ছোটোগল্প
উপন্যাস
অন্যান্য

মার্জারের অপমৃত্যু

মার্জারের অপমৃত্যু (ছোট গল্প)

পশ্চিম মেক্সিকোর বিশাল জলাভূমি সিনেগা গ্র্যান্ডির বুকের উপর দাঁড়িয়ে যে লোক বলতে পারে, আমি একটুও ভয় পাইনি- সে হয় ডাহা অন্ধ আর নয় তো বদ্ধ পাগল।

ডেল লী সাহসী ছেলে কিন্তু সে অন্ধও নয় পাগলও নয়। চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করেই সে বুঝে নিল– জায়গাটা মোটেই সুবিধের নয়, একটু অসাবধান হলেই প্রাণপাখি হঠাৎ খাঁচাছাড়া হতে পারে।

সামনে ঝুঁকে পড়ে ডেল বললে, গাড়ি থামাও।

 ট্রাক থামল।

ডেল লী গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামল, আদেশ করলে, তবু লাগাও।

তাঁবু খাটাবার সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে ট্রাক থেকে নামল দুজন স্থানীয় অধিবাসী এবং একজন শ্বেতাঙ্গ যুবক।

তারা তিনজনেই তাঁবু খাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পকেট থেকে পাইপ বার করে ডেল ধূমপানে মন দিল..

এই বুঝি সিনেগা গ্র্যান্ডি?

ডেল চমকে উঠল। শেতাঙ্গ যুবকটি তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ডেল বললে, হ্যাঁ। এই হল সিনেগা গ্র্যান্ডি মেক্সিকোর বিশাল জলাভূমি। তোমার কেমন লাগছে ক্লে?

ক্লে ভ্রূকুঞ্চিত করলে, জঘন্য! চারদিকে খালি জল আর কাদা, কাদা আর জল। এর মধ্যে এই জায়গাটাই একটু শুকনো। কিন্তু কি মশা! উঃ! একেবারে পাগল করে দিল!

কথাটা সত্যি। ঝাঁকে ঝাকে মশা উড়ছে।

তাদের মিলিত আক্রমণে এর মধ্যেই ক্লে-র কপাল ও মুখ ফুলে উঠেছে। ডেল-এর মুখও অক্ষত নয়, কিন্তু সে সম্পূর্ণ নির্বিকার।

শূন্যে খানিকটা ধোঁয়া উড়িয়ে ডেল পাইপটা নামিয়ে নিল। গম্ভীরভাবে বললে, ট্রাকের ভিতর মশার প্রতিষেধক তেল আছে। ওই তেল মুখে আর হাতে লাগিয়ে নিলে মশার কবল থেকে নিষ্কৃতি পাবে। তবে, যে কাজে এসেছি তাতে কিছুটা সহ্য করতেই হবে। আমরা তো এখানে বনভোজন করতে আসিনি, আমাদের–

ঝপ! ঝপাস!

ডেল-এর বাক্যস্রোতে বাধা দিয়ে অকস্মাৎ জলের বুকে জেগে উঠল এক প্রচণ্ড আলোড়ন-ধ্বনি।

ও কী? ও কিসের শব্দ?

ক্লে চমকে উঠল। কিন্তু সন্ধ্যার আলো আর অন্ধকারের মধ্যে সে জলের উপর কিছুই দেখতে পেল না।

সঙ্গীর মুখের দিকে তাকিয়ে ক্লে প্রশ্ন করলে, ওটা কিসের শব্দ?

ডেল-এর মুখে হাসির রেখা ফুটল, সে কথা বললে না।

ঝপ! ঝপাস!

আবার সেই শব্দ। কিন্তু শব্দটা এবার আসছে জলার অন্য দিক থেকে।

বুঝেছি, ক্লে হেসে উঠল, জায়গাটা দেখছি ভারি চমৎকার!

হ্যাঁ, চমৎকার, একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে ডেল বললে, শুধু কুমির নয়ওই ঘন ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে জলের উপর ছড়িয়ে আছে বিষাক্ত মোকাসিন সাপও।

ক্লে বললে, বাঃ! খুব চমৎকার জায়গায় নিয়ে এসেছ তো! একেবারে যমের দক্ষিণ দুয়ার!

…. হ্যাঁ, যমের দক্ষিণ দুয়ার বটে।

মেক্সিকোর ভাষায় সিনেগা গ্র্যান্ডি কথাটার অর্থ হচ্ছে বিশাল জলাভূমি।

এই বিশাল জলাভূমিকে কেউ যদি যমের দক্ষিণ দুয়ার আখ্যা দেয় তবে বিশেষ ভুল হবে না।

চারদিকে খালি জল আর জল- মাঝে মাঝে কর্দমাক্ত ভূমি– তারপর আবার জল। জলের গভীরতা সব জায়গায় সমান নয়। কোথাও হয়ত এক-মানুষ জল, আবার কোথাও হয়ত হাঁটুও ডোবে না। এই বিশাল জলরাশির ধারে ধারে জল এবং মাটিকে নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেছে অজস্র বুনো লতা ও ঘাসের ঝোঁপ, আর সেই জলজ ঘাস-জঙ্গল ভেদ করে সুর্যের আলো দেখার জন্যে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ছোটো বড়ো বিভিন্ন গাছের সারি।

গাছের ডালে ডালে কলরব করে ভিড় জমিয়েছে নানা জাতের নানা রং-এর পাখি। এই রং-বেরং-এর পাখির ঝাকের দিকে তাকিয়ে কেউ ভাবতে পারবে না যে নীচে ওত পেতে আছে সাক্ষাৎ মৃত্যু। ঘাস-ঝোপের আড়ালে অনেক সময় আত্মগোপন করে শুয়ে থাকে ভয়াবহ কুম্ভীর। এখানকার জলে মাছের অভাব নেই, কিন্তু কুমিরগুলো শুধু মৎস্যভোজী নয়, তারা মাংসাশীও বটে।

যে ছোটো ছোটো হরিণগুলো ডাঙার উপর ঘুরে বেড়ায়, সুযোগ পেলেই হিংস্র সরীসৃপ তাদের ঠ্যাং কামড়ে ধরে জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অধিকাংশ বন্যজন্তু মানুষকে ভয় পায়, এড়িয়ে চলে। কিন্তু এই কুমিরগুলো মৃগমাংসের পরিবর্তে নরমাংস পেলে একটুও আপত্তি করে না।

শুধু কুমির নয় এখানকার জলে-স্থলে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মোকাসিন সর্প। তাদের বিষাক্ত চুম্বন গ্রহণ করলে যে-কোনো মানুষ মৃত্যু বরণ করতে বাধ্য হবে।

এমন চমৎকার স্থানটিকে কেউ যদি যমের দক্ষিণ দুয়ার আখ্যা দেয় তবে তাকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না।

কিন্তু কথা হচ্ছে, পৃথিবীতে অনেক ভালো ভালো জায়গা থাকতে এমন নরকুণ্ডে বেড়াতে আসার দরকার কী?

-হ্যাঁ, দরকার আছে।

পৃথিবীতে এক শ্রেণির লোক আছে যারা জীবনটাকে বাজি রেখে ভাগ্যের সঙ্গে জুয়া খেলতে একটুও ভয় পায় না।

কাছেই সুদূর আরিজোনা থেকে ডেল লী নামধারী মানুষটি যদি পশ্চিম মেক্সিকোর ভয়াবহ জলাভূমির উপর ছুটে আসে তাতে খুব বেশি আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই।

তবে, বিনা প্রয়োজনে কেউ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে চায় না।

ডেল-এর একটা উদ্দেশ্য অছে বইকি। জাগুয়ারের চামড়া সংগ্রহের জন্য সিনেগা গ্রান্ডির ভয়াবহ অঞ্চলে হানা দিয়েছে সে।

এইখানে জাগুয়ার নামক জন্তুটির একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। স্থানীয় অধিবাসীরা বলে El Tigre, কথাটার বাংলা অর্থ– বাঘ।

এই El Tigre বা জাগুয়ার বিড়াল জাতীয় প্রাণী।

তবে, বাঘের চাইতে প্যান্থার বা লেপার্ডের সঙ্গেই তার সাদৃশ্য বেশি। গাঢ় কমলা-হলুদ জমির উপর কালো কালো ছাপ মারা জাগুয়ারের চামড়াটা দেখতে অনেকটা বৈষ্ণবের নামাবলীর মতো।

এই চামড়ার লোভে অনেক সময় দুঃসাহসী শিকারিরা জাগুয়ারের ডেরায় হানা দেয়। তবে El Tigre বা জাগুয়ার মোটেই নিরীহ জন্তু নয়, তাকে হত্যা করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। দেহচর্মের সঙ্গে নামাবলীর যথেষ্ট সাদৃশ্য থাকলেও স্বভাব-চরিত্রে তার সঙ্গে বৈষ্ণবের কোনো মিলই নেই, বরং প্রাচীনপন্থী শাক্তদের মতোই তার প্রকৃতি অতিশয় উগ্র ও ভয়ঙ্কর।

অধিকাংশ বিড়াল-জাতীয় প্রাণী জলে নামতে চায় না। জাগুয়ার সম্বন্ধে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। এই বিপুলবপু মার্জার ঠিক অলিম্পিকের দক্ষ সাঁতারুর মতো সাঁতার কাটতে পারে এবং শিকারিকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যে সে বারংবার জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এমন উদাহরণও নিতান্ত বিরল নয়। এই ধূর্ত জানোয়ার যে শুধু সাঁতারেই দক্ষ তা নয়- গাছে উঠতেও সে সমান পটু। গাছের ডালে ডালে যে-সব বাঁদর ঘুরে বেড়ায় তারাও জাগুয়ারের কবল থেকে রক্ষা পায়না।

অর্থাৎ মেক্সিকোর El Tigre, ডাঙার উপর বাঘের মতোই দ্রুত ছুটতে পারে, জলে সে কুমিরের মতো সাঁতার কাটতে জানে আবার বিড়ালের মতো চটপট গাছে উঠতেও তার বিন্দুমাত্র অসুবিধা নেই।

কর্দমাক্ত জলাভূমির মধ্যে এমন জানোয়ারকে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। তাই শিকারিরা জাগুয়ার মিশরের জন্য শিক্ষিত কুকুরের সাহায্য গ্রহণ করে।

এই কুকুরগুলো গন্ধ শুঁকে অতি সহজেই জাগুয়ারকে আবিষ্কার করতে পারে। সেই সময় জাগুয়ার শক্ত জমির উপর থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং জল থেকে ডাঙায় উঠে আবার ছুটতে থাকে। জলের মধ্যে জাগুয়ারের গায়ের গন্ধ হারিয়ে যায়, তাই অনেক সময় অনুসরণকারী কুকুরের দল বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তবে, সব সময় তার এই কায়দা সফল হয় না। অভিজ্ঞ কুকুর জলে সাঁতরে অপর পারে গিয়ে শিকারের গন্ধ খুঁজে বার করে এবং আবার নতুন করে শুরু হয় অনুসরণ-পর্ব।

পালাবার পথ না থাকলে অথবা খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়লে কখনও কখনও সে গাছের উপর আশ্রয় নেয়। কিন্তু একবার বৃক্ষশাখা অবলম্বন করলে তার আর বাঁচার আশা থাকে না, কারণ গাছের নীচে দাঁড়িয়ে পাহারা দেয় কুকুরের দল এবং তাদের তীব্র চিৎকার শুনে যথাস্থানে এসে উপস্থিত হয় বন্দুকধারী শিকারি। তারপর আর কী? নীচের থেকে গুলি চার্লিয়ে জাগুয়ারাকে হত্যা করা খুবই সহজ।

কিন্তু সব সময়ে এত সহজে সব কিছু হয় না। তাড়া-খাওয়া জাগুয়ার হঠাৎ রুখে দাঁড়িয়ে শত্রুর উপর দাঁত ও নখের ধার পরীক্ষা করতে থাকে। শিকারি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার আগেই কয়েকটি কুকুরকে ধরাশায়ী করে সে গা-ঢাকা দেয়।

শিকারি এসে দেখতে পায় শূন্য রঙ্গমঞ্চে রক্তমাখা দেহ নিয়ে শুয়ে আছে হত ও আহত অভিনেতার দল- নাটকের নায়ক অদৃশ্য।

শুধু কুকুর নয় মাঝে মাঝে কুকুরের মালিকের প্রাণ নিয়েও টানাটানি হয়। ক্ষিপ্ত জাগুয়ার অনেক সময় সারমেয় বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে শিকারির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে : তৎক্ষণাৎ নির্ভুল লক্ষ্যে একেবারে মর্মস্থানে আঘাত করতে না পারলে শিকারির মৃত্যু অনিবার্য কারণ আহত হলেও জাগুয়ার মরণকামড় বসায়, দন্ত ও নখের ভয়াল আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে শত্রুকে; শিকার ও শিকারির প্রাণহীন দেহ একই সঙ্গে মাটির উপর লুটিয়ে পড়ে।

এইসব রক্ত জল করা তথ্য ডেল লী ভালোভাবেই জানত।

সে জাত শিকারি। মৃগয়াকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছে তার পূর্বপুরুষ- ডেল তাদের যোগ্য উত্তরাধিকারী।

ডেল জানত পশ্চিম মেক্সিকোর জলাভূমি সিনেগা গ্রান্ডি জাগুয়ারের প্রিয় বাসস্থান। মার্জারবংশের এই জন্তুটি যে গৃহপালিত বিড়ালের মতো শান্ত ও সুবোধ নয় সে কথাও তার অজানা ছিল না। তবে শিকারের নেশা বড়ো নেশা– সুদূর আরিজোনা থেকে গাড়ি হাঁকিয়ে ডেল ছুটে এল এই কুখ্যাত জলাভূমির নরককুণ্ডে, তার সঙ্গে এল ছোটো ভাই ক্লে লী এবং একদল হাউন্ড জাতীয় কুকুর।

সিনেগা গ্র্যান্ডি অঞ্চলে তাদের গাড়ি যখন এসে থামল তখন সন্ধ্যার ধূসর যবনিকা দিনের আলোকে লুপ্ত করে দিয়েছে। প্রায় অন্ধকার জলাভূমির বুকে মাঝে মাঝে সশব্দ আলোড়ন উঠছে– অভিজ্ঞ মানুষ সেই শব্দ শুনেই বুঝতে পারবে কর্দমাক্ত জলে হানা দিয়ে ফিরছে ভয়াবহ কুমিরের দল।

ক্লে লী সাহসী ছেলে, বন্দুক-রিভলভার ছুঁড়তেও সে ওস্তাদ; কিন্তু বড় ভাইয়ের মতো পাকা শিকারি সে নয়।

ক্লে যখন জানতে পারলে এই জলাভূমিতে অসংখ্য কুমির ও বিষাক্ত সর্প বাস করে তখন সে রীতিমত চমকে উঠল। চমৎকার জায়গা দেখছি– একেবারে যমের দক্ষিণ দুয়ার!

ডেল হেসে বললে, মোটা হান্টিং সুট-এর আবরণ ভেদ করে সাপের দাঁত সহজে তোমার দেহ স্পর্শ করতে পারবে না। আমাদের হাতে থাকবে দু-দুটো রাইফেল, কাজেই ডাঙার উপর কুমিরকে পরোয়া করার দরকার হবে না। আমরা গভীর জলে সাঁতার কাটব না তেমন প্রয়োজন হলে হয়ত হাঁটু জলে নামতে পারি। ওই সময়ে অবশ্য বিপদ ঘটতে পারে, কিন্তু বিপদের ভয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে শিকার করা চলে না। তবে একটা কথা তুমি আমার কাছে শুনে রাখ–সাপ এবং কুমিরের চেয়ে জাগুয়ার অনেক বেশি বিপদজনক জানোয়ার। কোণঠাসা জাগুয়ার যদি তোমায় আক্রমণ করে তাহলে একটিমাত্র গুলিতেই তাকে ঘায়েল করতে হবে দ্বিতীয়বার গুলি ছোঁড়ার সুযোগ তুমি পাবে না। ঘাড়ে অথবা বুকে গুলি চার্লিয়ে যদি তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলতে না পার তাহলে আর তোমার নিস্তার নেই– উন্মত্ত জাগুয়ার তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তোমাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়বে। ভেনেজুয়েলায় শিকার করতে গিয়ে কয়েকজন জাগুয়ার শিকারির দুর্দশা আমি নিজের চোখে দেখেছি। অভিজ্ঞ শিকারিদের কাছে শুনেছি এই অঞ্চলের জাগুয়ারগুলি নাকি আরও হিংস্র, আরও ভয়ংকর।

ডেল-এর কথাটাকে সমর্থন জানিয়ে দুর জলার বুকে এক দানবকণ্ঠে গর্জন উঠল—

 অন্ হা! অন্ হা! অন্ হা!

ডেল অস্ফুটস্বরে বললে, জাগুয়ার!

ক্লে কথা বললে না, শুধু চুপ করে শুনতে লাগল।

সেই কর্কশ ধ্বনি-তরঙ্গ স্তব্ধ হওয়ার আগেই জলার অন্য দিক থেকে ভেসে এল আর এক ভৈরব-কণ্ঠের হুঙ্কার সংগীত।

আর একটা জাগুয়ার।

ডেল ভাইয়ের পিঠে সশব্দে চপেটাঘাত করলে, শুনছ ক্লে, শুনছ? এই জলাটায় অনেকগুলো জাগুয়ার ডেরা বেঁধেছে। আমার ইচ্ছে হচ্ছে এখনই রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।

ক্লে বললে, ইচ্ছেটা এখন মুলতুবি রাখ। কাল সকালে যা হয় করা যাবে।

ডেল হাসল, আরে তা তো বটেই, সত্যি সত্যি কি এই অন্ধকারে জলার মধ্যে পা বাড়াব নাকি? আমি শিকার করতে এসেছি, আত্মহত্যা করতে আসিনি। চল এখন তাঁবুর মধ্যে– চটপট খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়া যাক। কাল সকালে জাগুয়ারের পিছনে ছুটতে হবে।

…অন্ধকারের কালো যবনিকা ভেদ করে উঁকি দিল ঊষার আলোকধারা, গাছে গাছে কলরব করে পাখির দল বন্দনা জানাল সূর্যকে।

দিনের আলোয় জলাভূমিকে খুব বেশি ভয়ানক মনে হল না। জলাশয়গুলিতে কোনো অশুভ বিভীষিকার ইঙ্গিত নেই। বল্লমের ফলার মতো পাতা ছড়িয়ে অদ্ভুত জাতের যে-সব গাছ দাঁড়িয়ে আছে, তাদের উপর থেকে শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিচিত্র বর্ণের বিভিন্ন পক্ষী। সমস্ত পরিবেশ অত্যন্ত শান্ত ও মধুর।

সুর্যের তেজ খুব বেশি প্রখর হওয়ার আগেই শিকারিদের কুকুরগুলো একটা জাগুয়ারকে কোণঠাসা করে ঘিরে ধরলে।

শিকারিরা তার ফোটো তুলল, তারপর দু-দুটো রাইফেল গর্জে উঠতেই জাগুয়ারের প্রাণহীন দেহ মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।

সমস্ত ব্যাপারটা মনে হল ছেলেখেলার মতোই সহজ।

ক্লে বড়ো ভাইকে বিদ্রূপ করে হেসে উঠল, এই নাকি তোমার সাংঘাতিক জানোয়ারের নমুনা? এ তো দেখছি হরিণ-শিকারের মতোই সহজ!

ডেল গম্ভীর স্বরে বললে, দাঁড়াও, এই তো সবে শুরু, এখনও দুপুর হয়নি। রাত্রি পর্যন্ত যদি তোমার মুখের হাসি বজায় থাকে তাহলে বুঝব তুমি বাহাদুর শিকারি। প্রত্যেকবারই যে আমাদের ভাগ্য প্রসন্ন হবে এমন আশা করো না। তাছাড়া এই জন্তুটা স্ত্রী-জাতীয় পুরুষ জাগুয়ার এত সহজে পরাজয় স্বীকার করে না।

ক্লে কোনো মন্তব্য করল না বটে, কিন্তু তার মুখ দেখে মনে হল ভাইয়ের কথা সে বিশ্বাস করতে রাজি নয়।

সারা দুপুরের মধ্যে শিকারিরা আর একটিও জাগুয়ারের সন্ধান পেল না। কুকুরগুলি এদিক সেদিক ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়ল।

ডেল লী তখন এক নতুন কৌশল অবলম্বন করলে। ভেনেজুয়েলায় থাকতে সে জাগুয়ারের শব্দ অনুকরণ করতে শিখেছিল। এবার সেই কায়দাটা সে কাজে লাগাতে চাইল।

একটা ফাঁপা গোরুর শিং-এ মুখ লাগিয়ে ডেল মাটির উপর ঝুঁকে পড়ল। পরমুহূর্তেই তার মুখ থেকে ঠিক জাগুয়ারের গর্জনের মতো আওয়াজ শোনা গেল।

তাঁবুর পিছনে একটা হ্রদের পাশ থেকে তৎক্ষণাৎ দুটো জাগুয়ার গর্জে উঠল। দুর পাহাড়ের নীচে আর-একটা জলাশয়ের বুক থেকে ভেসে এল তৃতীয় কণ্ঠের হুঙ্কারধ্বনি।

নকল জাগুয়ারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে গর্জে উঠেছে তিন-তিনটে আসল জাগুয়ার।

শিকারিরা বুঝতে পারল শব্দ অনুসরণ করে হানা দিলে কাল সকালেই জাগুয়ারের পায়ের দাগ চোখে পড়বে। দিনের আলো প্রায় নিভে এসেছে, এমন সময়ে নেহাৎ মূর্খ এবং উন্মাদ ছাড়া কেউ জাগুয়ারের পিছনে তাড়া করে না। অতএব সকালের জন্য অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের

সকাল হল।

আজকের অভিযানের জন্য শিকারিরা দলের ভিতর থেকে বেছে নিল কয়েকটা হাউন্ড-জাতীয় কুকুর। এই জন্তুগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী এবং শিকারের রক্তাক্ত খেলায় তারা প্রত্যেকেই ওস্তাদ খেলোয়াড়।

দলের অন্যান্য কুকুরগুলিকে তাঁবুর মধ্যে বেঁধে রেখে শুধু বাছাইকরা জন্তুগুলিকে নিয়ে দুই ভাই একটা ছোটো পাহাড়ি নদীর বাঁক ধরে যাত্রা শুরু করলে। তাঁবুর মধ্যে বাঁধা কুকুরগুলো তারস্বরে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাতে লাগল, কিন্তু শিকারিরা তাদের অভিযোগে কর্ণপাত করলে না।

যে কুকুরগুলোকে শিকারিরা সঙ্গে নিয়েছিল তারা হঠাৎ খাঁড়ির জলে নামল। এই জায়গাগুলো বিষাক্ত মোকাসিন সাপের আড্ডা– সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে ক্লে এবং ডেল জলে নেমে পড়ল।

হাঁটু পর্যন্ত জল, কিন্তু খাড়িটা গভীর না হলেও বেশ চওড়া।

খাঁড়ি পার হয়ে কুকুরগুলো হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল। শিকারিরা বুঝল ওরা জাগুয়ারের গন্ধ পেয়েছে। দলের মধ্যে যে কুকুরটার নাম বাদামি চোখ, তাকে সঙ্গে নিয়ে ডেল এগিয়ে গেল।

কুকুরগুলো এখন ভীষণ উত্তেজিত, বারবার টানে মেরে শিকারিদের হাত থেকে শিকল ছিনিয়ে নিতে চাইছে।

বাদামি চোখ হঠাৎ খাঁড়িটাকে পিছনে ফেলে বাঁ দিকে ঘুরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ডেলও সেইদিকে ঘুরল; সে জানত তার কুকুর কখনো ভুল করবে না। ডেল-এর অনুমান নির্ভুল একটু পরেই তারা একটা জাগুয়ারের পায়ের চিহ্ন দেখতে পেল।

ডেল লী ঝানু শিকারি; পদচিহ্ন পরীক্ষা করে দেখে সে বুঝতে পারল এটা একটা পুরুষ জাগুয়ারের পায়ের ছাপ।

ক্লের দিকে তাকিয়ে সে বললে, অন্য কুকুরগুলিকে এখানে নিয়ে এস।

বাদামি চোখ আগেই জাগুয়ারের গায়ের গন্ধ পেয়েছিল।

অন্য কুকুরগুলো এখানে এসেই চঞ্চল হয়ে উঠল। চিৎকার করে, লাফিয়ে তারা গলার শিকল ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম করলে।

শিকারিরা এবার কুকুরগুলোর গলা থেকে শিকল খুলে নিল।

সঙ্গেসঙ্গে জন্তুগুলো খাঁড়ির বাঁক ধরে ছুটতে শুরু করলে।

দুই ভাই বুঝল জাগুয়ার কিছুক্ষণ আগে এখানেই ছিল, কারণ কুকুরগুলো মাথা নিচু করে মাটিতে শত্রুর গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করেনি, শূন্যে মাথা তুলে তারা দ্রুত ছুটে চলেছে। অর্থাৎ এখনো বাতাসে জাগুয়ারের গায়ের গন্ধ লেগে আছে।

ডেল ছোটো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসল, আর বেশিক্ষণ নয়। দশ মিনিটের মধ্যেই ওই ছাপ-মারা বিড়ালটাকে আমরা ধরে ফেলব।

.

..দুর থেকে কুকুরের তীব্র চিৎকার শোনা গেল।

কিছুক্ষণ পরে সেই শব্দ থেমে গেল। শিকারিরা পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলে এই নীরবতার কারণ কী?

আবার শুরু হল ককরের চিৎকার।

 শিকারিরা তখন কাদা আর জঙ্গল ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। হঠাৎ কুকুরগুলির গলার আওয়াজ বদলে গেল। সে কি উৎকট শব্দ! ভাষা দিয়ে সেই বীভৎস স্বর-লহরীর বর্ণনা দেওয়া যায় না- রুদ্ধ আক্রোশের প্রচণ্ড আস্ফালনে যেন কুকুরগুলো সমস্ত দুনিয়াটাকেই ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে।

ডেল চিৎকার করে উঠল, ওরা জাগুয়ারকে ঘিরে ধরেছে! ক্লে, হাঁ করে কী দেখছ? তাড়াতাড়ি চল, তাড়াতাড়ি চল!

কিন্তু তাড়াতাড়ি চল বললেই কি তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়?

বল্লমের ফলার মতো শক্ত গাছের পাতা আর অজস্র গাছের সরু সরু ডালপালা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে আছে। সেই অসংখ্য উদ্ভিদের ব্যুহ ভেদ করে এগিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব বললেই চলে। সবচেয়ে বিশ্রী হচ্ছে ম্যানগ্রোভ গাছের ঝোঁপগুলি। এগুলো বুক পর্যন্ত উঁচু অর্থাৎ উপর দিয়ে ডিঙিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, আবার তলা দিয়ে নিচু হয়ে যাওয়াও সম্ভব না।

ডেল কিন্তু অসাধ্য সাধন করলে।

মাথার উপর রাইফেল তুলে ধরে ঘন উদ্ভিদের বেড়াজাল ছিঁড়ে সে পাগলের মতো শব্দ লক্ষ্য করে ছুটল।

একটা পূর্ণবয়স্ক জাগুয়ার যদি কুকুরের দলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে কুকুরগুলোর কি অবস্থা হতে পারে ডেল তা জানে। তার পোষা জন্তুগুলোর শোচনীয় দুর্দশার কথা কল্পনা করে ডেল মরিয়া হয়ে উঠেছিল।

ভাইকে পিছনে ফেলে, উদ্ভিদের দুর্ভেদ্য ফাঁদ ছিঁড়ে ডেল ছুটল শব্দ লক্ষ্য করে…

ক্লে অতি কষ্টে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। সারমেয় কণ্ঠের হিংস্র গর্জন শুনে সে বুঝতে পারলে লড়াইটা খুব জোর চলছে। কিন্তু শত্রুপক্ষ সম্পূর্ণ নীরব- শুধু মাঝে মাঝে দু-একটা কুকুর তীব্র আর্তনাদ করে জানিয়ে দিচ্ছে, প্রতিপক্ষ নীরব হলেও নিশ্চেষ্ট নয়।

ছপ-ছপ-ছপাস!

হঠাৎ শিকারিদের কানে এল জলের আলোড়নধ্বনি- জাগুয়ার বোধহয় ডাঙা ছেড়ে জলের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে।

মিনিট দশেক বাদে লড়াইয়ের শব্দ অনুসরণ করে ক্লে আর একটা জলাশয়ের ধারে এসে দাঁড়াল। সামনের দিকে তাকিয়ে ডেল তার আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছে এবং কুকুরগুলো হ্রদের তীরবর্তী অগভীর জলে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চিৎকার করছে। তীর থেকে একটু দূরে গভীর জলের দিকে ভেসে যাচ্ছে আর একটা কুকুরের দেহ; তার কাঁধের উপর থেকে উদর অবধি নেমে এসেছে একটা দীর্ঘ রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন।

হ্রদের ঘোলাটে-হলুদ জলের উপর বৃত্তের আকারে ছড়িয়ে পড়ছে লাল রক্তের আলপনা। কুকুরটা দুর্বলভাবে পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটতে চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু তার মাথা এখনই জলের উপর ঝুঁকে পড়েছে।

ব্যাঞ্জো ওটাকে থামাতে চেষ্টা করেছিল, ডেল শান্ত স্বরে বললে, সেইজন্যেই ওর এই দুর্দশা।

হ্রদের অপরদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ডেল আবার বললে, জাগুয়ার ওইদিকে পালিয়েছে।

অন্যান্য কুকুরগুলি তখনও চিৎকার করছে। খুব সম্ভব পলাতক জাগুয়ারকে তারা সারমেয়-ভাষায় গালাগালি দিচ্ছে।

শিকারি দুজন এবার হ্রদের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলে। হ্রদটা যেমন প্রশস্ত তেমনি গভীর। হ্রদের বিপরীত দিকে পৌঁছতে হলে খাড়ি এবং অন্যান্য জলাশয়ের ধার দিয়ে অন্তত ঘন্টাখানেক হাঁটতে হবে। অবসন্ন দেহ মন নিয়ে জাগুয়ারের পিছনে তাড়া করার উৎসাহ শিকারিদের ছিল না। প্রিয় হাউন্ডের মৃত্যুতে দুই ভাই খুব মুষড়ে পড়েছিল।

ডেল-এর দুঃখই বেশি, কারণ ব্যাঞ্জো তার নিজস্ব কুকুর। শিকারের বিপদজনক খেলায় ব্যাঞ্জো ছিল একটি পাকা খেলোয়াড় এবং তার দক্ষতার পিছনে আছে শিকারিদের বহু বৎসরের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ধৈর্যের ইতিহাস। এই ধরনের একটা শিক্ষিত কুকুরের দাম প্রায় ১০০০ ডলার। কিন্তু টাকাটাই একমাত্র প্রশ্ন নয়, প্রায় একশোটা শিকার অভিযানে ব্যাঞ্জো ছিল দুই ভাইয়ের সঙ্গী ও বন্ধু।

সেদিন রাত্রে তাঁবুতে ফিরে ডেল গোরুর শিং-এর শিঙা বার করলে। শিঙাটাকে মাটির খুব কাছে নামিয়ে ধরে শিঙায় মুখ লাগিয়ে ডেল গর্জন করে উঠল।

অবিকল জাগুয়ারের কণ্ঠস্বর।

গম্ভীর হুঙ্কারধ্বনিতে সাড়া এল হ্রদের অপর দিক থেকে, ব্যাঞ্জোর হত্যাকারী এখনও সেখানেই আছে।

আরও দু-একটা জাগুয়ার শিঙার ডাকে সাড়া দিয়ে গর্জে উঠল। কিন্তু ডেল সেদিকে কর্ণপাত করলে না।

হ্রদের উলটো দিকে আছে ব্যাঞ্জোর হত্যাকারী- ডেল চায় শুধু তাকেই।

ডেল এবং ক্লে-র কুকুর-বাহিনীতে ছিল প্রায় কুড়িটা শক্তিশালী হাউন্ড। সমস্ত দলটাকে নিয়ে তারা শিকার অভিযানে যাত্রা করলে। এই বিপুল সারমেয় বাহিনীর কবল থেকে বোধহয় কোনো জাগুয়ারই আত্মরক্ষা করতে পারবে না। উপরন্তু তাদের সঙ্গী হল আরও দু-জন স্থানীয় শিকারি অর্থাৎ আয়োজনের আর কোনো ত্রুটি রইল না।

পূর্ব বার্ণিত খাঁড়ির মধ্য দিয়ে জল, জঙ্গল এবং প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা ভেঙে শুরু হল শিকার অভিযান।

ডেল ভেবেছিল হ্রদটাকে সম্পূর্ণ প্রদক্ষিণ করার আগে পলাতকের সন্ধান পাওয়া যাবে না। কিন্তু প্রায় অর্ধেক পথ যেতে না যেতেই তাদের চোখে পড়ল জাগুয়ারের পায়ের দাগ। ডেল-এর অভিজ্ঞ চক্ষু এক নজরেই বুঝতে পারলে, এই পদচিহ্নের মালিক হচ্ছে ব্যাঞ্জোর হত্যাকারী।

পদচিহ্নের কাছাকাছি এসেই কুকুরগুলো সমস্বরে চিৎকার করে জানিয়ে দিল তারা শিকারের গায়ের গন্ধ পেয়েছে। ডেল তৎক্ষণাৎ কুকুরগুলোর গলার শিকল খুলে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই বিপুল সারমেয় বাহিনী চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। এবারেও দলের নেতৃত্বের ভার নিল বাদামি চোখ নামধারী কুকুরটি– আগের দিনের অভিযানে যে ছিল দলের নেতা।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সারমেয় কণ্ঠের উল্লাসধ্বনি শিকারিদের জানিয়ে দিল, জাগুয়ার আবার কোণঠাসা হয়েছে।

যে-দিক থেকে কুকুরের চিৎকার ভেসে আসছিল শিকারিরা সেইদিক লক্ষ্য করে দ্রুত পা চার্লিয়ে দিল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে শিকারিদের চোখে পড়ল, একটা ছোটো গাছের ডালের উপর গুঁড়ি মেরে জাগুয়ার বসে আছে। মুখব্যাদান করে নীচে পাহারা দিচ্ছে দন্ত-ভয়াল সারমেয়-বাহিনী, অতএব জাগুয়ারের নীচে নামার উপায় নেই।

ক্লে এবং ডেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জন্তুটাকে নিরীক্ষণ করলে।

সঙ্গেসঙ্গে তাদের মুখে ফুটল হতাশার অভিব্যক্তি। স্থানীয় শিকারিদের দিকে তাকিয়ে ডেল নিরাশ স্বরে বললে, এটা আমাদের আসামী নয়। তাছাড়া এটা মাদি জানোয়ার।

জাগুয়ারটার দেহ-সৌষ্ঠব কিন্তু চমৎকার।

কমলা-হলুদ জমির উপর কালো কালো বুটিদার চামড়ায় ঢাকা দেহটি যেন শক্তি ও সৌন্দর্যের আধার।

ক্যামেরা বাগিয়ে ধরে ডেল জন্তুটার ফোটো তুলল। তারপর স্থানীয় শিকারিদের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করলে। একজন শিকারি এগিয়ে এসে গুলি ছুড়ল।

পরক্ষণেই বৃক্ষশাখা থেকে সশব্দে ভূমিপৃষ্ঠে লম্বমান হল জাগুয়ারের প্রাণহীন দেহ।

সেদিন আর উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটল না।

.

দু-দিন পরের কথা।

জলাভূমির শেষ প্রান্তে অবস্থিত পর্বতশ্রেণির নীচে আর একটা জাগুয়ার কুকুর বাহিনীর বেড়াজালে ধরা পড়ে প্রাণ বিসর্জন দিল।

এই জন্তুটা পুরুষ জাতীয়, তবে ব্যাঞ্জোর হত্যাকারী পলাতক জাগুয়ারটার তুলনায় নেহাত বাচ্চা।

পর-পর দুটো জাগুয়ারকে হত্যা করলেও শিকারিরা ব্যাঞ্জোর হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করতে পারলে না। ডেল-এর মাথায় খুন চড়ে গেল। গাড়ি চলার রাস্তা ধরে সে এগিয়ে গেল এবং স্থানীয় অধিবাসীদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে জোগাড় করে ফেলল একটা ভাঙা-চোরা ক্যানো নৌকা।

জলার বুকে এই ক্যানো বেয়ে চলাফেরা করতে খুব সুবিধা। এইসব ছোটো-ছোটো নৌকাতে লগি থাকে না, শুধু একখানা দাঁড়ের সাহায্যে চালাতে হয়।

ডেল স্থির করেছিল এই ক্যানোতে চড়েই তারা পলাতক আসামীকে গ্রেপ্তার করবে।

ফেরার সময়ে ডেল এবং কে মাটিতে পদার্পণ করলে না– ক্যানোটাকে জলার উপর নামিয়ে তাতে উঠে বসল। নৌকাটার অবস্থা অবশ্য খুব ভালো নয়, কিন্তু নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো- অতএব সেই ভাঙাচোরা ক্যানোটায় উঠে একখানা মাত্র বৈঠা সম্বল করে দু-ভাই জলার বুকে ভেসে পড়ল।

.

সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ।

কিন্তু কালো রাত্রির অন্ধকার আজ মানুষের দৃষ্টিকে অন্ধকার করে দিতে পারবে না। কারণ, আকাশের পটভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করেছেন শুভ্রকান্তি চন্দ্রদেব, হ্রদের জলে ছড়িয়ে পড়ছে রুপালি জ্যোৎস্নার আলোকধারা।

এমন চাঁদের আলোতে নৌকার উপর বসে জলবিহার করলে যে-কোনো মানুষেরই গান গাইতে ইচ্ছে করে।

ক্লে গুনগুন করে গান ধরলে।

কিন্তু ডেল একেবারেই কাষ্ঠরসিক– এক ধমকে কে-র গান থামিয়ে দিয়ে সে কাঁধে আটকানো চামড়ার ফিতেটা খুলে ফেলল। পরমুহূর্তেই তার হাতের মুঠোতে দেখা দিল সেই বিখ্যাত গোরুর শিং।

ক্লে আশ্চর্য হয়ে বললে, তুমি কি আবার শিঙা বাজিয়ে জাগুয়ারকে ডাকবে?

ডেল মাথা নেড়ে বললে, আলবৎ! জাগুয়ার যদি কাছাকাছি থাকে তাহলে নিশ্চয় সাড়া দেবে। আমাদের ভাগ্য যদি প্রসন্ন থাকে তাহলে হয়ত জন্তুটা জলার ধারে হাজিরা দিতেও পারে। আজ চমৎকার জ্যোৎস্না আছে- একবার রাইফেলের নাগালের মধ্যে এলে হতভাগা আর পালাতে পারবে না। শয়তানটা আমাদের অনেক ভুগিয়েছে!

ডেল শিঙায় মুখ দিল।

জলার বুকে জাগল জাগুয়ারের গর্জন। সেই নকল গর্জনের প্রতিধ্বনি শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই একটা অকৃত্রিম কণ্ঠের গম্ভীর হুঙ্কার শোনা গেল।

হ্রদের বিপরীত দিক থেকে আসল জাগুয়ার তার অস্তিত্ব ঘোষণা করছে।

বুঝলে ক্লে, ডেল ফিসফিস করে বললে, এটাই আমাদের আসামী। আমি ওর গলার আওয়াজ চিনতে পেরেছি।

ডেল ভুল করেনি, ওই ভাঙা-ভাঙা কর্কশ গর্জিত কণ্ঠ কে-র কাছেও অপরিচিত নয়।

বিগত কয়েকদিনের মধ্যে বহুবার তারা জন্তুটার কণ্ঠস্বর শুনেছে। ক্লে ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে ভাইকে ইঙ্গিত করলে, চুপ করো।

শিঙায় মুখ লাগিয়ে ডেল আবার গর্জন করলে।

এবার খুব কাছ থেকে উত্তর এল।

জাগুয়ারের গর্জন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। কিন্তু তার গলায় আওয়াজ খুব চাপা এবং অস্পষ্ট।

ক্লে সবিস্ময়ে বললে, জস্তুটা বোধহয় জলে নেমে সাঁতার কেটে এগিয়ে আসছে।

ডেল বললে, আমারও তাই মনে হয়। জাগুয়ারের গলার আওয়াজ জলের মধ্যে অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

জলার উপরিভাগে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে দুই শিকারি নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ নৌকার খুব কাছেই একটা গোলাকার বস্তু শিকারিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে।

হ্যাঁ, জাগুয়ার।

সচল গোলাকার বস্তুটি আর কিছু নয়- জাগুয়ারের ভাসমান মুণ্ড। জন্তুটা জলার বুকে সাঁতার কেটে এগিয়ে আসছে শিকারিদের দিকে। চাঁদের আলোয় তার মাথাটা দেখাচ্ছে মস্ত হাঁড়ির মতো। জাগুয়ার আরও কাছে এগিয়ে এল কাছে, কাছে, আরও কাছে…

খুব কাছে এসে পড়েছে জাগুয়ার। তার মুণ্ড ও ভাসমান পৃষ্ঠদেশের উপর কালো কালো ছাপগুলি এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

জাগুয়ার গর্জন করে উঠল– অন্ধকার মুখ-গহ্বরের আড়াল থেকে উঁকি দিল ছুরিকা-শুভ্র করাল দন্তের সারি।

ঠিক সেই চমর মুহূর্তে শিকারিরা তাদের ভুল বুঝতে পারলে।

তাদের সঙ্গে এখন কোনো অস্ত্র নেই।

দুটো রাইফেলই তারা তাবুতে ফেলে এসেছে, এমনকি যে পিস্তলটা সব সময় ডেল-এর কাছে থাকে সেটাকেও সে সঙ্গে আনতে ভুলে গেছে।

মারাত্মক ভুল!

এমন ভুল তাদের কখনো হয় না। কিন্তু আজ তারা শিকারের জন্য প্রস্তুত ছিল না শুধু নৌকাটাকে জোগাড় করার জন্যেই স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে তারা দরবার করতে এসেছিল।

এখন আর কোনো উপায় নেই।

ভরসার মধ্যে আছে ক্লে-র হাতে নৌকার একখানা বৈঠা বা দাঁড়। সেই দাঁড়টাকেই মুগুরের মতো বাগিয়ে ধরে ক্লে প্রস্তুত হল।

নিজের অস্ত্রের উপর ক্লের বিশেষ ভরসা ছিল না। ওই নড়বড়ে কাষ্ঠদণ্ডের আঘাতে জাগুয়ারের মতো বলিষ্ঠ পশুর কী ক্ষতি হবে?

ক্লে-র মনে পড়ল ব্যাঞ্জোর কথা।

জলের উপর ভাসমান অবস্থায় ছটফট করছে একটা আহত কুকুর, তার কাঁধ থেকে পেট পর্যন্ত নেমে এসেছে একটা রক্তাক্ত ক্ষতরেখা।–ব্যাঞ্জো! ক্লে শিউরে উঠল।

জাগুয়ার যদি ক্যানোর উপরে হানা দেয় তবে ভাঙা-চোরা ক্যানো নির্ঘাত উলটে যাবে। জলের মধ্যে ওই বিপুলবপু মার্জারের কবলে পড়লে তাদের দশা হবে ব্যাঞ্জোর মতোই। যে জানোয়ার একটা শক্তিশালী হাউন্ডকে ছিঁড়ে ফেলতে পারে, মানুষ তো তার কাছে নস্যি–

ক্লে শিউরে উঠল।

 জাগুয়ার কিন্তু এখনও তাদের আক্রমণ করছে না। শিকারিদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে কেবল ক্যানোর চারপাশে সাঁতার কেটে চক্রাকারে ঘুরছে আর ঘুরছে চাঁদের আলোয় তার সবুজ চোখ দুটো জ্বলে জ্বলে উঠছে দু-টুকরো মরকত-মণির মতো।

দারুণ আতঙ্কে হঠাৎ ক্লে-র কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে এল তীব্র আর্তধ্বনি। তৎক্ষণাৎ ক্লে-র সঙ্গে গলা মিলেয়ে চিৎকার করে উঠল ডেল।

জ্বলন্ত চক্ষু মেলে জাগুয়ার একবার দু-ভাইকে পর্যবেক্ষণ করলে।

 সে যেন শত্রুদের ভালো করে চিনে নিতে চাইছে।

শুধু কয়েকটি মুহূর্তের জন্য জন্তুটা জলের উপর স্থির হয়ে ভেসে রইল। তারপর খুব নির্লিপ্তভাবে সাঁতার কেটে একবার ক্যানোটাকে প্রদক্ষিণ করে আবার তেমনি অলস মন্থর গতিতে সে হ্রদের দূরবর্তী তীর লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল।

একটু পরেই হ্রদের অপর পারে গাছপালার ছায়ামাখা ঘন অন্ধকারের মধ্যে সেই বিপুলবপু মার্জারের দেহ অদৃশ্য হয়ে গেল।

ক্লে আর একটুও দেরি করল না, প্রাণপণে বৈঠা টেনে সে ক্যানোটাকে তাবুর দিকে চার্লিয়ে দিল…

সেদিন রাত্রে তাঁবুর মধ্যে নৈশভোজের আসরে তর্কের ঝড় উঠল। জাগুয়ারের অদ্ভুত আচরণ কারোরই ভালো লাগেনি। যে জানোয়ার কুম্ভীর-সঙ্কুল জলার বুকে নির্ভয়ে সাঁতার কাটতে পারে এবং মানুষ দেখে যে না পালিয়ে কাছে এগিয়ে আসতে চায়, তাকে এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ- এই হচ্ছে ক্লে-র অভিমত।

স্থানীয় শিকারিরা তাকে সমর্থন করলে।

 শিকারিদের ভোট পেয়ে ক্লে উৎসাহিত হয়ে উঠল।

সে জানিয়ে দিল এই গুণ্ডা জাগুয়ারটার পিছনে তাড়া করার ইচ্ছে তার নেই।

ক্লে-র যুক্তি হচ্ছে, এই বেপরোয়া জন্তুটাকে যখন হাউন্ডগুলো ঘেরাও করবে তখন সে নিশ্চয়ই রুখে দাঁড়াবে সেক্ষেত্রে কয়েকটি মূল্যবান কুকুরের মৃত্যু অবধারিত। এত ঝামেলার দরকার কী? সিনেগা গ্র্যান্ডি অঞ্চলে জাগুয়ারের অভাব নেই- ওই শয়তান জানোয়ারটাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য জাগুয়ারের পিছু নিলে অনেক সহজেই তারা সাফল্য অর্জন করতে পারবে।

ক্লে-র যুক্তি অকাট্য।

স্থানীয় শিকারিরা এবারও ক্লে-র মতে মত দিল।

কিন্তু ডেল নাছোড়বান্দা, কারো কথায় সে কর্ণপাত করতে রাজি নয়; ওই সাঁতার কাটা হুলোবিড়ালটাকে আমি ছাড়ব না, ওকে আমি চাই! তার জন্য যদি সারা শীতকালটা এখানে কাটাতে হয় তাতেও আমার আপত্তি নেই।

ডেল একটু থামল, তারপর রুদ্ধস্বরে বললে, আমি ভুলিনি ব্যাঞ্জো কিভাবে মরেছে!

ক্লে আর তর্ক করলে না। সে বুঝলে ডেলকে নিরস্ত করা অসম্ভব।

পরের দিন সকালে ডেল সেই নড়বড়ে ক্যানোতে চারটে কুকুর নিয়ে হ্রদের অপর পারের উদ্দেশে যাত্রা করলে। এখানে ব্যাট বাধল। হ্রদের জলে যে হাঁসগুলো মনের আনন্দে জলক্রীড়া করছিল তাদের দেখে কুকুরগুলো নৌকার উপর চঞ্চল হয়ে উঠল। এই জন্তুগুলো খুব বড়ো জাতের হাউন্ড; তাদের গুরুভার দেহের নড়বড়ে ক্যানো ডোবে আর কি। প্রতি মুহূর্তে ডেল-এর ভয় করতে লাগল, এই বুঝি সবসুদ্ধ নৌকাটা জলের মধ্যে তলিয়ে যায়।

কোনো রকমে কুকুর সামলে সে ঘর্মাক্ত অবস্থায় অপর পারে পৌঁছল। দুপুরবেলার মধ্যেই ডেল আরও চারটে কুকুরকে হ্রদের অন্য ধারে পাচার করলে।

শোন ক্লে, ডেল বললে, একদল কুকুর নিয়ে আমি ওদের একদিকে থাকব, অন্যধারে আটটা কুকুর নিয়ে তুমি টহল দেবে। জাগুয়ার যে পারেই থাকুক, আমাদের মধ্যে একজন তাকে নির্ঘাত ধরে ফেলবে। যদি শয়তানটা জলে নামে তাহলেও তার নিস্তার নেই। এতগুলো শক্তিশালী হাউন্ডকে ফাঁকি দিয়ে জাগুয়ার পালাতে পারবে না।

হ্রদের দু-ধারে তাবু খাঁটিয়ে শিকারিরা সেদিন অপেক্ষা করলে।

অভিযান শুরু হল পরের দিন সকালে।

 নাঃ, সকাল ঠিক নয়, বরং শেষ রাত্রি বলা চলে।

ডেল যখন তার শিঙা নিয়ে হ্রদের ধারে এসে দাঁড়াল তখনও আকাশে সূর্যদেব আত্মপ্রকাশ করেননি। তবে অন্ধকার প্রায় দূর হয়ে এসেছে, ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই।

ডেল তার শিঙায় মুখ দিলে, শেষ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ঘন ঘন বেজে উঠল নকল জাগুয়ারের নকল গর্জন।

গভীর গর্জন-ধ্বনির সঙ্গে ভাঙা ভাঙা কাসির শব্দে জাগুয়ার সাড়া দিল। আওয়াজ এল ডেল-এর উলটো দিক থেকে

অর্থাৎ হ্রদের যেদিকে ক্লে আছে জাগুয়ারটাও সেদিকের তীরেই আশ্রয় নিয়েছে। কয়েকটা হাউন্ডকে ছেড়ে দিয়ে ক্লে সাগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগল।

ক্লে-র সারমেয়-বাহিনীতে যে কুকুরটা নেতৃত্ব করছিল সে হঠাৎ চিৎকার করে জানিয়ে দিল জাগুয়ারের চলাচলের রাস্তা তার অজানা নেই।

ক্লে আর দেরি করলে না, সব কুকুরগুলিকেই ছেড়ে দিল। ঝোঁপঝাড় ভেঙে কুকুরের দল তিরবেগে ছুটল। তাদের পিছু পিছু ছুটল ক্লে এবং তার সঙ্গী দু-জন স্থানীয় শিকারি।

ছুট! ছুট! ছুট!

হ্রদের পাশ দিয়ে চলে গেছে কতগুলো ছোটো-ছোটো পাহাড়ি নদী। সেই নদীগুলোর বাঁকের উপর দিয়ে শিকার তাড়িয়ে ছুটল কুকুরের দল।

জঙ্গল ভেঙে, কাদা মাড়িয়ে, খাঁড়ির অগভীর জলে ঢেউ তুলে শিকারিরা ঊর্ধ্বশ্বাসে কুকুরের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে।

দারুণ উত্তেজনায় সাপ আর কুমিরের কথা তারা খেয়ালই করলে না। সারমেয় কণ্ঠের তীব্র উল্লাসধ্বনি শুনে অভিজ্ঞ শিকারিরা বুঝতে পারল জাগুয়ার আর অদৃশ্য নেই, কুকুরগুলি তাকে দেখতে পেয়েছে…

ক্লে জাগুয়ারকে দেখতে পেল, তবু গুলি চালাবার সুযোগ হল না। কুকুরগুলি এখন তাকে ঘিরে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু জাগুয়ার কিছুতেই এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছে না সে ছুটছে আর লড়াই করছে, লড়াই করছে আর ছুটছে।

কুকুরগুলি যখনই খুব কাছে এসে পড়ে তখনই জাগুয়ার থমকে দাঁড়ায়; তার পেশিবহুল দেহ বিদ্যুদ্বেগে ঘুরতে থাকে একবার সামনে একবার পিছনে, একবার বামে একবার দক্ষিণে। দন্ত ও নখরের সেই প্রখর ঝটিকার সম্মুখীন হওয়া কুকুরের পক্ষে অসম্ভব– তারা ক্ষণিকের জন্য পিছু হটে পড়ে। মুহূর্তের সুযোগে জাগুয়ার আবার ছুট দেয়। নাছোড়বান্দা কুকুরের দল আবার তাকে তাড়া করে, আবার জাগুয়ার রুখে দাঁড়ায় এবং এই একই ঘটনার হয় পুনরাবৃত্তি।

এই ঝটাপটির মধ্যে ক্লে গুলি চালাতে সাহস করলে না, কারণ কুকুরের গায়ে গুলি লাগতে পারে। রাইফেলটা তুলে ধরে সে পিছনের শিকারি দুজনকে ইঙ্গিত করলে, তারপর ধাবমান জাগুয়ার ও কুকুরগুলির পিছনে ছুটল।

হ্রদের জল যেখানে পাশের বিরাট জলাভূমিটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ঠিক সেই জায়গায় জলের ধারে মাটির উপর মাথা তুলেছে একঝাড় ম্যানগ্রোভ গাছ।

ছুটতে ছুটতে জাগুয়ার ওই ম্যানগ্রোভ ঝোপের ভিতরে ঢুকল। কুকুরগুলি তার পিছন পিছন ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

উদ্ভিদের বেড়াজাল ভেঙে ক্লে যখন জলের ধারে উপস্থিত হল জাগুয়ার তখন আর সেখানে নেই, শুধু কিনারায় দাঁড়িয়ে পাঁচটা হাউন্ড গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে।

কী হল! জাগুয়ার কি আবার ফাঁকি দিল?

ক্লে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চারদিক পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। না, জাগুয়ার এখনও পালাতে পারেনি। জলাশয়ের অপর দিকে তীরের খুব কাছে জন্তুটা সাঁতার কাটছে, অর্থাৎ একটা সুবিধামত জায়গা দেখে সে তীরে উঠতে চায়। ক্লে শুধু তার ভাসমান মুণ্ডটা দেখতে পেল অত দূর থেকে জলের উপর শরীরের অন্য কোনো অংশ তার চোখে পড়ল না।

একটা ম্যানগ্রোভ গাছের শিকড়ের উপর রাইফেল রেখে সে নিশানা স্থির করলে, তারপর ঘোড়া টিপে দিল।

ভাসমান জাগুয়ারের পিছনে প্রায় ফুট-তিনেক দূরে রাইফেলের গুলি কামড় বসাল, জলের উপর লাফিয়ে উঠল অজস্র জলকণা–

ক্লের লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে।

হ্রদের বিপরীত দিকে অনুসরণের শব্দ শুনে ডেল বুঝতে পেরেছিল ক্লের কুকুর বাহিনী জাগুয়ারকে তাড়া করছে। এপার থেকে সেই শব্দের সঙ্গে সমান্তরালভাবে সে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পথের মধ্যে দুটো জলাশয় তাকে বাধা দিল। এই জলাশয় দুটো যেমন লম্বা তেমনি গভীর। অনেক খোঁজাখুঁজি এবং ঘোরাঘুরির পরে সে আবিষ্কার করলে এক জায়গায় জলের গভীরতা খুব কম, ইচ্ছে করলে হেঁটে পার হওয়া যায়।

জল ভেঙে ডেল যখন শক্ত মাটিতে পা রাখলে তখন অনুসরণের শব্দ থেমে গেছে।

হঠাৎ হ্রদের বুকে প্রতিধ্বনি তুলে গর্জে উঠল একটা রাইফেল। আওয়াজটা শুনে ডেল ভাবলে জাগুয়ার এবার নিশ্চয় মারা পড়েছে।

কিন্তু একটু পরে সে যখন কুকুরের বিভ্রান্ত চিৎকার শুনতে পেল তখনই বুঝল, মানুষের বন্দুক এবং কুকুরের দাঁতকে ফাঁকি দিয়ে জাগুয়ার আবার পালিয়েছে।

তবে, পালাবে কোথায়!

 ব্যাঞ্জোর হত্যাকারীর জন্য হ্রদের দুই তীরে মরণফাঁদ সাজিয়ে রেখেছে ডেল।

হ্রদের জলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ডেল জাগুয়ারকে দেখতে পেল।

সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে প্রায় চারশো গজ দূরে জন্তুটা সাঁতার কাটছে।

ওপার থেকে তাড়া খেয়ে জাগুয়ার এপারে আশ্রয় নিতে চায়।

বুনো লতা-ঝোপের আলিঙ্গন ভেদ করে ডেল পাগলের মতো ছুটল।

 জাগুয়ার তার শত্রুদের চেয়ে অনেক বেশি চালাক, অনেক বেশি চটপটে।

ডেল যথাস্থানে এসে তাকে গ্রেপ্তার করার আগেই সে জল থেকে ডাঙায় উঠে সরে পড়ল।

প্রায় মিনিট পাঁচেক বাদে কুকুর নিয়ে ডেল যেখানে এসে দাঁড়াল একটু আগেই সেখান থেকে জাগুয়ার পলায়ন করেছে।

কিন্তু মানুষকে ফাঁকি দিলেও কুকুরের ঘ্রাণশক্তিকে ফাঁকি দেওয়া যায় না।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কুকুরগুলি শত্রুর গায়ের গন্ধ পেয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ শুরু হল অনুসরণ-পর্ব।

ডেল-এর কুকুরগুলি এখন পর্যন্ত খুব বেশি ছুটোছুটি করেনি, কাজেই তাদের উৎসাহে ভাটা পড়ার কোনো কারণ ছিল না। পূর্ণ উদ্যমে তারা জাগুয়ারের পিছনে ছুটল।

জাগুয়ার আর পালাতে চেষ্টা করলে না। বোধহয় সে বুঝতে পেরেছে আক্রমণই হচ্ছে আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। একটা কোপেক গাছের শিকড়ে পিঠ দিয়ে সে কোণঠাসা বিড়ালের মতো রুখে দাঁড়াল।

কুকুরের দল সামনে আসতেই সে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রক্তের নেশায় হাউন্ডগুলো খেপে রয়েছে, তারও পিছু হটল না।

অগ্রবর্তী দুটো কুকুর কিনো আর মিউজিক একেবারে জাগুয়ারের ঘাড়ের উপর এসে পড়ল।

মাত্র একটি মুহূর্ত প্রচণ্ড দংশনে মট করে ভেঙে গেল কিনোর মাথার খুলি, সনখ থাবার একটি মাত্র আঘাতে মিউজিক-এর বক্ষপঞ্জর বিদীর্ণ করে জেগে উঠল একটা রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন।

দুটো কুকুরই তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করলে।

 জাগুয়ার এবার অন্য কুকুরগুলির সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হল…

ঘন উদ্ভিদের ফাঁক দিয়ে ডেল তার প্রিয় কুকুরদের দুর্দশা দেখতে পেল। কিন্তু সেই দুর্ভেদ্য আগাছার জঙ্গলের মধ্যে রাইফেল তুলে নিশানা করাই অসম্ভব– গুলি চালানো তো দুরের কথা।

ঝোপের শেষ বাধাটা উত্তীর্ণ করে ডেল যখন রাইফেল তুলে ধরলে তখন কুকুরগুলো আবার জাগুয়ারকে আক্রমণ করেছে।

হাতের অস্ত্র নামিয়ে ডেল সাগ্রহে দেখতে লাগল এক বন্য নাটকের হিংস্র অভিনয়।

ডেল অ্যারিজোনার অধিবাসী, আমাদের মহাভারতের সঙ্গে তার পরিচয় নেই। সে যদি মহাভারত পড়ত তাহলে নিশ্চয়ই তার সপ্তরথী-বেষ্টিত অভিমন্যর কথা মনে হত।

…জাগুয়ারকে মাঝখানে রেখে সারমেয় বাহিনী অর্ধবৃত্তাকারে এগিয়ে এল কাছে, কাছে আরও কাছে…

হিংস্র উল্লাসে কুকুরগুলো ক্রমাগত চিৎকার করছে।

জন্তুগুলোর চেহারা তখন সত্যিই ভয়ানক—

 তাদের জ্বলন্ত চোখ থেকে মুছে গেছে গৃহপালিত পশুর নিরীহ অভিব্যক্তি কপিশ চক্ষুর অগ্নিময় দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে বন্য নেকড়ের ক্ষুধিত হিংসা, হত্যার উদগ্র আগ্রহে উন্মুক্ত মুখবিবরের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে নিষ্ঠুর দাঁতের সারি।

অপর পক্ষে জাগুয়ারের দেহে উত্তেজনার বিশেষ কোনো চিহ্ন নেই।

তার বজ্রকণ্ঠ সম্পূর্ণ নীরব শুধু মাটির উপর দুলে দুলে উঠছে তার সুদীর্ঘ লাঙ্গুল এবং থাবার নখগুলি বাইরে বেরিয়ে এসেছে কোষমুক্ত কিরিচের মতো।

ডেল রাইফেল তুলে নামিয়ে নিল, কারণ ঠিক তখনই হাউন্ডগুলো একসঙ্গে জাগুয়ারকে আক্রমণ করলে।

অস্ত্র নামিয়ে ডেল দেখতে লাগল যুদ্ধের দৃশ্য।

একটা হাউন্ড পিছনের পায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে জাগুয়ারের ঘাড়ে দাঁত বসাতে গেল।

জাগুয়ার নীরব হলেও নিশ্চল নয়। একটা নখরযুক্ত প্রকাণ্ড থাবা বিদ্যুৎবেগে কুকুরটার কণ্ঠ আলিঙ্গন করলে।

ডেল সবিস্ময়ে দেখল, আহত হাউন্ড মাটির উপর লুটিয়ে পড়ে আর উঠল না তার বিভক্ত কণ্ঠনালী থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছে তপ্ত রক্তধারা।

দারুণ আতঙ্কে কুকুরের দল ছিটকে সরে গেল। সারমেয়-বাহিনীর যোদ্ধারা এতক্ষণে বুঝেছে, এই বুটিদার বিড়াল অতি সাংঘাতিক জীব, তার সামনে গেলে মৃত্যু অবধারিত। কুকুরগুলো দূর থেকে জাগুয়ারকে লক্ষ করে জাতীয় ভাষায় গালিগালাজ শুরু করলে ওই শরীরী মৃত্যুর সম্মুখীন হতে তারা রাজি নয়!

ডেল বুঝল এই তার সুযোগ, রাইফেল তুলে সে নিশানা করতে লাগল।

হঠাৎ জাগুয়ারের চোখ পড়ল ডেল-এর দিকে।

সঙ্গেসঙ্গে সে বুঝতে পারলে এই হচ্ছে তার আসল শত্রু, এই মানুষটাকে হত্যা করতে পারলেই আজকের যুদ্ধে তার জয় অনিবার্য।

জাগুয়ার খুব নিচু হয়ে বসে পড়ল, তার কান দুটো চ্যাপ্টা হয়ে মিশে গেল মাথার খুলির সঙ্গে- ডেল বুঝল জন্তুটা এবার তাকে লক্ষ্য করে লাফ মারবে।

জাগুয়ার লাফ দিল।

সঙ্গেসঙ্গে অগ্নি-উদগার করে গর্জে উঠল রাইফেল।

হাঁড়ির মতো গোল মুণ্ডটা একবার গুলির আঘাতে শিউরে উঠল, পরক্ষণেই তার প্রাণহীন দেহ অসাড় অবস্থায় লুটিয়ে পড়ল ডেল লীর পায়ের কাছে।

কুকুরগুলো এবার জাগুয়ারের জলে-ভেজা মৃতদেহটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বীর বিক্রমে দংশন করতে লাগল।

.

এই ঘটনার পরে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বৎসর। ইতিমধ্যে লী ভাইদের রাইফেলের গুলিতে ইহলীলা সংবরণ করেছে প্রায় শ-খানেক জাগুয়ার। প্রাণ দেওয়া-নেওয়ার এই বিপদজনক খেলায় লীদের ক্ষতিও হয়েছে যথেষ্ট। নিহত জন্তুগুলোর মধ্যে কয়েকটা জাগুয়ার ছিল অত্যন্ত হিংস্র ও দুর্দান্ত। রাইফেলের গুলিতে তারা মৃত্যুবরণ করেছে বটে, কিন্তু মরার আগে শিকারিদের উপহার দিয়ে গেছে অনেকগুলি মূল্যবান কুকুরের রক্তাক্ত মৃতদেহ।

শুধু তাই নয় ক্ষিপ্ত জাগুয়ারের আক্রমণে শিকারিদের জীবন বিপন্ন হয়েছে একাধিকবার।

তবে, ডেল লীর অভিমত হচ্ছে সিনেগা গ্র্যান্ডির সাঁতার কাটা জাগুয়ারটাই হচ্ছে সবচেয়ে বলিষ্ঠ, সবচেয়ে ধূর্ত, সবচেয়ে সাহসী।

মরার আগে তার লড়াইটাও হয়েছিল সত্যি দেখবার মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *