মার্কেট ভিজিট ৪
কলকাতার সেলস ম্যানেজার সুজন বলেছিলো গড়িয়াহাটের আগে পাল কোম্পানীর বড় কসমেটিক্সের দোকানের সামনেই সেলসম্যান দাঁড়িয়ে থাকবে। অনিবার্য কারনে উনি নিজে উপস্থিত থাকতে পারছেন না বটে (ঝাড়ের নাম বাবাজী আর কি। অনেকেরই আমার সংগে মার্কেট করতে অসুবিধা হয় রে ভাই, বুঝি), তবে ছেলে নাকি খুবই চৌখস আর আমার কোনই অসুবিধা হবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
‘তা তাকে চিনবো কি করে?’
‘আপনি দেখলেই চিনবেন স্যার, ইউ ক্যান্ট মিস হিম (খিক খিক), তাছাড়া ও আপনাকে আগেও মীটিঙে দেখেছে, ওই বরং আপনাকে খুঁজে নেবে ঠিক’।
সেই মতন ঠিক দশটার সময় পাল কোম্পানীর সামনে দাঁড়িয়ে ইতিউতি তাকাচ্ছি, এমন সময় শুনলাম সামনেই কেউ বেশ বলদৃপ্ত ন্ট্রে ডাকল ‘শ্যার’।
কিন্তু কাউকে তো দেখিনা রে ভাই! সকাল দশটায় গড়িয়াহাটের মোড়ে নিশি ডাকল নাকি?
মাথাটা এগারো ডিগ্রী মতন নিচে নামাতেই,
নির্ঘাত এইই সেই।
ছোকরার ডাইমেনশন দেখে বাক্যি হরে গেলো। খানিক্ষণ বাদে ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘তোর নাম কি?’
‘বাবলু মন্ডল স্যার’
‘হাইট কতো?’
‘চার ফুট আট ইঞ্চি স্যার’
‘ওজন?’
‘ঊনচল্লিশ কিলো স্যার’
চমৎকৃত হলাম। এই স্ট্রাকচারে এতো বড় লোড নিচ্ছে, কম বড় কথা নয়!
‘বয়েস কত?’
‘ঊনিশ, স্যার’
‘চল মার্কেটে। কোন মার্কেট আজ?’
‘গোলপার্ক টু প্রিন্স আনোয়ার শা বীটে কাজ আছে স্যার’
‘চল’
‘আমার বাইকে র পেছনে বসুন স্যার’
‘ফেলে দিবি না তো’
‘হি হি। না না স্যার, বসুন না’
‘কবে কিনলি বাইক?’
‘আমার নয় স্যার, স্টকিস রতনদার। আমি চালাই, মাঝে মাঝে মাল ডেলিভারও করি। তাছাড়া রতনদার ছেলেকে স্কুল থেকে এনে দিইই, বউদিকে বাজার এনে দিই….’
বুঝলাম। বাইক চালানোর মূলো দেখিয়ে যতটা নিংড়ে নেওয়া যায় আর কি!
‘বাইক চালাতে ভালো লাগে?’
‘হেবি লাগে স্যার, একদিন তো বুলেট চালালাম। ব্যাপক’।
‘বুলেট চালালি কি রে? বুলেটের ওজন জানিস?’
‘সাইজ দিয়ে কিছু হয় স্যার? ইনজিন কন্ট্রোল করতে জানতে হয়। একবার সাইজ করে ঘাড়ে বসে ব্যলান্স রাখলেই, ব্যাস’
সুজন ঠিকই বলেছিল, ছোকরার চোখেমুখে কথা।
‘হ্যাঁ রে হেলমেট নেই কেন? পুলিশ ধরে কেস দিলে কে বাঁচাবে?’
‘চিন্তা করবেন না একদম স্যার’, ছোকরা দুহাত তুলে অভয়দান করলো ‘আপনি আমার এলাকায় আছেন স্যার। ওসব নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না’
উরিশ্লা, এই দিলতোড় কনফিডেন্স দেখে সন্দেহ হল,
‘হ্যাঁ রে, পার্টি পলিটিক্স করিস নাকি’
‘ওই আর কি স্যার, হেঁ হেঁ’
‘বাড়ি কোথায় তোর?’
‘বারুইপুর স্যার’
মার্কেট করতে করতে চলেছি। আমার চিরকালের অভ্যেস সেলসম্যানদের হাঁড়ির খবর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার করা, টুকটাক করে সে চেষ্টাও চলছে।
‘হ্যাঁ রে, মাইনে কত পাস?’
‘ছয় মত স্যার, ইন্সেন্টিভ নিয়ে সাত হয়ে যায় ‘
‘বাবা কি করেন?’
‘মারা গেছেন স্যার, মাদ্রাসাতে পড়াতেন’
শুনে একটু খটকা লাগলো,
‘হ্যা রে, তোর নাম কি বললি যেন?’
‘বাবলু’, একটু চোরা ইতস্তত ভঙ্গি।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বুঝল আমার আসল প্রশ্নটা কি।
ফিক করে হেসে বলল, ‘আখতার মন্ডল স্যার। ডাকনাম বাবলু’।
তখনও তাকিয়ে আছি দেখে এবার একটু ম্লান হেসে বলল, ‘একটু এই ধরনের নাম বললে কাজ পেতে সুবিধা হয় স্যার’।
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, ‘চ’ ‘চ’, আরও সতেরোটা দোকান বাকি। বাড়িতে কে কে আছেন?’
‘বোন’
মানে??
‘বুঝলাম না হে। শুধু বোন?’
‘হ্যা স্যার, গেলো বচ্ছর আগস্টে মা মারা গেলো। এখন আমি আর বোন থাকি’।
‘কবে থেকে ঢুকলি সেলসে?’
‘সেপ্টেম্বর থেকে’
‘পড়াশুনা করিস’
‘করতাম স্যার, এগারক্লাসে উঠেছিলাম’
বুঝলাম, সবই ওই ”গেলো বচ্ছর আগস্টে” কেস।
‘বোন কত বড়? কি নাম?’
‘এই তো আট ক্লাসে উঠবে। ওর নাম লক্ষ্মী’, বলেই আমার দিকে ঝটিতি চেয়ে যোগ করল, ‘ভালো নাম শবনম’।
‘বোন লেখাপড়া করে?’
‘কি বলছেন স্যার? লক্ষ্মী তো পত্যেক বছর ফাস্ট বা সেকেন হয়। হেবি ব্রেন স্যার। গেলো অ্যানুয়ালে অঙ্কে একাশি পেয়েছে, আর ম্যাথসে সাতাত্তর’।
বুঝলাম কোথাও গুলিয়ে ফেলেছে, কিন্তু ঠিক করে বোঝাবার আগেই ‘বুলেটগাড়ি খুব ছুটেছে’ ভঙ্গিতে তার বাক্যস্রোত দৌড়তে থাকলো, ‘ওর ইস্কুলের হেডস্যার রণেনবাবু বলেছেন ওর মাথা খুব সাফ স্যার। আমাকে বলেছেন বোন যেন লেখাপড়া বন্ধ না করে, অসুবিধা হলে জানাতে’।
এরপর বকবক চলতেই থাকলো। লক্ষ্মীর বুদ্ধিমত্তা, স্বভাবচরিত্র, শিল্পানুরাগ ইত্যাদির বিবিধ ব্যাখান শুনে আমারও কেমন যেন মনে হতে শুরু করেছে যে হাফ কিলো মারি কুরির সংগে আড়াইসের ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল আর পোয়াটাক লীলা মজুমদার মিশিয়ে এই স্ত্রীরত্নটি ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন, এমন সময় খেয়াল হল,
খিদে পেয়েছে, খুব খিদে পেয়েছে।
সামনেই সাউথ সিটি। টপ ফ্লোরে মেইনল্যান্ড চায়না। কথাটা মনে পড়তেই পেটের ভেতর নাড়িভুঁড়ি গুলো পাক দিতে লাগল। শ্রীমান বাবলুকে বললাম, ‘হ্যাঁ রে, তোর খিদে পায়নি?’
‘বেশি পায়নি স্যার, সকালে ভাত খেয়ে বেরিয়েছি তো।’
‘আচ্ছা? কি খেলি?’ হাল্কাচ্ছলে জিজ্ঞাসা করলুম।
‘ভাত’
‘ধুর শালা, সে তো শুনলাম। আর কি?’
খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘গরম গরম ফ্যানা ভাত স্যার, নুন, লঙ্কা আর সর্ষের তেল দিয়ে। ব্যাপক লাগে খেতে’।
‘বাহ বাহ, এ তো রাজভোগ রে। চল, আমার খিদে পেয়েছে, একসঙ্গে খাবো’।
ছোকরা তৎক্ষণাৎ ঘ্যাঁচ করে ব্রেক মেরে দাঁড়িয়ে গেলো, ‘না স্যার, আপনি যান’
‘মারবো কানের গোড়ায় দুই থাপ্পড়, চল বলছি’।
সে অনিচ্ছুক ঘোড়াকে টেনেটেনে মেইনল্যান্ড চায়না অবধি তো নিয়ে গেলাম, ঢুকে দেখি বাবুর হাত পা ঠান্ডা, চোখমুখ ফ্যাকাশে, কথায় উড়নতুবড়ি ছোটানো স্মার্টনেস উধাও। জবুথবু হয়ে সীটে প্রায় সিঁটিয়ে আছে। এসব জায়গায় যে আগে আসেনি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
নাহ, ছোকরা কে একটু উৎসাহ দেওয়া দরকার।
একটা ক্যান্টনিজ নুডলস আর চিলি চিকেন অর্ডার দিয়ে ওর দিকে ফিরলাম।
‘তুই আর বোন ছাড়া আর কোন আত্মীয়স্বজন নেই?’
‘চা-ইয়ে এক কাকা আছেন। ‘
‘তিনি কিছু সাহায্য করেন না?’
ম্লান হাসল, ‘বলেছিলাম। চাচী বললো ওদের বাড়ি কি এতিমখানা?’
‘তোদের কি নিজেদের বাড়ি’
‘না স্যার, ভাড়াবাড়ি। একটা ঘর নিয়ে দুইজনে থাকি’
ততক্ষণে খাবার চলে আসায়, বাধ্য হয়েই এই সদালাপ বন্ধ রাখতে হয়।
মাথা নিচু করে নিবিষ্ট মনে খাচ্ছিলাম, চিলি চিকেনের বৌল থেকে হাফ তুলে নিয়ে। হঠাৎ মাথা তুলে দেখি, ই কি ব্যাপার??
ছোকরা স্রেফ নুডলস খেয়ে চলেছে, চিলি চিকেনে হাত অবধি লাগায় নি।
‘কি রে, চিলি চিকেন টা তোর’।
‘জানি স্যার’
‘জানিস যখন খাচ্ছিস না কেন?’
ফিক করে হেসে ফেলে, ‘রাগ করবেন না তো? ‘
‘না। বল’।
‘এদের বললে আমার চিল্লি চিকেনটা পেলাস্টিকে করে গাডার দিয়ে বেঁধে দেবে না স্যার?’
‘দেবে, কিন্তু কেন?’
‘লক্ষ্মীর খুব চিল্লি চিকেন খাওয়ার ইচ্ছে স্যার। কোন্দিন খায় নি তো। ভাবছি গাডার দিয়ে বেঁধে নে যাই, রাত্তিরে দুইজনে খাবো”খন? আপনি রাগ করলেন না তো স্যার’।
গলায় নুডলসটা আটকে গেলো নাকি?
কে যেন জিজ্ঞেস করেছিলেন না, কতখানি নতজানু হলে কতটুকু বেঁচে থাকা যায়?
কতখানি, ভারতবর্ষ? কতটুকু?
অথ হোস্টেল সিরিজঃ
বিধিসম্মত সতর্কীকরণঃ আমার হস্টেলজীবনের বেশিরভাগ গল্পই সেন্সরের অ্যান্টেনার অনেক ওপর দিয়ে ওড়ে। ফলে সব গুফন কথা ওপেন করে বলায় সামান্য অসুবিধা হ্যাজ। ”অশ্লীলতার দায়ে নবীন লেখককে অমুক থানায় দেওয়া হলো প্রবল কচুয়া ধোলাই,” খবরের কাগজে এমন শিরোনাম গুরুজনেরা খুব একটা পছন্দ করবেন না বলেই বিশ্বাস। অবশ্য বলা যায় না, অনেকে হয়তো সেই আশাতেই বসে আছেন! দিনকাল তো ভাল না। তাই এখানে উল্লিখিত সব গল্পই যাকে বলে সুরূচির উপকূল ছুঁয়ে যাবে। যাদের বাজে ইয়ার্কি অপছন্দ তারা এখানেই ক্ষমাঘেন্না করে ছেড়ে দিন। আর তার পরেও যেসব মহাত্মারা এগোতে চান, মে দ্য ফোর্স বি উইথ ইউ!
শুরু করি তাহলে? জয়ক্কালী
অথ হোস্টেল সিরিজঃ পার্ট ১
পক্ষীদের আদি পিতামহ মহাত্মা শিবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নাকি বাগবাজারেদের উড়তে শেখান।
নরেন্দ্রপুরে আমাদের উড়তে শেখান জনাব মন্ডল। ওনার পিতৃদত্ত নামটি চেপে গেলাম। কারণ ভদ্রলোক এখন দাপুটে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। তার ওপর এই অধমের পাশের পাড়ায় থাকেন। আর আমার ইনশিওরেন্স এর লেটেস্ট প্রিমিয়াম টা খুব সম্ভবত দেওয়া হয় নি, অতএব…
এহেন শ্রীমন্ডল সুহৃদ মহলে বাপ বলে পরিচিত ছিলেন। সঠিক কারণ দেবা নঃ জানন্তি। তবে ডাকনামটি যে আক্ষরিক অর্থে সত্য ছিলো না সে বিষয়ে আমরা অবিশ্যি নিঃসংশয় ছিলাম। সেরকম কিছু হলে খবর চাপা থাকত না।
শ্রীমন্ডল অত্যন্ত নির্বিরোধী নিরীহ ভদ্রলোক ছিলেন। পোচ্চন্ড গাঁজা খেতেন, রাস্তার সাইডে মাথা নিচু করে হাটতেন। কারো সাতেপাঁচে থাকতেন না। কাউকে জ্বালাতেন না, নিজেও জ্বলতেন না।
এহেন নিপাট ভদ্রলোকটি খ্যাতির মধ্যগগনে ওঠেন, যখন, নতুন বাংলার স্যার এঁকে প্রশ্ন করেন ‘আচ্ছা বলত, গফুর ত মুসলমান ছিলো, তবু তার গরুর নাম হিন্দু মহেশ ছিলো কেন?’ বাপ অনেক ভেবেচিন্তে মাথা খাটিয়ে জবাব দেন ‘তার কারণ উর্দুতে ষাঁড়ের কোন ভালো নাম হয় না স্যার, তাই’।
আমাদের গল্প এহেন শ্রীমন্ডলের সবচেয়ে আলোচিত, সবচেয়ে রোমহর্ষক লীলাটি নিয়ে।
একদিন প্রসন্ন প্রভাতে, টেস্ট পরীক্ষা শেষে, দিকে দিকে আনন্দঘন পরিবেশ। শ্রীমন্ডল ঘুম থেকে উঠে নিতান্ত স্বাভাবিক ভাবে স্নানে যাচ্ছিলেন। ঐতিহাসিকরা পরে সাক্ষ্য দেন যে ওইদিন উনি মালঞ্চ’র নুন শো তে ‘লুট গ্যয়ি কুঁয়ারি দুলহন’ দেখা মনস্থ করেছিলেন।
আমাদের হস্টেল গুলো ছিলো স্কোয়ার টাইপের। মাঝখানে খোলা ছোট্ট মাঠ। চারদিকে বারান্দা আর সারি সারি ঘর। চারটে কর্ণারে চারটে গণবাথরুম।
উনি স্নানযাত্রার রাজবেশে, মানে কোমরে একটি শতছিন্ন গামছা জড়িয়ে মন্দ মন্দ মলয় সমীরণে রাজেন্দ্রপ্রতিম আভিজাত্যে হেটে যাচ্ছিলেন।
বাপের রুমমেট ছিলেন অনীশ তালুকদার নামের জনৈক প্রতিক্রিয়াশীল শাসকশ্রেণীর প্রতিভূ, সাম্রাজ্যবাদের দালাল এক তরুণ। তিনি তখন কটিমাত্র বস্ত্রাবৃত হয়ে ইয়ারবন্ধু সমভিব্যাহারে মাধুরী দীক্ষিতের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু রসজ্ঞ আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ করে কী মনে হওয়াতে তিনি শ্রীমণ্ডলের পরিধেয় গামছাটি আকর্ষণ করে ‘বাপ তোর গামছা নেবো, বাপ তোর গামছা নেবো ‘ বলে অত্যন্ত অশ্লীলভাবে এবং কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি করতে থাকে।
কে না জানে, বিয়ন্ড আ পয়েন্ট সমস্ত সাধুপুরুষই ইন্টলারেন্ট। মহামতি আমির খান থেকে শুরু করে আমাদের বাপও তাই। মিনিটখানেক সহ্য করে, ঠিক যে স্টাইলে সম্রাট হর্ষবর্ধন পরিধেয় শেষ বস্ত্রখন্ডটি কুম্ভমেলার জনারণ্যে বিলিয়ে দিতেন, ঠিক সেই স্টাইলে শ্রীমন্ডল ‘গামছা নিবি? এই নে’ বলে গামছাটি খুলে অনীশ এর হাতে দিয়ে বাথরুমের দিকে রওনা দিলেন।
পাঠক, কল্পনা করুন। মাঠের এদিক থেকে ওদিক ধীর কিন্তু দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছেন এক মহাপুরুষ। এই মুহূর্তে তিনি আক্ষরিক অর্থেই দুঃখেষুঅনুদ্বিগ্নমনাসুখেষুবিগতস্পৃহ এক সন্ন্যাসী। পরণে শুধু আঙুলে জড়ানো একটা ব্যান্ডেড। আর বাঁ হাতে বালতি আর সাবান। সারা হস্টেল স্তব্ধ। বাক্যরহিত। বাই চান্স যদি কোন মহারাজ দেখে ফ্যালেন….
বেচারি অনীশের তখন আক্ষরিক অর্থেই সসেমিরা অবস্থা। তারপর শুরু হল মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক অদ্ভুত ঘটনা। অনীশ বাপের পেছন পেছন ঘুরছে ‘বাপ, প্লিজ গামছা পর’। কন্ঠস্বরে সে কি আকুতি। বাপ পুরো সন্ন্যাসীরাজা স্টাইলে সামান্য হেসে বলছে ‘ তোমরা আমাকে গামছা পরতে বলছ? কিন্তু আমি যে গামছা পরতে চাইনি’। সারা হস্টেলে হুলুস্থুলু আন্দোলন। প্রায় সারা হস্টেল বাপের পেছনে হাত জোড় করে বলছে ‘বাপ, প্লিজ গামছা পর’
বাপ কিন্তু ভদ্রলোক। এক কথা। জাগতিক সমস্ত প্রলোভন দুপায়ে মাড়িয়ে বীরদর্পে সে এগিয়ে চলেছে সবচেয়ে দূরবর্তী বাথরুমটির দিকে, পুরো শাহরুখ খান স্টাইলে।
শেষে কি হয়েছিল আমারও ঠিক মনে নেই।
শুধু এটুকু জানি নেক্সট এক মাস বাপকে গাঁজা-আদি জাগতিক ব্যাপারে এক পয়সা খরচ করতে হয়নি।
সেই পয়সা কে বা কারা যুগিয়েছিল সেটা এখানে বলার মতন নীচ আমি কখনওই হতে পারব না!
অথ হস্টেল সিরিজঃ পার্ট ২
আবার সে এসেছে ফিরিয়া!!!
অথ শ্রীমন্ডলের দ্বিতীয় লীলা। তবে আগেই বলে রাখি, গপ্পটা আমার শোনা। অতএব ‘ইহা সত্য কারণ ইহা বৈজ্ঞানিক’ গোছের ডিসক্লেমার দিতে পারবো না।
জনাব মন্ডল উচ্চ মাধ্যমিকের গেরো কাটিয়ে যে ঘাটে মনপবনের নাও বাঁধেন সেটি একটি প্রসিদ্ধ মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। প্রতি বছরই সেই মহাদ্রূমের শাখাপ্রশাখায় দেশবিদেশের বিচিত্র সব পক্ষীকূল বাসা বাঁধে। সেই বিশাল পক্ষীসমাজে অবশ্য শ্রীমণ্ডল জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠতে উনি বেশি সময় নেন নি। অসম্ভব গঞ্জিকাকুশলতার কারণে শ্রীমন্ডলের সতীর্থরা ওনাকে শিবজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতো।
ইতিহাসবিশারদেরা জানাচ্ছেন যে কেমিস্ট্রির প্র্যারকটিক্যালের প্রথম ক্লাসেই উনি সবার সপ্রশংস বাহবা কুড়িয়ে নেন। কোন এক নাদান ব্যাচমেট ভুল করে খানিকটা ইথার খেয়ে’ বাপ, ইথার খেয়ে ফেলেছি, কি করব’ জিজ্ঞেস করে ফেলায় উনি খুবই সুচিন্তিত সৎপরামর্শ দেন, ‘কি আর করবি, পেছনে একটা মোমবাতি গুঁজে জ্বালিয়ে দে’। সেই থেকে খেটে খাওয়া প্রলেতারিয়েত আমজনতার নয়নের মণি হয়ে উঠতে ও প্রবল প্রতাপে রাজত্ব চালাতে বিন্দুবৎ অসুবিধা হয় নাই।
সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনাটি যদিচ ঘটে ফাইনাল ইয়ারে।
রসিক পাঠক মাত্রেই জানেন যে ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফাইনাল ইয়ারে মনটা সদা সর্বদাই তুরীয়মার্গে বিচরণ করে। এই মলিন ধরাধামের সমস্ত নীচ দীনতা, যেমন পড়াশোনা, ভাইভা, প্র্যা কটিক্যাল, সেমেস্টার এক্সাম এসব তুচ্ছ দিনগত পাপক্ষয় থেকে মুক্ত হয়ে এই ব্যাকুল হৃদয় সদা সর্বদাই ‘মন হারাল হারাল মন হারাল’ গাইতে থাকে।
এমন মনকেমন করা ‘শোন, কোন এক দিন’ শ্রীমন্ডলের রুমমেটের ভাই, সাম খোকা, এজেড এরাউন্ড এইট্টিন, দেশের বাড়ি থেকে তার দাদা ও দাদার রুমমেটের জন্যে নাড়ু বা সামথিং লাইক দ্যাট নিয়ে এক প্রসন্ন দুপুরে এসে হাজির।
ভাইটি পেরথম বার দাদার কাছে এয়েচে। দুএকজনকে জিজ্ঞেস করতেই, ‘তোমার দাদা বাপের ঘরে থাকে’ শুনে বেহুদ্দ ঘাবড়েছে। যাই হউক, এদিক সেদিক করে রুম খুঁজে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই ধাঁ!
সারা ঘর গাঁজার ধোয়াতে অন্ধকার। ঘরে এক্সাক্টলি কোথায় কি আছে, কিচ্চু বোঝা যাচ্ছে না। তাকের ওপর ওল্ড মংকের খান চারেক বোতল রাখা। চেয়ারের ওপর একটি প্লেটে বেশ কিছু নিরীহ মুরগির ধ্বংসাবশেষ ছড়ানো। আর তার মধ্যে দুইদিকে দুই বিছানার ওপর মধুর মধুর হাস্যরত দুই ভুবনবিজয়ী বীর।
তখন টেবিলের ওপর একটা ডেস্কটপে শ্রীমতী সানি লিওনির একটি অত্যন্ত শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র চলছিল, যদিচ কোন অজ্ঞাত কারণে সাউন্ড মিউট করা ছিলো।
কিন্তু যা দেখে খোকা বিচলিত এবং পুরোপুরি কনফুজিয়া গেলো, সে হচ্ছে দুই মহাপুরুষই সম্পূর্ণত মুক্তকচ্ছ। আক্ষরিক অর্থেই কটিমাত্র বস্ত্রাবৃত।
ব্যাপারটা খোকার কেমন কেমন লাগল। কিন্তু হাজার হলেও দাদা, চট করে তো কিছু জিজ্ঞেস করা যায় না!
যাই হক, ঘন্টাখানেক নানা রকম ভব্যিযুক্ত আলোচনার পর, জগত ও জীবন সম্পর্কে অসীম জ্ঞান আহরণের পর, ভবিষ্যতের পথে বহুমূল্য কিছু পাথেয় সংগ্রহ করে খোকাবাবু যখন লাল জুতো পায়ে বেরোবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন, শ্রীমন্ডল ঝটিতি একটা রিস্ট ওয়াচ হাতে বেধে নিয়ে বললেন, ‘চ, তোকে নিচে ছেড়ে দিয়ে আসি’।
পুরো সীনটা আপনার মানসনেত্রে কল্পনা করুন পাঠক। নিরালা দুপুরে এক নির্জন করিডর ধরে হেটে যাচ্ছে এক যুবক, জকি আর টাইটান পড়ে, এক কিশোরকে এইটে বোঝাতে বোঝাতে, ‘ফার্স ইমপ্রেসনটাই সব বুঝলি, আর সবসময় ফিটফাট থাকবি, একদম টিপটপ।
নিচে নেমে চলে যাবার আগে খোকা আর পারলো না, জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
‘ইয়ে, মানে আপনারা, মানে তোমরা কি মানে ইয়ে মানে সবসময় (অপাঙ্গে নিচের দিকে তাকিয়ে) এইপরেই থাকো?’
নির্বাণপ্রাপ্ত বুদ্ধদেবের মতো স্মিত হেসে বাপ বললেন,’ ধুর পাগলা, তাই কখনো হয়? আজ তুই এলি বলে জাঙিয়াটা পরলাম’।
ভাইটি নাকি শুনেই এক চলতি ট্যাক্সিতে লাফিয়ে উঠে পড়ে। রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে ঈষৎ স্খলিত স্বরে ড্রাইভারকে বলে, ‘একটু তাড়াতাড়ি চালিয়ে দাদা, সোজা শিয়ালদা, রাস্তায় কোত্থাও দাঁড়াবেন না’।
অথ হোস্টেল সিরিজ পার্ট ৩ঃ
কুষ্ঠিতে ‘বিংশতি বর্ষে উচ্চস্থান হইতে পতনজনিত কারনে রক্তপাত’লেখা থাকায়, আই আই টি তে ইলেক্ট্রিকালে ভর্তি হবার পর আমার ঠাকুমা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘ত’রে ল্যাম্পপোস্টে উঠতে অইব না’তো?’
না। ল্যাম্পপোস্টে উঠতে হয়নি বটে। কিন্তু ফাঁড়া একটা গেছিলো বটে। যে কোনও ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্টের থেকে সে জিনিস কোনও অংশে কম নয়। তার নাম হল’গে, গ্র্যা ন্ড ভাইভা।
গ্র্যান্ড ভাইভা হল গিয়ে আই আই টি খড়গপুরে একটি ভয়াবহ বজ্রপাত সহ ঝড়ঝঞ্ঝা বিশেষ। আয়লা, এল নিনো, পম্পেই, হিরোশিমা আদি সূর্যোগ এর কাছে তুশ্চু, যাকে বলে ফ্ল্যাশ ইন দ্য প্যান। কুম্ভীপাক নরকের সংগে সুলেইমানি দোযখ সাঁইতিরিশ বার গুন করলে সাড়ে দুই পার্সেন্ট মতন এর আইডিয়া হয়।
আপনি যখন ফোর্থ ইয়ারে একটি রসালো চাগরি বাগিয়ে, ‘আমি কি ডরাই সখি ভিখারি সিজিপিয়ে’ আউড়ে, ওল্ড মঙ্ক, হিউম্যান ডাইজেস্ট, গাঁজা, সানি লিওনি ইত্যাদি প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন সাব্যস্ত করেছেন, তখনই এই অনাছিষ্টির ডাক। অত্যন্ত সংগত কারনে আমরা এর উল্লেখ র’ফলা য’ফলা বাদ দিয়েই করতাম।
ইহা কি? রসিকা পাঠিকা, ঘাবড়াইবেন না। ইহা তেমন বিশেষ কিছুই নহে।
ধরুন কোন এক বসন্তের সোনাঝরা সন্ধ্যায় আপনার ডিপার্টমেন্টে এগারোজন প্রফেসর আপনাকে ঘিরে বসেছেন। অন্ধকার ঘর, পুরো জঙ্গলের পরিবেশ, চারিদিকে জ্বলন্ত চোখ আর খিকখিক করে অত্যন্ত অপমানজনক হাসি। সেই আতঙ্কের হাড়হিম করা পরিবেশে আপনার দিকে ইন্টারন্যাশনাল ব্যালিস্টিক মিসাইলের মতন উড়ে আসছে অসভ্য টাইপের কোশ্চেন, আপনি লাস্ট চার বছর কি কি শিখেছেন তার সব কিছুর ওপর। মানে চার বছরে আপনার যা যা শেখবার কতা ছিল, না না উটকো ফালতু ঝামেলায় শিখে উঠতে পারেন নি, পূজ্যপাদ প্রফেসরেরর দল সেই সব হিসেব আজ কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেবেন।
পাঞ্চালীর বস্ত্রহরণ বোধহয় একটু বেশি মানবিক ও সিমপ্যাথেটিক ছিলো এর থেকে।
নিজের কতা কইতে নজ্জা নাগে। শুধু এটুকু মনে আছে, ঘন্টা দুয়েকের পর ওরা যখন খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে জিগাইলেন ‘সরকার বাবু, আপনি তো দেখছি সেরেফ ইয়েমস্তি করে কাটিয়েছেন চার বচ্ছর। আপনাকে তো ডিগ্রীখানি পেরাণে ধরে দিতে পারচি না, গার্জিয়ান কল করতে লাগে। বাবার নাম খানি বলুন ত মশায়’। আমি পাক্কা আড়াই মিনিট চুপ থেকে বলেছিলুম ‘আরেকটু সময় দিন স্যার, মনে করার চেষ্টা করছি’।
কিন্তু মহাত্মা অ্যালেক্স হেইলি মহাগ্রন্থ ‘রুটস’ এর লাস্ট লাইনে বলেই গেছেন, মাঝে মাঝে পরাজিতের লিখিত ইতিহাসও মহত্তর হয়ে ওঠে। আমাদের গপ্প সেই নিয়েই। ওই এক বারই, জাস্ট একবারই ঘুঘুতে আর ধান খেয়ে যেতে পারেনি পুরোপুরি, সেইটাই আপনাদের কমু”অনে।
আমাদের মেকানিকালের শ্রীমান ক্যাবলা, বুইলেন কিনা, চেষ্টাচরিত্তির করে আই আই টি তে ঢুকে পরার পর মা সরস্বতীকে আর বিশেষ ডিস্টার্ব করেন নি। উনি ওঁর মত ছিলেন, ইনি নিজের মতন। কিন্তু ভাইগ্যের লিখন খন্ডাবে কে? এক বর্ষণক্লান্ত সন্ধ্যায় বিরহী যক্ষের পত্রখানির মতই সেই নিয়তির ডাক আসিয়া পৌঁছাইল।
১৯৯৮ এর সেই শীতার্ত বিকেলে মেকানিকাল ডিপার্টমেন্টের ল্যাবে শ্রীমান ক্যাবলা যখন গ্র্যান্ড ভাইভাতে অ্যাপিয়ার হন, তখনো অপেক্ষমান উল্লসিত আটজন প্রফেসর আন্দাজ করে উঠতে পারেননি ঠিক কি ঘটতে চলেছে।
ক্যাবলা সেই আয়রন থ্রোনে অধিষ্ঠিত হতেই সমস্বরে ‘হাউ ইউ আর ফীলিং টুডে ক্যাবলা?’ গোছের প্রশ্ন উড়ে আসে। জবাবে ক্যাবলাসুন্দর ফেঁস করে একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন, যার মর্মার্থ ‘সখি, কি পুছসি অনুভব মোয়?’
এরপর ওনাকে একাদিক্রমে বাইশটি প্রশ্ন করা হয়। আঠারোটির উত্তরে উনি বলেন ‘আই ডোন্ট নো’। বাকি চারটির উত্তরে বলেন ‘আই ক্যান্ট রিকল নাউ’।
এর পর সমবেত খ্যাঁক খ্যাঁক খোউয়া খোউয়া র মধ্যে,
-‘বাপু, তোমার সিজিপিএ কতো এখন?’
-‘ফোর পয়েন্ট এইট আউট অফ টেন স্যার’।
-‘চাকরি পেয়েছ?’
-‘না স্যার’
-‘ক্যাট দিয়েছিলে? পারসেন্টাইল কতো? ‘
-‘সিক্সটি টু, স্যার’
(নেপথ্যে আবার সেই খ্যাঁক খ্যাঁক…)
-‘জি আর ই দিয়েছিলে নাকি? স্কোর কত?’
-‘১১০০ আউট অফ ২৪০০ স্যার’
সমবেত কুরুচিপূর্ণ হাস্যরোলের মধ্যে একজন জিগালেন, ‘সন্টিমন্টি, এই তো তোমার নেকাপড়ার অবস্তা। জীবনে কি করবে কিচু ঠিক করেচ?
-‘হ্যা স্যার, ভাবছি আই আই টি র প্রফেসর হব’।
এর পরের ঘটনার বিশদ বর্ণনা দেওয়াটা বাহুল্য। তবে এটা ঘটনা কে শ্রীমান ক্যাবলা শুধু মাত্র তাঁর নিজের ইচ্ছায় ডিগ্রীখানি পরের বছর গ্রহণ করেন। এখন হীন চরিত্রের কেউ যদি ওই ভাইভাকে এর কারণ হিসেবে দেখাতে চান, তাহলে আমি নেহাতই নাচার।
তবে ক্যাবলার কাহিনী এখানেই শেষ নয়!
শ্রীমান ক্যাবলার বাবা নিতান্ত নিরীহ বাঙালী ভদ্রলোক হলেও মা ছিলেন অত্যন্ত দাপুটে ভাটিন্ডা কি শিখণী। ভবানিপুরে কোনোদিন বাঘ বেরোয়নি, কিন্তু বেরলে যে ওনার দাপটে স্থানীয় গরুদের সংগে একই ঘাটে জল খেতো সে নিয়ে কারও মনেই কোনো সন্দেহ ছিল না। এহেন ভদ্রমহিলার ক্ষেত্রে স্নেহ নিম্নগামী হবার প্রশ্নই ওঠে না। আর তাছাড়া ভাটিন্ডা আর ইতালি পাশাপাশিও নয়।
ফলে ছেলের সংগে প্রফেসরদের মুলাকাতের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেয়েই, কোকিলের কুহুমুখরিত এক বসন্তের বিকেলে উনি নিরীহ হাসব্যান্ড ভদ্রলোকটিকে চুরণীতে বেঁধে, হোস্টেলে এসে হাজির।
শ্রীমান তখন হিউম্যান ডাইজেস্ট নামক একটি অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের ম্যাগাজিন থেকে রস আহরণে কিঞ্চিৎ বিজি ছিলেন। ফলত সঙ্গত কারণেই এই অনৈসর্গিক আক্রমণের জন্যে উনি প্রস্তুত ছিলেন না। ক্ষণকালের মধ্যেই একটি হাড়হিম করা আর্তচিৎকারে আমাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারপর ক্যাবলার রুম থেকে কিছু কাঠের স্কেল ভাঙার শব্দ উড়ে আসে, এবং অনতিবিলম্বে কটিমাত্র বস্ত্রাবৃত হইয়া ক্যাবলার নিজের উইং থেকে অন্য উইংএ দৌড়, অবধারিত ভাবে কার্ল লুইসের কথা মনে পড়িয়ে দেয়।
এর ফলশ্রুতি হিসেবে অনেকটা বাধ্য হয়েই ক্যাবলাকে পরের বছর মা সরস্বতীর সংগে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে আসতে হয়। ভদ্রমহোদয়াও এবার আর সম্পূর্ণ নিরাশ করেননি। টুকটুক করে, কখনো হামাগুড়ি নিয়ে, কখনো লাফিয়ে,নানান ধরনের ‘টেন্স, বাট আন্ডার কন্ট্রোল’ সিচুয়েশনের মধ্যে দিয়ে ক্যাবলাকে লাস্ট সেমেস্টারের গেরো পেরিয়ে ক্যাবলা ফের এসে পড়ল সেই কালান্তক গ্র্যান্ড ভাইভার সামনে!
ভাইভার দিন সকালবেলা থেকেই ক্যাবলা ল্যাবের সামনে। যারই শেষ হয়ে যাচ্ছে, তার কাছে দৌড়ে গিয়ে ‘এই বল না, কি কি জিজ্ঞেস করলো’ বলে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
সব অত্যাচারেরই লিমিট থাকে,প্রফেসরদের কোয়েশ্চেনের স্টকেরও। ফলে মোটামুটি ভাবে দুপুরের মধ্যেই ব্যাপারটা অস্নাত অভুক্ত ছেলেটির আয়ত্তের মধ্যে এসে গেলো।
সেবার প্রায় সব ছেলেকেই একটি বিশেষ প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করা হচ্ছিলো। দুটি বিভিন্ন সাইজের পুলি ( ঞ্ঝন্ডননত্রা) ওপর দিয়ে বেল্ট লাগানো সংক্রান্ত একটি প্রশ্ন। এর পর তাদের স্পীড, রোটেশন, রেডিয়াসের রেশিও, বেল্টের টেনশন ইত্যাকার নানাবিধ রকমফের।
ক্যাবলাও এর প্রতিটি ভ্যারিয়েশনের আনসার হৃদমাঝারে রেখে দিয়েছিললেন,কারণ সোনার গৌর যদি এবারেও উনি ছেড়ে দেন, তার ফলাফল ভেবেই ওনার দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছিল।
ক্যাবলার ডাক আসে প্রায় সন্ধ্যে হবার মুখে।আবার সেই প্রায়ান্ধকার ল্যাব, সেই সব কুটিল কুচক্রী স্যারেরা। সমস্বরে সবাই ‘পধারো মারে দেস’ বলে অত্যন্ত হিংস্র উল্লাসের সংগে ওনাকে ঘিরে বসলেন।
প্রথম প্রশ্নটা ওঁরা একটু সহজই করে ফেলেছিলেন। ক্যাবলাও লুজ বল পেয়েই যথাযথ মর্যাদায় মাঠের বাইরে ফেলতে দ্বিধাবোধ করেননি।
স্যারেরা সচকিত। একটু নড়েচড়ে বসলেন।
এর পর নানান ধরনের আক্রমণ। কখনো বিষাক্ত স্পিনের ছোবল, কখনো হটাৎ উঠে আসা বাউন্সার, তো কখনওবা চোরা ইয়র্কার। বেল্ট এবং পুলির প্রশ্নটির সমস্ত রকমফের জিজ্ঞাসা করা হয়ে গেলো। কিন্তু ট্রু স্থিতধী পুরুষের প্রজ্ঞায়, সমস্ত হীন চক্রান্ত ‘এহ বাহ্য’ বলে হেলায় সরিয়ে ক্যাবলা আজ পুরো রিকি পন্টিং।
স্যারেরা চমকিত। অনেকেই পুলকিত হৃদয়ে আনন্দাশ্রু গোপন করার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ গতবারের ঘটনার জন্যে খুবই অনুতপ্ত ও লজ্জিত। বোধহয় কি ভাবে সেই পাপস্খালন করা যায় সেই চিন্তা শুরু হয়েছে,
এমন সময় হঠাৎ একজন চুড়ান্ত বেরসিক এক প্রফেসর জিজ্ঞেস করে বসলেন ‘আচ্ছা, এইবার বলত, যদি পুলির বেল্টটা মাঝখানে ছিঁড়ে যায়, তাহলে কি হবে?’
মিনিটখানেক চেষ্টা করে ক্যাবলা ন্যায্য ক্রোধে ফেটে পড়লেন, ‘এতগুলো ছেলের ভাইভা হোল, কারও বেলায় বেল্ট ছিঁড়লো না, আমার বেলাতেই ছিঁড়তে হোল?’
প্রফেসরকুল স্তম্ভিত ও হতবাক!
যাই হোক, পৃথিবীতে যে ধম্মোজ্ঞান কিছুটা অবশিষ্ট আছে বোঝা গেলো, যখন সন্ধ্যেবেলায় খবর এলো ক্যাবলা সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
সেইদিন রাতে হাফ বোতল হুইস্কি খেয়ে, শুধু এনসিসি বুট আর তোয়ালে পড়ে ক্যাবলার নাগিন ড্যান্স যদি আপনি না দেখে থাকেন পাঠক, আপনি জানেনই না যে আপনি কি হারিয়েছেন!