মার্কেট ভিজিট ৬
মার্চস্য প্রথম দিবসে প্রচন্ড গরমের মধ্যে মুম্বাইয়ের ঘাটকোপার এলাকায় মার্কেট করছি, অবস্থা কহতব্য নয়। বিক্রিবাটার অবস্থা তলানিতে কম বলা হয়। ব্লাডপ্রেশার ক্রমশ গগনচুম্বী, বসের ভ্রুকুটিকুটিল মুখটা মনে করলেই পেটের ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠছে। শেষে ঘামটাম মুছে সেলসম্যানকে সরিয়ে আসরে নিজেই অবতীর্ণ হয়ে এক অতীব খচ্চর রিটেইলারকে বোঝাবার চেষ্টা করছি, যে এই ডাল খেলে চিত্তশুদ্ধি ঘটে,অমরত্ব গ্যারান্টিড, ইহাতে অপুত্রের পুত্র হয় নির্ধনের ধন, ইহলোকে সুখী অন্তে বৈকুন্ঠগমন, এমন সময় হঠাৎ দেখি কোত্থেকে এক শালপ্রাংশু মহাভুজ সাইজের ছোকরা এসে আমাকে সবেগে জড়িয়ে ধরে বলল’ দাদা,আপ ইঁহা? কিতনে দিনোঁ বাদ, ক্যায়সে হ্যায় আপ? ডু ইউ রিমেম্বার মি?’
কোনমতে সেই ভীম আলিঙ্গনের নাগপাশ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে তাকিয়ে দেখি, আরে, এ তো ধ্রুব কাপুর!
নিমেষে মনটা নয় বছর পিছিয়ে গেলো।
আজ থেকে নয় বছর আগে, আমি বিহারে একটি বিখ্যাত পেইন্টস কম্পানীর এরিয়া ম্যানেজার ছিলুম। বছরখানেক হয়েছে বি-স্কুল থেকে পাশ করে বেরিয়ে সেলসের ঘাঁতঘোঁত শিখছি। এমন সময়ে এক বৃষ্টিবহুল সকালে একটি কচি গোছের অতি সভ্যভদ্র প্রাণী আমার কেবিনের দরজায় টোকা মেরেই ঢুকে পড়ে সবিনয়ে প্রশ্ন করলো ‘মে আই কাম ইন স্যার?’
কোন কারণে খ’চে ছিলুম, খ্যাঁক করে বল্লুম, ঢুকেই তো পড়েছেন, আবার অনুমতি চাই কিসের?
দেখলুম ছেলে সহবত জানে। তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গিয়ে ফের দরজা দিয়ে মুণ্ডু বাড়িয়ে বলল, ‘মে আই কাম ইন প্লিজ?’
বুঝলুম ছেলে অতি সরল ও বিনয়ী। ডেকে সামনে বসিয়ে আগমনের হেতু জানতে চাইলে অবগত হলাম, যে ইনি কারেন্ট ব্যাচের ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি। আমার কাছে পাঠানো হয়েছে সেলসের ট্রেইনিঙের জন্যে!
হা হতোস্মি, একেই বিজনেসের এই অবস্থা, তার ওপর এই বোঝা!
জিজ্ঞাসাবাদ করে বুঝলুম আমার কপালে কষ্ট আছে। এমনিতে ছেলে দেখতে এক্কেবারে রাজপুত্তুর। ছ’ফিট হাইট, টকটকে ফর্সা, টিকোলো নাক, গাল দুখানি হিমাচলের আপেল। আরো জিজ্ঞাসাবাদে প্রকাশ পেলো যে ছোঁড়া বনেদী জমিদার বাড়ির ছেলে, বাপ আর্মির কর্নেল। কাপুরথালায় বিশালাকার পুশত্যায়নি হাভেলি সহ ফার্ম, পয়সার ফাদার মাদার আঙ্কেল আন্টি কেউ নেই। সামার ভ্যাকেশনটা সচরাচর ইয়োরোপেই কাটিয়ে থাকেন। পড়াশোনা দুন স্কুলে, ইঞ্জিনিয়ারিং অস্ট্রেলিয়াতে, ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটায় এমবিএ’টা আর হাভার্ডে গিয়ে পড়া হয়নি, আই আই এম আহমেদাবাদ থেকেই ডিগ্রীখানি হাসিল করে এখানে জয়েন করেন।
এবং ট্রেইনিং-পরমার্থহেতু আজ সকালে উনি আমার সকাশে এসে দণ্ডায়মান!
বুঝলাম এইচ আর এর কোন এক রসিক বিধাতাপুরুষ এই বিরাটশিশুকে নিয়ে যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে খেলাটি রচিয়াছেন!
ছেলে দেখলাম ইঞ্জিরি বলে অক্সফোর্ড টাইপ, মশামাছি দেখলে এমন করে যেন সোঁদরবনের বাঘের সংগে হঠাৎ চারিচক্ষুর মিলন! একদিন পথভ্রষ্ট এক চামচিকেছানাকে আমার কেবিনে দেখে ”মি ঘৎ” বলে প্রায় চোখ উলটে কেতরে পড়ছিল। তখনো পাটনায় সাবওয়ে বা কেএফসি খোলেনি। সেই শুনে বাবু চোখফোখ কপালে তুলে জানালো এরকম অবিশ্বাস্য ব্যাপার সত্য ত্রেতা দ্বাপরে ককনো ঘটে না, নেহাত পাটনাতে এখন ঘোর কলি, তাই!
আরও কানাঘুষো শোনা গেলো উনি নাকি পটি করে ধোবার জন্যেও মিনারেল ওয়াটার ইউজ করেন, একদিন নাকি এক্সিবিশন রোডের মোড়ে কোন এক নিরুপায় নিরীহ গরুকে ল্যাজ তুলে পটি করতে দেখে বমি করে ফেলেছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাতে আমার কিছু এসে যাচ্ছিল না বিশেষ। পার্সোনাল কমোড, পার্সোনাল পটি। তদন্তে ও নিজের পার্সোনাল ইয়ে নিজের পয়সায় কেনা যেকোন ওয়াটার, এমন কি গোলাপ জল দিয়েও ধুতে পারে, কার বাবার কি হে??
মুশকিল হল অন্য জায়গায়। ছোকরার জাগতিক জ্ঞানগম্যি প্রায় শিউড়ে ওঠার মতন। দুনিয়াদারির হাটে প্রায় নাদান সদ্যজাত ”সিসু” বললেই চলে। এবং তার সংগে যেটা যাকে বলে সোনে পে সোহাগা, সেটা হচ্ছে দিলতোড় জ্ঞানতৃষ্ণা। সব কিছুই একেবারে গোড়া থেকে তলিয়ে না বোঝা অবধি বাবুর স্বস্তি নেই এক মুহূর্ত।
একবার দায়িত্ব দিলুম ডীলারদের ROI (রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট) নিয়ে স্টাডি করার। উনি খানিকক্ষণ বাদে নালা রোডের সবচেয়ে বড় হোলসেলারের কাছে গিয়ে দাবি জানালেন উনি সেই ব্যবসায়ীকূলপতির ক্যাশবাক্স এক্ষুণি চেক করবেন, তৎসঙ্গে যাবতীয় ব্যাংক একাউন্টস ডিটেইলস। খানিকক্ষণ বাদে দেড়শ কিলোর সেই মাড়োয়ারিতনয় ঘামতে ঘামতে আমার কেবিনে এসেই ধপাস করে পতন ও মূর্ছা, ‘আপলোগ কবসে ছাপা মারনে লাগে?’ অস্যার্থ, আপনারা, অর্থাৎ কম্পানীগুলি কবে থেকে ইনকাম ট্যাক্স রেইড শুরু করলেন?
নিরুপায় হয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে দিলুম অন্য কাজ, এমপ্লয়ী এনগেজমেন্ট সার্ভে। অর্থাৎ আমাদের সেলস অফিসারাদি দুধেভাতে কেমন আছে তার ছানবিন করার কাজ। দুদিন বাদে সবচেয়ে অভিজ্ঞ সেলস অফিসার সমীর সিনহা কেবিনে ঢুকে আমার হাঁটু জড়িয়ে হাউ হাউ করে সে কি কান্না ‘আপনে মেরে সাথ এয়সা কিঁউ কিয়া?’ হতচকিতভাব কেটে যাবার পর তাকে ধুলোফুলো ঝেড়ে চোখের জল মুছিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ঘটনা কি?
কান্নাজড়ানো শ্লেষ্মাবিঘ্নিত গলায় সিনহাসাহেব জানালেন যে দায়িত্ব পেয়েই শ্রীকাপুর সরাসরি সিনহাসাহেবের ল্যান্ডলাইনে ফোন করে শ্রীমতী সিনহাকে নিষ্কাম যোগীর ঔচিত্যপ্রেরণায় জিজ্ঞেস করেন যে মাস তিনেক আগে মিস্টার সমীর যে লাখতিনেক টাকা ইন্সেন্টিভ হিসেবে পেয়েছেন, শ্রীমতী সিনহা তার কি কি সদ্ব্যবহার করেছেন? প্রসংগত উল্লেখ্য যে এই ইন্সেন্টিভের কথা সিনহাসাহেব ঘুণাক্ষরেও কাউকে জানান নি। ফলাফল সহজেই অনুমেয়।
এসব ঝামেলা সামলে তাকে একদিন মোকামা নিয়ে গেছি মার্কেট ভিজিটে, অপার করুণাময় পরমপিতা ঘন্টা কয়েকের মধ্যে আমার সমস্ত মুশকিল আসান করে দিলেন!
আশ্বিনের সেই প্রসন্ন শারদপ্রাতে গঙ্গার ঘাট বরাবর মার্কেট করতে করতে আমার হাওড়ার ইংরেজি দিয়ে এই ক্ষণজন্মা প্রতিভাটিকে কনজিউমার বিহেভিয়ার বোঝাবার চেষ্টায় ছিলাম। মানে ধরুন ডেটল,এর ব্র্যান্ড পার্সোনাললিটি অ্যান্ড ব্র্যান্ড আর্কিটেকচার কি টাইপের? এর বিশেষ গন্ধ, কালার এবং জ্বলুনির স্মৃতি কনজুমারের মনে কি ধরণের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ধারণা তৈরি করে?আর কি কি ব্র্যান্ড অ্যাট্রিবিউট গণমানসে আনুগত্য বা লয়্যালটি তৈরি করে? যেমন ল্যাকমে, কি গুডনাইট, কি লাক্স….
ইত্যাদি সদর্থক আলোচনা করতে করতে কোন এক ঘাটে পৌঁছেছি, হঠাৎ ছোকরা চঞ্চল হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, একটা কনজিউমার বিহেভিয়ারের প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা এখনই করলে আমি কিছু মাইন্ড করবো কি না।
আমি এখনো স্পষ্ট মনে করতে পারি যে আমি খুব একটা ভেবেচিন্তে ‘হ্যাঁ’ বলিনি। যদিও সেটা উচিৎ ছিলো খুবই। কারণ পরমুহূর্তেই দেখি সেই মহাপ্রভু তরতর করে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে একদম শেষধাপে কিছু স্নানরতা রমণীদের প্রতি দ্রুত ধাবমান!
সেখানে তখন এক প্রৌঢ়া রমণী দুটি কচি সদ্যবিবাহিতার সংগে রাত্রিকালীন প্রণয়অভিসার বিষয়ে কুছু নিষ্পাপ বার্তালাপ করছিলেন নিশ্চিত। থেকে থেকে উচ্চকিত বামাকণ্ঠের লজ্জামিশ্রিত হাস্যরোল ভেসে আসছিল।
এমন সময় আমার ভয়ে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া বিস্ফারিত চোখের সামনে দিয়ে, জ্ঞানপিপাসু ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিটি নেমে গিয়ে এক হেমেন মজুমদার চিত্রিত সিক্তবসনা রমণীর কাঁধে টোকা মেরে সুকুমারবর্ণিত ন্যাড়ার মতনই হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হ্যাল্লো ম্যাডাম, গুড আফটারনুন। ক্যান ইউ প্লিজ টেল মি হুইচ সোপ ডু ইউ ইউজ? অ্যান্ড হোয়াই?’
সেকেণ্ডের মধ্যে উত্থিত সেই গগনবিদারী আর্তনাদের মধ্যে দেখি লাঠিসোঁটা নিয়ে কয়েকটি পুরুষ এদিকেই দ্রুত ধাবমান।
বাকি কথা বিস্তারিত বলার দরকার নেই। সারাদিন পুলিশ পঞ্চায়েত সামলে,আমাদের ডিলারের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যখন পঞ্চায়েত প্রধানের গোয়ালে বেঁধে রাখা সেই জ্ঞানতাপসকে উদ্ধার করলাম, উনি মুক্তি পেয়েই ঢকঢক করে একঘটি জল খেয়ে নিজের রিসার্চসমৃদ্ধ মতামতটি প্রকাশ করলেন, ‘বিহারি কনজিউমার্স আর ভায়োলেন্ট, ভেরি ভেরি ভায়োলেন্ট।’
এতদিন বাদে সেই ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখি সেই রাজেন্দ্রপ্রতিম গোরাচাঁদটির চামড়া এখন ঘোর ভারতীয় তাম্রবর্ণ, চোখেমুখের ভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সংগে মিশেছে শান্ত ব্যবহারিক জ্ঞান। স্বভাবজ বিনয় ও ডিগ্রীর সংগে যুক্ত হয়েছে তীক্ষ্ন ক্ষিপ্রবুদ্ধি। সেলসের চাকরিতে বিভিন্ন স্থানকালপাত্রজাতিভাষাবর্ণবহুল অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মাদার ইন্ডিয়া তাঁর এই নাদান সন্তানটিকে ঠিক নিজের মতন করে গড়েপিটে নিয়েছেন নিজের প্রয়োজনেই!
ভারতবর্ষ নামক এই বিচিত্র পাঠশালাটির কাছে ফের নতজানু হলাম।