মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব ও একটি তৃতীয় বিকল্পের সম্ভাবনা : বাংলার অভিজ্ঞতা

মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব ও একটি তৃতীয় বিকল্পের  সম্ভাবনা : বাংলার অভিজ্ঞতা
অনুরাধা রায়

মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব : কী ও কীজন্য?

প্রথমেই যে প্রশ্নটা আমাদের তুলতে হবে তা হল— মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব ব্যাপারটা কী? আদৌ কি মার্কস কোনও নন্দনতত্ত্বের সাধারণ সূত্র রচনা করে গিয়েছিলেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন হল— যদি মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব বলে কিছু থেকেই থাকে তাহলে তা কীজন্য? অর্থাৎ তা কী ধরনের কার্য সম্পাদন করে, বা করবে বলে আশা করা যায়?

প্রথম প্রশ্নটি দিয়েই শুরু করি। না, মার্কস কোনও সংহত নন্দনতত্ত্বের সন্ধান আমাদের দিয়ে যাননি। তবে কিনা তিনি এবং তাঁর সহযোগী এঙ্গেলস শিল্পসাহিত্য বিষয়ে বেশ কিছু লেখালিখি করেছিলেন, যার ভিত্তিতে একটা তত্ত্বপ্রকল্প বোধহয় মোটামুটি খাড়া করা যায়, অন্তত মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীরা সেরকমই প্রয়াস নিয়েছিলেন। ডিকেন্স, থ্যাকারে, (শার্লট) ব্রোন্টি ও গ্যাসকেল-কে নিয়ে মার্কসের মুগ্ধতা, বা বালজাক ও গ্যোয়েটে-এর প্রতি এঙ্গেলসের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনকে উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। মার্কস ও এঙ্গেলসের মতে, এইসব সাহিত্যিক এমনভাবেই শ্রেণিসমাজের ভেতরকার দ্বন্দ্বগুলি ফুটিয়ে তুলেছিলেন যে তা ঐতিহাসিক বা অর্থনীতিবিদের ‘বিজ্ঞানসম্মত’ বিশ্লেষণের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ও মূল্যবান। এই সাহিত্যিকরা কেউ বিপ্লবীও ছিলেন না। কিন্তু শ্রেণিসমাজে জন্ম নিয়েও তাঁদের সৃষ্টি শ্রেণিসমাজের বাস্তবতাকে অতিক্রম করে একটা নতুন শ্রেয়স্কর বাস্তবে পাঠককে পৌঁছে দেয়, পাঠকের মানবিক সারসত্তাকে পুনরুদ্ধার করে। এবং সেটা হয় তাঁদের চেতনার জোরে। মার্কসীয় বিপ্লবের তত্ত্বই হোক বা মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব, সেখানে বস্তুবাদের চেয়ে চেতনার গুরুত্ব কিছু কম নয়— যে-চেতনার প্রাথমিক আধার ‘মানবিক সারসত্তা’; যদিও বিংশ শতকে দীর্ঘদিন ধরে সব দ্বান্দ্বিকতা পরিহার করে মার্কসবাদকে ‘অর্থনৈতিক কৈবল্যবাদ’ (economic determinism)-এর সঙ্গেই সমীকৃত করে দেখা হয়েছে। গোড়ার দিকে কিন্তু বেশ কয়েক জন বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তক— উইলিয়াম মরিস, ফ্রানৎজ মেহরিং, আন্তোনিও লাবরিওলা— এমনই উদার সংবেদনশীলতার সঙ্গে সাহিত্যপাঠে মগ্ন হয়েছিলেন। উল্লেখ্য রোজা লুক্সেমবুর্গও, বিশেষ করে দস্তয়েভস্কি ও তলস্তয় সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য— সমাজবাদীদের দস্তয়েভস্কির প্রতি বিরূপ মনোভাবের সমালোচনা এবং তাঁর বক্তব্য যে এই দু’জনেরই ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা সত্ত্বেও তাঁদের লেখা পড়লে আমরা অনুপ্রাণিত হই, মুক্তির স্বাদ পাই, কারণ তাঁরা আদতে পশ্চাৎমুখী ও প্রতিক্রিয়াশীল নন, তাঁদের চেতনার মূলে মানুষ নিয়ে কোনওরকম সংকীর্ণতা বা ঘৃণা নেই, বরং আছে মানুষের প্রতি উষ্ণ ভালবাসা আর সামাজিক অন্যায়ের প্রবল বিরোধিতা।

এখান থেকে আমরা চলে আসতে পারি দ্বিতীয় প্রশ্নটিতে, অর্থাৎ, মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের কার্যকারিতা প্রসঙ্গে। বোঝাই যাচ্ছে প্রথমদিকের মার্কসবাদীদের কাছে তাদের নন্দনতত্ত্বের কার্যকারিতা ছিল শিল্পসাহিত্যের অনুভব ও রসাস্বাদনে পাঠককে প্রস্তুত করা, শিল্পী-সাহিত্যিকদের কাছে কোনওরকম অনুজ্ঞা বা দাবি রাখার কোনও প্রশ্নই সেখানে ছিল না। কিন্তু ক্রমে একটা ব্যাবহারিক উপযোগিতার মাত্রা যুক্ত হল মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বে। শুধু মুগ্ধতা তৈরি করলেই হবে নাকি? শিল্পসাহিত্যকে তো বিপ্লবের হাতিয়ার হতে হবে! এই বোধটা এল প্রধানত রুশ বিপ্লবের সুবাদে। ১৯০৫ সালেই লেনিন ‘দলীয় আনুগত্যহীন লেখক’ (non-partisan writers) ও ‘সাহিত্যিক মহাপুরুষ’ (literary supermen)-দের ধিক্কার জানিয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর স্ত্রী ক্রুপস্কায়ার মতে সে নাকি নেহাত আইনসভায় মেনশেভিক, নারোদনিক ও অ্যানার্কিস্টদের সঙ্গে বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে, সত্যি করেই সৃজনশীল সাহিত্যিকদের কণ্ঠরোধ তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। লেনিনই তো তলস্তয়কে ‘রুশ বিপ্লবের দর্পণ’ বলে বর্ণনা করেছিলেন (অর্থাৎ, বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী কৃষক-বুর্জোয়ারা যতরকম টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে গিয়ে তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল তার দর্পণ; লেনিনই তো স্বপ্ন দেখার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন! তবু মনে হয় শিল্পসাহিত্য নিয়ে তাঁর একটা দোটানা ছিল। গান, ছবি খুব ভালবাসতেন; কিন্তু সে ভালবাসাকে প্রশ্রয় দিতে চাইতেন না, ভাবতেন বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে এসবের চর্চা বিলাসিতামাত্র। এই নেতিবাচক মনোভাবটাই বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় প্রবলতর হয়ে উঠল এবং তার সমর্থনে লেনিন থেকে (এমনকী মার্কস-এঙ্গেলস থেকেও!) উদ্ধৃতি দেওয়া হতে লাগল। প্রাক্‌-বিপ্লব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সমসাময়িক শিল্পী-সাহিত্যিকদের অবমূল্যায়ন, নতুন প্রলেতারীয় সমাজের জন্য প্রলেতারীয় সাহিত্যের উদগ্র দাবি, ইত্যাদি অনেক কিছুতেই তার প্রতিফলন ঘটল। ত্রৎস্কি, বুখারিন বা লুনাচারস্কি-র মতো সংবেদনশীল তাত্ত্বিকদের হটিয়ে স্তালিনের সোভিয়েত রাশিয়ায় নন্দনতাত্ত্বিক চর্চায় প্রধান জায়গাটা ক্রমে নিয়ে নিলেন ঝ্‌দানভ— সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির এক প্রধান নেতা, বিশেষত সংস্কৃতিক্ষেত্রে। সেটা তিরিশের দশকের মাঝামাঝি। ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’ (Socialist Realism) হয়ে উঠল মার্কসীয় নন্দনতাত্ত্বিকদের লব্জ। সে কিন্তু বেশ একটা স্ববিরোধী ব্যাপার। এক দিকে অর্থনৈতিক কৈবল্যবাদের প্রয়োগ করে বলা হল— বুর্জোয়া সমাজের অবক্ষয় প্রতিফলিত হয় বুর্জোয়া সাহিত্যে, অন্য দিকে দাবি করা হল— সমাজতান্ত্রিক সমাজে ‘সমাজবাদী বাস্তব’-এর প্রতিফলন ঘটানো উচিত। অর্থাৎ এক দিকে ‘হয়’, অন্য দিকে ‘হওয়া উচিত’। পার্টির আদর্শে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করা হল শিল্পী-সাহিত্যিকদের, প্রলেতারীয় সাহিত্যের দাবি জানানো হল, তদনুযায়ী তাঁদের জন্য নির্ধারিত হল পুরস্কার বা তিরস্কার। যাঁরা তাতে আপত্তি করলেন তাঁদের দেগে দেওয়া হল ‘ত্রৎস্কিপন্থী’ বলে। মার্কস-এঙ্গেলসকে রেহাই দিলেও মেহরিং, রোজা লুক্সেমবুর্গ সহ পুরনো দিনের মার্কসীয় নন্দনতাত্ত্বিকদের ওপর আক্রমণ শানানো হল।

স্তালিন-প্রাণিত, ঝ্‌দানভ-নির্দেশিত, সোভিয়েত-চালিত মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের আবহের মধ্যেই চিন বিপ্লব সূচিত হল এবং মাও জে-দং একটা ভারসাম্য আনার চেষ্টা করলেন শিল্পীর স্বাধীনতা আর শিল্পের বৈপ্লবিক উপযোগিতার মধ্যে। ১৯৪২-এর বিখ্যাত ইয়েনান বক্তৃতাতেই তিনি বিপ্লবের আবাহনে বুর্জোয়া সাহিত্যিকদের অবদান স্বীকার করেছিলেন, সবরকম সাহিত্যের প্রতি সহিষ্ণুতার সুপারিশ করেছিলেন; তবে শর্ত ছিল— শত্রু জাপানকে যেন সুবিধে করে না দেওয়া হয়; আর জাতীয় স্বার্থ, বিজ্ঞান, জনসাধারণ ও কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধিতাও কাম্য নয়। অন্য দিকে, রাজনৈতিকভাবে সঠিক হয়েও যে শিল্পের শৈল্পিক শক্তি নেই, মানে পোস্টার বা স্লোগান ধরনের শিল্প, তাকে তিনি নস্যাৎ করেছিলেন। তারপর যখন চিনের সংগ্রাম একটা তুমুল যুদ্ধের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছল, তিনি শিল্পী-সাহিত্যিকদেরও আহ্বান জানালেন তাতে অংশগ্রহণের জন্য। কিন্তু মাও-এর নন্দনতত্ত্বে হুকুমদারির ভঙ্গি এনে ফেললে এ ধরনের আহ্বানেও অসহিষ্ণুতা ও অবদমনের সম্ভাবনা থেকে যায়।

একটা বিষয় আমাদের বুঝতে হবে যে, শিল্পসাহিত্যের বৈপ্লবিক উপযোগিতার দিকটা ১৯৩০-৪০-৫০-এর দশকে অধিকাংশ মার্কসবাদীর পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না, কারণ মহামন্দা ও বিশ্বযুদ্ধ-জনিত সংকট মার্কসবাদী তো বটেই অনেক অ-মার্কসবাদীর মনেও সেই সময়ে এমন একটা ধারণার জন্ম দিয়েছিল যে ধনতন্ত্রের ধ্বংস আসন্ন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে অনিবার্য বলেই মনে হচ্ছিল অনেকের। সোভিয়েত আর চিনের দৃষ্টান্ত তো প্রেরণার উৎস হিসেবে ছিলই। কিন্তু এমন যদি পরিস্থিতি হয় যেখানে বিপ্লবের সম্ভাবনা দূর-অস্ত, সেক্ষেত্রে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের ভূমিকা কী হবে? বস্তুত সেই মধ্য-বিংশ শতকের বিপ্লবের সম্ভাবনাও যে অনেকটা চিত্তবিভ্রম ছিল সেটাও তো পরে প্রমাণিত। তারপর যত দিন গেছে সে সম্ভাবনা ততই দূরে হটেছে। আজ উত্তর-উদারনৈতিক বিশ্বায়িত অর্থনীতির যুগে তো অতি বড় মার্কসবাদীর পক্ষেও অদূর ভবিষ্যতে বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখতে পাওয়ার প্রশ্ন নেই। অতএব মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা এই দাঁড়াল— অ-বৈপ্লবিক সামাজিক পরিস্থিতিতেও শিল্পসাহিত্য কি কোনওরকম শ্রেয়স্কর মতাদর্শগত পরিবর্তন নিয়ে আসার ক্ষমতা রাখে? মার্কসবাদীরা যদি বাস্তববাদী হন, এ প্রশ্নের মুখোমুখি তাঁদের হতেই হবে। যাকে Western Marxism বা পশ্চিমি মার্কসবাদ বলা হয় তার প্রধান চিন্তকরা— মানে, লুকাচ, আডোর্নো, মারকিউজ প্রমুখ— তাঁরা অনেক আগে থেকেই এ নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই তাঁদের মনে হয়েছিল বিপ্লব চট করে হবে না। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অবসানের পর তাঁদের এটাও মনে হল যে মার্কসীয় দর্শনের কেন্দ্রীয় সমস্যা এখন চেতনা; এবং সমাজবাদের শেষ লক্ষ্য নিছক অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক নয়, চেতনাসঞ্জাত মূল্যবোধ দিয়েই তা নির্ধারণ করা দরকার। শিল্পসাহিত্যের মধ্যেই তাঁরা দেখতে পেলেন চারদিকের পণ্যাসক্ত বাস্তবের মধ্যেও সেই মূলগত মানবচেতনা জেগে ওঠার সম্ভাব্যতা। মানবজীবনে বিচ্ছিন্নতার বিড়ম্বনার (মার্কসের বিখ্যাত ‘এলিয়েনেশন’ তত্ত্ব অনুযায়ী) মানবিক সমালোচনার জন্য তাঁরা শিল্পসাহিত্যের ওপরেই ভরসা রাখলেন। শিল্পসাহিত্যের এই মূল্যবান ভূমিকার ইঙ্গিত মার্কস-এঙ্গেলস তথা প্রথমদিকের মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরাই দিয়ে গিয়েছিলেন। পশ্চিমি মার্কসবাদীদের মধ্যে তাকে আরও বিশ্লেষণমূলক ও পরিশীলিত তত্ত্বে পরিণত করার প্রচেষ্টা দেখা গেল। এইভাবে নিছক রসাস্বাদনে সাহায্য করা, তৈরি করা ও বিপ্লবের হাতিয়ার হয়ে ওঠা ছাড়াও মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের একটি তৃতীয় বিকল্পের সন্ধান পাওয়া গেল পশ্চিমি মার্কসবাদে।

বাংলায় মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের বিকাশ

বাংলায় মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বে কিন্তু গোড়া থেকেই স্তালিনপন্থার নান্দনিক সংস্করণ ঝ্‌দানভবাদেরই আধিপত্য ছিল এবং সেটা ছিল অনেকদিন ধরে। মনে রাখতে হবে, ঝ্‌দানভবাদ-সদৃশ নন্দনতত্ত্ব ঝ্‌দানভের উত্থানের আগে থেকেই ছিল এবং এমনকী মধ্য-পঞ্চাশে নি-স্তালিনীকরণের পরেও ধরনটা খুব-একটা বদলায়নি। আমরা অবশ্য এই প্রবন্ধে আমাদের আলোচনা অন্তিম-ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বের গোড়ার দিকটায় সীমাবদ্ধ রাখছি এবং শিল্পমাধ্যমগুলির মধ্যে শুধুমাত্র সাহিত্যের প্রতি মনোনিবেশ করছি, যদিও অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রেও আমাদের পর্যবেক্ষণ প্রযোজ্য।

প্রত্যাশিতভাবেই বাংলায় মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বে সাহিত্যপাঠের প্রধান ভিত্তি হয়ে উঠেছিল অর্থনৈতিক কৈবল্যবাদ— ‘ফিউডাল’ বা ‘বুর্জোয়া’র মতো তকমা দিয়ে সাহিত্য বিচার। সাহিত্য যে তার চারপাশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবের ভিতকে ছাপিয়ে গিয়ে অন্য কোনও কাম্য বাস্তবতায় উত্তীর্ণ হতে পারে সেই বোধ প্রায় অন্তর্হিত হয়েছিল। বলা হত— শিল্পসাহিত্যকে বাস্তবানুগ হতে হবে আর বিপ্লবের প্রক্রিয়াতেও সাহায্য করতে হবে, সে যখন বাস্তবে বিপ্লবের সম্ভাবনা ক্ষীয়মাণ তখনও। সোভিয়েত রাশিয়ার নন্দনতত্ত্বের প্রধান বিতর্কমূলক বিষয়গুলির পুনরাবৃত্তি দেখা গেল এদেশেও। পশ্চিমি মার্কসবাদীদের হাতে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের তৃতীয় যে কার্যকারিতা চিহ্নিত ও বিশ্লেষিত হয়েছিল, তা অনুধাবনের সুযোগ বাংলায় তেমন ছিল না।

সেই ১৯৩১-৩২ সালেই দেশ ও আনন্দবাজার পত্রিকায় ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের কলমে যান্ত্রিক মার্কসীয় সমালোচনার পরিচয় মেলে— বিশ্ব-ইতিহাসের মার্কসকথিত পর্বগুলির সঙ্গে একেবারে খাপে খাপে মেলাতে চান তিনি বিশ্বসাহিত্যের বিকাশকেও। আর রবীন্দ্রনাথের শরৎ প্রকৃতির গান ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া’র এমতো ব্যাখ্যা দেন ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে— গানে উল্লিখিত নৌকোটি হল সামন্ততন্ত্র, পাল হল ভারতীয়দের রাজনৈতিক চেতনা, নরম ও উদারপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনের হাওয়া সেই পালকে মন্দ মধুর দোলা দিচ্ছে। পরের পঙ্‌ক্তি ‘দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া’র ব্যাখ্যা হল এরকম— তা তো বটেই, কার্ল মার্কস যে পড়েনি, সে তো কিছুই দেখতে পায় না, বুঝতে পারে না। ধূর্জটিপ্রসাদ জিজ্ঞাসা করেন— কবিতা বোঝার জন্য কি কার্ল মার্কস পড়া জরুরি? ভূপেন্দ্রনাথ উত্তর দেন— রাজনৈতিক কবিতার জন্য কার্ল মার্কস অবশ্যই জরুরি।

দেশবিদেশের নানা উৎস থেকে আহৃত যত পুরনো ও নতুন ধ্যানধারণার ধারা বেশ কিছু দিন ধরে প্রবাহিত হচ্ছিল বঙ্গীয় সাহিত্যক্ষেত্রে, বাংলায় প্রথম পরিচয় পত্রিকায় (প্রতিষ্ঠা ১৯৩১) সেই ‘ভাবগঙ্গার ঘোলাটে জলে ফুটল লালের আভা’ এবং ক্রমেই তা গাঢ়তর হতে লাগল। পরিচয় ও পরিচয়-কেন্দ্রিক আড্ডার আবহাওয়া ছিল বেশ উন্মুক্ত। মার্কসবাদী ও অ-মার্কসবাদী দু’ধরনের বুদ্ধিজীবী-লেখকরাই মতবিনিময় করতেন। সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত নিজে মার্কসবাদী না হলেও তাঁর অনেক মার্কসবাদী বন্ধু ছিলেন। কিন্তু মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীদের মুখপত্র হিসেবেই প্রকাশিত অগ্রণী (১৯৩৯), তারপর তার জায়গা নিল যে অরণি (১৯৪১) পত্রিকা— সেসবের মাধ্যমে মার্কসবাদী সমালোচনা ক্রমেই সংকীর্ণচিত্ত, অসহিষ্ণু ও নেতিবাচক হয়ে উঠল। যদিও তখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তাগিদে কমিউনিস্টরা যুক্তফ্রন্ট নীতির ভিত্তিতে গড়ে তুলেছে এক বিশাল উদার সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট যার নাম ‘প্রগতি লেখক সংঘ’, মার্কসবাদী তো বটেই অনেক অ-মার্কসবাদীও সেই ফ্রন্টে শামিল হয়েছেন, তবুও ভেতরে ভেতরে রয়ে গেল এই নেতিবাচক প্রবণতা। প্রায়শই প্রবলভাবে আক্রমণ করা হত প্রগতি শিবিরের অ-মার্কসবাদী লেখকদের (যেমন বুদ্ধদেব বসু); এমনকী যাঁদের সহযাত্রী বলা হত, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হয়েও অনেকটা সমমনস্ক, তাঁদেরও (যেমন বিষ্ণু দে)।

যুদ্ধান্তে ফ্যাসিবাদের বিপদ অন্তর্হিত হলে আক্রমণ আরোই শানিত হয়ে উঠল। ১৯৪৭-এর শেষের দিকে ‘উর্দি-পরা শিল্পী’ আর ‘উর্দি-ছাড়া শিল্পী’ নিয়ে ফ্রান্সের আরাগঁ-গারোদি বিতর্ক এখানেও মার্কসবাদী মহলে শোরগোল তুলল। আরাগঁ শিল্পীদের পক্ষে পার্টির প্রতি পুরোপুরি আনুগত্যের দাবি করেন, গারোদি এমন বাধ্যবাধকতার বিরোধিতা করেন। বাংলায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে বা জ্যোতির্ময় রায়ের মতো পার্টি-বহির্ভূত লেখকরা তো বটেই, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতো কোনও কোনও পার্টি সদস্যও গারোদিরই সমর্থক ছিলেন। সে যুগের বাংলায় কমিউনিস্ট সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের এক প্রধান সংগঠক চিন্মোহন সেহানবীশ বলেন, তিনি প্রথমে ছিলেন আরাগঁপন্থী, কিন্তু পরে বিষ্ণু দে তাঁকে গারোদির দিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। তখনও এখানকার কমিউনিস্ট পার্টি নির্দিষ্ট কোনও সাংস্কৃতিক নীতি গ্রহণ করেনি এবং লেখক সংঘের ঐক্য বজায় রাখারই পক্ষপাতী ছিল। ফলে পার্টির কালচারাল সাব-কমিটির অনুজ্ঞায় গারোদিপন্থীদেরই জয় হল তখনকার মতো। কিন্তু সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের ঐক্য বেশিদিন বজায় রাখা গেল না।

১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চে কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে সদ্যলব্ধ স্বাধীনতাকে নাকচ করে এক অতিবিপ্লবী রাজনৈতিক পন্থা গৃহীত হল এবং তার পরিপূরক হিসেবে সংস্কৃতিক্ষেত্রে নীতিগতভাবেই অবলম্বন করা হল অসহিষ্ণুতা ও অবদমনের পন্থা। পার্টির তাত্ত্বিক পত্রিকা মার্কসবাদী-তে তার প্রতিফলন ঘটল। প্রথম সংখ্যাতেই ‘বীরেন পাল’ ছদ্মনামে পলিটব্যুরো সদস্য ভবানী সেন এবং ‘ঊর্মিলা গুহ’ ছদ্মনামে আরেক নেতা প্রদ্যোৎ গুহ লিখলেন যে, বুর্জোয়া সাহিত্য একদা প্রগতিশীল হলেও এখন তা অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, এসে গেছে প্রলেতারীয় সাহিত্য বিকাশের সময়। তার জন্য শিল্পীদের তেলেঙ্গানা বা তেভাগার গ্রামগুলিতে গিয়ে শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামে অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এঁরা মনে করতেন এইসব বিক্ষিপ্ত সংগ্রামই দ্রুত সংহত হয়ে উঠে বিরাট বিপ্লব ঘটাবে। এপ্রিল ১৯৪৯-এ সর্বভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘের চতুর্থ অধিবেশনেও এই মতই ব্যক্ত হল।

এরপর মার্কসবাদী-র চতুর্থ ও পঞ্চম সংখ্যায় ভবানী সেন ও প্রদ্যোৎ গুহ প্রবন্ধ লিখলেন যথাক্রমে ‘রবীন্দ্র গুপ্ত’ ও ‘প্রকাশ রায়’ ছদ্মনামে। ক্রমে এই দু’জনের বক্তব্যে সংযোজন ও বিস্তার ঘটালেন আরও অনেকে। এই পর্যায়ে অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতার চরমে পৌঁছল মার্কসবাদীদের সংস্কৃতিনীতি। বলা হল বাংলার বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী লেখকরা— সেই রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত, এবং তারও পরে— আগাগোড়া সুবিধাবাদী ও জনবিরোধী। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নিষ্ঠাবান কমিউনিস্ট লেখককেও তিরস্কার করা হল যথেষ্ট প্রোলেতারীয় নন বলে। নিষিদ্ধ পার্টিতে তখন গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটা নেই। বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করে অতি বিপ্লবীরা পার্টি চালাচ্ছেন। সংস্কৃতিক্ষেত্রেও সেটাই দেখা গেল। ইতিমধ্যে, ১৯৪৪ সালে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পরিচয় পত্রিকা তুলে দিয়েছিলেন তাঁর মার্কসবাদী বন্ধুদের হাতে। তবুও সেখানে বেশ কিছু দিন পর্যন্ত নরম ও চরম উভয়মতেরই স্থান ছিল, তর্কাতর্কির পরিসর ছিল। দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর পার্টির বে-আইনি পর্বে পরিচয় বন্ধ হয়ে যায়। এরপর যখন নবপর্যায় পরিচয় প্রকাশিত হল, তার সম্পাদক হলেন রবীন্দ্র গুপ্ত -পন্থী সরোজ দত্ত ও গোলাম কুদ্দুস। পত্রিকাটির চরিত্র পালটে গেল। পার্টি বা পার্টি-ঘনিষ্ঠ কোনও কাগজে জায়গা না পেয়ে বিষ্ণু দের মতো কয়েক জন লেখক (হীরেন মুখার্জির মতো কতিপয় পার্টিনেতাও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন) সাহিত্যপত্র নামে পত্রিকা প্রকাশ করলেন (১৯৪৮)। প্রথম সংখ্যাতেই বিষ্ণু দে ‘রাজায় রাজায়’ প্রবন্ধে তাঁর নিজের নন্দনতত্ত্ব উপস্থাপিত করলেন।১০ বুদ্ধদেব বসুর An Acre of Green Grass বইটির সমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি বসুর ‘শুদ্ধ সাহিত্যবাদ’ এবং উলটো দিকে বামদের স্বকল্পিত মার্কসীয় মতবাদের বর্জন নীতি দুয়ের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করলেন।১১ এই পত্রিকাটিতে, বলা বাহুল্য, একটু অন্যরকম মার্কসবাদী সমালোচনার সুযোগ তৈরি হল।

১৯৪৮-৪৯ সালে চিনের সংগ্রাম ও বিপ্লব মার্কসবাদী মহলে সাড়া ফেলে দিল। চিন নিয়ে আবেগে আপ্লুত তখন বাংলার মার্কসবাদী পত্রিকাগুলি। মাও-এর ইয়েনান বক্তৃতাও ততদিনে বাংলায় এসে পৌঁছেছে। নতুনসাহিত্য পত্রিকাটি এই বক্তৃতাকেই করল তার নান্দনিক নীতির ভিত্তি। ডাক, ইস্পাত ইত্যাদি আরও কিছু সদ্য প্রকাশিত পত্রিকাতেও মাও-এর অনুসরণে ঔপনিবেশিক বুর্জোয়াদের প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রগতিশীল এই দুই মুখের কথা বলা হল এবং তদনুযায়ী বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের পুরোপুরি বরবাদ করে দেওয়ার নীতির বিরোধিতা করা হল। ২৭ জানুয়ারি ১৯৫০, চিনের প্রভাবে কমিনফর্মের মুখপত্র For a Lasting Peace For a People’s Democracy-তে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্য দেওয়া হল নতুন নীতিনির্দেশ। ফলে পার্টি তার নীতি পরিবর্তন করল রুশপন্থা থেকে চিনাপন্থায়। নেতৃত্বও বদল হল কিছু দিনের মধ্যে। নবপর্যায় পরিচয়-এর দায়িত্ব নিলেন সুশীল জানা ও মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়। পত্রিকাটিতে সাম্রাজ্যবাদ- ও সামন্ত্রতন্ত্র-বিরোধী ঐক্যের ডাক দেওয়া হল। রাজনীতি বদলালেও কমিউনিস্টদের নান্দনিক নীতি কিন্তু শিল্পসাহিত্য জুড়ে বুর্জোয়া সুবিধাবাদ দেখার পীড়াকর প্রবণতা থেকে চট করে মুক্ত হল না।

বাংলায় মার্কসবাদী নান্দনিক চিন্তার কিছু জটিলতা ও তর্কবিতর্ক১২

বাঙালি মার্কসবাদীদের সাহিত্যপাঠের ক্ষেত্রে প্রধান প্রবণতা অবশ্যই ছিল ‘বুর্জোয়া’ বা ‘ফিউডাল’ বলে অতীত ও সমসাময়িক সাহিত্যকে চিহ্নিত করে দেওয়া (যদিও বুর্জোয়া কারা, ফিউডালই-বা কারা এসব ধারণা মোটেই স্পষ্ট ছিল না); তারই মধ্যে সামান্য কিছু শ্রমজীবী সাহিত্যের দৃষ্টান্ত খুঁজে বের করা ও তার প্রশংসা। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আক্রমণের বড় লক্ষ্য। এমনকী মার্কসবাদীদের ক্ষণিক বন্ধু বুদ্ধদেব বসুও ১৯৩৮ সালে প্রগতি লেখক সংঘের অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া বলে নাকচ করে দেন।১৩ বিনয় ঘোষ অবশ্য ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত শিল্প-সংস্কৃতি-সমাজ এবং নূতন সাহিত্য ও সমালোচনা বই দু’টিতে মনস্থির করে উঠতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়া না ফিউডাল। ১৯৪৮-৫০ সালের অতিবাম পর্বে যখন গোটা উনিশ শতকীয় ঐতিহ্যই অর্থনৈতিক কৈবল্যবাদের দ্বারা আক্রান্ত হল, তখন সেই বিগত শতাব্দীর কৃষক তথা গণবিদ্রোহের সমর্থনে কিছু লেখালিখি (যেমন দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক), শহুরে বুর্জোয়াবাবুদের ব্যঙ্গ করে কিছু রচনা (যেমন কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা) এবং অবশ্যই লোকসংস্কৃতিকেই শুধু প্রগতিশীল বলে গণ্য করা হল। কিন্তু কোনও কোনও মার্কসবাদী সমালোচক বাছাই-করা কিছু পূর্বতন বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও প্রগতিবাদী চরিত্র খুঁজে পেতে চাইলেন (মাও-কথিত বুর্জোয়া দ্বিমুখিতার তত্ত্ব তো সামনে ছিলই), অন্য দিকে তাঁরা যুক্তি দিলেন যে কৃষক বা গণবিদ্রোহগুলি প্রায়শই প্রগতিশীল নয়, বরং পশ্চাৎমুখী। ফলে অর্থনৈতিক কৈবল্যবাদ তথা বুর্জোয়া/ফিউডাল বনাম প্রলেতারীয় বলে লেখকদের চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি আরেকটা প্রবণতা দেখা দিল— বুর্জোয়াদের মধ্যে কে প্রতিক্রিয়াশীল, কে প্রগতিশীল তা প্রতিষ্ঠা করা। বাঙালি ভদ্রলোকের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত একই ব্যক্তি তখন কোনও মার্কসবাদীর লেখায় প্রগতিবাদী, আবার অন্য কোনও মার্কসবাদীর লেখায় প্রতিক্রিয়াশীল বলে প্রতিপন্ন হলেন। যেমন, বিবেকানন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্র গুপ্ত ও প্রকাশ রায়ের বক্তব্য— তিনি ধর্মীয় অধ্যাত্মবাদের ওপর জোর দিয়েছেন, যে-ধর্ম কিনা মার্কসের ভাষায় ‘জনগণের আফিম’, সুতরাং তিনি প্রতিক্রিয়াশীল; তিনি নিরক্ষর ভারতীয়, দরিদ্র ভারতীয়দের জাতিগঠনে আহ্বান জানালেও মুসলিম ভারতীয়দের জানাননি, অতএব তিনি সাম্প্রদায়িক। অন্য দিকে নরহরি কবিরাজ ও নীরেন্দ্রনাথ রায়ের মতে, বিবেকানন্দের গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তিনি শূদ্রের ক্ষমতার জাগৃতি চেয়েছিলেন, তিনি আধুনিক মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদের প্রবক্তা, পুনরুজ্জীবনবাদের নন, অতএব তিনি প্রগতিশীল।১৪ বলা বাহুল্য, সমালোচকদের যাঁর যেমন পড়াশোনা ও পছন্দ-অপছন্দ সেই অনুযায়ী এসব কথা বলা হত, আর সবটাকে ‘মার্কসীয়’ তত্ত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হত। উনিশ শতকের আধুনিকীকরণের সময় থেকে বাংলার সব বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, তাঁদের স্ববিরোধিতা ও জটিলতা নিয়ে দু’রকম মার্কসীয় ব্যাখ্যাতেই ধরা দিতে পারতেন। এইভাবে প্রতিক্রিয়াশীলতা আর প্রগতিশীলতার খণ্ড দর্শনই হয়ে দাঁড়াল যেকোনও রচনা পাঠের পদ্ধতিতন্ত্র। এতে সামগ্রিকভাবে রচনাগুলি ও রচনাকারদের প্রতি অবিচার হল তো বটেই, পাঠকের নিজের নান্দনিক সত্তাও হল দ্বিখণ্ডিত।

বিশেষ করে সৃজনমূলক সাহিত্যের ক্ষেত্রে এমন প্রগতিশীলতা/প্রতিক্রিয়াশীলতার সন্ধান আরোই গোলমাল বাঁধাল। যেহেতু পছন্দের কোনও লেখা বা লেখককে ন্যায্যতা দিতে হলে প্রগতিশীলতা, বিপ্লব-অনুকূলতার দোহাই দিতে হত, নীরেন্দ্রনাথ রায় তাই দাবি করলেন রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতাটি আসলে সামন্ত্রতান্ত্রিক বঞ্চনার আখ্যান— কৃষকের সব ধান নৌকায় তুলে নিয়ে মহাজন তাকে শূন্য নদীর তীরে ফেলে রেখে চলে গেল (যা আমাদের ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের ‘অমল ধবল পালে লেগেছে’ গানটির ব্যাখ্যা মনে করিয়ে দেয়)।১৫ নীরেন্দ্রনাথ পরিষ্কারই বলেছিলেন— সাহিত্য রচনা বা উপভোগ এক কথা, সাহিত্যের বিচার কিন্তু করতে হবে সমাজতত্ত্বের নিরিখে।১৬ সাহিত্য যে প্রতিফলিত সমাজসত্যকে ছাপিয়ে উত্তরণের সত্যে পৌঁছতে পারে, বিচারকের আসনে না বসে এটা বুঝে সাহিত্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলেই যে গোল মিটে যেতে পারে, বস্তুত পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা থেকে উত্তীর্ণ হতে পারে বলেই যে মহৎ সাহিত্য সর্বসময়ে সমসাময়িক— এটা এইসব সমালোচক বুঝে উঠতে পারেননি।

এ তো গেল সাহিত্যপাঠের কথা, যেখানে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের প্রাথমিক কার্যকারিতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তার দ্বিতীয় কার্যকারিতা অর্থাৎ সাহিত্যিকের প্রতি নির্দেশ জারিও কিন্তু এইসব তাত্ত্বিকের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। অনেকটা একই মানদণ্ড উভয়ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হত। প্রথমত সাহিত্যিকদের কাছে দাবি করা হল ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’। তার প্রথম শর্ত— সমাজের অবক্ষয়ের বর্ণনা দিয়ে তার সমালোচনা করলে শুধু হবে না, সংগ্রামের কথা বলতে হবে, আশার বাণী শোনাতে হবে। বুদ্ধদেব বসু ১৯৩৮-এর প্রগতি লেখক সংঘের অধিবেশনে তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন— বর্তমান পরিস্থিতিতে, অর্থাৎ যতদিন-না নতুন সমাজ তৈরি হয়, সাহিত্যিক মানুষের যন্ত্রণা, ভীতি, ক্লান্তি ইত্যাদির বর্ণনাই শুধু দিতে পারেন। অগ্রণী-তে বসুর কঠোর সমালোচনা করলেন সরোজ দত্ত।১৭ একই অধিবেশনে মার্কসবাদী কবি সমর সেনের বক্তব্য ‘In Defence of the Decadence’ একইভাবে সমালোচিত হল সরোজ দত্তের কলমে।১৮ সমর সেন বা বিষ্ণু দের মতো লেখকরা টি এস এলিয়টের ভক্ত ছিলেন। দত্ত এলিয়ট সম্পর্কে বললেন— ‘সাম্যবাদের শত্রু, চিরজীবন ধরিয়া তিনি decadence নিঙড়াইয়া গেলেন, একফোঁটা বিপ্লব পাওয়া গেল না।’১৯ দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর অবক্ষয়বাদী বলে চিহ্নিত করা হল আরও অনেক বাঙালি সাহিত্যিক ও তাঁদের সাহিত্যকীর্তিকে (যেমন, কালিন্দী ও মন্বন্তর-এর পর্ব পেরিয়ে-আসা তারাশঙ্করের হাসুলি বাঁকের উপকথা— কাহারদের নৈতিক অপকর্ষ দেখানোর জন্য। আর তারাশঙ্করের গান্ধীবাদী ঝোঁক তো মার্কসবাদীদের বিরূপতার কারণ ছিলই)। বলা হল, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা-ও বেশ নেতিবাচক।২০ এমনকী মন্বন্তর নিয়ে লেখা ও পার্টির আরেক সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট গণনাট্য সংঘ প্রযোজিত যে নবান্ন নাটক ছিল কমিউনিস্টদের শ্লাঘার বিষয়, তার সম্পর্কেও সমালোচনা করে বলা হল যে তা ‘কাঁদায়, কিন্তু দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ক্রোধ উদ্দীপ্ত করে না।’২১ অবশ্য মার্কসবাদীদের মধ্যে থেকেই এই ধরনের যান্ত্রিক দাবি তথা সমালোচনার প্রতিবাদ হয়, যেমন নতুন সাহিত্য পত্রিকায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় একটি সাম্প্রতিক ছোটগল্পের প্রসঙ্গ টেনে নিতান্ত দুঃখ ও হতাশার পরিস্থিতিতে কৃত্রিমভাবে আশা জাগানোর চেষ্টার বিরুদ্ধতা করেন (এই প্রবন্ধে তিনি হাসুলি বাঁকের উপকথা-রও প্রশংসা করেন সমাজের প্রান্তিকায়িত মানুষদের বোঝার ক্ষেত্রে এক বড় পদক্ষেপ হিসেবে)।২২ ডাক পত্রিকায় স্বদেশ বসু ছদ্মনামে শান্তি বসুও গোর্কির ‘ছাব্বিশটি পুরুষ ও একটি মেয়ে’র দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতে চান যে, সবসময়ে হাতিয়ার উঁচিয়েই সংগ্রামী গল্প লিখতে হবে তার কোনও মানে নেই।২৩ কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের অধিকাংশ প্রবক্তাই গোর্কির মা উপন্যাসকেই একমাত্র অনুসরণযোগ্য মনে করতেন। দাবি করতেন মা-এর পাভলভের মতো ‘পজিটিভ হিরো’।২৪

সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের দু’নম্বর শর্ত— গল্প-উপন্যাসে চাই ‘টিপিকাল পরিস্থিতিতে টিপিকাল চরিত্র’।২৫ মনে করা হত, ব্যক্তিমানুষের ব্যক্তিক বিশেষত্ব, তার মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, অন্তর্দ্বন্দ্ব সাহিত্যের উপজীব্য হওয়া উচিত নয়; কারণ মানুষের আসল ব্যক্তিত্ব তো তৈরি করে কৌমের সঙ্গে তার সম্পর্ক, ফলে একমাত্র পুঁজিবাদের কৌমবিচ্ছিন্ন অসুস্থ মানুষেরই এমন মানসিক দ্বন্দ্ব ও জটিলতা থাকতে পারে।২৬ ব্যক্তিমানুষের ব্যক্তিত্ব ব্যাপারটাও অবশ্য বিষ্ণু দে অন্যভাবে দেখেছিলেন, তাকে মানবসভ্যতার পরিণতিরই একটি অবদান বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন।২৭ তাঁর বক্তব্য মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের বিকল্প সম্ভাবনা প্রসঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ, যা আমরা পরে ভাল করে বুঝে নেবার চেষ্টা করব।

সাহিত্যিকদের প্রতি তিন নম্বর তাত্ত্বিক নির্দেশ ছিল শ্রমজীবী সাহিত্য রচনা। সেই সাহিত্য শ্রমজীবীদের জন্য, কিন্তু শ্রমজীবীদের দ্বারা রচিত নয়। তার জন্য সাহিত্যিকদের বিশ্রেণিকরণ কাম্য মনে করা হত। সেটা যদি চট করে সম্ভব নাও হয়, সাহিত্যিকদের দু’টি পথের নির্দেশ দেওয়া হল শ্রমজীবী সাহিত্যের স্বার্থে। প্রথম— সহজ আঙ্গিক তথা শৈলীর ব্যবহার, যাতে শ্রমিক-কৃষক সে সাহিত্য বুঝতে পারে। আর দ্বিতীয়পথ— গণসংযোগ।

শৈলীর ব্যাপারে বিষ্ণু দে মার্কসবাদীদের আক্রমণের বিশেষ লক্ষ্য ছিলেন। তিনি দুর্বোধ্যতাবিলাসী, তাই শ্রমিক-কৃষকের পক্ষে তাঁর কবিতা বোঝা অসম্ভব— অভিযোগটা বাহ্যত এমনই ছিল, কিন্তু আসলে সমালোচকদের নিজেদের কাছেই তাঁর কবিতা দুর্বোধ্য ঠেকত। (বস্তুত নিরক্ষর শ্রমজীবীদের কাছে তখন যেকোনও কবিতাই অগম্য— সে শক্ত বা সোজা যাই হোক না কেন; এবং মার্কসবাদীরা সাক্ষরতা প্রসারের কোনও উদ্যোগও নেননি)। মার্কসবাদী সমালোচকদের মতে, শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্তের মতো বিষ্ণু দের কবিতা নাকি বহির্জগৎকে মায়ায় পরিণত করার চেষ্টা। প্রকাশ রায় বিষ্ণুদের ‘জঙ্গী’ নামে কবিতার সঙ্গে লোককবি গুরুদাস পালের নিম্নলিখিত কবিতাটির তুলনা করলেন—

নির্বিচারে নরনারী ছাত্রছাত্রী হত্যা

এই যদি হয় শিশুরাষ্ট্রের আইন নিরাপত্তা

তবে আমি সভার মাঝে উচ্চকণ্ঠে কহি

পাঁচশো হাজার অসংখ্য বার আমি রাজদ্রোহী।

এবং সাড়ম্বরে চ্যালেঞ্জ করলেন— ‘বিষ্ণুদের মত তথাকথিত “ভদ্র” কবিরা রচনা করুন তো দেখি এমন কবিতা তাঁদের মুরোদ বুঝি! কিন্তু বিষ্ণুবাবুদের তা সাধ্যাতীত— কোথায় পাবে বুর্জোয়াদের বশংবদ সংস্কৃতিবিদেরা এমন প্রাণশক্তি?’২৮ অবশ্য লৌকিক আঙ্গিক হলেই প্রগতিশীল এমন সরলীকরণ মানেননি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তিনি নতুন দিনের সাহিত্যে নতুন আঙ্গিকের প্রয়োজনের পক্ষে মত দেন। বলেন, ছন্দের শ্লথতার জন্য রামায়ণ-মহাভারতে যুদ্ধের বিবরণ হাস্যকর রকম একঘেয়ে ও ব্যর্থ, তার জন্য মধুসূদন দত্তকে মেঘনাদবধ কাব্য-এ নতুন আঙ্গিকের আমদানি করতে হয়েছিল। আরও বলেন, বিষ্ণু দের ‘বরফের টুকরো’র চেয়ে অবশ্য গুরুদাস পালের কবিতা বেশি মূল্যবান, কিন্তু আঙ্গিকের অ-পর্যাপ্ততার জন্য এখানে ‘আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের আগুন’ হয়ে গেছে ‘গ্রাম্য হুঁকোর টিকের আগুন’।২৯ স্বদেশ বসুও ডাক পত্রিকার পূর্বোক্ত প্রবন্ধে মাও-কে উদ্ধৃত করে বলেন— ‘আঙ্গিকের ব্যাপারে সাহিত্যিকের অবশ্যই যত্নবান হওয়া উচিত। গুরুদাস পালের মতো স্লোগানধর্মী কবিতা আসলে কবিতাই নয়, এই নিরিখে তো “কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোকে” পয়ারে লিখলেই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী কবিতা হবে।’ অন্য দিকে, তাঁর মতে, ভাল সাহিত্যের অনুধাবনের জন্য পাঠকেরও প্রস্তুতি প্রয়োজন, আর এদেশের শ্রমিক-কৃষকের তো অক্ষরজ্ঞানই নেই। তাই ‘আপাতত আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের শ্রমিক-কৃষকের জন্য অ আ ক খ-র পাঠ তৈরি করতে হবে। কিন্তু সবসময়েই এই কথা বুঝতে হবে এই প্রয়াস সাহিত্য-সৃষ্টি নয়।’ ক্রমে তাদের শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটাতে হবে ও ‘উচ্চ সাহিত্যে’র প্রতি তাদের আকর্ষণ তৈরি করতে হবে।৩০

গণসংযোগের ব্যাপারে রাশিয়া, চিন ও অন্যত্র সাহিত্যিকদের (মায়াকভস্কি, গোর্কি, পাবলো নেরুদা প্রমুখ) সংগ্রামী কার্যকলাপের নমুনা দিয়ে এদেশীয় সাহিত্যিকদের তাঁদের অনুসরণ করতে বলা হত।৩১ কেউ কেউ, যেমন স্বদেশ বসু, অবশ্য ফের মাও জে-দং-কে উদ্ধৃত করে বলেন যে, গণসংযোগ দরকার, কিন্তু ওপর-ভাসা গণসংযোগের চেয়েও জরুরি সংবেদনশীলতা ও কল্পনা, যাতে সাহিত্যসৃষ্টি প্রত্যয়সিদ্ধ হতে পারে।৩২ কিন্তু এ ব্যাপারে মাও-এর প্রভাব একটা সময়ে অন্যভাবেও লক্ষিত হল। চিনের মুক্তিসংগ্রামের একটা পর্যায়ে মাও সাহিত্যিকদের তাতে অংশ নিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সে এমনই এক সময় যখন জনৈক চিনা লেখক টিং লিং-এর বয়ান অনুযায়ী, গত ছ’মাস তিনি ট্রেঞ্চে শুয়ে আছেন এবং দেশকে মুক্ত করা ছাড়া আর কোনও লক্ষ্য তাঁর সামনে নেই— সাহিত্য নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশই নেই!৩৩ অনেকটা এই মনোভাব নিয়েই বাংলার কমিউনিস্ট সংস্কৃতিফ্রন্টের নেতা চিন্মোহন সেহানবীশ সর্বভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘের চতুর্থ অধিবেশনে (১৯৪৯) বললেন— ‘ট্রেড ইউনিয়ন বা কিষাণসভার অবিশ্রান্ত কাজকর্মের ফলে যদি দু’চার বছর লেখা বন্ধও থাকে তাতেই বা কি এসে যায়। ইতিমধ্যে সেই কাজের মধ্যে দিয়ে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর মানসিকতার ক্ষেত্রে পলি পড়বেই— আগামী দিনের সোনালি ফসলের যা নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি। তাই বৈশাখের রুদ্রদাহ দেখে বিহ্বল না হয়ে ভরসা রাখতে হবে আষাঢ়ের অকৃপণ দাক্ষিণ্যে।’৩৪ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এতে আপত্তি করলেন। বললেন, এখানে তো চিনের পরিস্থিতি নয়, এখানে কোথায় রুদ্রদাহ? সাম্যবাদী লড়াই বেশ কোণঠাসা, বুর্জোয়া সংস্কৃতি মানুষকে লুব্ধ করার চেষ্টা করছে সদাসর্বদা। এখন যদি প্রগতিবাদী সাহিত্যিকরা লেখা বন্ধ করেন, পরিস্থিতি আরোই বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। লেনিনকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, বিপ্লবের জন্য শ্রমিক মতাদর্শ নয়, সমাজবাদী মতাদর্শ চাই। প্রগতি সাহিত্যকে শ্রমিকচেতনার স্তরে নামিয়ে আনা নয়, শ্রমিককে প্রগতি সাহিত্যের সৌন্দর্য উপলব্ধির মতো করে প্রস্তুত করা প্রয়োজন।৩৫ চিন্মোহন সেহানবীশ পরে আত্মসমালোচনা করে বলেছিলেন, এই তর্কটা চলার সময়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে বলেন, কৃষকসংগ্রাম নিয়ে লেখার জন্য লেখকদের তাতে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও চলবে। কারণ লেখকরা ত্রিনয়ন— তাঁরা গ্রামে উপস্থিত না থেকেও তাঁদের অতিরিক্ত চোখ দিয়ে দেখতে পান সেখানে কী হচ্ছে। সেহানবীশ আরও বলেন— কয়েক দিনের মধ্যেই মানিক সত্যি করেই লিখলেন তাঁর অসাধারণ গল্প ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’— সুন্দরবনে তেভাগা আন্দোলনের অগ্রণী গ্রাম বড় কমলাপুরকে নিয়ে। এটাও সেহানবীশ জানান যে, জেলে বসে সেই গল্প পড়ে তিনি দারুণ আপ্লুত হন এবং শেষপর্যন্ত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে সায় দেন।৩৬

বাংলার মার্কসবাদী নন্দনতাত্ত্বিকদের আরেক দাবি ছিল— সাহিত্যিক প্রচারকের ভূমিকা পালন করবেন, পার্টির নীতি ও মতাদর্শ প্রচার করবেন। তবে এই দাবিটি তুলনামূলকভাবে কম উচ্চকিত ছিল। তার কারণ হল মিনা কাউটস্কিকে লেখা এঙ্গেলসের চিঠিতে সরাসরি প্রচারমূলক সাহিত্যের বিরোধিতা— শুধু শৈল্পিক কারণে নয়, কার্যকারিতার কথা ভেবেই। এঙ্গেলস বলেছিলেন— পক্ষপাত যেন নিঃসৃত হয় উপন্যাসে নির্মিত পরিস্থিতি ও চরিত্রদের কার্যকলাপ থেকেই, সামাজিক সংগ্রামের আগাম ঐতিহাসিক সমাধানের কথা পাঠককে জানানোর কোনও দায় লেখকের নেই। বিশেষ করে পাঠকদের অধিকাংশ যেহেতু বুর্জোয়াশ্রেণিরই এবং হয়তো সরাসরি কমিউনিস্টও নয়, লেখক বুর্জোয়াসমাজ সম্পর্কে তাদের মোহভঙ্গ ঘটাতে পারলেই কাজের কাজ করবেন।৩৭ বাংলায় মাঝে মাঝে প্রচারের পক্ষে মত ব্যক্ত হয়েছে (যেমন পরিচয়-এ চিদানন্দ দাশগুপ্তের ‘প্রচারবাদী সাহিত্য’,৩৮ বা নবপর্যায় পরিচয়-এ ননী ভৌমিক৩৯), কিন্তু নিচু গলায় এবং খুব বেশি নয়। তবে ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’ আর প্রোলেতারীয় সাহিত্যের দাবি তো আদতে প্রচারমূলক সাহিত্যেরই দাবি ছিল।

আবু সয়ীদ আইয়ুব ছিলেন মার্কসবাদ-বোদ্ধা কিন্তু মার্কসবাদী নন। মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী মহলের সঙ্গে তাঁর ভালই পরিচয় ছিল। তিনি নবপর্যায় পরিচয়-এ মার্কসবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন এই বলে যে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিই চরম লক্ষ্য নয়, মানবমুক্তি ও আনন্দের কাম্য লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। যে সাহিত্য সচেতনভাবে নতুন অর্থনীতি আনার জন্য সচেষ্ট তার উপকরণ মূল্য আছে, সেটা ‘ফলিত সাহিত্য’। কিন্তু ‘বিশুদ্ধ সাহিত্য’ বলে একটা ব্যাপারও আছে, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের মতোই— যার ভিত্তি ‘সত্য-শিব-সুন্দর’-এর মতো চরম মূল্য।৪০ মূলধারার মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরা আইয়ুবের বক্তব্যের প্রবল প্রতিবাদ করেন এবং এ নিয়ে বেশ বড় বিতর্কের সূচনা হয়।৪১ শীতাংশু মৈত্র যেমন বলেন— চরম মূল্য বলে কিছু নেই। জ্ঞান, বোধ ইত্যাদিকে যদি চরম মূল্য বলা হয়, তাহলে একমাত্র বিপ্লবই তার জন্ম দিতে পারে। উপনিষদ-কথিত সত্য-শিব-সুন্দরের উদ্ধৃতি তাঁর কাছে আইয়ুবের প্রতিক্রিয়াশীলতারই প্রমাণ বলে মনে হয়।৪২ কিন্তু মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীদেরও কেউ কেউ কখনও কখনও সাহিত্যের চরম মূল্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন। হয়তো তাঁদের মনে হয়েছে সেই চরম মূল্যের যথাযোগ্য স্বীকৃতি বিপ্লবোত্তর যুগেই আসতে পারে। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর পর সুশোভন সরকার তাঁর একটি মূল্যায়ন করেন পরিচয় পত্রিকায়।৪৩ তিনি বলেন, আসলে এই মহাকবি ও মহৎ শিল্পী কতগুলি বিশিষ্ট রাষ্ট্রিক, সামাজিক বা দার্শনিক বিশ্বাসের চাইতে অনেক বড়। আর অগ্রগতি ও কাঙ্ক্ষিত বিপ্লবের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের দু’ধরনের প্রাসঙ্গিকতা তিনি লক্ষ করেন— এক, ভারতীয় ঐতিহ্যের নানা সংস্কার তাঁর মধ্যে থাকলেও, পরিবর্তনের প্রবহমান স্রোতে তাঁর অন্তর সবসময় সাড়া দিত এবং এ ব্যাপারে তিনি নির্ভীক ছিলেন; দুই, বুর্জোয়া সংস্কৃতি স্বভাবতই ক্ষুদ্র সামাজিক গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। সেই গণ্ডি ভেঙে যেদিন শ্রেণিহীন সমাজ গড়ে উঠবে রবীন্দ্রসাহিত্যের মর্যাদা সেদিন বাড়বে বই কমবে না, কারণ ভাষা, আঙ্গিক, আনন্দরস ও সৌন্দর্যসৃষ্টির ক্ষেত্রে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর অবদান। সাহিত্যের চরম মূল্যের স্বীকৃতি তথা বিপ্লবোত্তর যুগে তার সার্থকতার উজ্জ্বলতর সম্ভাবনার কথা বিষ্ণু দের গভীর ভাবনামূলক প্রতর্কের মধ্যেও ছিল, যা নিয়ে পরে আমাদের আলোচনা করতে হবে।

আপাতত এই প্রসঙ্গে এটাও হয়তো যোগ করে দেওয়া যায় যে, শুধু সৌন্দর্যচেতনা ও সুখানুভূতির দিক দিয়ে পাঠককে সমৃদ্ধ করা নয়, সাহিত্যের চরম মূল্যের আরেকটি ভিত্তি মানবমন ও জীবনের নেতিবাচক দিকগুলিকে তুলে ধরা। অর্থনৈতিক সমতা এলেই যে মানুষের সব দুঃখ-কষ্ট ও সংগ্রামের অবসান হবে তা নয়। তারপরেও জীবনে থাকবে আলোর সঙ্গে অন্ধকার। মনের গভীরে থেকে যাবে নানা ভয়-ভীতি, অবসাদ, বেদনা ও অর্থহীনতার বোধ। এসব যে-সাহিত্যের উপজীব্য তার চরম মূল্যও অক্ষত থাকার কথা বিপ্লবোত্তর যুগে।

বাংলায় অন্তিম-ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগের গোড়ার দিকে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের প্রধান দু’টি কার্যকারিতা— সাহিত্যের সংবেদনশীল পাঠ এবং সাহিত্যের কাছে বৈপ্লবিক উপযোগিতার দাবি— এ দু’টি দিককে স্পষ্টতই মেলানো যায়নি। প্রথমটির সেরা দৃষ্টান্ত হিসেবে বিষ্ণু দের উল্লেখ করা যায়; আর দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, যদিও এমন নয় যে প্রথমজন বিপ্লববিমুখ ছিলেন বা দ্বিতীয়জন সাহিত্যবোদ্ধা ছিলেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধান্তে সাধারণভাবে এক জঙ্গি মেজাজ ব্যাপৃত হয়েছিল জনমানসে এবং তেভাগার দাবিতে কৃষক আন্দোলনের কথা শোনা যাচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই, তবুও ১৯৪৬ সালের মে মাসে মৌভোগে কিষান সমাবেশের সময়েও কিন্তু পার্টি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারেনি, তেভাগার ডাক দেয়নি। এই সমাবেশ উপলক্ষে রচিত বিষ্ণু দের কবিতা ‘মৌভোগ’-এ (‘জন্মে তাদের কিষান শুনি কাস্তে বানায় ইস্পাতে—’) কিন্তু কৃষকের সংগ্রামী মেজাজ প্রত্যক্ষভাবে ধরা পড়ে— ‘নীলকমলের আগে দেখি লালকমল জাগে/ তৈরি হাতে নিদ্রাহারা কঠিন তলোয়ার/ লাল তিলকে ললাট রাঙা ঊষার রক্তরাগে/ কার এসেছে কাল!’৪৪ আর বিষ্ণু দের শিল্পসাহিত্য উপলব্ধির পরিচয় ছড়িয়ে আছে তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে। সে উপলব্ধিতে একাধারে ধরা দিয়ে বাঁধা পড়ে আপাতভাবে খুব আলাদা ধরনের শিল্পসাহিত্য— নানা দেশ-কালের নানা শিল্পীর, যার কোনওটা ধ্রুপদি কোনওটা-বা লৌকিক চরিত্রের। সাহিত্যের ভবিষ্যৎ বইটির ‘পরিবর্তমান এই বিশ্বে’ নামে প্রবন্ধে তিনি বলেন— ‘মার্কস থেকে বিকশিত সমগ্রতার পটেই কি বার্টকের হারমনির সুরেলা এবং দেশজ ছন্দে বিস্তৃত আধুনিকতা সুবোধ্য নয়? ব্লখ বা ওঅলটনের বেলায় এই কথাই কি ভিন্নভাবে প্রযোজ্য নয়? চিত্রে কিউবিসমের মতো সঙ্গীতে জ্যাজ পরিপ্রেক্ষিতের অচলায়তন ভেঙেছে বলেই কি রয়হ্যারিস বা কিছু সোভিয়েট সঙ্গীতের বর্তুল শব্দলহরীর তীব্র ঐকতান?’৪৫ অন্য দিকে লক্ষণীয় সাহিত্যের মাধ্যমে বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করার জন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র তাগিদ, ভেতরে-বাইরে সে পথের যত বাধা সেগুলি অনুধাবন ও বিশ্লেষণের জন্য তাঁর নিজের গল্প-উপন্যাসে সাহসী পরীক্ষানিরীক্ষা, যা তাঁর লেখাকে আলাদা করেছিল সে যুগের অধিকাংশ মার্কসবাদী লেখকের লেখনীজাত সরল ও একরৈখিক বিপ্লবপ্রক্রিয়ার ছবি থেকে। শুধু শত্রুপক্ষের অত্যাচার নয়, সাম্যবাদীদের নিজেদের বিশ্রেণিকরণের প্রক্রিয়াও যে সহজ সমস্যা নয় (উল্লেখযোগ্য দর্পণ উপন্যাস), অথবা শোষকের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির লড়াইয়ের সঙ্গে স্বীয় কাজের বিশেষজ্ঞতার মর্যাদারক্ষা তথা আত্মমর্যাদার লড়াইও যে খুব বড় কথা— এসব তিনি যেভাবে দেখিয়েছেন তা সত্যি তুলনারহিত। বিপ্লবী তাগিদের তীব্রতায় তিনি এক দিকে যেমন বিষ্ণু দেরও নিন্দা করেছেন, অন্য দিকে মূলধারার মার্কসবাদী নন্দনতাত্ত্বিকদেরও সমালোচনা করতে ছাড়েননি। বলেছেন, বুর্জোয়া সাহিত্যের নির্বিচার প্রশংসা যদি ‘দক্ষিণপন্থী সংস্কারবাদ’ হয়, কোনও বিকল্পের সন্ধান না দিয়ে স্বদেশের গোটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নস্যাৎ করে দেওয়া আর সাহিত্যিককে লেখা বন্ধ করে কৃষকদের লড়াইয়ে অংশ নিতে বলা আসলে বৈপ্লবিকতার নামে ‘বামপন্থী সংস্কারবাদ’, যার ফলশ্রুতি ১৯৪৯-এ প্রগতি লেখক সংঘের চতুর্থ বার্ষিক সম্মেলনে শেষপর্যন্ত দক্ষিণপন্থীদের কাছেই ‘বিপ্লববাদী’দের আত্মসমর্পণ এবং সংঘের তরফে বিপ্লবের প্রাণহীন আবাহন করে একটি ঘোষণাপত্রের প্রকাশ— যার সবটাই সংগ্রামবিমুখ ফর্ম্যালিজ়ম।৪৬

মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের উল্লিখিত দুই কার্যকারিতার মধ্যে, অর্থাৎ বিষ্ণু দে ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে, বিরোধ হয়তো মিটতে পারত মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের তৃতীয় বিকল্প কার্যকারিতার ওপর গুরুত্ব দিলে। অর্থাৎ, অ-বৈপ্লবিক সামাজিক পরিস্থিতিতেও শিল্পসাহিত্য কি কোনওরকম মতাদর্শগত পরিবর্তন নিয়ে আসার ক্ষমতা রাখে?— এই প্রশ্নটির মোকাবিলা করলে। এবং প্রশ্নটির মোকাবিলায় একবগ্গা হয়ে না থেকে একটি দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি অবলম্বন করলে। অবশ্যই তাতে জোর গলায় কোনও দাবি রাখা সম্ভব হত না শিল্পীসাহিত্যিকদের কাছে, কিন্তু শিল্পসাহিত্যের ওপর একটা ইতিবাচক আস্থা রাখা যেত এবং ফলে শিল্পসাহিত্য হয়তো সত্যি করেই একটা শুভংকর ভবিষ্যতের দিকে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রক্রিয়ায় বড় ভূমিকা পালন করতে পারত। আমরা আগেই বলেছি যে, মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের এই তৃতীয় কার্যকারিতা খুব গুরুত্ব পেয়েছিল পশ্চিমি মার্কসবাদীদের কাছে। কিন্তু সেরকম কোনও বিকল্পের সম্ভাবনা বাংলায় অন্তিম- ও উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগের গোড়ায় বিশেষ ছিল না। সে যুগের বাঙালি মার্কসবাদীরা চূড়ান্ত বিপ্লববিভ্রমে ভুগছিলেন; আর সমাজ-রাজনীতির ক্ষেত্রে যত-না বৈপ্লবিক লড়াই করছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি করছিলেন সাহিত্যক্ষেত্রে (যদিও আমাদের চেনা মার্কসবাদী তত্ত্বে সাহিত্যক্ষেত্র নেহাত ভিত্তিভূমির ওপর উপরি-কাঠামো মাত্র!)। সেই সময়ে তাঁরা নানান উগ্র অসম্ভব দাবি সাহিত্যিকদের কাছে রেখে তীব্র বিদ্বেষ ও তিক্ততার আবহ তৈরি করছেন, বন্ধুভাবাপন্ন সাহিত্যিকদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। অথচ মজার কথা, এই ধরনের সমালোচক নিজে যখন সাহিত্য রচনা করছেন, তখন সেসব বৈপ্লবিক দাবি প্রায়শই মেটাতে পারছেন না, হয়তো উলটো পথেই হাঁটছেন। দু-একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় সমর সেনের সমালোচনা করেছিলেন ‘flaw of passivity’-র (নিষ্ক্রিয়তা দোষে দুষ্ট )। তাঁর নিজের কাব্যগ্রন্থ হিমাচল আসমুদ্র রুদ্র যখন প্রায় একই কারণে— কোমল আবেগধর্মিতার জন্য— সমালোচিত হল মণীন্দ্র রায়ের কলমে, তিনি প্রতিবাদ করে বললেন পূর্বস্থিরীকৃত ধারণার সাহায্যে কোনও নতুন শিল্পকর্মের বিচার অনুচিত।৪৭ কথাটা যদিও সমর সেন সম্পর্কে মঙ্গলাচরণের সমালোচনা সম্পর্কেও প্রযোজ্য হতে পারত। একইরকম দ্বৈততা দেখা যায় এক দিকে সমালোচক ও অন্য দিকে কবি সরোজ দত্তের মধ্যেও।৪৮

তবু সে যুগের বাংলায় মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের মধ্যে তৃতীয় বিকল্পের সম্ভাবনা যেটুকু ছিল সেটা আমরা প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে বুঝে নেবার চেষ্টা করব। আমাদের মনে হয় এই সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি ছিল বিষ্ণু দের মধ্যে। বিষ্ণু দে নিজেকে পার্টির সহযাত্রী ভাবতেন। পার্টির অনেকের সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব ও সমভাব ছিল। তাঁর সংগ্রামী চেতনা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু পার্টি মোটের ওপর তাঁকে প্রগতিশিবিরে ‘ট্রজান হর্স’ বলেই মনে করত। পরিচয়-এ বিষ্ণু দে স্বাগত ছিলেন। কিন্তু অগ্রণী পত্রিকায় তাঁর একটা লেখাও প্রকাশ হয়নি, যদিও অরণি-তে কিছু বেরিয়েছিল। পরে পার্টির প্রতিকূলতার কারণে তাঁকে সাহিত্যপত্র প্রকাশ করতে হয় বিকল্প মতের বাহক হিসেবে। তাঁর ফর্মের কাঠিন্য ও জটিলতার যে অভিযোগে সদা মুখরিত থাকতেন অনেক মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী, সে সম্পর্কে বিষ্ণু দে নিজেও অস্বস্তিতে ভুগতেন। জানতেন পাঠকসমাজের সঙ্গে তাঁর যোগ ‘ক্ষীণ ও জটিল’, যার জন্য তিনি মূলত দায়ী করতেন ধনতান্ত্রিক সমাজকে। ‘কেন লিখি’ প্রশ্নটির উত্তর দিতে গিয়ে তাই তিনি ‘সামাজিক চাহিদার চেয়ে ব্যক্তিগত প্রকাশ-ইচ্ছার পরীক্ষানিরীক্ষা’র ওপরেই জোর দেন। ‘কিসের প্রকাশ’ প্রসঙ্গে অবশ্য বিড়ম্বিত ‘সমাজচৈতন্যের ভুক্তাবশেষ’-জনিত অস্থিরতার কথা বলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে টেকনিক নিয়ে চিন্তাভাবনার সপক্ষেও যুক্তি দেন— ‘ট্রেড ইউনিয়ন কি বলে না, যেকোনও কাজে চরম বিশেষজ্ঞতা অর্জন নিতান্ত প্রয়োজন?’ (যদিও শ্রমিক সম্পর্কে এই ভাবনা সে যুগের মার্কসবাদী মহলে দুর্লভ ছিল, একমাত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শিল্পী’র মতো গল্পেই তার আভাস পাওয়া যায়।) ‘কেন লিখি’ প্রবন্ধে বিষ্ণু দে আশা করেন, যদিও লেখকের শ্রম প্রত্যক্ষ নয় এবং অধরা চৈতন্যের সঙ্গে লিপ্ত, তবু কমিউনিস্ট-চালিত প্রগতি লেখক সংঘ ট্রেড ইউনিয়নের মতোই লেখকদের এই বিশেষজ্ঞতার অধিকার সুরক্ষিত করবে। শেষপর্যন্ত তাই তিনি সান্ত্বনা খোঁজেন ‘সাহিত্যিক গণ্ডি ছাড়িয়ে— কমিউনিস্ট পার্টিতে’ই। আশা করেন, একদিন আসবে যেদিন মার্কসবাদ লেখক ও পাঠকের মানবসম্বন্ধ সুষ্ঠুভাবে স্থাপন করবে।৪৯ আবার, বিষ্ণু দে সে যুগের মার্কসীয় গোঁড়ামির সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে ছিলেন বলেও মনে হয় না। তাঁর ‘সোভিয়েট শিল্পসাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে সেদেশের নান্দনিক ক্ষেত্রের সব কিছু সম্পর্কে তাঁর অবাধ উচ্ছ্বাস লক্ষণীয়।৫০ এই সমস্যায় সে যুগের মার্কসীয় বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই ভুগতেন। সোভিয়েতের কোনও কিছু সম্পর্কে— সে তত্ত্বই হোক বা কার্যকলাপ— কোনও সন্দেহ মনে জাগলেও বিশ্বের একমেব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির প্রতি আনুগত্য তাঁদের আবশ্যিক মনে হত। ফলে স্বজ্ঞার বিপরীতে গিয়ে নানান যুক্তি সাজিয়ে সোভিয়েতকে বাধ্যত সমর্থন করতেন। সব সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখেও প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে আমরা যেটা দেখব তা হল বিষ্ণু দে কীভাবে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের মূল সমস্যাটিকে (অর্থাৎ অ-বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে শিল্পসাহিত্য কীভাবে শ্রেয়স্কর পরিবর্তনের সম্ভাবনা জাগাতে পারে) চমৎকার ধরতে পেরেছিলেন, যা তাঁকে সেই নন্দনতত্ত্বের তৃতীয় বিকল্পের সন্ধান দিয়েছিল। এইভাবে ‘পশ্চিমি মার্কসবাদ’-এর গুরুত্বপূর্ণ চর্চার পূর্বাভাস দেখা গিয়েছিল তাঁর মধ্যে।

বাংলায় মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের তৃতীয় বিকল্পের সম্ভাবনা

তার আগে আমাদের ‘পশ্চিমি মার্কসবাদ’ ব্যাপারটা একটু বুঝে নিতে হবে।৫১ এটি কোনও আঁটোসাটো তত্ত্ব নয়। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত সব চিন্তকই উপলব্ধি করেছিলেন যে, মানবচেতনার মুক্তির প্রক্রিয়ায় শিল্পসাহিত্যের একটা বড় ভূমিকা থাকতে পারে। তাঁরা বুঝেছিলেন, দৈনন্দিন যে বাস্তব আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে রাখে, তার চেয়ে উৎকৃষ্টতর ও প্রত্যয় জাগানোর মতো বাস্তবের সন্ধান শিল্পসাহিত্য আমাদের দিতে পারে। কথাটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। সাহিত্যে যে সত্যতর, সম্পূর্ণতর ও প্রবলতর বাস্তবের সন্ধান মেলে সেটা আরিস্ততল থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনেকেই বলেছেন। মনে পড়বে রবীন্দ্রনাথের ‘সেই সত্য যা রচিছ তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নয়/ কবি, তব মনোভূমি রামের জনমভূমি অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ বস্তুত, গোড়ার দিকের মার্কসীয় চিন্তকদের অনুভবেও এটা ছিল। তবুও কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়— চারদিকের বস্তুকামিতা ও বিচ্ছিন্নতার আবহে সাহিত্য এই যে আলোকিত ও মুক্ত চেতনার সন্ধান আমাদের দেয় বলে দাবি করা হচ্ছে, সেটা কীভাবে সম্ভব? এই চেতনা কি আমাদের দিনানুদৈনিকের গতিশক্তি থেকেই সঞ্জাত? না কি তার বাইরে থেকে— হয়তো কোনও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের স্বয়ংক্রিয় শক্তি থেকে— উৎসারিত? মার্কস বা প্রথম যুগের মার্কসবাদীরা কিন্তু এই প্রশ্নের কোনও স্পষ্ট উত্তর দেননি।

আমরা লুকাচের চিন্তার অনুসরণ করে বিষয়টির মধ্যে প্রবেশ করতে পারি।৫২ বাহ্যত লুকাচ সোভিয়েত নন্দনতত্ত্বের ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’-এরই সমর্থক ছিলেন, এমনকী তাঁকে ‘ঝ্‌দানভবাদের শেক্সপীয়ার’-ও বলা হত। কিন্তু তাঁর চিন্তায় বাস্তববাদ ঠিক বাস্তবানুগতা বা প্রকৃতিবাদ (naturalism) ছিল না এবং তা ছিল অনেক বেশি মানবিকতা-মণ্ডিত। প্রতিদিনের সাধারণ চিন্তায় বাস্তবের ভ্রান্ত প্রতিফলনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বস্তুকামিতাকে প্রত্যাঘাত হানার যে ক্ষমতা সাহিত্যের আছে, তার উৎস হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন সাহিত্যিকের বাস্তব সম্পর্কে ‘সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি’ (totalizing perspective)-কে। তাঁর মতে, এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যেই সাহিত্য খণ্ডিত-বিকৃত বাস্তবের ওপর-ভাসা চেহারা শুধু না দেখে বাস্তবের সারাৎসারকে সামগ্রিকভাবে ধরতে পারে, এবং এইভাবে দৈনন্দিন বাস্তবকে নতুন করে আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে নিয়ে আসে। সুতরাং লুকাচের বাস্তববাদ ঠিক বাস্তবের সঙ্গে মেলে না, বরং তা বাস্তবের প্রতিদ্বন্দ্বী। বাইরের জড়বাস্তবটুকুই শুধু চেতনায় প্রতিফলিত হয়— ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’-এর এই ধারণা তিনি মানতেন না। তিনি বলেন, চেতনার উৎস বাইরের বাস্তবের ভেতরেও যেমন, তেমনি বাইরেও। তাঁর আরও দাবি— সাহিত্যিকের এই বাস্তববোধ কোনও সচেতন মহৎ উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাও হতে পারে, স্রেফ তাঁর সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই জন্মাতে পারে। সেজন্য তিনি সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের ‘অন্তঃস্থ দৃষ্টিভঙ্গি’র থেকে সাহিত্যের ‘মহান বাস্তববাদী ঐতিহ্যের’ (বালজাক, তলস্তয় প্রমুখের) ‘বহিঃস্থ পদ্ধতি’ই বেশি পছন্দ করতেন। কান্টের মতো তিনি সমাজবাস্তব থেকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন কোনও চেতনাকে সাহিত্যের উৎস হিসেবে ভাবতে চাইতেন না, আবার সাহিত্যে নীতিশিক্ষা দেওয়াও তাঁর পছন্দ ছিল না। সরাসরি বিপ্লবের প্রচার তাঁর কাছে একেবারেই কাম্য ছিল না। তিনি সাহিত্যকে ‘মানবিক প্রস্তুতি’র মাধ্যম হিসেবেই দেখতেন, কোনও বিশেষ কর্মসম্পাদনের প্রত্যক্ষ সহায়ক হিসেবে নয়।

লুকাচের বাস্তববাদে কিছু স্ববিরোধিতা ছিল। স্বতঃস্ফূর্ত ‘বহিঃস্থ পদ্ধতি’র ওপর জোর দিলেও তিনি পণ্যাসক্ত বাস্তব থেকে উত্তরণের জন্য বাস্তববাদী সাহিত্যিকের তরফে কিছু বিশেষ মননগত প্রয়াসও দাবি করেছিলেন। এই দাবি শুধু লেখকের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে না, একটি লেখা পড়ে পাঠক কীভাবে পণ্যাসক্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত হয়ে বাস্তব সম্পর্কে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করবে সে প্রশ্নও তুলে দেয়। পাঠকের কাছেও স্বতন্ত্র মননগত প্রয়াসের দাবি করলে সেটা তো খুব বেশি দাবি হয়ে যাবে! শুধু তা-ই নয়, এতে মননে ধার দেবার নামে (হয়তো-বা ‘বিজ্ঞান’-এর দোহাই দিয়ে) কোনও বিশেষ রাজনৈতিক কর্তৃত্বের (পড়ুন ‘কমিউনিস্ট পার্টি’) যথেচ্ছাচারিতার সম্ভাবনাও তৈরি হয়। তাহলে কি সত্যি সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের পণ্যাসক্ত বাস্তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই? একটা সময় পর্যন্ত লুকাচ তাঁর নন্দনতত্ত্ব চর্চায় এই জায়গাটায় আটকে গিয়েছিলেন। তবু স্বীকার করতে হবে যে, তিনি মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের মূল সমস্যাটি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছিলেন, যা বাঙালি মার্কসবাদীরা মোটের ওপর এড়িয়েই গিয়েছিলেন। বাংলায় তাঁরা বাস্তববাদ ও প্রকৃতিবাদ গুলিয়ে ফেলেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন শুধু শিক্ষামূলক সাহিত্য। তাঁদের নন্দনতত্ত্বের যান্ত্রিকতা প্রায় অবমানবায়নের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।

পরবর্তীকালেও যে বাংলায় মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব বিবর্তিত হয়ে তেমন কোনও সংবেদশীলতা অর্জন করেছিল তা বলা যায় না। লুকাচের তাত্ত্বিক ভাবনা কিন্তু বিবর্তিত হয়েছিল। নি-স্তালিনীকরণের পর্বে তিনি প্রতিদিনের বাস্তবের গতিশক্তির মধ্যে বস্তুকামরহিত চেতনার সন্ধান করতে গিয়ে ব্যক্তিমানুষ ও মানবসত্তার আবহমান কালের একটি ‘অত্যাবশ্যক তাগিদ’ (vital need)-কে চিহ্নিত করেন। এটি হল বিষয়মুখী জ্ঞানের (objective knowledge) সামগ্রিকতা ও এক শ্রেয়স্কর পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষা। লুকাচের এই চিন্তা স্পষ্টতই মার্কসের ‘প্রজাতিগত অস্তিত্ব’ (species being) ও ‘মানবিক সারসত্তা’ (human essence)-র ধারণা দ্বারা প্রভাবিত। লুকাচ সেই সময়ে আরও বলেন যে, এই তাগিদ মানুষের কোনও সহজাত গুণ নয়— নিজেকে ক্রমশ পরিবর্তন করতে করতে, নিজের ভেতরকার ক্ষমতা জাগিয়ে তুলতে তুলতে, বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করতে করতে, ইতিহাসের ক্রমান্বয়ী পথ ধরে মানুষের মানবিকতার দিকে যাত্রা। লুকাচের নন্দনতত্ত্বও এইভাবে আরও মানবিক হয়ে ওঠে ১৯৬০-এর দশক নাগাদ।৫৩ বাস্তব সম্পর্কে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি যে মানুষের ভিতরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন ও সেই প্রয়োজনবোধটি যে দৈনন্দিন বাস্তবের অভিজ্ঞতা থেকেই উৎসারিত তা তিনি এবার বুঝলেন ও বোঝাতে পারলেন। বাইরে থেকে বৈপ্লবিক চেতনাকে সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার না করেও তাঁর তত্ত্ব আরও গণতান্ত্রিক হয়ে উঠল।

এই সময়টায় লুকাচের কণ্ঠে আমরা প্রগাঢ় মানবিকতা স্পন্দিত হতে শুনি— ‘আমাদের প্রজাতিগত চরিত্রকে হাসিল করার জন্য বিশেষ ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে ধ্বংস করা নিষ্প্রয়োজন। সেই ব্যক্তিত্ত্ব আমাদের প্রজাতিগত চরিত্রকে আরও সমৃদ্ধই করবে। বরং ধনতান্ত্রিক সমাজের আওতায় ব্যক্তিত্বের যে একমাত্রিকতা সেটাই ঐতিহাসিকভাবে তৈরি হয়ে ওঠা মানবিক ক্ষমতার বৈরী।’ আমাদের প্রতিদিনের চেতনা হয়তো পার্থিবতায় আচ্ছন্ন, কিন্তু তারই তলায় তলায় থাকে যে প্রজাতিগত চেতনা তা ওই দৈনন্দিনতার মধ্যেই মুক্তি পেতে পারে, আর এইভাবেই মিলে যায় মানুষের ব্যক্তিক ও সর্বজনীন সত্তা। সাহিত্যিকের ‘সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি’ তাই ‘বর্ধিত বিষয়মুখিতা’ (increased objectivity)-র সঙ্গে জড়িয়ে থেকে গভীরতর বিষয়িত্ব তথা ব্যক্তির বিচিত্র সম্ভাবনা সম্পর্কেও আমাদের সজাগ করে তোলে। বলা যায়, এইভাবে যেন চেতনা চৈতন্য হয়ে ওঠে এবং ব্যক্তি হয়ে ওঠে সর্বজনীনতায় অসীম।

পশ্চিমি মার্কসবাদীরা, বিশেষত ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের অনেকেই, সমাজজীবনের বিচ্ছিন্নতা থেকে মানুষের উত্তরণ প্রসঙ্গে ক্রমে বেশি বেশি করে বলতে লাগলেন মানুষের ‘চরম তাগিদ’ (radical need)-এর কথা। লেখকের রাজনৈতিক অবস্থানের থেকে ও তাঁর মানবিক মূল্যবোধ তাঁদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হল এবং তাঁরা সাহিত্যের স্বয়ংক্রিয় ভূমিকার পক্ষে সওয়াল করলেন। তাঁদের নিজেদের মধ্যে অনেক মতপার্থক্য ছিল। অনেক অ-মার্কসীয় উৎস থেকেও তাঁরা চিন্তার প্রেরণা পেয়েছিলেন। সবাই যে লুকাচের মতো আশাবাদী ছিলেন তাও নয়। যেমন মার্কিউজ ও আডোর্নো-র মতে, যন্ত্রসভ্যতা-লালিত গণসংস্কৃতিতে ‘চরম তাগিদ’ তথা বিপ্লবের সম্ভাবনা একেবারেই হারিয়ে গেছে। তবে মার্কিউজ বলেন, ধ্রুপদি শিল্পসাহিত্য এ ব্যাপারে মানুষকে সাহায্য করতে পারে। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের বেনইয়ামিন আবার ধর্মকে খুব গভীরভাবে জড়িয়ে থাকতে দেখেছেন ‘চরম তাগিদ’-এর সঙ্গে। অন্য দিকে আলতুসের-কে পশ্চিমি মার্কসবাদের অন্তর্ভুক্ত করে দেখলে সেখানে রীতিমতো এলিটিস্ট পক্ষপাত লক্ষ করা যায়। তাঁর মতে, বাইরে থেকে আহৃত কোনও ‘বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব’ই শুধু বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে এবং সেই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অনেকটাই স্বয়ম্ভূ। শিল্পায়নের যে স্তরে এসে সমাজে বুর্জোয়া- ও শ্রমিক-শ্রেণি উভয়েরই আত্মপ্রত্যয় ও উদ্দেশ্যর বোধ হারিয়ে গেছে, যেখানে অব্যবহিত অভিজ্ঞতা থেকে চেতনার জাগৃতির আর কোনও সম্ভাবনা নেই, সেখানে এটাই একমাত্র পরিবর্তনের পথ বলে তাঁর মনে হয়েছিল। এইভাবে কিন্তু তাঁর তত্ত্বে মানুষের বিষয়িত্ব অস্বীকৃত হল, মার্কসবাদের মানবিক দিকটি আবার চাপা পড়ে গেল, এবং ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ এলিট গোষ্ঠী, পার্টি ও তার আমলাতন্ত্রের ভূমিকায় জোর পড়ল।

মোটের ওপর দেখতে গেলে কিন্তু পাশ্চাত্যের মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বে ক্রমেই জোরালো হয়ে ওঠে ‘চরম তাগিদ’-এর তত্ত্ব— ধনতন্ত্রই যে-তাগিদের জন্ম দেয় এবং যে-তাগিদ ধনতন্ত্র সম্পর্কে মানুষের অসন্তোষের সঙ্গে সমপ্রমেয়। এই তাগিদই লেখক ও পাঠক উভয়ের মধ্যে বৈপ্লবিক সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। পাঠকের মনও তো আর tabula rasa বা ফাঁকা গ্রামোফোন রেকর্ড নয় যেখানে কোনও রচনা প্রথম দাগ কাটছে। ‘চরম তাগিদ’ পাঠকের মনের মধ্যেও কোনওভাবে থাকে। সামগ্রিকতার দৃষ্টি নিয়ে লেখা রচনা সেই তাগিদের কাছেই আবেদন রাখে, তাকেই আরও শক্তিশালী করে তোলে।৫৪

এইবার আমরা বিষ্ণু দের প্রসঙ্গে আসতে পারি। আমরা আগেই দেখেছি, মার্কসবাদ তাঁর কাছে কখনোই একপেশে ভাবনা নয়, বরং দ্বন্দ্বময়তার দ্যোতক। তাই তিনি যেমন সাহিত্যে ভাব ও রূপের মিলমিশে বিশ্বাসী, তেমনই সাহিত্যরচনায় সামাজিক ভিত্তির সঙ্গে সক্রিয় ব্যক্তিমনের সম্পর্কস্থাপনও তাঁর কাছে জরুরি। ‘কেন লিখি’ প্রবন্ধটিতেই বলেছিলেন— ‘লেখক বা শিল্পী কর্তা এবং দালাল দু-ই একসঙ্গে।’ বলেছিলেন, ‘সমাজবিপ্লবের আগে সাহিত্যে বিপ্লব কল্পনাবিলাস মাত্র। আবার যে লেখক নিষ্ক্রিয়, নিছক agent মাত্র, তার লেখা জনপ্রিয় হলেও দুর্গত; যথা রহস্যলহরী, বসুমতীর অনেক কিছু।’ এই প্রসঙ্গে উগ্র বামপন্থীদের প্রতি তাঁর অভিমানও ব্যক্ত হয়েছিল— তাঁরা ‘লেখককে বাদ দিয়ে শুধু abstract সামাজিক চাহিদার কথাই বলেন’ বলে। সাহিত্যে সমাজচৈতন্য ও ব্যক্তিমনের দ্বান্দ্বিকতার এই ভাবনার চমৎকার প্রকাশ বিষ্ণু দের ‘বাংলাসাহিত্যে প্রগতি’৫৫ শীর্ষক প্রবন্ধেও—

কলাকৌশল বা টেকনিকের প্রগতি নির্ভর করে মানসের ব্যাপ্তি বা রূপান্তরে। আর এই মনের মানচিত্রে সৃষ্টির আবেগ থাকবে কি করে যদি সে জীবনের দিকে না তাকায়? সাধারণের জীবনেই তো এ মানস সরোবরের উৎস, যদিচ তার নীল জলে আকাশের ছবি প্রতিফলিত।

কিন্তু শুধু এটুকুই নয়, এই ‘মানস সরোবর’-এর গভীর গহন ‘চরম তাগিদ’টিকেও তিনি চিহ্নিত করেছিলেন লুকাচ বা পশ্চিমি মার্কসবাদীদের অনেক আগে, ‘সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’ প্রবন্ধে।৫৬ সেখানে মানবিক সারসত্তার পুনরুদ্ধারের বাসনায় মানুষের অন্তরের ‘চরম তাগিদ’-এর ওপর জোর দিয়েছিলেন। তার জন্য সে যুগের মার্কসবাদীদের মতো মানবেতিহাসের নিছক বস্তুবাদী ব্যাখ্যা না দিয়ে তিনি ব্যক্তিস্বরূপের বিকাশের সহায়ক এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার কথা বলেছিলেন এবং তাঁর বক্তব্য প্রতিষ্ঠার জন্য রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় নিয়েছিলেন, যে রবীন্দ্রনাথ তখন মার্কসবাদী মহলে বহুনিন্দিত—

সভ্যতার একটি বড় প্রত্যয় হচ্ছে ব্যক্তিত্ববোধ। কী করে সমাজ ও ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বাশ্রয়ী সম্বন্ধের দীর্ঘ ইতিহাসে এই ব্যক্তির স্বরূপ মর্যাদা পেতে লাগল, তার ব্যাখ্যা সভ্যতারই ইতিহাস। বহির্জগতে বিরুদ্ধশক্তি, অন্ধপ্রকৃতি, জন্তুজানোয়ার, হিংস্র গোষ্ঠীর দলাদলি যতদিন-না মানুষের শুভবুদ্ধির কর্তৃত্বে রূপান্তরিত হবার সম্ভাবনা পেয়েছে, ততদিন ব্যক্তির এই মহিমা কবিদের মনেও আসে নি। বাল্মীকি বা হোমর গোষ্ঠীর মহাকাব্যই রচনা করেছেন, রবীন্দ্রনাথই বলতে পেরেছেন ব্যক্তির স্বকীয়তার কথা:

‘বহুদিন মনে ছিল আশা

ধরণীর এক কোণে রহিব আপন মনে,

ধন নয়, মান নয়, একটুকু বাসা

করেছিনু আশা!’

(আমাদের মনে পড়ে, এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ‘একটুকু বাসা’র সঙ্গে ‘কিছু ভালবাসা’ আর ‘ধেয়ানের ভাষা’র আশাও ব্যক্ত করেছিলেন— ব্যক্তিক বিকাশ ও সার্থকতা অর্জনের জন্য।)

এরপর বিষ্ণু দে বলছেন—

ব্যক্তিত্বের স্বরূপ বিষয়ে যে-বোধ থেকে এই আশার জন্ম, সে-বোধ মানবসভ্যতার বিশেষ একটা পরিণতিতেই সম্ভব। কিন্তু এখনও সম্ভব নয় এই আশাকে সকলের পক্ষে সফল করা। ব্যক্তির এ-স্বাধীনতা কোথায়, যেখানে অর্থের প্রতিযোগিতায় ব্যক্তিত্বই পণ্যদ্রব্য মাত্র?

আরও বলছেন—

নানা লোভে ক্রূরতায় আজ আমরা ক্ষত-বিক্ষত। অভাবে যুদ্ধে প্রতিষেধ্য রোগে, অনাবশ্যক মৃত্যুতে আমাদের স্বপ্নগুলিও ছত্রভঙ্গ। তাই ঐকতান ছিন্নভিন্ন অন্ধকার কলকাতার উচ্চকিত রাস্তায় গলিতে। কিন্তু জীবন তবু হার মানে না, তার শিকড় আমাদের মনের গভীরে, দুর্মর প্রাণ নৈর্ব্যক্তিক আবেগে নির্নিমেষ চোখ মেলে থাকে, উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে দেশ, আসন্ন সমাজ কাঁপে চৈতন্যের সম্ভাবনায়, অবশ্যম্ভাবিতায় বীজকম্প্র নীল অন্ধকারে বর্শার ফলার মতো, পাহাড়ের চূড়ার মতন। বিসম্বাদের মধ্যেই উজ্জীবনের সমাধান এঁকে যায়, উদয়াচলে মেশে অস্তাচলের রক্তস্রোত, ভগ্নদূতের মুখে জাগে প্রবল আশা, প্রাণের কবি অতীতের সিঁড়ি ভাঙে আর গায় ভাবীকালের ভাষা।

মূলধারার সমকালীন মার্কসবাদী নন্দনতাত্ত্বিকদের সব সংকীর্ণতা ও স্থূলতার এমন মুখের মতো জবাব সে যুগে আর কোনও মার্কসবাদী চিন্তক দিতে পেরেছিলেন কি না আমাদের জানা নেই। কিন্তু ব্যক্তিবাদের ধারণা সে যুগের মার্কসবাদীদের কাছে একেবারেই গ্রাহ্য ছিল না, তাঁরা ব্যক্তিবাদ বলতে স্বার্থসর্বস্ব পার্থিবতাই শুধু বুঝতেন। বিষ্ণু দের বক্তব্যের গভীর তাৎপর্য বোঝা তাঁদের অধিকাংশের পক্ষেই অসম্ভব ছিল। সুতরাং মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের তৃতীয় বিকল্পের সম্ভাবনা ব্যতিক্রমী ব্যক্তিগত মননে জাগ্রত হলেও সেটির যথাযথ বিকাশ ও প্রসারের সুযোগ বাংলার মার্কসবাদ তৈরি করতে পারেনি।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

১. মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের ওপর একটি মূল্যবান বই Maynard Solomon (ed), Marxism and Art (Harvester Press: Brighton, 1979)। বইটি এই বিষয়ে মার্কস-এঙ্গেলস থেকে শুরু করে বহুসংখ্যক তাত্ত্বিকের লেখার সংগ্রহ। সলোমনের নিজের ভূমিকাটিও বিপুল গবেষণার ভিত্তিতে রচিত ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বর্তমান প্রবন্ধের এই প্রথম অংশটি উক্ত বইটির কাছে খুব ঋণী। এটি আমার নিজের বই, Anuradha Roy, Bengal Marxism : Early Discourses and Debates (Samya : Kolkata, 2014)-এর ‘The Development of an Exacting Aesthetic System’ শীর্ষক অধ্যায় থেকেও কিয়দংশে গৃহীত।

২. ১৯৩৪ সালেই সোভিয়েত লেখকদের কংগ্রেসে ঝ্‌দানভ (ও রাডেক) ‘socialist realism’-এর ডাক দেন। ১৯৪৬ সালে সোভিয়েত দেশের সাংস্কৃতিক নীতির দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়। জানা যায়, স্তালিনের আমলে সোভিয়েত রাশিয়ায় বহুসংখ্যক মানুষকে হত্যার জন্যেও ঝ্‌দানভ অনেকাংশে দায়ী।

৩. বর্তমান প্রবন্ধের এই অংশটি ও আমার উল্লিখিত গ্রন্থের উল্লিখিত অধ্যায়ে প্রদত্ত তথ্যসমূহ— যা অনেকটাই আমার গবেষণালব্ধ— তার সংক্ষিপ্তসার।

৪. ১৩৪১ বঙ্গাব্দে লিখিত ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ যা নতুন সাহিত্য— রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী সংখ্যা (১৯৬১)-য় পুনর্মুদ্রিত হয়।

৫. হিরণকুমার সান্যাল, পরিচয়ের কুড়ি বছর ও অন্যান্য স্মৃতিচিত্র (প্যাপিরাস : কলকাতা, ১৯৭৮), পৃ. ৮৭।

৬. দু’জনেই যুদ্ধের সময়ে ফরাসি প্রতিরোধ আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

৭. চিন্মোহন সেহানবীশ একটি সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছিলেন— তর্ক করতে করতে তিনি ও বিষ্ণু দে সহ বেশ কয়েক জন সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ-এর কফি হাউসে যান। সেখানে বিষ্ণু দে তাঁকে বলেন, ‘যদি এমন দিন আসে যেদিন আপনার পক্ষে পার্টির নির্দেশ অনুসারে কোনও মেয়েকে ভালবাসা সম্ভব হবে, সেদিনই আপনি পার্টির নির্দেশমতো কবিতা লেখায় সায় দিতে পারবেন।’

৮. বীরেন পাল, ‘বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি ধারা’ এবং ঊর্মিলা গুহ, ‘সাহিত্য বিচারের মার্কসীয় পদ্ধতি’, মার্কসবাদী, প্রথম সংকলন, অক্টোবর ১৯৪৮। দু’টি প্রবন্ধই ধনঞ্জয় দাশ সম্পাদিত মার্কসবাদী সাহিত্য-বিতর্ক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ধনঞ্জয় দাশের তিন খণ্ডের বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯৭০-এর দশকে, অখণ্ড সংস্করণ প্রকাশ করেছে করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ২০১৩।

৯. দু’জনেরই প্রবন্ধের শিরোনাম ‘বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা’। প্রকাশিত যথাক্রমে মার্কসবাদী, চতুর্থ সংকলন, জুলাই ১৯৪৯ ও পঞ্চম সংকলন, সেপ্টেম্বর ১৯৪৯। এই প্রবন্ধগুলি এবং অনুরূপ আরও বেশ কিছু প্রবন্ধ ধনঞ্জয় দাশ সম্পাদিত পূর্বোক্ত গ্রন্থে আছে।

১০. প্রবন্ধটি বিষ্ণু দে-র সাহিত্যের ভবিষ্যৎ ও অন্যান্য প্রবন্ধ নামে সংকলন গ্রন্থের (প্রথম সিগনেট সংস্করণ ১৩৫৯) অন্তর্গত।

১১. বুদ্ধদেব বসু একটা সময়ে প্রগতি শিবিরের বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন, ততদিনে অবশ্য সরে এসেছেন। যে রবীন্দ্রনাথের একদিন কঠোর সমালোচনা করেছিলেন তিনি, এই ইংরিজি বইয়ের প্রথমেই তিনি বলতে গেলে তারই প্রায়শ্চিত্ত করেন, যা অবশ্য বিষ্ণু দেকে খুশিই করে।

১২. এই তর্কবিতর্কগুলি বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে আমার Bengal Marxism (২০১৪) (পূর্বোক্ত) গ্রন্থের ‘Major Issues of the Aesthetic Debates’ অধ্যায়ে। এখানে সংক্ষিপ্ত করতে হচ্ছে।

১৩. বসুর বক্তৃতাটি আংশিকভাবে নেপাল মজুমদারের ভারতে জাতীয়তা, আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থের অন্তর্গত (চতুষ্কোণ প্রাইভেট লিমিটেড : কলকাতা, ১৯৭১)। সম্পূর্ণ বক্তৃতাটি আমি দেখেছিলাম নেপাল মজুমদারের সৌজন্যে।

১৪. নরহরি কবিরাজের রচনা ‘বিবেকানন্দের মত ও পথ’ প্রকাশিত হয় পরিচয়, কার্তিক ১৩৫১-তে। নীরেন্দ্রনাথ রায়ের প্রবন্ধ ‘বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা’ প্রকাশ হয় নবপর্যায় পরিচয়, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ, ১৩৫৭-তে। এই অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সব রচনাই ধনঞ্জয় দাশ সম্পাদিত মার্কসবাদী সাহিত্য-বিতর্ক গ্রন্থের অন্তর্গত (পূর্বোক্ত)।

১৫. নীরেন্দ্রনাথ রায়, ‘কবিতায় বক্তব্য’, শারদীয় পরিচয়, ১৩৫৩।

১৬. নীরেন্দ্রনাথ রায়, ‘বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা’, পূর্বোক্ত। দ্রষ্টব্য নীরেন্দ্রনাথের ‘সাহিত্যবিচারে মার্কসবাদ’ প্রবন্ধটিও (পরিচয়, বৈশাখ-আষাঢ়, ১৩৫৫)।

১৭. অগ্রণী, ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৯; ‘ছিন্ন কর ছদ্মবেশ’ শিরোনামে।

১৮. ‘অতি আধুনিক বাংলা কবিতা’, অগ্রণী, এপ্রিল, ১৯৪০।

১৯. ‘অতি আধুনিক বাংলা কবিতা’।

২০ . ‘বীরেন পাল’ ছদ্মনামে ভবানী সেনের পূর্বোক্ত প্রবন্ধ।

২১. ‘প্রকাশরায়’ ছদ্মনামে প্রদ্যোৎ গুহর পূর্বোক্ত প্রবন্ধ।

২২. ‘প্রতিবাদী সাহিত্য’, নতুন সাহিত্য, বৈশাখ, ১৩৫৫। যে ছোটগল্পটির কথা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন সেটি এরকম— স্বামী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হয়েছেন ও হাসপাতালে তাঁর দেহ আছে জেনে স্ত্রী হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছিলেন। পথে দেখলেন শান্তি মিছিল বেরিয়েছে। তিনিও অমনি চোখের জল মুছে মিছিলে যোগ দিলেন।

২৩. শারদীয় ডাক, ১৩৫৬।

২৪. গোলাম কুদ্দুস যেমন বলেছিলেন— বাস্তবে দুর্লভ হলেও সর্বদা সদর্থক চরিত্রই চিত্রিত করা উচিত। অবশ্য তারও প্রতিবাদ হয়। পরিচয়, মাঘ ১৩৫৬-তে অনিরুদ্ধ সান্যাল বলেন যা দুর্লভ তার চিত্রায়ণ কী করে বাস্তববাদ হবে!

২৫. ননী ভৌমিক, পরিচয়, অগ্রহায়ণ, ১৩৫৯।

২৬. সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, ‘প্রগতি সাহিত্যে নায়ক চরিত্রের ভূমিকা’, নবপর্যায় পরিচয়, আষাঢ়, ১৩৫৯।

২৭. ‘সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’, সাহিত্যের ভবিষ্যৎ গ্রন্থের (পূর্বোক্ত) অন্তর্ভুক্ত।

২৮. প্রকাশ রায় তথা প্রদ্যোৎ গুহর প্রবন্ধ, পূর্বোক্ত।

২৯. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা’, নবপর্যায় পরিচয়, পৌষ, ১৩৫৬।

৩০. স্বদেশ বসু, পূর্বোক্ত।

৩১. সরোজ দত্ত বুদ্ধদেব বসুর বক্তৃতার জবাবে ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯-এর অগ্রণী-তে যে প্রবন্ধটি লেখেন (পূর্বোক্ত) সেখানেই এমন কথা বলেন যে, শ্রমজীবী মানুষের জীবনের কোনও অভিজ্ঞতা ছাড়াই যে লেখক তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখান তিনি আসলে বিপ্লবের ক্ষতি করেন।

৩২. স্বদেশ বসু, পূর্বোক্ত।

৩৩. আনা লুই স্ট্রং-কে লেখা টিংলিং-এর চিঠি। মার্কসবাদী, প্রথম সংকলনে শরৎ চট্টোপাধ্যায় উদ্ধৃত করেছেন তাঁর ‘মহাচীনে শিল্পীদের জয়যাত্রা’ শীর্ষক প্রবন্ধে।

৩৪. চিন্মোহন সেহানবীশের পঠিত প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ‘সাহিত্য ও গণসংগ্রাম’ নামে, পরিচয়, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়, ১৩৫৬।

৩৫. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত।

৩৬. এই তর্কটির কথা সবিস্তারে আমাকে বলেছিলেন চিন্মোহন সেহানবীশ নিজে।

৩৭. Maynard Solomon সংকলিত ও সম্পাদিত পূর্বোক্ত Marxism and Art-এ উদ্ধৃত, পৃ. ৬৬। মিনা কাউটস্কি বিখ্যাত মার্কসীয় তাত্ত্বিক কার্ল কাউটস্কির মা— ও নিজে ঔপন্যাসিক। তাঁর লেখায় ‘tendentiousness’-কে এঙ্গেলস সমালোচনা করেন।

৩৮. পরিচয়, আষাঢ়, ১৩৫৩।

৩৯. নবপর্যায় পরিচয়, চৈত্র, ১৩৫৯।

৪০. আইয়ুব, ‘সাহিত্যের চরম ও উপকরণ মূল্য’, পরিচয়, মাঘ, ১৩৫৪ এবং ‘বিশুদ্ধ ও ফলিত সাহিত্য’, পরিচয়, চৈত্র, ১৩৫৪ (দ্বিতীয়টি জবাবি লেখা)।

৪১. গোটা বিতর্কটি সংকলিত হয়েছে ধনঞ্জয় দাশ সম্পাদিত বস্তুবাদী সাহিত্য বিচার ও অন্যমত গ্রন্থে, নতুন পরিবেশ প্রকাশনী, ১৯৭৬। পরে মার্কসবাদী সাহিত্য-বিতর্ক গ্রন্থের করুণা প্রকাশনী প্রকাশিত সংস্করণের অন্তর্ভুক্ত (পূর্বোক্ত)।

৪২. শীতাংশু মৈত্র, ‘সাহিত্যের চরম ও উপকরণ মূল্য’, পরিচয়, ফাল্গুন, ১৩৫৪।

৪৩. সুশোভন সরকার, ‘রবীন্দ্রনাথ ও অগ্রগতি’, পরিচয়, আশ্বিন, ১৩৪৮।

৪৪. ‘মৌভোগ’ প্রথম প্রকাশিত শারদীয় অরণি পত্রিকায়, ১৯৪৬ সালে, পরে বিষ্ণু দের সন্দ্বীপের চর কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত।

৪৫. সাহিত্যের ভবিষ্যৎ, পূর্বোক্ত।

৪৬. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত।

৪৭. মঙ্গলাচরণের চিঠি, পরিচয়, পৌষ, ১৩৫৪।

৪৮. সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় এই দ্বৈততার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন শারদীয় এক্ষণ, ১৩৮৯-এ প্রকাশিত ‘সরোজ দত্ত ও শশাঙ্ক’ প্রবন্ধে।

৪৯. বিষ্ণু দের রচনা, হিরণ কুমার সান্যাল ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত কেন লিখি গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত, ফ্যাসি-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ দ্বারা প্রকাশিত, ১৯৪৪।

৫০. সাহিত্যের ভবিষ্যৎ (পূর্বোক্ত) গ্রন্থের অন্তর্গত।

৫১. আমার Bengal Marxism বইয়ের ‘An Alternative Search for Revolutionary Dynamics in Art’ অধ্যায়ে এ নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা আছে। Frankfurt School ও Althusser-এর Structural Marxism নিয়ে আলোচনা আছে বইটির Appendix 1-এ।

৫২. দ্রষ্টব্য Pauline Johnson, Marxist Aesthetics : The Foundations within Everyday Life for an Emancipated Consciousness (Routledge & Kegan Paul : London, 1984), Part I: ‘Lukács : Reification and Its Overcoming’।

৫৩. দ্রষ্টব্য লুকাচ-এর Die Eigenart der Aesthetischen (The Specificity of Aesthetics), যেটি ১৯৬৩ সালে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয়। বইটির কোনও ইংরেজি সংস্করণ এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি।

৫৪. দ্রষ্টব্য Agnes Heller, The Theory of Need in Marx (Allison and Busby : London, 1976)। অবশ্য হেলার বলেন যে, ‘চরম তাগিদ’-এর তত্ত্ব মার্কসবাদকে আবার মানবিকতায় ফিরিয়ে দিলেও এলিটিস্ট পক্ষপাত থেকে একেবারে মুক্ত করতে পারেনি। বিষয়ীর কোনও তাগিদ যদি সে নিজেই না চিনতে পারে, যদি বাইরে থেকে কিছু সুবিধাসম্পন্ন নেতাই তাদের সেই তাগিদকে চিনিয়ে দিতে চান নিজেদের চেতনা অনুযায়ী ও সর্বজনীনতার নামে, যদি সেই নেতারাই ঠিক করে দেন কোনটা সঠিক তাগিদ আর কোনটা বেঠিক, তাহলে আর মানবিক সারসত্তার ‘চরম তাগিদ’ ব্যাপারটা দাঁড়ায় কী করে!

৫৫. সাহিত্যের ভবিষ্যৎ ও অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ।

৫৬. পূর্বোক্ত সাহিত্যের ভবিষ্যৎ গ্রন্থের অন্তর্গত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *