মার্কস ও একজন উত্তর-কাঠামোবাদী : একটি কাল্পনিক সংলাপ

মার্কস ও একজন উত্তর-কাঠামোবাদী : একটি  কাল্পনিক সংলাপ
প্রদীপ বসু

[ভূমিকা: আমরা জানি বিশিষ্ট জার্মান বিপ্লবী ও দার্শনিক কার্ল মার্কসের রচনা-সম্ভার বিপুল এবং সেগুলির বহু প্রকার ব্যাখ্যা রয়েছে। মার্কস কেবল একক, একটি মাত্র, নিশ্চিত, বৈপরীত্যহীন, নিঃসংশয়, দ্বিধাহীন, বিশুদ্ধ ও বৈধ (authentic) মার্কস নন। মার্কস বহু। তাঁর রচনায় বহু ধরনের ভাবনা ও ধারণার অস্তিত্ব বিদ্যমান। এখানে স্পষ্ট করা দরকার যে, আমরা মার্কসের পরিচিত, প্রথাগত, প্রতিষ্ঠিত রূপটিকেই বিবেচনা করেছি। বস্তুত প্রথা-বহির্ভূত মার্কসের রচনাগুলি এ-যাবৎ অনেকটাই উপেক্ষিত। কমিউনিস্টদের বাস্তব সামাজিক অনুশীলনের ক্ষেত্রে সেগুলি বিশেষ প্রভাব ফেলেনি৷ এই রচনাগুলি বিশ্বের বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টিগুলির কাছে অবহেলিত ছিল। এইসব রচনায় এমন অনেক ধ্যানধারণা আছে যা প্রতিষ্ঠিত মার্কসীয় চিন্তার বিপরীত, এমনকী বিরোধী। সেগুলি এ-যাবৎ ছিল প্রান্তে নির্বাসিত, গৌণ। সাম্প্রতিককালে সেগুলি নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। কিন্তু এখানে আমরা প্রাধান্যকারী মার্কসের প্রথাগত রচনাসমূহকেই মূলত কথোপকথনের জন্য গণ্য করেছি। কারণ, বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্টদের সামাজিক অনুশীলনে সেগুলির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

অন্য দিকে, উত্তর-কাঠামোবাদ ও উত্তর-আধুনিক তত্ত্ব এ দু’টি খুবই কাছাকাছি। এদের অর্থ নিয়েও বিতর্ক আছে। জাক দেরিদা-র পরে কোনও শব্দেরই সারসত্তা (essence) বা চিরন্তন স্থায়ী অর্থের কথা বলা অর্থহীন। তাই এখানে আমরা ‘উত্তর-কাঠামোবাদী’ (‘post-structuralist’) বলতে কাদের বুঝিয়েছি সেটা স্পষ্ট করে বলা দরকার। আমরা বুঝিয়েছি তাঁদের যাঁরা অনমনীয় কাঠামো, সংগতিপূর্ণ ও স্থির অর্থ, চিরন্তন সারসত্তা, বাস্তবতার সঙ্গে ভাষার সরলরৈখিক সম্পর্ক, উপস্থাপনা (representation)-র স্বচ্ছতা, আলোকপ্রাপ্তির ঔপকরণিক যুক্তি, প্রযুক্তি-কেন্দ্রিকতা ইত্যাদি পাশ্চাত্য আধুনিকতার ধারণাগুলির সমালোচক। তাঁরা মহা-আখ্যান (metanarrative)-এ অবিশ্বাসী, অনুশাসনমূলক (disciplinary) ক্ষমতাতন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচনকারী, আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার সামাজিক যৌক্তিকীকরণের জন্যে যে চরম মূল্য দিতে হয় তার বিরোধী। তাঁরা অপর (other)-এর প্রতি শ্রদ্ধাবান ও দায়বদ্ধ। তাঁরা পার্থক্য ও বহুত্বের জয়গান করেন। পরিশেষে, তাঁরা অবিনির্মাণ (deconstruction)-এর ভিত্তিতে রণনৈতিক অভিযান (strategic moves) চালিয়ে যান যার উদ্দেশ্য হল প্রান্তিক ও ক্ষমতার দ্বারা অবদমিত মানুষদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে গুরুত্বদান৷

এই কাল্পনিক কথোপকথনের লেখক মনে করেন নিপীড়িত মানুষের প্রতিরোধ সংগ্রামকে বাস্তবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই ধরনের কথোপকথন বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। —লেখক]

উত্তর-কাঠামোবাদী: অষ্টাদশ শতকের ইউরোপের আলোকপ্রাপ্তি (Enlightenment) নামক বৌদ্ধিক আন্দোলনের সঙ্গে পশ্চিমি আধুনিকতার বিশ্বব্যাপী প্রসারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সম্বন্ধে আমরা অবহিত। কিন্তু এই আলোকপ্রাপ্তি বা আধুনিকতার অবদানগুলিকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে আমরা রাজি নই। আমরা এনলাইটেনমেন্ট ও পাশ্চাত্য আধুনিকতার একটি সমালোচনাত্মক বিচার গড়ে তোলার পক্ষপাতী। কিন্তু মার্কস, দুর্ভাগ্যবশত, আপনার বিবিধ রচনায় আমরা আলোকপ্রাপ্তি ও পশ্চিমি আধুনিকতার জয়গানই শুধু লক্ষ করি।

মার্কস: মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের বিপরীতে আধুনিক ধনতন্ত্রের উদ্ভব ও তার সাথে সাথে ইউরোপীয় রেনেশাঁস ও অষ্টাদশ শতকের ইউরোপীয় আলোকপ্রাপ্তির আবির্ভাবকে আমি বিশ্ব-ইতিহাসের অগ্রগতির পথে একটি প্রগতিশীল উপাদান হিসেবে গণ্য করি। সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতিতে উৎপাদিকা শক্তি ছিল অনেক নিচু স্তরে। প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অনুন্নত। সে তুলনায় পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটেছে বিপুল পরিমাণে। প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নতি লক্ষ করা যায়। একইসঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি ছিল অন্ধ বিশ্বাস এবং ধর্মীয় কুসংস্কারে পূর্ণ। সেখানে ছিল খ্রিস্টীয় চার্চের একাধিপত্য। দৈব শক্তির হাতের পুতুল ছিল মানুষ। সে তুলনায় নবজাগরণ, বিশেষত আলোকপ্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে এল যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাভাবনা, মানবকেন্দ্রিক তত্ত্ব, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, দৈব-বিচ্ছিন্ন ইহজাগতিক ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা। এই আধুনিক শিল্প-সভ্যতা যথার্থই বিশ্ব-ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছে।

উত্তর-কাঠামোবাদী: প্রথমত, আপনি হেগেলীয় প্রভাবের বশে যেভাবে একটি বিশ্ব-ইতিহাসের ধারণায় বিশ্বাসী, আমরা তার বিরোধী। একটিই বিশ্বব্যাপী মহা-ইতিহাসের পরিবর্তে আমরা বলব ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাসের কথা। এখানে আমরা বরং ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ইতিহাস-ধারণাকে তুলে ধরব। বিশ্ব-ইতিহাস বলে কিছু নেই। আছে পৃথক পৃথক অঞ্চলের— পৃথক পৃথক জনগোষ্ঠীর ইতিহাস।

দ্বিতীয়ত, হেগেলীয় প্রভাবে আপনি মনে করেন একরৈখিক অভিমুখে বিশ্ব-ইতিহাসের ক্রমবিকাশ ঘটে চলেছে— বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে— নিম্নতর পর্যায় থেকে উচ্চতর পর্যায়ে। আমরা বলব, এরকম একরৈখিক বিকাশের ধারণায় সমস্যা রয়েছে। সমাজ সর্বদা প্রগতির পথে অগ্রসরমান এ কথা বলা যায় না। কোনটি অগ্রগতি আর কোনটি পশ্চাৎগতি তা বিচারের কোনও বিশ্বজনীন মানদণ্ড নেই। আপনি অবশ্য উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের স্তরকে অগ্রগতি বা অনগ্রসরতা বিচারের একটি বিশ্বজনীন মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করেছেন। এ হল উৎপাদিকা শক্তি সম্পর্কে একটি সারসত্তাবাদী (essentialist) দৃষ্টিভঙ্গি। কেন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের স্তর অনুযায়ী একটি সামাজিক পর্যায়কে অনুন্নত এবং আরেকটি সামাজিক পর্যায়কে উন্নত বলে বিবেচনা করতে হবে তার কোনও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আমরা পাই না। আপনার এবং এঙ্গেলসের বহু রচনায় আমরা দেখতে পাই উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের ভিত্তিতে বিশ্ব-ইতিহাসের নিম্নোক্ত ক্রমপর্যায়গুলিকে আপনারা চিহ্নিত করেছেন: আদিম সাম্যবাদী সমাজ, দাস-সমাজ, সামন্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র এবং অন্তবর্তীকালীন সমাজতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে পরিশেষে সাম্যবাদী সমাজ। কিন্তু আমরা বলব, ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীগুলির নিজ নিজ সমাজের পরিবর্তন ঐতিহাসিক বস্তুবাদের এই বিশ্বজনীন ছকটিকে মেনে ঘটে না। আসলে আপনি পশ্চিম ইউরোপীয় সমাজের একটি বিশেষ সময়কালের পরিবর্তনের ইতিহাসকে বিশ্বজনীন মডেলের রূপ দিতে প্রয়াসী। এ কথা ঠিক যে আপনার শেষ জীবনের চিঠিপত্র ও কয়েকটি রচনাতে আপনি এই ছক থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সে প্রচেষ্টা আপনার তত্ত্বচর্চার প্রান্তদেশে ঠাঁই পেয়েছে।

মার্কস: কিন্তু এ কথা তো অনস্বীকার্য যে সামন্ততন্ত্রের একপ্রকার গতিহীন, অনুন্নত অর্থনীতির তুলনায় আধুনিক ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উৎপাদনশীলতা বিস্ময়করভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই শিল্প-সভ্যতায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ প্রকৃতির ওপর অনেকাংশে বিজয় অর্জনে সমর্থ হয়েছে। অন্ধ প্রাকৃতিক শক্তির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে আর সে বাধ্য নয়। মানুষের এই জয়যাত্রা পরিশেষে তার বৃহত্তর স্বাধীনতা লাভের পথকে সুগম করেছে।

উত্তর-কাঠামোবাদী: প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার এই উদ্ধত উচ্চাকাঙ্ক্ষা আলোকপ্রাপ্তির এক লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। যদিও আপনার রচনায় কোথাও কোথাও ধনতন্ত্রের দ্বারা প্রকৃতিকে অবাধ লুণ্ঠনের সমালোচনা দেখা যায়, তবু এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে আপনি এক্ষেত্রে আলোকপ্রাপ্তির দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত। অপর পক্ষে, আমরা বলব, প্রকৃতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ যেমন কাম্য নয়, তেমনই প্রকৃতিকে মানুষের দাসে পরিণতি করার উচ্চাভিলাষও বিপজ্জনক। পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র (ecology)-এর ভারসাম্যকে ধ্বংস করলে মানুষের বিনাশ অনিবার্য। এর বিপরীতে মানুষকে একটি বিনম্র, বিনীত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রকৃতিকে দেখতে হবে। মানুষ প্রকৃতির সন্তান— তার অংশ মাত্র। পৃথিবীটা একা মানুষের ভোগের সামগ্রী নয়। পশু-পাখি, গাছপালারও প্রকৃতির ওপর সমান অধিকার। শিল্প-উৎপাদন ব্যবস্থা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রকৃতিকে নির্বিচারে লুণ্ঠন করে। এভাবে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সে প্রাচুর্য লাভ করে। এর পরিণাম ভয়াবহ। এ প্রসঙ্গে আপনি শুধু পুঁজিবাদী শিল্প-উৎপাদনের সমালোচনা করেছেন, তাও সেটা কেবলমাত্র গুটিকয়েক রচনায়। কিন্তু বিদ্যমান কেন্দ্রীভূত, ভারী শিল্প-ভিত্তিক, সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায়ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। একই দোষে তাকেও দায়ী করা চলে।

মার্কস: কিন্তু আলোকপ্রাপ্তির যুক্তিবাদ, ইহজাগতিক ধর্মবিচ্ছিন্ন চিন্তা, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, মানবকেন্দ্রিক ভাবনা— এগুলোর যে বিপুল প্রগতিশীল ভূমিকা আছে তা কি আপনারা অস্বীকার করতে পারেন? মধ্যযুগীয় অন্ধ ধর্মবিশ্বাস, দৈব-নির্ভরতা, সংকীর্ণতা, কুসংস্কার দূর করে আলোকপ্রাপ্তি যে এক আধুনিক, উদারমনস্ক, যুক্তিবাদী সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করল তার ঐতিহাসিক মূল্য কি অপরিসীম নয়? এ কথা মানতেই হবে যে, জাতিভেদ, বংশকৌলীন্য, পিতৃতন্ত্র, বর্ণবেষম্য, রাজতন্ত্র, চার্চের ও ধর্মের অনুশাসন ইত্যাদিকে সজোরে আঘাত করেছে আধুনিক জীবনাদর্শ। ভাববাদী দর্শনকে বর্জন করে বস্তুবাদী বিশ্ববীক্ষার বিস্তারে আলোকপ্রাপ্তি এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। আর প্রকৃতি, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে আমি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। আমার বিভিন্ন রচনায় আমি এগুলিকে যথাযথরূপে সংরক্ষণ করার কথা বলেছি। এগুলিকে ধ্বংস করে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার স্বপ্ন একমাত্র যান্ত্রিক মার্কসবাদীরাই দেখতে পারে।

উত্তর-কাঠামোবাদী: দাঁড়ান, দাঁড়ান। আলোকপ্রাপ্তির চিন্তাধারার উপরোক্ত প্রতিটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেই আমাদের সমালোচনা রয়েছে। যেমন ধরুন, আলোকপ্রাপ্তির যুক্তি। আপনি একে মানবমুক্তির একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন। বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ ও আধুনিক যুক্তিধারার সাহায্যে মানুষের পক্ষে সমাজ বিকাশের নিয়মগুলিকে জানা ও বোঝা সম্ভব হয়েছে বলে আপনি মনে করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আলোকপ্রাপ্তির যুক্তিও এক নতুন রকমের ক্ষমতাতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তা হল আধুনিক শিল্পসভ্যতার অদৃশ্য ও সর্বব্যাপী ক্ষমতাতন্ত্র। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর রচনায় আমরা তার বিশদ বিশ্লেষণ পাই। আলোকপ্রাপ্তির যুক্তি মোটেই মানবমুক্তির দিশা দেখায় না, সভ্যতাকে স্বাধীনতা অর্জনের পথে এক ধাপ এগিয়ে দেয় না। ওই যুক্তির কোনও বিশ্বজনীন চরিত্র নেই, যদিও সে বিশ্বজনীন মানবমুক্তির পথিকৃৎ হিসেবে নিজেকে দাবি করে। সে নিছকই একটি নির্দিষ্ট সময়কালে উদ্ভূত পশ্চিম ইউরোপীয় সমাজের যুক্তি। এর বাইরে বাকি ইউরোপে অন্য ধরনের যুক্তির অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। শুধু তাই নয়। ইউরোপের বাইরে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায়— আরব সভ্যতায়, চিনে, ভারতবর্ষে স্বতন্ত্র যুক্তিধারার ঐতিহ্য বিদ্যমান। তা ছাড়া, মানবজীবনকে কেবল যুক্তিভিত্তিক হিসেবে দেখানোটা ভুল। আমাদের জীবনে অযুক্তি, প্রবৃত্তি, বিশ্বাস ও আবেগের গুরুত্ব ও ভুমিকা কিছু কম নয়। বস্তুত আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা ও তার যুক্তি হিংস্রতা ও ক্ষমতার, লোভ ও ভোগদখলের সঙ্গে যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এতে কোনো সন্দেহ নেই। উপনিবেশবাদী লুণ্ঠন, আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় গণহত্যা, আদিম অধিবাসীদের নিশ্চিহ্নকরণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেড ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে আদিম অধিবাসীদের ওপর নির্মম অত্যাচার, হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ, ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের উত্থান, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা, সাম্প্রতিক কালে মার্কিন সেনাবাহিনী কর্তৃক ইরাক ও আফগানিস্থান আক্রমণ এসব তারই প্রমাণচিহ্ন বহন করছে।

মার্কস: দুর্ভাগ্যবশত পুঁজিবাদী শোষণ ও ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনের সঙ্গে আপনারা আলোকপ্রাপ্তির যুক্তিবাদকে গুলিয়ে ফেলছেন। আমি এ কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই যে আলোকপ্রাপ্তির উচ্চতম আদর্শগুলি বাস্তবে রূপায়িত হতে পারেনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণে। আলোকপ্রাপ্তির লক্ষ্য ও নীতিগুলি, যথা— প্রগতি, মুক্তি, যুক্তি, ফরাসি বিপ্লবের আদর্শগুলি, যথা— সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা, এগুলির যথার্থ বাস্তবায়ন বাধা পেয়েছে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাছ থেকে। পুঁজিবাদে রয়েছে উৎপাদনব্যবস্থার ওপর ব্যক্তিমালিকানার নিয়ন্ত্রণ, মুনাফা-কেন্দ্রিক, প্রতিযোগিতা-ভিত্তিক বাজার অর্থনীতি, লোভ, হিংস্রতা, দুর্নীতি। আমি বিশ্বাস করি আধুনিকতার পুঁজিবাদী রূপটিকে, বিশেষত সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ ও আজকের বহুজাতিক সংস্থাগুলি দ্বারা চালিত গ্লোবাল পুঁজিকে ধ্বংস করা প্রয়োজন। এই আধুনিকতা বুর্জোয়াশ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে, আধুনিকতার এই ভাবনা বুর্জোয়াশ্রেণির শ্রেণিস্বার্থের দ্বারা সংজ্ঞায়িত। তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তার সীমাহীন প্রগতিশীল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বুর্জোয়া শিল্পসভ্যতার সংকীর্ণ মুনাফা-কেন্দ্রিক স্বার্থের দ্বারা শৃঙ্খলিত। শৃঙ্খলাবদ্ধ উৎপাদিকা শক্তি ও পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের মধ্যেই নিহিত রয়েছে এর সমাধান সূত্র। তারই প্রতিফলন ঘটছে বুর্জোয়া ও প্রোলেতারিয়েতের মধ্যেকার তীব্রতর শ্রেণিসংগ্রামে। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমেই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে প্রোলেতারিয়েত এই বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করতে পারে ও ধনতন্ত্রের বিলোপ ঘটিয়ে এক নতুন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। সেই ব্যবস্থায় উৎপাদনব্যবস্থার ওপর ব্যক্তিমালিকানার নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটানো হবে। মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ লোপ পাবে। ওই ব্যবস্থা ক্রমশ শ্রেণিহীন, রাষ্ট্রহীন কমিউনিস্ট সমাজব্যবস্থায় উন্নীত হবে। এভাবেই আলোকপ্রাপ্তির আদর্শগুলির যথার্থ ও পরিপূর্ণ রূপায়ণ সম্ভব হবে। দাসত্ব, শোষণ, দারিদ্র, বৈষম্য, অযুক্তি, প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ এগুলির হাত থেকে ঘটবে মুক্তি। অমোঘ আবশ্যকতার রাজ্যের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হবে স্বাধীনতার রাজ্য। সেখানে প্রত্যেকের অবাধ বিকাশ হবে সকলের অবাধ বিকাশের শর্ত।

উত্তর-কাঠামোবাদী: আপনার চিন্তায় ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, উৎপাদিকা শক্তি, মূলত অর্থনৈতিক কারণে সৃষ্ট শ্রেণি ও শ্রেণিসংগ্রাম যে-গুরুত্ব পেয়েছে তার থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া চলে যে, আপনার চিন্তায় অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ এবং হ্রস্বকরণ (reductionism) গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলত, আপনি ক্ষমতা, প্রভুত্ব (domination) ও আধিপত্য (hegemony)-এর স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ ভুমিকাকে যথেষ্ট তাৎপর্যসম্পন্ন বলে ভাবতে অক্ষম। সমাজে বহু ধরনের শোষণ, প্রভুত্ব, দমনপীড়ন, আধিপত্য, ক্ষমতা ও বৈষম্য ক্রিয়াশীল রয়েছে। যেমন জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্য, পিতৃতন্ত্র, শ্রেণিশোষণ, সংখ্যালঘুদের পীড়ন, উপজাতীয় মানুষের ওপর অত্যাচার, সমকামীদের দমন ইত্যাদি। কিন্তু আপনি সব ধরনের বৈষম্যকেই শ্রেণিবৈষম্যের প্রকাশ হিসেবে দেখেছেন। আপনার তত্ত্বে এই মতটিই প্রচ্ছন্ন যে অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারলেই সমস্ত প্রকার বৈষম্যের অবসান ঘটবে। পুঁজিবাদের বিলোপ ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই আলোকপ্রাপ্তির আদর্শগুলির প্রকৃত রূপায়ণ ঘটবে। আলোকপ্রাপ্তির মধ্যেই, আধুনিকতার গর্ভেই যে অদৃশ্য ক্ষমতাতন্ত্র বিরাজমান সেই সচেতনতা আমরা আপনার রচনায় লক্ষ করি না।

মার্কস: আমি স্বীকার করছি, আপনারা তত্ত্বগত দৃষ্টিকোণ নিয়ে অনেক কিছু ভেবেছেন। কিন্তু আমি মনে করি বিপ্লবী অনুশীলন ও শ্রেণিসংগ্রামের বাস্তব প্রয়োগের সঙ্গে যুক্ত না থাকলে সেই তত্ত্বচর্চা অসার ও বন্ধ্যা হতে বাধ্য। এ-যাবৎ বিভিন্ন দার্শনিক জগৎকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু আসল বিষয়টা হল জগৎটাকে পালটানো। আপনাদের তত্ত্বচর্চার সঙ্গে শ্রমজীবী জনগণের, বিশেষত প্রোলেতারিয়েত বা আধুনিক কলকারখানায় উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত শিল্প-শ্রমিক শ্রেণির শ্রেণিসংগ্রামের কোনও যোগাযোগ নেই। তাই আপনাদের তত্ত্বচৰ্চা গজদন্তমিনারে বসে বিভিন্ন দুরূহ শব্দ নিয়ে মাতামাতির সমান। বাস্তব অনুশীলন ও সামাজিক প্রয়োগের মাধ্যমেই তত্ত্ব ক্রমাগত সঠিকতর ও পরিশীলিত হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, বিভিন্ন শ্রেণির জ্ঞান ও তত্ত্বচর্চা তাদের সামাজিক অবস্থান, অর্থাৎ, বস্তুগত শর্ত, তাদের শ্রেণিগত অবস্থান, মতাদর্শ ও রাজনীতি দ্বারা নির্ধারিত। একমাত্র প্রোলেতারিয়েতের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। সে যখন ‘আত্ম-নিমজ্জিত শ্রেণি’ (class-in-itself) থেকে ‘আত্ম-সচেতন শ্রেণি’ (class-for-itself)-তে উন্নীত হয়ে ওঠে, অর্থাৎ, শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে নিজের ঐতিহাসিক ভূমিকা, নিজের বিপ্লবী ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে, তখন তার মতাদর্শ বিজ্ঞানে পরিণত হয়। সেটাই হল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের তাত্ত্বিক জ্ঞান। তখনই একমাত্র প্রোলেতারিয়েত উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে আংশিক, আশু দাবির সংস্কারমূলক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনে আবদ্ধ থাকার পরিবর্তে তাকে সমগ্র ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার আমূল ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এটাই তার ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত দায়িত্ব ও কর্তব্য। সমাজের অন্য সব শ্রেণির তুলনায় প্রোলেতারিয়েত হল সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল ও নেতৃত্বদায়ী বিপ্লবী শ্রেণি, কারণ সে সবচেয়ে অগ্রসর শিল্প-উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্যকরূপে পরিচিত, নতুন ও উন্নত যন্ত্রগুলির সে চালক। সে জাত-পাত, মধ্যযুগীয় ধর্মীয় সংকীর্ণতা, আঞ্চলিকতা থেকে মুক্ত, উদার শহুরে নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত, সাক্ষরতা ও শিক্ষার অধিকারী, আধুনিক সংস্কৃতির সংস্পর্শে পুষ্ট। কারখানায় একত্রে উৎপাদন কার্যে যুক্ত থাকার কারণে প্রোলেতারিয়েত কৃষক বা পেটি বুর্জোয়ার তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ, শৃঙ্খলাপরায়ণ ও সচেতন। সে তুলনায় কৃষক হল রক্ষণশীল, পশ্চাৎপদ, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা-সম্পন্ন, আর পেটি বুর্জোয়া হল নৈরাজ্যবাদী, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও খণ্ডিত চেতনার অধিকারী।

উত্তর-কাঠামোবাদী: আপনার বক্তব্য সম্পর্কে আমাদের অনেকগুলি মন্তব্য আছে। প্রথমত, তত্ত্বচর্চার সঠিকতা সামাজিক প্রয়োগ, বাস্তব শ্রেণিসংগ্রাম ও বৈপ্লবিক অনুশীলনের ওপর মোটেই সর্বদা নির্ভর করে না। প্রয়োগের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে ভ্রান্ত তত্ত্ব যে সৃষ্টি হতে পারে তার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। আবার, উলটো দিকে নিছক যুক্তিতর্ক, বিশ্লেষণ, চিন্তনের মাধ্যমে অনেক সময়ে অভ্রান্ত তাত্ত্বিক অবস্থান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। দ্বিতীয়ত, আপনি সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হলেই যে নতুন এক শোষণমুক্ত ন্যায়বিচার-ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। কারণ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতে কিছু পরিবর্তন ঘটলেও সেখানে আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্র নতুন রূপ গ্রহণ করে উদ্ভূত হতে পারে। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বর্তমান গণ-প্রজাতন্ত্রী চিনের অভিজ্ঞতা তাই দেখায়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতায় এক বিশাল আমলাতন্ত্র, একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব ও রেজিমেন্টেড পার্টি সংগঠন নতুন করে দাসত্ব সৃষ্টি করে। তৃতীয়ত, প্রোলেতারিয়েতকে সর্বদা সবচেয়ে প্রগতিশীল শ্রেণি, সবচেয়ে বিপ্লবী শ্রেণি বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। আজকের শিল্পোন্নত দেশের পুঁজিবাদী সমাজে হোয়াইট কলার শ্রমিকরা রীতিমতো সুবিধাভোগী। তেমনি ভারতের মতো উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশে আদিবাসী বা উপজাতীয় জনগোষ্ঠী, ভূমিহীন কৃষক, কৃষিশ্রমিক সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। চতুর্থত, আপনি কেবল পুরুষ শ্রমিকদের কথা বলেছেন। নারী শ্রমিক অথবা পুরুষ শ্রমিকের গৃহে গৃহকর্মরত নারীদের শ্রম ও তাঁদের ওপর পুঁজিবাদী ও পিতৃতান্ত্রিক শোষণ, তাঁদের প্রতিরোধ সংগ্রাম— এসব আপনার চিন্তায় উপেক্ষিত। পঞ্চমত, আপনি শ্রেণিবিভাজন, শ্রেণিসত্তা, শ্রেণিচেতনা, অর্থনৈতিক ও শ্রেণিশোষণ এবং শ্রেণিসংগ্রামের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু সমাজে শ্রেণি ছাড়াও অন্যান্য বহু ধরনের সত্তা আছে, যাদের ঘিরে বৈষম্য, শোষণ ও প্রতিরোধ-সংগ্রাম বিরাজমান। যেমন ধরুন জাতপাত ব্যবস্থা ও দলিতদদের ওপর নিপীড়ন, পিতৃতন্ত্রের সর্বব্যাপী ব্যবস্থা ও নারীদের বিরুদ্ধে বৈষম্য, বর্ণবৈষম্য ব্যবস্থায় কৃষ্ণকায় মানুষের ওপর শ্বেতকায় মানুষের প্রভুত্ব, জমি ও জঙ্গল থেকে উৎখাত হওয়া মানুষ, ছিন্নমূল উদ্বাস্তু, নাগরিকত্ব বিহীন মানুষ, যুদ্ধের শিকার, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু এবং উপজাতীয় বা আদিবাসীদের ওপর দমনপীড়ন, LGBTQ, তৃতীয় লিঙ্গ, যৌনকর্মী, শিশুশ্রমিক, কৃষক, অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিক, পরিবেশ কর্মী ইত্যাদির বিরুদ্ধে বৈষম্য ও শোষণ। আপনি শোষণকারী ও শাসকশ্রেণি হিসেবে উৎপাদন উপায়সমূহের মালিকশ্রেণি যথা সামন্তপ্রভু বা পুঁজিপতিদের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এমন অনেক পরিস্থিতি আছে যেখানে প্রভুত্বকারী, দমনকারী গোষ্ঠী আদৌ উৎপাদন উপায়সমূহের মালিক নয়। ষষ্ঠত, আপনি সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রকে দু’টি অখণ্ড সমগ্র ব্যবস্থা হিসেবে ভেবেছেন যারা পারস্পরিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এরূপ দ্বিত্ব-অনুসারী (binary) বিভাজনকে সমস্যায়িত করে দেখিয়েছেন ফরাসি দার্শনিক জাক দেরিদা। তাঁর অবিনির্মাণ (deconstruction) দেখায় বাইনারির জোড়াগুলির মধ্যেকার দেওয়াল বা সীমানা নেহাতই ভঙ্গুর, অস্থিতিশীল। সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্র দু’টি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, বিপরীত, অখণ্ড সমগ্র যাদের মধ্যে কঠিন, অনমনীয়, অনতিক্রম্য বিভাজন-রেখা বা দেওয়াল রয়েছে এভাবে দেখাকে আমরা ঠিক মনে করি না।

মার্কস: সমাজ-প্রগতির ধারণাকে আপনারা তাত্ত্বিক কচকচির সাহায্যে অযথা গুলিয়ে দিচ্ছেন। অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা সহজেই অবগত হই যে, মানবসমাজ ক্রমাগত অনুন্নত পর্যায় থেকে উন্নততর পর্যায়ে অগ্রসর হয়ে চলেছে। ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা এই জ্ঞানকেই প্রতিষ্ঠিত করে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ধনতন্ত্রের মধ্যে শ্রেণিশোষণ, অন্যায়-অবিচার, দমনপীড়ন রয়েছে। আমার সমস্ত রচনাতে আমি ধনতন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচন করার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়েছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি দৃঢ়ভাবে বলব, সামন্ততন্ত্রের তুলনায় ধনতন্ত্র উন্নততর একটি ব্যবস্থা। প্রাক্-আধুনিক সমাজের তুলনায় আধুনিক সমাজ অনেক বেশি অগ্রসর। আমি ধনতন্ত্রকে উৎখাত করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার পক্ষপাতী। কারণ ধনতন্ত্রের তুলনায় সমাজতন্ত্র আরও অনেক বেশি উন্নত ও মুক্ত সমাজ। বাস্তব ইতিহাসের বস্তুগত পর্যালোচনা থেকে উপরোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব। সমস্যা হল আপনারা ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করেন না। আপনাদের জ্ঞানতত্ত্বে বাস্তব দুনিয়ার চেতনা-নিরপেক্ষ, বস্তুগত অস্তিত্ব আদৌ স্বীকৃত নয়। ফলে অত্যন্ত সাধারণ, স্বাভাবিক যুক্তিসংগত বাস্তবভিত্তিক উপলব্ধিকেও আপনারা অযথা অবিশ্বাস ও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। একই কারণে শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষের ওপর বাস্তবের নিষ্ঠুর শোষণ ব্যবস্থা, দমনপীড়ন ও তার বিরুদ্ধে তাঁদের বীরত্বপূর্ণ শ্রেণিসংগ্রামকে আপনারা গুরুত্ব দেন না। আপনাদের তত্ত্বচর্চায় বাস্তবের শ্রেণিসংগ্রাম ও বৈপ্লবিক সংগ্রামের প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা দেখা যায় না।

উত্তর-কাঠামোবাদী: কিন্তু আপনি কি এটা অস্বীকার করতে পারেন যে ‘বাস্তবতা’-র অর্থ একেক জন মানুষের কাছে একেক রকম?

মার্কস: সামাজিক অবস্থান, বিশেষত শ্রেণিগত অবস্থান অনুযায়ী বাস্তবতা-সংক্রান্ত উপলব্ধি পৃথক হয়। মতাদর্শ সেখানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তার মধ্যে বুর্জোয়াশ্রেণির চৈতন্য আসলে অলীক চৈতন্য (false consciousness)। প্রকৃত ও যথার্থ চৈতন্য অর্থাৎ বাস্তবতা সম্পর্কে অভ্রান্ত বোধ থাকার সম্ভাবনা আছে শ্রেণি হিসেবে একমাত্র প্রোলেতারিয়েতের মধ্যে। বাস্তবতা সম্পর্কে সেই যথার্থ জ্ঞানই হল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ। প্রোলেতারিয়েত বুর্জোয়াশ্রেণির অলীক চৈতন্যের প্রভাবে আচ্ছন্ন থাকলেও শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের চেতনা ও জ্ঞানে সমৃদ্ধ বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের সংস্পর্শে এসে, প্রোলেতারিয়েত ওই অলীক চেতনা থেকে মুক্ত হয় এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের চেতনা লাভ করে। প্রোলেতারিয়েতের মতাদর্শ ও বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান এ দু’টি তখন সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। আমি ভাববাদী নই। বরং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে বিশ্বাসী। শেষপর্যন্ত আমি মনে করি ‘বাস্তবতা’-র চেতনা-নিরপেক্ষ একটি বস্তুগত চরিত্র আছে। তা যতই দ্বন্দ্বসংকুল ও গতিময় হোক না কেন। তাকে জানা সম্ভব বিজ্ঞানের অগ্রগতির মাধ্যমে। তার সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানই হল বিজ্ঞান।

উত্তর-কাঠামোবাদী: আমরা বলব ‘বাস্তবতা’ একটি ধারণা। বিভিন্ন মানুষের কাছে তার বিভিন্ন অর্থ, পৃথক ব্যাখ্যা, স্বতন্ত্র উপলব্ধি আছে। তা শুধুমাত্র শ্রেণিগত অবস্থান ও মতাদর্শের ওপর নির্ভর করে না। জাত-পাত, লিঙ্গভেদ, বর্ণ (colour), ধর্মীয় চেতনা, বিভিন্ন গোষ্ঠীগত অবস্থান ইত্যাদির ওপরও তা নির্ভর করে। বিশেষত ক্ষমতা-ভাষ্য (discourse), ক্ষমতা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও ভাষার ওপর তা নির্ভরশীল। ডিসকোর্স আমাদের একভাবে ভাবতে সক্ষম করে তোলে, তেমনই অন্যভাবে ভাববার সামর্থ্যকে নষ্ট করে। মিশেল ফুকো জ্ঞান ও ক্ষমতার যুগল সত্তা, তাদের মধ্যেকার অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক সম্বন্ধে আলোকপাত করেছেন। একইভাবে জাক দেরিদা দেখিয়েছেন একটি পাঠ্য (text)-এর কোনও এক নির্দিষ্ট, স্থায়ী, যথার্থ (authentic) অর্থ থাকে না। বরং তার বহুবিধ অর্থ, চলমান অর্থ, অনিশ্চিত ও অনির্ধারণযোগ্য অর্থ থাকে। অবিনির্মাণ এই সত্যকেই তুলে ধরে যে সত্য চঞ্চল, অস্থির, আপেক্ষিক, বহুবিধ।

মার্কস: আপনারা যদি বলেন অন্ধ কুসংস্কারও সত্য, প্রগতিশীল মূল্যবোধ ও যুক্তিবাদও সত্য, তাহলে, আপনাদের সঙ্গে কোনওভাবেই একমত হওয়া সম্ভব নয়। আলোকপ্রাপ্তির যুক্তিবাদ তার অনেক ত্রুটি সত্ত্বেও আমাদের জীবনকে অন্ধকার থেকে আলোয় এনেছে এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। আপনারা যেভাবে আলোকপ্রাপ্তি, আধুনিক সভ্যতা, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের বিরোধিতা করছেন তাতে সমস্তরকম, প্রাক্-আধুনিক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, প্রগতি-বিরোধী চিন্তা, অনমনীয় প্রাচীন সামাজিক কাঠামোর অচলায়তন, প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক রীতি-নীতি, অন্ধ ধর্মবিশ্বাস, কুপ্রথা ইত্যাদি আদর্শগত দিক থেকে যৌক্তিকতা ও ন্যায্যতা লাভ করছে। এর ফল হল এই যে, প্রগতিশীল শক্তিগুলি দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি প্রবল হয়ে উঠছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশে এক দিকে যেমন তালাক ও বোরখা প্রথার সমর্থক ও নারী স্বাধীনতার বিরোধী গোঁড়া মুসলিম মৌলবাদীদের উত্থান ঘটেছে, অন্য দিকে তেমনি জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতাবাদ ও মৌলবাদ সংখ্যালঘু বিদ্বেষকে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছে। ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে মুক্ত চিন্তার সমর্থক যুক্তিবাদীরা হিংস্র আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। মানবমনের গভীর অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত যত বিষাক্ত, যুক্তি-বিরোধী, দূষিত, সংকীর্ণ চিন্তা আজ আপনাদের মতো বুদ্ধিজীবীদের তত্ত্ব দ্বারা নৈতিক ও যৌক্তিক সমর্থন লাভ করে রীতিমতো প্রকাশ্যে নিজেদের অস্তিত্বকে সদম্ভে ঘোষণা করছে। আপনারা ভুলে গেছেন যে, আলোকপ্রাপ্তির যুক্তিবাদ মানুষকে যুক্তিবাদী, বিবেকবোধ-সম্পন্ন, প্রজ্ঞাবান, বিবেচক, বিজ্ঞানমনস্ক, পরধর্মসহিষ্ণু, ধৈর্যশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে ওঠার শিক্ষা দিয়েছিল।

উত্তর-কাঠামোবাদী:  মৌলবাদ যেমন ভয়ংকর, আলোকপ্রাপ্তির যুক্তিবাদও কিন্তু ততটাই বিপজ্জনক। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি আফ্রিকার ক্রীতদাস-ব্যাবসা, উপনিবেশবাদ, আদিম অধিবাসীদের গণহত্যা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিরোশিমা-নাগাসাকি, নাৎসিবাদ ইত্যাদির কথা। আলোকপ্রাপ্তির যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানসর্বস্বতা আধুনিকতার এমন এক অনমনীয় কঠোর কাঠামোকে প্রতিষ্ঠা করে যার অন্তরালে নিয়ত সক্রিয় রয়েছে ক্ষমতার তন্ত্রজাল। তা অদৃশ্য কিন্তু সর্বব্যাপী। আধুনিক মানুষ যেমন এই তন্ত্রজালের মধ্যে নিমজ্জিত, তেমনই এই তন্ত্রজালও মানুষের অভ্যন্তরে অন্তর্লিনীকৃত (internalised)। আলোকপ্রাপ্তির যুক্তি-কাঠামোর বিরোধিতা করলেই যে মৌলবাদের পক্ষে দাঁড়াতে হবে তা আমরা মনে করি না। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক দীপেশ চক্রবর্তী এইভাবে ভাবাকে কল্পনার দৈন্য বলেছেন। আমাদের কল্পনাকে, মননকে আরও প্রসারিত করলে আমরা আলোকপ্রাপ্তির যুক্তিবাদ এবং মৌলবাদ এই দুয়ের বাইরে একটি তৃতীয় বিকল্প অবস্থানকেও ভাবতে পারি। তা হল, নিম্নবর্গীয় মানুষের সংস্কৃতিতে বিরাজমান সমন্বয়ের সংস্কৃতি। ভারতের ক্ষেত্রে এর উদাহরণ হল কবির, লালন ফকির এঁদের লোকধর্মের সমন্বয়মুখী ভাবনা। তা এক দিকে যেমন পাশ্চাত্য আধুনিকতার ফসল সেকুলারিজ়ম নয়, অন্য দিকে কোনও ধর্মীয় মৌলবাদও নয়।

মার্কস: লোকধর্ম, সমন্বয়ের আদর্শ, অতীন্দ্রিয়বাদ, মরমিয়া তত্ত্ব এগুলির তুলনায় আলোকপ্রাপ্তির যুক্তিবাদকে আমি বহু গুণে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি। ওই যুক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে। ওই বিজ্ঞানের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে আধুনিক শিল্পোন্নত সমাজ। তবে তা ব্যক্তিগত মালিকানা-ভিত্তিক পুঁজিবাদী সমাজ হলে চলবে না। তাকে হতে হবে সামাজিক মালিকানা-ভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক সমাজ। এভাবেই একটি অনগ্রসর প্রাক্‌-পুঁজিবাদী বা সামন্ততান্ত্রিক সমাজ আধুনিক শিল্পোন্নত সমাজতান্ত্রিক সমাজে উন্নীত হতে পারে। কেন্দ্রীভূত, রাষ্ট্রায়ত্ত, পরিকল্পিত অর্থনীতিতে উন্নত প্রযুক্তি ও ভারী শিল্পায়নের মাধ্যমে তা ঘটতে পারে। লালন ফকিরের বাউল দর্শনের মাধ্যমে তা আদৌ সম্ভব নয়। আপনারা দারিদ্রকে মহান করে দেখতে চান। এ হল এক ধরনের সামন্ততান্ত্রিক রোমান্টিক ভাবাদর্শ। পাতি বুর্জোয়া, কৃষক, ছোট দোকানদার, মধ্যযুগীয় ক্ষুদ্র উৎপাদক, ধর্মযাজকরা এই ধরনের স্বপ্নবিলাসে অভ্যস্ত। এ হল উন্নত প্রযুক্তি, আধুনিক বিজ্ঞান, বৃহদায়তন শিল্প, কল-কারখানা, কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রক্ষমতা এসব বর্জন করে মধ্যযুগের ক্ষুদ্র উৎপাদন ব্যবস্থায় ফিরে যাবার গিল্ড সমাজতন্ত্রবাদী তত্ত্ব। ভারী শিল্পায়ন, আধুনিক জাতীয়তাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র-পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থা ব্যতীত আধুনিক, মুক্ত, সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন করা যাবে কীভাবে? শিল্পায়নের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক উন্নয়ন সম্ভব, কৃষিভিত্তিক গ্রামসমাজে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে নয়।

উত্তর-কাঠামোবাদী: আপনার প্রস্তাবিত এই সমাজতন্ত্র হল একটি একশিলা (monolithic), সমসাত্ত্বিক (homogeneous) সমাজ। এর বিপরীতে আমরা বহুত্ব ও পার্থক্যের সমর্থক। সমাজে বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও শক্তির অস্তিত্ব সমাজকে সমৃদ্ধ ও জীবনীশক্তিতে ভরপুর রাখে। পার্থক্যকে স্বাগত না জানিয়ে তাকে দমন করে সর্বব্যাপী ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস রেজিমেন্টেশনের নামান্তর মাত্র। কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে ভারী শিল্পায়ন কখনোই একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী, বিকেন্দ্রীভূত সমাজ সৃষ্টি করতে পারে না। বরং তা একটি মাথাভারী বৃহৎ আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও রীতিমতো দমনমূলক কর্তৃত্ববাদী সমাজের জন্ম দেয়। আমরা চাই স্থানীয় সম্পদ, দেশীয় প্রযুক্তির ভিত্তিতে অসংখ্য ক্ষুদ্র শিল্প, স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ শিল্প, হস্তশিল্প, কুটির শিল্প, দেশজ শিল্পের গণতান্ত্রিক বিকাশ। এভাবেই তৃণমূল স্তরে অবস্থিত গ্রাম ও শহরের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকানির্বাহের ব্যবস্থা হতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তি-কেন্দ্রিক শিল্পায়নের পরিবর্তে শ্রম-নিবিড়, পরিবেশ-বান্ধব বিকেন্দ্রীভূত শিল্পায়ন, স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ সমাজ, স্বেচ্ছামূলক যৌথ উৎপাদন ব্যবস্থা কাম্য। এই শিল্পায়নের পরিচালনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করবে তৃণমূল স্তরের মানুষ। কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পায়ন এইসব মানুষদের থেকে বহুদূরে রয়ে যায়। ভারী শিল্পায়নে পরিচালন-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলি দূর থেকে কর্তৃত্ববাদী, উচ্চবর্গীয় (elite) মন্ত্রী ও আমলারা মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়। লক্ষ লক্ষ কৃষক জমি থেকে এবং উপজাতীয় মানুষেরা জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ হয়ে যান। শুধু জীবিকানির্বাহের দিক থেকেই নয়। বিকল্প বিকেন্দ্রীভূত দেশজ, শিল্পায়ন, স্থিতিক্ষম (sustainable) উন্নয়ন স্থানীয় মানুষদের চলতি জীবনধারা, নিজস্ব সংস্কৃতি, তাঁদের মূল্যবোধ, আদর্শ, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মর্যাদা দেয়। তাই উর্বর কৃষিজমিকে সরকার বলপূর্বক অধিগ্রহণ করে ভারী শিল্পায়ন ঘটাতে চাইলে আমরা তার বিরোধিতা করি। জমির প্রতি কৃষকের মমত্ববোধ ও টানকে অসম্মান করার অধিকার রাষ্ট্রের নেই।

তা ছাড়া আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাটিতেও সমস্যা রয়েছে। জাতি-রাষ্ট্র একটি একক প্রভুত্বকারী সংস্কৃতিকে তার অভ্যন্তরের অন্য সমস্ত সংস্কৃতির ওপর চাপিয়ে দেয়। ওই সংস্কৃতি জাতি-রাষ্ট্রকে এক চিরন্তন পবিত্র সত্তা হিসেবে তুলে ধরে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে তার বেদিমূলে উৎসর্গ করা হয়। জাতি-রাষ্ট্রের সমালোচনা করলে, বিরোধিতা করলে, জাতি-রাষ্ট্রের থেকে ভিন্নমত পোষণ করলে ও সেই মত প্রকাশ করলে জাতি-রাষ্ট্র তাকে নির্মমভাবে দমন করে। তা সে পুঁজিবাদী উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র হোক, আর আপনার প্রস্তাবিত সমাজতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র হোক। জাতি-রাষ্ট্রকে এতটাই পবিত্র একটি প্রতিষ্ঠান বলে গণ্য করা হয় যে তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করাটা নাগরিকের অবশ্য পালনীয়, বাধ্যতামূলক কর্তব্য মনে করা হয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, আইন, সংস্থা, সংগঠন, নিয়মাবলি, সামাজিক রীতি, নাগরিক সমাজ, পত্রপত্রিকা, সিনেমা, থিয়েটার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার, ধর্মীয় সংঘ, পেশাভিত্তিক সমিতি, ব্যক্তি এই জাতি-রাষ্ট্রের অধীন। জাতি-রাষ্ট্রই সর্বোচ্চ সত্তা। তার বিরুদ্ধে যেকোনওরকম সমালোচনাই জাতীয়তাবিরোধী বলে বিবেচিত হয়। জাতীয়তাবাদকে সর্বোচ্চ, মহান ও পবিত্রতম এক ভাবাদর্শ মনে করা হয়। এটা ঠিক যে, আপনি ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ বলে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এটাও ঠিক যে, আপনি প্রোলেতারিয়েতের আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতিকে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু কার্যত ফলিত সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতায় এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, বাস্তবে বিদ্যমান প্রতিটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রই জাতীয়তা-সর্বস্ব। তারা জাতীয় স্বার্থকে সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। তাদের অভ্যন্তরীণ নীতি ও বিদেশ নীতি তারই প্রতিফলন।

মার্কস: আপনারা জাতি-রাষ্ট্রের যে সমালোচনা করছেন তা কিন্তু মূলত, পুঁজিবাদী জাতি-রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যথার্থ রূপে প্রযোজ্য। তা ছাড়া সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপরীতে জাতি-রাষ্ট্রের উত্থানকে কি একটি প্রগতিশীল ঘটনা বলা যাবে না? ঐতিহাসিক বিকাশের একটি বিশেষ পর্যায়ে জাতি-রাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদের আর্বিভাব। সমাজতন্ত্র থেকে কমিউনিজ়মে উত্তরণের পর্বে এই সমাজতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র গঠন একটি অনিবার্য পর্যায়। মধ্যযুগের ব্যক্তি শাসকের প্রতি প্রজার আনুগত্যের তুলনায় আধুনিক যুগে জাতি-রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের ব্যক্তি-নিরপেক্ষ আনুগত্য কি একটি অগ্রসর পদক্ষেপ নয়? আমার উত্তরসূরি রুশ তাত্ত্বিক ও বিপ্লবী লেনিন দেখিয়েছেন উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদ এক অতি তাৎপর্যপূর্ণ প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করে। অবশ্য প্রোলেতারিয়েতের আন্তর্জাতিক স্বার্থের সঙ্গে আপস করা চলে না কোনও মতেই। সেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনই সমর্থনযোগ্য যা প্রোলেতারিয়েতের আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক স্বার্থের পক্ষে অনুকূল।

উত্তর-কাঠামোবাদী: ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘প্রোলেতারিয়েত’, ‘সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘পুঁজিবাদ’ ইত্যাদি শব্দগুলি আপনি এমনভাবে ব্যবহার করেন যেন সেগুলি এক একটি নির্দিষ্ট, নিশ্চিত, স্থায়ী অর্থ বহন করে। কিন্তু অবিনির্মাণ দেখায় যে, কোনও নামই কোনও স্থায়ী নিশ্চিত অর্থকে নির্দেশ করে না। প্রতিটি নামের মধ্যে বহু স্ববিরোধিতা, পার্থক্য, দ্বন্দ্ব, বৈপরীত্য চাপা পড়ে থাকে। নাম মাত্রই বহুস্বরবিশিষ্ট। অপর, প্রান্তিক স্বরকে অবদমিত করে একটি প্রধান স্বর প্রবল ও প্রভুত্বকামী হয়ে ওঠে। নামগুলির অর্থ সাময়িক, পরিপ্রেক্ষিত-নির্ভর, পাঠক-নির্ভর, অস্থায়ী, অনিশ্চিত। অর্থ স্বয়ংসম্পূর্ণ কিছু নয়। এটি রাজনৈতিকভাবে সৃষ্ট। ‘সমাজতন্ত্র’ এই নামটির মধ্যে ‘মার্কসীয় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’, ‘কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রায়ত্ত কম্যান্ড ইকনমির সমাজতন্ত্র’, ‘বিকেন্দ্রীভূত স্থানীয় কারখানা-ভিত্তিক পরিচালনার সমাজতন্ত্র’, ‘গিল্ড সমাজতন্ত্র’, ‘ফেবিয়ান সমাজতন্ত্র’, ‘নৈরাজ্যবাদী সমাজতন্ত্র’, ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ এরকম বহুবিচিত্র অর্থ লুক্কায়িত। জাক দেরিদা তাঁর দিফেরঁস ধারণাটির মাধ্যমে দেখিয়েছেন পার্থক্যের মধ্যে দিয়েই অর্থের নির্মাণ ঘটে, আবার শব্দের অর্থ সর্বদাই স্থগিত থেকে যায়। ভাষার অর্থনির্মাণ প্রক্রিয়ার এই চরিত্র সম্পর্কে অবহিত না থাকলে রাজনৈতিক জ্ঞান ও রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্মাণের প্রক্রিয়াকে বোঝা যাবে না।

মার্কস: এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, ভাষার অর্থনির্মাণের নিয়মগুলি সম্পর্কে আপনারা অনেক দূর ভেবেছেন। কিন্তু আমি বলব আপনাদের চিন্তায় এক মারাত্মক গলদ রয়ে গেছে। তা হল, ভাষা-সর্বস্বতা। আমি মনে করি বহির্বাস্তব চেতনা-নিরপেক্ষভাবে বিদ্যমান (objectively)। তার অস্তিত্ব ভাষার ওপর নির্ভরশীল নয়। ভাষার মাধ্যমে বাস্তব জগতের উপস্থাপনা (representation) ঘটে। ভাষা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অর্থ নির্মাণ করে তা অবশ্যই নয়। অর্থ নির্মাণের প্রক্রিয়া একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া তাও আমি মানি। কিন্তু সে রাজনীতি আপনাদের অর্থে ঘটছে তা আমি বলব না। বরং আমি ভাষার অর্থনির্মাণ প্রক্রিয়াতে অর্থনৈতিক উৎপাদন পদ্ধতি, শ্রেণি-অবস্থান ও শ্রেণি-রাজনীতির প্রবল প্রভাবের কথা বলব।

উত্তর-কাঠামোবাদী: ভাষার অর্থনির্মাণ প্রক্রিয়ার ওপর শুধু শ্রেণি-রাজনীতির বা অর্থনৈতিক উৎপাদন পদ্ধতির প্রভাব থাকে বললে সবটা বলা হল না। শ্রেণি-রাজনীতির বাইরেও অন্যান্য রাজনীতি থাকে। রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষমতা রয়েছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাব ছাড়াও আছে সামাজিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক প্রভাব। জাতপাত, ধর্ম, বর্ণবৈষম্য, পিতৃতন্ত্র ইত্যাদির প্রভাব। ভাষার অর্থনির্মাণের পেছনে ক্ষমতা-ভাষ্য (discourse) গুলির মধ্যেকার তীব্র লড়াই রয়েছে। কোন অর্থ প্রাধান্যের অবস্থানটিকে দখল করবে তা স্বয়ং একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। আপনি বলেছেন ভাষার মাধ্যমে বাস্তবতার উপস্থাপনা ঘটে। কিন্তু শুধু তাই নয়। ভাষা নিষ্ক্রিয় একটি মাধ্যম মাত্র নয়। শব্দের অর্থ উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ভাষা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ভাষার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন জিনিসকে চিনে থাকি, তাদের নামকরণ করি, তাদের চিহ্নিত করি। হুসাৰ্ল ভেবেছিলেন শব্দের একটি সারসত্তা (essence) থাকে। কিন্তু এই ভাবনায় সমস্যা আছে। শব্দের এরকম কোনো পূর্বনির্ধারিত স্থির অর্থ বা সারসত্তা থাকে না। দেরিদার মতে, ‘Différance is prior to essence’। পার্থক্য ও স্থগিতকরণ নিয়ে দিফেরঁস (Différance)। পার্থক্য অর্থের জননী। আবার শব্দের মধ্যে অর্থ থাকে না। শব্দ কখনোই তার পূর্ণ অর্থে পৌঁছায় না। অর্থ সর্বদাই স্থগিত হয়ে যায়। অর্থের এই অসম্পূর্ণতা, ফাটল, স্ববৈপরীত্য, সংশয়, ছেদ, অসংগতি এবং ধারাবাহিকতার অভাবকে খেয়াল রেখেই আমাদের রাজনৈতিক তত্ত্ব নির্মাণ করতে হবে। নামের অচলায়তন, অর্থের অনমনীয়তা, শব্দের অপরিবর্তনীয়তা, ভাষার নিশ্চয়তা জন্ম দেয় সব ধরনের ফ্যাসিবাদের।

মার্কস: বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ কখনোই এটা মেনে নিতে পারে না যে বাস্তবতা ভাষার ওপর নির্ভরশীল। বস্তুত বৈজ্ঞানিক সমাজবাদ বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারায় বিশ্বাসী আর বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারা বাস্তবতার স্বাধীন ও চৈতন্য-নিরপেক্ষ অস্তিত্বে বিশ্বাসী। অন্য সমস্ত ধরনের চিন্তাধারার তুলনায় এই কারণে বৈজ্ঞানিক সমাজবাদ বেশি অগ্রসর। আপনারা যাঁদের নিম্নবর্গ বলেন, যাঁরা সাধারণ কৃষক, যাঁরা শ্রমিক তাঁদের চৈতন্যের তুলনায় কমিউনিস্টরা অনেক এগিয়ে ভাবতে সক্ষম। এইসমস্ত মানুষদের শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব কমিউনিস্টদের। তাঁরাই এঁদের নিম্নস্তরের চৈতন্যকে উন্নত স্তরে, ক্রমশ বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের স্তরে নিয়ে যাবেন। এই বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের যথার্থতা বিচারের একটিই মাত্র কষ্টিপাথর আছে, তা হল বাস্তবতার অভ্রান্ত বিশ্লেষণ। ভাষার দ্বারা এই বিশ্লেষণ সীমাবদ্ধ নয়। তা যদি হত তাহলে কোনটা নির্ভুল বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আর কোনটা অজ্ঞানতা তা বিচারের কোনো মানদণ্ডই থাকত না।

উত্তর-কাঠামোবাদী: তাহলে আপনি মনে করেন শ্রমিক-কৃষক বা সাধারণভাবে নিম্নবর্গীয় (subaltern) মানুষের থেকে শিক্ষা গ্রহণের পরিবর্তে আপনারা কমিউনিস্টরা বরং তাঁদের শিক্ষা দান করবেন। তাঁদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, অনুভব, যুক্তিবোধ, বুদ্ধিবৃত্তি আপনাদের তথাকথিত বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান-বুদ্ধির তুলনায় নিকৃষ্টতর। তাই সমাজ পরিবর্তনের সঠিক দিশা তাঁদের আন্দোলনে আপনারাই জোগাবেন। কিন্তু সত্যিই কি আপনাদের বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান ও তাঁদের অভিজ্ঞতালদ্ধ জ্ঞানের মধ্যে কোনও তুলনা করা যায় যে কোনটি উৎকৃষ্টতর? এর কোনও সর্বজনস্বীকৃত বস্তুগত মানদণ্ড আদৌ আছে কি? আমরা কমিউনিস্টদের এই শিক্ষকসুলভ মনোভাবকে অতি উদ্ধত, দুর্বিনীত, অযৌক্তিক ও অন্যায় বলে মনে করি। এ হল এক ধরনের প্রবরবাদ (elitism)। নিম্নবর্গীয় জনসাধারণের জন্যে কোনটি ভাল আর কোনটি মন্দ সেটা তাঁদের চেয়ে আপনারা বেশি ভাল বুঝবেন এটাই আপনাদের দাবি। এটা গণতন্ত্রের মূল নীতিকেই লঙ্ঘন করে। আমরা ওই গুরুগিরি (pedagogy) করার মানসিকতাকে বর্জন করে চলার পক্ষপাতী। আপনার উত্তরসূরি লেনিন এভাবেই মনে করেছিলেন যে, শ্রমিকশ্রেণির নিজস্ব চৈতন্য নিজে থেকে কেবলমাত্র ট্রেড ইউনিয়ন স্তর পর্যন্ত উন্নীত হতে পারে। কখনোই তা সমাজতান্ত্রিক চেতনার স্তর পর্যন্ত উঠতে পারে না। উক্ত সমাজতান্ত্রিক চেতনা শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে আসতে পারে কেবলমাত্র শ্রমিকশ্রেণির বাইরে থেকে (‘from without’), অর্থাৎ বিপ্লবী কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের মারফত। এ ধরনের চিন্তা আদৌ ঠিক নয়। কারণ এটা গুরুগিরিকেই বৈধতা দান করে। মিশেল ফুকোর ধারণা থেকে বলা যায় এভাবে সাধারণ শ্রমিক ও কৃষক বা বৃহত্তর অর্থে নিম্নবর্গীয় মানুষের জ্ঞানকে আলোকপ্রাপ্তির জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রান্তে নির্বাসিত করে এবং তার ওপর নিজের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে। চূড়ান্ত অর্থে কোন জ্ঞান উৎকৃষ্টতর আর কোন জ্ঞান নিকৃষ্টতর তা নির্ভর করে ক্ষমতা ও ক্ষমতা-ভাষ্যের ওপর। নিম্নবর্গীয় চৈতন্য, বিশেষত, নিজেদের জীবন, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কে কৃষকদের নিজেদের ধ্যানধারণা ও উপলব্ধি, তাঁদের নিজস্ব স্বাধীনতা ও ন্যায়ের বোধ, সুখ-দুঃখ ও স্বনির্ভরতার আকাঙ্ক্ষা, নিজস্ব বিচারবুদ্ধি ও জীবনসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা, এসবই উপেক্ষিত হয়। কিন্তু প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে ফলিত সমাজতন্ত্রের পতন কি কমিউনিস্টদের তথাকথিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় না? তা ছাড়া, অবিনির্মাণের ধারণার সাহায্য নিয়ে আমরা বলতে পারি সমাজতান্ত্রিক চৈতন্য আর নিম্নবর্গীয় চৈতন্য এ দু’টিকে দ্বিত্ব অনুসারী ভাবনা হিসেবে, পরস্পরের বিপরীত ও পারস্পরিকভাবে (mutually exclusive) ও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দু’টি ধারণা হিসেবে দেখাটাও ভুল। একটি অপরটির তুলনায় উচ্চতর ভাবার মধ্যেও ক্ষমতা ক্রিয়াশীল।

মার্কস: কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফলিত সমাজতন্ত্রের সংকট ও ব্যর্থতা সামগ্রিকভাবে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্বকে নস্যাৎ করে দেয় এ কথা আমি মনে করি না। বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রোলেতারিয়েত ও বৃহত্তর শ্রমজীবী জনগণের শ্রেণিসংগ্রাম কিন্তু আজও অব্যাহত আছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ অনপনেয় সংকট ও দ্বন্দ্বের নিরসন হয়নি। সামাজিক পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জ্ঞান আরও অভ্রান্ত হয়ে উঠবে। এটাই যেকোনও বিজ্ঞানের ধর্ম। বাস্তব সামাজিক অনুশীলন, অভিজ্ঞতার সারসংকলন ও তার যথার্থ সমীক্ষার মাধ্যমে এই জ্ঞান অগ্রসর হয়। সমাজতন্ত্রের সাময়িক পতন এটা কোনো চূড়ান্ত ঘটনা নয়। সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদের বিজয়ও একদিনে আসেনি। দীর্ঘ কয়েক শত বর্ষের সংগ্রামের ফলস্বরূপ ক্রমশ সামন্ততন্ত্রের বিলোপ ও ধনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। শ্রেণিসংগ্রামের অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ করে ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ক্রমশ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান সমৃদ্ধতর হয়ে উঠবে। সাময়িক কিছু ব্যর্থতার জন্য ওই জ্ঞানকে ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা সম্পর্কে অজ্ঞ ও দ্বন্দ্বতত্ত্ব (Dialectics) সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ সাধারণ শ্রমিক ও কৃষকের জ্ঞানের স্তরে, চেতনার স্তরে নামিয়ে আনা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। আমার অপর এক উত্তরসূরি চিনা কমিউনিস্ট মাও জে-দং যথার্থই বলেছেন, সঠিক জ্ঞান আসে শ্রেণিসংগ্রাম, অর্থনৈতিক উৎপাদনের অভিজ্ঞতা ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে। একইসঙ্গে অবশ্য মাও জে-দং শ্রমজীবী জনগণের কাছ থেকে কমিউনিস্টদের শিক্ষা লাভ করার ওপরেও জোর দেন এবং তা যথার্থ।

উত্তর-কাঠামোবাদী: উন্নততর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অধিকারী এই দাবির ভিত্তিতে কমিউনিস্টরা নিম্নবর্গীয় জনতার ওপর নির্দ্বিধায় তাদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে ও মাতব্বরি চালিয়ে যায়। অথচ ওই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জ্ঞান প্রকৃতই উন্নততর কি না তা পরিমাপের কোনো সর্বজনস্বীকৃত মানদণ্ড নেই। নিছক মর্জিমাফিক উন্নততর জ্ঞানের এই দাবিকে তুলে ধরা হয় যাতে নিম্নবর্গীয় মানুষের ওপর কমিউনিস্টরা তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। এজন্যে মিশেল ফুকো জ্ঞান/ক্ষমতা যুগলের ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। জ্ঞান ও ক্ষমতা পরস্পর নিবিড়ভাবে, অঙ্গাঙ্গিরূপে যুক্ত। একে অপরকে শক্তিশালী করে তোলে। ক্ষমতা অধীনস্থ মানুষগুলি সম্পর্কে জ্ঞান সৃষ্টি করে। আর জ্ঞান উৎপাদন করে অধীনস্থ মানুষগুলিকে যাতে আরও বেশি করে ক্ষমতার দাস করে তোলা যায় তার উপায়।

মার্কস: আপনাদের যুক্তিতে নির্ভুল জ্ঞান ও ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। বিজ্ঞান ও অবিজ্ঞানের মধ্যে কোনও তফাত নেই। উৎকৃষ্টতর বা উন্নততর জ্ঞান আর নিকৃষ্টতর বা অনুন্নত স্তরের জ্ঞানের মধ্যে আপনারা কোনও তুলনা টানতে অক্ষম। এ হল এক অতি-সরলীকৃত শিশুসুলভ জ্ঞানতত্ত্ব। এর দ্বারা কেবল স্বতঃস্ফূর্ততার পূজা করা চলে। নিয়ন্ত্রণবিহীন বুর্জোয়া স্বাধীনতার ধারণা, অবাধ মুক্তির তত্ত্ব, যা ইচ্ছে ভাবা ও করার নীতি এর থেকেই জন্ম নেয়। সমাজ পরিবর্তনের সচেতন দিশা, praxis, সুপরিকল্পিত অনুশীলন, বিপ্লবী লক্ষ্যে নিয়োজিত প্রয়োগ, সমাজতন্ত্রের জন্যে দিক্‌নির্দেশ— এসব নিম্নবর্গীয় চৈতন্যে মেলা ভার। অবাধ স্বাধীনতা ও চরম গণতন্ত্রের নাম করে, নিম্নবর্গীয় চৈতন্যের ধ্বজা উড়িয়ে, নেতৃত্ব-বিহীন, কর্তৃত্ব-বিরোধী, পরিচালনা-বর্জিত আন্দোলনের বিপ্লবী বুলি আউড়ে এ হল প্রকৃতপক্ষে সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার তত্ত্ব। অর্থাৎ সমাজ-পরিবর্তনে বাধা সৃষ্টি করা ও ধনতন্ত্র বা সামন্ততন্ত্রকে অটুট রাখাই এর অঘোষিত এবং হয়তো অসচেতন, অনাকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। কমিউনিস্টরা স্বতঃস্ফূর্ততার পূজারি হতে পারেন না। হাজার হাজার বছর ধরে শ্রেণিসংগ্রাম চলেছে। সেটা মোটেই কমিউনিস্টদের সৃষ্টি নয়। কিন্তু কমিউনিস্টরা ওই শ্রেণিসংগ্রামে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সচেতন দিশা দান করেন, এটাই তাঁদের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও কর্তব্য। আমার উত্তরসূরি লেনিন স্বতঃস্ফূর্ততার পেছনে ছোটাকে ‘জনগণের লেজুড় বৃত্তি’ (Khovostism) বলে ব্যঙ্গ করেছেন। লেনিন ও রোজা লুক্সেমবুর্গের মধ্যে বিতর্কে রোজা যদিও সাধারণ শ্রমিকশ্রেণির চেতনা ও ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তবু কখনোই তিনি স্বতঃস্ফূর্ততার অবাধ অনুসরণের পক্ষপাতী ছিলেন না।

উত্তর-কাঠামোবাদী: সমাজতান্ত্রিক চেতনাকে সর্বোচ্চ, অভ্রান্ত ও নিশ্চিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ভাবার কারণেই কমিউনিস্ট পার্টি ও পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সর্বোচ্চ, একচ্ছত্র, কেন্দ্রীভূত ও কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত থাকে। একই যুক্তিতে সমস্ত বিরোধী দল ও ব্যক্তিকে, সমালোচনাকারী মতকে নির্মমভাবে দমন করা হয়। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিন জমানায়, রুমানিয়াতে চাসেস্কুর আমলে, কামপুচিয়াতে পল পটের শাসনকালে তা ঘটেছে। একই যুক্তির ভিত্তিতে লেনিন ভ্যানগার্ড পার্টির সংগঠনের নীতি হিসেবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ধারণাকে ব্যাখ্যা করেন। স্তালিনের তুলনায় লেনিন গণতন্ত্রকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিলেও শেষপর্যন্ত কেন্দ্রিকতাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এভাবেই পার্টির মধ্যে চরম শৃঙ্খলাপরায়ণতা ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন দেখা দেয়। ফুকো-বর্ণিত প্যানপ্‌টিকনের মতো কমিউনিস্ট পার্টি কর্মীদের ওপর নিরলস, অতন্দ্র চোখে নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি চালিয়ে যায়। সমাজতান্ত্রিক চেতনাকে অভ্রান্ত সত্য ও একমাত্র নিঃসংশয় বৈজ্ঞানিক জ্ঞান হিসেবে দেখার ফলে এটা ঘটে। এর বিপরীতে আমরা সত্যের বহুত্ব, জ্ঞানের বহুরূপতা, প্রামাণ্য তত্ত্বের অভাব, জ্ঞানের অনিশ্চয়তা ও সংশয়, সত্যের অনির্দিষ্টতা ও অনির্ণেয়তা, মহা আখ্যানে অবিশ্বাস, ‘অপর’ (other)-এর প্রতি দায়বদ্ধতা, ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা— এগুলির ওপর জোর দিয়ে থাকি। অভ্রান্ত সত্যের ও জ্ঞানের একমাত্র অধিকারী, একক দাবিদার হিসেবে নেতৃত্ব যখন প্রশ্নাতীত, নিঃশর্ত আনুগত্য আদায় করে তখনই সেখানে কর্তৃত্ববাদ ও স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার উদ্ভব ঘটে, তা সে নেতৃত্ব যতটাই বিপ্লবী ও কমিউনিস্ট হোক না কেন। শুধু বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বনাম অবৈজ্ঞানিক ধারণা, সমাজতান্ত্রিক চেতনা বনাম কৃষক চৈতন্য এরূপ বাইনারিই নয়, বিপ্লবী কমিউনিস্ট কর্তৃত্ব বনাম সংশোধনবাদী কর্তৃত্ব এই বাইনারি ব্যবহার করেও ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করা ও অব্যাহত রাখা যায়। যেকোনও বাইনারির মতো এই বাইনারিগুলিও অবিনির্মাণযোগ্য।

মার্কস: আপনাদের সঙ্গে বর্তমান আলাপচারিতা থেকে এ কথা স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান যে, আমাদের মধ্যে দার্শনিক স্তরে, ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে, চিন্তায়-ভাবনায়, যুক্তিতে-মননে, অনেক পার্থক্য রয়েছে। আমার দৃষ্টিতে আপনারা দার্শনিকভাবে নাস্তিবাদী (nihilist) এবং মতাদর্শের ক্ষেত্রে নৈরাজ্যবাদী (anarchist)। তা সত্ত্বেও আমি বলব, উত্তর-কাঠামোবাদী উত্তর-আধুনিক যে-ধারাটিকে সমাজবিজ্ঞানীরা Ludic বা ‘ক্রীড়াপ্রিয়’ বলে বর্ণনা করেন, অর্থাৎ যাঁরা সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে উদাসীন, যাঁদের কাছে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনগুলি অবান্তর, যাঁদের কাছে শোষণ, দমনপীড়ন, প্রতিরোধ এসবই নেহাত খেলামাত্র, তাঁদের তুলনায় আপনাদের উত্তর-কাঠামোবাদী চিন্তার ধারাটি সামাজিকভাবে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ও মূল্যবান। তার একটা বড় কারণ হল এই যে, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, ক্ষমতা, দমনপীড়ন, শোষণ, প্রভুত্ব, ন্যায়-অন্যায়, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, সংগ্রাম এসব নিয়ে আপনারা অনেক ভেবেছেন। ক্ষমতার প্রায় অদৃশ্য তন্তুজালকে উন্মোচন করে, বৈধতা ও সম্মতির কালো পর্দার আবরণকে ছিন্ন করে আপনারা ক্ষমতাকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। সমাজতন্ত্রকে সমর্থন নাই-বা করলেন, পুঁজিবাদের আপনারা তীব্র সমালোচনা করেছেন। শ্রেণিসংগ্রাম ও শ্রেণিশোষণকে আপনারা কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দিতে অস্বীকার করেছেন এ কথা ঠিক। কিন্তু একইসঙ্গে আপনারা প্রান্তিক মানুষের ওপর অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের শোষণ, অন্যায়-অবিচার ও দমনপীড়নের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যথা— পিতৃতন্ত্র, জাতপাত, বর্ণবৈষম্য ইত্যাদি। পুঁজিবাদ, গ্লোবাল ক্যাপিটাল, সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে, পিতৃতন্ত্র, জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমরা আপনাদের সহযোদ্ধা হিসেবে পেতে পারি এই আশাই করব।

গ্রন্থপঞ্জি

১. Karl Marx, Frederick Engels, Collected Works (Progress Publishers : Moscow). প্রাসঙ্গিক খণ্ডসমূহ।

২. Jonathan Culler, On Deconstruction : Theory and Criticism after Structuralism (Routledge : London, 1983).

৩. Michel Foucault, Power/Knowledge (Pantheon : New York. 1980).

৪. Christopher Norris, Derrida (Fontana : London, 1987).

৫. V. I. Lenin, What is to be Done? (Foreign Languages Publishing House : Peking, 1978).

৬. Mark Poster, Foucault, Marxism and History (Polity Press : Cambrige, 1985).

৭. Stephen K. White, Political Theory and Postmodernism (Cambridge University Press : Cambridge, 1991).

৮. Jacques Derrida, Of Grammatalogy (Motilal Banarasidass : Delhi, First Indian edition, 1994).

৯. Jean-François Lyotard, The Postmodern Condition : A Report on Knowledge (University of Minnesota Press : Minneapolis, 1993).

১০. Madan Sarup, An Introductory Guide to Post-structuralism and Postmodernism (Harvester Wheatsheaf : London, 1988).

১১. Michel Foucault, Discipline and Punish (Penguin : London, 1991).

১২. Jacques Derrida, Writing and Difference (Routledge : New York, 2001).

১৩. Jacques Derrida, Specters of Marx (Routledge : New York & London, 1994).

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *