মার্কস : নৈতিক মাত্রায় মূল্যতত্ত্ব

মার্কস : নৈতিক মাত্রায় মূল্যতত্ত্ব
সৌরীন ভট্টাচার্য

ভূমিকা

মার্কসের তত্ত্বকাঠামোয় মূল্যতত্ত্বের ভূমিকা খুবই মৌলিক। এ কথাটা এমনিতে মনে হবে খুব সরল। তবে এ নিয়েও অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেকেই মনে করেন মার্কসের মূল্যতত্ত্ব যেভাবে আমাদের হাতে আছে তা অত জরুরি কিছু না। এবং সেই চেহারায় মূল্যতত্ত্বের মধ্যে যুক্তিগত সমস্যাও কিছু কম না। তাই মার্কসের মূল্যতত্ত্বের যে-চেহারায় আমরা অভ্যস্ত তা এড়িয়ে যাওয়াই বোধহয় বাঞ্ছনীয়। মার্কসের তত্ত্বকাঠামো খোলনলচে সমেত বর্জন করতে চান যাঁরা তাঁদের কথা হচ্ছে না। যাঁরা মনে করেন মার্কসের কাঠামোর অনেক কথা খুব জরুরি এবং সেসব কথা নিশ্ছিদ্রভাবে আমাদের হাতে পাওয়া দরকার তাঁরাও মূল্যতত্ত্ব বিষয়ে এরকম সংশয়ের প্রশ্ন তোলেন। কেউ কেউ তা হয়তো সংশোধনের চেষ্টাও করেন। মার্কসের মূল্যতত্ত্ব নিয়ে সমালোচনাত্মক প্রশ্ন তোলার একটা প্রায় নিরবচ্ছিন্ন ধারা বর্তমান আছে। তার সূত্রপাতও প্রায় মার্কসের সমকালেই। ইউজেন ব্যোম বাভার্ক-এর নাম এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই তীক্ষ্ণধারার সমালোচনার মূল লক্ষ্য আসলে মূল্যের শ্রমতত্ত্ব। মার্কসের আগে শ্রমভিত্তিক মূল্যতত্ত্বের একজন প্রধান প্রবক্তা ডেভিড রিকার্ডো। তাঁকেও এই সমালোচনা শুনতে হয়েছে যে, ওই ধরনের মূল্যতত্ত্বে বৈজ্ঞানিকতার কোনো পরিচয় নেই, যা আছে তা শুধু সমাজতান্ত্রিক বুলি। তাই মূল্যের শ্রমতত্ত্ব নিয়ে বিতর্কের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। আর কেবল মার্কস যে তার লক্ষ্য তাও ঠিক কথা নয়। তবে এটাও ঠিক যে, মার্কসের হাতেই শ্রমতত্ত্বের রূপ যে-পরিণতি পেয়েছে তার জন্য সমালোচনাও সেদিকে বেশি ধাবিত হয়েছে। এ ছাড়াও আলাদা রকমের তত্ত্বপরিবেশের প্রশ্ন তো আছেই।

মার্কসের তত্ত্বকাঠামোতে মূল্যতত্ত্বের ভূমিকা যে মৌলিক সে কথা মার্কস নিজে নিশ্চয়ই মুখ ফুটে বলেননি। বলার কথাও না। বস্তুত তাঁর নিজের তত্ত্বকাঠামো বিষয়ে ওরকম সামগ্রিক কোনও কথা তিনি বিশেষ কিছুই বলেননি। কিন্তু তাঁর পুঁজি গ্রন্থের যে আলোচ্য বিষয় সে বিষয়টিতে প্রবেশ করার জন্য মূল্যের ধারণা এবং তার তত্ত্ববিস্তার যে অপরিহার্য এমন কথা তাঁর নিজের লেখাতেই পাওয়া যায়। ওই বইয়ের এক ফরাসি সংস্করণ প্রকাশের সময়ে প্রস্তাব ছিল, গোটা বইটা ছোট ছোট আকারে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করা হোক, যাতে বই প্রকাশের মোট খরচ অল্প অল্প করে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে। মার্কস এই প্রস্তাবে সাগ্রহে সম্মতি জানান। বইকে সংক্ষিপ্ত করার চেয়ে মূল বইকে ভাগে ভাগে ভেঙে ফেলার চিন্তা ভাল। তাতে করে মূল্যতত্ত্ব অক্ষত থাকবে, ওই সংহত চেহারায় গোটা মূল্যতত্ত্ব পাঠকের হাতে আসা দরকার। মূল্যতত্ত্বের কোনো আধাখ্যাঁচড়া সংক্ষিপ্ত চেহারা তিনি চাইতেন না। অনুমান করা যায় পুঁজি গ্রন্থের কাঠামোর মধ্যে তাতে প্রবেশের অসুবিধা হবে, এই ছিল মার্কসের ধারণা।

পুঁজি বইটাকে যদি মার্কসের তত্ত্বকাঠামোর জন্য কেন্দ্রীয় গুরুত্বে স্থাপন করা হয় তাহলে মূল্যতত্ত্ব ব্যাপারটাই মার্কসীয় তত্ত্বে অত্যন্ত জরুরি বিষয় হয়ে উঠছে। কাজেই একটা প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে মার্কসের পুঁজি বইটাকে কোথায় কেমন করে স্থাপন করা হবে তাই নিয়ে। সহজভাবে বলতে গেলে কথাটা এইভাবে তোলা যায়: পুঁজি গ্রন্থটিকে আমরা দর্শনের বই হিসেবে দেখব না অর্থনীতির বই হিসেবে দেখব। সাধারণভাবে এই জাতীয় কথার খুব বেশি কোনও মানে নেই। কিন্তু বর্তমান প্রসঙ্গে দার্শনিক পাঠ ও অর্থনৈতিক পাঠের মধ্যে ফারাক করার একটা নির্দিষ্ট মানে আছে। সে মানে পেতে গেলে সমস্যাপটের ধারণার দিকে নজর দিতে হবে। খেয়াল করা দরকার আমাদের তত্ত্ববিশ্বে কোনও কথাই ঠিক একেবারে আলগা নিরাবলম্ব হয়ে থাকে না। বিভিন্ন ধারণা ও অনুষঙ্গে জড়িয়ে থাকে বলে সব কথারই একটা প্রতিবেশ তৈরি হয়। সেই প্রতিবেশ যে সবসময়ে খুব পরিষ্কার চেহারায় ফুটে ওঠে তা নয়। এক এক রকমের প্রতিবেশ থেকে অন্য রকমের প্রতিবেশকে আলাদা করতে গেলে টের পাওয়া যায় কীভাবে ছোট ছোট ফারাকের মধ্যে থেকে আস্তে করে বড় রকমের একটা তফাত ঘটে যায়। ওই বড় তফাত যখন ঘটে তখন খেয়াল করে দেখলে দেখা যাবে যে আলোচ্য সমস্যার পটভূমিটাই বদলে গেছে। অর্থাৎ, আমরা যেন সমস্যার একটা পট থেকে অন্য একটা পটে সরে এসেছি। এগুলো ধরতে গেলে সমস্যাপটের ধারণা বেশ কাজে লাগে। দার্শনিক পাঠ যেহেতু আমাদের বিবেচনার পরিধি বড়ো পরিসরে বিস্তৃত করে দেয়, তাই দার্শনিক পাঠের দিক দিয়ে এগোলে অনেক সময়ে দিশা পেতে সুবিধা হয়। প্রতিতুলনায় অর্থনৈতিক পাঠ আমাদের একটি নির্দিষ্ট সংকীর্ণ পরিধিতে আটকে দেয়। তখন অর্থনৈতিক সমস্যাপটের সংকীর্ণ গণ্ডিতে নিতান্ত এক বিকল্প তত্ত্বের বেশি আর কোনও চেহারা ফুটে ওঠে না। দার্শনিক পাঠে অন্য মাত্রাও স্পর্শ করা যায় বলে অর্থনৈতিক ঘেরাটোপের সমস্যা কাটানো যায়। কোনও সন্দেহ নেই যে, পুঁজি গ্রন্থের অর্থনৈতিক পাঠের এক দীর্ঘ ইতিহাস তৈরি হয়ে আছে। মার্কসীয় প্রকল্পের অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদী ব্যাখ্যা এর জন্য অনেকটা দায়ী। সিন্দবাদের নাবিকের মতো সে ব্যাখ্যা আমাদের ঘাড়ে চেপে থাকে বলে আমরা সহজে অর্থনৈতিক সমস্যাপটের বাইরে মূল্যতত্ত্বকে স্থাপন করে দেখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি না।

দুই সমস্যাপট

ইংরেজিতে ইকনমি আর ইকনমিক্স দুটো আলাদা শব্দ। ইকনমি বলতে বোঝায় বাস্তব জীবনের সেইসব প্রক্রিয়া যার মধ্যে দিয়ে আমাদের খাওয়া-পরার মতো দৈনন্দিন সমস্যা এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের দ্রব্যোৎপাদন ও বিভিন্ন প্রয়োজনে তাদের বণ্টনের মতো সমস্যার সমাধান হয়। আর ইকনমিক্স বলতে বোঝায় সেই বিদ্যাক্ষেত্র যেখানে এই সমস্যাগুলির আলোচনা ও ব্যাখ্যা করা হয়। ইকনমি হল বাস্তবের একটা অংশ, আর ইকনমিক্স হল সেই বাস্তবের আলোচনার এক বিদ্যাক্ষেত্র। বাংলাতে অর্থনীতি শব্দটা দিয়ে আমরা দুটো অর্থই প্রকাশ করে থাকি। প্রসঙ্গ থেকে বুঝে নিতে হয় কোথায় তা বাস্তবের অর্থনীতির কথা বলছে আর কোথায়-বা তা সেই অর্থনৈতিক বাস্তবের আলোচনা ক্ষেত্রের কথা বলছে।

আধুনিক কালের অর্থনীতি বলে যে-বিদ্যাক্ষেত্রের সঙ্গে আমরা পরিচিত সাধারণভাবে তার উৎসবিন্দু ধরা হয় ইংরেজদের পোলিটিকাল ইকনমি। অবশ্য এই অবস্থান মূলত ইংরেজি ভাষা প্রভাবের অঞ্চলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে এ কথায় সন্দেহ নেই যে, আধুনিক অর্থনীতির বিকাশে পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ইংল্যান্ডের প্রভাবই বেশি। এর পিছনে অনেক ঐতিহাসিক ও দার্শনিক কারণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। সে আলোচনা এখানে অবান্তর। কিন্তু মার্কসের মূল্যতত্ত্বের ধারণা যে ইংরেজদের পোলিটিকাল ইকনমির ধারণাগত পরিমণ্ডলের মধ্যে অবস্থিত এটুকু মেনে নেওয়া চলে। মার্কসের সমস্যাপট চিনে নিতে গেলে এই উৎসবিন্দুর দিকে যেমন আমাদের তাকাতে হবে, তেমনই ওই পোলিটিকাল ইকনমির সঙ্গে তাকে একাকার করে দিলেও যে চলবে না, সে কথাও মনে রাখতে হবে।

ইংরেজদের পোলিটিকাল ইকনমি মোটামুটি আঠারো শতকের ব্যাপার। তার প্রধান পুরুষ অ্যাডাম স্মিথ (১৭২৩-১৭৯০)। তাঁর প্রধান গ্রন্থ অ্যান ইন্‌কোয়ারি ইন্‌টু দ্য নেচার অ্যান্ড কজেস অফ ওয়েলথ অফ নেশন্‌স্‌ (১৭৭৬)। সমাজের পার্থিব ধনসম্পদ বৃদ্ধির কাহিনি রচনা করা ছিল স্মিথের প্রধান উদ্দেশ্য। মনে রাখতে হবে তার আগের পর্বের ইতিহাসে ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের প্রচেষ্টায় নতুন মহাদেশ আবিষ্কৃত হয়েছে। অর্থাৎ, সেই অজানা ভূখণ্ডের পরিচয় জানা গেছে ও তার সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। ইউরোপীয় দৃষ্টিতে পার্থিব সম্পদের চিন্তায় ও বিস্তারে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল। এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার আঠারো শতকী চেহারা দাঁড়াল নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও শিল্পোৎপাদনের সম্ভাবনা। ইতিহাসের এই পর্বকেই সাধারণত গ্রেট ট্রান্সফরমেশন বা মহারূপান্তরের পর্ব বলে বলা হয়। অ্যাডাম স্মিথ এই মহারূপান্তরের দার্শনিক। অর্থাৎ মানুষের সমাজ ইতিহাসের একটা পর্বের বিকাশ ও বিবর্তনের কাহিনি রচনা করা তাঁর লক্ষ্য। এবং সেই পর্বে মানুষের সামাজিক উৎপাদনের চেহারায় ও প্রযুক্তিগত পদ্ধতিতে বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। বাষ্পচালিত শক্তির ব্যবহার মানুষের আয়ত্তে আসায় সামাজিক উৎপাদনের চালিকাশক্তিতে গুণগত বদল এসে গেল। কৃষি উৎপাদনে যে-অর্থে পশুশক্তি চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয় সে-অর্থে শিল্পে এল বাষ্পশক্তির ব্যবহার। এতে করে উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন হয়ে গেল। এই পর্বেই শ্রমবিভাজন ও শ্রমিকের দক্ষতাবৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে এল শ্রমের উৎপাদনী শক্তির লক্ষণীয় বৃদ্ধি। এই রূপান্তরের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত ছিল অ্যাডাম স্মিথের সমস্যাপট।

অ্যাডাম স্মিথের হাতে যে ক্ল্যাসিকাল পোলিটিকাল ইকনমির সূত্রপাত সেখানে মূল্যতত্ত্বের একটা বড় ভূমিকা দেখা দেয় সূচক সমস্যার সমাধান হিসেবে। আঠারো শতকী আধুনিক অর্থনীতিতে কৃষি উৎপাদন ছাড়িয়ে শিল্পোৎপাদন ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এই উৎপাদনের বৈচিত্র বেশি। এই বৈচিত্রের মধ্যে কোনও একটা নির্ভরযোগ্য একক ছাড়া আমরা মোট উৎপাদনের কোনও ধারণাগত হদিশ করে উঠতে পারব না। পার্থিব ধনসম্পদের বৃদ্ধিই যখন আলোচনার লক্ষ্য তখন এমন এক একক আমাদের লাগবে যার সাহায্যে সমস্ত রকমের দ্রব্যসম্ভারকে আমরা তুল্যমূল্য এক বিচারে নিয়ে আসতে পারি। ক্ল্যাসিকাল তত্ত্বকাঠামোতে মূল্যের ধারণা সমাজের মোট উৎপাদনের সূচক সমস্যার এক সমাধান। মূল্যই প্রত্যেক উৎপাদিত দ্রব্যের অন্তর্গত সাধারণ ধর্ম। ধর্মের এই সাধারণত্ব আসে উৎপাদনের সূত্রে। মূল্যের ধারণা সেই কারণেই উৎপাদনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।

কিন্তু আধুনিক সমাজে উৎপাদনের সঙ্গে বিনিময় প্রক্রিয়াও ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকে। সমাজে শ্রমবিভাজন যত এগোবে বিনিময়ের অবকাশ ও প্রয়োজন তত বেশি করে দেখা দেবে। সমাজে পাঁচ রকমের উৎপাদনের কাজ পাঁচ হাতে ভাগ হয়ে গেছে তো বটেই, একটা নির্দিষ্ট উৎপাদনের বিভিন্ন অংশও বিভিন্ন হাতে ভাগ হয়ে গেছে। তাই একের সঙ্গে অন্যের দ্রব্য বিনিময়ের দরকার এখন অনেক বেশি। গুণগতভাবে আলাদা রকমের দু’টি জিনিসের বিনিময়ের বেলায় ন্যায্যতা বা সমতা বা এই ধরনের কোনও এক রকমের নৈতিক প্রশ্ন দেখা দেবেই। আমি আমার দ্রব্যের কতটুকুর বিনিময়ে অন্যের দ্রব্যের ঠিক কতটুকু পেলে বলা যাবে যে ন্যায্য বিনিময় সাধিত হল? ন্যায্যতার কোনও একটা মানদণ্ড যদি স্থির করা যায়, তাহলে সেই মানের থেকে বিচ্যুতির ধরনটাও তখন হদিশ করা যাবে। অর্থাৎ, বিনিময়ে অন্যায়ভাবে সুবিধা পাওয়া বা অন্যায়ভাবে প্রতারিত হওয়ার অবকাশ রয়েছে। সে বিষয়ে কোনো নির্দিষ্টতায় পৌঁছতে গেলে বিনিময় হারের ন্যায্যতার প্রশ্ন মীমাংসা করতে হবে। বিনিময়ের সময়ে কোনও দ্রব্যের এক এককের সঙ্গে অন্য একটি দ্রব্যের যত এককের বিনিময় হচ্ছে তাকে বলা যেতে পারে দ্রব্য দু’টির বিনিময় হার বা তাদের একটির সাপেক্ষে আর একটির দাম। কোনও একটিমাত্র নির্দিষ্ট দ্রব্যের সাপেক্ষে যদি সমস্ত বিনিময়যোগ্য দ্রব্যের বিনিময় হার জানা থাকে তাহলে প্রত্যেকটি দ্রব্যের পারস্পরিক বিনিময় হারও জানা হয়ে যাবে। তাই আমরা বলতে পারি যে, দ্রব্যসমূহের দাম জানা থাকা মানে সেই দ্রব্যসমূহের বিনিময় হার জানা আছে। দ্রব্যাদির দাম, এই কাঠামো সম্বন্ধেই ওই ন্যায্যতার প্রশ্ন এখন তোলা সম্ভব।

মূল্যের ধারণা ওই ন্যায্যতার প্রশ্নের এক রকমের সমাধান। মূল্যের ধারণার মধ্যে আমরা গুণগতভাবে ভিন্ন দু’টি দ্রব্যের মধ্যেকার এক ধরনের সমতার একটা মাপকাঠি পেয়ে যাচ্ছি। সেখানে সমতা আসছে উৎপাদনের বিচারের দিক থেকে। সমাজে দু’টি উৎপাদিত দ্রব্যের মধ্যে উৎপাদনের দৃষ্টিকোণ থেকে একটা সমতা আবিষ্কার করাই মূল্যতত্ত্বের লক্ষ্য। গুণগত বিচারে দু’টি ভিন্ন দ্রব্যের মধ্যে সমতা সাধন করা যায় মূল্যের ধারণার সাহায্যে। ধ্রুপদি অর্থনীতিতে মূল্যের ধারণা এই উৎপাদনগত সমতার সন্ধানে ব্যাপৃত। দ্রব্যাদির মধ্যে মূল্য কাঠামো জানা থাকা মানে উৎপাদনগত বিচারে সমতার একটা পরিমাণগত রূপায়ণ সম্ভব হচ্ছে। ধরা যাক দু’টি দ্রব্যের মধ্যে মূল্যানুপাত পাওয়া গেল ১:২। অর্থাৎ প্রথম দ্রব্যের এক এককে যতটা মূল্য আছে দ্বিতীয় দ্রব্যের দুই এককে ঠিক ততখানি মূল্য আছে। এ কথাটা পাওয়া গেছে দু’টি দ্রব্যের উৎপাদনের বিবরণ থেকে। দ্রব্য দু’টির বিনিময় হার বিষয়ে কোনও কথা কিন্তু এই মূল্য হার থেকে কিছু বলা যাচ্ছে না। শুধু এইটুকু বলা যায় যে, বিনিময় হার ওই ১:২ হলে উৎপাদনের চেহারার সঙ্গে সমতা রক্ষা হচ্ছে। এই সমতা বিনিময়ের ন্যায্যতার একটা মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। ধ্রুপদি মূল্যধারণার এটা এক নৈতিক মাত্রা। মার্কসের মূল্যতত্ত্বে নৈতিকতার এই মাত্রা অবশ্যই বর্তমান। উপরন্তু মার্কসের তত্ত্বে মূল্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও জরুরি এক নৈতিক মাত্রা। বিযুক্তির ধারণার উপরে প্রতিষ্ঠিত সেই মাত্রা। মার্কসীয় মূল্যতত্ত্বে বিযুক্তির ধারণা দেখা দেয় যে-চেহারায় তার জন্য পরিচিত শব্দবন্ধ হল ‘পণ্যরতি’, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘কমোডিটি ফেটিশিজ়ম’। সে প্রসঙ্গে আমরা আসব একটু পরে। এই নৈতিক মাত্রা বিষয়ে রোনাল্ড মীক পণ্যরতি ও বিযুক্তির গুরুত্ব যথার্থ অনুধাবন করেছেন।

উপরের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থেকে একটা কথা পরিষ্কার টের পাওয়া যাচ্ছে। ধ্রুপদি সমস্যাপটে কোনও দ্রব্যের মূল্য তার উৎপাদনগত চরিত্রের একটা প্রকাশ। দ্রব্যসমূহ উৎপাদিত হলেই তার মূল্যকাঠামো নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যগুলি পারস্পরিক বিনিময়ের সম্পর্কের মধ্যে জড়িত হোক বা না-হোক, তাদের মূল্যকাঠামো আমাদের হাতে থাকছে অবশ্যই। বিনিময়ের প্রশ্ন উঠছে এর পরের ধাপে। সেই স্তরে সাম্যাবস্থার প্রয়োজন খুব জরুরি। দ্রব্যগুলির মধ্যেকার নির্দিষ্ট বিনিময় হার এমন হওয়া দরকার যাতে করে প্রত্যেক দ্রব্যের বেলায় চাহিদা ও জোগানের সামঞ্জস্য সাধিত হয়। তা যদি না হয় তাহলে চাহিদা-জোগানের অসামঞ্জস্যের জন্য বিনিময় প্রক্রিয়া বস্তুত সুসম্পাদিত হতে পারবে না। উৎপাদিত দ্রব্যের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। তাই সাম্যাবস্থার বিশ্লেষণও জরুরি সমস্যা। কিন্তু তা চরিত্রগতভাবেই মূল্যতত্ত্বের সমস্যার থেকে আলাদা। অর্থ সাপেক্ষে বিনিময় হারকে আমরা বলছি দাম। যে-দামে সাম্যাবস্থা সাধিত হচ্ছে তাকে বলছি সাম্যাবস্থার দাম। সাম্যাবস্থার দামে পৌঁছতে পারলে চাহিদা-জোগানের সামঞ্জস্য সম্ভব হবে। সুসমঞ্জস বিনিময়ের জন্য এই সাম্যাবস্থা আমাদের কাম্য। চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বিনিময়ে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকের স্বাধীন ইচ্ছা প্রতিফলিত। কোনও নির্দিষ্ট বিনিময় হারে কে কোন দ্রব্যের কতটুকু পেতে চায় বা ছেড়ে দিতে চায় সেই অনুসারে দ্রব্যাদির চাহিদা-জোগান নির্ধারিত হচ্ছে। সাম্যাবস্থায় প্রত্যেকের এই স্বাধীন ইচ্ছা ঠিকমতো পূর্ণ হচ্ছে। তাই প্রত্যেকটি দ্রব্যের ব্যবহার যেখানে যেমন চাহিদা সেইমতো নির্ধারিত হতে পারছে এবং সাম্যাবস্থার সুবাদে সেখানে কোনও অসামঞ্জস্য তৈরি হচ্ছে না। ধ্রুপদি অর্থনীতির সমস্যাপট সমাজের বিকাশের তত্ত্ব নির্ধারণে আগ্রহী আর সাম্যাবস্থার সমস্যাপট এক নির্দিষ্ট সময়পরিধিতে দ্রব্যাদির যথাযথ বিতরণে আগ্রহী। ধ্রুপদি চিন্তার মূল্যধারণা হিসেবে উৎপাদনসঞ্জাত আর সাম্যাবস্থার দাম শুধুই বিনিময় প্রাসঙ্গিক। দাম বিনিময়ের হার, মূল্য উৎপাদনমুহূর্তে দ্রব্যের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত এক বস্তু। বিভিন্ন দ্রব্যের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত সেই বস্তুর পরিমাণের ওপরে নির্ভর করে স্থির হয় তাদের মূল্য হার। মার্কসের মূল্যতত্ত্ব ধ্রুপদি চিন্তার সমস্যাপটকে আরও বিস্তারিত ক্ষেত্রে প্রয়োগে সচেষ্ট।

দ্রব্যের পণ্যায়ন

মানব-ইতিহাসের যে পর্বটাকে আমরা মোটামুটি পুঁজিতন্ত্রের কাল বলে চিনে থাকি ইংরেজদের ধ্রুপদি অর্থনীতি মূলত সেই পর্বের বিচার-বিশ্লেষণে সীমাবদ্ধ। বললাম বটে মানব-ইতিহাসের একটা পর্ব, কিন্তু আসলে তা ছিল প্রধানত সতেরো-আঠারো শতকে বিকশিত পশ্চিম ইউরোপের সমাজের কথা। মার্কসের বেলাতেও তাই। তবে গোটা উনিশ শতকের পুঁজিতন্ত্রকে মার্কস দেখে যাবার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাই সেই পর্বের কিছু কিছু লক্ষণও হয়তো তাঁর বিবেচনায় ছিল। কিন্তু ইংরেজদের ধ্রুপদি অর্থনীতি থেকে মার্কসের ফারাক ভাবতে গেলে শুধু এইটুকু কথা আদৌ কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা নয়। মার্কস পুঁজিতন্ত্র বা সমাজ-ইতিহাসের যেকোনও পর্বকে যে দৃষ্টিতে দেখতে চেয়েছিলেন তফাত মূলত সেখানে। মার্কসের কাছে প্রত্যেকটা পর্বই পরিবর্তনের এক একটা স্তর। অর্থাৎ, সমাজ-ইতিহাসের কোনও পর্বই স্থির নয়, ক্রম পরিবর্তনশীল। মার্কসের তত্ত্বকাঠামো সমাজের এই পরিবর্তনশীল চরিত্রকে ব্যাখ্যা, বর্ণনা ও বিশ্লেষণের চেষ্টা করে। মার্কসের দৃষ্টিতে পুঁজিতন্ত্রের আগে অন্য চরিত্রের সমাজকাঠামো বর্তমান ছিল, আবার এর পরেও অন্য কোনও কাঠামোর উদ্ভব হবে। আপাতত ওই কালপর্বে এই এক রকমের কাঠামো আমরা দেখতে পাচ্ছি। তার বিচার-বিশ্লেষণ আমাদের লক্ষ্য।

যে পর্বকে বিশ্লেষণ করতে হবে তার চরিত্রায়ণ করে নিতে হবে আগে। অন্তত মোটামুটি একটা চেহারা সাজিয়ে নিতে হবে। এই চরিত্রায়ণ করতে হবে ইতিহাসগতভাবে। অর্থাৎ, এমনভাবে পর্বটাকে চিহ্নিত করতে হবে যাতে করে ইতিহাসের অন্যান্য পর্ব থেকে এই পর্বকে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়। মার্কসের তত্ত্বে চিহ্নিতকরণের এই কাজটা প্রধানত হচ্ছে পণ্যের ধারণার মাধ্যমে। ওপরে আমরা উৎপাদন ও বিনিময় নিয়ে এ-পর্যন্ত যা আলোচনা করেছি তা সবই করেছি দ্রব্যের প্রসঙ্গে। সে আলোচনায় ঐতিহাসিক পর্বভেদের কোনো প্রয়োজন ছিল না। কাজেই দ্রব্যের উৎপাদন হচ্ছে, না পণ্যের উৎপাদন হচ্ছে, এ কথাটা সেখানে জরুরি নয়। কিন্তু মার্কসের আলোচনায় ঐতিহাসিক বর্গ নির্মাণ একান্ত জরুরি। কেননা ইতিহাসের পর্বভেদ ও তার বিশ্লেষণ এই আলোচনার মূল লক্ষ্য। তাই মার্কসের প্রসঙ্গে দ্রব্য ও পণ্যের তফাত পরিষ্কার করতেই হবে।

পণ্য হল এমন এক উৎপাদন যেখানে উৎপাদিত দ্রব্য বা বস্তু উৎপাদনকারীর ব্যবহারের লক্ষ্যে উৎপাদিত হচ্ছে না। উৎপাদিত হচ্ছে বিক্রয়ের জন্য। অজানা অচেনা কোনো ক্রেতার জন্য। বাজার নামে যে সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ক্রেতা ও বিক্রেতার সংযোগবিন্দুটি সেখানে সংগঠিত রূপ পাচ্ছে। পণ্যোৎপাদনের লক্ষ্য এই বাজারে নিবদ্ধ। দ্রব্য উৎপাদিত হয়— যে সরাসরি উৎপাদন করে তার অথবা তার কোনো চেনাজানা নিকটজনের ব্যবহারের জন্য। সেখানে দ্রব্যটির ব্যাবহারিক মূল্যই প্রধান বিবেচ্য। দ্রব্যটি কারও নির্দিষ্ট কোনো কাজে লাগছে। ব্যবহার যে করছে তার কোনো প্রয়োজন মিটছে। ব্যাবহারিক মূল্যের দিক থেকে দ্রব্যটির উপভোগ মানে দ্রব্যের গুণাগুণ এবং ব্যবহারকারীর প্রয়োজনের মধ্যে এক সম্পর্ক স্থাপন। কিন্তু পণ্যচরিত্রে দ্রব্যের গুণ, ব্যবহারকারীর উপভোগ এসব কোনও কথাই বিবেচ্য নয়। সেখানে একমাত্র বিবেচ্য পণ্যের সঙ্গে জড়িত বিনিময় মূল্য। একটি পণ্য বিনিময় করে অন্য যে-পণ্য পাওয়া যাবে তার মূল্যই প্রথম পণ্যের বিনিময় মূল্য। মূল্য, অর্থাৎ সেই অন্তর্গত বস্তু যা উৎপাদনের সূত্রে পণ্যটির মধ্যে অন্তর্নিহিত হয়ে আছে। এবং সেই মূল্যের আছে শুধু এক পরিমাণগত চরিত্র, তার অন্য কোনও গুণাগুণ নেই। পণ্যতন্ত্রে বিনিময় মূল্য মূলত নিতান্ত পরিমাণগত একটি ধারণা। তার কোনও গুণগত চরিত্র নেই। বিনিময় মূল্যের ভিত্তিতে আছে যে–মূল্যের ধারণা তারও কোনো গুণগত চরিত্র নেই। সেইজন্যেই বিনিময় মূল্যেরও কোনও গুণগত চরিত্র নেই। কেন মূল্যের কোনও গুণগত চরিত্র নেই তা বোঝা যাবে মার্কসের মূল্যতত্ত্ব থেকে। ইতিমধ্যে খেয়াল করা যাক পণ্য কেন ঐতিহাসিক বর্গ।

পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের প্রথম বাক্যটি হল: ‘যেসব সমাজে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি বর্তমান সেসব সমাজে সম্পদের চেহারা “পণ্যের এক বিপুল পুঞ্জীভূত সম্ভার” হিসেবে প্রতিভাত হয়ে থাকে, এক একটি নির্দিষ্ট পণ্য সেই সম্ভারের এক এক একক।’ পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি মানে পণ্যেরই উৎপাদন। এখানে একটা ব্যাপারে একটু সাবধান হওয়ার দরকার আছে। এই কথাগুলোকে বুঝতে হবে মার্কসের পদ্ধতির কথা মাথায় রেখে। সেই পদ্ধতির এক প্রাথমিক কাজ তত্ত্ববর্গ নির্মাণ করা। তাই এই কথাগুলোকে নিতে হবে স্পষ্ট প্রতীয়মান লক্ষণ হিসেবে, তথ্যের বর্ণনা হিসেবে নিলে চলবে না। ইতিহাসে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পণ্যোৎপাদন প্রক্রিয়াও ক্রমশ বিকাশ লাভ করে। অর্থাৎ, এমন অনেক জিনিস পাওয়া যাবে যা আগে পণ্য হিসেবে উৎপাদিত হত না, এখন হয়তো তাই হচ্ছে। ব্যাবহারিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য অল্প পরিমাণে অল্প পরিসরে উৎপাদন আর বৃহদায়তন বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য বিপুল পরিমাণে উৎপাদন, এই দুইয়ের মধ্যে যে ফারাক তা-ই হল দ্রব্য ও পণ্যোৎপাদনের ফারাক। পণ্যোৎপাদনের বিস্তার ইতিহাসের নির্দিষ্ট পর্বের এক নির্দিষ্ট চরিত্র। এরই সঙ্গে জড়িয়ে আছে যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির প্রয়োগ, ও আনুষঙ্গিক শ্রমবিভাজনের প্রক্রিয়া। ইতিহাসে যে একদিন কলকারখানার উৎপাদন জায়গা জুড়ে নিয়েছিল সে তো এক নির্দিষ্ট পর্বেরই ধর্ম। উৎপাদন বড় আয়তনে করতে গেলে বড় আয়তনে পুঁজি সংগ্রহ করতে হয়। তাই ক্রমে ক্রমে পুঁজি বাজারের প্রাতিষ্ঠানিক চেহারাতেও বদল এল। আধুনিক অর্থনীতির চেহারা নানা দিকেই পরিবর্তিত হল। এইসমস্ত প্রক্রিয়ার বিকাশের পর্বে পর্বে বিকশিত হল দ্রব্যের পণ্যে রূপান্তরের প্রক্রিয়া।

পণ্যের মূল্যতত্ত্ব

মার্কসীয় তত্ত্বে দ্রব্যের পণ্যায়ন প্রক্রিয়া একটি মৌলিক প্রক্রিয়া। তাই পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের গতিবিধি অনুধাবন করতে গেলে পণ্যের চরিত্র বুঝে নিতে হবে। ইংরেজদের পোলিটিকাল ইকনমির দুই প্রধান পুরুষ অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডো। এঁরা দু’জনেই যেকোনও দ্রব্যের ব্যাবহারিক মূল্য এবং বিনিময় মূল্যের মধ্যে ফারাক করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ওই ফারাকের থেকে মার্কস যতদূর পর্যন্ত সমাজ সম্পর্কের অন্তর্নিহিত কথায় যেতে পেরেছিলেন এঁরা ততটা পারেননি। তার কারণ সম্ভবত এই যে, মার্কসের সমস্যাপটে ইতিহাস যতটা জরুরি ছিল এঁদের বেলায় তো তা ছিল না। কেননা এঁরা ইতিহাসের একটা নির্দিষ্ট পর্বকেই বুঝে নিতে চাইছিলেন। যেন সেই পর্বটা ইতিহাসের গতিপথে একটা চূড়ান্ত কোনও জায়গায় পৌঁছে গেছে। ইতিহাসের পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়ার দিকে তাঁদের মন নিবদ্ধ হয়নি। তাই তত্ত্ব আলোচনার যেসব বর্গ তাঁরা নির্মাণ করেছিলেন তাদের মধ্যে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের অবকাশ ছিল না। দ্রব্যের পণ্যায়ন যে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এক চলমান প্রক্রিয়া এই কথাটা হিসেবে নিলে অন্তরালবর্তী অনেক সামাজিক প্রক্রিয়ার রহস্যজাল উন্মোচিত হতে পারে।

উনিশ শতকের আর্থ-সামাজিক বিকাশে, মূলত পশ্চিম ইউরোপের সমাজের ক্ষেত্রে, বিভিন্ন ক্ষেত্রের উৎপাদন ক্রমশ পণ্যের চরিত্র অর্জন করছিল। কলকারখানা-ভিত্তিক উৎপাদনের এটাই ভবিতব্য। যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি, অনেক বড় আকারে পুঁজির সংগ্রহ, সামাজিক পুঁজির নতুন সাংগঠনিক চেহারা, এইসবের সঙ্গে আগের দিনের অসংগঠিত পুঁজির ভিত্তিতে খানিকটা নিজেদের ব্যক্তিগত দায়িত্বে ও তত্ত্বাবধানে অল্পস্বল্প উৎপাদনের যে-চেহারা তা চরিত্রগতভাবে আলাদা। পুঁজি ও উৎপাদন সবই সেখানে ব্যক্তি পরিসরে সীমাবদ্ধ। কাজে কাজেই সে উৎপাদনের ব্যবহার ক্ষেত্রও অনেক সংকীর্ণ। তার বদলে যাকে আমরা পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন বলে দেখতে পাই তার পুঁজি সংগৃহীত হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক পুঁজি-বাজারে আর উৎপাদিত পণ্যের ব্যবহার ক্ষেত্রও অনেক প্রসারিত। প্রসারিত বলেই এই উৎপাদন তন্ত্রে প্রত্যক্ষ উৎপাদনকারী এবং উৎপাদিত পণ্যের ব্যবহারকারীর মধ্যে কোনও চেনাজানা নেই। সবটাই নৈর্ব্যক্তিক এক তন্ত্রের অন্তর্গত প্রক্রিয়া হিসেবে সাধিত হচ্ছে। সমাজ বিকাশের স্তরটাই এখন অন্য প্রকৃতির। পরিবহণের সুযোগসুবিধা এখন বেশি, নইলে তো পণ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অত সহজে চলাচল করতেই পারবে না। তেমনই সমাজক্ষেত্রে শক্তি ব্যবহারের চেহারাও এখন অন্য রকমের। বাষ্প শক্তি থেকে বিদ্যুৎ শক্তি, তা থেকে পরমাণু শক্তি, এইসব উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়ার যে পরিবর্তন দেখা গেছে তার ফলে পণ্যোৎপাদন প্রক্রিয়াই প্রসারিত হয়েছে। তাই মার্কসের চিন্তায় পণ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার পরিণতি। সমাজ-ইতিহাসের গতিপথ তার মধ্যে প্রতিফলিত।

অতএব পণ্য উৎপাদিত হয় বিনিময়ের লক্ষ্যে। পণ্যোৎপাদনের অর্থ হল বিনিময় মূল্যের উৎপাদন। এই বিন্দুতে পণ্য ব্যাবহারিক মূল্যের থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত হয়ে পড়ছে। তার ব্যাবহারিক মূল্য থাক চাই নাই থাক, বিনিময় মূল্য থাকলেই চলবে। পণ্য হিসেবে সমাজের কাছে তার তাৎপর্য একমাত্র বিনিময় মূল্যের বিচারে। ব্যাবহারিক মূল্যের ধারণাটাই যেন এখান থেকে খসে পড়ছে। সদর্থক ব্যাবহারিক মূল্যের বদলে উৎপাদনের যদি রীতিমতো অসদর্থক ব্যাবহারিক মূল্য থাকে তাতেও কিছু এসে যাবে না, যদি তার বিনিময় মূল্য ঠিক থাকে। তাই সামরিক অস্ত্র, তাই মাদক দ্রব্য, সবই একমাত্র বিনিময় মূল্যের বিচারে বিচার্য। নীতিগত মাত্রা আমাদের মূল্যতত্ত্বের সঙ্গে এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে যাচ্ছে। সমাজমনের বিচারে হিতকর আর অহিতকর উৎপাদন দুই-ই পণ্যমূল্যের বিচারে তুল্যমূল্য হয়ে যাচ্ছে। পণ্য হিসেবে ওই নির্দিষ্ট উৎপাদনের মধ্যে যে-পরিমাণ মূল্য অন্তর্গত হয়ে থাকছে তা-ই সমাজের নতুন মূল্যসৃষ্টির সূচক। উৎপাদিত বস্তুটি সমাজের পক্ষে মঙ্গলজনক, না অমঙ্গলজনক, এইসব নৈতিক প্রশ্নের সে তোয়াক্কা করে না। কাজেই পুঁজিতান্ত্রিক মূল্যসৃষ্টি নৈতিক বিচারের অমঙ্গলকেও গ্রাহ্য করে তুলতে পারে।

এখন প্রশ্ন পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনে মূল্যের স্বরূপ কী। মার্কসের আলোচনায় এই প্রশ্নের উত্তরে রীতিমতো গুণগত বিচার করা হয়েছে। দু’টি পণ্যের মধ্যেকার পরিমাণগত বিনিময় হার মূল্য নয়। ওই হার কোনও এক রকমে পণ্য দু’টির অন্তর্গত মূল্যের সঙ্গে হয়তো জড়িত। কিন্তু মার্কসের মূল্যতত্ত্বে মূল্যের গুণগত স্বরূপ বিচারই প্রধান প্রশ্ন। সামাজিক উৎপাদনের মধ্য দিয়ে যে মূল্যসৃষ্টি হচ্ছে তার কারণ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সমাজের কাছে মূল্যবান এমন কোনও কিছু ওই উৎপাদিত পণ্যটির মধ্যে অন্তর্গত হয়ে থাকছে। উৎপাদনের জন্য সমাজের কাছে মূল্যবান জিনিস কোনটি? মার্কসের দৃষ্টিতে এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা পাই শ্রম, সামাজিক শ্রম। শ্রমের ধারণাটা তাই বিশদে বুঝে নেওয়া দরকার।

শ্রম : মূর্ত ও বিমূর্ত

যেকোনও দু’টি পণ্যের বিনিময়ের প্রসঙ্গে আমরা এই সমীকরণ ব্যবহার করতে পারি।

ক পণ্যের ১ একক = খ পণ্যের x একক।

এই সমীকরণটিকে বুঝে নেওয়া মার্কসের মূল্যতত্ত্বের মূল কথা। মার্কসের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির তাগিদে এই বুঝে নেওয়া ব্যাপারটাকেও এগোতে হবে পণ্য দু’টির উৎপাদনগত অবস্থানের দিক থেকে। কেন? তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিতে মানুষের সমাজ-ইতিহাসের চরিত্র মুখ্যত নির্ভর করে সমাজের উৎপাদনের চরিত্রের ওপর। মনুষ্য প্রজাতির বৈশিষ্ট্যই হল সে উৎপাদনক্ষম প্রাণী। যা তার চারপাশে প্রকৃতির দান হিসেবে সে পায় তার চেয়ে অনেক বেশি সে অন্য রকমের নতুন বস্তু উৎপাদন করে। আগে যা ছিল না এখন তা উৎপাদিত হল। যা ছিল তাকে কাজে লাগিয়েই তা হল। একদিন হয়তো মানুষ সরাসরি প্রকৃতি থেকে যা পাওয়া যায় তা-ই দিয়েই তার জীবনধারণ করত। কিন্তু ইতিহাসের গতিপথে জীবনের ধারা বদলাতে বদলাতে আমাদের আলোচ্য আধুনিক পর্বে মানুষ যত বস্তু ব্যবহার করে তার বড় অংশই তার উৎপাদিত। প্রকৃতি থেকে সরাসরি সংগ্রহে তার আধুনিক জীবন চলে না। তাই মার্কসের মূল্যতত্ত্বে যে মানুষের কথা আমরা পাই সে মানুষের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য উৎপাদন। ফলে উপরের সমীকরণটিকে বুঝে নিতে হবে উৎপাদন বৈশিষ্ট্যের নিরিখে। উৎপাদনের মূল কথা মানুষের শ্রমের প্রয়োগ। এক দিকে প্রকৃতির দান, আর-এক দিকে মানুষের পরিশ্রম। তাই উৎপাদন বৈশিষ্ট্য দেখতে গেলে আমাদের এসে পৌঁছতে হবে মানুষের শ্রমের কথায়। কেননা প্রকৃতির দান তো দেওয়াই আছে, ব্যবহার করা না-করা ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই সেখানে। আমাদের সিদ্ধান্তের আওতায় আসে কেবল আমাদের শ্রম। এই যুক্তিপথে উৎপাদন কর্ম প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে যায় আমাদের শ্রমের সঙ্গে। এমনকী আধুনিক উৎপাদনে এত যে যন্ত্রপাতির ব্যবহার দেখি তাও আসলে অতীত শ্রমের ফল। ফলে উৎপাদনের গঠনগত উপাদান মূলত এই দু’টি: প্রকৃতির দান ও মানুষের শ্রম।

এবারে আসা যাক বিনিময় সমীকরণের কথায়। সমীকরণের বর্ণনার বিষয় বিনিময়, কিন্তু তার রহস্য লুকিয়ে আছে উৎপাদনে। মার্কসের তত্ত্বের উদ্দেশ্য সেই রহস্য উন্মোচন। মূল্যের শ্রমতত্ত্ব মার্কসের আগেও ছিল। ধ্রুপদি অর্থনীতিতে তো ছিলই। তারও আগে মূল্য প্রসঙ্গে শ্রমের ধারণা যথেষ্ট পরিচিত ছিল। মার্কসের অভিনবত্ব সেখানে নয়। শ্রমের ধারণাকে মার্কস যেভাবে প্রয়োগ করছেন তাঁর তত্ত্বের বিশেষত্ব সেখানে।

ফিরে আসা যাক সমীকরণের কথায়। মাত্রাগত সমতা সমীকরণের আবশ্যিক শর্ত। অর্থাৎ সমীকরণের ডান দিকে এবং বাঁ-দিকে একই রকমের বস্তু থাকতে হবে। তা যদি হয় তাহলে ক পণ্যের ১ এককের সঙ্গে খ পণ্যের কোনও পরিমাণেরই কোনও সমীকরণ সম্ভব নয়। দুটো আলাদা বস্তু। এখানে মার্কসের যুক্তি হল আলাদা দু’টি বস্তুর মধ্যেও উৎপাদনের বিচারে সমতা আবিষ্কার সম্ভব। কেননা বস্তু দু’টিই সামাজিক উৎপাদন। তাই তাদের মধ্যে সামাজিক শ্রম অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। আর এই সামাজিক শ্রম সমাজের কাছে মূল্যবান, কেননা সমাজের সব উৎপাদনের জন্যই শ্রম প্রয়োজন। সামাজিকভাবে মূল্যবান বলেই পণ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সামাজিক শ্রমই পণ্যের মূল্য।

কিন্তু এখনও মাত্রাগত সমস্যার পুরো সমাধান হয়নি। ক পণ্যের মধ্যে যে-শ্রম আছে তা ক উৎপাদনের কাজেই লাগে, আবার খ-এর মধ্যেকার শ্রম খ উৎপাদনের জন্যই উপযুক্ত। অর্থাৎ, বিভিন্ন বস্তুর উৎপাদনে ব্যবহৃত শ্রম বিভিন্ন রকমের। তারা এক রকমের বস্তু নয়, তাদের মধ্যে তাই মাত্রাগত সমতা নেই। নির্দিষ্ট উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত শ্রম নির্দিষ্ট প্রকৃতির। তাকে বলা যায় মূর্ত শ্রম। মূর্ত শ্রমের নির্দিষ্ট চরিত্র আছে। এক এক রকমের মূর্ত শ্রম এক এক রকমের কাজের উপযুক্ত। তারা গুণগতভাবে আলাদা। তাই সমীকরণের দু’পাশে আছে দু’রকমের মূর্ত শ্রম। অতএব এই পথে সমীকরণের ব্যাখ্যা সম্ভব হচ্ছে না।

আমাদের আরও এক ধাপ এগোতে হবে। ওই মূর্ত শ্রমের উৎপত্তি কীভাবে হল মার্কস সে কথাটা বুঝে নিতে চাইছেন। তাঁর কল্পনা এইরকম: সমাজের হাতে আছে মূলত নেহাত অদীক্ষিত কাঁচা শ্রমশক্তি, অর্থাৎ গায়ে-গতরে খাটবার ক্ষমতা। খাটবার ক্ষমতাটা আছে, কিন্তু কোনওরকম বিশেষ প্রশিক্ষণ বা সামর্থ্য কিছুই নেই। এইরকম অপ্রশিক্ষিত শ্রমশক্তির মালিক যে-শ্রমিক তাকে দিয়ে এখনই কিন্তু কোনও উৎপাদনের কাজ হবে না, কেননা সে কোনও কিছু উৎপাদনের জন্য সমর্থ নয় এখনও। তাকে সমর্থ করে তুলতে হবে। তার জন্য লাগবে বিশেষ ধরনের শিক্ষাদীক্ষা, প্রশিক্ষণ, ইত্যাদি। এই যে কাঁচা শ্রমশক্তির ধারণা এটাই হল বিমূর্ত শ্রম। এর কোনও গুণগত চরিত্র নেই। কাজেই বিমূর্ত শ্রমের আছে শুধু পরিমাণ। এক দলা বিমূর্ত শ্রম আর আর-এক দলা বিমূর্ত শ্রম, এই দুই দলার মধ্যে পরিমাণের বিচার ছাড়া গুণের বিচারের কোনও অবকাশ নেই। সমাজের মোট বিমূর্ত শ্রমের পরিমাণ এত, এর বেশি আর কোনও বর্ণনা সম্ভব না। যেই তাকে কিছু-একটা প্রশিক্ষণ দেওয়া হল অমনি সে কোনও এক রকমের মূর্ত শ্রমে পরিণত হল। অন্য দিক দিয়েও বলা যায়, বিমূর্ত শ্রম প্রয়োগের স্তরে আমরা কখনোই দেখার প্রত্যাশা করতে পারি না। যখনই কোনও উৎপাদনে নিয়োজিত কোনও রকমের শ্রম আমরা দেখছি তখনই বুঝতে হবে সেই শ্রমে নির্দিষ্ট কোনও উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। তাহলে সেই শ্রমের কোনও এক রকমের নির্দিষ্ট উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। তা হলে সেই শ্রম আর বিমূর্ত শ্রম রইল না। তা মূর্ত শ্রম।

এবার মার্কসের মূল্যতত্ত্বের শেষ ধাপ। সমাজের হাতে আছে মূল্যবান এই বিমূর্ত শ্রমের একটা মোট পরিমাণ। এই দিয়েই সমাজের যা-কিছু উৎপাদন কর্ম সাধিত হচ্ছে। প্রত্যেকটি পণ্যোৎপাদনে নিয়োজিত হয়েছে সামাজিক শ্রমের এই মোট পরিমাণের একটা অংশ। যেকোনও পণ্যের মধ্যে আছে সেই পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত মূর্ত শ্রম তৈরি করতে যে-পরিমাণ বিমূর্ত শ্রম লাগছে সেইটুকু বিমূর্ত শ্রম। ওই বিমূর্ত শ্রমই সমাজের কাছে মূল্যবান। তাই ওই পরিমাণ বিমূর্ত শ্রমই পণ্যের মূল্য। বেশ। কিন্তু যে শ্রমিকের মারফত প্রয়োজনীয় মূর্ত শ্রমের প্রয়োগ হচ্ছে সেই শ্রমিক যদি অলস হয়, সে যদি নিতান্ত অদক্ষ হয়, সে যদি কাজে গাফিলতি করে দরকারের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করে তাহলে তো বিমূর্ত শ্রমের প্রয়োজন অকারণ বেশি দেখাবে। তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে, শ্রমিক অলস ও অদক্ষ বলেই সে বেশি মূল্য উৎপাদন করছে, কেননা তার বেলায় মূর্ত শ্রমের পরিমাণ বেশি লাগছে এবং তাই আনুপাতিকভাবে বিমূর্ত শ্রমও বেশি দেখাবে। এর উত্তরে মার্কস বলছেন, বিমূর্ত শ্রমের কতটুকু ব্যয় হচ্ছে তা হিসেব করার জন্যে বস্তুত ব্যবহৃত মূর্ত শ্রমের হিসেব না নিয়ে নিতে হবে সমাজে মোটামুটি গড়পড়তা প্রয়োজনীয় মূর্ত শ্রম যা লাগে তার হিসেব। তাই মার্কসের মূল্যতত্ত্বে একটি পণ্যের মূল্য বলতে বোঝায় পণ্যটির উৎপাদনে নিয়োজিত সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় বিমূর্ত শ্রমের পরিমাণ। এবং এই বিমূর্ত শ্রম অলক্ষ্য। তার অস্তিত্ব অদৃশ্যের স্তরে, পর্যবেক্ষণের স্তরে নয়। তাই তা সরাসরি পরিমাপযোগ্য ধারণাও নয়। মার্কসের এই চালটাকেই অনেকে হেগেলীয় চাল হিসেবে দেখতে চাইতে পারেন। হেগেলীয় পরিভাষায় দাঁড়াবে মার্কসের মূল্যের ধারণা Wesen (ভেজ়েন) বা নির্যাস স্তরের ধারণা, Sein (জ়াইন) বা সত্তার স্তরের ধারণা নয়।

মূল্যের অবয়ব

মূল্যের স্বরূপের ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে মার্কসের মূল্যতত্ত্বে। কিন্তু ‘ভেজ়েন’ স্তরের এই মূল্যের প্রকাশিত চেহারা কেমন? এই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য মার্কস ‘মূল্যের অবয়ব’ এই শিরোনামে এক বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তবে সচরাচর মার্কসের মূল্যতত্ত্বের আলোচনায় এই অবয়বের আলোচনার উপরে খুব জোর পড়ে না। সম্ভবত তার একটা কারণ এই যে, মূল্য যে ‘ভেজ়েন’ স্তরের ধারণা সে কথাটা আমরা প্রায়শ খুব খেয়াল রাখি না। পরিণত মার্কস হেগেল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন এই সংস্কার হয়তো এর জন্য অংশত দায়ী। উপরন্তু অর্থনৈতিক সমস্যাপটে মূল্য ধারণাটাকেই আমরা প্রধানত বিনিময়ের হার অর্থাৎ একটা অনুপাতের চেহারায় ভাবতে অভ্যস্ত। মার্কসের ধারণায় মূল্য যে স্বরূপত একটা বস্তু এ কথাটা খেয়াল রাখলে মূল্যের অবয়ব আলোচনার তাৎপর্য বোঝা যাবে। মূল্য নামের বস্তু পণ্যের মধ্যে অন্তর্নিহিত হয়ে থাকছে উৎপাদনের ক্ষেত্রে। কিন্তু মূল্যের স্বরূপে তার পরিচয় আমাদের গোচরে আসে বিনিময়ের ক্ষেত্রে। বিনিময়ের ক্ষেত্রের সমীকরণ থেকেই যাত্রা শুরু করে আমরা মূল্যের ধারণায় পৌঁছতে পেরেছি। মূল্যের উৎপাদন ও তার প্রকাশ তাই হাত ধরাধরি করে চলে। এবং সেই প্রকাশের আছে নানা ধরন। বিনিময় প্রক্রিয়ার বিবর্তনের এক একটা স্তরে সেই প্রকাশের চেহারা এক এক রকম। প্রকাশের চেহারাকে মার্কস বলছেন মূল্যের অবয়ব। তাঁর সময় পর্যন্ত বিবর্তনের ধারা বর্ণনা করে মার্কস চারটি অবয়বের কথা ব্যাখ্যা করেছেন। পরবর্তী ধারা বিচার করে আমরা হয়তো আরও অবয়বের কথা ভাবতে পারি।

পণ্যকে জগতে আমরা দেখতে পাই দ্রব্য হিসেবে। তাদের আছে ব্যাবহারিক মূল্য। যেমন, লোহা, কাপড়, শস্য। এইরকমই আমাদের চারপাশের দ্রব্যের সম্ভার। কিন্তু উৎপাদনের সুবাদে দ্রব্যগুলি মূল্যগর্ভও বটে। তাই তাদের একটা মূল্য অবয়বও আমাদের কল্পনায় থাকা দরকার। ব্যাবহারিক মূল্য হিসেবে তাদের অবয়ব দ্রব্য আর মূল্য বা বিনিময় মূল্য হিসেবে তাদের অবয়ব পণ্য। পণ্য অবয়ব হিসেবে তার কোনো দ্রব্যত্ব নেই। বলা যায় তার কোনো বস্তুত্ব নেই। পণ্যের দু’টি রূপ— স্বাভাবিকরূপে সে একটা দ্রব্য, তার আছে বস্তুত্ব; আর আছে তার মূল্যরূপ, সেই রূপে তার মধ্যে বস্তুত্বের নামমাত্রও নেই।

নির্বস্তুক এই মূল্যরূপের প্রকাশ পদ্ধতি আমাদের বুঝে নেবার দরকার আছে। মূল্যের ধারক হিসেবে একটি পণ্যকে দেখতে গেলে এমন কিছু আমাদের লাগবে যেখানে সেই মূল্যস্বরূপ প্রতিফলিত হচ্ছে। বিনিময় প্রক্রিয়া বেশ খানিকটা অগ্রসর হয়েছে এমন সমাজে সেই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই অর্থে। অর্থে প্রতিফলিত মূল্যরূপ মূল্যের একটা অবয়ব। মার্কস মূল্যের চারটি অবয়বের বর্ণনার মধ্য দিয়ে এই অর্থরূপের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেছেন। ক, খ, গ, ঘ এই চারটি অবয়বের নাম যথাক্রমে : প্রাথমিক বা আপতিক অবয়ব, সামগ্রিক বা প্রসারিত অবয়ব, সাধারণ অবয়ব, অর্থ অবয়ব। আমরা সংক্ষেপে অবয়বগুলির বর্ণনা দিচ্ছি।

ক. প্রাথমিক বা আপতিক অবয়ব

মার্কসের নিজের ব্যবহার করা উদাহরণ এইরকম:

ক পণ্যের x একক = খ পণ্যের y একক, অর্থাৎ, ক পণ্যের x একক খ পণ্যের y এককের সঙ্গে মূল্যে তুল্যমূল্য।

লিনেনের ২০ গজ = ১ কোট, অর্থাৎ, ২০ গজ লিনেন ১ কোটের সঙ্গে মূল্যে তুল্যমূল্য।

বিনিময় প্রক্রিয়ার এটা একেবারে প্রাথমিক বর্ণনা। অন্তত দু’টি পণ্য না থাকলে বিনিময়ের প্রশ্নই ওঠে না। এই অবয়বে ২০ গজ লিনেনের মূল্য প্রকাশিত বা প্রতিফলিত হচ্ছে। তাই লিনেন আছে আপেক্ষিক আকারে। আপেক্ষিক আকারে লিনেন সক্রিয় ভূমিকায় নিজের মূল্যের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। এই সক্রিয় ভূমিকায় সে কিন্তু নিজের মূল্য নিজের পণ্যশরীরে প্রতিফলিত করতে পারবে না। তা করতে গেলে ২০ গজ লিনেনের মূল্য ২০ গজ লিনেনই হবে। নিতান্ত তুচ্ছ কথা। কাজেই তার লাগবে অন্য কোনও পণ্য। এখানে কোট সেই পণ্য। কোট যেন প্রতিফলিত মূল্য গ্রহণ করছে তার নিজের পণ্য শরীরে। কোটের ভূমিকা এখানে নিষ্ক্রিয়। দুই পণ্যের মূল্যসামান্যের দৌলতে এই অবয়বে কোট আছে তুল্যমূল্য আকারে। তাহলে এই প্রথম অবয়বে দুই পণ্যের মধ্যে কোনটি থাকছে আপেক্ষিক আকারে আর কোনটি থাকবে তুল্যমূল্য আকারে সেটা নিতান্ত আপতিক। সমীকরণের সমান চিহ্নের বাঁ-দিকে থাকবে না ডান দিকে থাকবে তার উপরে নির্ভর করছে কে আছে আপেক্ষিক আকারে আর কে আছে তুল্যমূল্য আকারে। লক্ষ করতে হবে যে, সামান্য আকারে আছে যে-পণ্যের মূল্য এই একই সমীকরণে কিন্তু তার মূল্য প্রকাশ করা যাবে না। অর্থাৎ, বাঁ-দিকের পণ্যের মূল্যই কেবল প্রকাশ করা যাবে। ডান দিকের পণ্যের মূল্য প্রকাশ করতে গেলে সমীকরণের চেহারা বদলে নিতে হবে। আপেক্ষিক আকারের পণ্য আর তুল্যমূল্য আকারের পণ্যের স্থান বদল হয়ে যাবে।

খ. সামগ্রিক অথবা প্রসারিত অবয়ব

ক পণ্যের z একক = খ পণ্যের u একক; অথবা, = গ পণ্যের v একক; অথবা, = ঘ পণ্যের w একক; অথবা, = ঙ পণ্যের x একক; অথবা, = … ইত্যাদি।

২০ গজ লিনেন = ১ কোট; অথবা, = ১০ পাউন্ড চা; অথবা, = ৪০ পাউন্ড কফি; অথবা, = ১ কোয়ার্টার শস্য; অথবা, = ২ আউন্স সোনা; অথবা, = ১/২ টন লোহা; অথবা, = … ইত্যাদি।

একটা পণ্যের মূল্য আর-একটা পণ্যের শরীরে প্রতিফলিত হচ্ছে, এই ব্যাপারটা আমরা আগের অবয়বে দেখেছি। যে-পণ্যের শরীরে প্রতিফলিত হচ্ছে সে যেন একটা আয়না। মূল্য ‘ভেজ়েন’ স্তরের বিষয় বলে এমনিতে টের পাওয়া যায় না। অন্য পণ্যের শরীরে প্রতিফলিত হলে তাকে দেখা যায়। বর্তমান অবয়বে একটি নির্দিষ্ট পণ্যের মূল্য প্রতিফলিত হচ্ছে নানা পণ্যের শরীরে। এখানে লিনেন আছে আপেক্ষিক আকারে আর অন্যসব পণ্য আছে তুল্যমূল্য আকারে। এই বহু প্রতিফলনের সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে ২০ গজ লিনেনের মূল্য মূল্যসত্তায় তুল্যমূল্য হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে অন্য আরও অনেক পণ্যশরীরে। মূল্য যেহেতু পণ্যোৎপাদনে ব্যবহৃত সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় বিমূর্ত শ্রম তাই সেই বিমূর্ত শ্রম সমপরিমাণে ওইসমস্ত আয়নার উৎপাদনের মধ্য দিয়ে তাদের শরীরেও অন্তর্গত হয়ে আছে বলেই এই প্রতিফলন সম্ভব হচ্ছে। এই উদাহরণে লিনেন তার মূল্য অবয়বের জন্য পণ্যজগতের আর সবার সঙ্গে এক সামাজিক সম্বন্ধে আবদ্ধ হয়ে থাকছে। পণ্যজগতে কে কোন দ্রব্যশরীরে অবস্থান করছে মূল্যসত্তার বিচারে সেটা আদৌ জরুরি নয়। বিনিময়ের এই প্রসারিত বর্ণনায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কোন আনুপাতিক পরিমাণে পণ্যসমূহের পারস্পরিক বিনিময় হচ্ছে সেটা দ্রব্যগুণের উপরে নির্ভর করে না তো বটেই, এমনকী তা বিনিময়ের স্তরেও নির্ধারিত হচ্ছে না। বস্তুত উৎপাদন স্তরে নির্ধারিত মূল্য সম্পর্কের জোরেই পণ্যজগতে বিনিময়ের পরিমাণগত চেহারা নির্ধারিত হচ্ছে। স্রাফাতন্ত্রে দাম নির্ধারণের পদ্ধতির সঙ্গে মার্কসের মূল্যতত্ত্বের সম্পর্ক নিয়ে যেসব জল্পনাকল্পনা আছে সেখানে এই দৃষ্টিতে এগোলে কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া হয়তো সম্ভব।

গ. মূল্যের সাধারণ অবয়ব

১ কোট

১০ পাউন্ড চা

৪০ পাউন্ড কফি

১ কোয়ার্টার শস্য

২ আউন্স সোনা

১/২ টন লোহা

ক পণ্যের x একক, ইত্যাদি = লিনেনের ২০ গজ

দেখাই যাচ্ছে আগের অবয়বে যে পণ্যেরা তুল্যমূল্য আকারে ছিল এখন তারা আপেক্ষিক আকারে উপস্থিত। আর যে লিনেন ছিল আপেক্ষিক আকারে এখন সে তুল্যমূল্য আকারে রয়েছে। এর তাৎপর্য হল লিনেন যদি অন্য সমস্ত পণ্যের দ্রব্যশরীরে নিজের মূল্য প্রতিফলিত করতে পারে, তাহলে একটা সামাজিক সম্মতি তৈরি হলে অন্য সমস্ত পণ্যই লিনেনের পণ্যশরীরে তাদের মূল্য প্রতিফলিত করতে পারে। প্রতিফলনের সমীকরণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সমস্ত পণ্যই মূল্যপটে তুল্যমূল্য। তাদের দ্রব্যশরীর ভিন্ন ভিন্ন, অর্থাৎ, সমাজের বিনিময় প্রক্রিয়া এই রকমের প্রসারিত চেহারায় যখন দেখা দেয় তখন মূল্যস্তরে দ্রব্যের কোনও জাত নেই। দ্রব্যসত্তা আচ্ছন্ন করে তখন সমাজে শুধুই পণ্যসত্তা বিরাজ করছে। সমাজসম্পর্ক পণ্যসম্পর্কে বিলীয়মান। মূল্যের এই বর্তমান অবয়ব আসলে প্রাথমিক, কিন্তু সব পণ্যের জন্যই তা সমানভাবে প্রাথমিক, তাই তা সাধারণ। আর এই উদাহরণে এই যে লিনেনের পণ্যশরীরে সব পণ্যের মূল্য প্রতিফলিত হচ্ছে তার জন্য ওই পণ্যে সমাজের সম্মতি দরকার এবং বুঝতে হবে তা তৈরি হয়েছে, নইলে সমাজ তখনও সাধারণ অবয়বের স্তরে পৌঁছতে পেরেছে তা বলা যাবে না। সমাজের উৎপাদনের দ্রব্যচরিত্র ক্রমশ অন্তরালে চলে যাচ্ছে এবং মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে পণ্যচরিত্র। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ বিকাশের এই অন্তর্দৃষ্টি মার্কস থেকে আমাদের প্রাপ্য।

ঘ. পণ্যের অর্থ অবয়ব

২০ গজ লিনেন =

১ কোট =

১০ পাউন্ড চা =

৪০ পাউন্ড কফি =

১ কোয়ার্টার শস্য =

১/২ টন লোহা =

ক পণ্যের x একক = ২ আউন্স সোনা

গ অবয়বের সঙ্গে ঘ অবয়বের বাহ্য তফাত শুধু এটুকুই যে গ অবয়বের বিশেষ একটি পণ্য এখন ঘ অবয়বে তুল্যমূল্য আকারে প্রকাশিত। সোনা সেই বিশেষ পণ্য। আগের অবয়বে ২০ গজ লিনেন ছিল একমাত্র তুল্যমূল্য আকারে। অন্য সমস্ত পণ্য তাদের মূল্য প্রতিফলিত করছিল ২০ গজ লিনেনে। লিনেন সে অর্থে ওই অবয়বে সার্বিকভাবে তুল্যমূল্যতার ভূমিকায় ছিল। এবং অন্যসব পণ্য যে তাদের মূল্য একযোগে প্রতিফলিত করতে পারে তার জন্যই কি আলাদা করে সমান চিহ্ন দেওয়া হল না? ঠিক যেন বিভিন্ন বস্তুর প্রতিফলন একইসঙ্গে একটা আয়নায় দেখা যাচ্ছে। আর এই ঘ অবয়বে সমাজ ইতিমধ্যে অন্য নানা বস্তুগুণাবলির জন্যই হয়তো সোনাকে একমাত্র সার্বিক তুল্যমূল্যতার ভূমিকায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। সব পণ্যের মূল্যই এখন এই আয়নায় প্রতিফলিত হতে পারে। একযোগে হওয়ার কোনও বাধ্যতা নেই। প্রত্যেকে আলাদাভাবে তার মূল্য ওখানে প্রতিফলিত করতে পারে। গ অবয়বে সার্বিকতার কথাটা পরিষ্কার করে দেখানোর জন্য একযোগে প্রতিফলনের উপরে জোর দিতে হচ্ছে। সমান চিহ্নের অনুপস্থিতির মধ্যে দিয়ে কি তা-ই সূচিত হচ্ছে? ঘ অবয়বে আলাদাভাবে প্রতিফলন সম্ভব, আলাদা আলাদা সমান চিহ্নে কি তারই ইঙ্গিত? তা যদি হয় তাহলে আমরা ভাবতেই পারি যে ঘ অবয়বের সোনা ওই আপেক্ষিক আকারে প্রকাশিত প্রত্যেকটি পণ্যের মধ্যেকার মূল্যপরিমাণ নিজের মূল্যশরীরে ধারণ করতে সক্ষম। গ অবয়বের তুল্যমূল্যতার সার্বিকতার মধ্যেই অর্থের ধারণার অন্তর্গত সার্বিকতার চরিত্র ধরা পড়ছে। কিন্তু অর্থের ধারণার মধ্যে মূল্যের আধার এই চরিত্রও বর্তমান। আলাদা সমান চিহ্নের ইঙ্গিতে আধুনিক অর্থের এই আধার-চরিত্র কি ভ্রূণাকারে ধরা পড়ছে? বিনিময়ের ইতিহাস, অর্থের উদ্ভব ইত্যাদির এই বর্ণনার মধ্যে সমাজ ইতিহাসের বদলের যে চেহারা ধরা পড়ছে, তার মধ্যে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে মূল্যধারণার গুরুত্ব ও বিকাশ দুই-ই বিভাসিত হচ্ছে। পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের প্রথম অধ্যায়ে আলোচিত পণ্য বিশ্লেষণের মধ্যে মূল্যধারণার এই ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিকটা আমরা সম্যক পেয়ে যাই। মূল্যধারণার একটা নৈতিক দিকও আছে। ওই অধ্যায়ের শেষ অংশে পণ্যরতির যে আলোচনা আছে তার মধ্যে আমরা নৈতিক দিকের আন্দাজ পাব।

পণ্যরতি

পুঁজি বইটিকে নিতান্ত অর্থনীতির বই হিসেবে দেখলে মনে হবে বুঝি কোনও এক রকমে একটা দামের তত্ত্বে পৌঁছে যাওয়াই আমাদের প্রধান কাজ। অর্থাৎ, সেখানে মূল্যতত্ত্বের যদি কোনও ভূমিকা থাকেও তবে তা হবে দামের পরিমাণগত নির্ধারণের একটা উপায়। ঘ অবয়বের আলোচনায় মার্কস পরিষ্কার করেই বলেছেন যে, আমাদের এই অবয়বের মধ্যে অন্তর্নিহিত প্রাথমিক অবয়ব থেকেই দামের পরিমাণগত হদিশ পাওয়া যাবে। আলাদা সমতা চিহ্নের সুবাদে এই উদাহরণ থেকেই আমরা পেয়ে যেতে পারি ২০ গজ লিনেন = ২ আউন্স সোনা। এটা প্রাথমিক অবয়বের চেহারা। সোনা এখন অর্থের ভূমিকায় উত্তীর্ণ। এটাই, মার্কসের বিবরণে, এই পণ্যটির দাম-অবয়বে প্রকাশ। কাজেই দামের নির্ধারণ মার্কসের মূল্যতত্ত্ব থেকে স্বতঃপ্রকাশিত হয়ে বেরিয়ে আসছে। এবং এই দামের সঙ্গে মূল্যের সমতা সাধিত হচ্ছে যে, মূল্য সম্পর্কের মধ্যে পণ্যজগতের উৎপাদন সম্পর্ক নিহিত আছে। ওই স্তর সমাজের মৌলিক বাস্তবতার স্তর। দাম অবয়বের মধ্যে প্রকাশিত যে-দাম তা ওই মৌলিক সমাজ বাস্তবের সঙ্গে জড়িত। এই অর্থে সেই দামের সঙ্গে একটা নৈতিক মানও জড়িয়ে আছে বলে আমরা ভাবতে পারি।

কিন্তু মার্কসের মূল্যতত্ত্বে এর চেয়ে আরও বড়ো অর্থেও নৈতিকতার জায়গা রয়েছে। মনে রাখতে হবে যে মার্কস মূল্যের প্রসঙ্গে এসে পড়ছেন পণ্যের চরিত্র আলোচনা করতে গিয়ে। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য পণ্য উৎপাদন। পণ্যের বৈশিষ্ট্য তার বিনিময় মূল্যের সঙ্গে ব্যাবহারিক মূল্যের বিভাজন। শুধু বিভাজন নয়, পণ্যচরিত্র বস্তুত বিনিময় মূল্য আশ্রিত। ব্যাবহারিক মূল্যে একটা দ্রব্যের সঙ্গে ব্যবহারকারীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বিনিময় মূল্যের মধ্যে সমাজের উৎপাদন সম্পর্কের ছায়া পড়ে। ব্যাবহারিক মূল্যের ধারণার সঙ্গে উপভোক্তার প্রয়োজনের প্রশ্ন জড়িত। বিনিময় মূল্যের সঙ্গে এরকম কোনও প্রয়োজনের সম্পর্ক নেই। তার লক্ষ্য মূল্য আহরণ। তাই দ্রব্যচেহারাকে ছাপিয়ে সমাজে যত বেশি করে পণ্যচেহারা ফুটে উঠবে ততই জীবনের প্রয়োজনের কথাটা চাপা পড়ে যাবে। বিনিময় মূল্যের স্তরে ব্যক্তি, ব্যক্তি গোষ্ঠী বা সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক কেবলমাত্র মূল্যের নিরিখেই বিচার্য। আর কোনও বিবেচনা সেখানে অবান্তর। পণ্যময় এই সামাজিক অস্তিত্বে পণ্যসম্পর্কেই মানবগোষ্ঠীসম্পর্ক প্রতিফলিত। প্রয়োজন নিরপেক্ষ মানবেতর পণ্যপ্রধান এই অবস্থার মধ্যে যেন এক ধরনের প্রায় ধর্মীয় অতীন্দ্রিয়তা কাজ করে। মানুষ যেন তার মস্তিষ্কপ্রসূত কোনো কল্পনার বশে পণ্যমোহে নিজেকে আচ্ছন্ন করে তুলছে। মানুষের শ্রমের পরিণাম যে উৎপাদন তার মধ্য দিয়ে মানুষের সম্পর্কের প্রকাশ আশ্রয় নিচ্ছে পণ্যসম্পর্কের মধ্যে। কেননা বস্তুবিশ্বে সেই শ্রমের পরিণাম কোনও চিহ্ন রাখে না। সেই শ্রমের ছায়াপাত ঘটে শুধু পণ্য দুনিয়ায়। এই অবস্থাটাকে মার্কস বলেন পণ্যরতি। পণ্যের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এমনি করেই মার্কস মানুষের সামাজিক অবস্থা বিষয়ে এক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সন্ধান পাচ্ছেন। শুধুমাত্র দাম নির্ধারণের তত্ত্ব সন্ধান করে এই অবস্থানে পৌঁছনো যাবে না। কাজেই দুই সমস্যাপটের ফারাক খেয়াল রেখে পুঁজি গ্রন্থের পাঠ গ্রহণ করতে পারলে আমরা এক বিশিষ্ট দার্শনিক অবস্থানে পৌঁছতে পারব।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

১. Ian Steedman, Marx after Sraffa (New Left Books : London, 1977).

২. Michio Morishima, Marx’s Economics : A Dual Theory of Value and Growth (Cambridge University Press : Cambridge, 1973).

৩. Ladislaus Bortkiewicz, Wertrechnung und Preisrechnung im Marxschen System, in Archiv fur Sozialwissenschaft, vol. xxv, 1907, pp. 10-51, 445-488. For English version of this text see International Economic Papers, no. 2, 1952 and Paul Sweezy, The Theory of Capitalist Development (Monthly Review Press : New York, 1942).

৪. Eugen von Böhm-Bawerk, Paul M. Sweezy and Rudolf Hilferding, Karl Marx and the Close of his System and Böhm-Bawerk’s Criticism of Karl Marx (Orion Editions : New York, 1984).

৫. William Stanley Jevons, The Theory of Political Economy (Macmillan : London, 1888).

৬. Karl Marx, Capital, vol. 1, chapter 1 (Progress Publishers : Moscow, 1954).

৭. Ronald L. Meek, Studies in the Labour Theory of Value, (Lawrence & Wishart : London, 1973).

৮. Karl Marx, Capital vol. I, chapter 1 (Progress Publishers : Moscow, n.d.), p. 43.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *