মার্কেট ভিজিট ১
সক্কাল সক্কাল প্রভাদেভিতে ওলা ক্যাব থেকে নামতেই দাঁত কেলিয়ে যে ছোকরা এসে সেলাম ঠুকে দাঁড়ালো, তার নাম হাশিম মির্জা, দাদর এলাকার সেলস অফিসার। পরণে কুর্তা পাজামা, পাজামা গোড়ালির ওপর ইঞ্চিখানেক ওঠানো, তৎসহ থুতনিতে দিব্বি কচি একটি দাড়ি এবং নিখুঁত ভাবে কামানো গোঁফ। বেশ একটা অহিংস ছাগল ছাগল ভাব। বিগলিত গ্যালগ্যালে হাসি নিয়ে ‘আইয়ে স্যার, ওয়েলকাম টু মাই টেরিটোরি’ বলে সে কি অভ্যর্থনার ঘনঘটা!
একবার অপাঙ্গে তাকিয়ে নিলাম। নাহ, এখান থেকে বেরিয়েই শিন্ডেকে ধমকাতে হবে। এ কি ধরনের মার্কেট ভিজিটের পোষাক আশাক হে বাপু? বলি প্রপার ডেকোরাম বলে বস্তুটি কি গাধার ইয়েতে দিয়েচ? মুম্বাইএর এরিয়া সেলস ম্যানেজার শিন্ডে অবশ্য বলেছিলো এই নাকি আপাতত মুম্বাই টিমের সেরা সেলস অফিসার। হবেও বা,তা বলে তো আর ‘সিল্পি মানুস, হতিই পারে’ বলে ছেড়ে দেওয়া যায় না রে ভাই!!
যাগগে। চল মার্কেটে। হালগতিক দেখি। তাপ্পর তোর খপর নেবো।
টুকটুক করে খান দশেক দোকান করেও ফেললুম। হুঁ, খারাপ নয়। প্রোডাক্ট প্লেসমেন্ট আছে ভালোই। স্টক অ্যাভেইলেবল, রেঞ্জও আছে ঠিকঠাক, এবং ভিজিবিলিটিও চমৎকার।
মনটা একটু খুঁতখুঁত করতে লাগলো। এদ্দুর এলুম, একটু চেঁচামেচি, আগাপাশতলা ঝাড়, ভারী গলায় সদুপদেশ এসব না করলে খরচায় পোষাবে ক্যানে? দিনটা কি বৃথা যাবে?
একটু পর খেয়াল হল তেষ্টা পাচ্ছে। বিয়ার ঘেঁষা তেষ্টা। নেহাৎ ওয়ার্কিং আওয়ার্সে আছি তাই, নইলে রাস্তার উল্টোদিকেই একটা বার আগে থেকেই নজরে ছিল। এদিকওদিক তাকিয়ে দেখি হাশিমবাবুর ব্যাকপ্যাকে একটা জলের বোতল গোঁজা। বল্লুম ‘জলটা দে’। সে বাবু খানিকক্ষণ ঘাড় বাঁকিয়ে থেকে তাপ্পর ভারি কুণ্ঠিত স্বরে বলল ‘ইয়ে, স্যার, জলটা বাড়ি থেকে এনিচি’। বল্লুম সে তো দেখতেই পাচ্চি। তা বাড়ির জল খাওয়াতে কি পয়সা নিবি নাকি? নাকি জল খাওয়াতেও রেশন কার্ড লাগবে?
সে একগাল হেসে বলল, কি যে বলেন স্যার। নিন।
এরপর আরও খান দশেক দোকান। এরপর বিরক্ত লাগতে শুরু করলো। কোত্থাও কিছু বলার নেই। জেনারেলি গিন্নির সঙ্গে ঝগড়া হলেই পরদিন টুক করে একটা মার্কেট ভিজিট করে নিই। সেলস অফিসার আর সেলসম্যানদের ওপর খুব খানিকটা চোটপাট করে, চাকরি চলে যাবার ভয় দেখিয়ে, ভীত সন্ত্রস্ত ছেলেগুলোর গালে ঠোনা মেরে, শরীর মন চনমনে করে তুলে বাড়ি ফিরে আসি।এ হারামজাদা দেখছি সে গুড়ে কিলোখানেক বালি ঢেলে রেখেছে।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। নাহ, মার্কেট এত ঠিকঠাক থাকাটা কোন কাজের কথা নয়।
এরপর একটা রাস্তা পেরিয়ে, পেট্রল পাম্পের উল্টোদিকে ছোটখাট একটা দোতলা বাড়ির সামনে এনে ছোকরা আবার সেই গা জ্বালানি গ্যালগ্যালে হাসিটা হেসে বলল, যান স্যার, ব্যাপারটা সেরে আসুন।
আমার তো ভাই পায়নি। কি সেরে আসবো?
সে তো ঘাড়ফাড় নাড়িয়ে ”ন্ন্যা ন্ন্যা কি বলচেন স্যার” বলে জিভটিভ কেটে অস্থির।
তার মাথা নাড়ানো থামলে বল্লুম, তবে?
আরে স্যার ভালো করে তাকিয়ে দেকুন। সিদ্ধিবিনায়ক টেম্পুল। সারা দুনিয়া থেকে রেগুলার কুটি কুটি লোক আসে পেন্নাম ঠুকতে। হেব্বি জাগ্রত ঠাকুর স্যার। আর আপনি এতো কাচে এসেও স্লাইট পুণ্যি নিয়ে যাবেন নি, সেটি হয় নিকি কত্তা? হেঁ হেঁ। লোক পাটিয়েচি ডালা কিনে আনতে, এখন ওই কলের জলে একটু ওজু করে নিন দিকিন।
বিরক্ত হয়ে বল্লুম, দ্যাখো বাপু, আমার ওসবে বিশ্বেস টিশ্বেস নেই। মেলা কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান কোরো না। আর কাছেপিঠে কোথায় ভালো নন ভেজ রেস্তরাঁ আছে, নিয়ে চল। খুব হিংস্র টাইপের খিদে পেয়েছে।
সে বাবু তো চোখফোখ কপালে তুলে দিল।
বলেন কি স্যার? হেঁদুর ছেলে হয়ে এসব কি অনাছিষ্টি কতা? বলি ধম্মোজ্ঞান কি এক্কেরে থাকতে নেই? বউছেলেমেয়ে নিয়ে সোমসার করেন, বলি ভক্তি না হলেও, ভয় বলে তো একটি বস্তু আচে মশাই। অন্তত তাদের ভালোমন্দটাতো দেকতে হয়। চাচাচাচির কতাটা না হয় ছেড়েই দিলুম।
ছোকরার মুখে হঠাৎ খই ফুটতে দেখে পাক্কা আড়াই মিনিট হাঁ করে রইলুম।
তার পর মনে পড়লো, আমরা তো এইরকমই ছিলুম। মাজারে-মন্দিরে, সিন্নি-ফিরনিতে, শাঁখে-আযানে, ঝগড়া-কোলাকুলিতে, হাসি-কান্না- লজ্জা-ঘৃণা-ভয়ে-আনন্দে জড়াজড়ি জাপটাজাপটি করে তো খুব খারাপ ছিলুম না। দার-উল-হার্ব আর হিন্দুরাষ্ট্র কে শেখালে আমাদের? কাফের মারলেই বাহাত্তর হুরের লোভ কারা দেখালো? মোছলমান দেকলেই পাকিস্তানে পাঠানোর কতাটা কে আমাদের কানে তুলল বলুন দিকিন? দাদরির মাংস আর কালিয়াচকের কালিয়া কে খাওয়াচ্ছে আমাদের?
সত্যি করে বলুন তো, কে শেকালো এসব আমাদের? কে?