মার্কেট ভিজিট ৭
সে বড় সুখের ভিজিট নয়, সে বড় আনন্দের ভিজিট নয়!
আগেই বলেছি, এমবিএ করে বেরিয়েই আমার প্রথম পোস্টিং ছিল বিহারে, একটি বিখ্যাত পেইন্টস কোম্পানির এরিয়া ম্যানেজার হয়ে।
তখন বিহারে লালুর জঙ্গলরাজের শেষ লগ্ন, কয়েকদিন বাদের নির্বাচনে বিপুলভাবে জিতে আসবেন কুর্মিপুত্র নীতিশ কুমার। দেওয়ালে দেওয়ালে সে লিখন স্পষ্ট। ”যব তক রহেগা সামোসেমে আলু” এই ঘোষণা করে যিনি নিরবধিকাল নিজেকে বিপুল মগধ সাম্রাজ্যের আমৃত্যু একচ্ছত্রাধিপত্যের মৌরসিপাট্টা দিয়েই রেখেছিলেন, বোঝা যাচ্ছিলো তার ক্যারিশমামিশ্রিত কমিক ম্যানারিজম আর কাজ করছে না। ইন্ডাস্ট্রি বলতে সুপারি কিলিং আর কিডন্যাপিং। সন্ধ্যে সাড়ে ছটার পরে পাটনার বোরিং রোডের মতন ”পশ” এলাকাতেও কেউ আর বাইরে বেরোয় না। আত্মরক্ষার জন্যে সব বাড়িতেই খুঁজে পেতে দেসি কাট্টা, বা দোনালিয়া মজুত। চুড়ান্ত অরাজক মাৎস্যন্যায়।
উত্তর-পূর্ব বিহার আক্ষরিক অর্থেই ‘যাদবপুর’। মাধেপুরা, সুপৌল, সহরসা, পূর্ণিয়া, কিষণগঞ্জ, এই বিস্তীর্ণ কোশি বেল্ট জুড়ে যাদবজাতির অপ্রতিহত দাপট। লালু থেকে শরদ, যাবতীয় যাদবকূলপতি আজও এই এলাকা থেকেই ভোটে জিতে আসেন। কিন্তু সেইবারেই বুঝেছিলাম লালুর পতন আসন্ন। গ্রামেগঞ্জে ”বারগত পেঢ়”, অর্থাৎ বটগাছের নিচে গাঁওবুড়াদের হুঁকো মীটিংএ শামিল হবার সৌভাগ্য হয়েছিল। ওনারাও এই ”পঢ়ালিকখা” কচিসাইজের ”বংগালি মানিজার বাবু”টিকে বসিয়ে ঘন সরওয়ালা দুধ (”কিতনা দুবলা হোরে বাবুনা”) খাইয়ে বিস্তারিতভাবে জানিয়েছিলেন কেন এই সমগ্র যাদবকুল এইবারকার ‘ইলেকসনওয়া মে’ কুর্মিহৃদয়সম্রাট নীতিশ কুমারকে ভোট দেবেন। আর এই লালুশাসিত ”রাকশস রাজ” যাদবদের মধ্যে কি সাংঘাতিক মৌষলপর্ব এনে দিয়েছে।
এই বিস্তীর্ণ উত্তরভারতে এখনো ধর্ম, জাতিভেদ, কুসংস্কার ও স্থানিক বিশ্বাসের দাপট দেখলে মলশোভিত, পণ্যফেটিশাক্রান্ত শাইনিং আরবান ইন্ডিয়া আর গাঢ় জাতিভেদপ্রথার নিগড়ে বাঁধা গ্রামীণ ভারতের দুস্তর ব্যবধান স্পষ্ট হয়। আমাদের শৌখিন শহুরে রাজনীতি আর এই রংরেজ দেশের রঙিলা ”পরজা-তন্তরের” মধ্যে কি আকাশপাতাল তফাৎ সে আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
তা সেই টালমাটাল দিনগুলির মধ্যে এক পড়ন্ত ফেব্রুয়ারিতে মার্কেট ভিজিট ঠিক হল বেতিয়াতে। বেতিয়া হল পশ্চিম চম্পারণের ডিস্ট্রিক্ট টাউন, উত্তর পশ্চিম বিহারে। সেখানে দুদিন আগেই জয়েন করেছিলো হিমাংশু কুমার নামের এক নবীন সেলস অফিসার। তার সংগে মোলাকাত করাও জরুরী ছিল খুবই।
পটনা থেকে বেরিয়ে উত্তর এবং পশ্চিম বিহারে যেতে গেলে সবার আগে পেরোতে হয়, একটি দ্রষ্টব্য বস্তু,তার নাম গঙ্গাপুল।
গঙ্গাপুল হচ্ছে পাটনা থেকে উত্তর এবং পশ্চিম বিহারে যাবার একমাত্র সেতু। ব্রিটিশ আমলে বানানো মাল, লম্বায় এগারো কিলোমিটার। সেতুর দু অংশের মাঝের স্ল্যাবগুলি নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে সদাসর্বদা আঁখমিচোলি খেলতেই থাকে। ফলে সর্বক্ষণ আপনি ব্রিজের ওপরে গাড়িতে চলাকালীন গাড়ির চাকার নিচে মা গঙ্গাকে সাক্ষাৎ দর্শন করে সুরধুনী গঙ্গাস্তোত্র আউড়ে পুণ্যার্জন করে ফেলতে পারেন। পড়ে গেলে ডাইরেক্ট বৈকুণ্ঠ, আর ভয় পেলে কিন্তু খেলবো না!
পটনা থেকে প্রথমে গেলাম মুজাফফরপুর। তখন সময় লাগতো ঘন্টাতিনেকের ওপর, (মানে গঙ্গাপুলের ওপরে জ্যামে না আটকালে। আটকালে নো টাইমলাইন। আমার চেনা এক এরিয়া ম্যানেজার একবার এই গঙ্গাপুলের জ্যামে সন্ধ্যে সাতটায় আটকে পরের দিন সকালে পটনায় ঢুকেছিল)।
মুজাফফরপুরে দুদিন উস্তমকুস্তম ম্যানেজারগিরি করে, স্থানীয় ডিলারকে স্যাক করে, (”দেখ লেঙ্গে দাদা, আপ ক্যায়সে ইঁহা ধান্দা করতে হো”। ছোঃ। আমিও শালা বাঙালবাচ্চা বে। কার ইয়েতে কত দম দেখে নেবো), ইত্যাদি ঝামেলা সামলে রওনা দিলুম বেতিয়ার প্রতি।
প্রায় সারা সন্ধ্যে ধরে সাত ঘন্টার জার্নির পর যখন ভাড়া করা এসইউভিটি বেতিয়া ঢুকলো, তখন রাত দশটা।
তখন সারা বেতিয়া টাউনে একটাই হোটেল ছিলো, তার ”স্যুইট রুম” বুক করা ছিলো আমার নামে।
স্যুইট রুমের সুইট বন্ননা দিয়ে আপনাদের ঈর্ষা উদ্রেক করবো না। এসি দূরস্থান। সাদামাটা ঘরে একটা ক্ষীণজীবী বালব আর একটি দুর্গমগিরিকান্তারমরু রিকেটি পাখা ঝুলছে। জল চাইলে নিচের টিউবওয়েলে ক্যাঁচক্যাঁচ করে আওয়াজ তুলে জল তুলে দিয়ে যায়, খাওয়া, স্নান, আর ইয়ে, মানে বাকি সবকিছু ওতেই!!
তবে হ্যাঁ, দারুর বন্দোবস্ত যবরদস্ত। ইলেকশনের আগের টাইম। তৎকালীন আরজেডির ”এম্লেসাহিব” উদারহস্তে টাকাদারুমাংস বিলোচ্ছেন। আমার হোটেলওয়ালা এসে এক বোতল ব্ল্যাক ডগ, দেহাতিস্টাইলে ভাজা ঝাল ঝাল দেশি মুরগির মাংস ভাজা আর স্টিলের বাটিতে বরফের টুকরো দিয়ে গেলেন। সেই সব খেয়ে, তারপর দুর্ধর্ষ ভালো চিকেন কলেজা (মেটে)র ঝাল তরকারি, উরৎকা দাল (অড়হর ডাল) আর ফুলকা রোটি খেয়ে ”হোগা উব্বুত কইর্যা” ডীপস্লিপ নিদ্রাযাপন।
পরের দিন সকালে সোজা মার্কেট।
সাদামাটা মার্কেট। নবীন সেলসকিশোরটিও দেখলাম ভুবনডাঙার মাঠে খেলুড়ে পাবলিক। ফলে বিশেষ কিছুই শেখাবার নেই। চৌখস ছেলে।
দিনের শেষে জিজ্ঞেস করলাম, হ্যাঁ রে হিমাংশু, কাছেপিঠে কোন অপকান্ট্রি মার্কেট আছে?
ছেলে খানিকক্ষণ গোঁজ হয়ে রইলো। তারপর বলল, হ্যায় এক, হরণাটাঁড় বলে, তবে সেখানে কি আমার না গেলেই নয়?
সে কি রে পাগলা? শেয়ালকে তাও ভাঙা বেড়া দেখানো যায়, বাঙালকে তো একদম না! একবার যখন সন্দেহপ্রকাশ করেছিস, তাহলে তো যেতেই হচ্ছে!!
অত্যন্ত অনিচ্ছাসহকারে সে বলে গেলো, ”ঠিক হ্যায়, চলিয়ে”।
পরের দিন সকালে স্নান করে, খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে ডোবানো লিট্টি আর চোখা খেয়ে, পার্ফেক্ট স্যুটেডবুটেড বাবুটি হয়ে রেডি, এমন সময় হিমাংশু এসে আমাকে দেখেই বলল, উঁহু, এসব চলবে না।
কি চলবে না?
এই সাহেবি ড্রেস।
কেনো?
বলবো না। কিন্তু প্লিজ এসব ধড়াচূড়া ছেড়ে শস্তা দলামোচড়া শার্ট, নোংরা শাল আর হাওয়াই চপ্পল পরে যেতে হবে।
টং করে মাথাটা গরম হয়ে গেলো। তুই জানিস আমি কোত্থেকে এমবিএ করে এসেছি? আই আই এম। নাম শুনেছিস বে? তোর চোদ্দ পুরুষ শুনেছে? আমি তোর বস না তুই আমার বস? কে কার কথা শুনে চলবে র্যা ? আমি এই পরেই যাবো।
সে ছেলে খানিকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইলো। তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, চলুন তবে।
খুব যে দূরে জায়গাটা তা নয়, চল্লিশ কিলোমিটার মতন, কিন্তু রাস্তা বলে কিছু না থাকলে তো আর তার জন্যে গাড়িকে দোষ দেওয়া যায় না। ফলে ঘন্টা দুয়েক বাদে যখন হরণাটাঁড় পৌঁছে মাটিতে পা রাখলাম, তখন নিজেকে অমিতাভ বচ্চন কম, কাঞ্চন মল্লিক মনে হচ্ছিল বেশি!
আধা জঙ্গুলে আধা মফস্বল হরণাটাঁড়ে আমাদের বড় ডিলার একজনই। তার কাছে বসে ঘন্টাখানেক কথা বলে পরের জনের কাছে যাবো, রাস্তায় একটা দোকানে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছি, এমন সময় লক্ষ্য করলাম দুই মাঝবয়েসী মক্কেল আমার পাশে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে খৈনি টিপছে, আর মৃদুস্বরে আলোচনা করছে ‘এ হে সেঠওয়া হ কা, হোরা চিট্টা, নয়া নয়া কাপড়া জুতা পহনল বা। বৈঠও একরা কে। পাঁচ দস লাখ কে কাম এয়সেহি হো যাই’। অস্যার্থ, এই কি শেঠ নাকি রে ভাই, দিব্যি ফুলবাবুটি, লতুন লতুন জামা জুতো চড়িয়ে এসেছে। ধরে বসিয়ে রাখ মালটাকে, পাঁচ দশ লাখ তো এমনিতেই এসে যাবে!
শোনামাত্র আমার ঘাড়ের সমস্ত রোঁয়া দাঁড়িয়ে গেলো। বলে কি?
আড়চোখে তাকিয়ে দেখি দুটি প্রায় চল্লিশ ছোঁয়া মুশকো টাইপের লোক, সাদা ফতুয়া আর খাটো ধুতি পরা, মাথায় গামছা বাঁধা, খৈনিটা দু আঙুলে তুলে, বাঁ হাতে নিচের ঠেঁটটা একটু টেনে খৈনিটা দাঁত আর ঠেঁটের মাঝে চালান করে হাত দুটো ঝাড়তে ঝাড়তে এদিকে এগিয়ে আসছে।
দূরে দেখি আমার গাড়ির পাশে অলরেডি একটা জটলা, মানে দৌড়ে পালাবার পথও বন্ধ।
সেই দুটি খৈনিপুরুষ কাছে এসে ভারী বিগলিত হেসে বলল ‘রাম রাম সেঠজি, কঁহা সে আয়েল বানি? পটনা সে?’
জীবনের সেই সংকটতম মুহুর্তে প্রথম বুঝলাম ঈশ্বর কখন কি রূপ ধরে কোন ক্যাবলাকাত্তিককে কেন কৃপা করেন তা বোঝা সত্যিই দায়।
আরও বুঝলাম, সেলস হয়তো অনেককেই ট্রেইনিং দিয়ে শেখানো যায়, কিন্তু জাত সেলসম্যান জন্মায়, তৈরি করা যায় না।
তড়িৎগতিতে হিমাংশু এগিয়ে এসে খ্যাঁক করে হেসে বলল ‘আরে নাহি নাহি চাচা, ই তো নয়া সেলসম্যানওয়া হামার। বহাল ভ্যইল বানি আজ সে। ই লইকা নয়া বা। বংগাল সে আয়িল রহল। আভি তো ই হারামি টেরনিংওয়া লেত বা’।
তৎক্ষণাৎ তাদের একজন দ্রুত ঘুরে ধূর্ত কুটিলস্বরে জিজ্ঞেস করলো ‘তোহার বাপু কা কর লেতানি?’
আবারও সংকটত্রাতা শ্রীমধুসূদন। হিমাংশু গভীর আক্ষেপের সংগে মাথা নেড়ে বলল ‘ই কা বাবুজি তো কিসানি করেলান। নোকরি ভ্যয়ল হ তো একঠো কাপড়া সিলওয়া দেলান হ’।
তবুও জগাই মাধাইয়ের সন্দেহ যায় না, ‘তোহার কিতনা তংখা মিলেলা হ?’
সর্বক্ষণ নোয়া নিজেই নৌকার হাল ধরে অবোধ অপোগণ্ডগুলিকে এই ক্ষুরস্য ধারা, নিশিত দুরত্ময়া পার করাবেন, এ আশা অত্যন্ত অনুচিত। তাছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিংএর চারটি বছর স্রেফ নাটক আর নাট্যচর্চা করেই কাটিয়েছি, সে কথাটাও টক করে মনে পড়ে গেলো। ফলে অত্যন্ত করুন কাঁদোকাঁদো স্বরে বললাম ‘মাহিনা সাড়ে চার হাজার, অউর রোজ কি খোরাকি শ” রূপেয়া তক মিল যাতা হ্যায়। আজ তো আভি তক কুছ নেহি খায়া’।
তবু কিডন্যাপিঙের ভবী কি অত সহজে ভোলে কাকা? পরের পাক্কা এক ঘন্টা ধরে নানাবিধ ভব্য আলাপচারিতার পর প্রভুরা যখন নিঃসন্দেহ হলেন যে এ ভোলানাথ সে ভোলানাথ নয়, তখন দেঁতো হাসি হেসে ” গুড বাই বাডি, কাম ব্যাক এগেইন ” টাইপের শুভাশিস ও আশির্বাণী আউড়ে আমাদের ”যাও পাখি বোলো তারে, সে যেন ভোলেনা মোরে” ঘেঁষা মুক্তি দিলেন।
রাতের জঙ্গুলে মেঠো রাস্তায়, ভাড়া করা গাড়ির হেড লাইটের সেই ঝিমধরা অ্যান্ড মায়াবী আলো আঁধারিয়ামোহিত ঝিঁঝিঁবহুল নিশ্চুপ সান্ধ্যজার্নিতে, আমি সন্তর্পণে সেই ঈশ্বরকে প্রণাম করলাম যিনি লিখেছিলেন,
”অদ্যাপিও সেই লীলা করে গৌর রায়।
কোন কোন ভাগ্যবান দেখিবারে পায়।।”