেরিয়েছে প্রতিভাময়। মিশন রো-র পাশের একটা গলিতে আধা-সরকারি অফিস, যাকে বলা হয় সরকারি সংস্থা বা আন্ডারটেকিং।
বউবাজার-শিয়ালদা পুরনো মোড়ে, ফ্লাইওভারের নীচ ধরে দক্ষিণ বরাবর পিতল-কাঁসার থালাবাসনের দোকান আছে। মানে ছিল। এখনও আছে কিনা বলা কঠিন। ফ্লাইওভার তৈরি হওয়ার পর থেকে ওই অঞ্চলটা তো একেবারে অগম্য হয়ে উঠেছে।
আজ ওই বাসনের দোকানে যাবে বলে প্রতিভাময় আধঘণ্টা আগে থেকে বেরিয়েছে। দুপুরে অফিস থেকে বেরোলেই ভাল হত।
প্রতিভাময় থাকে লবণ হ্রদে। বিকেলে ছুটির পরে অফিস থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে রাজভবনের কাছে গেলেই সল্টলেকে তার আস্তানায় ফেরার জন্যে প্রায় খালি মিনিবাসে ওঠা যায়।
বউবাজারের মোড় থেকেও অবশ্য বেশ কয়েকটা বাস আছে সল্টলেকের। কিন্তু এই সন্ধ্যাবেলায় সেগুলোতে ভয়াবহ ভিড়। উল্টোডাঙার ট্রামে উঠে সেখানে নেমে হেঁটে বা অটোতে যাওয়া যায়। কিন্তু ট্রাম কদাচিৎ মেলে।
কিন্তু এসব ঝামেলা আজ প্রতিভাময়কে সইতেই হবে। যে সমস্যায় সে পড়েছে তার থেকে উদ্ধার পেতেই হবে তাকে।
সমস্যাটা আগেই বলে ফেলা ভাল।
প্রতিভাময় সল্টলেকে জামাইবাবুর বাড়িতে থাকে। দিদি-জামাইবাবু থাকেন জামশেদপুরে।
খালি বাড়ি, দোতলায় তালা। একতলায় খাওয়ার ঘর, বসার ঘর, শোয়ার ঘর, বাথরুম, এই নিয়ে প্রতিভাময়ের বসবাস।
প্রতিভাময়ের বয়েস তিরিশের কাছাকাছি। মোটামুটি ভাল ছেলে। দু-চার জায়গা থেকে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। এ ছাড়া এক জায়গায় ছাড়া ছাড়া ভালবাসার সম্পর্কও আছে, সে মেয়ে খারাপ নয়।
প্রতিভাময়ের মা-বাবা নেই। এখন অভিভাবক বলতে ওই দিদি-জামাইবাবু। তাঁরা পুজোর সময়ে দেশে এলে এ বিষয়ে একটা কিছু পাকাপাকি করবেন, এরকম একটা ক্ষীণ আশা মনে মনে পোষণ করে সে।
কিন্তু প্রতিভাময়ের যে সমস্যা বা ঝামেলার কথা একটু আগে বলেছি, তা কিন্তু তার প্রেম তথা বিবাহঘটিত নয়। সে জাতীয় সমস্যা চিরকালই আছে, ছিল, থাকবে। এই বর্ষার অনিশ্চিত বিকেলে যে সমস্যার জন্যে প্রতিভাময়কে বউবাজারে থালাবাসনের দোকানে যেতে হচ্ছে সেটা খুবই অভিনব এবং জটিলও বটে।
সমস্যাটি আমি যথাসাধ্য সরলভাবে গুছিয়ে বলার চেষ্টা করছি। প্রথমেই বলে নিই, প্রতিভাময়ের সমস্যা হল বেড়াল নিয়ে, বেড়াল তাড়ানো নিয়ে।
প্রতিভাময়ের দিদি চারুশীলা এবং জামাইবাবু ষষ্ঠীচরণ অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই আসছেন। এবার পুজো বেশ আগে আগে। এদিকে বর্ষার মাঝামাঝি হয়ে গেছে। দিদিদের আসার আর বড় জোর মাস দুয়েক বাকি আছে। সেই জন্যেই সমস্যাটা আরও তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে।
যদিও স্বামীর নাম ষষ্ঠীচরণ, আর বেড়াল হল মা ষষ্ঠীর জীব, চারুশীলা কিন্তু দুই চোখে বেড়াল দেখতে পারেন না। বেড়াল দেখলে তার মাথায় রক্ত উঠে যায়, একবার হাতের কাছে কিছু না পেয়ে তিনি হাতের থেকে সোনার কঙ্কন খুলে বেড়ালকে ছুঁড়ে মেরেছিলেন।
সেই দিদি-জামাইবাবু এসে যাচ্ছেন। সময় নেই বললেই চলে। এদিকে চারুশীলার সল্টলেকের বাড়িতে, যে বাড়িতে প্রতিভাময়কে তাঁরা থাকতে দিয়েছেন, বেড়াল গিজগিজ করছে।
চারুশীলা এবং প্রতিভাময়, দুই ভাই-বোনের নামে যেমন মিল নেই, তেমনি অন্যান্য বিষয়েও খুব একটা একাত্মতা নেই।
প্রতিভাময় আন্তরিকভাবে প্রাণীপ্রেমিক। রাস্তার কুকুরদের সে দোকান থেকে বিস্কুট কিনে খাওয়ায়। প্রতিদিন সকালবেলায় ছাদে উঠে আগের রাতের বাসি রুটি টুকরো টুকরো করে ছিটিয়ে দেয় পাড়ার কাকদের। কাকদের এটা অভ্যাস হয়ে গেছে, কোনওদিন সকালবেলায় প্রতিভাময়ের ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলে, তার একতলার শোয়ার ঘরের জানলায় এসে চেঁচামেচি করে।
লবণ হ্রদে এমনিতেই বেড়ালের সংখ্যা খুব বেশি। যতজন অধিবাসী বেড়ালের সংখ্যা তার থেকে কম হবে না। যেকোনও সময় যেকোনও গলির মুখে গেলে দেখা যায় এ বাড়ির বারান্দায় দুটো বেড়াল ঘুরছে, ও বাড়ির সিঁড়িতে একটা বেড়াল ঘুমোচ্ছে। এ বাড়ির দরজা দিয়ে একটা বেড়াল। বেরোচ্ছে, ও বাড়ির জানলা দিয়ে দুটো বেড়াল ঢুকছে।
যারা গাড়ি চালায়, যাদের সংস্কার আছে, গাড়ির সামনে দিয়ে বেড়াল গেলে অমঙ্গল হয়, কাটাকুটি না হলে, অর্থাৎ আরেকটা বেড়াল রাস্তা না পেরোলে কিংবা অন্য একটা গাড়ি চলে না গেলে আর এগোনো যাবে না, তাদের সল্টলেকে খুব ঝামেলা। তাদের স্থির হয়ে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে ঘামতে ঘামতে অনবরত অপেক্ষা করতে হয় পরবর্তী কাটাকুটির জন্যে। কারণ যেকোনও সময় একটা বেড়াল গাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে যাবেই।
ওয়াই-জেড ব্লকের একশো নম্বর বাড়ি হল প্রতিভাময়ের জামাইবাবু ষষ্ঠীচরণের। এই একশো নম্বর বাড়িতে আগে কোনও স্থায়ী বা পোষা বেড়াল ছিল না। তবে বেড়ালের যাতায়াত নেই এমন বাড়ি এ তল্লাটে খুঁজে পাওয়া যাবে না, একশো নম্বর বাড়িও এ বিষয়ে কোনও ব্যতিক্রম নয়।
দিদি-জামাইবাবু এখানে থাকতেই দুয়েকটা বেড়ালের যাতায়াত ছিল একশো নম্বর বাড়িতে। কিন্তু বেড়াল সম্পর্কে চারুশীলার হল দেখ-মার সিসটেম, অর্থাৎ বেড়াল দেখা মাত্র মারো। যাতে চোখে পড়া মাত্র একটুও দেরি না করে বেড়ালকে মারা যায় তার জন্যে ঘরে ঘরে, দেয়ালে দেয়ালে, দরজা-জানলার আনাচে-কানাচে বাঁশের কঞ্চির বন্দোবস্ত রেখেছিলেন চারুশীলা।
বলা বাহুল্য, চারুশীলারা জামশেদপুর চলে যাওয়ার পরে পশুপ্রেমী প্রতিভাময় এতটা কড়াকড়ি করতে পারেনি। বরং, সত্যি কথা বলতে গেলে, বেড়ালগুলোকে একটু প্রশ্রয়ই দিয়েছে।
একশো নম্বর বাড়িটা এখন এ পাড়ার স্ত্রী-বেড়ালদের প্রসূতি সদন। বাইরের ঘরের কোণে, সিঁড়ির নীচে, এমনকী প্রতিভাময়ের বিছানায় পর্যন্ত বেড়ালেরা বাচ্চা দিয়েছে। প্রথম দিকের ছানাগুলো এখন বেশ বড় হয়েছে। আগের ধাড়ি বেড়ালগুলোকে মারধোর করে বাড়ি থেকে তাড়াতে পারলেও এই নবপ্রজন্মের মার্জার শিশু ও যুবকদের হাজার চেষ্টা করেও এখান থেকে বহিষ্কার করা অসম্ভব। কারণ এখানে বাস করা তাদের জন্মগত অধিকার।
এখন এই বেড়ালদের এখান থেকে হটাতে হবে, তা না হলে কেলেংকারি কাণ্ড অবশ্যম্ভাবী। দিদি-জামাইবাবুর এ বাড়ি তো ছাড়তে হবেই, তা ছাড়া দিদি তার বিয়ের জন্যে কোনও উদ্যোগ নেবে না। এদিকে নিজে বিয়ে করার এলেম যে তার নেই সেটা প্রতিভাময় ভাল করেই জানে।
বেড়ালগুলোকে একটা একটা করে থলেতে ভরে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসা যায়। কিন্তু তাতে নাকি কোনও লাভ হবে না। অফিসে তার সহকর্মিণী সুহাসিনী তাকে বলেছে, বেড়াল যেখানেই ছেড়ে দিয়ে আসা হোক, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে একা একাই পথ খুঁজে বাড়ি আসবে। এ কথা অনেকদিন আগেই নাকি শিবরাম চক্রবর্তী তাঁর গল্পে বিশদভাবে বলে গেছেন।
অনেক ভেবেচিন্তে প্রতিভাময় বুঝতে পেরেছে কোথাও ফেলে-টেলে দিয়ে এলে সেটা পণ্ডশ্রম হবে, তার চেয়ে এই বেড়ালগুলোকে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে হবে।
এখন বিবেচনা করতে হয়েছে, বেড়াল কীসে ভয় পায়?
মারধোর করলে বেড়াল কিছুক্ষণের জন্য পালিয়ে যায়, তারপর আবার ফিরে আসে। খাবার বন্ধ করলে অন্য জায়গায় গিয়ে চুরি করে খেয়ে আবার চলে আসে।
অবশ্য বেড়াল তাড়ানো নিয়ে প্রতিভাময় অনিবার্য কারণেই নানারকম চিন্তা করেছে।
এর আগে যখন বরানগরে একটা ভাঙা পুরনো বাড়িতে থাকত, সেখানে প্রতিভাময় একটা ব্যাপার লক্ষ করেছে। এমনিতেই সবাই জানে যে বেড়াল ইঁদুর ধরে, ইঁদুর মারে এবং সত্যি ঘটনাও তাই। কিন্তু বেড়াল ইঁদুরের রাজসংস্করণ ছুঁচোকে খুব ভয় পায়। বরানগরের বাড়ির উঠোনে সে দেখেছে অনেকদিন রাতে বেড়াল ছুঁচোর তাড়া খেয়ে দৌড়ে দেয়াল টপকিয়ে পালাচ্ছে।
তবে ছুঁচো সংগ্রহ করা সহজ নয়। এটা নতুন এলাকা, এদিকে এখনও সে ছুঁচো দেখেনি। এর চেয়েও বড় কথা, বেড়াল তাড়ানোর জন্যে বাড়িতে ছুঁচো নিয়ে আসা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
তবে একটা কথা, বেড়াল কুকুরকে খুব ভয় পায়। কিন্তু বাড়ির মধ্যে কুকুর ঢোকালে সেটাও চারুশীলা বরদাস্ত করবেন না। আর কুকুরছানায় তো হবে না। পোষা বড় কুকুর চাই, তেমন কুকুর কীভাবে পাওয়া যাবে?
অবশ্য এর একটা বিহিত করেছিল প্রতিভাময়। বাজারের মোড়ে গিয়ে একটা ছোট স্লাইস পাউরুটি কিনে সে রাস্তার নেড়ি কুকুরদের মধ্যে অসম বণ্টন করে, বেশ পক্ষপাতিত্ব দেখায়। একে কম দেয় ওকে বেশি দেয়।
ফলে নেড়ি কুকুরদের মধ্যে বেশ একটা হুলুস্থুল ঝগড়া লেগে গিয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ হুটোপাটি, ভৌ-ভৌ, ঘেউ-ঘেউ, কেঁও-কেঁও।
সঙ্গে কাঁধের ঝোলার মধ্যে টেপরেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিল প্রতিভাময়। পাশের চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে চা খেতে খেতে কুকুরদের পুরো ঝগড়াটাই রেকর্ড করে এনেছিল সে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এতে কোনওই কাজ হয়নি। বাসায় এনে সেই টেপটা উচ্চগ্রামে বাজানোর পরে বেড়ালদের মধ্যে কোনও ভাববিকার দেখা যায়নি, শুধু একটা বুড়ো বেড়াল এসে টেপরেকর্ডারটা ঘুরে-ফিরে শুকে দেখেছিল।
বেড়াল তাড়ানোর কোনও উপায় বার করতে না পারায় প্রতিভাময় স্বভাবতই খুব মুড়িয়ে পড়ে। এমন সময় তার মনে পড়ে একটি বাল্যস্মৃতির কথা।
প্রতিভাময়দের দেশের বাড়িতে একটা আধফাটা কাসর-ঘণ্টা ছিল। পুজো-পার্বণে সেই ভাঙা কাসর বাজানোর দায়িত্ব ছিল প্রতিভাময়ের।
তার বেশ মনে আছে, কঁসর-ঘণ্টা বাজানো আরম্ভ করা মাত্র বাড়ির দুটো পোষা বেড়াল লেজ তুলে পালাত। পরে ভাঙা কাসর পালটিয়ে নতুন কাসর-ঘণ্টা কেনার পর কিন্তু কাসরের বাজনা শুনে বেড়াল দুটো আর ভয় পেয়ে পালাত না।
০২. ফাটা কাঁসরের খোঁজে
এ কথা মনে পড়ার পর প্রতিভাময়ের একমাত্র চেষ্টা হল একটা ফাটা কাঁসর-ঘণ্টা সংগ্রহ।
বাসার দোতলায় চারুশীলার পুজোর ঘরে একটা পুরনো কাসর ছিল। সেটা হাতুড়ি পিটিয়ে সে ফাটানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু চারুশীলার শাশুড়ির আমলের জিনিস সেটা, ইসলামপুরের খাঁটি কাঁসার তৈরি। অনেক চেষ্টা করেও সেটা ফাটানো গেল না। শেষে সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে সেটার মধ্যস্থানে হাতুড়ি মারতে সাবেকি জিনিসটা ভেঙে চৌচির হয়ে গেল, একেবারে চার টুকরো। প্রতিভাময় বুঝতে পারল কসর না ভেঙে ফাটানো সোজা কাজ নয়। এখন কথা হল ফাটা কাসর কোথায় পাওয়া যাবে। অনেক ভেবেচিন্তে অফিসে সুহাসিনীকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনাদের বাড়িতে ফাটা কাঁসর-ঘণ্টা আছে?
সুহাসিনী একটু ক্ষুণ্ণ কণ্ঠে বলল, কেন? আমার গলার স্বর শুনে আপনার বুঝি তাই মনে হয়?
রীতিমতো অপ্রস্তুত হয়ে বেড়াল তাড়ানোর কথাটা চেপে গিয়ে প্রতিভাময় বলল, না না। তা নয়। আসলে হয়েছে কি আমাদের পাড়ার একটা তাসা পার্টি আছে। ভাঙা কসর না হলে তাসা পার্টি জমে না। আমি বলেছি, আমি ওদের একটা ভাঙা কাঁসর উপহার দেব।
সুহাসিনী অবাক হয়ে বলল, সে কী? সল্টলেকে তাসা পার্টি।
সুহাসিনীর প্রশ্নবোধক এবং ব্যঞ্জনাময় ভ্রকুঞ্চন দেখে এর পরে আর কথা বাড়ানোর সাহস পায়নি প্রতিভাময়। সাহস করে, পরিচিত আর কারও কাছে ফাটা কাসরের অনুসন্ধানও করেনি।
অবশেষে আজ বড়বাবুর কাছে অফিস শেষ হওয়ার আধঘণ্টা আগে ছুটি নিয়ে প্রতিভাময় রওনা হয়েছে বউবাজার-শিয়ালদার পুরনো মোড়ের দিকে। ওখানে আগে অনেক কাসা-পিতলের বাসনের দোকান ছিল। এখনও নিশ্চয় আছে। সেখানে শুধু বাসন নয়, কাসা-পিতলের সবরকম জিনিস, ফুলদানি, পঞ্চপ্রদীপ, কাঁসর-ঘণ্টা সব কিছুই বিক্রি হয়।
প্রতিভাময় এটাও জানে যে সোনার গয়নার দোকানের মতোই এসব দোকানে কেনা-বেচা দুই-ই হয়। নতুন জিনিস যেমন বেচা হয় তেমনিই পুরনো জিনিস কেনাও হয়।
সেই আশাতেই আজ সে বউবাজারের মোড়ে এসেছে। এত বড় কলকাতা শহর, কেউ কি একটা ফাটা কাসর কোনও দোকানে বেচেনি।
আষাঢ় শেষের কলকাতার বৃষ্টি হুমহুম, বৃষ্টি ঝিরঝিরে, কাদা থিকথিক, কাদা প্যাঁচপ্যাঁচে রাস্তা।
বউবাজার স্ট্রিট দিয়ে যাওয়া যাবে না।
সেখানে ট্র্যাফিক পুলিশ পাবলিকদের ধরে হাঁটি হাঁটি পা-পা শেখাচ্ছে, যে শিখছে না, শিখতে পারছে না তার একশো টাকা ফাইন। দুজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি নাকি টেরিটি বাজারের মুখে ফিরিঙ্গি কালীবাড়িতে হত্যা দিয়ে শুয়ে ছিল, তাদের পা রাস্তায় গিয়ে পড়ায় পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে ওই একশো টাকা জরিমানা করেছে।
ফাটা কাঁসর-ঘণ্টা কিনতে কত লাগবে, কে জানে? তার ওপরে ওই জরিমানার একশো টাকা দেওয়ার ক্ষমতা প্রতিভাময়ের নেই। সে গণেশ অ্যাভিনিউ ধরে, ওয়েলিংটন স্কোয়ার পার হয়ে পুরনো জেলেপাড়া, মুচিপাড়া পার হয়ে ঝমঝমে বৃষ্টিতে ছাতার নীচে কোনওরকমে মাথা বাঁচিয়ে, সারা শরীর ভিজিয়ে অবশেষে প্রথম বড় দোকানটায় ঢুকল।
খাগড়ার খাঁটি কাঁসা ও পিতলের দোকান, কিন্তু দোকানে ঢুকে প্রতিভাময় দেখল এটা একটা স্টেনলেস স্টিলের বাসনের দোকান।
কোনও বাক্যবিনিময় না করে, দোকান থেকে বেরিয়ে প্রতিভাময় বেশ কিছুটা এদিক ওদিক করে একটা ভাঙা-ভোল্লা কাসা-পিতলের দোকান খুঁজে পেল।
বেশ বড় দোকান। মহাত্মা গান্ধীর মতো গোল চশমা, হাফ ধুতি পরা এক স্বাস্থ্যবান বৃদ্ধ একটা মেহগিনি কাঠের শূন্য শো-কেস ভরা বিশাল ঘরে ষাট পাওয়ার বালবের নীচে ছায়াছত্রে বসে আছেন। এই প্রবীণ কংসবণিককে বেচাকেনায় খুব উৎসাহী মনে হল না। প্রতিভাময়ই এগিয়ে গিয়ে তার কাছে তার প্রয়োজনের কথা বলল।
দেখা গেল ভদ্রলোক স্টেনলেস স্টিলের বাসনপত্রের ওপর খুব খাপ্পা। প্রতিভাময়ের অনুসন্ধানের কোনও জবাব না দিয়ে নিজেই প্রশ্ন করলেন, কেন, স্টেনলেসের কাঁসর-ঘণ্টা পেলেন না?
নিজের বিদ্যাবুদ্ধি অনুযায়ী প্রতিভাময় বললে, কাঁসার তৈরি বলেই তো কঁসর-ঘণ্টা। স্টিলের হবে কী করে?
প্রতিভাময়ের জ্ঞান দেখে বৃদ্ধ বেশ খুশি হলেন, বললেন, আজকাল তো কসর-ঘণ্টা বিক্রিবাটা নেই। পিতল-কাঁসার বাসনই বিক্রি হয় না। তবে আমার কাছে একটা কাসর পড়ে আছে। সেটা আপনি নিতে পারেন।
এই বলে বৃদ্ধ দোকানের ভিতরের দিকে মুখ করে, এই সন্ধ্যা, এই সন্ধ্যা বলে চেঁচাতে লাগলেন। মিনিট খানেকের মধ্যেই ঘুম চোখ, আলুলায়িত চুল, আলুথালু হাতকাটা ম্যাক্সি পরা এক ঠিক-কোন বয়েসিবলা কঠিন মহিলা বাসনের আলমারির পেছন থেকে বেরিয়ে এলেন, তার কোলে একটা হৃষ্টপুষ্ট সাদা-কালো বেড়াল।
মহিলাটি এই প্রবীণ কংসবণিকের স্ত্রী না কন্যা না নাতনি নাকি আরও ঘনিষ্ঠতর কেউ সেটা অনুমান করতে না পারলেও প্রতিভাময় এটা বুঝতে পারল এই মার্জারপ্রেমিকার কাছে ভাঙা কাঁসর-ঘণ্টা পিটিয়ে বেড়াল তাড়ানোর কথা বলা যাবে না।
সে যা হোক, বৃদ্ধ মহিলাটিকে বললেন, সেই কাঁসর-ঘণ্টাটা নিয়ে আয় তো।
মহিলাটি বললেন, সেই রায়পুর স্কুলের ঘণ্টাটা?
বৃদ্ধ বললেন, ওই একটাই তো ঘণ্টা দোকানে আছে। তারপর প্রতিভাময়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, রায়পুর স্কুল থেকে এই ঘণ্টাটা বানাতে দিয়ে গিয়েছিল। তা আজ প্রায় দশ বারো বছর। কিন্তু সে স্কুলের হেডমাস্টারের সঙ্গে স্কুল কমিটির হাইকোর্টে মামলা চলছে, শুনেছি স্কুল নাকি উঠে গেছে।
ইতিমধ্যে মহিলাটি দোকানের ভিতর থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে একটা দড়ি ঝোলানো কাঁসর-ঘণ্টা বার করে নিয়ে এসেছে।
প্রতিভাময় কাঁসরটি হাতে নিয়ে দেখল তার নীচের দিকে বড় বড় অক্ষরে খোদাই করা রয়েছে, রায়পুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়
১৯৮০
তার মানে সেই উনিশশো আশি থেকে এই কাঁসরটি পড়ে আছে সতেরো বছর।
খোদাই করা জায়গাটা প্রতিভাময় লক্ষ করছে দেখে বৃদ্ধ বললেন, ও কিছু নয়, যদি চান তো ঘষে তুলে দেওয়া যাবে।
প্রতিভাময় বলল, তা তুলে দিতে হবে। তা ছাড়া কাসরটাকে মধ্য দিয়ে ফাটিয়ে দিতে হবে।
অবাক হয়ে বৃদ্ধ এবং মহিলাটি একসঙ্গে সমস্বরে বললেন, কেন?
মহিলাটির বক্ষলগ্ন বেড়ালটি তখনও আরামে হাই তুলছে। ওই দিকে তাকিয়ে বেড়াল তাড়ানোর কথা চেপে গিয়ে প্রতিভাময় মিথ্যে করে বলল, গত বছর সত্যনারায়ণ পুজোর সময় পাড়ার একটি বাড়ি থেকে একটা কাসর ধার করে এনেছিলাম। সেটা ছিল ফাটা। কী করে যেন সেটা হারিয়ে গেছে। অনেকদিন ঘুরিয়েছি, এবার কাসরটা ফেরত দিতেই হবে।
বৃদ্ধ নির্বিকারভাবে বললেন, ঠিক আছে ফাটিয়ে দিচ্ছি। আপনি আর সন্ধ্যা দুজনে কাসরটার দুদিক ধরুন।
প্রতিভাময় ও সন্ধ্যা দুজনে মুখোমুখি বসে শক্ত করে কাঁসরটা ধরল। ফ্যানের হাওয়ায় সন্ধ্যার এলোচুলের ঝাপটা এসে লাগছে প্রতিভাময়ের মুখে। চুলে কী একটা মেয়েলি তেলের গন্ধ।
বৃদ্ধ একটা দুকেজি বাটখারা হাতে নিয়ে পাঁঠাবলির ভঙ্গিতে নিলডাউন হয়ে বসে বললেন, আমি যেই ওয়ান-টু-থ্রি বলব, দুজনে কাসরটাকে শক্ত করে ধরবেন।
অতঃপর ওয়ান-টু-থ্রি বলে বৃদ্ধ সর্বশক্তি দিয়ে কাসরের মধ্যিখানটায় আঘাত হানলেন। বাটখারার তীব্র আঘাতে কসর থেকে প্রতিভাময়ের হাতটা বেরিয়ে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে ভারী কাসার সেই জিনিসটা শূন্যপানে ছিটকিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার চিবুকে লাগল।
ও মাগো, মরে গেলাম গো, বলে চোখ উলটিয়ে, ভিরমি খেয়ে সন্ধ্যা প্রতিভাময়ের কোলে পড়ে গেল। সন্ধ্যার বেড়ালটা ফাঁচ করে প্রতিভাময়কে আঁচড়িয়ে দিয়ে বাসনের শো-কেসের মাথায় উঠে বসল।
০৩. কাঁসর-ঘণ্টা বাজল ঢং ঢং
সেই যে একটা কথা আছে না, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়।
আজ তাই ঘটল।
বাইরে বৃষ্টির ঝাপটা হঠাৎ খুব বেড়ে যাওয়ায় ঠিক এই মুহূর্তে বাসনের দোকানের মধ্যে এসে যে ঢুকল, সে আর কেউ নয়, সুহাসিনী। তার বাড়ি সোনারপুরে। শেয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে, প্রতিদিন এই পথেই যায়।
আজ এই কাঁসা-পিতলের দোকানে ঢুকে সুহাসিনী যে দৃশ্য দেখল তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ। সে তাড়াতাড়ি দোকানঘর থেকে সসংকোচে বেরিয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় আবিষ্কার করল যে অকুস্থলে বিজড়িত পুরুষমানুষটি তারই পাঁচ বছরের সহকর্মী এবং বন্ধু প্রতিভাময়।
এ অবস্থায় প্রায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও সুহাসিনী বলে বসল, এ কী? এখানে আপনি এইরকমভাবে এসব কী করছেন?
সুহাসিনীকে দেখে, আপাতত কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রতিভাময় এক ঝটকায় সন্ধ্যার বাহুপাশ ছিন্ন করে দরজার পাশে রাখা তার ছাতাটা এক হাতে তুলে নিয়ে অন্য হাতে সুহাসিনীর হাত ধরে দ্রুত রাস্তায় বেরিয়ে এল।
নিজের ছাতার নীচে সুহাসিনীকে টেনে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে পথ চলতে চলতে কোনওকম কিছু ব্যাখ্যা না দিয়ে সে উলটে অনুযোগ করল, আপনাকে বললাম একটা ফাটা কসর জোগাড় করে দিতে, দিলেন না তো।
সুহাসিনী বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, তাই কী হল?
প্রতিভাময় বলল, সেই জন্যেই তো একটা ফাটা কাসর কিনতে এসে আমার এই বিপত্তি।
পুরো ব্যাপারটা সুহাসিনীর কাছে রীতিমতো ধাঁধার মাফিক লাগছে।
কাছেই ক্রিক রো-র একটু আগে একটা পুরনো চায়ের দোকান। এই বৃষ্টির সন্ধ্যায় সেখানে লোজন বেশি নেই। চা খেতে খেতে অতি সংক্ষেপে আধঘণ্টার মধ্যে প্রতিভাময় বেড়াল ও দিদিঘটিত সমস্যা সুহাসিনীকে বোঝাল।
প্রতিভাময় এ কথাও বলল যে দিদি একবার চটে গেলে আমার সল্টলেকের বাড়িতেও থাকা হবে না, বিয়েও হবে না।
সামান্য কয়েকটা বেড়ালের জন্যে বাড়ি ছাড়তে হবে, বিয়ে করতে পারবে না–এসব কথা শুনে সুহাসিনীর মনটা একটু নরম হল। সোনারপুরের মেয়েরা এমনিতেই খুব নরম হয়।
সুহাসিনী প্রতিভাময়কে বলল, আচ্ছা, আপনি যদি জামশেদপুরে গিয়ে আপনার দিদিকে একটু গুছিয়ে বলেন, যদি বোঝাতে পারেন যে সল্টলেকে সব বাড়িতেই বেড়াল গিজগিজ করে।
প্রতিভাময় বলল, আমার সে সাহস নেই। দিদির সামনে বেড়ালের কথা আমি বলতে পারব না।
দুম করে সুহাসিনী বলে বসল, আমি যদি আপনার সঙ্গে যাই?
এর চেয়ে ভাল প্রস্তাব আর কী হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিভাময় রাজি হয়ে গেল।
পরের শনিবার খুব ভোরের ট্রেনে দুজনায় জামশেদপুর। পাঁচ বছর অফিসে পাশাপাশি কাজ করেও যা হয়নি, একবেলার রেল যাত্রায় দুজনের সম্পর্ক আপনি-আজ্ঞে থেকে তুমিতে নেমে এল।
জামশেদপুরে যাওয়ার পর কিন্তু চারুশীলাকে বেড়ালের কথা বলার সুযোগই পাওয়া গেল না। চারুশীলা চিরদিনই একরোখা। সুহাসিনীকে দেখেই চারুশীলা মনস্থির করে ফেললেন, প্রতিভাময়কে বললেন, এ বয়েসে অত বড় খালি বাড়িতে তোমার একলা থাকা ঠিক নয়।
বাড়ি যে মোটেই খালি নয়, বাড়িভর্তি যে বেড়াল, সে কথা বলতে পারল না প্রতিভাময়।
ততক্ষণে সুহাসিনীকে চারুশীলা বলেছেন, কয়েকদিনের মধ্যেই ভাদ্র মাস পড়ে যাবে। তার আগে তোমাদের বিয়েটা সেরে ফেলো। তোমরা কালকেই রেজিস্ট্রি করে নাও।
ঘটনার ও প্রস্তাবের আকস্মিকতায় প্রতিভাময় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। সুহাসিনী ক্ষীণ আপত্তি জানাল, রেজিষ্ট্রি করতে একমাসের নোটিশ লাগবে যে।
চারুশীলা ধমক দিয়ে উঠলেন, নোটিশ, নোটিশের নিকুচি করেছে। বেহারে নোটিশ-ফোটিশ কিছু লাগে না।
বিয়ে হয়ে গেল সুহাসিনী ও প্রতিভাময়ের। এবং এ গল্পও এর পরে টেনে যাওয়া উচিত হবে না। কিন্তু বিড়ালদের ব্যাপারটা এখনও একটু বাকি আছে। সেটুকু না লিখলে চলবে না।
সস্ত্রীক প্রতিভাময়কে দেখে বেড়ালেরা কী বুঝল কে জানে। তবে বেড়ালের আগে কাকেরা পালাল।
সুহাসিনী যে অত কর্কশকণ্ঠী এ কথা ঘুণাক্ষরেও প্রতিভাময় অনুমান করেনি। অল্প দিনের মধ্যেই দাম্পত্য কলহ এমন মাত্রা ধারণ করল যে সকালে রুটির টুকরো খেতে ছাদে যে কাকগুলো আসত, তারা আর আসে না। কোথায় যে চলে গেল, সেগুলোকে আর দেখাই যায় না।
অতঃপর নিঃশব্দে একে একে বেড়ালগুলোও গৃহান্তরী হল। সুহাসিনীর কণ্ঠস্বর শুনলেই তাদের থরহরি কম্প হচ্ছিল।
পুজোর সময় যখন চারুশীলা ও তার স্বামী সল্টলেকের বাসভবনে এলেন, তাঁরা টেরও পেলেন যে এই বাড়িতে দুমাস আগেও বেড়ালদের ডেরা ছিল।
সুহাসিনী ননদকে আদর-যত্ন করে। এবার পুজো চারুশীলারও খুবই আনন্দে কাটল। সুহাসিনীও বুদ্ধিমতী। তার কর্কশকণ্ঠ একবারের জন্যেও বড় ননদের কর্ণগোচর হয়নি। তদুপরি নন্দাইয়ের সঙ্গে হাস্য-পরিহাসে তার দিন শহরের মেঘের মতো হালকা চালে ভেসে চলেছে।
হতভাগ্য প্রতিভাময়। পুরনো বেড়ালগুলো তার জন্যে গলির মোড়ে অপেক্ষা করে। সে গোপনে বাজার থেকে কুচো মাছ কিনে এনে তাদের খাওয়ায়।