মার্কেট ভিজিট ১৭
মুড়ির ঠোঙা হাতে নিয়ে ছোকরার দিকে স্তম্ভিত চোখে চেয়ে রইলাম!
ঘটনাটা তাহলে খুলেই বলি শুনুন।
সেবার গিয়েসলুম জলপাইগুড়ি, বুইলেন। সে ভারী চমৎকার শহর। শান্ত, মধ্যবিত্ত, ভদ্ররুচির জায়গা। ছড়ানো ছিটোনো পাড়া, পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট একতলা বাড়ি, তাদের সামনে বাগান। দেখলেই হাওড়ার শিবপুরে আমার ছোটবেলার শান্ত ছায়াঘেরা পাড়াটির কথা মনে পড়ে যায়। তাছাড়া শহর জুড়ে অত বইয়ের দোকানের কথা ভুললেও চলবে না! একটা শহরে লোকে অত বই পড়ে দেখলেও ভালো লাগে। হাজার হোক, বই বেচুয়ে পাবলিক, কাস্টমার দেখলে ভারী আমোদ আহ্লাদ হয় এই আর কি!
কাজের সূত্রে জলপাইগুড়িতে অনেকবারই গেছি। লোকজন ভারী মিশুকে। দোকানদার থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালা অবধি এমন মিঠে ঘরোয়া ভাষায় বাক্যালাপ করে থাকে যে মনেই হয় না ঘরের বাইরে আছি বলে। তার ওপর ডে লা প্রীতম বলে একটা চমৎকার হোটেল আছে, সেখানে সকালে জুতো পালিশ কমপ্লিমেনটারি! সেলসে চাকরি করার সুবাদে আজ অবধি দেশে বিদেশে অনেক হোটেলে থেকেছি, কিন্তু সাতসকালে ঘরে বেল বাজিয়ে ”জুতো পালিশ করে দিই বাবু?” বলে মুচি এসে জুতো টেনে নিয়ে যায়, এ অভিজ্ঞতা অদ্যাপি কঁহি নেহি হুয়া!
বলতে বাধা নেই, উত্তরবঙ্গকে আমি বড় ভালোবাসি। তার অবশ্য কারণও আছে। জন্ম ইস্তক আমার বেড়ে ওঠাটা আদ্যন্ত শহুরে/ মফস্বলী হয়ে থাকলে কী হবে, গ্রামবাংলা দেখলেই হৃদয় আমার ময়ূরের মতো ট্যাঙ্গো ট্যাঙ্গো জিঙ্গো জিঙ্গো নাচে রে করে ওঠে। জন্মসূত্রে আমি কাঠ বাঙাল, আমার চোদ্দ পুরুষ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে মানুষ। খুব সম্ভবত তাঁদের রক্তের টান চান্স পেলেই আমার শিরায় শিরায় ডান্স করতে থাকে বলেই গ্রামদেশের প্রতি আমার এই আদিখ্যেতা। তার ওপর বাপমায়ের আশীর্বাদে চাকরিটিও এমন করি যে মাসের বেশ কিছুটা সময় ভারতের ”গাঁও দেহাত”এ কাটাতেই হয়। অস্বীকার করবো না, সেই সুযোগ আসা মাত্র বড়ই উৎফুল্ল হই। নিজের দেশ দেখার এই লোভটি আমার বড় প্রবল। গ্রামেগঞ্জের কোনও দোকানে বসে দোকানদার আর ক্রেতার দরকষাকষি আর সুখদুখ কী দো বাতেঁ শোনার মধ্যে আমি অতি বিমলানন্দ উপভোগ করি। ট্র্যা ক্টরের ”আয়েল” কিনতে আসা মধ্যবিত্ত কৃষক, ”ফারচুনার কা লুব্রিকেন্টওয়া” কিনতে আসা হঠাৎ বড়লোক, ”ভটভটি”র তেল কিনতে আসা দরিদ্র অটোওয়ালা, এদের সঙ্গে কথা বলে দিব্যি সময় কেটে যায়। এই সুখটুকুর জন্যই আমার এই অতি অকিঞ্চিৎকর বেচুজীবনযাপন।
সে যাই হোক, বাজে কথায় বেলা চলে গেলো অনেক, কাজের কথায় আসি। কোথা থেকে কথা শুরু হয়েছিলো যেন? ও হ্যাঁ, সেই মুড়ির ঠোঙা।
যাচ্ছিলুম জলপাইগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার। অমন ছায়াঘেরা, মিঠে রোদ্দুরমাখা ঝকমকে রাস্তার কথা বিস্তারে উল্লেখ করে আপনাদের ঈর্ষা উদ্রেক করবো না। শুধু বলে রাখি যে উত্তরবঙ্গের মতো এমন মায়াভরা চিকনসুন্দর জায়গা কমই দেখেছি। তা সেই ঝরঝরে শরতের সকালে যখন কম্পানীর ভাড়া করা ইনোভা চড়ে গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করলাম তখন সকাল সাতটা নয়, পাক্কা সাড়ে আটটা।
সঙ্গে ছিলো বেঙ্গল অ্যান্ড নর্থ ইস্টের এরিয়া ম্যানেজার। সে ছোকরার সবই ভালো, দোষের মধ্যে স্বভাবে বড়ই কল্পনাপ্রবণ ও স্পর্শকাতর। মাঝে মাঝে ব্যাপারটা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। যেমন ধরুন আপনি খুব মন দিয়ে এই মাসে কোন ডিস্ট্রিবিউটরটিকে চিকেন বানিয়ে মুর্গ মসল্লম খাবেন সেই পাঁয়তাড়া কষছেন, তার মধ্যেই ইনি হঠাৎ ছলছল চোখে, ”আচ্ছা বস, কাল যদি আমার বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলের ব্যাথাটা চাগাড় দিয়ে ওঠে তাহলে কী আপনার টার্গেট হবে?”, অথবা ”ধরুন কাল থেকে কম্পানী বললো যে কাজ করতে হবে না, এমনিই মাইনে পাবো, তাহলে কী সঙ্গে ইনসেন্টিভও দেবে? ” ইত্যকার বাজে ও ফালতু সেন্টিমেন্টাল, ডেকামেন্টাল এবং কিলোমেন্টাল ডায়লগ দিয়ে ব্যাপারটা পুরো ভেস্তে দেন। সচরাচর আমি এসব ছল্লিবল্লিতে বিশেষ পাত্তা দিই না, একসঙ্গে ট্যুরে যাওয়ার হলে গাড়িতে উঠে একটা বই খুলে অতি গম্ভীরভাবে চোখদুটো বইয়ের পাতায় চিপকে দিই।
তা এবারেও তাই হলো। আগের দিন রাতে নিতান্ত অকারণে গিন্নীর সঙ্গে ফোনে চাট্টি ফালতু ঝগড়া করে মন মেজাজ ভারী টকে ছিলো। ফলে সকালে রুম থেকে বেরিয়ে গ্যাটম্যাট করে গাড়িতে বসেই খুব ভারী এবং গম্ভীর গলায় ড্রাইভার ছোকরাকে বল্লুম, ‘পৌঁছতে হবে জলদি কিন্তু গাড়ি চালাবে ধীরে, তাড়াহুড়ো একেবারেই করবে না আর টাইমের আধঘণ্টা আগে না পৌঁছলে তোমার নামে আমি এজেন্সিতে কমপ্লেইন করবো, মনে থাকে যেন।’
ছোকরা কী বুঝলো খোদায় মালুম। মুখটা খানিকক্ষণ তুম্বো করে আমার দিকে চেয়ে রইলো, তারপর ছলছল চোখে বললো ‘আচ্ছা স্যার। ধীরেসুস্থে চালিয়ে আপনাকে ঝড়ের বেগে আলিপুরদুয়ার পৌঁছে দিতে হবে, এই তো? চেষ্টা করছি স্যার।’
ইতিমধ্যে এরিয়া ম্যানেজার সাহেব ভারী চমৎকার পারফিউম লাগিয়ে চুপিচুপি আমার গাড়িতে এসে বসেছেন। বোধকরি আমার মেজাজ দেখেই সামান্য ম্রিয়মান মনে হলো তেনাকে। নইলে সচরাচর তিনি গাড়িতে উঠেই ‘বস, যদি কালই ভূমিকম্প হয়ে চাদ্দিকে ধ্বসেটসে যায়, আর যদি কাদাখোঁচাকে হাঁড়িচাচা বলে বলে ভুল করি তাহলে কি আমি নেক্সট ইয়ারে প্রমোশন পাবো?’ এইধরণের প্রশ্ন করতে থাকেন। আজ দেখলাম একেবারে স্পিকটি নট।
তিস্তা ব্রিজ পেরোবার পর দুটো রাস্তা আছে আলিপুরদুয়ার যাওয়ার, একটা জামালদহ হয়ে, বাংলাদেশ বর্ডারের গা ঘেঁষে। তবে নেহাতই বাধ্য না হলে সে রাস্তা কেউ ধরে না। আমরা নিলাম সোজা রাস্তাটা, ধূপগুড়ি, ফালাকাটা হয়ে সিধে যে রাস্তাটা আলিপুরদুয়ার পৌঁছচ্ছে সেটা।
গাড়ি সবেমাত্র ময়নাগুড়ি এসেছে, এমন সময় আমার হঠাৎ জ্ঞানবিতরণের অভ্যেসটা চাগিয়ে উঠলো!
ব্যাপারটা নিয়ে দু এক কথা খোলসা করে বলা দরকার। অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই জানেন যে কচি ছাগলের শিং গজালে সে সর্বত্র তার ধার পরখ করে বেড়ায়। বাঁশগাছ বটগাছে তফাৎ করে না। আমার অবস্থাও খানিকটা তদ্রূপ। নতুন কিছু শিখলেই আশেপাশে সেই জ্ঞানের আলো বিকিরণ করার দুর্মদ ইচ্ছেটা আমার মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে, নিজেকে বেশ লাইটহাউস লাইটহাউস ফীল হতে থাকে। কবি সেই কবেই গেয়ে গেছেন শিক্ষা আনে চেতনা আর চেতনা আনে ভাট বকা। আমি আমার অতি নিরীহ ও নিষ্পাপ সহকর্মীদের ওপর সেই অর্ধপক্ব জ্ঞান দোর্দণ্ডপ্রতাপে লোষ্ট্রবৎ নিক্ষেপ করতে থাকি। তেনারা অতি সুশীল মানুষ, সহনশীল হৃদয়ে এসব প্রলাপ ন্যালাখ্যাপাষু ইগনোরবৎ করে থাকেন।
আগের রাতেই কোথাও একটা স্ট্যাচু বিষয়ক লেখা পড়ছিলাম। তাতে কোনও অশ্বারোহী শহীদ বীরপুরুষের স্ট্যাচুর অশ্বটির সামনের পা ওঠানো না নামানো সেইটা দেখে আরোহী সমরাঙ্গনে শাহাদাত নসীব করেছেন না শান্তির পায়রা ওড়াউড়ির সময় এন্তেকাল করেছেন সেটার ব্যাপারে ভারী মনোজ্ঞ আলোচনা আছে। পড়ার পর থেকে রাতে ভালো ঘুম হয়নি, স্বপ্ন দেখছিলাম নাপোলিঁয় বোনাপার্টের সঙ্গে আউট্রাম ঘাটে বসে রাম খাচ্ছি, এমন সময় রাণা প্রতাপ কোত্থেকে এসে মাথায় গাঁট্টা মেরে বলছেন, ‘ ওই যাচ্ছে ঘটিগরম, ক্যুইক করে দুটো ঠোঙা নিয়ে আয় দিকি।’
সে যাই হোক, হজম না হওয়া সেই জ্ঞানরাজি পেটের মধ্যে বাসি হুইস্কির মতো গজগজ করছিলো। খানিকক্ষণ পর উসখুস করে সে নির্বিরোধী নির্বিবাদী ম্যানেজার সাহেবের উদ্দেশ্যে আলতো করে একটি প্রশ্ন নিক্ষেপ করলাম,
‘ভায়া, কখনও শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে নেতাজীর ঘোড়াটাকে দেখেছো?’
সে ছোঁড়া এতক্ষণ খুবই নিষ্প্রভ এবং ম্রিয়মান হয়ে গাড়ির এক কোণে বসেছিলো। প্রশ্ন শুনেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে সোৎসাহে বললো, ‘হ্যাঁ তো বস, দেখেছি তো। এই কালকেই রাজ মোটর্সে গেছিলাম মার্কেট ভিজিট করতে। সে যে কী বজ্জাত ডীলার আপনাকে কী বলবো! আচ্ছা, বস কাল যদি আমরা ওটাকে বন্ধ করে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে তাঁবু টাঙিয়ে ল্যুব বিক্রি করি?’
‘পুরসভা আর পুলিশ যৌথভাবে এসে তোমাকে পালিশ করে যাবে’, খুবই বিরক্তি সহকারে খেঁকিয়ে উঠি। কথা হচ্ছে ঘোড়া নিয়ে এমন সময়… ‘বলি ঘোড়াটাকে কখনও ভালো করে দেখেছো কি?’
‘দেখেছি বৈ কি!’
‘দেখেছো তো বুঝলাম, তা সেই ঘোড়াটার মধ্যে বিশেষ কোনও বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছো ভায়া?’ জলসাঘরের বিশ্বম্ভরবাবুর মত অটল আভিজাত্যের সঙ্গে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম। ডানহাতের কবজিটা অজানতেই নাকের কাছে উঠে এসেছিলো। সেখানে বেলফুলের মালা জড়ানো নেই দেখে নেহাত মনঃক্ষুন্ন হয়েই হাতটা সন্তর্পণে নামিয়ে নিলাম।
‘হ্যাঁ তো, তাও করেছি বস।’ খোকার স্বরে সেই দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় আমাকে চমকে দেয়।
‘সেটা কী?’ নিজের স্বরে সন্ধিগ্ধভাবটা আর গোপন করা যায় না।
অবিমিশ্র সারল্যের সঙ্গে উত্তর ভেসে আসে, ‘লক্ষ্য করে দেখেছি ওটা একটা পুরুষ ঘোড়া, বস।’
স্তম্ভিত হয়ে সে দিকে চেয়ে থাকি। অমন একটা স্থাপত্যের মধ্যে তুই শুধু ঘোড়ার ইয়েটাই দেখলি? হ্যাঁ রে, তোর চোখে কি ইয়ের ফিল্টার লাগানো আছে? এই অশ্লীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আমার মনের মধ্যে একটা তীব্র বিদ্বেষ ঘনিয়ে উঠতে থাকে। বলি দেশ জাতি সমাজ, এদের কাছে তুই মুখ দেখাবি কী করে? ছ্যা ছ্যা ছ্যা, কাদের নিয়ে সংসার করি!
ভাবতে ভাবতে নিজেই গভীর মনোযোগের সঙ্গে ভাবার চেষ্টা করছি যে হাতিবাগান না বাগবাজার, কোনদিক থেকে এলে ঠিক বোঝা যাবে যে ওটা পুরুষ ঘোড়া কি না, এমন সময় একটা বিচ্ছিরি খুঁক খুঁক আওয়াজ শুনে দেখি আমাদের ড্রাইভার সাহেব গাড়ি চালাতে চালাতে প্রবলভাবে হাসি চাপার চেষ্টা করছেন!
আমরা দুজনেই একটু অবাক হলাম, বলাই বাহুল্য। সচরাচর সেন্টার থেকে ভাড়া করা গাড়ির ড্রাইভাররা অতি ভব্যসভ্য হন। প্রয়োজনের বাইরে একটিও বাড়তি কথা বলেন না। কোনও হাসি ঠাট্টার কথা তো ভাবাই যায় না। ইনি হাসছেন, এবং বেশ শব্দ করে, বডি কাঁপিয়ে হাসছেন।
‘স্যার কিন্তু ভারী ইয়ে আছেন’ ড্রাইভার সাহেব খ্যাঁক করে হেসে বক্তব্য পেশ করলেন।
‘বটে?’ ম্যানেজারবাবুর গলায় স্পষ্টই ঝড়ের আভাস।
‘আচ্ছা স্যার,’ এবার আমার উদ্দেশ্যে, ‘আপনি কখনও শিবাজী মহারাজের স্ট্যাচু দেখেছেন?’
দেখেছি তো বটেই, গোটা চারটে বছর মুম্বাইতে কাটালাম, গাদাগুচ্ছের দেখেছি।
‘আপনি মুম্বাই ছিলেন স্যার?’ সে প্রায় লাফিয়েই ওঠে, ‘আমি তো এগারো বচ্ছর ওখানে ছিলাম স্যার। ডোম্বিভিলিতে থাকতাম, আর এক বিল্ডারের গাড়ি চালাতাম।’
এইবার বেশ কিছু টুকটাক কথাবার্তা শুরু হয়। মুম্বাইয়ের লোক ও লোকাল, কাজ ও কর্ম, অটো ও বৃষ্টি নিয়ে বেশ কিছু চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা শেয়ার করি।
এমন সময়ে সঙ্গী ভদ্রলোক ধরে বসেন, ‘বস, মুম্বাইয়ের কিছু গল্প বলুন না।’
সেই লোকাল ট্রেনের গল্পটা দিয়ে শুরু করি। এক বেচারা দেহাতি লোকাল ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে কীরকম নাজেহাল হয়েছিলো সেই গল্প। তারপর বৃষ্টির রাতে অটো ধরে বাড়ি ফেরার গল্প। লোকাল ট্রেনেই কার একটা লুঙ্গি উড়ে যাওয়ার গল্প, ইত্যাদি। এবার দেখি খ্যাঁকম্যাক করে দুজনেরই সে কী হাসি! গাড়ি কেঁপে কেঁপে উঠছে প্রায়!
ততক্ষণে বীরপাড়া পেরিয়ে গেছি, হাসিমারা আসবে আসবে করছে। জলদাপাড়ায় গাড়ি থামিয়ে চা বিস্কুট খাওয়া হলো। বলা বাহুল্য, এসব খরচা যাত্রীকেই মেটাতে হয়। চুক্তিমত এজেন্সিকে ড্রাইভারদের খরচা বাবদ যা পেমেন্ট করি তার মধ্যে খাওয়া খরচাও ধরা থাকে বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি এঁদের চা বা লাঞ্চ খাইয়ে থাকি বা টাকা দিয়ে থাকি। একে এঁরা যে টাকাটা পান সেটা হাস্যকরভাবে কম, তাছাড়া লম্বা জার্নিতে যাই, ড্রাইভার সাহেবরা খুশি থাকলে কাজেকর্মে একটু সুবিধা হয় আর কি! ক”টা টাকারই বা মামলা?
কুচবিহার পৌঁছত পৌঁছতে সাড়ে এগারোটা। তারপর সেখানে কাজকর্ম মিটিয়ে যখন শঙ্কর হোটেলে ঢুকলাম তখন বাজে প্রায় দেড়টা, খিদের চোটে পেট চুঁইচুঁই করছে।
খাওয়া দাওয়া মেটাতে মেটাতে প্রায় সোয়া দুটো। লাঞ্চের পর একটা পান খাওয়া আমার বরাবরের শখ। সেসব বায়নাক্কা মিটিয়ে রওনা হতে হতে প্রায় আড়াইটে।
ফিরতি পথে যখন জলদাপাড়া পেরোচ্ছি, রাস্তার ওপর গাছের ছায়া ক্রমেই লম্বা হয়ে আসছে, এমন সময় ড্রাইভার সাহেব, (এতক্ষণে বছর তিরিশেকের ছেলেটির নাম জেনে গেছি, জামাল) ইরশাদ করলেন ‘স্যার, জমিয়ে গল্পগুলো বলছিলেন মাইরি, আরও দু এক পিস ছাড়ুন না।’
কী আর করা। আগডুম বাগডুম দু একটা গল্প বলতেই হলো। খেয়াল করলাম বিকেল নেমে আসছে। চারদিকে ঘন জঙ্গল, বেশ একটা গা ছমছমে পরিবেশ। মওকা বুঝে একটা চেনা গল্প বলতে শুরু করলাম,
‘একটা গল্প বলি শোনো। অনেকদিন আগের কথা, বুঝলে। তখন দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানীর রাজত্ব। ভোপাল নবাবের একটা গোপন খবর নিয়ে আহমেদ খাঁ বলে একটা লোক যাচ্ছিলো সগরে। সগর মধ্যপ্রদেশেরই একটা শহর। একে সেই সময় দেশে আইনকানুন বলে কিছু ছিলো না, তার ওপর রাস্তাঘাটের অবস্থা ছিলো খুব খারাপ, প্রাণ হাতে করে যাতায়াত করতে হতো। কারণ একদল লোক, বুঝলে কী না, গরীব পথিকদের সঙ্গে রাস্তাতেই আলাপ জমাতো। তারপর রাতের অন্ধকারে….’
গল্পটা বলতে লাগলো প্রায় মিনিট কুড়ি। এতক্ষণ দুজনের কেউ কথা বলেননি। গল্প শেষ হওয়ার পর ম্যানেজার সাহেব শুকনো ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় গলায় বললেন, ‘জামাল, গাড়িটা একটু সাইড করো তো ভাই, ইয়ে করবো।’
শুধু তিনি কেন, গাড়ি থামিয়ে জামালও যেভাবে ঝোপঝাড়ের দিকে দৌড়ে গেলো, দেখে বোঝা গেলো যে প্রকৃতিদেবী অনেকক্ষণ থেকেই দুজনকে ঢালাও আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন।
তারপর বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ। গাড়ি তখন বীরপাড়া ছাড়িয়ে প্রায় ধূপগুড়ির কাছে। গাড়ি থামিয়ে ফের একপ্রস্থ চা জলখাবার খাওয়া হলো।
‘আরেকটা গল্প শুনবে নাকি হে?’ গাড়িতে বসেই বেশ সহাস্যে জিজ্ঞেস করলুম।
সঙ্গী ভদ্রলোকটি হাঁ হাঁ করে উঠতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই জামাল সম্মতি জানিয়ে ফেলেছে, ‘আরেকটা বলুন তো স্যার। তবে অত পুরোনো কালের গল্প নয়, স্যার। শুনলেই কেমন ভূতভুতুম করে। ‘
‘একালের গল্প শুনবে? তাহলে শোনো,’ এই বলে আমি আরেকটা চেনা গল্প শুরু করলাম, ‘সাউথ কলকাতায় নেতাজীনগর আছে না? সেখানে আমার এক চেনা লোক থাকে, বুঝলে, নাম অতীন। বাপ মা নেই, একটা এফএমসিজি কম্পানীর ট্রেড মার্কেটিং এ চাকরি করে। খুব ভদ্র ছেলে, কোনও নেশাভাং নেই, ব্যবহার অতি মার্জিত। নেশা বলতে শুধু কিউরিও থেকে পুরোনো জিনিসপত্তর কেনা। এইভাবেই একদিন তার হাতে একটা একটা অদ্ভুত মূর্তি এলো….’
এটা শেষ হতে প্রায় মিনিট পঁচিশ। তখন ময়নাগুড়ি ছাড়িয়ে গাড়ি আরেকটু এগিয়েছে, তিস্তা ব্রিজ পার হবো হবো করছি। অখণ্ড নৈঃশব্দের মধ্যে ব্রিজটা পেরোলাম। তিস্তার শুকনো খাতে চাঁদের আলোয় বালি চিক চিক করছে। দু একটা বাইক ছাড়া আর বিশেষ জনমনিষ্যি নেই। আকাশে ভুতুড়ে চাঁদ, ঘোলাটে মেঘে আদ্ধেক ঢাকা।
এমন সময় ব্রিজটা পেরিয়েছি কি পেরোইনি, একটা চায়ের গুমটির সামনে গাড়ি থামালো জামাল। শুকনো গলায় বললো, ‘একটু চা খেয়ে নিই স্যার?’
আমারও পরাণডা চা চা করছিলই, ফলে অনুমতি দিতে দুবার ভাবতে হয়নি। ম্যানেজার সাহেবকে দেখে মনে হলো সীটে পুরো জমে গেছেন, তেনাকে বোধহয় বেলচা দিয়ে তুলতে হবে!
সে যা হোক, তিনজনে নেমে টিমটিমে হ্যারিকেন জ্বলা গুমটির দিকে হাঁটা মারলাম। গিয়ে দেখি দোকানী ভদ্রমহিলা উনুনে সবে আগুন দেবেন দেবেন করছেন। জামাল দাঁত কেলিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কী গো মাসি, আজ দেরী হলো যে বড়?’
প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা পানের ছোপ ধরা দাঁত মেলে বললেন, ‘ছেলেটাকে ডাক্তার কাছে নিয়ে গেছিলুম বাবা। কয়েকদিন ধরে জ্বরজারিতে বড় কাহিল হয়ে আছে বেচারি।’
মাসি ভাইপোর এই স্নেহালাপ হয়তো অনেকক্ষণ চলতো। কিন্তু তখন আমি ফুল নাটুকে মুডে আছি, সাইত্যস্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই সুনীল! উনুনের অল্প আঁচের দিকে চেয়ে হেঁড়ে গলায় আবৃত্তি করলাম, ”নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে।”
বলেই গর্বে ইতিউতি চেয়েছি কি চাইনি, প্রৌঢ়া মৃদু হেসে বললেন, ‘আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি বাঁচার আনন্দে!’
আমি তো মাইরি টোটাল হুব্বা! মানে? হাই রোডের পাশের গুমটির মালকিন শঙখ ঘোষ আওড়াচ্ছে?
মাথা নাড়লুম, দিন দিন প্রেজুডিসড হয়ে যাচ্ছি। ভুলে গেসলুম যে এটা নর্থ বেঙ্গল। জায়গাটাকে আমি অকারণে এত ভালোবাসি না।
বাকি দুজন ততক্ষণ আয়েশ করে বসে গপ্প জুড়েছেন। কিছু পরে চা এলো। আমি আবার র”টী খাই। মাসি দেখলাম যত্ন করে একটু আদা আর চাট মশলাও দিয়েছে। তাতে চায়ের স্বাদ দিব্যি খোলতাই হয়েছে, আমি এক চুমুক খেয়ে সজোরে বল্লুম, ‘বাহ, চমৎকার চা। সুন্দর চা। দিব্যি ভালো চা।’
চা খেয়ে দাম দিয়ে উঠে আসবো, এমন সময় জামাল বললো ‘সে কী স্যার, উঠে যাচ্ছেন যে, মাসীর ইসপেসাল মুড়িটাই তো খেলেন না। ওটার জন্যই তো গাড়িটা দাঁড় করালাম।’ বলেই একটা হাঁক পাড়লো, ‘ও মাসী তোমার ইসপেসাল মুড়ি তিনটে দাও দেখি।’
তখন যে আমার মুড়ি খাওয়ার খুব একটা ইচ্ছে ছিলো তা নয়। তবে কি না ”ইসপেশাল” মুড়িমাখা। ভাবলুম খেয়েই দেখি, খুব খারাপ হলে গাড়ি থেকে জানাল গলিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবো না হয়।
এইবার ভদ্রমহিলা একটা উনিশশো সাতচল্লিশ সালের ভাঙাচোরা মগে মুড়ি, বাদাম, চানাচুর, সর্ষের তেল নিয়ে মাখতে শুরু করলেন। যে সব রংচটা মলিন প্লাস্টিকের কৌটো থেকে ভদ্রমহিলা এসব মালমশলা বার করছিলেন সেসব দেখলেই সেই অনৈসর্গিক মুড়িমাখার ওপর থেকে ভক্তিশ্রদ্ধা চটে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবুও যাবতীয় বিতৃষ্ণা গোপন করে ওয়েট করতে থাকলুম, হায় আল্লা এসবও খেতে হবে নাকি এখন? তাও পয়সা দিয়ে?
মুড়িমাখা শেষ হলো, ভদ্রমহিলা তিনটে ঠোঙায় মুড়ি ঢেলে এগিয়ে দিলেন। পকেট থেকে ওয়ালেট বার করে টাকা দিতে যাবো, এমন সময় দেখি জামাল বুক পকেট থেকে টাকা বের করে তার মাসিকে দিয় ঠোঙাগুলো নিজের হাতে নিলো। আমি সামান্য বিস্মিত হলাম, এমন তো হওয়ার কথা নয়। এসব ক্ষেত্রে সচরাচর আমারই পেমেন্ট করার কথা।
তবে বিস্ময়ের তখনও বাকি ছিলো। সে ছোকরা একটা ঠোঙা নিয়ে এসে আমার হাতে দিয়ে ভারী সলজ্জ ভঙ্গিতে বললো, ‘সারাদিন ধরে হেবি এন্টারটেইনমেন্ট দিলেন স্যার। নিন, এইটা আমার পক্ষ থেকে। আপনাকে খাওয়ালুম!’
মুড়ির ঠোঙা হাতে নিয়ে ছোকরার দিকে স্তম্ভিত চোখে চেয়ে রইলাম !
খুব ছোটবেলায় একবার মামা”র হাত ধরে যাত্রা দেখতে গেছিলুম। সালটা উনিশশো চুরাশি নাগাদ, তখন আমার বয়েস পাঁচ কী ছয়। তখনও হাওড়ার মফস্বলে যাত্রাটাত্রা হতো, যদিও দ্রুতই সেই পাট উঠে যায়। যাত্রাটা ছিলো কোনও এক ধর্মীয় চরিত্র নিয়ে, খুব সম্ভবত রাজা হরিশচন্দ্র। সে মশাই মেলোড্রামার একেবারে হদ্দমুদ্দ, কোথায় লাগে সুখেন দাস, কোথায় লাগে নিরূপা রয়! প্রতিটি সীনে সামনের শতরঞ্চিতে মহিলাকূলের রোলারুলি, এদিকে ওদিকে পূরুষ দর্শকদের মধ্যেও ফ্যাঁচফেঁচ। এদিকে কে তার নাক ভুল করে অন্য কারও লুঙ্গিতে মুছে ফেলেছে, সে নিয়ে আবার এক অন্য বাওয়াল।
তবে যেটা আশ্চর্য লেগেছিলো সেটা হচ্ছে যে যাত্রার শেষে মূল চরিত্রাভিনেতারা ধরাচূড়া পরেই সেই তিনদিক খোলা স্টেজে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন, আর দর্শকরা স্টেজে উঠে গিয়ে তাঁদের প্রণাম করে সামনে রাখা কৌটোতে প্রণামী রেখে আসছেন। বেশিরভাগই একটাকা বা দুটাকা দিচ্ছেন, পাঁচটাকা দান করা সেযুগে মস্ত বড় ব্যাপার ছিলো। কম লোকই তা করতে পারতেন।
তখন ব্যাপারটা অদ্ভুত লেগেছিলো বটে। এখন বুঝি, যাঁরা সেযুগে যাত্রা করে আমজনতার মনোরঞ্জন করতেন তাঁদের টাকাপয়সা এতই কম ছিলো যে পারিশ্রমিকের কিছু টাকা এভাবেই উঠে আসতো।
শুধু কি তাই? তার মধ্যে কি কিছুটা প্রশংসাও মিশে থাকতো না? মিশে থাকতো না এই অনুচ্চ ঘোষণা, ”হে কলাবিৎ, আপনার অভিনয়নৈপুণ্যে আমি তৃপ্ত। দয়া করে তার স্বীকৃতি স্বরূপ এই একটি টাকা স্বীকার করুন?” সেই একটি টাকার মধ্যে দয়া বা পুণ্যকামনার সঙ্গে শিল্পীর প্রতি কিছুটা শ্রদ্ধাও মিশে থাকতো না কি?
হোটেল পৌঁছনো ইস্তক সেই বিদুরের খুদ একটু একটু করে তারিয়ে তারিয়ে খেলাম। তার যেমন সোয়াদ, তেমনই সুতার। এখনও জিভে লেগে আছে।