মার্কেট ভিজিট ১১
ইয়ে, আমার সেই পুরোনো বসের কথা বোধহয় আপনাদের একবার বলিচি, না? সেই চে গ্যেভারার কেসটা নিয়ে?
অ্যাঁ? মনে পড়েচে বলচেন? বেশ বেশ।
তা ভদ্রলোক এমনি মানুষ হিসেবে খুবই ভালো ছিলেন। সৎ, সাহসী, পরোপকারী ইত্যাদি ইত্যাদি। পুলিশগিরির বালাই ছিল না, আরা আমাকে যাকে বলে বেশ স্নেহই করতেন আর কি!
কিন্তু ইয়ে, মানে যাকে বলে বেসিক লেখাপড়ার যায়গাটা, বা টেকনোলজি বিষয়ে নুন্যতম ব্যবহারিক জ্ঞান বিষয়ে এনার জানকারি, তালিম ইত্যাদি ছিল শিউড়ে ওঠার মতন। দুএকটি উমদা এক্সপিরিয়েন্স রসিকজনের পদতলে নিবেদন কল্লুম, সামলেসুমলে রাখবেন মাইরি!
গপ্প একঃ সেবার অফিসে নতুন শ্রেডার এসেছে। আমরা, অর্থাৎ চ্যাংড়া ম্যানেজারের দল মহা উৎসাহে প্রচুর কাগজপত্তর ফেলে কেমন কুচিকুচি হয় সেসব হাতেকলমে পরীক্ষা করছি। গভীর চিন্তাভাবনার পর সেই বছরের ইনক্রিমেন্ট লেটারটাও শ্রেডারে ফেলে দেওয়াটা ঠিক হবে কি না এ নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা চলছে, এমন সময় দেখলুম অফিসের বাইরে ক্যাব এসে দাঁড়ালো, বাবু সেখান থেকে নামলেন।
এইখানে বলে রাখি, ভদ্রলোক থাকতেন হায়দ্রাবাদে। ওনার পৃথিবী সামশাবাদে শুরু, নাচারামে শেষ। সেকেন্দ্রাবাদ ওনার কাছে স্বর্গ, হাইটেকসিটি পারিজাতবনশোভিনী নন্দনকানন, আর ওল্ড হায়দ্রাবাদ তো হুরপরী বিলোলিত, শরাবান তহুরা ছলাৎছলায়িত সাক্ষাৎ জন্নত এ ফিরদৌস! কথা হচ্ছে যে তাতে আপত্তি করার কিছু ছিল না। কিন্তু মুশকিল ছিল যে হায়দ্রাবাদের বাইরে সমস্ত দুনিয়া ওনার কাছে বিলকুল ফালতু যায়গা এবং বেশ উচ্চস্বরে সেসব মতামত প্রকাশে ওনার মধ্যে কোন বুর্জোয়াসুলভ দ্বিধা ছিল না। দিল্লি ওনার কাছে ”কামিনা”দের দের শহর, মুম্বাই নরকের আগের স্টেশন আর কলকাতা তো সাক্ষাৎ যমের দক্ষিণ দুয়ার! আমরা, মানে বাঙালিরা যে পবিত্র হায়দ্রাবাদ শহরে জন্মানোর সৌভাগ্য থেকে চিরবঞ্চিত, এ আক্ষেপে সদাসর্বদাই ওনার মনটা হুহু করতে থাকতো। আর এই পাপে পরিপূর্ণ নোংরা আমিষাশী শহরে চাকরি করিয়ে ওনার আয়ু থেকে কম করে দশটা বছর কেড়ে নেবার জন্যে হামেশাই উর্দতন কর্তৃপক্ষের মুণ্ডুপাত করতেন।
ওনার জন্যেই অন্ধ্রপ্রদেশ ইস্টে অ্যাড করে নিউ ইস্ট রিজিয়ন বানানো হয়েছিল। যাতে করে উনি মাসের মধ্যে দিন পনেরো কি কুড়ি হায়দ্রাবাদের বিশুদ্ধ হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিয়ে বেশ চনমনে ফীল করে উঠে ফের কষ্টকর বাকি দিনগুলো এই ছ্যাঁচড়া শহরে এসে দিনগত পাপক্ষয় করতে পারেন আর কি!!
যাগগে যাক, কি বলছিলুম যেন? হ্যাঁ, তা দেখলুম বাবু ক্যাব থেকে নামছেন, মানে এয়ারপোর্ট থেকে এলেন আর কি। যথারীতি বাকিরা ধাঁ। আমি দাঁত কেলিয়ে অভ্যর্থনা জানাবো বলে ড্যেঁইরে রইলুম।
তিনি হন্তদন্ত হয়ে এলেন, ভেতরে ঢুকলেন। আমি হাত বাড়িয়ে গুড আফটারনুন জানালুম। তিনি শ্রেডারটি দেখে ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘ ইয়ে কেয়া হ্যায় বেটা?’। আমি খুবই বিনয়ের সঙ্গে বল্লুম ‘স্যার, দিস ইজ আ শ্রেডার, আজ হি আয়া হ্যা’। উনি দেখলুম শোনামাত্র ভারি উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, ‘ভ্যারি গুড বেটা, মুঝে আবভি চাহিয়ে থা ইয়ে’, বলে ল্যাপটপ ব্যাগ থেকে দ্রুত একতাড়া কাগজ বের করে বলেন ‘উসমে ডাল দেগা বেটা?’
আমি চিরকালই একটু বসঘেঁষা পাবলিক, মানে সেবাযত্ন করে যতটা নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়া যায় আর কি! আমি তো শোনামাত্র ”আপ কে সেবা মে সদেব তৎপর” টাইপের দ্রুততার সঙ্গে কাগজগুলো হাতে নিয়ে যথাস্থানে গুঁজে দিলুম।
পুরো সেটটা শ্রেডারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বাবু ভারি তৃপ্তির মুখে বললেন, ‘ ইয়েক্সেলেন্ট বেটা, ইসকা দো দো কপি নিকালো, বহুত আর্জেন্ট লীগ্যাল ডকুমেন্ট হ্যায়’।
সেদিন আমার সামনে আয়না ছিল না, ফলে বলতে পারবো না আমার মুখমণ্ডলে এক্স্যাক্টলি কি এক্সপ্রেশন ফুটিয়াছিল!
গপ্প দুইঃ
চোদ্দই এপ্রিল, মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে গলদঘর্ম হয়ে বড়বাজারে হোলসেলারদের মধ্যে বিলিয়ে বেড়াচ্ছি, আর হাত কচলে দাঁতক্যালানে বাঞ্ছারাম হয়ে ‘হেঁ হেঁ, শুবো নবোবসসো দাদা, পরের মাসের অর্ডারটা একটু দেখবেন ‘ বলে গেঁড়ে মদন টাইপের বিলক্ষণ ধান্দাবাজি চালিয়ে যাচ্ছি, এমন সময়ে বাবুর ফোন, ‘বেটা মেরা উইন্ডোজ নট ওপেনিং ‘।
মুখে দিয়ে আট্টু হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল ‘ধুসসালা, তাতে আমি কি করবো, আমি কি দরজা জানলার মিস্তিরি, অ্যাঁ?’ কিন্তু হাজার হোক, বস। বললুম ‘একটু কোশিশ করকে দেখিয়ে, খুল যায়েগা, একটু ধাক্কাধাক্কি করনে সে কভি কভি খুল যাতা হ্যায়’। খানিকক্ষণ ধাক্কাধাক্কির স্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসার পর ফের সেই কাতরোক্তি ‘ফিরভি নেহি খুল রহা হ্যায় বেটা ‘। মিষ্টি করে বল্লুম ‘ অফিসে যে ছোকরা গুলো চায়ে দেতা হ্যায় উয়ো অলপ্পেয়ে মিনসেগুলো কি ঘোড়ার ঘাস কাট রাহা হ্যায়? প্রশান্ত, যতীন ইন লোগো কো ডাকিয়ে। দরকার হোগা তো উইন্ডোর ফ্রেম অব্ধি খুলকে লায়ে গা’। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘নেহি বেটা, উনলোগ সে নেহি হোগা, তুম জলদি অফিস আ যাও’!
আমি তো মাইরি, সংস্কৃতে যাকে বলে, স্তম্ভিত!! মার্কেট ছেড়ে এখন এই জন্যে অফিস যেতে হবে? জয়েনিং লেটারে ”দরকারে বসের কেবিনের দরজাজানালা সারাইতে হইবেক” টাইপের কিছু ক্লজ ছিল কি না খুব মন দিয়ে ভাবার চেষ্টা করতে করতে বল্লুম ‘ থোড়াসা তেল ডালকে রাখিয়ে, লুজ হো যায়েগা। ম্যায় আভি আ রাহা হুঁ’। ওপার থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাবু বললেন, ‘জলদি আ যাও বেটা’।
আমি আমার সেলস অফিসার সুজয়কে বাকিটা বুঝিয়ে দিয়ে পোস্তার দিকে ”হাডা” মাল্লুম। ডেরাইভারকে বলে, গাড়িটা একটু এগিয়ে এনে প্রায় দৌড়ে সিটে বসেই আবার ফোনালুম, ‘বস, কিছু হুয়া তেল ডালনে সে?’
ওপাশ থেকে হাউহাউ আর্তনাদ ভেসে এলো, ‘নেহি বেটা, আভি তো ল্যাপটপ ইজ অলসো নট ওপেনিং ‘!