মার্কেট ভিজিট ১৬

মার্কেট ভিজিট ১৬

দিল্লি থেকে কলকাতা ফিরছিলাম দুরন্ততে, কালকেই।

কেন জানি না, আমার সব সফরেই অতি অল্প হলেও বলার মতন কিছু না কিছু ঘটে। তারই কিছু বেঝেবুঝে আপনাদের পায়ের কাছে ‘মার্কেট ভিজিট’ বলে পেশ করি। আপনারাও যে নেহাত স্নেহজড়িত কারণে নাদান বালকের এই দুর্বল প্রচেষ্টায় করুণাবশতই ঠেকা দিয়ে চলেন তাও বুঝি। এবারেও প্রায় সেরকমই একটা ঘটবে বুঝতে পেরেছিলাম, যখন আমার সিটের উল্টোদিকে তিনি এবং তাঁর দিদিমা এসে অধিষ্ঠান হলেন।

দিদিমার বয়েস পঞ্চাশ প্লাস। ‘তিনি’র মা তাঁকে স্টেশনে ছাড়তে এসেছিলেন, মায়ের বয়েস ৩২ এর মতন, এবং অত্যধিক পৃথুলা, দেখলেই আমার নিজের বোনের কথা মনে পড়ে!

বোঝা গেলো যে দিদিমা মাস তিনেকের জন্যে নাতনিকে নিয়ে কলকাতা যাচ্ছেন। মা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, তেনার কাজ আছে দিল্লিতে, তাই তিনি যেতে পাচ্ছেন না। আর ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সেই বছর তিরিশের মা যখন জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের রক্তপুত্তলিটির দিকে চেয়েছিলেন, সে সজলকরুণ দৃষ্টি দেখিয়া যাহার হৃদয় দ্রব হয় না, সে পাপমতি নির্ঘাত পাষাণ, অবশ্যই পাষাণ!

ও, বাই দ্য ওয়ে, তেনার বয়েস হচ্ছে দুই!



নাম? টিয়া। মানে Tia.

তা ট্রেন ছাড়ার পর কথাবার্তা শুরু হলো। ওঁরা যে ক্রিশ্চান সেটা দিদিমার মোবাইলের স্ক্রিনসেভারে প্রভু যীশুর ছবি দেখে দিব্যি বুঝেছিলাম। এঁরা সপরিবারে ডেট্রয়েটে থাকেন, দেশে ফিরলে গুরগাঁওয়ে কিনে রাখা দামী ফ্ল্যাটে ওঠেন। দিদিমা কলকাতা যাচ্ছেন তাঁর মায়ের সঙ্গে নাতনির দেখা করাতে! দিদিমার মায়ের বয়েসও আশির ওপর। লাস্ট মোমেন্টে ফ্লাইটের টিকিট পাননি তাই….. এঁদের পরিবারের কথাবার্তার মাধ্যম আবার ইংরেজি। এবং শুধু ইংরেজি নয়, চমৎকার ব্রিটিশ ইংলিশ, মার্কিনি সস্তাংরেজির চিহ্নমাত্র নেই।

কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে ব্যাপারটা খোলাসা হলো। দিদিমা লোরেটো বউবাজারের মেয়ে। একে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, তদুপরি লোরেটো। ফলে ইংরেজিটা প্রাণপাত করেই শিখেছেন। এবং শুধু ল্যাংগুয়েজ নয়, লিটারেচারেও দেখলাম তিনি অনন্যা। জেন অস্টেন থেকে বিক্রম শেঠ অবধি অবাধ গতিবিধি!

আমিও মশাই লাইনের লোক, কথায় আলাপ জমাতে দেরি হলো না। আর সামান্য আলাপ জমতেই বাঙালির যা সাধারণ প্রশ্ন, জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,

বাড়ি? কোথায় যাবেন কলকাতায়? আমি লেকটাউন যাবো। আপনি?

উই আর গোইং টু বো ব্যারাকস। হার্ড অ্যবাউট দ্যট?

প্রথম যৌবনের অনেক যন্ত্রণার কথা মহর্ষি অঞ্জন দত্ত বলে দিয়েছেন বছর বিশেক আগে। সেই থেকে বো ব্যারাকস চিনি বৈ কি! কলকাতার মধ্যে সে এক গাঢ়তর কলকাতা! সেলসের কাজেও অনেকবার মার্কেট ভিজিট করতে হয়েছে।

আলাপচারিতা শেষ হয়েছে কি হয়নি, এরপরেই শুরু হলো খেল। এই বুঢ়ি অওরতের ইতনা বড়া সাহস যে মহারাণীকে মায়ের থেকে কেড়ে আনে? ব্রিটিশ জমানা হলে বোধহয় দিদিমাকে ইণ্ডিয়া গেটের সামনে কোর্ট মার্শাল করা হতো। হায়, সে মিসেস মাউন্টব্যাটেনও নাই সে নেহরুও নাই! ফলে তাঁর মানে টিয়ারাণীর তো ভয়ানক ক্রুদ্ধ হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায়ই থাকতে পারে না! তা প্রথমেই বোঝা গেলো যে কিছুতেই দিদিমার কোলে থাকবেন না। আঁচড়ে কামড়ে নানা অবর্ণনীয় ভাষায় নিজের ক্ষোভ ব্যক্ত করে তো তিনি দিগ্বদিক সচকিত করে তুললেন। সেই ভাষার সঙ্গে ধ্বন্যাত্মক দিক থেকে চাইনিজের সঙ্গেই মিল বেশি। তবে মন দিয়ে শুনলে বুঝতে ভুল হওয়ার কথা নয়। আরে চাচ্চু, ভাওনাঁও কো সমঝো!

যাই হোক, সারমর্ম হলো যে ভদ্রমহিলা ক্রুদ্ধ, সাতিশয় ক্রুদ্ধ! নিজের মায়ের আঁচল থেকে ছিঁড়ে নিয়ে এলে কারই বা মন মেজাজ ভালো থাকে মশাই! বিশেষ করে তেনার বয়েস যখন দুই?

এখন কথা হচ্ছে যে গান্ধারী বলেছিলেন ‘যথাধর্মোস্ততোজয়ঃ’। তিনি স্বেচ্ছান্ধ মহিলা হয়ে যে কথাটা অত সহজে বুঝলেন, ‘ন্যায় ও অধিকার’ নামের মহিলা সেটা তাঁর কালি কালি আঁখে ড্যাবড্যাব ফ্যায়লাকে বুঝবেন না সেটা হয় না। ফলে মিস টিয়াকে একটা গ্রেসফুল এক্সিট মেরে সাইড চেঞ্জ করতে হলো।

মুশকিল হচ্ছে সাইডের ওপারে দিদিমা তুমি রাধে, এপারে আমি! বেশি কিছু বোঝবার আগেই মিস টিয়া, বয়েস বছর দুই, হ্যাঁচোরপ্যাঁচোর করে আমার কোলে অধিষ্ঠিতা হয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন ‘আঙ্কিলাভুমিচংচুংহাম্মা?’ এসব প্রশ্নের নঞর্থক উত্তর হয় না, হতেই পারে না, ফলে আমিও একগাল হেসে জবাব দিলুম ‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, আই অ্যাম ফিলিং চমৎকার সৌভাগ্যবান। আপনার কোনও কষ্ট হচ্ছে না তো মহারাণী? ‘

এরপর আমাদের মধ্যে সাংকেতিক ভাষায় নানা ভব্য আলোচনা হয়। সেসব আধ্যাত্মিক গূঢ় আলোচনার কথা না হয় একদিন আপনাদের সময় সুযোগ পেলে বলবো। তাতে ট্রাম্পের বিদেশনীতি থেকে শুরু করে আইটি ইন্ড্রাস্ট্রির ভবিষ্যৎ সবই ইনক্লুডেড ছিলো। ইন ফ্যাক্ট একবার তো টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ে আমাদের গভীর আড্ডার মাঝখানে অরসিকা দিদিমা এসে রসভঙ্গ করলেন, বিরসবদনে শুদ্ধ বাংলায় শুধোলেন, ‘টিয়া তুমি কি খাবে?’

আই লা, অ্যাংলো দিদিমা দিব্য ব্রিটিশ ইংরেজি কপচাচ্ছিলেন, বাগবাজারী বাংলায় কি করে ডাইভ মারলেন গা?

এইবার দিদিমা খাপ খুললেন। তেনার বাপ শ্যামবাজারের রকের বিশিষ্ট ইয়ে ছিলেন। সৎমায়ের গঞ্জনায় ভাগ্যান্বেষণে বম্বে যান এবং গিয়ে কার্যসূত্রে আলাপিত এক গোয়ানিজ কন্যায় যদিদং হৃদয়ং মমটি সম্পন্ন করেন। বিয়ের পরে দেশে ফিরে কুলাঙ্গার ছেলেটির আর পৈতৃক বাড়িতে ঠাঁই হয়নি, ফলে কচি বউকে নিয়ে তিনি এক জাহাজি পিদ্রুর সহায়তায় প্রথমে খিদিরপুর, পরে বো ব্যারাকে বাসা বাঁধতে বাধ্য হন।

‘বাবা আমাকে সুকুমার রায়ও পড়িয়েছেন, শরতচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথও অল্প অল্প পড়েছি।’ সলজ্জ মুখে জানালেন ভিয়েনা গঞ্জালভেস ( নামটা চেঞ্জ করলাম, বোধগম্য কারণেই)। হ্যাঁ, মায়ের পদবীটাই ব্যবহার করেন তিনি।

এদিকে মিস টিয়া তো গোঁ ধরে বসে আছেন, তিনি বর্ডারের ওপারে যাবেন না। ফলে আমাকেই কিছু খাওয়াতে হলো। সেই কবে নিজের মেয়েকে খাইয়ে দিয়েছি..এখন অন্যের মেয়েকে…

আর অন্যের মেয়ে, ‘দিডিঘুচিমিংচুং’ বলে হাসিমুখে উজ্জ্বল চোখ মেলে তাকালে কি আর খেয়াল থাকে মশাই যে এ কার মেয়ে?

যাই হোক, বহুকষ্টে কিছুমিছু খেয়ে তিনি আমাকে ধন্য তো করলেন! এরপর শুরু হলো নতুন বায়নাক্কা!

তিনি আমার সঙ্গে শোবেন! কিচ্ছুত্তেই ওই বৃদ্ধা ‘আংরদিম্মাম্মম্নেই’এর সঙ্গে শোবেন না!

মাইরি বলছি, আমার মেয়ে যখন এই বয়সের ছিলো, আমি অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে ঘুমোতাম। এক বিছানায় শুলেই ভয় হতো ঘুমের ঘোরে যদি আমার ওই ভীমসেন মার্কা হাত পা কচিটার গায়ে উঠে যায়? যদি কোথাও লাগে? বেচারিতো বলতেও পারবে না যে কোথায় ব্যথা লেগেছে!আর এখন এ কি ধর্মসঙ্কট বলুন দেখি!তদুপরি দুবছরের শিশু যদি কোলে উঠে গলা আঁকড়ে ঝুলে পড়ে, তাকে ঠিক কি উপায়ে নিরস্ত করা যায়? গলা আঁকড়ে থাকা কচি হাতের বাঁধন জোর করে খুলতেও তো মায়া লাগে! আর একটিবার চেষ্টা করলেই ওই দুই বছরের শিশু যা তীব্র অভিমানী চোখে তাকাচ্ছে, তার কাছে পৃথিবীর যাবতীয় প্রতিরোধ সূচ্যগ্রপরিমাণধূলসম অর্থহীন!

অবশেষে নিঠুর নিদয়া দিদিমা অসাধ্যসাধন করলেন। নানাবিধ চমকপ্রদ ইংরেজিতে বকাঝকা করে মিস টিয়াকে সিটের ওপর সদ্য পাতা বিছানায় জোর করে শোয়ালেন। তারপর লাইট অফ করে কড়া বললেন, ‘লেট বোথ অফ ইউ স্লিপ নাউ’।

অন্ধকার কম্পার্টমেন্ট। মিস টিয়ার খুঁ খুঁ আওয়াজ ভেসে আসছে। এমন সময়ে দিদিমার অ্যাপোলোজেটিক গলা ভেসে এলো মৃদুস্বরে…’অ্যাকচুয়ালি ওর মা ডিভোর্সি। দিস কিড হ্যাজ নেভার সিন হার ফাদার…দ্যাটস হোয়াই…আই হোপ ইউ ডিডন”ট মাইন্ড’।

এসব কথার উত্তর হয় না, দিতে নেই। চুপ করে শুয়ে রইলাম।

খানিকক্ষণ পর শুনি বাঙালি বাবার মেয়ে তাঁর নাতনিকে গুণগুণ করে গান গেয়ে ঘুম পাড়াচ্ছেন, ‘টিয়া টিয়া টিয়া, অজ পাড়াগাঁয়ে থাকে…’

গাঢ় কষ্টের ঘুম নেমে এলো দুই শিশুর চোখে। একজনের বয়েস দুই।

আরেকজনের?

আটত্রিশ।





রায়, অভিজিৎ রায়

‘প্রভু, বলি ও প্রভু, শুনছেন?’

‘কে র‌্যা? শান্তিতে যে দুদন্ড ঘুমুব তার জো নেই, অ্যাঁ? রাত নেই, দিন নেই, সকাল সন্ধ্যে এত্ত প্রভু প্রভু কিসের হে?’

‘ইয়ে, সকাল হলো যে, সভার কাজ শুরু হতে দেরি হচ্ছে যে প্রভু, লোকজন সব আসতে শুরু করেছে যে। (সজোরে) অভয় দিলেন যদি করি নিবেদন/ শুনিতে ইচ্ছা কিছু অমৃতবচন’।

‘উরিশ্লা, সক্কাল সক্কাল কোবতে মারাচ্ছ, উমম, চুল উষ্কখুষ্ক, লাল চোখ, নাঃ এখনো তোমার হ্যাংওভার কাটেনি দেকচি। শোন একটা টোটকা বলি, চশমাটা দাও দিকিন,হ্যাঁ। সক্কাল সক্কাল এমন হলে না, একছিপি স্কচ নীট মেরে দেবে, বুইলে? ওইদিকে যাও, বাঁ দিকের তাক থেকে ওই লম্বাপানা বোতলটা নামাও দিকিন, গ্লেনফিডিচ, ওইখান থেকে…’

‘আহ, প্রভু, সক্কাল সক্কাল কি শুরু করলেন? একটা কাজের কথা কি বলা যাবে না শান্তিতে? রাদ্দিন মালের ধুনকিতে বুঁদ হয়ে থাকবেন?’

(ব্যাকগ্রাউন্ডে, ‘জয় সদাপ্রভুর জয়। ধ্বংস হোক সদাপ্রভুর শত্রুদের জীবন ও সমস্ত সম্পদ। বিধর্মী ও নারীরা নিক্ষিপ্ত হোক নরকের আগুনে। প্রভুর শত্রুদের ঘাড়গর্দানে আঘাত হানো জোড়ায় জোড়ায়। প্রভু অবশ্যই দয়ালু ও ক্ষমাশীল…..’)

‘না বুঁদ হয়ে উপায় কি বাওয়া? শুনতে পাচ্ছো? অ্যাই শুরু হল। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠতেই রাজ্যের বাজারি কেচ্ছা। রোজ রোজ এগুলো শুনতে ভাল্লাগে না মাইরি, কতবার বলবো অ্যাঁ? আহা, ভাষার কি ছিরি, শুনে তো মাইরি আমি নিজেই ঘাবড়ে গেসলুম, আমি ভগবান না সিসিলির মাফিয়া, অ্যাঁ? ‘

‘ইয়ে ঠিক আছে প্রভু, পরের বার নাহয় ল্যাঙ্গুয়েজটা আরেকটু মিঠে করে দেবো, হেঁ হেঁ… ‘

‘আর বিউগলের সংগে প্যাঁ প্যাঁ করে ওটা কি বাজাচ্ছে হে?’

‘হেঁ হেঁ, এটাকে ভুভুজেলা বলে প্রভু, মহর্ষি নারদ এইবার এটি ইডেন গার্ডেনের গেটের বাইরে থেকে কুড়িয়ে এনেছেন’।

‘নারুকে বলবে এটা রোজ সকালে, ইন্দ্রের কানের কাছে বাজাতে। সে মহাপ্রভু কোথায় এখন?’

‘মহর্ষি নারদ? উনি এখন নন্দনকাননের পারিজাত বনে প্রভু?’

‘বাঃ বাঃ, হুলও ফোটাচ্ছে, আবার ফুলও? তা ভালো। কিন্তু নারু নয় চিতু, আমি ইন্দ্রের কথা জিজ্ঞেস করছি’।

‘ইয়ে, উনি একটু ব্যস্ত আছেন প্রভু….’

‘কিসের ব্যস্ত হে? দেশে ঠিকঠাক বৃষ্টি নেই, একের পর এক ক্ষেতের ফসল জ্বলে যাচ্ছে, আর উনি কি উর্বশীর ভাইটাল স্ট্যাট মাপতে ব্যস্ত? ওটাকে বলবে রোজ সকালে এটা দুঘণ্টা করে ওর কানের কাছে বাজানো হবে, আমার আদেশ। ‘

‘ইয়ে, তাহলে প্রথম আগন্তুককে পেশ করতে বলি প্রভু?’

‘বলবেই? আটকানো যায় না? আচ্ছা, বলো।’

‘ইয়ে, ওহে প্রতিহারী, প্রথম আগন্তুককে পেশ করা হোক’।

(আগন্তুকের প্রবেশ)

‘প্রভু, প্রভু, আপনিই কি সেই? ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং মঙ্গলমূর্তি কাশ্যপেয়ং হে চরাচরসারে দর্শনমাত্রেনমানাকামনাপূর্তি কুচযুগশোভিত মুকুতাহারে জয় জয় বিষহরি….’

‘ওরে থাম থাম, ও চিতু একে থামাও, গনশা থেকে মনসা সব ঘেঁটে ঘ করে দিচ্ছে তো। শান্ত হয়ে বসো বাপু। ধীরে সুস্থে, অ্যায়, এইভাবে, থেবড়ে বসো দিকিন। চিতু এর জন্যে একটা বড় দেখে পাতিয়ালা বানিয়ে আনো তো,বাঁ দিকের তাক থেকে ওই লম্বাপানা বোতলটা, হাফ বোতল গ্লেনফিডিচ এখনো রয়ে গেছে বোধহয়, খবদ্দার, জল মেশাবে না….’

‘আহ প্রভু, কি করছেন কি? সভার মধ্যিখানে…’

‘কেন? ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি লাগছে নাকি? যাগগে যাক। তা ইয়ে, ওহে আগন্তুক, তোমার নামটি কী ঘোঁচুসোনা?’

‘কত পুণ্যবলে আপনার চরণসকাশে এসে আজি কি অপার আনন্দের হিল্লোল আমার শরীরে প্রভু, কি দুর্নিবার মোহমায়ার বন্ধন ছাড়িয়ে আমার আত্মা আজ অনন্ত আকাশে…’

‘উরিব্বাস, দিব্যি সরেস বাঙলা বেরোচ্ছে তো মুখ থেকে!’

‘হেঁ হেঁ, ঠিকই ধরেছেন প্রভু, ওই বাঙলাই আর কি, হেঁ হেঁ… যমদূত দাদাকে বল্লুম যখন খালাসিটোলা হয়েই যাচ্ছি, একটু বসে গেলে হত না? হেঁ হেঁ, অপরাধ নেবেন না কিন্তু স্যার’।

‘চিতু, শুনলে?’

‘শুনলাম প্রভু, আজকেই ওটার ব্যবস্থা করছি’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ করে ফেলো, করে ফেলো। রোজই কি আর স্কচ খেতে মন যায় হে? মাঝে মাঝে এসব বাংলা টাংলাও তো….’

‘আহ কি হচ্ছে কি প্রভু? আমি কি তাই বল্লুম? সক্কাল সক্কাল কি শুরু করলেন বলুন তো? বাংলা না, যমদূতটার কথা বলছি।’

‘ অ। যাই হোক, তা বাপু, বাংলু টেনে মেজাজটি যে দিব্বি খোলতাই সে বুঝনু। এইবার খোলসা করে বলতো ছুংকুমণি, কি কি এমন পুণ্যকাজ করে এসেছো পৃথিবীতে যে তোমাকে স্বর্গে হাসিখুশি খেলে বেড়াতে দেওয়া হবে? প্রূভ ইওর পয়েন্ট, বি ক্রিস্প অ্যান্ড শার্প। আমার হাতে টাইম বেশি নেই। কি করতে হে মর্তে?’

‘ইয়ে, সেলসে ছিলাম প্রভু’।

‘অ্যাঁ? সেলসে? চিতু, একে নিয়ে যাও, স্ট্রেইট রৌরব নরক, পাঁচশো বছর। রাস্তায় কোত্থাও দাঁড়াবে না। হেব্বি ডেঞ্জারাস মাল। স্ট্যাম্প প্যাডটা এদিকে দাও দিকিন। আহ, পেনটা আবার কোথায় রাখলুম..কি জ্বালা…..’

‘প্রভু প্রভু, কি অপরাধ প্রভু? আপনি তো শুনলেনই না….’

‘বেশি শোনার দরকার নেই সন্টিমন্টি। সেলসের লোকগুলোকে হাড়ে হাড়ে চিনি। গতবার এক ছোঁড়া আমাকে একটা বাক্স দিয়ে বলে তাতে নাকি স্পেশাল অ্যান্টিগ্র্যাভিটি সিউয়িং ইন্সট্রুমেন্ট, ও মা খুলে দেখি একবাক্স সূঁচ আর সুতো! এই গছিয়ে দিয়ে স্বর্গে যাবার ধান্ধা আর কি! সাহসটা ভাবো! আরেক মক্কেল তো অথেনটিক ওয়্যারেবল এয়ার কন্ডিশনিং র‌্যাপঅ্যারাউন্ড নাম করে ইয়াব্বড় একটা প্যাকিং বাক্স নিয়ে হাজির, স্বর্গে যাবার নজরানা, আমি তো মাইরি হেবি ইম্প্রেসড, ওমা, খুলে দেখি বারোখানা বাঁদিপোতার গামছা! ওপরে আবার লেখা ওয়র্কস বেস্ট হোয়েন ওয়েট! দুটোকেই দেড় হাজার দেড় হাজার বছর করে কুম্ভীপাকে পাঠিয়েছি। ‘

‘ইয়ে, সব সেলসম্যান তো ওরকম না প্রভু’।

‘বটে? প্রূভ ইট। আর কি কি করেছো? ‘

‘বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ সেবা করেছি প্রভু’

‘সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং। কি রকম?’

‘ফেসবুকে একটি বাংলা সাহিত্যমূলক গ্রুপের অ্যাডমিন ছিলাম স্যার। এছাড়াও আরও অনেক গ্রুপে….’

‘চিতু, লিখে নাও, পাঁচশো বছর রৌরবের সংগে আড়াইশো বছর অন্ধকূপ। আর শোনো, ঝটপট রওনা করিয়ে দাও। ইশশ অনেকটা বেলা হয়ে গেলো এই একটা কেস নিয়েই। ন্যাঅ্যাঅ্যাক্সট’।

‘প্রভু প্রভু, দয়া করুন। আমি আরও ভালো ভালো কাজ করেছি..’

‘শুনি। এইটেই লাস্ট চান্স কিন্তু, বুইলে তো?’

‘পাড়ায় পাড়ায় ভোটের আগে দেওয়াল লিখেছি প্রভু, বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, পুজোয় বইয়ের স্টল, রক্তদান শিবির, ফাইভ অ্যা সাইড ফুটবল টুর্নামেন্ট, ব্রিগেডে মিটিং ও চিড়িয়াখানা অ্যান্ড বিরিয়ানি, গণসংগীত ও লোকাল কমিটি। তারপর মোমবাতি মিছিল, ইলিশ ও হাওয়াই চটি উৎসব, ইনফ্যাক্ট একবার তো বইমেলায় ”জাগো বাঙলা”র স্টলের সামনে বাউল অবধি হয়েছিলাম প্রভু।’

‘হেঁ হেঁ। তুমি কি লেভেলের আতাক্যালানে পাবলিক সেটা নিজে এখনো বোঝনি, না? নাহ, কৃমিভোজন নরক আরও আড়াইশো বছর, ন্যাঅ্যাঅ্যাক্সট…’

‘প্রভু, ও প্রভু, শুনুন না… আহ এই দ্যাখো জাপটে ধরে, উঁহহ, সর না মাইরি, কি বিচ্ছিরি গন্ধ গায়ে…’

(যমদুতেরা চ্যাংদোলা করে আগন্তুককে বাইরে নিয়ে যায়).

-‘ চিতু, পরের ক্যান্ডিডেটকে… এ কি, খামোখা দাঁত ক্যালাচ্ছো কেন? ওরে কে আছিস, চট করে একটা তক্তা কি বাটাম নিয়ে আয় তো, এটার বোধহয় আন্তারা ফাঁচকলিয়ে গেছে…’

-‘ও হো, খ্যাঁক খ্যাঁক, খৌয়া খৌয়া…. ‘

‘ইঃ, হাসছে দেখো, যেন দাঁড়কাকে রসগোল্লা খাচ্ছে। বলি এত আনন্দের কি হলো অ্যাঁ ? এমাসের টার্গেট অ্যাচিভমেন্টের স্ট্যাটাস মনে হচ্ছে ভালো, নইলে এতো হেসে কুটিপাটি হবার কারণ কি বাওয়া? কেসটা কি, অ্যাঁ? ‘

‘সে সুখবরটা দিতেই তো সকাল থেকে প্রাণটা আনচান করছে প্রভু। শুনলে আপনি হেসে কুটিপাটি হবেন। এখন মাসের টার্গেট দিনেই হচ্ছে কি না, হেঁ হেঁ। আজকেরটায় অবশ্য আপাতত তিপ্পান্ন কনফার্মড, তবে ওটা বাড়তেও পারে।’

‘অ্যাঁ? বল কি? এখন তো ইয়ার এন্ডিং নয় চিতু, তাতেই এই?? বাহ বাহ, শাব্বাস, ব্রাভো। তা কোথাকার কাস্টমার চিতু? ওই বলি ইরাক নাকি নাইজেরিয়া ?’

‘না প্রভু, অরল্যান্ডো, আমেরিকা’।

‘বাহ বাহ বেশ। তা কোন স্কিমে তুল্লে?’

‘সে ভারি বিচ্ছিরি ব্যাপার স্যাপার প্রভু, আপনি হয়তো শুনতেই চাইবেন না। হোমো’।

‘মোমো? তা তিব্বত না এক্সাইড মোড়েরটা? আমার অবিশ্যি এক্সাইড মোড়েরটাই…..’

‘আহ, তা নয় প্রভু, বলতেও যে ছাই কি গা গুলোচ্ছে সে আর কি বলি! বলছি শস্তায় খান পঞ্চাশেক হোমো তুলেছি প্রভু। হোমো, হিজড়ে, বেশ্যামাগী, এগুলো শস্তা মাল প্রভু, তুলতে কষ্টটা একটু কম হয়, কেউ বিশেষ গা করে না কি না। ভ্যালুতে না হলেও, ভল্যুম টার্গেট কিন্তু দিব্যি পুষিয়ে যায় প্রভু, অন্তত আপিস চালানোর খরচাটা উঠে আসে আর কি, হেঁ হেঁ। ‘

‘বেশ করেছ, তা বাপু, এই হোমো না মোমো কি একটা বললে, তা এরা এমন কি করছিল যে এর”ম হোলসেল রেটে খামচে তুল্লে?’

‘সে কি অসৈরণ কাণ্ডকারখানা প্রভু, আপনাকে আমি লজ্জায় বলতেই পারবো না, ছি ছি ছি ‘।

‘ক্যানো, ক্যানো?’

‘সে সৃষ্টিস্থিতিলয়, সমাজসংস্থিতি লোপ, ইত্যাদি মিলিয়ে খুবই ভজঘট্ট কেস প্রভু। ধরুন অ্যাবস্ট্রাক্ট জিওমেট্রির সঙ্গে খামচা মেরে এট্টু সাব অল্টার্ন স্টাডি, বা স্ট্রিং থিওরির সঙ্গে সুররিয়ালিজম খুব কষে ঘুঁটে দিলে…..’

‘ওরে কে কোথায় আছিস, আমার ডাঙ্গশটা নিয়ে আয় তো, এটাকে সামান্য গুছিয়ে ক্যালাই, নইলে মনে হচ্ছে না বাংলা ভাষায় কেসটা খুলে বলবে বলে ‘।

‘না না, তা নয়… ‘

‘তাহলে কেস টা কি হে?’

‘ইয়ে, ওরা চুমু খায় প্রভু’

‘তো? তো?? তো??? ঘুষ নয়, বিষ নয়, কাটমানি নয়, কারো রক্ত নয়, নিষিদ্ধ নেশার বস্তু নয়, চুমু খাচ্ছে বলে মুঠো ধরে… ‘

‘ছেলে ছেলেকে চুমু খায় প্রভু, মেয়ে মেয়েকে, ছিঃ ছিঃ…. ‘

‘একটু এদিকে এসো তো চিতু, এই আমার কাছে একটু কাছে, অ্যায়, মুখটা একটু নিচে নামিয়ে বাহ বেশ, এই বার….

<চকামগ্গ....

‘এ হে হে হে, অ্যা ম্যা, এটা কি করলেন প্রভু, এটা….’

‘ভালোবাসা একটু আধটু রেসপেক্ট করতে শেখো, চিতু। তোমায় বোধহয় অনেক দিন কেউ চুমু খায় নি,না? তাই একটু খেলুম, হে হে। তাছাড়া কারো প্রাইভেট ব্যাপারে নাক গলানোটা ইতরামি, সেটা তোমাকে তোমার মা বাবা ছোটবেলায় শেখায় নি চিতু, অ্যাঁ? যাগগে যাক। তা চুমু খাওয়া ছাড়া এরা আর কি কি করছিল বাওয়া?’

‘সে বলতে গেলে, ম্যা গো, ওয়াক ওয়াক….’

‘ওরে কে আছিস, আমার ডাঙ্গশটা…. ‘

‘না না থাক, ইয়ে ওরা প্রভু, ইয়ে মানে, কি করে বলি, নিজেদের মধ্যে ঝিংকুলুলু করে।’

‘অ্যাঁ, কি করে বলে? ‘

‘ঝিংকুলুলু, ইশ ছি ছি, বলতেও অপবিত্র অপবিত্র বোধ হচ্ছে’।

‘সেটা কি হে? ঝিংকু… ওরেশশশাল্লা, বুয়েছি। ওলে বাবালে, ঘুঞ্চুপুঁচু নেকুপুষু আমার, তা বাওয়া তুমি করো না? রাত্তিরে বউমার সঙ্গে কি লুডো খেলো, অ্যাঁ? ‘

‘আজকাল তো আর ( দীর্ঘশ্বাস),… ইয়ে, লুডোই চলে প্রভু’।

‘নইলে আর অন্যের আনন্দ দেখে চোখ টাটাবে কেন বাওয়া? বলি একটু এদিকে এসো তো চিতু…. ‘

‘না না প্রভু, ইয়ে, থাক বরং, আপনার ইয়ে, বক্তব্যটা মানে, যথাযথ ভাবে প্রণিধান কল্লুম। কিন্তু আমার কথা শুনুন, ওসব কি ঠিক? মানে হারাম বা নিষিদ্ধ ইয়ে না? ‘

‘ হুমম, তা সন্টুমন্টু বাপিসোনা, আমার নামে আর কি কি হারাম বলে চালিয়ে বাওয়াল দিচ্ছ তার লিস্টিটা এট্টু দাও তো বাপধন। মালঝাল খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকি বলে আমার নামে আর কি কি….’

‘খুব ছোওট্ট লিস্ট প্রভু, বিয়ের আগে ভালোবাসা বা জেনা করা, গরু বা শুয়োরের মাংস, বেজাতকুজাতে বিয়ে দেওয়া, এর দেশে ওর পুজোআচ্চা… ‘

‘ফুটবল?’

‘ইয়ে, খেলাধুলো তো হারাম তাই….’

‘স্কচ?’

‘ইয়ে, মদ তো নিষিদ্ধ তাই আর কি… নেহাত বাধ্য হয়েই, হেঁ হেঁ হেঁ…কিছু মাইন্ড করলেন না তো?’

‘বিধর্মী মেয়েদের গণিমতের মাল বলে রেপ? বিধর্মীদের সম্পত্তি ”শত্রুসম্পত্তি” দেগে দিয়ে লুটতরাজ? জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া? বাচ্চা কেটে তারই মা কে খাইয়ে দেওয়া? বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের বিক্রি করে দেওয়া? বাচ্চা ছেলেদের ইয়ের চুলের সাইজ দেখে কতল করা? ফ্রিজে মাংস দেখে বুড়ো লোককে পিটিয়ে মারা?’

‘ইয়ে না প্রভু, ঠিকঠাক, মানে ধর্মীয় ইয়ে মেনে চললে…’

‘বাহ বাহ বাহ, গানবাজনা?’

‘হারাম’

‘নাচ? অভিনয়? নাটক?’

‘মানে, ইয়ে, হারাম প্রভু’

‘কবিতা? চিত্রশিল্প? ভাস্কর্য? ‘

‘ইয়ে, মানে এক কথা কেন আমাকে দিয়ে বারবার বলাচ্ছেন প্রভু? এসবই হারাম ‘

‘শাবাস চিতু,ভালো ব্যবসা ফেঁদে বসেছ হে, বেশ গুছিয়ে বসেছো তো বাপু। আমার তো মনে হচ্ছে যে তোমার রাজত্বে বেঁচে থাকাটাই হারাম চিতু, বেঁচে থাকাটাই হারাম!’

-‘অ। আমার দোষটাই চোখে পড়লো, না? বলি রাদ্দিন যে মালঝাল খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকেন, এই সৃষ্টি সামলায় কে? এই লোকস্থিতি কার দায়িত্বে থাকে, অ্যাঁ? দেখুন প্রভু, এভাবে চলতে পারে না। বিশেষত, আপনাকে ওই ইয়ে, মানে ওদের ব্যাপারে কিন্তু একটা ডিসিশন নিতেই হবে প্রভু। নইলে কিন্তু আমার পক্ষে এভাবে ডিউটি করা আর সম্ভব হচ্ছে না, পষ্ট করে বলে দিলুম, হ্যাঁ’।

‘এই দ্যাকো, রাগ কত্তে নেই চিতু। এইখানে বসো দিকিন, অ্যাই দ্যাকো ফেঁতফেঁত করে। একটু বকেছি বলে, ওল্লে বাবালে, ঘুন্নুমুন্নুপুচুটা….’

‘ইয়ে, না থাক, মানে চুমুটা, ন্না, ইয়ে থাক প্রভু। পষ্টাপষ্টি কাজের কথায় আসুন। বলি ওদের কি ব্যবস্থা করলেন?’

‘কাদের?’

‘সেই অবাধ্য ত্যাঁদড় ছোকরার দল, যাদের আপনি তো লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছেন। হারামজাদাগুলোকে পাঠালেই ঝামেলা কেলেংকারির একশেষ! উঃ দুদন্ড তিষ্ঠোতে দেয় এরা? সব সময় এঁচোড়ে পাকামি, জাত ধর্ম নিয়ম নিষ্ঠা সব কিছু নিয়ে ক্যাচাল, একে খোঁচাবে, ওকে রাগিয়ে দেবে, কিছু বলতে গেলেই উলটে দুটো প্রশ্ন করে, উফফ, পুরো হাড়হারামজাদা দল, জাতবিছুটি এক একটা’…

‘উরেব্বাবা থামো, এক্কেবারে মেলট্রেন চালিয়ে দিলে হে? তা বলি বাপু,তাতে তোমার ইয়ে জ্বলছে কেন সন্টিমন্টি?’

‘মানে? জ্বলবে না? আজকাল আদ্দেক লোক পুজোআচ্চা শুনলে খ্যাঁক করে হেসে ফেলছে, প্রার্থনা করতে বললে জিজ্ঞেস করছে এই করে কোন মহাভারত উদ্ধার হবে, উফফফ, পুরো ধ্বংস করে দিল, জ্বালিয়ে দিল মাইরি।’

‘অ”, তা বাপু এরা খুব মারামারি কচ্চে নাকি আজকাল? বোম? বন্দুক? চাপাতি? ত্রিশূল? নাকি সবকিচু নিয়েই নেমেচে? এক্কেবারে রক্তারক্তিতে বানভাসি কান্ড নাকি হে?’

‘ইয়ে, না তা অবিশ্যি নয়’

‘তাহলে শোন ভাই, আজ অনেক কাজ কল্লুম, গুন্নাইট। তুমি এখন এসো, আমার অনেক কাজ আছে, আর গ্লেনের বোতলটা এদিকে….’

‘উফফ, আবার শুরু হল। বলি মারামারি করচে না বটে, তবে যেটা করচে, সেটা আরও ভয়ংকর’।

‘অ্যাঁ ? আরও ভয়ংকর? কি রকম? ইস্কুল কলেজ লাইব্রেরি জ্বালিয়ে দিচ্চে? সেই নালন্দা কি আলেক্সান্দ্রিয়া টাইপ? সে কি হে? এদ্দিন বলনি” তো। নাঃ, এবার তো তাহলে গতর নাড়াতে হচ্চে দেখচি। ‘

‘আরে ধুর, সেসব না। এরা খালি প্রশ্ন করে। সে কি বিশ্রী নোংরা নোংরা কথা প্রভু, আপনি হয়ত শুনতেই চাইবেন না’।

‘নোংরা প্রশ্ন করছে তোমাকে? বাহ বাহ, বেশ চনমনে ফীল করছি তো, দাঁড়াও বাপু, উঠে বসি, হ্যাঁ তোমার কোন কেচ্ছাটা নিয়ে প্রশ্ন তুলচে শুনি? সেই মামিকে নিয়ে ঢলাঢলির কেসটা? নাকি ছেলের বউ বিছানায় তোলার কেসটা? হেঁ হেঁ, বলি কেচ্ছা কেলেংকারির কি কিছু কমতি তুমি নিজেই রেখেছ? ইদিকে ষোল হাজার, উদিকে এগারো খান ইয়ে তারওপর লুটপাট করে তুলে আনা মালগুলো, মাঝে মাঝে তো মনে হয় তোমাকে শুধু বুঝি লাগাতেই পাঠাই, হ্যা হ্যা হ্যা’।

‘উফফফফ ভাল্লাগেনা মাইরি। বলি আআআমাকে নিয়ে নয়, আপনি যে বইগুলো আমার থ্রু দিয়ে আমজনতাকে পাটিয়েচেন মানুষ হবার জন্যে..।

‘দেখো বাপু, বার বার বলছি, ঘ্যান ঘ্যান কোর না। তুমি শালা কতটা কি গাঁজা খেয়ে বা খাইয়ে নাচনকেঁদন করে চাট্টি বই বিয়োলে, আর আমার নাম করে পাবলিককে বললে এসবই নাকি সত্য, কারণ ইহা বৈজ্ঞানিক, এসব ধান্দাবাজির মধ্যে আমার নাম একদম নেবে না। লোকশাসনের বই লিখতে গেলে পড়াশোনা লাগে, ওই আম্বেদকর ছোঁড়াকে দেখে শেখো। যাগগে যাক। তা সেই নিয়ে কি হয়েছে?’

‘আরে সে সব বই থেকে লাইন ধরে ধরে প্রশ্ন। কি সব বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি প্রশ্ন সে সব’

‘সে কি হে, সব কটা বই থেকে প্রশ্ন?’

‘নইলে আর বলছি কি প্রভু?’

‘তার মানে ওরা তোমার অতগুলো গাঁজাখুরি পড়েছে? বাহ বাহ’

‘বাহ বাহ? এই আপনার বিচার? আর সেখান থেকে হারামি গুখোরবেটাগুলো শক্ত শক্ত প্রশ্ন করছে যে?’

‘উলি বাবা, নেকুপুষু আমার। লাত্তিলে কি খাবাল খাও সোনা? আমছাগলের মানছো দিয়ে, অসগোল্লার অস দিয়ে উটি? ন্যাকামো দেখে ইয়ে জ্বলে যায় মাইরি। বলি তোমারই লেখা ছাইপাঁশ থেকে তোমাকে প্রশ্ন করছে, তাও তুমি ধ্যাড়াচ্ছো, আবার আমার কাছে এসেচ নাকিকান্না কাঁদতে? শোন বাপু, মাথা গরম করিও না, তুমি এসো, আর যাবার আগে গ্লেনের বোতলটা এদিকে….

‘প্রভু, প্রভু, শুনুন না, একটা নিবেদন ছিল’।

‘উফফ, কি যমযন্ত্রণা মাইরি। বলে ফেল।’

‘বলি প্রভু, এই গ্যাংটা কিন্তু আপনার নামেও যা তা বলছে।

‘আচ্ছা, কি রকম শুনি?’

‘বলছে আপনি নাকি নেই?’

‘তো?’

‘তো? তো?? তো??? আপনাকে না মানলে যে সৃষ্টিস্থিতিলয় কিচুই থাকবে না প্রভু’।

‘সেটা তুমি আমাকে বুঝতে দাও না ডাল্লিং। তারে তোমার ইয়েতে এত কুটকুট করচে কেন হে?’

‘আপনার অপমান কি আমারই অপমান নয় প্রভু?’

‘উঃ কি সেন্টি মাইরি, পুরো সুখেন দাস! বলি দুনিয়াজুড়ে এতো যে কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে বসেচ তাতে আমার মানসম্মানের কি হাল সে নিয়ে কোন আইডিয়া আছে? যেখানে যেখানে পাঠিয়েছি, সেখানে সেখানে ছড়িয়েছ। বল্লুম, ভাইটি ইন্ডিয়াতে যা, ধর্মাধর্ম শিখিয়ে আয় দিকিন। তা বাপু যা শিখিয়েছ হে, ছ্যাঃ ছ্যাঃ, দেখে ঘেন্নাপিত্তি চটকে যায়। শেষে চার্বাক আর কপিলকে পাঠিয়ে কিছু সামাল দেওয়া। তাপ্পর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বল্লুম, যা তো বাপু, ওই মরুভূমির দিকটা একটু সামলে আয়, বাপ রে বাপ, কি ঝাম মাইরি। কি জিনিস বানিয়েছ বাপ? ইরাকে নাইজেরিয়াতে, পাকিস্তানে, কি ছেড়ে এলে বাপি? পালে পালে মেয়ে তুলে রেপ করছে, বিক্রি করে দিচ্ছে, জ্যান্ত পুড়িয়ে মারছে, বাচ্চা কেটে মা” কে খাইয়ে দিচ্ছে, কি শিখিয়ে এলে চাঁদু?’

‘ইয়ে, প্রভু, মানে ওগুলো ইয়ে, মানে সহিহ আমার ইয়ে না’।

‘ইশশ, দিন দিন কি বিটক্যাওড়া ন্যাকাচৈতন পাবলিক হয়ে উঠছো খেয়াল আছে? কাল তো তোমার ছেলে নেমন্তন্ন বাড়িতে গিয়ে হেগে ফেললে বলবে এ আমার সহিহ ছেলে নহে!’

‘প্লিজ প্রভু, খ”চে যাচ্ছেন কেন?’

‘যাবো না? তারও আগে কি কম ছড়িয়েছ গ্রীসে? এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে চিত্তির করছো দেখে সেই খিটকেল দেখতে ছোঁড়াকে বল্লুম, যাও তো বাপধন, একটু যুক্তিতক্ক নেকাপড়া শিখিয়ে এসো, বলি সেই তাকেই যে ধরেবেঁধে যে বিষটুকু খাইয়ে দিয়ে এলে, বলি আমাকে জানিয়ে করেছিলে?’

‘কি করবো স্যার, ওই লোকটা যে প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছিল প্রভু, পুরো সিডিশন কেস যে!’

‘বাহ বাহ, দুটো প্রশ্ন করতে না করতেই তোমার চেতিয়ে থাকা ঈমানদণ্ড নেতিয়ে পড়লো বাওয়া? পড়াশোনা কি এক্কেবারে অশ্বতরের গূহ্যদেশে দিয়ে এলে ভাইটি?’

‘বাদ্দিন প্রভু, বাদ্দিন, যাদের কথা হচ্চিল, এদের কি করবেন?’

‘কি আবার করবো? যুগে যুগে যা যা করেছি তাই তাই করবো? ‘

‘মানে?’

‘ইশশ, কি অশিক্ষিত মাইরি, মাধ্যমিকে হিস্ট্রিতে কত ছিল হে? মানে আবার কি ? ছোকরাগুলো কে আবার রেডি করো, আবার নামাতে হবে যে। বলি সে ছেলেগুলো কই? হোয়ের আর মাই বয়েজ?’

‘ইঃ, এক্কাবারে মাই বয়েজ?’

‘হ্যাঁ বাপু যতবার তোমার দালালগুলো আমার নামে খচড়ামি করা শুরু করবে, ততবার এই ছেলেগুলো তোমার ইয়েগুলোকে ঘেঁটে দিয়ে আসবেই।’

‘বলি প্রত্যেকবারই তো বেঘোরে মারা যায়’।

‘সেইটাই তো ওদের কাজ, মাই ডিয়ার, মশালে আগুনটুকু লাগিয়ে যাওয়া। মশাল একবার জ্বললে হাজার বছরের অন্ধকার কি আস্তে আস্তে পালায় বাপ, একেবারেই পালায়। তা বলি তারা কই? গেলবারে কি কি নাম দিয়েছিলুম যেন? ও হ্যাঁ হ্যাঁ, কৃষ্ণমোহন, রামগোপাল, রামতনু, শিবচন্দ্র…’

‘যাবে আর কই? এক এক করে পাঠাচ্ছি অগত্যা। শুধু রাধানাথকে পাঠাতে একটু দেরি হবে। তা পাঠাবেন কোথায় শুনি?’

‘বাংলাদেশে’।

‘ফের? তা ভালো। তা পালের গোদাটিকেও পাঠাবেন নাকি? ‘

‘সে তো পাঠাবই। সেইবার বেচারি বিষ খেয়ে মরেছে, গেলবার না খেয়ে, এবারে পাক্কা কোপ খেয়ে মরবে’।

‘তবে গেলবার নামটা জব্বর দিয়েছিলেন, ডি-রো-জি-ও। বলি এবারে কি নাম দেবো প্রভু?’

‘রায়, অভিজিৎ রায়’।
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *