তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

মার্কোপোলোর কলকাতা পর্যটন

মার্কোপোলোর কলকাতা পর্যটন

।। প্রথম পর্ব।।

মার্কোপোলো বললেন, অবিশ্বাস কোরো না, ভূত ভেবে ভয়ও পেও না, মানুষ ইন ফ্যাকট মরে না, মরলে কিম্বা মারতে পারলে এতদিনে বাঙালি মরে একসটিংকট হয়ে যেত। নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি। ইহাদের ভেজালে মারা যায় না, কুপথ্যে ইহারা কাবু নয়, বোমা পাইপ, পটকা ইহাদের কিছু করিতে পারে না, বুট জুতার লাথি ইহারা সহজে হজম করিতে পারে, খাইয়া না খাইয়া ইহারা মহানন্দে বংশ বৃদ্ধি করিয়া চলে, ইহারা দাস হইতে জানে, প্রভু হইতেও জানে, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাও ইহাদের শেষ করিতে পারে না। ইহারা ফিরে-ফিরে আসে, কত কাঁদে হাসে, কোথা যায় সদা ভাবে গো তাই। শুনে রাখো, বৎস, সব ফোর্থ ডাইমেনসানে গিয়ে জমা হয়। আমিও সেইখান থেকেই আসছি, কুবলাই খানের নির্দেশে।

কেন দাদা?

দাদা নয়রে ব্যাটা, দাদু দাদু—তোর চে’ আমি সাড়ে সাতশো কি আটশো বছর বয়েসে বড়। মার্কো বললেন, আমি একটা ডাকসাইটে ভূপর্যটক। ইতিহাস যদি পড়ে থাকো, নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে, আমি কীভাবে ভারতে এসেছিলুম! কোনও বিপদ, কোনও বাধা, কোনও ভয় আমাকে কাবু করতে পারেনি। সে সময় বিমান ছিল না, লাকসারি লাইনার ছিল না, ন্যাশানাল হাইওয়ে ছিল না। তবু, তবু আমার আসন টলে গেছে।

কে টলিয়েছে দাদু?

তোমরা, তোমাদের কলকাতার ব্রেভ ম্যানেরা। তোমরা প্রতিদিন যা করো, আমি যদি একবার তাহা করিতে না পারি, তাহলে ফোথ ডাইমেনসানে আমাকে সাহসী পর্যটক বলে কেউ আর স্বীকার করবে না। কুবলাই খানের নির্দেশে সেই কারণেই আমার কলকাতা আগমন। মিশন—অফিস টাইমে কলকাতার যেকোনও প্রান্ত থেকে বিবাদিবাগ গমন, সরকারি বাস, ট্রাম, কিম্বা বে-সরকারি বাসে। শর্ত—নিজেকে পর্যটক ভাবলে চলবে না, ভাবতে হবে নিম্নপদস্থ কর্মচারী। ঠিক সময়ে অফিসে হাজিরা দেওয়ার জন্যে ভেতরটা আকুলি বিকুলি করবে। হাতে থাকবে একটা ব্রিফকেস, সেটার ওজন হবে মিনিমাম পাঁচ থেকে সাত কেজি। প্যান্টের পাশ-পকেটে থাকবে মানিব্যাগ। সেই ব্যাগে থাকবে ভাড়া দেওয়ার খুচরো পয়সা কিম্বা টাকা, পাটকরা রুমাল, দু-এক কুঁচি সুপুরি। পায়ে থাকবে, সামনে খোলা, আঙুল বের করা জুতো, চোখে থাকবে চশমা। পরনে থাকবে পা-ফুলো ট্রাউডার। বুশ শার্ট। আজকে আমি তোমার সঙ্গে রেকনেসেনসে বেরেবো, কাল বেরোবো একা-একা।

সকাল ন’টার সাইরেন বেজে গেল। মার্কো অবাক হয়ে বললেন, এয়ার রেড চলছিল নাকি, অল ক্লিয়ার বাজছে! আজ্ঞে না, এটার মানে অন্য ক্লিয়ার আউট। কলকাতা শহরের চাকুরিজীবী পরিবারে অল ক্লিয়ার হল। হাসিখুশি কর্তা, খিটখিটে কর্তা, ত্রিভঙ্গ মুরারি কর্তা, কান্নিক মারা কর্তা সব বেরিয়ে পড় রাস্তায়। গৃহ এখন গৃহিণীদের জন্যে। কর্তা ক্লিয়ার, কর্ম ক্লিয়ার, কারণ ক্লিয়ার।

রাস্তায় নেমে মার্কো বললেন, রোজই যখন এই সময়ে বেরোতেই হয় তখন সেইভাবে আর একটু আগে থেকে প্রস্তুত হতে পারো না। শেষ সময়ের এই তাড়াহুড়ো। তা তোমার হাতে ওটা কী! ভেটিরিনারি হসপিটেল হয়ে যাবে বুঝি!

না তো! তাই তো! দেখেছেন, কী কাণ্ড! দুটো চেয়ারে দুটো জিনিস ছিল, একটা ফোলিওব্যাগ, আর একটা গুটিসুটি বেড়াল। তাড়াতাড়িতে বেড়ালটা নিয়েই বেরিয়ে পড়েছি, যাই রেখে আসি। বেড়ালটাকে সিঁড়ির মুখে ছেড়ে দিলেই জানি ঠিক ওপরে চলে যাবে। কিন্তু ফোলিও ব্যাগ না হলে আমি অচল। ব্যাগে আমার সেক্রেটারিয়েট, ড্রয়ারের চাবি, লন্ড্রির বিল, ইলেকট্রিক বিল, দাঁতের, চোখের, নাকের, কানের, পেটের প্রেসক্রিপশন, হজমের, মাথা ধরার ওষুধ, অ্যান্টাসিড, অ্যান্টি-অ্যামিবিক পিল, টিফিনের কৌটা, কাছে দেখার চশমা, কেনাকাটার ফর্দ, উত্তর দেওয়ার চিঠির ডাঁই, রোজকার খরচের হিসেব-লেখা স্লিপ, ফেরার পথে বাজার করার পাটকরা নরম ব্যাগ, গোটাকতক আরশোলার ডিম, একটা-দুটো ছোট আরশোলা, যার অপর নাম চ্যালা, বাস আর ট্রামের অজস্র টিকিট। কি নেই ওই পেটমোটা ব্যাগে!

ব্যাগ নিয়ে ফিরে আসতে কিঞ্চিৎ বিলম্বই হয়। মার্কো বললেন, তোমরা ওরিয়েন্টাল পিপলরা ভেরি স্লো, স্লোগিস —লেথারজিক।

আজ্ঞে না সাহেব! সমীক্ষায় প্রকাশ, কলকাতার অধিকাংশ মানুষ খাওয়াদাওয়ার পর একটু বড় বাইরের জন্যে উসখুস করে। তলপেটে জিয়ার্ডিয়া, অ্যামিবায়োসিসের কমবাইন্ড পাঞ্চ। সেই কাজটি সেরে এলুম, সাহেব।

বেশ করেছ, এখন ওইটাকে ভেতরে ঢোকাও, তোমার ইনসাইড আউট হয়ে আছে।

আ, ওটা আমার সেক্রেড থ্রেড, পৈতে, অনেকদিন ধোলাই করা হয়নি, সাহেব।

জামার বোতাম ঠিক করে লাগাও, ওলটপালট হয়ে আছে, বি ডিসেন্ট, মাই বয়। কাল থেকে সব কাজ ঠিক সময়ে করার চেষ্টা করবে। জেনে রেখো একপেট খেয়ে যে দৌড়োয়, মৃত্যুও তার পেছনে দৌড়োয়।

সব জানি সাহেব, ক্যালকেসিয়ানরা সব জ্ঞানপাপী। সমীক্ষায় প্রকাশ—কলকাতায় হাইপ্রেশার আর লো প্রেশার পাশাপাশি চলেছে। হ্যাংওভার আর মর্নিং সিকনেসের সহ অবস্থান। কোষ্ঠকাঠিন্য আর তারল্য যেন যমজ দুটি ভাই। সকালে চায়ের ফার্স্ট এডিসান, সেকেন্ড এডিসান, খবরের কাগজ, মুভমেন্ট, খুঁতখুঁত, অ্যাগেন চা, ফিন অ্যাগেন মুভমেন্ট, স্ত্রীর ফাইফরমাশ, ছেলের অঙ্ক, মেয়ের মহাভারত, বাড়িওলার সঙ্গে জল নিয়ে খ্যাচাখেচি, প্রতিবেশীর পিলে পাংচার, শ্বশুর মহাশয়ের কন্যার সঙ্গে ক্ষণে হাতে দড়ি, ক্ষণে চাঁদ, নিজস্ব জিনিসপত্রের হারানো, প্রাপ্তি, নিরুদ্দেশ, এরপর সময় থাকে! টাইম অ্যান্ড টাইড, মার্কোপোলো! কী আর বলব! এখন চলো ট্রাম ডিপোয় যাই।

বিশ বাইশ বছর ধরে নিত্য অফিস করা মানুষের হাঁটার বেগ আর ফোর্থ ডাইমেনসান থেকে উঠে আসা সাড়ে সাতশো বছর আগের ভূপর্যটকের বেগে তফাত থাকবেই। আমি চলেছি গন্ডারের মতো, প্যাটন ট্যাঙ্কের মতো। মার্কো আসছেন পেছনে পাল-তোলা মহাজনী নৌকোর মতো। এ হেহে, দ্যাখো তো হে, ব্রহ্মতালুতে গরম মত কী খানিকটা পড়ল! মার্কো মাথা নীচু করে এগিয়ে এলেন। মাথার মধ্যবিন্দুতে যেন হোয়াইটওয়াশ! কী বলো তো! আজ্ঞে ক্যালকাটার ক্রো বৈদ্যুতিক তারে বসে পেছন ঝুলিয়ে একটু করে দিয়েছে। কী করেছে। কাকস্য প্রাত: বহু কৃত্য। মার্কো মাথা তুলে বললেন, ছি, ছি।

ছি ছি কী। ওসব আমরা মাইন্ড করি না। সয়ে গেছে।

আরে, সেজন্যে ছি ছি করছি না হে, করছি তোমার সংস্কৃত শুনে। বিদ্যাসাগর, রামমোহনকে আমি কীভাবে বোঝাব। তোমাদের তৈরি ফাউন্ডেশানের ওপর দাঁড়িয়ে নাতি আমার বহু কৃত্য বলছে। ধাতুরূপ, শব্দরূপ ভুলে বসে আছ হে। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের উপক্রমণিকাটা তো মাঝে-মাঝে ওলটাতে পারো!

ধ্যাস কী যে বলেন। ওনার লেখা অমন ভালো বই প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগই বাতিল করে দিয়েছি আমরা। অ এ অজগর আর তেড়ে আসে না। এখন অফসেটে ছাপা অ এ অটোমেশান তেড়ে আসে। আপনি বলছেন উপক্রমণিকা! ও বই এখন হয়তো গুটেনবার্গের ছেলেমেয়েরা উলটে দেখবে!

মার্কো বললেন, তা হলেও জেনে রাখো বহু বহু বহব—বহবকৃত্য।

সাত সকালেই সাহেবের সঙ্গে ইন্ডোলজি করছ না কি হে! সুটেড-বুটেড হাতে একতাড়া মুলো, হনহন করে বৃন্দাবন পাশ দিয়ে সাঁত করে বেরিয়ে যেতে-যেতে প্রশ্নটা রেখে গেল। আজ বেরোবে না?

মুলো হাতে চললে কোথায়? একটু জোর কদমে হেঁটে বৃন্দাবনের পাশাপাশি এসে গেছি, একতাড়া মুলো সহ শ্রীবৃন্দাবন। মুলো কী করবে?

ঘুষ দেব হে ঘুষ!

মুলো ঘুষ!

মাসের শেষে অন্য মালা পাবো কোথায়! মুলো ঘুষে পৌষ কালীও খিল খিল করে হেসে ওঠেন, দপ্তরের কেরানি একটু নড়ে বসবে না! কি বলো হে! এই রইল ভাই তোমার টেবিলে একতাড়া চাষের মুলো, ফাইলটা একটু ঠেলে দাও পাশের টেবিলে। পাশের টেবিলে পড়বে এইটা। বৃন্দাবনের হিপ পকেট থেকে বেরোল একটা মেয়েদের চিরুনি। বউয়ের চিরুনিটা হাতিয়ে এনেছি। যশোরের শেষ মাল বলে চালিয়ে দেব। একটু ঠেলে দাও ভাই ওপরে। এইভাবে ফাইল উঠবে, আমিও উঠব। স্টেপ বাই স্টেপ, সব শেষে বিলিতির বোতল। বুড়োকে কী করে শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ।

মার্কো পেছনেই ছিলেন। খুশি হয়ে বললেন, ভেরি গুড, ভেরি গুড, তুমি দেখছি শুদ্ধ সংস্কৃত জানো। বুড়োকে কী করে বোঝাই সারা কলকাতায় প্রভাতবাবুর ‘আই ডোন্ট নো’ চলেছে। তুমি তো খুব ফানি ম্যান হে। মার্কো বৃন্দাবনের প্রেমে পড়েছেন। বৃন্দাবন গাঙ্গুলিদের মতো চালু লোকেরাই কলকাতার চল ও বল। তোমার কথা আমি ত্রৈলোক্যকে বলব।

কে ত্রৈলোক্য?

তুমি ত্রৈলোক্য মুখোপাধ্যায়ের নাম শোননি। ফোর্থ ডাইমেনসানে এলে পরিচয় করিয়ে দেব।

বৃন্দাবন ইশারায় বুঝতে চাইল, সাহেবের মাথার গোলমাল কিনা!

ফিসফিস করে বললুম, পাগলা সাহেব।

করছ কি তুমি, বৃন্দাবন মুলোর খোঁচা মারল। হাতিয়ে নাও, হাতিয়ে নাও যা পাও, ফরেন কারেনসি, টেপ রেকর্ডার, ট্রানজিসটার, ক্যামেরা, কসমেটিকস, ফরেন লিকার, গোলড বিসকিট, হাসিস, মারিয়ুনা। তুমি না পারো আমার হাতে ছেড়ে দাও।

মার্কো পেছিয়ে পড়েছেন। দাঁড়িয়ে পড়েছেন। ভেলভেট মোড়া খাতায় লিখছেন, কী লিখছেন গ্র্যান্ড গ্র্যান্ড ওলড ম্যান!

আমি যা দেখি, আমি যা শুনি, একটু নোট করেনি। এই দ্যাখো নোট ওয়ান, এটা আমি ওয়ারেন হেস্টিংসকে বলব, কলকাতার রাইটারবাবুদের স্বভাব তোমার সময়ে যা ছিল, এখনও তাই আছে। কলাটা, মুলোটা না দিলে লাল ফিতের বাঁধন খোলে না। রেফারেনস, মুলোধারী বৃন্দাবন। সময়, নটা পঁয়তাল্লিশ। ডেট, আজকের তারিখ। দ্বিতীয় নোট, ফর বিদ্যাসাগর, ফর রামমোহন, ফর রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ এট আল। বই লিখলে কিস্যু হয় না, ছবি চাই, ভালো ছাপা চাই, বই চালাবার জন্যে ধরবার জন্যে বৃন্দাবন গাঙ্গুলি অ্যান্ড হিজ মুলো প্রেসক্রিপশান চাই।

ক্লিপ। খাতা বন্ধ হল। পায়ে-পায়ে ট্রাম ডিপো।

।। দ্বিতীয় পর্ব ।।

মার্কো বললেন, ডিপো থেকে ট্রামে বসে জানালা দিয়ে চাঁদপানা মুখ বের করে হাওয়া খেতে-খেতে বিবাদিবাগ যেকোনও শিশুও যেতে পারে। এর মধ্যে সেই থ্রিল কোথায়! যে থ্রিল আমি ইংলন্ডে দেখেছি, মধ্যযুগে গ্লায়েটারদের লড়াইয়ে। তুমি পড়েছ স্কটের বইয়ে। যে থ্রিল দেখেছি স্পেনে বুলফাইটারদের মধ্যে। রোমে রথের দৌড়ে। এই তো সেদিন আমাদের ফোর্থ ডাইমেনশানে তোমাদের কলকাতার একটি ইয়ং ছেলে বিবাদিবাগ থেকে বাড়ি ফেরার পথে সোজা চলে এল, তখনও তার মুখে সেই বীরের সংগীত—হাতল ধরে ঝুলব তবু ভেতরে তো যাব না। আমি সেই হিম উত্তেজনা চাই, অভিজ্ঞতা চাই, গুঁতো-গুঁতি চাই, ঠাসাঠাসি চাই। এই পড়ে যাই, এই মরে যাই অভিজ্ঞতা নিয়ে পতাকার মতো উড়তে-উড়তে যেতে চাই। ঝান্ডা উঁচা রহে হামারা।

।। অভিমানীর অভিমানী ট্রাম ।।

সারি-সারি ট্রাম ঠ্যাং উঁচু করে পরপর দাঁড়িয়ে আছে। ‘হল্ট’ বলে সৈন্যবাহিনীকে স্থানু করে দিয়ে জেনারেল যেন ব্যাটেল ফিলড থেকে সরে পড়েছেন। বিভিন্ন বয়সের, মাপের, মেজাজের স্ত্রী ও পুরুষ যাত্রী চারদিকে ভাঙা ডিমের কুসুমের মতো পোচের প্যানে গ্রিজের ওপর হড়কে-হড়কে বেড়াচ্ছেন। আলতো হাতের আদরের স্পর্শ পড়ছে হাতলে, শরীরের চাদরে। যেন ট্রামের জ্বর দেখা হচ্ছে, প্রেশার মাপা হচ্ছে, তোয়াজ হচ্ছে নানাভাবে। কেন অমন কচ্চিস মাইরি! সাতসকালে কেন তোর এই ভিটকেমি! চল বাবা সুন্দরী, চল বাবা বোঁচানাকি অসুন্দরী। কানের কাছে বেজে উঠল—গড সেভ দি কিং। মার্কো মহাখুশী। ট্রাম তোমাদের চলবে না। চলো, যাই হাতল ধরে উপচে-পড়া বাসে।

কী হয়েচে ভাই! যাবে না, যাচ্ছে না! সবাই প্রশ্ন ফেরি করে বেড়াচ্ছেন। উত্তর দেনেওয়ালা, ইউনিফর্মধারী ফলক লাগানো সেই মহামানবরা কই। এই একজন আসছেন। ওই মহামানব আসে। কী হয়েছে ভাই? আমার অফ ডিউটি। জিগ্যেস করুন, ওই গাছতলায় টুপিওয়ালাকে। টুপিদা, ট্রাম! জানি না, জিগ্যেস করুন ওই টুপি-দাড়িওয়ালাকে। টুপি-দাড়িদা কী হয়েছে ভাই, এই তো সারি-সারি ট্রামের। জানি না, আমি খুচরো দেওয়ার অফিসার। আমি টাকার চেঞ্জ দিয়ে থাকি, আদার বেপারি জাহাজের…, জিগ্যেস করুন ওই ডান্ডাধারীকে। হে ত্রিশূলধারী, কী হয়েছে ভাই! অমন করে আকাশের দিকে চোখ তুললে কী বুঝব বাপি, মু সে তো কুছ বোল, সেঁইয়া মু সে তো কুচ বোল। পক্ষাঘাত, প্যারালিসিস। বিদ্যুৎ নেই। তবে একটা সিগ্রেট পেলে ধোঁয়া ছেড়ে বলতে পারি, তিনি কখন আসবেন। কখন তুমি গেলে প্রিয় কখন তুমি এলে।

তোর কোনও ফান্ডা নেই বে। মেয়েরা প্রেমে পড়লে ওই রকম একটু করে। কিছুই জানিস না রে প্রেম করচিস। আমার পাঠশালে পড়, ট্রেনিং দিয়ে ছেড়ে দেব, ইউ হিউ হিউ, সব বাজার ক্যাপচার, সব দিল ফ্যাকচার। হোয়াট ইজ দিস। এ কি ল্যাঙ্গোয়েজ। এরা কারা! খালি ট্রামেই এঁদের বাসা। এঁরা প্যারাডাইসের নতুন পাখি। কলকাতার প্রেমিক যুবক সম্প্রদায়ের দুটি স্পেসিমেন। ভাস্কো-ডা-গামার মতো চুল, ইউকালিপটাসের মতো শীর্ণ সবল। আমাদের ভবিষ্যতের ঝুলঝাড়ু।

এইবার তোকে খুব মারব বলে দিচ্ছি অনিন্দ্য। তখন থেকে তুই আমাকে টিজ করচিস। কেন করব না, মাকু। শাড়ি দিচ্ছে, কবরেজি খাওয়াচ্ছে, ভিকটোরিয়ার সবুজ মাঠে ঘাসের চারা লাগাচ্ছে, বাড়ির সামনে বাঁকা শ্যাম হচ্ছে, ঝুলে পড় মাইরি বাপের একছেলে। ওষুধের দোকান আছে, আমাদের মতো ফাঁকা মাঠের কাকাতাডুয়া নয় ইয়ার। ওকি, ওকি! পাবলিক প্লেসে সাতসকালে! ও কিছু না, দেখেও দেখো না সাহেব, উত্তেজিতা, প্রেমিকা যুবতী, যুবকটির লম্বা চুল চাঁপার কলির মতো আঙুলে খামচে ধরে হেঁইসো হেঁইসো করে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে। তা বলে এই ট্রামে! তাতে কি হয়েছে, যে ট্রাম চলে না সেই ট্রাম আর বৈঠকখানায় তফাত কী! মিনিবাসে কিস দেখেছ! সে আবার কী? দেখবে-দেখবে, সব দেখবে, এসেছ যখন সব তোমাকে দেখাব। গড়ের মাঠের গোলকুন্ডা দেখাব। ভূতঘাটের নৌকোর ব্রজবিলাস দেখাব। জাতীয় গ্রন্থাগারে লুকোচুরি, বিশ্ববিদ্যালয়ে হা-ডু-ডু দেখাব।

নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমোই না! তুমি ভাবো আমি কিচ্ছু টের পাই না! ডুবে-ডুবে জল খাই শিবের বাবাও টের পায় না! সব জানি, সব জানি, আমার চোখকে তুমি ফাঁকি দেবে মিঞা! কি টের পেয়েছ! নোংরা মেয়েমানুষ! মুখ সামলে, তুমি মুখ সামলে—মুউখ সামালকে। এটা কী ব্যাপার! সায়েব, এঁরা স্বামী-স্ত্রী, ঝগড়ার স্টক ক্লিয়ারেনস হচ্ছে। সময় নষ্ট করে লাভ কী! ট্রাম চলুক না চলুক, ঝগড়া চলুক।

কী লিখছেন! দাঁড়াও একটু নোট করে নি—অভিমানীর অভিমানী ট্রাম। ট্রামের অভিমান, কামরায় কামরায় অভিমানী যাত্রী। সময় চলে ট্রাম অচল। কলকাতার ল্যাঙ্গোয়েজ—ফান্ডা, এনথু, বে, মিঞা, মাকু হেভি গরম, ক্যালি। নেসফিলড! সেই গ্রামার-লেখা নেসফিলড। সর্বনাশ, তাঁকে আবার নাড়া দিয়ে জাগাবেন কেন! এক গ্রামারেই কুপোকাত, আবার যদি একটা ছাড়েন। বেশ তো চলছে গ্রামার-ছাঁটা ইংলিশ।

এটা কী ব্যাপার হে! সোয়েটার। জানলার ধারে শীতের রোদ গায়ে মেখে জোড়া পা সামনের আসনের পিঠে উঁচু করে ঠেসিয়ে, দিদি আমার বুনছেন! খেয়াল নেই উলের গোলাটা জানলার বাইরে পড়ে গেছে। দাঁড়ান তুলে দি। আপনার নোটবুকে লিখে নিন, ক্যালকাটার হ্যাবিট-এক, চলতে-চলতে রাইট অ্যান্ড লেফট থুতু ফেলা; দুই, যেকোনও দেয়ালে নেচারস লিকুইড কল, কলকল করে ছেড়ে দেওয়া; তিন, ছুটির দিন বই দেখে চিনে খাবার রান্না করা, চাউমিন চাউচাউ, চার, ট্রামে, বাসে, হাসপাতালের আউটডোরে, এমনকি শ্মশানেও সোয়েটার বোনা, খুলে বোনা, বুনে খোলা। দেখবেন? এই যে আপনার বল, এবছর ক’টা হবে? বেশি না গোটাতিরিশ, বোন-পো, বোন-ঝি, ভাসুরপো, গীতার ছোট ছেলের, ঠাকুরপোর, জেসমিনের। বুঝেচি-বুঝেচি। কী বুঝলেন, মার্কো? মাস্ট বি ভেরি রিচ! রিচ, পুওরের ব্যাপার নয়। রেস, নস্যি, সিগারেট, জর্দা, সোয়েটার, জপের মালা, দাদের চুলকুনি—সব এক ক্যাটিগোরির জিনিস।

।। হৃদয়হীন সরকারি বাস ।।

ভালোই, কী বলো! কী ভালো! ট্রাম যদি একেবারেই বসে যায় তাহলে তোমাদের এই হাউসিং প্রবলেম, স্পেস-প্রবলেমের কেমন সহজ সমাধান! এক-একটা কামরা, এক-একটা ফ্ল্যাট। লাইন দিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে দাও, উত্তর থেকে দক্ষিণ, পুব থেকে পশ্চিম। ছোট-ছোট ফ্যামিলি, ছোট-ছোট কামরা। ট্রাম প্লাস হাউসিং, তোমাদের নতুন গ্রামারের নিয়মে সন্ধি করলে, অকারের পর আকার থাকিলে উভয় মিলিয়া নিরাকার মানে ট্রামাউসিং। ম্যালথাস সায়েব সাধে তোমাদের গাল দিয়েচে। মাউসের মতো বংশ বৃদ্ধি করলে ট্রামাউসিং-ই হবে।

বকবক সাহেবকে নিয়ে ডিপোর বাইরে। এই দ্যাখো সায়েব, দোতলা পোড়ো বাড়ি, এর নাম হাউস খাস। পরিকল্পনা—রাজ্য সরকার, পরিকল্পনা—রাজ্য পরিবহন করপোরেশান, ব্যবস্থাপনা—আমরা। পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায় করতে-করতে প্রচুর ধূম আর প্রচণ্ড শব্দ নির্গত করতে-করতে এই গর্ভধারিণী অবশেষ মাঝরাস্তায় গর্ভমোচন করে এলিয়ে পড়েছেন। জঠরের মালেরা সদ্য ডিমফোটা চিকেনের মতো ইতস্তত খেলে বেড়াচ্ছেন। বিবাদিবাগে ভূমিষ্ঠ না হয়ে যদুবাবুর বাজারের কাছে প্রিম্যাচিওর ডেলিভারি। জননী পাষাণী।

ককপিট থেকে লাফিয়ে নেমে এলেন পাইলট। কী হয়েছে ড্রাইভার? এই, ড্রাইভার না, ড্রাইভার না। কী চাষারে! হি ইজ এ পাইলট। কী হল, আমাদের পাইলটদা! উত্তর পাবে না, বৎস। কী হল কন্ডাকটার! আবার! বলুন, পার্টনারদা। উত্তর পাবে না, বৎস। ওই দ্যাখো, ত্রিমূর্তি কাঁধে-কাঁধে হাত রেখে দূর থেকে দূরে ঝাপসা হয়ে গেল, আপনার আমার কাছে ওরা ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব। শূকরশাবকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমরা বাধ্য নই, আমরা অন হিজ ম্যাজিসটিস সার্ভিসে রেভিনিউ স্ট্যাম্পে সই করে মাইনে নি। কমিশান মারি, একমাত্র আল্লাহ কিংবা ঈশ্বরের এক-আধটা প্রশ্নের জবাব দিতে পারি।

পোস্ট মর্টেম করছেন যাত্রীরাই, বোধহয় মা-জননীর অ্যাকসেল ভাঙিয়া গিয়াছে। ধূর মশাই, টাই রড কেটে গেচে। কিস্যু জানেন না, টাই রড কাটলে আর নাক নাড়তে হত না, ডিজেল ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে গেচে। আজ্ঞে না, তাহলে ফোঁটা-ফোঁটা, গিয়ার জ্যাম হয়ে গেচে। ঘোড়ার ডিম জানেন, ভেঁপু লিক করেচে, ঘন্টির দড়ি ছিঁড়েচে। কিস্যু হয়নি দাদা। দোতলার জানলায় একটি হাসি-হাসি মুখ। কে-এ-এ তুমি বসি জানালার ধারে একেলা-আ-আ। ছলনা করি, ছলনা কোওরি। আমি স্টার্টার। টার্মিনাসে আমি টাইট দিয়েচি, আমাদের টাইট দিয়ে গেলো। কিস্যু করার নেই দাদা। জমানা বদল গিয়া, ডান্ডা উঁচা রহে উসলোগোঁকো। ইউনিয়ান, ইউনিয়ান।

মইটা লাগো। মই! ইয়েস, স্যার, বউ ডাল বেঁটেচে, ছাদ পাচ্ছিলুম না বড়ি দেওয়ার, ভগবান ছাদ এনে দিয়েছেন ঝট করে, কয়েকটা ঝালের বড়ি দিয়ে দিক। নাও নাও, উঠে পড়ো, পড়ো উঠে। হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক পারবে। পূর্বদেশের মেয়ে। চারটে-এর সময় চাআটা দিয়েএ যাআস বাআবা। আপনি লাঠি ঠুকে-ঠুকে কোথায় উঠছেন দাদু! অ্যাই বৃঅদ্ধ বয়ওসে গৃহেএঁএঁ বড়ওও গঅন্ডগোওল তাইই এমোওন দোওতলায় একটু সংবাদপত্রটা শাআন্তিতে—

কী লিখছেন মার্কো! লিখছি-সহৃদয়হীন সরকারি বাস, গতির অগতি, অগতিরগতি। স্টপ।

।। তৃতীয় পর্ব : দাম্ভিক ট্যাকসি ।।

পঞ্চম ট্যাকসির ড্রাইভার যখন হাত নেড়ে, সুর্মা-টানা ঢুলু-ঢুলু চোখে ফিচকে হাসির ঢেউ তুলে, গায়ের ওপর আধখাওয়া সিগারেটের টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে বৃহন্নলার মতো এদিকে-ওদিকে এঁকে-বেঁকে সরে পড়ল, মার্কো তখন বললেন, কোনওদিন যদি কলকাতার কোনও ট্যাকসিচালককে একান্তে পাই তাহলে হিপ্লাটিক কোনও ওষুধ খাইয়ে প্রশ্ন করব, মাই লর্ড, কীসের জন্যে তোমরা স্টিয়ারিং ধরে রাস্তায় নামো! একী খেলা সারা বেলা! সায়েব, হায় সায়েব, তুমি জানো না, গুরু, এদের বিহেভিয়ার ব্রহ্মের মতোই প্রশ্নাতীত, তর্কাতীত। যমরাজের মতো এরা কখন কাকে নেবে, একমাত্র এরাই জানে। উত্তরে যেতে চাইলে দক্ষিণে যাওয়ার বাহানা করবে, পুবে যেতে চাইলে পশ্চিমে। আমরা অভ্যস্ত। তবু মার্জারস্বভাব! চেষ্টা করে দেখা, সিকে যদি ছেঁড়ে! গোবর্ধনবাবুর স্ত্রীর লেবার পেন উঠেছিল সকাল দশার সময়। তিনটে অবধি তোলপাড় করেও ট্যাকসি মিলল না। তারপর কী হল, তারপর! হলই না। বছরের পর বছর ঘুরে গেল, হেভি কনস্টিপেসান। ‘হেভি কনস্টিপেসান’ কী ধরনের ইংরেজি! এটা হল বাংলা ইংরেজি—বাংরেজি। ভাষার প্রেজেন্ট জেনারেশানের ব্যাকগিয়ার। ইংরেজি করুন তো—তুমি একটি মাল। ইউ আর এ লাগেজ। আজ্ঞে না, হল না। কলকাতার মালেরা সকাল থেকে মাল খায়। দি লাগেজেস অফ ক্যালকাটা টেক লাগেজেস ফ্রম মর্নিং। হবে না স্যার, হবে না। ডেভিড হেয়ারও হার মেনে যাবেন!

মার্কো নোট বুকে লিখছেন—কলকাতায় দুরকমের ট্যাকসি আছে—কালো আর হলদে। তিন জাতের ড্রাইভার—বাঙালি, বিহারি, পাঞ্জাবি। আচার-আচরণে এঁরা কিন্তু এক জাতি, এক প্রাণ, একতা। বড়ই দাম্ভিক। যাত্রীর ইচ্ছায় গাড়ি চলে না, গাড়ির ইচ্ছায় যাত্রী চলে। কলকাতার লোকের স্বভাব যদিও বাড়িয়ে বলা তবু আজ আমি নিজে প্রত্যক্ষ করলাম উদ্দেশ্যহীন ট্যাকসি কার উদ্দেশে রাজপথে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *