মার্ক টোয়েন (১৮৩৫–১৯১০) – বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রসস্রষ্টা
যুক্তরাষ্ট্রের কৃতি লেখক মার্ক টোয়েন (Mark Twain) এমনই বিখ্যাত ও মহান ব্যক্তি ছিলেন, যাঁর জীবনকাহিনী অবলম্বনে হলিউডের এক ফিল্ম কোম্পানি চার লাখ পাউন্ড ব্যয়ে একটি ছবিও তৈরি করেছিল।
অথচ এই প্রখ্যাত প্রতিভাধর সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছিল ফ্লোরিডার এক দরিদ্র, অজ্ঞাত ও অখ্যাত মানুষের ঘরে।
দু-কামরার এমন এক অন্ধকার ঘরে মার্কের বাল্যকাল কেটেছে, যেখানে আজকের অবস্থাপন্ন কৃষকরাও তাদের গরু-ছাগল বেঁধে রাখতে রাজি হবেন না। মিসৌরি নদীর উপকূলবর্তী এক পাড়াগাঁয়ে ১৮৩৫ সালের ৩০ নভেম্বর তাঁর জন্ম। মার্ক টোয়েনের যখন জন্ম হয় তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন একজন সাধারণ শ্রমিক হিসেবে খালিপায়ে কাঠের লাঙল চালাতেন।
মার্ক শৈশবে এমন রোগা ও দুর্বল ছিলেন যে, অনেকের মনে আশঙ্কা জাগত ছেলেটা হয়ত আসন্ন শীতের প্রথম ধকলটাই কাটিয়ে উঠতে পারবে না।
আর ছোটবেলায় তিনি ছিলেন বড় প্যানপ্যানে। সবাইকে জ্বালিয়ে মারতেন। সারাক্ষণ পণ্ডিতসুলভ কৌতুকের ফিকিরে থাকতেন। স্কুলে যাওয়া ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অপছন্দের কাজ। প্রায়ই স্কুল পালিয়ে সমুদ্রোপকূলে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট দ্বীপ, মন্থরগামী পালতোলা নৌকা, সমুদ্রতরঙ্গ ইত্যাদি দৃশ্যের মধ্যে ডুবে যেতেন। তিনি সমুদ্রোপকূলে বসে বসে রঙিন স্বপ্নের জাল বুনতেন। এই স্বপ্ন দেখতে দেখতেই তিনি নয়বার সমুদ্রে ডুবে মরতে মরতেও বেঁচে গিয়েছিলেন।
মার্ক টোয়েনের পিতার নাম ছিল জন মার্শাল ক্লিমেন্স। ফ্লোরিডার সমুদ্র উপকূলের এক বাজারে ছিল তাঁর একটি ছোট দোকান। কিন্তু এই ছোট দোকানটিও তিনি ধরে রাখতে পারলেন না। ব্যবসা উঠে গেল।
ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের পরিবার ফ্লোরিডা থেকে চলে আসে মিসিসিপি নদীর তীরে হ্যানিবল নামের একটি ছোট্ট শহরে।
মূলত এখানেই মার্ক টেয়েনের বাল্যজীবন শুরু হয়। এই কিশোরবয়সেই লোরা হকিন্স নামের একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। থাকে বলে নির্মল বাল্যপ্রেম।
হ্যানিবল গাঁয়ের ভাঙা নড়বড়ে স্কুলে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন। কিন্তু পড়াশোনায় ছিল তাঁর দারুণ অনীহা। স্কুল পালিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। তবু এখানেই তিনি কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলেন এবং এ পর্যন্তই ছিল তাঁর প্রাতিষ্ঠনিক শিক্ষার দৌড়। এরপর আর কখনও স্কুলে যাওয়া হয়নি তাঁর I
অথচ পরবর্তী জীবনে এই মার্ক টোয়েনকেই অক্সফোর্ড ও জেইল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দুটো প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁর সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্যলাভ করতে পারলে সারা পৃথিবীর জ্ঞানী, গুণী, পণ্ডিত এবং বিদ্বান ব্যক্তিরা পর্যন্ত নিজেদের ধন্য মনে করতেন।
তিনি বই লিখে যত অর্থ উপার্জন করেছেন, অন্য কোনো লেখক তা করেছেন কি না সন্দেহ। তাঁর মৃত্যুর পর আজও তাঁর ওয়ারিসানরা তাঁর বই, রেডিও ফিচার ও ফিল্ম থেকে প্রচুর অর্থ রয়্যালটি বাবদ পেয়ে থাকেন।
মার্ক টোয়েনের বারো বছর বয়সে যখন বাবার মৃত্যু হয়, তখন খুবই অনুশোচনা হয় তাঁর। তিনি বাবার অবাধ্য ছিলেন বলেই এমনটা হয়েছিল। এই কৃত অপরাধের জন্য তিনি নিজেকে রীতিমতো অপরাধী ভাবতে শুরু করেন। তখন মা তাঁকে বললেন, যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন থেকে তুমি ভালো হবার চেষ্ট করো।
দিন কয়েক পর মা তাঁকে এক প্রেসে কাজ শেখবার জন্য ভর্তি করিয়ে দিলেন। তিনি শুধু খাওয়া-পরার বিনিময়ে দুবছর কাজ শেখেন যেখানে।
এর পর ঘটল এক ঘটনা। তিনি একদিন মিসৌরি শহরের রাস্তায় কুড়িয়ে পেলেন একটি ছেঁড়া বইয়ের পাতা। ঘটানাটা হয়তো খুবই সাধারণ। কিন্তু সেই সাধারণ ঘটনাই তাঁর জীবনে ঘটিয়ে ফেলল এক অসাধারণ ব্যাপার। এই ছেঁড়া পাতাটা ছিল ফ্রান্সের বীরকন্যা জোয়ান অব আর্কের আত্মচরিত গ্রন্থের একটি পাতা। এতে তাঁর বন্দিদশার কাহিনী বর্ণিত ছিল।
বইয়ের পাতা ছেঁড়ার মতো এই অন্যায় কাজ চোদ্দ বছর বয়সের বালকের মনে এক অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, অথচ জোয়ান অব আর্কের কথা তিনি তখনও জানতেন না। কিন্তু সেই থেকেই জোয়ান অব আর্কের চিন্তা তাঁর মনে গভীরভাবে বাসা বাঁধে। জোয়ান অব আর্কের ওপর যত বই ছিল, তার সবগুলো তিনি পড়ে ফেললেন। পরে তিনি জোয়ান অব আর্কের ওপর নিজেও একটি বই লিখে ফেলেন।
চার খণ্ডে প্রকাশিত মার্ক টোয়েনের জীবনীগ্রন্থের প্রণেতা আলবার্ট বিপ্লোপিন বলেছেন, এই কুড়িয়ে পাওয়া পাতাটাই তাঁকে ইতিহাসপাঠে আগ্রহী করে তোলে। এই পাতাটাই তাঁর অন্তরকে এমন এক ভাবরসে সঞ্জীবিত করে, যা তাঁর চিন্তাজগতের বিশিষ্ট স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায় এবং আমৃত্যু এটা তাঁর অন্তরকে আঁকড়ে থাকে। এই উড়ন্ত ছেঁড়া পাতাটাই তাঁর ভবিষ্যৎ চিন্তভাবনাকে একটি নির্দিষ্ট খাতে প্রবাহিত করে।
তিনি হ্যানিবল শহর থেকে প্রকাশিত ‘হ্যানিবল জার্নাল’ (Hannibal Journals) পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেন। কিন্তু সেখানেও তিনি বেশিদিন টিকতে পারেননি। তাঁর নিজের বড় ভাই ওরিয়নের ঝগড়া লেগে যায়। ফলে তিনি পত্রিকার কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন সেন্ট লুইস শহরে কাজের আশায়।
সেখানে তাঁর বোন পামেলা থাকতেন। তাঁর কাছেই এসে উঠলেন তিনি। এখানে এসে তিনি স্থানীয় ‘সেন্ট লুইস ইভিনিং নিউজ’ (St Louis Evening News) পত্রিকায় কম্পোজিটরের পদে চাকরি লাভ করেন।
তারপর হাতে কিছু টাকা জমা হওয়ার পরই তিনি ভাগ্যের অন্বেষণে চলে আসেন নিউ ইয়র্ক শহরে ১৮৫৩ সালে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮ বছর।
এখানে এসে তিনি সপ্তাহে চার ডলার পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এক প্রেসে চাকরি পেলেন।
কিন্তু এখানেও বেশিদিন থাকা হলো না। তিনি আরও ভালো চাকরির আশায় চলে এলেন ফিলাডেলফিয়া শহরে। এখানে এসে তিনি চাকরি নিলেন ‘দি ইনকুয়িরার’ (The Inquirer) পত্রিকায়। তখন তিনি ছিলেন একজন দক্ষ কম্পোজিটর। দিনে দশ হাজার এম (Em) কম্পোজ করতে পারতেন। ‘দি ইনকুয়িরার’ পত্রিকায় এক বছর চাকরি করার পর তিনি আবার ফিরে এলেন সেন্ট লুইস শহরে। আবার চাকরি নিলেন ‘ইভিনিং নিউজ’ পত্রিকায়।
কিন্তু এখানেও তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। ভালো চাকরির জন্য এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করতে লাগলেন। এই সময়েই তাঁর সক্ষাৎ হয় ক্যাপ্টেন হোরেস বিক্সবি নামের একজন জাহাজ-ক্যাপ্টেনের সাথে। তিনি মিসিসিপি নদীতে জাহাজ চালাতেন। মার্ক টোয়েন প্রেসের কাজ ছেড়ে দিয়ে হোরেসের কাছে জাহাজ চালানোর প্রশিক্ষণ নিলেন এবং তাঁর সঙ্গে দুবছর কাজও করলেন সহকারী সারেং হিসেবে।
১৮৬১ সাল থেকে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধে শুরু হলে মার্ক টোয়েন আবার ফিরে এলেন নিজের শহর হ্যানিবলে। এখানে এসেই তিনি নাম লেখালেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে। অংশ নিলেন যুদ্ধে। এখানে তিনি ১৮৬১ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ছিলেন। এখানে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে বাহিনী থেকে তাঁর নাম কাটা যায়। তিনি তখন ফিরে আসেন তাঁর বড় ভাই ওরিয়নের কাছে। ওরিয়ন তখন নেভাডা টেরিটরির সেক্রেটারি। মার্ক টোয়েন হলেন সেক্রেটারি ওরিয়নের প্রাইভেট সেক্রেটারি।
কিছুদিন পর ভাইয়ের সঙ্গে তিনি চলে আসেন কারসন শহরে। কিন্তু এখানে এসে দুজনেই কর্মহীন হয়ে পড়েন। হাতের পয়সা ফুরিয়ে এল।
মার্ক টোয়েন তখন বড় ভাইয়ের চাকরি ছেড়ে সোনা সংগ্রহের কাজে নেমে পড়লেন। কিন্তু সোনার সন্ধান পেলেন না। তখন তিনি ভার্জিনিয়া সিটি থেকে প্রকাশিত ‘এন্টারপ্রাইজ’ (Enterprise) পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতে শুরু করলেন। কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হবার পরই ‘এন্টারপ্রাইজ’-এর সম্পাদকের কাছ থেকে রিপোর্টারের পদের একটি চাকরির অফার এল।
এই সময় তাঁর ছিল প্রচণ্ড অর্থকষ্ট। যে কোনোরকমের একটা চাকরির। তাই তিনি চাকরিটা পেয়ে মহাখুশি হলেন।
কিন্তু চাকরিতে যোগদানের জন্য ভার্জিনিয়া যেতে যে গাড়ি ভাড়ার দরকার, সেটা তখন তাঁর কাছে ছিল না। তিনি যেখানে ছিলেন সেখান থেকে ভার্জিনিয়া ১১২ কিলোমিটারের পথ। অথচ তাঁকে যেতেই হবে।
ফলে তিনি হেঁটেই রওনা দিলেন। একটানা চারদিন পায়ে হেঁটে ১১২ কিলোমিটার পথ পার হয়ে চলে এলেন ভার্জিনিয়ার ‘এন্টারপ্রাইজ’ পত্রিকার অফিসে।
এই পত্রিকাতে রিপোর্টার হিসেবে লেখার সময়ই তিনি গ্রহণ করেন তাঁর ছদ্মনাম- মার্ক টোয়েন। স্যামুয়েল লঙহর্ন ক্লিমেন্স (Samuel Longhorne Clemens) থেকে হয়ে গেলেন মার্ক টোয়েন। একদিন মার্ক টোয়েনের জনপ্রিয়তার অন্তরালে হারিয়ে গেল তাঁর আসল নাম। মার্ক টোয়েন নামে তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৮৬৩ সালের ফেব্রুয়ারি।
এরপর তিনি সানফ্রান্সিসকোতে এসেও কিছুদিন খবরের কাগজে চাকরি করেন। এখানে এসে তাঁর পরিচয় হয় কবি ও ঔপন্যাসিক ব্রেট হার্টের সঙ্গে। কিন্তু তাঁদের এই বন্ধুত্ব বেশিদিন টেকেনি। দুজনে যৌথভাবে একটি নাটক লেখেন। কিন্তু নাটকটি মঞ্চসফলতা পায়নি। তখন একজন দোষ দিতে থাকেন আরেকজনকে। ফলে এই বন্ধুত্ব যায় নষ্ট হয়ে। মার্ক টোয়েনের জীবনের এটাই ছিল বড় দুঃখ যে, তিনি জীবনে কখনও কোথাও এক জায়গায় আসন গেড়ে বসে থাকতে পারেননি। প্রচুর অর্থ উপার্জন করেও পারেননি তা ধরে রাখতে।
মার্ক টোয়েনের জীবনের একটা মজার ব্যাপার ছিল এই যে, মোটেই তাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিল না। তিনি আজব সব ব্যাপারে টাকা খাটাতেন।
একবার বই পড়ে তাঁর মাথায় খেয়াল চাপল আমাজান নদীর উজানে নারকেল স্টক করে রাখলে প্রচুর মুনাফা হবে, অথচ নারকেল ব্যবসা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। তাঁর কাছে প্রচুর টাকাও ছিল না। এমনকি নারকেল কেনার জন্য দক্ষিণ আমেরিকায় যাওয়ার জাহাজ ভাড়া পর্যন্ত ছিল না তাঁর কাছে।
এরই মধ্যে একদিন তিনি দশ পাউন্ডের একটা নোট কুড়িয়ে পেলেন পথে। আর তা-ই নিয়েই চললেন নারকেল ব্যবসা করতে। কিন্তু অর্ধেক পথ যেতেই তাঁর সব পয়সা শেষ হয়ে গেল। ফলে নারকেলের ব্যবসার সেখানেই ঘটল ইতি। তিনি ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এলেন ঘরে। আর একবার কিছু না জেনেশুনেই তিনি গ্যাস উৎপাদনকারী একটা মেশিন নির্মাণে পুঁজি বিনিয়োগ করে বসেন। কিন্তু মেশিনটি গ্যাস উৎপাদন করতে ব্যর্থ হওয়ায় গচ্চা যায় তাঁর সমস্ত টাকা।
আর একবার ঘড়ি নিমার্ণের কারখানা খুলতে গিয়েও তিনি প্রচুর টাকা মার খান। আর একবার প্রকাশনার ব্যবসা করতে গিয়েও তাঁর গচ্চা যায় প্রায় ৩২ হাজার পাউন্ড।
অথচ অদৃষ্টের পরিহাস, যেখানে সামান্য অর্থ বিনিয়োগ করলেও তিনি অনায়াসে কোটিপতি হয়ে যেতে পারতেন, সেখানে তা তিনি বিনিয়োগ করেননি। টেলিফোন আবিষ্কারক গ্রাহাম বেল একবার তাঁর কাছে প্রস্তাব করেছিলেন এই বলে যে, এই আবিষ্কারে টাকা খাটালে এই যন্ত্র তৈরি করে বাজারে ছাড়লেই প্রচুর কাটতি হবে এবং মুনাফাও হবে। কথাটি শুনে মার্ক টোয়েন হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখন যদি তিনি টাকা খাটাতেন, তবে মাত্র ১০০ পাউন্ড পুঁজি খাটিয়ে কোটি টাকার মালিক হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে এই ১০০ পাউন্ড এক বন্ধুকে ধার দিয়েছিলেন, যে টাকা তিনি আর কোনোদিন ফেরত পাননি।
১৮৯৩ সালে ৫৮ বছর বয়সে মার্ক টোয়েন দেনার দায়ে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন। তিনি ইচ্ছে করলেই নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে এই দেনার দায় থেকে মুক্ত হতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি বুড়ো বয়সেও রাতদিন পরিশ্রম করে বই লিখে এবং বক্তৃতা দিয়ে অর্থ উপার্জন করে সমস্ত দেনা পরিশোধ করেছিলেন। যে মহিলার সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল, তাঁকে দেখার আগে ফটো দেখেই তিনি তাঁর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন, যার সূত্রপাত হয়েছিল এক জাহাজে। মার্ক টোয়েন জাহাজে চড়ে তীর্থযাত্রায় রওনা হয়েছিলেন। তাঁর বন্ধু ও জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন চার্লস। একদিন ক্যাপ্টেন চার্লসের কেবিনে গিয়ে তাঁর বোন অলিভিয়ার ছবি দেখেই মুগ্ধ হয়ে যান মার্ক টোয়েন। মাস কয়েক পর অলিভিয়ার সাথে তাঁর মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়। জীবনের শেষ ধাপে এসে মার্ক টোয়েন তাঁর স্ত্রী সম্পর্কে বলেছেন, প্রথম দেখার দিন থেকে আজ পর্যন্ত তাঁকে এক মুহূর্তের জন্যও হৃদয় থেকে আড়াল করতে পারিনি।
প্রথম দেখার আমন্ত্রণে তিনি অলিভিয়াদের বাড়ি যান এবং নানা ছলচাতুরি করে সেখানে অলিভিয়ার কাছে প্রায় দু সপ্তাহ কাটিয়ে আসেন। এমনি করে অলিভিয়ার মন জয় করতে এবং শেষে তাঁকে স্ত্রীরূপে লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বিয়ের আগে অলিভিয়া মার্ককে ডাকতেন ‘ইয়োথ’ বলে, আর তিনি অলিভিয়াকে ডাকতেন ‘লেডি’ বলে। বিয়ের পরও সারা জীবন তাঁরা পরস্পরকে এই নামেই সম্বোধন করতেন।
অলিভিয়া তাঁদের এই প্রেমকাহিনী লিখিত আকারে একটি ব্যাংকে গচ্ছিত রেখেছিলেন এবং ছুটির অবসর পেলেই ব্যাংক থেকে তুলে এনে দুজনে বসে বসে পড়তেন আর স্মৃতি রোমন্থন করতেন।
মার্ক টোয়েন তাঁর স্ত্রীকে যেমন ভালবাসতেন, তেমনি শ্রদ্ধাও করতেন। তাঁর সবগুলি বইয়ের পাণ্ডুলিপি পড়ে দেখতেন অলিভিয়া। এমনকি প্রয়োজনবোধে পরিবর্তনও করতেন। মার্ক টোয়েন এই সংশোধন মেনেও নিতেন সানন্দে।
পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যেতে পারে মার্ক টোয়েনের মনে সবসময় এরকমের একটা আশঙ্কা জেগেই থাকত। তাই তিনি বাসার ঝাড়ুদারকে স্ত্রীর টেবিলের ত্রিসিমানায় ঘেঁষতে দিতেন না। তিনি টেবিলের চারপাশে ঘরের মেঝেতে একটি দাগ কেটে রাখতেন। ফলে ঝাড়ুদারের ওই সীমা অতিক্রম করার সাহস হতো না।
১৮৭২ সালে টোয়েন স্ত্রী অলিভিয়াকে নিয়ে এসে ওঠেন হার্টফোর্ড শহরের একটা বাড়িতে। তিনি যেখানে বাসা নিয়েছিলেন, তার পাশের বাড়িতেই থাকতেন বিখ্যাত আঙ্কেল টমস কোবিনের (Uncle Toms Cabin) লেখিকা মিসেস হ্যারিয়েট বিচার স্টো। এর পর থেকে তিনি পুরোপুরি উপন্যাস ও নাটক লেখায় আত্মনিয়োগ করেন। লেখেন “রদিং ইট’ (Roughing it) এবং ‘দি গিলডেড এইজ’ (The gilded age) নামে দুটো নাটক।
মার্ক টোয়েনের সর্বাধিক আলেচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে ‘টম সয়ার’ (Tom Sawyer), ‘হাকেলবেরি ফিন’ (Huckelberry Finn) এবং ‘এ ইয়াঙ্কি অ্যাট দি কোর্ট অব কিং আরথার’ ( A Yankee at the Court of King Arther )।
মার্ক টোয়েনের জন্ম-মৃত্যু নিয়েও এক মজার গল্প প্রচলিত আছে। তাঁর কামনা ছিল মৃত্যুর আগে তিনি আবার হ্যালির ধূমকেতু দেখে যাবেন। তাঁর এই আশা পূর্ণ হয়েছিল।
কারণ, তাঁর জন্মের সময়েও হ্যালির ধূমকেতু দেখা দিয়েছিলেন আকাশে। তারপর ৭৫ বছর পরে ১৯১০ সালে হ্যালির ধূমকেতু আবার আকাশে দেখা দেয়। এই হ্যালির ধূমকেতু দেখার পরের রাতেই ২১ এপ্রিল তিনি মারা যান। অবিশ্বাস্য মনে হলেও ঘটনাটি সত্য।