মার্কসের রাষ্ট্রভাবনা

মার্কসের রাষ্ট্রভাবনা
সুদীপ্ত কবিরাজ

মার্কসবাদ ও রাষ্ট্রচিন্তা নিয়ে ভাবা শুরু করলেই একটা প্যারাডক্স চোখে পড়ে। এক অর্থে, বিপ্লবচিন্তা অর্থাৎ রাষ্ট্র কী ধরনের সংস্থা এবং তাকে ভেঙে নানাভাবে ধনতান্ত্রিক অর্থসংস্থানকে কীভাবে অপসারিত করে একটা নতুন অর্থব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করা যায় নিঃসন্দেহে এটাই মার্কসবাদী চিন্তার মূল প্রশ্ন। কিন্তু ভালভাবে দেখলে বোঝা যায় এই কথাটা সত্য হলেও বা সত্য বলেই হয়তো একটা অদ্ভুত খামতি মার্কসবাদের মধ্যে রয়েছে। যদি আমরা মনে করি ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা বৈষম্য তৈরি করে, বেশিরভাগ লোককেই শোষণ করে, বা অত্যাচার করে, সাধারণ লোকের সেই শোষণ বা অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণ লোকে সেটা করতে পারে না, কারণ রাষ্ট্রের শক্তি সেই অর্থব্যবস্থাকে রক্ষা করে; তাহলে ধনতন্ত্রকে ভাঙতে গেলে রাষ্ট্রকেও ভাঙা অথবা তাকে অচল করে দেওয়া প্রয়োজন। ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রকে ভাঙা বা ধ্বংস করা ভাবটাকে rhetorically ব্যবহার করার দিকেই মার্কসবাদী লেখকদের মনোযোগ ছিল অনেক বেশি। ভাঙার পর রাষ্ট্রকে নিয়ে কী করা যায় বা করা উচিত, বুর্জোয়া রাষ্ট্র ভাঙবার পরে নতুন কোনও রাষ্ট্র কীরকমের হতে পারে— এসব ব্যাপারে বিশাল মার্কসীয় দার্শনিক ইতিবৃত্তে খুব কমই কথা আছে। তাই একদিকে বিপ্লব ব্যাপারটা মার্কসবাদীদের কাছে অপরিসীম গুরুত্বের। আবার অন্য দিকে সেই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তার অত্যন্ত অভাব। রাষ্ট্র নিয়ে গভীর চিন্তার এই অভাব বা অপ্রতুলতা আমার বিশ্বাস মার্কসবাদের ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এই লেখায় আমি দেখবার চেষ্টা করব কী বিষয়ে মার্কসবাদীদের চিন্তা আছে আর কী বিষয়ে নেই।

প্রথমে আধুনিক জ্ঞানের একটি পদ্ধতিগত বৈশিষ্ট্যকে লক্ষ করা দরকার। আধুনিক চিন্তা সমাজ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করার সময় প্রথমেই পৃথিবীটাকে চিন্তা বা কল্পনা দিয়ে কেটে কয়েকটা ভাগে বিভক্ত করে নেয়। চিন্তকদের মধ্যে অন্য বিষয়ে যতই মতবিরোধ থাকুক, এই পৃথিবীকে কল্পনায় কেটে খণ্ড খণ্ড করার ব্যাপারে সবাই একমত। এই খণ্ডগুলোকে বলা হয় রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজনীতির জগৎ বা সংসার। আমাদের সাধারণ, স্বাভাবিক অভিজ্ঞতায় পৃথিবীর সঙ্গে এই চিন্তা দিয়ে তৈরি করা সংসারগুলোর কী সম্পর্ক? প্রাত্যহিক জীবনে আমরা একটা নিষ্কল সমাজের অভিজ্ঞতার মধ্যে থাকি। যদি আমাকে ডাকঘরে যেতে হয় সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে থাকে রাষ্ট্রের একটা বিভাগের সঙ্গে সম্পর্ক, একটা আর্থিক বিনিময় এবং সেই জায়গাটার ভেতরে লোকের ব্যবহারের সামাজিক অভিজ্ঞতা। আধুনিক সামাজিক জ্ঞানের প্রক্রিয়া এই তিনটে ব্যাপারকে তিনটি পৃথক বিষয়ের হাতে বিশ্লেষণ করার জন্য তুলে দেয়— রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও সমাজবিদ্যা। কিন্তু এই কাটাকাটি করার প্রয়োজন কেন? আধুনিক জ্ঞানতত্ত্বে মনে করা হয় জ্ঞানের জগতেও শ্রমের বিভাগ এবং বিশেষীকরণ করতে পারলে জ্ঞান সমৃদ্ধ, গভীর ও দৃঢ় হয়।

নিখিল নিসর্গকে বোঝার দায়িত্ব যেরকমভাবে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা ইত্যাদির মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া থাকে, সমাজকে বোঝার দায়িত্বও সেইভাবে এইসব সমাজসংক্রান্ত বিদ্যার মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। এই তিনটিকে তাই মানবসমাজের খণ্ড বা কলা বলা যেতে পারে। কিন্তু এই ধরনের খণ্ডন সাধারণ ব্যবচ্ছেদ বলতে যা মনে হয় সেরকম নয়। নৈসর্গিক জগৎও নিষ্কলভাবে আমাদের অভিজ্ঞতার কাছে জ্ঞাত হয়। কিন্তু তাকে ভাল করে বোঝাবার জন্যে তার ভৌতিক বস্তু ও তাদের সম্পর্ককে চিন্তা দিয়ে সেই পৃথিবী থেকে বিসৃষ্ট করে, এবং তারপর সেগুলোকে একত্র করে একটা ভৌতিক বস্তুতন্ত্রের সংসার তৈরি হয়। পদার্থবিদ্যা এই চিন্তা দিয়ে উদ্ভাবিত সেই ভৌতিক সংসারের সত্যকে সন্ধান করে। ঠিক একইভাবে উইলিয়াম পেটি ও তাঁর সমসাময়িক লেখকদের চিন্তার মধ্যে দিয়ে ‘অর্থনৈতিক’ জগৎ বলে একটা কল্পসংসার তৈরি হয়েছিল এবং পলিটিক্যাল ইকনমি বা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি বলে যে নতুন বিজ্ঞান সৃষ্টি হল সেটা সেই চিন্তা দিয়ে বিশ্লিষ্ট জগতের বিজ্ঞান। ক্রমশ এই সংসারটা রাষ্ট্র থেকে বিশ্লিষ্ট হয়ে একটা স্বতন্ত্র জগৎ বলে পরিচিত হল, আবার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দুটো পরস্পর বিশ্লিষ্ট জগৎ বলে কল্পনা করলে বাকি যেসব সামাজিক সম্পর্ক থেকে যায় তা অনেক সংকীর্ণ অর্থে ‘সমাজ’ বলে প্রতিভাত হলেও তার বিশিষ্ট বিজ্ঞান হিসেবে সোশিয়োলজি বা সমাজতত্ত্ব তৈরি হল। মার্কসের তত্ত্ব এই ধরনের বিশ্লিষ্ট সমাজকল্পকে ধরে নিয়েই ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি সম্পর্কে চিন্তা করেছে। তাই মার্কসের চিন্তায় ধরেই নেওয়া হয়েছে যে রাষ্ট্রশক্তি এবং ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি দুটো স্বতন্ত্র পদার্থ— যদিও তাদের মধ্যে ইতিহাসে সবসময়ই একটা গভীর সম্পর্ক থাকে। ইউরোপীয় চিন্তায় ক্রমশ একটা বিশাল ব্যবধান সৃষ্টি হতে দেখা যায়। হব্‌স্‌ ইত্যাদি প্রথম দিকের আধুনিক লেখকরা কেবলই রাষ্ট্রতত্ত্ব নিয়ে ভেবেছেন। ধনতন্ত্রের উত্থানের পর থেকে আবার অন্য এক ধারার চিন্তকরা অর্থনৈতিক তত্ত্ব নিয়েই ভেবেছেন। মার্কস এই দ্বিতীয় ধারার উত্তরসূরি। তাই তাঁর লেখায় অর্থনীতি নিয়ে যেরকম ব্যাপক, বিস্তীর্ণ এবং গভীর বিশ্লেষণ পাওয়া যায় রাষ্ট্রের ব্যাপারে তা নয়— বরং ছোটখাট বিকীর্ণ মন্তব্যের ওপরে আমাদের নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। এইজন্য পুরনো রাষ্ট্রতত্ত্বের প্রধান প্রশ্নটা মার্কসের লেখার মধ্যে বিশেষ কোনও গুরুত্ব পায়নি। আধুনিক পৃথিবী তৈরি হবার পিছনে দুটো বিরাট প্রক্রিয়ার কাজ আছে— তার একটা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি তৈরি হওয়ার; আর দ্বিতীয়টা আধুনিক সার্বভৌম রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার; ইতিহাসের দিকে তাকালে এখন মনে হয় এই দুটো প্রক্রিয়ার কোনওটাই প্রধান নয়— একটা অন্যটাকে প্রভাবিত করে, কিন্তু তার গতিকে নির্ধারিত করে না। রাষ্ট্রের দিকটা সম্পর্কে উপেক্ষাবশত মার্কসের নিজের চিন্তার মধ্যেই এক ধরনের একদেশদর্শিতা ছিল। অনেক মার্কসবাদী মনে করেন মার্কসের চিন্তা ‘theory of everything’— সর্বসত্যের তত্ত্ব। সেইভাবে চিন্তা করলে ধরে নিতে হয় মার্কসের রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা খুব কম হলেও সরস্বতী নদীর মতো কোনো অন্তঃসলিলা চিন্তার প্রবাহ তাঁর ভাবনার মধ্যে আমাদের আবিষ্কার করে নিতে হবে। আমার বিশ্বাস আমাদের এই ভ্রান্ত ধারণাকে বর্জন করে দেখা উচিত মার্কসের মধ্যে কোন বিষয়ের তত্ত্ব আছে এবং কোনটার নেই। যদি আমরা স্বীকার করে নিতে পারি যে মার্কসের চিন্তায় রাষ্ট্রতত্ত্বের অভাব আছে, তাহলে আরও ভাবতে হবে রাষ্ট্রের সঙ্গে আধুনিক সমাজের, বিশেষ করে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার, সম্পর্ক কী এ বিষয় আমরা কীভাবে চিন্তা করতে পারি।

একটা পুরো রাষ্ট্রতত্ত্ব মার্কসের মধ্যে না থাকলেও রাষ্ট্রের বিষয়ে তাঁর অনেক সংক্ষিপ্ত মন্তব্য ও বিশ্লেষণ আছে। তার থেকে আমরা কী ধরনের তাত্ত্বিক আলোর সন্ধান পেতে পারি? আমার পড়ায় মার্কস ধনতান্ত্রিক সমাজের রাষ্ট্র সম্পর্কে যে তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন সেই তত্ত্বের একটা ধারণা পাওয়া যায় লক-এর লেখায়। লক মনে করতেন আর্থিক সামর্থ্য মানুষের বুদ্ধির সার্মথ্যকে প্রতিফলিত করে। অর্থাৎ, যারা বাজারের আদানপ্রদানের মধ্যে ধনসঞ্চয় করতে পারে তাদের সেটা করতে পারার কারণ হল অন্য মানুষের থেকে তাদের বুদ্ধিসামর্থ্য (rationality) বেশি। তাই সমাজের আর্থিক বাঁধন সংক্রান্ত ক্রমোচ্চতা বিচারবুদ্ধির ক্রমোচ্চতাকেই নির্দেশ করে। ধনার্জনক্ষমতা এবং বিচারক্ষমতার মধ্যে এই ধরনের একটা সরল নির্ভরতার সম্পর্ক ধরে নিলে, লকের পরবর্তী যুক্তিগুলোকেও স্বীকার করা চলে। লক মনে করতেন আধুনিক রাষ্ট্র প্রাক্-আধুনিক মধ্যকালীন রাষ্ট্রর থেকে অনেক বেশি শক্তির অধিকারী। তাই সেই রাষ্ট্র না থাকলে যেমন আধুনিক ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি তৈরি হতে এবং চলতে পারে না, অন্য দিকে আবার এই দুর্নিবার্য রাষ্ট্রের শক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে রাখারও প্রয়োজন। নাহলে এই রাষ্ট্র সামাজিক উপকারের সাধন না হয়ে অত্যাচারের যন্ত্র হয়ে উঠতে পারে। তাই লকের মতে এই রাষ্ট্রক্ষমতাকে দু’রকমভাবে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস করা উচিত। প্রথমটা হল, সাধারণ সংস্কৃতির মধ্যে একটা কাল্পনিক ধারণা বা মিথ প্রচলন করা যে, শাসক ও শাসিতদের মধ্যে সম্পর্কটি কোনও ঈশ্বরপ্রদত্ত নিয়োগের মধ্য দিয়ে বা কোনও পাশবিক শক্তির মধ্য দিয়ে নয়, এই সম্পর্ক একটা গভীর স্তরে এক ধরনের চুক্তির মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত। রাজা-প্রজায় যদি একটা চুক্তির সম্পর্ককে সমাজ মেনে নেয় তাহলে সেই চুক্তিকে আরও স্পষ্ট এবং বিশদ করার জন্য একটা সংবিধান তৈরি করা যায়। এবং এও বলা যায় যে সাংবিধানিক নিয়মকে লঙ্ঘন করলে রাজাকে বা শাসককে পদচ্যুত করা যাবে। হব্‌স্‌-এর চিন্তার প্রধান কথা হল আধুনিক অর্থনীতির উপর বিধৃত যে-সমাজ তাতে একটা অপ্রতিহত সার্বভৌম ক্ষমতার উপস্থিতি প্রয়োজন। নাহলে সেই সমাজ অবিচ্ছিন্ন সংঘাতময়তার মধ্যে ডুবে যেতে থাকে। এক ধরনের অবিচ্ছিন্ন সামাজিক শান্তি না থাকলে আধুনিক সমাজের স্থিতি সম্ভব নয়। সেই সার্বভৌম শক্তি যে সমস্ত সমাজের উপরে, তার কোনও শ্রেণির উপরে বা কোনও ব্যক্তির উপরে অত্যাচার করতে পারে সেই ব্যাপারে হবসের কোনও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু লকের মধ্যে সেটাই রাজনীতি-চিন্তার একটা প্রধান বিষয়। লক যেমন এক দিকে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার অনিয়ন্ত্রিত ধনসঞ্চয়কে সমর্থন করেছেন তাঁর সম্পত্তির অধ্যায়ে, তেমনই অন্য দিকে এ কথাও বলেছেন যে, এই অর্থব্যবস্থার এক ধরনের সীমিত এবং দায়বদ্ধ শাসকের প্রয়োজন।১০ সেই সরকার কেবল সমাজের সঞ্চয়ী ধনিকশ্রেণির কাছেই জবাবদিহি করবে। তিনি আরও এগিয়ে গিয়ে এ কথাও বলেছেন যে, যদি শাসকরা সাংবিধানিক চুক্তিকে না মানে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অধিকার প্রজাদের আছে।১১ লকের চিন্তায় তাহলে শাসক, সমাজ ও প্রজাদের সম্পর্ক ঠিক কী ধরনের? লকের লেখার থেকে তাঁর এই বিষয়ে চিন্তার একটা ছবি তৈরি করে নেওয়া যায়।

শাসকদের সমাজের থেকে একভাবে যদি আলাদা করে নিয়ে সরকার বলে মনে করা যায়, তাহলে তাদের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক এই ধরনের। ধনবণ্টনের দিক থেকে ধরা যাক সমাজে কেবল তিনটি শ্রেণিবিভাগ আছে। পরে এতে মার্কসকে বোঝার সুবিধা হবে। কারণ মার্কসের লেখায় ধনতান্ত্রিক সমাজের অর্থনৈতিক ছবিটা এইরকমই। এই ধরনের রাষ্ট্রে শাসকদের উপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ রাখে সংবিধান। কিন্তু সংবিধানে রাজনৈতিক জীবনের কেবল খুব বড় ব্যাপারগুলো নিয়ে লেখা থাকে। তাতে কতকগুলো বিশাল আদর্শ এবং নীতির ঘোষণার বাইরে বিশেষ কিছু থাকে না। রাজনীতির যেসব প্রাত্যহিক বিষয় নির্ণয় বা নিশ্চয় করতে হয় সেগুলোকে সাংবিধানিক নীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন বা অসম্ভব। লকের মতে তাই শাসকদের একটা নির্বাচন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে শাসিতদের কাছে দায়বদ্ধ হওয়ার দরকার— যাতে নিয়মিতভাবে তাদের শাসিতদের কাছে জবান দিতে হয়। কিন্তু লকের মতে সমস্ত শাসিত লোকের কাছে তাদের কৈফিয়ত দেয়া বা দায়বদ্ধ থাকা ঠিক নয়। তাদের দায়িত্ব কেবল ধনিকশ্রেণির কাছে— তাই নির্বাচনের অধিকার সম্পত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া উচিত। তাই সমাজের একটা সংকীর্ণ ভাগকেই নাগরিক করা উচিত— কারণ তারা সেই সমাজের বা রাষ্ট্রের আইনকে মেনে চলে এবং সেই আইন তারাই সামূহিকভাবে তৈরি করে, অন্যরা কেবলই শাসিত— প্রজা— তারা আইনের আয়ত্তের মধ্যে, কিন্তু আইন তাদের আয়ত্তের মধ্যে নয়। লকের চোখে এই ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থাই আধুনিক অর্থনীতির উপরে বিধৃত সমাজে থাকা উচিত। মার্কস ঔচিত্যবিচারে লকের বিরোধী। কিন্তু তাঁর লেখা পড়লে মনে হয় ধনতান্ত্রিক সমাজের রাষ্ট্রব্যবস্থার ছবিটা তাঁর মনেও ঠিক একই ধরনের ছিল। মার্কস কখনোই মনে করতেন না যে ধনবৈষম্য বিচারশক্তির বৈষম্যকে প্রকাশ করে। কিন্তু তিনি মনে করতেন যে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রকৃতিটা এই ধরনের।

মার্কসের একেবারে অল্প বয়সের লেখা থেকে বোঝা যায় তিনি হেগেলের রাষ্ট্রতত্ত্বকে বিশেষ সমর্থনযোগ্য বলে মনে করেননি,১২ যদিও তিনি হেগেলের লেখা থেকে একটা অদ্ভুত ভাবনাকে তুলে নিয়ে সেটা একেবারে অন্যভাবে নিজের চিন্তায় ব্যবহার করেছিলেন। হেগেলের রাষ্ট্র-আলোচনা পড়লে মনে হয় তিনি যে ধরনের রাষ্ট্রকে সমর্থনযোগ্য বলে ভেবেছেন সেটা হল এক ধরনের লিবারাল সাংবিধানিক রাষ্ট্র, যার শাসনভার এক শ্রেণির আমলার হাতে থাকে, যারা প্রজাদের মধ্যে কোনওরকম বিভেদবুদ্ধি না ঘটিয়ে একেবারে নির্মম, নিরহংকার এবং নিরপেক্ষভাবে আইনকে জনগণের উপর প্রয়োগ করে। সমাজের অন্যান্য সব শ্রেণিরই তাদের নিজেদের শ্রেণিগত স্বার্থের প্রতি পক্ষপাত থাকে। কিন্তু ব্যুরোক্রেসি বা আমলাতন্ত্র তাঁদের সামূহিক স্বার্থবুদ্ধি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। হেগেল তাই তাদের বলেছেন সর্বজনীন শ্রেণি বা Universal class। কোনও একটা শ্রেণিকে সর্বজনীন বলার মধ্যে একটা আপাত দ্বন্দ্ব আছে।১৩ কারণ হেগেল মনে করতেন প্রত্যেক শ্রেণিরই কিছু বিশেষ শ্রেণিস্বার্থ থাকে। এবং তারা তাদের সামাজিক প্রয়াসের মধ্য দিয়ে সেই বিশেষ স্বার্থকে অনুসরণ করতে চায়। সেজন্যই আধুনিক লিবারাল সমাজের সমস্যা তৈরি হয়: সব ব্যক্তি এবং সব ধরনের সমষ্টিই যদি স্বার্থপরায়ণ হয়ে কাজ করে তাহলে এই ধরনের সমাজের যে সর্বজনীন অর্থ আছে তাকে কে অনুসরণ করবে? এবং তা যদি না হয়, তাহলে অনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও শ্রেণিসংঘাতের মধ্যে দিয়ে সেই সমাজ টিকবে কী করে? হেগেলের চিন্তায় এই সমস্যার একটা সমাধান হল আমলাতন্ত্র এবং তাদের নিঃস্বার্থভাবে সর্বজনীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা।১৪

হেগেলের এই চিন্তা তাঁর পরের দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায় বইতে থাকে। তাঁর সর্বজনীন শ্রেণির ধারণাকে আরও অনেকভাবে বিস্তৃত করে লিবারাল রাষ্ট্রের থিয়োরি তৈরি করেন মাক্স ভেবার। তাঁর চিন্তায় যে rational-legal (আইনসম্মত প্রভুত্বের) কর্তৃত্বের আলোচনা পাওয়া যায় সেটা স্পষ্টতই হেগেলের সংক্ষিপ্ত আলোচনার একটা বিশাল সম্প্রসারণ।১৫ মার্কস এই চিন্তাধারার সঙ্গে একেবারেই একমত ছিলেন না। কিন্তু তিনি হেগেল থেকে ‘Universal class’ কথাটা তুলে নিয়ে আমলাতন্ত্রের পরিবর্তে শ্রমিকশ্রেণি সম্পর্কে ব্যবহার করলেন। এই যুক্তিধারার সঙ্গে সম্পর্ক আছে মার্কসের সেই ধারণার যে, শ্রমিকশ্রেণি কেবল নিজেকেই স্বাধীন করবে তা নয়, তারা নিজেদের মুক্ত করার সঙ্গে সমাজের অন্যসব লোককেও মুক্ত করবে।১৬ তার অর্থ হল, অন্যান্য বিপ্লবের পরে এক ধরনের প্রভুত্বের পরিবর্তে অন্য আরেক ধরনের বা অন্য কোনও বিশিষ্ট গোষ্ঠীর প্রভুত্বের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের বিপ্লবের পরে অন্য কোনও শ্রেণির উপর কারও নতুন প্রভুত্ব সৃষ্টি হবে না। কিন্তু সেদিকে না তাকিয়ে মার্কসের রাষ্ট্রচিন্তায় ফিরে আসা যাক।

তত্ত্বের দিক থেকে দেখলে লক মনে করতেন ধনতান্ত্রিক সমাজের রাষ্ট্রের গঠনটা ওইরকম— এবং সেটা হওয়াই তাঁর মতে ঠিক। মার্কস অবশ্যই নৈতিক চিন্তার দিকে এই ধরনের রাষ্ট্রকে সমর্থনযোগ্য মনে করবেন না। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে তাঁর সঙ্গে লকের চিন্তার কোনও বিশেষ পার্থক্য নেই। অনেক ঐতিহাসিক আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, লকের সময়ে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি এমনকী ইংলন্ডেও বিশেষ বিকাশ লাভ করেনি। কিন্তু মার্কসের সময়ে সেই অর্থনীতির গঠনটাকে অনেক স্পষ্টভাবে দেখা গেল। এবং মার্কস তাঁর অর্থনীতির বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সেই অবয়বের মধ্যে নতুন একটা কথা যোগ করলেন। তাঁর ধারণা ছিল, ধনতান্ত্রিক আর্থিক প্রক্রিয়া এমন যে, মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে তা ক্রমাগত সংকীর্ণ করে তোলে। মধ্যবিত্তের মধ্যে এক সামান্য সংখ্যক লোক অর্থার্জন করে বুর্জোয়াশ্রেণিতে যোগ দেয়। কিন্তু বেশিরভাগ লোকই তাদের যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি আছে সেগুলো ক্রমশ হারিয়ে ফেলে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তাই শ্রেণিসংগ্রাম ক্রমশই গভীর এবং হিংসাত্মক হতে থাকে। সাধারণ লোকের বিক্ষুব্ধ ভাবনা সত্ত্বেও তাদের বশে রাখার জন্য রাষ্ট্রকে কাজ করতে হয়। একই ছবিকে মার্কস এবং লক দু’রকমভাবে দেখেছেন। লক মনে করেছেন এই রাষ্ট্র কিছু লোকের কাছে দায়িত্বের সম্পর্কে বদ্ধ। তাই একে সমর্থন করা উচিত। মার্কস মনে করেছেন যে এই রাষ্ট্রের প্রধান ঐতিহাসিক দায়িত্ব সাধারণ মানুষকে দমন করে রাখা। একটা নির্বাচনী সম্পর্ক রয়েছে বলে যেমন একে এক ধরনের প্রাথমিক গণতন্ত্র বলে দাবি করা যায়, আবার অন্য দিক থেকে কেবল বুর্জোয়াদেরই গণতন্ত্র, বা কেবল বুর্জোয়াশ্রেণির জন্যই এটা গণতান্ত্রিক, অন্যদের জন্য নয়— সে কথা বলাও অন্যায় নয়। মার্কস এই ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বুর্জোয়াশ্রেণির একনায়কতন্ত্র বলেছেন।১৭ তাই এই রাষ্ট্রকে যদি গণতান্ত্রিক আখ্যা দেওয়া হয়, তাহলে বলাই যেতে পারে যে গণতন্ত্র ব্যাপারটাই এই ধরনের বুর্জোয়া গণতন্ত্র। এবং এই গণতন্ত্র হচ্ছে একটা প্রতারণা, নাম ছাড়া এর মধ্যে গণতন্ত্রের সত্য কিছুই নেই।

এসব বলা সত্ত্বেও দুটো কথা আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন। হয়তো ontology of sphere-এ বিশ্বাসের জন্যই মার্কসের মধ্যে যে বিপুল প্রাচুর্যে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার আলোচনা আছে তার তুলনায় আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে বিশ্লেষণ বিশেষ কিছুই নেই। এ কথাটা অত্যন্ত প্রাথমিক হলেও স্পষ্ট করে বলা দরকার। নাহলে ‘সব কিছুর তত্ত্বের’ চাপে আমরা ভাবতে পারি পরিস্ফুটভাবে না হলেও কোনও ধরনের একটা রাষ্ট্রতত্ত্ব উহ্যভাবে মার্কসে আছে।১৮ সেই বিশ্বাস থাকলে মার্কসবাদীদের প্রয়াসটা চলে যাবে সেই ঘোষিত তত্ত্বকে উদ্ধার করার দিকে— অনুপস্থিত তত্ত্বকে তৈরি করার দিকে নয়। এই দুই বিশ্বাসের মধ্যে বিশাল ব্যবধান। আর এ কথাটা আমরা জানিই যে, মার্কসের নিজের লেখার মধ্যেও দু’রকমের চিন্তার চলন লক্ষ করা যায়। অনেকসময় মার্কস ধনতন্ত্রের শক্তিকে এতই বড় করে দেখেছেন যে মনে হয় তিনি ভাবতেন রাষ্ট্রকে আলাদা করে বিশ্লেষণ করবার কিছুই নেই। ধনতন্ত্রের গতি রাষ্ট্রকে যেদিকে ঠেলে নিয়ে যাবে রাষ্ট্র সেদিকে যেতেই বাধ্য। অর্থনীতির এইরকম একটা অপ্রতিহত নির্ধারণকারী শক্তিতে বিশ্বাসের ফলেই মার্কস রাষ্ট্রের ব্যাপারে কম জোর দিয়েছেন— তাও হতে পারে।

সম্প্রতি এতিয়েন বালিবার মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বের আরেকটা বড় সমালোচনা করেছেন— যদিও সেটা ব্যক্তিগতভাবে মার্কসের বিরুদ্ধে নয়। সমস্ত মার্কসবাদী সমাজদর্শনের বিরুদ্ধে। ফরাসি বিপ্লবে মানুষের যে মূল মুক্তির স্বপ্ন ছিল তার মধ্যে স্বাতন্ত্র্য ও সাম্যের আদর্শ একেবারে অবিচ্ছিন্নভাবে সম্পৃক্ত হয়ে থাকার কথা। কিন্তু এক দিকে ইউরোপের পরবর্তী কালের লিবারাল চিন্তা কেবল স্বাধীনতার উপরে এবং উলটো দিকে সমাজবাদী চিন্তা কেবলই সাম্যের উপরে জোর দিতে থাকে। ফলে ফরাসি বিপ্লবের যে মুক্তির চিন্তা ছিল তার সত্যটা দুটো অর্ধসত্যের মধ্যে বিভাজিত হয়ে গেল। এবং মার্কসবাদীরাও তাঁদের দিক থেকে এই বিভ্রান্তিটাকে স্বীকার করলেন যে স্বাতন্ত্র্য এবং সাম্যের মধ্যে সম্পর্ক সততই বিভেদের। স্বাতন্ত্র্যকে ভাল করে ভোগ করতে গেলে সাম্যকে খানিকটা ছেড়ে দিতেই হয়। আর অন্য দিকে সাম্য সৃষ্টি করতে গেলে স্বাতন্ত্র্যকে বর্জন না করে কোনও উপায় নেই। এইভাবে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে মানুষের স্বাধীনতার একটা শত্রুতার সম্পর্ক তৈরি হওয়াতে, কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের স্বৈরতন্ত্র এবং একক নেতৃতন্ত্র তৈরি করে নিতে সুবিধে হয়ে গেল। স্তালিন, মাও সমস্ত বড় কমিউনিস্ট নেতাই শেষপর্যন্ত বিপ্লবের পরে এক ধরনের স্বৈরতন্ত্র এবং স্বেচ্ছাচারী আমলাতন্ত্রের মিশ্রণ সৃষ্টি করে তাদের সমাজগুলোকে শাসন করে গেছেন। যখন এসব সমাজে অর্থনৈতিক বিকাশ বন্ধ হয়ে গেছে তখন এইসব সমাজের জনগণই শাসনব্যবস্থাকে অবিমিশ্র অত্যাচার বলে মনে করে সেগুলোর পতন ঘটিয়েছে। যারা সমাজতন্ত্রের পক্ষে তাদের বিশেষ করে মনে রাখা উচিত যে, কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো জনগণের বিদ্রোহেই নষ্ট হয়েছে, কোনও প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্রের ফলে নয়। এবং আমলাতন্ত্রের যেটা প্রধান লক্ষ্য— নির্বিচারে সমস্ত নাগরিককে সমানভাবে দেখা, হেগেল ও ভেবারের লেখায় যা পাওয়া যায়, সেটা এই ধরনের সমাজে সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত ছিল। তাই সেই সমাজের সাধারণ মানুষ এবং প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা তাকে অসাম্যের এবং অত্যাচারের ব্যবস্থা বলে বর্জন এবং প্রতিরোধ করেছে। কিন্তু অন্যান্য সমাজের সমাজতন্ত্রী বুদ্ধিজীবীরা— যাদের স্তালিনের শাসনে বাস করতে হয়নি— তাকে সামাজিক স্বর্গ বলে প্রচার করেছেন। এই প্রচারের ফলে সোভিয়েত রাশিয়া বা চিনের মানুষের মধ্যে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে কোনও প্রেমের সঞ্চার ঘটেনি। কেবল তাদেরই নিজেদের অনবহিত রেখে নিজেদেরই মন ভোলানোর একটা ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। তাই আমি মনে করি আমাদের বালিবার-এর কথাটা স্বীকার করে নিয়ে চেষ্টা করা উচিত সমাজ সম্পর্কে চিন্তা করার সময় যাতে স্বাধীনতা ও সাম্যকে বিরোধী আদর্শ বলে মনে করা না হয়।

মার্কস নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন, ধনতন্ত্রের একটা অনপনেয় মৌলিক অবয়ব থাকলেও ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি অনেকসময় গভীরভাবে পরিবর্তিত হয়— যেমন তিনি ভেবেছিলেন তাঁর সময়েই ব্যবসায়ী ধনতন্ত্র থেকে পরিবর্তিত হয়ে ধনতন্ত্র একটা শিল্পতন্ত্রের রূপ নিচ্ছে। তাই এই নতুন ধনতন্ত্রকে আবার নতুন করে বিশ্লেষণ করার এবং বোঝার প্রয়োজন আছে। আমার চোখে মার্কসের চিন্তার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য তার ঐতিহাসিকতা, যেকোনও বিষয়ে চিন্তা করার সময় তার কালসাপেক্ষ বিবর্তন সম্পর্কে সচেতন থাকার প্রচেষ্টা। তাই ধনতন্ত্র সম্পর্কে মার্কসের ক্যাপিটাল একটা আবয়বিক ছবি তুলে ধরলেও সেই অবয়ব যে কালক্রমে পালটে যায় এবং কীভাবে পালটায় সেটাকে বোঝাবার চেষ্টা করা ধনতন্ত্র অধ্যয়নের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সেই কারণে আশ্চর্যের ব্যাপার যে, মার্কসীয় দর্শন রাষ্ট্রের বিষয়ে এই কালিক বিবর্তনের ব্যাপারটাকে একেবারে অগ্রাহ্য করে চলে। মার্কসীয় লেখকদের লেখা পড়লে মনে হয় ধনতন্ত্রের অর্থনৈতিক আকৃতি গভীরভাবে বার বার পরিবর্তিত হলেও ‘ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ কখনও পরিবর্তিত হয়নি। এবং তার প্রকৃতিকে একটা ছবিতেই চিরকালের জন্যে বেঁধে ফেলা যায়। এবং মার্কসই সেই ছবি এঁকে আমাদের জন্যে দিয়ে গেছেন। আমাদের দেশের ভাষায় বললে, আধুনিক রাষ্ট্র বুর্জোয়াশ্রেণির একটা খাপ পঞ্চায়েতের মতন করে চলে— সেটা তাদের executive committee। আমাদের আর রাষ্ট্রকে নতুন করে এবং আলাদা করে বোঝার জন্য পরিশ্রম করার প্রয়োজন নেই। আমি আগেই বলেছি, মার্কস যদিও রাষ্ট্রের ব্যাপারে বিশেষ গভীরভাবে তাত্ত্বিক চিন্তা করেননি তাহলেও তার যে প্রতিকৃতি তাঁর মনে ছিল সেটা সেই সময়ের পক্ষে ভুল নয়। লকের আলোচনায় যে ধরনের রাষ্ট্রের কল্পনা দেখা যায় মার্কস সেই সময়ের পক্ষে তাকেই সেই সমাজের বুর্জোয়া রাষ্ট্রের প্রকৃত ছবি বলে মনে করতেন। এবং ঐতিহাসিকভাবে সেই ধারণা ঠিক ছিল। সমস্যা শুরু হল এই রাষ্ট্রশক্তির বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। হেগেল থেকে শুরু করে তকভিল, মার্কস সকলেই আধুনিক সমাজের কাঠামোগুলো সম্পর্কে একটা সাধারণ সত্য বার বার বলেছেন। আধুনিক ইতিহাসে দেখা যায় মানুষ সামাজিকভাবে তাদের নিজেদের সামাজিক কাঠামোগুলোকে ইচ্ছানির্দিষ্টভাবে পরিবর্তন করতে চেষ্টা করে। রাজনৈতিক বিপ্লবগুলো তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। বিপ্লবের উদাহরণ থেকেই বোঝা যায় তারা যা ইচ্ছা করে, বা ঠিক যেরকম পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে তা সবসময় হয়ে ওঠে না। কিন্তু সমাজের অবয়ব কোনও একটাভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই ধরনের স্বাভিমুখী (reflective) পরিবর্তন আধুনিকত্বের একটা বিরাট চিহ্ন। এই ধরনের প্রক্রিয়ার ফলে আধুনিকত্বের আকৃতি বা অবয়ব সবসময়েই পালটাতে থাকে— তার এই সতত পরিবর্তনের জন্যে যেকোনও আধুনিক ব্যবস্থাকে ফটো তোলার মতো একটা প্রতিচ্ছবির সত্যে আবদ্ধ করে ফেলা কঠিন। এই বারংবার পরিবর্তমান বাস্তবকে বারংবার সত্য হিসেবে জানতে হয়। উপমা দিয়ে বলা যায়, মার্কসবাদী সমাজদর্শনের একটা বড় সমস্যা হল যে এর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের দুটো চাকা আছে— অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক। অর্থনৈতিক চাকাটা খুবই ভাল চলে। আর রাজনৈতিক চাকাটা চলে না। এবং যথা হি একেন চক্রেন রথস্য গতির্ভবেৎ, সেইরকম এক দিকের বিশ্লেষণ বন্ধ থাকায় তত্ত্বগত জ্ঞান বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।

ধনতন্ত্রের মতো রাষ্ট্রতন্ত্রেরও যদি পরিবর্তন হয় তাহলে মার্কসীয় বিশ্লেষণ কোন দিকে যাওয়া উচিত আমরা ভাবতে পারি। ইতিহাস আলোচনা করলে স্বীকার করতেই হয় যে, আধুনিক ইউরোপের রাষ্ট্রের কতকগুলো গভীর পরিবর্তন হয়েছিল। তার প্রথমটা হল যখন প্রাগাধুনিক সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরে প্রথম রাজতান্ত্রিক সার্বভৌম রাষ্ট্র তৈরি হল। সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার অনেক কেন্দ্র থাকত। সার্বভৌম রাষ্ট্রে ক্ষমতার কেন্দ্র একটাই— রাজশক্তি। তার অনেক দিন পরে দেখা গেল রাজারা নিজেদের এককভাবে দেশের সামূহিক ক্ষমতার প্রতিভূ বলে উপস্থাপন করেছেন। চতুর্দশ লুই যেমন এক দিকে বলেন— ‘রাষ্ট্র কে? সে তো আমিই’, তেমনি অন্য দিকে তিনি এও দাবি করেন যে, তাঁর ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য্যের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে কেবল একজন ব্যক্তির ভোগলালসা নয়, গোটা ফ্রান্স দেশটির এবং ফ্রান্সের জনগণের মহত্ত্ব। তার পরের ধারণা জাতীয়তার চিন্তা প্রবল হওয়াতে রাজার সার্বভৌমত্বের বদলে জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণা ক্রমশ প্রচলিত হল। এইসমস্ত পরিবর্তনের ফলে সরকারের দায়িত্ব একটা সংকীর্ণ ধনিকশ্রেণির কাছে না হয়ে সমস্ত সাধারণ মানুষের কাছে— এই ধারণাটা ক্রমেই ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হল। এর মধ্যে দিয়েই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সূচনা হল। এই রাষ্ট্রের প্রকৃতি পূর্ববর্তী লকীয় সাংবিধানিক রাষ্ট্রের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ব্যবসায়ী ধনতন্ত্র ও শিল্পের ধনতন্ত্র যেরকম স্বতন্ত্র, এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্যও সেইরকমই গুরুত্বপূর্ণ। এই দ্বিতীয় স্তরের রাষ্ট্রকে প্রথম স্তরের রাষ্ট্রের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চিন্তার এক বিরাট প্রমাদ উপস্থিত হয়। আমি অন্য লেখায় বলেছি যে, মার্কসবাদী চিন্তার মধ্যে রাষ্ট্রের বিবর্তনের যে-দুটো স্তর আছে তাকে অস্বীকার করার জন্য মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরা প্রধানত অনৈতিহাসিকভাবে একটি একক রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক ছবি তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। করতে গিয়ে অনেকেরই মনে হয়েছে নতুন করে একটা তত্ত্বকে ভাবার দরকার নেই, কারণ মার্কসের লেখার মধ্যে, সংক্ষিপ্ত এবং অস্পষ্টভাবে হলেও, রাষ্ট্রতত্ত্ব এবং গণতন্ত্রের একটা সমালোচনাও রয়েছে। সেই সংক্ষিপ্ত এবং অসম্পূর্ণ তত্ত্বকে সম্পূর্ণ করে নিলেই আমাদের ধনতন্ত্র ও রাষ্ট্রের সম্পর্ককে বোঝবার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে— এই ভাবনার ফলে বিবর্তমান অর্থনীতি এবং বিবর্তনহীন রাষ্ট্রশক্তি নিয়ে একটা তাত্ত্বিক গোলযোগ তো হয়ই, কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, ধনতন্ত্রের ইতিহাসের দ্বিতীয় স্তরে যে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ক্রমশ তৈরি হল, তার বিশেষ কোনও নতুন তত্ত্ব তৈরি হল না। বরং মার্কসবাদীদের মধ্যে একটা গণতন্ত্রবিরোধী চিন্তা ক্রমশই প্রসারিত হয়ে গেল, যার ফলে অনেক ক্ষেত্রে দেখি যে মার্কসবাদী চিন্তা ও ফ্যাসিবাদী কার্ল স্মিট-এর লেখার যুক্তির মধ্যে কোনও তফাত নেই। অথচ এই নতুন ধরনের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যে বাস্তবে সত্য এবং ইতিহাসে কার্যকর তার নিদর্শন আমাদের চারদিকে ছড়ানো আছে। তার সবথেকে বড় প্রমাণ হল ধনতন্ত্রের চেহারার পরিবর্তন।

এককালে একটা বিরাট আলোচনা হয়েছিল self-fulfilling prophecy-র ব্যাপারে।১৯ মার্কসবাদীরা মার্কসবাদ বৈজ্ঞানিক সত্য বলে দাবি করতেন বলে তার বিরুদ্ধে একটা তর্ক অনেকে তৈরি করেছিলেন যে, কোনও ধারণা বা বিশ্বাস অসত্য হলেও তা ইতিহাসকে পরিবর্তিত করার ক্ষমতা রাখে। তারও পরে মার্কিন সমাজতাত্ত্বিক মারটন-এর একটা বিখ্যাত লেখা ছিল— ‘The self-fulfilling prophecy’, যাকে বলা যায় স্বয়ংসাধিত ভবিষ্যৎ বিচার, অর্থাৎ, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে কথাটা বলা হচ্ছে সেটা যদি পর্যাপ্ত সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করে নেয় এবং সেই বিশ্বাসের বশে কাজ করে তাহলে সেই ভবিষ্যৎ বিচার ঘোষণার সময়ে মিথ্যা হলেও সেটি বাস্তবে সাধিত হয়ে উঠতে পারে। যে কথাটা বলার সময় অসত্য ছিল সমাজে বিশ্বাসের শক্তির দ্বারা চালিত হয়ে সেটা ইতিহাসে সত্য হয়ে ওঠা সম্ভব। এর উত্তরে সহজেই দেখানো যায় যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনও বিচারের ক্ষেত্রে ঠিক এর উলটোটাও হওয়া সম্ভব,২০ যে প্রক্রিয়াকে আমরা self-falsifying prophecy বলতে পারি। আমি যদি মনে করি যে আমার স্নানঘরে একটা বয়লার আছে, এবং সেটা পুরানো হয়ে তার বাইরের লোহার চাদরটা কমজোর হয়ে এসেছে— এবং একটা-দুটো বিশেষ জায়গায় সেটা ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা; যদি আমি ওই ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি এবং কিছুই না করি তাহলে অবশ্যই কিছু দিন পরে বয়লারটা ফেটে গিয়ে প্রমাণ হবে যে সেই ভবিষ্যতের বিচারটা সত্য ছিল। কিন্তু কোনও সমাজের অস্তিত্ব নিয়ে কেউ একটা ভবিষ্যৎ বিচার করলে মানুষ তার উপরে কোনও কাজ না করে চুপ করে বসে থাকবে সেটা ভাবাও অস্বাভাবিক। তাই আমি যদি চিন্তিত হয়ে কোনও বিশেষজ্ঞকে ডেকে পাঠাই, তিনি হয়তো এসে বলবেন ওই দুটো জায়গায় আপনি একটা তাপ্পি লাগান। তাহলে হয়তো বয়লারটা ফাটবেই না। অথবা শেষপর্যন্ত ফাটলেও ফাটবে অন্য কোনও জায়গায়, ওই দুটো জায়গায় নয়। আমার মনে হয় মার্কসের চিন্তার ফলে ইতিহাসে দু’ধরনের প্রক্রিয়াই শুরু হয়েছিল। যার একটা স্বয়ংসাধিত প্রক্রিয়া অন্যটাকে বলা যায় স্বয়ংবাধিত— যেটা নিজের সাধিত হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে থাকে। স্বয়ংসাধিত হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে বিংশ শতাব্দীর বিপ্লবগুলো সাধিত বা সফল হয়েছে। আবার এ কথাও খেয়াল করা উচিত যে, স্বয়ংসাধিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উনিশ শতকের ধনতন্ত্র ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে অনেক কম হিংসার বিনিময়ে এমন এক আর্থিক প্রক্রিয়ার রূপ নিয়েছে— যার বহিঃপ্রকাশ হল কল্যাণ রাষ্ট্র। এই ধনতন্ত্রে ধনিকদের নিজেদের ভোগগুলোকে রুধিরপ্রদিগ্ধ বলে মনে করে দুঃখ পেতে হয় না।

কিন্তু উনিশ শতকের রক্তলিপ্ত ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি বিংশ শতাব্দীর কল্যাণ-রাষ্ট্রে পরিবর্তিত হল কী করে? সেটার কারণ নিশ্চয়ই এই নয় যে, বুর্জোয়াশ্রেণি ক্রমশ নিজেদের শোষণজনিত পাপকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে, নৈতিকভাবে অনুতপ্ত হয়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পরিবর্তিত করেছিল। বরং মনে হয় তার কারণ ছিল নতুন ধরনের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। জার্মানিতে বিসমার্কের সময় থেকেই ক্রমশ ধনতান্ত্রিক সমাজগুলো সর্বজনীন নির্বাচনের দিকে এগোতে শুরু করেছিল। শেষপর্যন্ত ১৯৩০-এর দশক থেকে ধাপে ধাপে সারা ইউরোপের সর্বসাধারণের হাতে নির্বাচনী অধিকার এসে পৌঁছাল। মার্কস নিজেই ভেবেছিলেন যে ধনতান্ত্রিক সমাজে যেহেতু শ্রমিকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের হাতে যদি নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে শাসনক্ষমতা এসে পৌঁছায়, তারা নিশ্চয়ই ক্রমশ সমাজতান্ত্রিক পার্টিগুলোকে নির্বাচন করবে এবং এইসব সমাজতন্ত্রী সরকার ইউরোপে ধনতন্ত্রকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা তৈরি করে তুলবে। এঙ্গেলস অবশ্য ১৮৯৫ সালে একটা লম্বা ভূমিকায় অন্য একটা নৈরাশ্যজনক সম্ভাব্য ঐতিহাসিক পথের কথা বলেছিলেন।২১ নির্বাচনের অধিকার পাওয়ার পরে সাধারণত জনতা যখন সমাজতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতায় আনার উপক্রম করবে তখন বুর্জোয়া শাসকশ্রেণি নিজেদের অর্থতান্ত্রিক আধিপত্য বজায় রাখবার জন্য গণতান্ত্রিক শাসনকে ধ্বংস করে একেবারে প্রত্যক্ষ বুর্জোয়া স্বৈরাচারকে প্রতিষ্ঠিত করবে বলেই তাঁর মনে হয়েছিল। ধনতন্ত্রের সৃষ্টি করা অসাম্য আর গণতন্ত্রের সৃষ্টি করা সাম্যের প্রক্রিয়া একসঙ্গে চলতে পারে না।

শেষপর্যন্ত ইউরোপে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাসে এই দুটো সম্ভাব্য পথের মধ্যে কোনওটাই ঠিক অনুসৃত হয়ে ওঠেনি। যেটা শেষে ঘটল তা হল, সাধারণ লোক নির্বাচনী অধিকার এমন কৌশলে ব্যবহার করতে শিখল যে ক্রমশই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো আইনের মধ্যে দিয়ে প্রাথমিক ধনতন্ত্রের অসাম্যকে অনেকটাই পরিমিত এবং নিয়ন্ত্রিত করে শেষে কল্যাণ-রাষ্ট্রের একটা পরিচিত চেহারা তৈরি করতে পেরেছিল। যে রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের এবং শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থে এতটাই করতে পেরেছিল, তাকে কেবল নিষ্ক্রিয়, অক্ষম এবং বুর্জোয়াশ্রেণির কমিটি বলে কী করে দেখা যায়? অর্থনীতিতে বুর্জোয়াদের প্রাধান্য বজায় থাকল ঠিকই। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্যে রাষ্ট্রটা ক্রমশই ধনিকদের রাষ্ট্র থেকে এক অর্থে সাধারণ মানুষের রাষ্ট্রে পরিণত হল পশ্চিম ইউরোপে। কালক্রমে বুর্জোয়াশ্রেণির এবং ধনতন্ত্রের চরিত্রও অনেক পরিবর্তিত রূপ নিয়েছে।

অন্য দিকে রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপে যেখানে রাষ্ট্রের এই দ্বিতীয় স্তরে বিবর্তন হল না সেখানে লেনিনের মতো মার্কসবাদীরা স্থির করলেন যে, এঙ্গেলসের কথাই ঠিক— বুর্জোয়া রাষ্ট্র কখনও গণতন্ত্রে উত্তীর্ণ হতে পারবে না। বুর্জোয়া গণতন্ত্র একেবারেই সত্য নয়, প্রতারণা মাত্র। সমাজতন্ত্রে যারা বিশ্বাসী তাদের সঙ্গে লিবারালদের কোনওরকম মতৈক্য নেই। কোনও আদর্শই তাদের মধ্যে এক বা সমাপতিত নয়। এই পন্থার মার্কসবাদের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি হল এই মনে করা যে গণতন্ত্র ব্যাপারটাই একটা বুজরুকি। সাধারণ লোককে ধোঁকা দেওয়ার ব্যবস্থা। তাই সমাজতন্ত্রীদের দায়িত্ব হচ্ছে যেকোনওভাবে গণতন্ত্রকে বিধ্বস্ত করে নিজেদের অপ্রতিহত আধিপত্য তৈরি করা।

এই বিশ্বাসের ফলে মার্কসবাদের এই প্রস্থানের মধ্যে কোনও বিশদ রাষ্ট্রতত্ত্ব তৈরি হয়নি। যে ব্যাপারটা অসত্য, একেবারেই নেই, তার আবার তত্ত্ব হবে কী করে— কোনও একটা তত্ত্ব যদি উপস্থিত থাকে তবেই সেই তত্ত্বটা কী ধরনের, অর্থাৎ তার তত্ত্ব কী সেই কথা উঠতে পারে। লেনিনীয় চিন্তা সমাজতান্ত্রিক বা মার্কসবাদী রাষ্ট্রতত্ত্বের বিকাশকেই বাধা সৃষ্টি করে তৈরি হতে দেয়নি। তাই আমার ধারণা মার্কসবাদে অন্তত এক দিক দিয়ে রাষ্ট্রচিন্তার বিশেষ অভাব আছে। ফেডেরালিস্ট পেপার্স-এর মতো কোনও প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা মার্কসবাদী লেখায় অনুপস্থিত।

কিন্তু এটাই মার্কসীয় রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে শেষকথা হতে পারে না। আমার উপরের বক্তব্যের বিরুদ্ধে কেউ বলতেই পারেন যে, তাহলে যে বিশাল মার্কসবাদী রাষ্ট্রবিশ্লেষণের ধারা আছে, তার কী হবে? তার কি কোনও মূল্য নেই? সেটা কি আমাদের রাষ্ট্রকে বুঝতে সাহায্য করে না? অবশ্যই এই ধরনের দাবি করার আমার ইচ্ছে নেই। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাকে একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে যে মার্কস থেকে ফুকো পর্যন্ত যে বিশাল বিদ্রোহী রাষ্ট্রচিন্তার ঐতিহ্য আছে, তার একটা অনপনেয় প্রভাব দেখা যায় সমস্ত আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বের ওপরে। আজকাল একেবারে পাঠ্যপুস্তকের রাষ্ট্রচিন্তা দেখলেও দেখা যাবে যে, তার একটা অংশ হেগেল থেকে যে-ধারা মাক্‌স ভেবারের মধ্যে দিয়ে বিস্তৃত হয়েছে তার থেকে নেওয়া, আর অন্য একটা অংশ এসেছে মার্কস থেকে গ্রামশি এবং ফুকোর মধ্যে দিয়ে। আজকে কোনও লিবারাল লেখকও মনে করতে পারেন না যে এই বিরোধী চিন্তার যে-‘দুসরী’ পরম্পরা তার রাষ্ট্রবিশ্লেষণের মধ্যে কোনও সত্য নেই।

এর একটা অদ্ভুত ফল দেখা যায় সাধারণ রাষ্ট্রতত্ত্বের ক্ষেত্রে। ধনতন্ত্রবিরোধী যে মার্কসীয় রাষ্ট্রচিন্তা সেই বিশ্লেষণের ধারা আসলে লিবারাল– বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বিশ্লেষণকেই অনেক সূক্ষ্ম করে তুলেছে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আজ কোনও রাজনীতির তাত্ত্বিকের পক্ষে বলা শক্ত যে, কোনও সমাজে গণতন্ত্রের প্রকৃতি বুঝতে গেলে তার সংবিধান পড়লেই হবে। তার আইনের ব্যবস্থা থেকেই সেই গণতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে কীভাবে কাজ করে তাকে আমরা ঠিকমতো বুঝতে পারব। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের, মহিলাদের এবং অন্যান্য অনেক ধরনের তথাকথিত অন্ত্যজ মানুষদের সামাজিক ব্রাত্যত্ব তাদের সংবিধানে লেখা নেই। আমাদের গণতন্ত্রেও সংবিধান বা আইন পড়লে কেবল সর্বজনীন সাম্যের ঘোষণাই চোখে পড়বে। কিন্তু সামাজিক সত্য সব গণতন্ত্রতেই সংবিধান থেকে অন্যরকম। এই সত্যকে এখন কোনও গণতন্ত্রবিদের পক্ষেই অস্বীকার করা সম্ভব না— প্রধানত মার্কসীয় রাষ্ট্রচিন্তার প্রভাবে।

কিন্তু এতে মার্কসবাদী রাষ্ট্রচিন্তার অন্য আরেকটা দিকে বিশেষ কোনও সুবিধে হল না। সেটা বিপ্লবের পরে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গঠন কীরকম হবে সেই প্রশ্নে। যতদিন মার্কসবাদীরা ক্ষমতায় আসীন নয়, যতদিন রাষ্ট্রের চরিত্র হল ধনতান্ত্রিক ও লিবারাল, ততদিন মার্কসবাদীরা একটা গভীর এবং ক্রিটিক্যাল রাষ্ট্রতত্ত্বকে বিকাশ করতে পারে। কিন্তু সেই মার্কসবাদী দলই যদি ক্ষমতা অধিকার করতে পারে, তাহলে তাদের এক ধরনের অদ্ভুত তত্ত্বসংকট শুরু হয়। তার কারণ হল মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরা অনেকেই লিবারাল রাষ্ট্রকে এতই গর্হিত ব্যাপার বলে প্রমাণ করতে তৎপর হন যে তাতে মনে হয়, ক্ষমতা তাদের হাতে এলে ওইরকম Imperfect রাষ্ট্রযন্ত্রকে কেন বজায় রাখা হবে। কিন্তু লিবারাল রাষ্ট্রকে যদি বর্জন করে ভেঙে ফেলা হয় তাহলে তার জায়গায় কী ধরনের রাষ্ট্র বা সরকার তৈরি করা হবে, সে বিষয়ে মার্কসবাদী চিন্তার ঐতিহ্যের মধ্যে প্রায় কিছুই নেই। আমার ধারণা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের যদি আবার পৃথিবীতে প্রভাব ফিরে পেতে হয়, তাহলে এই অভাবটা নিয়ে চিন্তা করা এবং তাকে দূর করা প্রথম প্রয়োজন। মার্কসের ‘গোথা প্রোগ্রাম’-এর সমালোচনায় কতগুলো অত্যন্ত ব্যাপক, বিমূর্ত আদর্শের উত্থাপন মাত্র পাওয়া যায়।২২ লেনিনের লেখায় এক দিকে সোভিয়েত সম্পর্কে কিছু স্বপ্নাবিষ্ট (ইউটোপিয়ান) কথা এবং রাষ্ট্রের অবসানের এক ধরনের অলীক এবং অবিমর্শী ঘোষণা আছে২৩ যাতে রাশিয়ার লোকের শেষপর্যন্ত কোনও সুবিধে হয়নি। সোভিয়েত রাষ্ট্র আর যাই হোক সোভিয়েত প্রথায় চলত না। গ্রামশি-র লেখার মধ্যেও নতুন একটা ব্যবস্থার আহ্বান আছে কিন্তু তার কোনও স্পষ্ট ছবি নেই। তার কারণ লিবারাল চিন্তার একটা দিক আছে যেটাকে মার্কসবাদীরা কখনও বিশেষ পাত্তা দেননি।

আধুনিক জগৎকে সৃষ্টি করবার পিছনে দুটো বিশাল প্রক্রিয়া কাজ করে— তার একটা ধনতান্ত্রিক অর্থতন্ত্রের অন্যটা আধুনিক রাষ্ট্রতন্ত্রের। লিবারাল চিন্তার ধনতন্ত্রের ব্যাপারে লক্ষ্য কম। তার অভিনিবেশ পুরোটাই রাষ্ট্রের ব্যাপারে। লিবারাল দার্শনিকরাই ভাল করে বোঝবার চেষ্টা করেছেন আধুনিক রাষ্ট্র বস্তুটা কী— এবং তার ক্ষমতাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যায়। কিন্তু লিবারাল দর্শনের প্রভাবে গণতান্ত্রিক বিপ্লবীরা অনেকসময় এ কথাও ভেবেছেন যে, রাষ্ট্রশক্তি যদি সম্পূর্ণ আমাদেরই করায়ত্ত হয়, তাহলে সেই শক্তিও অত্যাচারী হয়ে উঠতে পারে। তাই সেই রাষ্ট্রের উপরেও সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণের একইরকম প্রয়োজন আছে। এই ধরনের চিন্তা ফরাসি বিপ্লবের সমসাময়িক লেখক কন্দর্সে (Condorcet)২৪–র মধ্যে পাওয়া যায়— এবং এই চিন্তার সবথেকে বড় উদাহরণ আমেরিকার ফেডেরালিস্ট পেপার্স।২৫ বুর্জোয়া বিপ্লবের পরেও রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্যে ফেডেরালিস্ট যেভাবে কাজ করে, সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় তার কোনও সমান উদাহরণ নেই। সমাজতন্ত্রীরা রাষ্ট্রকে অধিকার করতে চান, নিয়ন্ত্রণ করতে নয়। বরং কোনও ব্যাপারে কোনও প্রকাশ্য, সোজাসাপটা এবং সত্যই খোলামেলা আলোচনা হোক এ কথা বললেই লেনিন থেকে মাও পর্যন্ত সব বিপ্লবী নেতাই তাকে প্রতিবিপ্লবী ধারণা বলে সমালোচকদের পার্টি থেকে, সোভিয়েত-চিন হলে ইহলোক থেকেই, বহিষ্কৃত করতে চাইবেন।২৬ রোগ, জরা, আঘাত এবং আততায়ীর হাতে নিধন ছাড়া সমাজতান্ত্রিক নেতৃত্বকে পরিবর্তিত বা অপসৃত করার কোনও উপায় নেই। সাম্প্রতিক ইতিহাসকে দেখে আমাদের স্বীকার করা উচিত যে লেনিনের রাশিয়া, মাও-এর চিন, হো চি মিনের ভিয়েতনাম এবং কাস্ত্রোর কিউবা সব জায়গাতেই যে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ভেঙে গেছে তার একটা কারণ সেই অর্থতন্ত্রগুলো উৎপাদনক্ষমতায় ধনতন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠেনি। দ্বিতীয় কারণ তাদের রাষ্ট্রতন্ত্রগুলো ক্রমশই সাধারণ মানুষের সঙ্গে অনন্বিত এক অত্যাচারী শাসনব্যবস্থা হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় কারণটার পিছনে কারণ হল মার্কসীয় দর্শনে রাষ্ট্রচিন্তার অভাব।

এই অভাবকে স্বীকার করলে তাকে দূর করার চেষ্টা করা যায় দু’ভাবে। প্রথমটা হল সমাজতান্ত্রিক অর্থতন্ত্রের সঙ্গে কী ধরনের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে একসাথে যুক্ত করা সম্ভব তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা— ফেডেরালিস্ট লেখকদের মতো— যাতে ভাবতে হয় যে সমাজতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতার অন্যায় ব্যবহার কী ধরনের অবস্থায় ঘটতে পারে এবং তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে কী করে প্রতিরোধ করবার ব্যবস্থা করা যায়। তার একটা প্রাথমিক শর্ত হল গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকরণ কখনোই গণতান্ত্রিক নয় সেটা স্বীকার করা। নাহলে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোতে যেভাবে শিশুদের মন ভোলানোর মতো বলা হয় বুর্জোয়া গণতন্ত্র সত্য নয়, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাই প্রকৃত গণতন্ত্রের রূপ— এই ধরনের কুমন্ত্রে খুশি থাকতে হবে। কীভাবে যে এই ধরনের নতুন তত্ত্ব তৈরি হতে পারে তা বলা শক্ত।

চিনে অনেকসময় শোনা যায় বুদ্ধিজীবীরা সাম্প্রতিক সরকারকে মাওবাদী দিক থেকে সমালোচনা করেন। কিন্তু মাওয়ের ঐতিহ্যও একেবারেই অবিমিশ্র একনায়কতন্ত্রের। সেই ঐতিহ্য থেকে গণতান্ত্রিক তত্ত্ব উঠে আসা কঠিন। অন্য দিকে দেখা যায় আজকাল চিনের লেখকরা এবং তাদের সঙ্গে কিছু পশ্চিমের লেখকও প্রমাণ করতে চেষ্টা করছেন যে লিবারাল গণতন্ত্রের বিভিন্ন ত্রুটির জন্য প্রাচীন চিনের দর্শনে যে কনফুসীয় শাসনতন্ত্রের ভাবনা আছে সেটা হয় গণতন্ত্রের সমান নয়তো আরও ভাল। এতে চিনের পার্টির নেতারা আনন্দিত হতে পারেন। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রশ্নে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তার এগিয়ে যাবার বিশেষ সম্ভাবনা নেই।

এ ছাড়া দ্বিতীয় পথটা এক অর্থে সহজ, অন্য অর্থে কঠিন। সেটা হল, লিবারাল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রতত্ত্বকে নিছক ধাপ্পা বলে সরিয়ে না দিয়ে, অবজ্ঞা না করে, তাকে আরও গভীরতর ভাবনা দিয়ে বিশ্লেষণ করা। গণতান্ত্রিক শাসন পশ্চিমের কোনও অদ্ভুত সাংস্কৃতিক সৃষ্টি নয়— যা অন্যান্য জায়গার ইতিহাসে সফলভাবে প্রয়োগ করা অসম্ভব। যদি ইউরোপের বাইরে অন্য সমাজে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে তাহলে গণতন্ত্র কেন সৃষ্টি করা যাবে না? নতুন সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় ধনতন্ত্রের সমালোচনার সঙ্গে গণতন্ত্রের প্রসারের কথা একসঙ্গে ভাবা উচিত। তা হলেই আধুনিক বিপ্লবচিন্তার যে দ্বৈতআদর্শ equaliberty তার দিকে এগনো সম্ভব।

ভারতবর্ষ থেকে একটা উদাহরণ দিয়ে আলোচনা শেষ করতে চাই। তত্ত্বের এই অভাব এবং এই অভাবটাকেই একটা বিরাট তত্ত্ব বলে ভ্রম করা— ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসকে স্পষ্টভাবেই প্রভাবিত করেছে। বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের থেকে ভারতবর্ষের রাজনীতিতেও সাম্যের আদর্শের প্রভাব কম ছিল না। কিন্তু সাম্যের রাজনীতি কথাটার অর্থ অস্পষ্ট। কারণ তার অর্থনির্দেশটা অনিশ্চিত থেকে যায় যতক্ষণ-না পরিষ্কার করে বলা হয় ঠিক কী ধরনের অসাম্যকে এই রাজনীতি অবলুপ্ত করতে চায়। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক বিমর্শে দু’ধরনের অসাম্যের কথা বিশেষ করে বলা হয়েছে সাম্যের আধেয় হিসেবে— একটা শ্রেণিবৈষম্য, অন্যটা জাতিবৈষম্য। কমিউনিস্টরা প্রথম ধরনের অসাম্যের বিরুদ্ধে রাজনীতি করেছেন। আম্বেদকর এবং তাঁর সহযোগীরা এবং অন্যভাবে গান্ধী দ্বিতীয় ধরনের অসাম্যকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে নেহরুর চিন্তার বিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো— কারণ ১৯৩০–৪০-এ মনে হয় তাঁর কাছে শ্রেণিবৈষম্যই বড় কথা।২৭ কিন্তু ঘোষণা করে না বললেও, স্বাধীনতার সময়কার কাজ দেখলে বোঝা যায় তিনি সংবিধানের মাধ্যমেই জাতিবৈষম্যকে খর্ব করা এবং লোপ করার চেষ্টা করেছেন। আমাদের ভেবে দেখা উচিত, এই দুই ধরনের সাম্যের রাজনীতির ঐতিহাসিক ফল কী হয়েছে। কমিউনিস্টরা লিবারাল গণতন্ত্রকে অবজ্ঞা করে তাকে ব্যবহারই করেননি।২৮ বরং যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শাসনক্ষমতা তাঁদের হাতে এসেছে সেখানে তাঁরা লিবারাল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এবং তার গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে অনেকভাবে নষ্ট করে এক ধরনের হিংসার রাজনীতি ডেকে এনেছেন।২৯ সাম্প্রতিক ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় এই হুমকি এবং হিংসার সাহায্য নিয়ে নির্বাচনী রাজনীতি বামপন্থীদের হাত থেকে অন্যদের হাতে চলে যেতে দেরি লাগে না। মহাভারতের কথায়—

অধর্মে নৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি।

ততো সপত্নান জয়তি সমূলস্তু বিনশ্যতি ॥

প্রথমে এতে সুবিধেই হয়। বিরোধীদের পরাজিত করা যায়। পরে সমূলে বিনষ্ট হতে হয়— অর্থাৎ পার্টির লোকেরা দলে দলে মতাদর্শগতভাবে একেবারে বিপরীতমুখী দলেও যোগ দিতে থাকে।

অন্য দিকে নেহরু ও আম্বেদকরের লিবারাল গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্রচিন্তা ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম জাতিপ্রথার অন্যায়কে একেবারে লোপ করতে না পারলেও অনেক দিক থেকে হ্রাস করতে পেরেছে। লিবারাল গণতন্ত্র কোনো বিশাল প্রতারণা নয়— আধুনিক রাষ্ট্রের যে অপ্রতিহত শক্তি তাকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা। তাকে উপহাস না করে, মনে হয় সেই রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে প্রবেশ করে তাকে আরও বিস্তৃত করার প্রয়াস করা প্রয়োজন। বিশেষ করে নিজেদেরই বিশ্বাস করানো প্রয়োজন যে গণতন্ত্র ও সমসমাজের আদর্শের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

১. এই চিন্তাটাকে social science-এর ভাষায় বলা হয় ontology of spheres.

২. ‘সংসার’ কথাটাকে এইভাবে ব্যবহার করা হয়েছে অভিনব গুপ্তের লেখায়: যেমন কাব্যসংসার। সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে অরিন্দম চক্রবর্তীকে ধন্যবাদ।

৩. Totality বা সম্পূর্ণ বস্তু যার কোনও ভাগ বা কলা নেই।

৪. William Petty, Political Arithmetick-এর উপরে মার্কসের আলোচনা আছে— Karl Marx, Theories of Surplus Value, Part I (Progress Publishers : Moscow), pp. 178-182.

৫. Foucault-র ‘Governmentality’ লেখায় এই ব্যাপারে একটা ছোট বিশ্লেষণ আছে। Foucault, ‘Governmentality’, in Gordon Burchell et al (eds.) The Foucault Effect (University of Chicago Press : Chicago, 1991), chapter 4, pp. 87-104.

৬. Keith Michael Baker, ‘Enlightenment and the institution of society: notes on a conceptual history’, in Sudipta Kaviraj and Sunil Khilnani (eds.), Civil Society: History and Possibilities (Cambridge University Press: Cambridge, 2001), chapter 5.

৭. John Locke, The Second Treatise of Civil Government (University of Adelaide : Adelaide, 2014). E Book.

৮. C. B. Macpherson, The Political Theory of Possessive Individualism (Oxford University Press : Oxford, 1962), pp. 221, 262.

৯. Hobbes, Leviathan, Edited by C. B. Macpherson, ‘Introduction’ (Penguin Books: Harmondsworth, 1968).

১০. Locke, The Second Treatise, Chapter 5, ‘Of Property’.

১১. Locke, The Second Treatise, Chapter 19, ‘Of the dissolution of government’.

১২. Marx, ‘Critique of Hegel’s Philosophy of Right’, in Karl Marx and Frederick Engels, Collected Works, vol. 3 (Progress Publishers: Moscow, 1975), pp. 44-48, 50-54.

১৩. Hegel, Elements of the Philosophy of Right (ed. Alan Wood) (Cambridge University Press : Cambridge), pp. 328-336.

১৪. Hegel, Elements of the Philosophy of Right, pp. 328-336.

১৫. Max Weber, The Theory of Social and Economic Organization (ed. Talcott Parsons), Part III (The Free Press : New York, 1964).

১৬. Shlomo Avineri, Karl Marx: Social and Political Thought (Cambridge University Press : Cambridge, 1968), chapter 2-এ এই ব্যাপারে আলোচনা আছে।

১৭. ‘…the bourgeoisie has at last, since the establishment of Modern Industry and of the worldmarket, conquered for itself, in the modern representative state, exclusive political sway. The executive of the modern State is but a committee for managing the common affairs of the whole bourgeoisie.’ Karl Marx and Friedrich Engels, The Communist Manifesto, Chapter 1 (Penguin Books : London), pp. 5-6.

১৮. যেমন Communist Manifesto-তে এবং ফ্রান্সের উপর লেখাগুলোতে রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনার মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করা যায়।

১৯. Robert K. Merton, ‘The self-fulfilling prophecy’ in Robert K. Merton, Social Theory and Social Structure (The Free Press : New York, 1957), chapter XIII.

২০. Sudipta Kaviraj, ‘The self-falsifying prophecy’, in Amal Kumar Mukhopadhyay (ed.) The Political Miscellany : Essays in Honour of Professor Ramesh Chandra Ghosh (K P Bagchi : Calcutta, 1986), pp. 15-22.

২১. Friedrich Engels, Introduction (1891), Karl Marx, Civil War in France. https://www.marxists.org/archive/marx/works/1871/civil-war-france/postscript.htm

২২. Karl Marx, Critique of the Gotha Program. https://www.marxists.org/archive/marx/works/1875/gotha/

২৩. ‘The government of men will be replaced by the administration of things and the direction of the process of production’, F. Engels, Anti-Duhring, quoted in Lenin, State and Revolution, Chapter 1. https://www.marxists.org/ebooks/lenin/state-and-revolution.pdf

২৪. Condorcet, Political Writings (eds. Steven Lukes and Nadia Urbinati) (Cambridge University Press : Cambridge, 2012), chapter 4, 5, 6, বিশেষ করে পৃ. ১৯০।

২৫. The Federalist Papers. http://www.let.rug.nl/usa/documents/1786-1800/the-federalist-papers/

২৬. আমাদের দেশে সি. পি. আই (এম) থেকে সমালোচক, অসন্তুষ্ট সভ্যদের অসভ্যভাবে বহিষ্কার করা তার সবথেকে সাম্প্রতিক উদাহরণ। লেনিন, স্তালিন, মাও-এর থেকে শক্তিতে কম হলেও ভারতের কমিউনিস্টরা স্বাধীনতা-বিরোধী আক্রোশে কিছু কম যান না।

২৭. Nehru, Presidential Address to the Indian National Congress, 1929 (Lahore) 1936 (Lucknow). http://www.celebratingnehru.org/english/select_speeches.aspx

২৮. যদিও এই ব্যাপারে সি. পি. আই-এর ইতিহাস আমাদের সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে উচিত। সি. পি. আই. ১৯৪৮-এ যখন বিপ্লব করার চেষ্টা করেছিল সেটা ছিল সত্যিই বিপ্লবের প্রয়াস। আবার ১৯৫৭-তে নির্বাচনের পরে কেরালার নামবুদিরিপাদ সরকার সত্যিই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিল। সি. পি. আই (এম) পরে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে একটা অসাধারণ মিশ্রণ তৈরি করতে পেরেছিল— বিপ্লবের কথা আর নির্বাচনের কাজের মধ্যে। শেষপর্যন্ত অবশ্য বোঝা গেছে:

সত্য মুল্য না দিয়েই বিপ্লবের খ্যাতি করা চুরি

ভাল নয় ভাল নয় নকল সে শৌখিন মজদুরি।

২৯. যদিও এই ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের মার্কসবাদীদের কৃতিত্বের কোনো তুলনা নেই। ভারতের অন্য জায়গার মার্কসবাদীদের সমান দোষ দেওয়া ঠিক নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *