মার্কসচর্চা : একুশ শতকের ভাবনা

মার্কসচর্চা : একুশ শতকের ভাবনা
শোভনলাল দত্তগুপ্ত

মার্কসচর্চা : সেকাল ও একাল

বিংশ শতাব্দীর একটা বড় সময় জুড়ে সামগ্রিকভাবে বামপন্থী চিন্তার জগতে মার্কসের আধিপত্য ছিল প্রায় প্রশ্নাতীত। রুশ বিপ্লবের পরে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানিকে পরাস্ত করার ক্ষেত্রে সোভিয়েত দেশের সাফল্য মার্কসীয় মতাদর্শের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ১৯৪৫-উত্তর পর্বে পূর্ব ইউরোপ সহ এশিয়ার একাধিক দেশে (চিন, ভিয়েতনাম) সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, গোটা তৃতীয় বিশ্ব জুড়ে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের দুর্বার অগ্রগতি, কিউবাতে সমাজতন্ত্রের পত্তন ইত্যাদি অসংখ্য ঘটনা মার্কসবাদ অপরাজেয়, মার্কসবাদ এক ধরনের বৈজ্ঞানিক সত্য— এরকম একটি ধারণার জন্ম দিল যে শুধু তা-ই নয়; এর সঙ্গে যে ভাবনাটা ব্যাপ্তি লাভ করল বা জনমানসে মান্যতা পেল সেটি হল এরকম : মার্কসবাদের এই প্রতিষ্ঠিত ভাষ্যটি মার্কসের চিন্তারই অনুসারী, অর্থাৎ, সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত ফলিত সমাজতন্ত্রের ধাঁচাটি ছিল মার্কসের তাত্ত্বিক ভাবনারই বাস্তব প্রতিফলন। এভাবেই মার্কস বাঁধা পড়লেন মার্কসবাদের অচ্ছেদ্য বন্ধনে। আরও স্পষ্ট করে বললে মার্কসের ভাবনাকে পরিণত করা হল একটি ভাষ্যে, যার চরিত্রটি ছিল একরৈখিক, একমাত্রিক। এই ভাষ্যে ছিল না কোনও অস্পটতা, কোনও ধরনের দ্বিধা। এক প্রবল আশাদীপ্ত, অমোঘ অনিবার্যতার বাণী এই ভাষ্যের মাধ্যমে ধ্বনিত হল,— যেখানে বলা হল ধনতন্ত্রের পরাজয় ও গোটা বিশ্ব জুড়ে সমাজতন্ত্রের উত্থান অবশ্যম্ভাবী। নিঃসন্দেহে নিপীড়িত মানুষের কাছে, অত্যাচারিত, শোষিত জনগণের কাছে এই ভাষ্যটি জুগিয়েছিল প্রবল আস্থা ও উদ্দীপনা, এক বড় রকমের বল ও ভরসা। তার চেয়েও বড় কথা, মার্কসবাদের এই ভাষ্য ক্যাডার-ভিত্তিক কমিউনিস্ট পার্টি, জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন ও বিভিন্ন ধরনের গণ-সংগঠন ও বামপন্থী প্রচার মাধ্যমকে গঠন করতে প্রভূত সাহায্য করেছিল। তার ফলে এক দিকে যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক শক্তি, অপর দিকে প্রত্যয়ঋদ্ধ হয়েছিলেন বামপন্থার অনুগামী মানুষজনেরা। সাধারণভাবে মানুষের মনে মার্কসও নির্মিত হলেন এই ভাষ্যকে আশ্রয় করে।

সোভিয়েত বিপ্লবের পরে অনিবার্যভাবেই মার্কসচর্চা একটি নতুন মাত্রা পরিগ্রহ করে। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগেই পৃথিবীর মানুষের কাছে মার্কস-এঙ্গেলসের লেখাপত্র অত্যন্ত সুলভ সংস্করণে পৌঁছতে শুরু করে, প্রকাশিত হয় মার্কসের চিন্তার বিভিন্ন দিক নিয়ে নানা ধরনের ব্যাখ্যা, অসংখ্য বইপত্র। এর ফলে সঞ্চারিত হয় মার্কসের তত্ত্বভাবনা সম্পর্কে প্রবল আগ্রহ, বামপন্থী আন্দোলনে যার ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু এখানে খেয়াল রাখা দরকার যে, বিংশ শতাব্দীর একটা বড় সময় জুড়ে মার্কসচর্চার সিংহভাগ আদলটাই ছিল প্রচলিত সোভিয়েত ভাষ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত। তত্ত্বগতভাবে বললে, এই ভাবনা ছিল এক ধরনের দৃষ্টবাদী (positivist) চিন্তার অনুযায়ী, যার একটি নিটোল প্রতিফলন ছিল ১৯২১ সালে প্রকাশিত নিকোলাই বুখারিন-এর Historical Materialism শীর্ষক অত্যন্ত জনপ্রিয় গ্রন্থটি। অনিবার্যতা, যান্ত্রিকতা ও এক ধরনের নির্ধারণবাদ, যা এই রচনাটিকে বিশিষ্টায়িত করেছিল ও যার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন আনতোনিও গ্রামশি এবং গেওর্গ লুকাচ, এক হিসেবে ছিল কাউটস্কি- ও প্লেখানভ-কৃত মার্কস-পাঠের অনুযায়ী।

মার্কসের চিন্তাকে, তাঁর তত্ত্বভাবনাকে, প্রায় এক ধরনের প্রকৃতিবিজ্ঞান সুলভ কার্য-কারণ সম্পর্কের যান্ত্রিকতায় পর্যবসিত করার এই যে ঝোঁক, যেখানে বস্তু ও বস্তুবাদকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে উপেক্ষিত হল বিষয়ীবাদিতা ও চেতনার প্রশ্নটি, তার বিরুদ্ধে অন্তত দু’টি পর্যায়ে দু’টি প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। বিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে গড়ে ওঠা ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠীর অনেক তাত্ত্বিকই (আডোর্নো, মারকিউস প্রমুখ) এই ভাষ্যের সমালোচনা করে মার্কস ও মার্কসবাদের যে বিকল্প ভাষ্যটির আভাস দিলেন, সেখানে প্রাধান্য পেল বিষয়ীবাদিতা, উপরিকাঠামোর স্তরে বিরাজমান সংস্কৃতি, মানবমন ইত্যাদি। রুশ বিপ্লবের অব্যবহিত পরে পরেই, প্রায় একই সময়ে বিষয়ীবাদী দৃষ্টিতে মার্কসের চিন্তাকে বিচার করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন আনতোনিও গ্রামশি, গেওর্গ লুকাচ, কার্ল কর্শ প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই এঁদের প্রতিবাদী ভাবনাচিন্তাকে প্রচলিত সোভিয়েত ভাষ্য বা কমিউনিস্ট পার্টিগুলি কোনও আমল দেয়নি। এখানে খেয়াল করা প্রয়োজন যে, বিশের দশকের এই পর্বে মার্কসের অনেক রচনাই ছিল অধরা, বিশেষত তাঁর গোড়ার দিকের অনেক লেখাই। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে। পঞ্চাশের দশকের ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে রজার গারোদি, প্রায় একই সময়ে পোল্যান্ডে অ্যাডাম শ্যাফ প্রমুখ ব্যক্তিত্ব ইতিমধ্যে প্রকাশিত মার্কসের ১৮৪৪ সালের আর্থ-দার্শনিক পাণ্ডুলিপি বা পারি পাণ্ডুলিপি (Economic and Phiolosophical Manuscripts of 1844 or Paris Manuscripts) বিশ্লেষণ করে খাড়া করলেন দুই মার্কসের তত্ত্ব বা তরুণ বনাম পরিণত মার্কসের তত্ত্ব। তাঁরা এ কথাটাই বলার চেষ্টা করলেন যে, মার্কস আদতে ছিলেন একজন মানবতাবাদী, যাঁর চিন্তায় প্রাধান্য পেয়েছিল মানবমুক্তি ও বিচ্ছিন্নতার প্রশ্ন, প্রকৃতিবিজ্ঞান সুলভ কার্য-কারণ সম্পর্কিত ভাবনা নয়। ক্যাপিটাল-এর তুলনায় তাঁরা অনেক বেশি গুরুত্ব দিলেন ১৮৪৪ সালের পারি পাণ্ডুলিপি-কে,— যে ভাবনার বিরোধিতা করেছিলেন প্রথাগত মার্কসচর্চার সঙ্গে জড়িত অনেক পণ্ডিতই। এই প্রশ্নটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করল ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে ক্রুশ্চভের স্তালিন-সমালোচনার প্রেক্ষিতে, যখন অনেক প্রশ্ন উঠে গেল সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের আপাত সাফল্য সম্পর্কে; যখন স্বীকার করে নিলেন অনেক মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিজীবী যে, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সংকুচিত পরিসরের প্রসারণ অত্যন্ত জরুরি। মার্কসচর্চার এই আবহে আবারও একটি নতুন বাঁক লক্ষ করা গেল সত্তরের দশকে, যখন ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির প্রসিদ্ধ তাত্ত্বিক-দার্শনিক লুই আলথুসের কামান দাগলেন গারোদি-কৃত ‘মানবতাবাদী মার্কস’-এর তত্ত্বের বিরুদ্ধে, যদিও তাঁর তাত্ত্বিক প্রেক্ষিত ও কাঠামোটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি প্রতিষ্ঠিত করলেন বৈজ্ঞানিক তাত্ত্বিক হিসেবে মার্কসকে, যদিও তাঁর ভাষ্যে মার্কসের বিজ্ঞানমনস্কতার ব্যাখ্যা দৃষ্টবাদী বিজ্ঞানমনস্কতার সমার্থক ছিল না।

ইতিমধ্যে কিন্তু সমাজতন্ত্রী বিশ্বের ফলিত সমাজতন্ত্রের বিষয়টি নিয়ে অনেক প্রশ্নই উঠে গিয়েছিল। ৭০-এর দশকে ইউরোকমিউনিজ়মের ভাবনা, তার আগে ১৯৬৮ সালে চেকোশ্লোভাকিয়াতে, প্রাগ-বসন্তের উন্মেষ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক হস্তক্ষেপ, পরিশেষে সোভিয়েত ইউনিয়নে মিখাইল গর্বাচেভ-এর নেতৃত্বে গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রোইকা-র প্রতিষ্ঠা মার্কসবাদের এতদিনকার প্রচলিত ভাষ্যকে অনেক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। ১৯৯১ সালে পতন ঘটল সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং তার পরিণতিতে মার্কসচর্চার গোটা পরিবেশটাই রাতারাতি বদলে গেল। দু’টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবারে বড় আকারে দেখা দিল। এক : সমাজতন্ত্রের এই বিপর্যয়ের মূলে কি ছিল মার্কসকে সঠিকভাবে বোঝার বা পাঠ করার ব্যর্থতা? দুই : মার্কসকে কি তাহলে পাঠ করতে হবে কোনও ভাষ্যকে আশ্রয় করে নয়,— তাঁকে পড়তে হবে তাঁর মতো করে, তাঁকে বিচার করতে হবে তাঁর চিন্তার নিজস্বতার নিরিখে?

দাভিদ রিয়াজানভ ও মেগা (MEGA)-১

মার্কসকে সঠিকভাবে না বোঝা বা না পাঠ করার পরিণতিতে মার্কসবাদের প্রায়োগিক ভাষ্যেও যে মস্ত বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল, ফলিত সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা হয়ে দাঁড়াল তার অন্যতম নির্দশন। তাই প্রশ্ন উঠে গেল যে এবারে শুধু মার্কস-এ ফেরা নয়, সেই ফেরাটা হবে নতুন করে নতুন ভাবনায় ঋদ্ধ হয়ে। সোভিয়েত-উত্তর পৃথিবীতে মার্কসচর্চার আঙ্গিককে হতে হবে তাই অনেক দিক থেকেই বিংশ শতাব্দীর প্রচলিত মার্কসচর্চার আদল থেকে ভিন্ন প্রকৃতির, ভিন্ন ধাঁচের। কিন্তু এই যে বোধ বা ভাবনা তার সূত্রপাত হয়েছিল গত শতাব্দীতে, অন্তত একশো বছর আগে, যদিও যাঁর নাম এর সঙ্গে জড়িত, তিনি আজ এক বিস্মৃতপ্রায় ব্যক্তিত্ব।

সালটা ১৯১১। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আসন্নপ্রায়। ভিয়েনা শহরে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন রুশ বিপ্লবী দাভিদ বরিসোভিচ রিয়াজানভ (১৮৭০–১৯৩৮), এককালে মেনশেভিক, পরবর্তীকালে বলশেভিক ও লেনিনের অতি প্রিয় পাত্র। তিনি বহু ভাষাবিদ্‌, মার্কসের রচনার তন্নিষ্ঠ পাঠক এবং সেই সুবাদে মাক্‌স আডলার, অটো বাউয়ের, রুডল্‌ফ্‌ হিলফারডিং, কার্ল রেনার প্রমুখ ছ’জন বিশিষ্ট অস্ট্রো-মার্কসবাদীকে নিয়ে গঠন করলেন একটি গোষ্ঠী, যার মুখ্য কাজ হবে মার্কস-এঙ্গেলসের সমগ্র রচনাবলি প্রকাশ করা। কিন্তু ইতিমধ্যে ১৯১৪ সালে ঘনিয়ে এল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কালো মেঘ এবং তার ফলে স্থগিত হয়ে গেল রিয়াজানভের এই উদ্যোগ।

১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবই রিয়াজানভকে প্রতিষ্ঠিত করল তাঁর স্বমহিমায়। লেনিনের উদ্যোগে তাঁকে মার্কস-এঙ্গেলস ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা নিয়োগ করা হল এবং তাঁকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হল তাঁর প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে। এই প্রকল্পটিকে রিয়াজানভ নামাঙ্কিত করলেন মেগা (MEGA বা Marx-Engels Gesamtausgabe), অর্থাৎ, মার্কস-এঙ্গেলস সমগ্র রচনাবলি। মার্কসচর্চার বৌদ্ধিক ইতিহাসে এই প্রকল্পটি ছিল প্রকৃত অর্থেই এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ, অন্তত দু’টি কারণে। প্রথমত, রিয়াজানভের ভাবনায় অগ্রাধিকার পেয়েছিল মার্কসকে মার্কসের মতো করে বোঝার, তাঁকে পাঠ করার বিষয়টি, কোনও ভাষ্যকে আশ্রয় করে বা মাধ্যম হিসেবে নয়। অর্থাৎ, মার্কসকে যদি ব্যাবহারিক রাজনীতিতে কাজে লাগাতে হয়, তাঁর শিক্ষাকে যদি বিপ্লবের অস্ত্র হিসেবে গণ্য করতে হয় তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন তাঁকে বোঝা তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকর্মের নিরিখে,— এমন একটি ইঙ্গিত এই মহাপ্রকল্পের গভীরে নিহিত ছিল। দ্বিতীয়ত, রিয়াজানভীয় ভাবনা এই প্রকল্পকে কোনও সংকীর্ণ দলীয় আনুগত্যের চৌহদ্দির মধ্যে বেঁধে রাখতে চায়নি, কারণ তাঁর কাছে মূল বিচার্য বিষয় ছিল একটিই: প্রকৃত অর্থে যাঁরা মার্কস-বিশেষজ্ঞ, তাঁদের সবাইকে এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করা। একটি হিসেব অনুযায়ী, ১৯৩০ সালে এই প্রকল্পের অধীন ১০৯ জন গবেষক-কর্মীদের মধ্যে ৩৯ জন ছিলেন বলশেভিক পার্টির সদস্য এবং অন্যেরা ছিলেন মেনশেভিক কিংবা সোশ্যালিস্ট-রেভল্যুশনারীদের অনুগামী। লেনিনের জীবদ্দশায় রিয়াজানভকে এর জন্য কোনও অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয়নি।

গোড়া থেকেই এই মহাপ্রকল্পটি কোন পথে এগোবে, রিয়াজানভ খুব স্পষ্ট করে সেটি বাতলে দিয়েছিলেন। মেগা-র কাঠামোটি ছিল ত্রিস্তরীয়। প্রথমত, মার্কস-এঙ্গেলসের আক্ষরিক অর্থেই যা-কিছু লিখিত আকারে পাওয়া যাবে, তার সমস্তটাই প্রকাশ করা হবে মূল ভাষাতেই। এই প্রকল্পে তাই অনুবাদের কোনও স্থান ছিল না, সুযোগ ছিল না কোনও ভাষান্তরের। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকবে একটি সহায়িকা (Apparat), যেটি পাঠককে বলে দেবে মার্কস-এঙ্গেলসের চিন্তার বিষয়টি কেমনভাবে রূপায়িত হয়েছিল, বিভিন্ন ধরনের শব্দসংক্রান্ত টীকাকে ব্যাখ্যা করবে, ইত্যাদি। তৃতীয়ত, মেগা-র ভাবনায় মার্কস-এঙ্গেলসের সমগ্র রচনাবলি প্রকাশিত হবে তিনটি অংশে। প্রথম অংশে স্থান পাবে ক্যাপিটাল বাদ দিয়ে অন্যসব প্রকাশিত রচনা। দ্বিতীয় অংশে থাকবে ক্যাপিটাল ও তার সঙ্গে জড়িত সমস্ত ধরনের লেখাপত্র। তৃতীয় অংশে অন্তর্ভুক্ত হবে চিঠিপত্র, যেখানে থাকবে মার্কস-এঙ্গেলস পত্রাবলি সহ তাঁদের কাছে লেখা তৃতীয় পক্ষের চিঠিপত্রও। এই চিঠিপত্রের আনুমানিক সংখ্যা হল ১০,০০০।

রিয়াজানভ তাঁর এই স্বপ্নের প্রকল্পকে কিন্তু নিজের জীবনে সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। ১৯৩১ সালে স্তালিন জমানায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। চিহ্নিত করা হয় ‘জনগণের শত্রু’ হিসেবে, আরও অনেকের মতোই ১৯৩৮ সালে মস্কো মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হন এবং বরণ করতে হয় মৃত্যুদণ্ড। অপরাধ: অতীতে মেনশেভিকদের সঙ্গে যুক্ত থাকা, পরবর্তীকালে মার্কস-এঙ্গেলস ইনস্টিটিউটকে অ-কমিউনিস্টদের সঙ্গে যুক্ত করা, ইত্যাদি ইত্যাদি। রিয়াজানভের জায়গায় পরবর্তী অধিকর্তা নিযুক্ত হলেন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অত্যন্ত আস্থাভাজন ভি. আদোরাৎসকি। ১৯২৪–৪০ পর্বে মেগা প্রকল্পের অধীনে মোট ১৩টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল। এর পরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে, যার পরিণতিতে ২২ জুন, ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করে নাৎসি জার্মানি এবং স্বাভাবিক কারণেই মেগা প্রকল্পটিতে ছেদ পড়ে।

এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। রিয়াজানভ তাঁর জীবদ্দশায় মার্কস-এঙ্গেলসের রচনাগুলির মূল পাণ্ডুলিপির ফটোকপি জোগাড় করেছিলেন মূলত জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির মহাফেজখানা থেকে এডুয়ার্ড বার্নস্টাইনের মাধ্যমে একটি চুক্তির খাতিরে। সেই চুক্তি খারিজ হয়ে যায় ১৯২৮ সালে যখন কমিনটার্নের নির্দেশে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে ফ্যাসিবাদী ও সোশ্যাল ডেমোক্রেসিকে সমগোত্রীয় হিসেবে চিহ্নিত করে দেখা হল। ১৯৩৬ সালে বুখারিনের মাধ্যমে চেষ্টা করা হয়েছিল এই চুক্তিটির নবীকরণের, কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। মেগা-র কাছে এটিও ছিল এক বড় ধাক্কা।

যুদ্ধোত্তর পর্বে মেগা : ১৯৪৫–১৯৯১

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পূর্ব ইউরোপে রাজনৈতিক পরিস্থিতির যে পরিবর্তন সূচিত হল, তার সুবাদে মেগা প্রকল্পটিকে নতুন করে ভাবা শুরু হয়। ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে এই প্রকল্পটিকে সম্পূর্ণ করা প্রয়োজন এবং তার ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯৬৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মান গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের যৌথ সহযোগিতায় উভয় দেশের ইনস্টিটিউট অফ মার্কসিজ়ম-লেনিনিজ়ম নতুন করে মেগা-র বাকি খণ্ডগুলি প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। একইসঙ্গে জার্মান গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে আনুমানিক পঞ্চাশ খণ্ডে Marx-Engels Werke (MEW), বা মার্কস-এঙ্গেলস রচনাবলি, যার ইংরেজি সংস্করণ আমাদের হাতে আসতে শুরু করে ৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। এখানে প্রশ্ন ওঠে: MEW এবং MEGA-র তফাত কী ছিল? একটি পরিসংখ্যান থেকেই তফাতটা বোঝা যায়। যেখানে মেগা-র হিসেবে সবসমেত ১১৪টির মতো খণ্ড প্রকাশিত হবার কথা, সেখানে MEW-র হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল ৫০টির মতো খণ্ড। তা ছাড়া মেগা-র কাঠামো এবং MEW-র কাঠামোও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। যুদ্ধোত্তর পর্বে মেগা-র সংস্করণেও রিয়াজানভ প্রদর্শিত পথকেই অনুসরণ করা হয়েছিল, মান্যতা দেয়া হয়েছিল তাঁর ভাবনাকেই, যদিও উভয় দেশের ক্ষেত্রেই একটি বিষয়কে সুনিশ্চিত করা হয়েছিল— সেটি হল শাসক দলের সর্বাত্মক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ।

এই দ্বিতীয় পর্যায়েও কিন্তু মেগা প্রকল্পটি বাধাপ্রাপ্ত হল, যখন ১৯৯১ সালে পতন ঘটল সোভিয়েত ইউনিয়নের। সোভিয়েত দুনিয়ার অবলুপ্তির ফলে মেগা-র ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে গভীরভাবে অনিশ্চিত। শেষপর্যন্ত অবশ্য একটি সুরাহা হয়, যখন ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত International Marx-Engels Foundation (Internationale Marx-Engels Stiftung)-এর উদ্যোগে ১৯৯৩ সালে Berlin Brandenburg Academy of Sciences (BBAW বা Berlin Brandenburg Akademie der Wissenschaften), নেদারল্যাণ্ডের Institute of Social History, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি এবং রুশ ফেডারেশনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও অনুদানের সুবাদে মেগা প্রকল্পটির পুনরুজ্জীবন ঘটে, যা মেগা-২ নামে পরিচিত হল। কিন্তু এবারে তার ধাঁচাটির ক্ষেত্রে বেশ বড় রকমের পরিবর্তন সাধিত হয়। এক নজরে সেগুলি এরকম। প্রথমত, বলা হল যে এই প্রকল্প হবে দলীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং পুরোপুরি বিশুদ্ধ অ্যাকাডেমিক ভাবনা দ্বারা প্রকল্পটি পরিচালিত হবে। স্পষ্ট করে বলা হল যে, অতীতের বিভিন্ন ক্ল্যাসিক্‌সকে ( যেমন অ্যারিস্টটল কিংবা স্পিনোজা) যেভাবে, যে মর্যাদায় আমরা পাঠ করি, মার্কস-এঙ্গেলসকেও পাঠ করা হবে সেভাবেই। দ্বিতীয়ত, মেগা-র অধীনে যে খণ্ডগুলি ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল, তার সিংহভাগের প্রকাশক ছিল বার্লিনের পার্টি পরিচালনাধীন Dietz Verlag; এখন বলা হল যে, মেগা-র নতুন খণ্ডগুলি প্রকাশ করবে বার্লিনের খ্যাতনামা পণ্ডিতমহলে বিশেষ সুপরিচিত, রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ Akademie Verlag। তৃতীয়ত, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রিয়াজানভের তৈরি করে দেয়া কাঠামোটিকে বজায় রেখেই একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন করা হল। মেগা-২-এর ক্ষেত্রে বলা হল যে, রিয়াজানভ প্রদর্শিত ত্রিস্তরীয় কাঠামোতে একটি নতুন স্তরের অন্তর্ভুক্তি হবে, যেখানে স্থান পাবে মার্কস-এঙ্গেলসের সংকলিত বিভিন্ন নোটবুক, তাঁদের ব্যবহার করা বইপত্রে মার্কস-এঙ্গেলসের রাখা নানা ধরনের নোট, মন্তব্য ইত্যাদি, যার মাধ্যমে পাঠ করা যাবে তাঁদের পঠন-পাঠন পদ্ধতি, তাঁদের পাঠাভ্যাস ইত্যাদি।

মেগা-২ প্রকল্প চালু হবার পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, এর অধীনে আনুমানিক ১১৪টি খণ্ড প্রকাশ করা হবে, যার মধ্যে এখন পর্যন্ত ৫১টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে, যদিও প্রথমে ভাবা হয়েছিল যে মোট খণ্ডের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬৪। কিন্তু ১৯৯২ সালে এই সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনা করে বলা হল সংখ্যাটি ১৬৪ থেকে কমিয়ে আনা হবে ১১৪-য়। আরও একটি গুরুত্বপুর্ণ ঘটনা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। মেগা-২ প্রকল্প মেগা-১-এর অনুসারী হলেও যেহেতু রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়টি আগাগোড়াই মেগা-র সঙ্গে জড়িয়ে ছিল, ১৯৯২ সালে তাই বলা হল যে, ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত মেগা-র খণ্ডগুলি প্রকৃত অর্থেই আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেছিল কি না, সেটিকে প্রথমে যাচাই করে নেবার প্রয়োজন। তার সুবাদে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিটার হেনরিষ (Dieter Henrich)-এর তত্ত্বাবধানে এই কাজটি সম্পন্ন করা হয় এবং তাঁদের রিপোর্টে এ কথা বলা হয় যে, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও মেগা-র প্রকাশিত খণ্ডগুলি কিন্তু ছিল আন্তর্জাতিক মানেরই এবং সেই মর্মে প্রতিষ্ঠিত হল মেগা-১ ও মেগা-২-এর মধ্যে একটি অচ্ছেদ্য ধারাবাহিকতা। প্রকাশিতব্য ১১৪টি খণ্ডের মধ্যে এভাবেই স্থান পেল মেগা-১ পর্বের প্রকাশিত খণ্ডগুলিও।

মেগা-২-এর বৌদ্ধিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মেগা-২ একবিংশ শতকে মার্কসচর্চার ক্ষেত্রে একটি সম্পূর্ণ নতুন ও অভিনব পদক্ষেপ, কারণ এই প্রথম মার্কসকে চেনা যাচ্ছে মার্কসের আয়নায়। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাঁর অপ্রকাশিত নোটবইগুলি। আমরা এর কিছুটা হদিশ পেয়েছিলাম গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের গোড়ায়, যখন ১৯৭৪ সালে লরেন্স ক্রাডের-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল মার্কসের Ethnological Notebooks। বর্তমানে যে তথ্যগুলি আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে তা থেকে আন্দাজ করা যাচ্ছে যে, ১৮৩৮–৮২ পর্বে আনুমানিক ২০০টি নোটবই মার্কস ব্যবহার করেছিলেন এবং বহুভাষাবিদ মার্কস নোট নেবার সময়ে একাধিক ভাষা ব্যবহার করতেন। এমন অন্তত ৮টি ভাষার উল্লেখ এই নোটবইগুলিতে পাওয়া যাচ্ছে, যথা, প্রাচীন গ্রিক, লাতিন, ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান, ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং রুশ। এইসঙ্গে আরও একটি চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, যা মার্কসের রচনার প্রকাশিত ভাষ্যকে আরও গভীরভাবে বুঝতে আমাদেরকে সাহায্য করবে। সেটি হল New York Daily Tribune-এ মার্কসের প্রকাশিত লেখাগুলির নেপথ্যে যে নোটগুলি তিনি ব্যবহার করেছিলেন, তার হদিশ আমরা পাচ্ছি মেগা-২-এর কল্যাণে।

এখানে আরও একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন আগ্রহী পাঠককে ভাবাবে। এই নোটবইগুলির ধাঁচাটা কেমন ছিল? মার্কস কী ধরনের বিষয়ে এই বিপুল পরিমাণ নোট সংগ্রহ করতে আগ্রহী ছিলেন? মোটামুটি যে তথ্যগুলি পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলি এরকম: গণিত সংক্রান্ত নোটবই (ইতিমধ্যেই প্রদীপ বক্সি-র সম্পাদনায় প্রকাশিত), রসায়নশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, শারীরবিদ্যা, ভূতত্ত্ব ও প্রযুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত নোটের বিপুল সম্ভার। এও জানা যাচ্ছে যে ক্যাপিটাল-এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড রচনার কাজ অনেক সময় বন্ধ রেখে তিনি এই বিষয়গুলির ওপরে নোট নিয়ে চলেছেন। তার অর্থ যদি এই হয় যে মার্কস ক্যাপিটাল সম্পূর্ণ করার ক্ষেত্রে অনেকটাই অনাগ্রহী হয়ে পড়েছিলেন, সেটি ভাবা কিন্তু ভুল হবে। একাধিক গবেষক এমনটাই ভাবার চেষ্টা করছেন যে, পুঁজিবাদী আধুনিকতার চরিত্রকে বোঝার জন্যই মার্কস তাঁর সময়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলিকে অনুধাবন করতে চেয়েছিলেন। সেইসঙ্গে বুঝতে চেয়েছিলেন জমি ও পরিবেশের ওপর পুঁজিবাদের পরিবর্তনশীল চরিত্র কী ধরনের প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।

মেগা-২ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত পরেশ চট্টোপাধ্যায় তাঁর একাধিক প্রবন্ধে একটি কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে চেয়েছেন যে আমরা এতকাল মার্কসের তত্ত্বভাবনাকে যেরকম একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষ্যের আকারে ভাবতে অভ্যস্ত ছিলাম, মেগা-র খণ্ডগুলি হাতে আসার পর থেকে এ কথা আর বলা যাবে না। মেগা-র আলোকে আমরা যে মার্কসকে দেখছি, তাঁর যে-তত্ত্ববিশ্বের সঙ্গে আমরা পরিচিত হচ্ছি, সেখানে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন যে-মার্কস, তিনি একজন নিরলস অনুসন্ধানী, যিনি ক্রমাগত নিজেকে ভাঙছেন, খণ্ডন করছেন, প্রশ্ন করছেন। তিনি জানতে চাইছেন সত্যটা কী, তিনি আদৌ প্রতিষ্ঠা করে যেতে চাননি কোনও মহাসত্যকে। তাই মার্কসের বৌদ্ধিক জগতে প্রাধান্য পেয়েছিল কোনও স্বয়ংসম্পূর্ণ, নিটোল সত্য প্রতিষ্ঠা নয়, সত্যকে জানার এক নিরলস অনুসন্ধান প্রক্রিয়া।

মার্কসের একাধিক রচনার ক্ষেত্রে মেগা-২-এর ভাবনা আমাদের অনেক চিরাচরিত ধারণাকে বদলে দেবে। এরকম দু’টি দৃষ্টান্ত দেব। ১৮৪৫ সালে মার্কসের অতি পরিচিত ফয়েরবাখ ভাষ্য, যার সঙ্গে আমরা পরিচিত বহুকাল থেকে, সেটি কিন্তু আদৌ মার্কসের মূল ভাষ্য নয়, কারণ মার্কস রচিত ফয়েরবাখ ভাষ্যের মূল খসড়াটি আবিষ্কৃত হয়েছে অনেক পরে। ১৮৮৮ সালে এঙ্গেলস মার্কস-কৃত ১৮৪৫ সালের ভাষ্যটিকে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন এবং এতদিন পর্যন্ত আমরা এই সম্পাদিত ভাষ্যকেই মার্কসের মূল ভাষ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছি। এবারে মার্কসের মূল ভাষ্যটির সঙ্গে এঙ্গেলসের সম্পাদিত ভাষ্য যদি তুলনা করি, তাহলে কিন্তু এটা বোঝা যায় যে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে এঙ্গেলসের সম্পাদনার ফলে মূল ভাষ্যের চরিত্র বদলে গেছে। কিছু কিছু শব্দ ও বাক্য মার্কস যেভাবে সাজিয়েছিলেন, এঙ্গেলসের সম্পাদনা যেখানে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। এরকমই একটি সমস্যা দেখা দেয় ক্যাপিটাল-এর তৃতীয় খণ্ডের ক্ষেত্রে। এই খণ্ডটির মুদ্রিত সংস্করণ যা আমরা হাতে পাই, সেটি সম্পূর্ণ হয়েছিল এঙ্গেলসের তত্ত্বাবধানে— এই তথ্যটি সুপরিচিত। কিন্তু মেগা-র দৌলতে আমরা প্রথম পরিচিত হচ্ছি মার্কস-কৃত এই খণ্ডের অসম্পূর্ণ, মূল খসড়াটির সঙ্গে, যাকে এঙ্গেলস পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছিলেন। এঙ্গেলসের এই সম্পাদনা মার্কসের খসড়াকে কি কোনওভাবে বিকৃত করেছিল, না কি এটি ছিল মূল ভাষ্যেরই অনুসারী? অর্থাৎ, এঙ্গেলসীয় সম্পাদনা কি ক্যাপিটাল, তৃতীয় খণ্ডের ক্ষেত্রে তাঁর নিজের ভাবনাকে প্রাধান্য দেয়? যার ফলে মার্কস কি এখানে হারিয়ে যান? এঙ্গেলস নিজে কিন্তু ক্যাপিটাল, তৃতীয় খণ্ডের ভূমিকায় এই বিষয়টি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন এবং এ কথা খুব স্পষ্ট করেই বলে দেন যে, মার্কসের অবিন্যস্ত খসড়াটিকে একটি যথোপযুক্ত রূপ দেয়ার জন্য যেটুকু সম্পাদনার প্রয়োজন ছিল, তিনি সেটুকুই করেছেন এবং সে কারণেই তিনি কখনোই দাবি করতে পারেন না যে, তৃতীয় খণ্ডের রচয়িতা হিসেবে তাঁর কোনও ভূমিকা থাকতে পারে। কিন্তু মার্কসের খসড়াটি হাতে আসার পরে ক্যাপিটাল–গবেষকদের মধ্যে এই প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই একটি বিতর্ক শুরু হয়েছে। এক পক্ষ মনে করছেন যে এঙ্গেলসের সম্পাদনা মার্কসের ভাবনাকে বোঝার ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়; অপর পক্ষ ভাবছেন যে এঙ্গেলসীয় সম্পাদনা মার্কসের মূল খসড়ার চরিত্রকে বিকৃত করেনি।

আগামী দিনের মার্কসচর্চা

মেগা-র আলোকে মার্কসকে দেখার এই যে সুযোগ, তার ফলে গোটা মার্কসচর্চার পরিসরটাই বদলে যাচ্ছে। বর্তমানে পশ্চিমি দুনিয়ার মার্কসের তত্ত্বভাবনা নিয়ে যেকোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় মেগা প্রসঙ্গ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্য, আমাদের এখানকার পণ্ডিতমহলে এই বিষয়টি নিয়ে তাত্ত্বিক সচেতনতা একেবারেই চোখে পড়ে না। একমাত্র দুই বঙ্গসন্তান, পরেশ চট্টোপাধ্যায় ও প্রদীপ বক্সি এই বিষয়টিকে জনসমক্ষে আনার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন তাঁদের একাধিক প্রবন্ধের মাধ্যমে। কিন্তু পাঠকমহলে, অন্তত আমাদের দেশে, তাঁদের এই গবেষণা ও পরিশ্রমের তেমন কোনও সমাদরের লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হয় না।

একটি প্রশ্ন ওঠা এক্ষেত্রে স্বাভাবিক। পাঠক জিজ্ঞাসা করতে পারেন, মেগা-র আলোকে মার্কসচর্চার অর্থ কি তাহলে এটাই যে, আমাদের এতদিনের সমস্ত ভাবনাচিন্তা, মার্কসকে আমরা এতকাল যেভাবে পাঠ করেছি, তার সবটাই এখন বাতিল করে দিতে হবে? তার উত্তর: একেবারেই তা নয়। মেগা আমাদের মার্কস-পাঠে সংযোজন করেছে একাধিক নতুন মাত্রা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংশোধন করে দিচ্ছে আমাদের প্রচলিত বেশ কয়েকটি ধারণা, বেশ অনেক ক্ষেত্রে মেগা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের প্রচলিত ভাবনার পরিপূরকও। ব্যাপারটা আদৌ এরকম নয় যে প্রাক্‌-মেগা মার্কস এবং মেগা-উত্তর মার্কসের মধ্যে কোনও আবশ্যিক বিরোধ আছে।

এখানে আরও একটি প্রশ্ন মার্কসবাদে আস্থাশীল রাজনৈতিক কর্মীরা করতে পারেন। মেগা-কে আশ্রয় করে মার্কসের যে-পাঠ, সেটি একান্তই বৌদ্ধিক। মার্কসবাদকে, মার্কসের শিক্ষাকে, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে মেগা-কেন্দ্রিক ভাবনা কতটা প্রাসঙ্গিক, কতটাই-বা গুরুত্বপূর্ণ? এটি অবশ্যই একটি কঠিন ও জটিল প্রশ্ন। এখানে বোধহয় দু’টি কথা বলা অন্যায় হবে না। প্রথমত, মার্কসের ভাবনার অনেক ধরনের প্রচলিত সরলীকৃত ভাষ্য মার্কসকে বোঝার ক্ষেত্রে বড় রকমের বাধা সৃষ্টি করেছে। সঠিকভাবে বোঝার পরিবর্তে মার্কসের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে এই সরলীকরণের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, মার্কসের তাত্ত্বিক ভাবনার সঙ্গে তাঁর চিন্তার প্রায়োগিক গুরুত্ব ও তাৎপর্যের অবশ্যই কোনও বিরোধ নেই কিন্তু প্রায়োগিক সাফল্য অনেকটাই নির্ভরশীল তত্ত্বগতভাবে মার্কসকে বোঝার ক্ষেত্রে, তাঁর তত্ত্ববিশ্বকে যথাযথভাবে অনুধাবন করার ক্ষেত্রে সঠিক পথটি অনুসরণ করা হল কি না তার ওপরে। মার্কসের চিন্তার তাত্ত্বিক ভাষ্য ও প্রায়োগিক ভাষ্য পরস্পরবিরোধী নয়,— কিন্তু প্রায়োগিক ভাষ্যের সাফল্যকে বহুলাংশেই স্থির করে দেবে তাত্ত্বিক ভাষ্যের যথাযোগ্য বিচার।

মেগা-র আবহে মার্কসচর্চা আগামী দিনে আমাদেরকে কোন ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারে, সে বিষয়ে উপসংহারে কয়েকটি কথা হয়তো বলা যেতে পারে। মূলধারার মার্কস-ভাষ্যে এরকম একটি ভাবনা প্রচলিত আছে যে মার্কস-এঙ্গেলস এক অভিন্ন, অচ্ছেদ্য সত্তা। সেই ভাবনাকে সংশোধন করে এখন বোধহয় স্বীকার করে নেবার প্রয়োজন আছে যে মার্কস-এঙ্গেলসের চিন্তার নৈকট্য যেমন ছিল, তেমনই ভিন্নতাও ছিল। এই দুই ব্যক্তিত্বকে একই বন্ধনীভুক্ত করাটা অনুচিত হবে। মেগা-র সুবাদে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, মার্কসের তাত্ত্বিক ভাবনার মধ্যে একটি নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা ছিল, যেখানে তিনি দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য সব কিছুই পাঠ করছেন তাঁর সময়টাকে বোঝার জন্য। এক সময়ে তরুণ বনাম পরিণত মার্কসের যে-তত্ত্বের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছিল, মেগা-র আলোকে সেই বিতর্ক আজ তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। আলথুসের মার্কসের তত্ত্বে যে বিচ্ছেদের কথা, অর্থাৎ, মানবতাবাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে বিজ্ঞানমনস্কতার ভাবনায় মার্কসের যে উত্তরণের কথা বলেছিলেন, মেগা-কে আশ্রয় করে এখন অনেক গবেষক বলছেন যে মার্কসের চিন্তা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে কতকগুলি বাঁক নিয়েছিল,— কিন্তু সেখানে ঘটেনি কোনও বিচ্ছেদ। সব শেষে বলতে হয় যে, মার্কসের তত্ত্বভাবনাকে দেখা দরকার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে, একটি নিটোল, অনড় সামাজিক তত্ত্ব হিসেবে নয়। মার্কস যে কোনও একটি নিশ্ছিদ্র, সম্পূর্ণ তত্ত্ব তৈরি করে আমাদের দিয়ে যাননি, তার অন্যতম প্রমাণ এটাই যে, মেগা আমাদেরকে হদিশ দিচ্ছে ১৮৫২ সাল থেকে মার্কস ভাবনাচিন্তা করছিলেন নারীসমস্যা, শিক্ষাবৈষম্যের ওপরে আধুনিকতার প্রভাব ইত্যাদি বিষয় নিয়েও, কিন্তু অসম্পূর্ণভাবে, খণ্ড খণ্ড চিন্তার মাধ্যমে। জীবনের শেষ পর্বে রুশ ভাষা আয়ত্ত করে তিনি দৃষ্টি ফিরিয়েছিলেন উন্নত পশ্চিম ইউরোপ থেকে অনুন্নত রাশিয়ার দিকে।

মার্কসের চিন্তার মধ্যে এই অসম্পূর্ণতা, অনির্দিষ্টতার উপাদানগুলিই১০ তাঁর চিন্তাকে প্রবলভাবে গতিশীল করে তুলতে পেরেছিল। মূলধারার মার্কসবাদী ভাষ্যে এই উপাদানগুলিকে স্বীকার করা হয় না বলেই আমাদের প্রবণতা থাকে মার্কসকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ছকের মধ্যে বেঁধে ফেলার, যাতে আমরা তাঁকে আমাদের মতো করে ব্যবহার করতে পারি। এর ফলে আমরা যদিও ভাবি যে মার্কসকে আমরা আয়ত্ত করেছি, বুঝে ফেলেছি, প্রকৃত অর্থে মার্কস কিন্তু আমাদের কাছে অধরাই থেকে যান।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

১. Nikolai Bukharin, Historical Materialism : A System of Sociology (The University of Michigan Press : Ann Arbor, 1969).

২. Antonio Gramsci, Prison Notebooks, Vol. 2. Edited by Joseph A. Buttigieg. (Columbia University Press : New York, 1996).

৩. Georg Lukács, ‘Technology and Social Relations’, New Left Review, no. 39, September–October, 1966.

৪. দাভিদ রিয়াজানভ এবং MEGA প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য— Bud Bukhard, ‘D.B. Ryazanov and the Marx–Engels Institute : Notes towards further Research’, Studies In Soviet Thought. July 1985. Rolf Hecker, ‘The History and Meaning of the MEGA Project from its inception until 1990’, KCI_FI001495132.pdf. Jürgen Rojahn, ‘Publishing Marx and Engels after 1989: The Fate of the MEGA’, Nature, Society and Thought, 13(4), October 2000 এবং ‘A MEGA update’, Nature, Society and Thought, 14(3), July 2001. Yulan Zhao, ‘Historical Birth of the First Historico–Critical Edition of MEGA (1–3)’, Critique : Journal of Socialist Theory, 41(3), 2013; 41(4), 2013; 42(1), 2014.

৫. Marcello Musto, ‘The Rediscovery of Karl Marx’, International Review of Social History, no. 52, 2007.

৬. Martin Hundt, ‘The Connection of Mind and Nature : Marx’s 1878 Notebooks on Geology’, http://www.usmarxisthumanists.org/articles/connection-mind-nature-marxs-1878-notebooks-geology-martin-hundt/ 7 August, 2012. Pradip Baxi, ‘Natural Science Notes of Marx and Engels, 1877–1833’, Nature, Society and Thought, no. 4, October 2001.

৭. দৃষ্টান্তস্বরূপ, Paresh Chattopadhyay, Review of ‘Karl Marx—Exzerpte und Notizen : Sommer 1844 bis Anfang 1847’ Gesamtausgabe (MEGA) vierte Abteilung. Band 3. https://libcorn.org/library/source-critique-political-economoy.

৮. এই বিতর্কের জন্য দেখুন Michael Heinrich, ‘Engels’ edition of the Third Volume of Capital and Marx’s original manuscript’, Science and Society, 60(4), Winter 1996/1997. Carl Erich Vollgraf et al, ‘“Marx in Marx’s Words”? On Engels’ Edition of the Manuscript of Book 3 of Capital, International Journal of Political Ecomony, 32(1), Spring 2002, Vitali Vygodskii, ‘What was it actually that Engels published in the years 1885 and 1894? On the article by Vollgraf and Jungnickel entitled “Marx in Marx’s Words”’, International Jurnal of Political Economy, 32(1), Spring 2002. এই গোটা বিতর্কটি প্রথমে মূল জার্মানে প্রকাশিত হয়েছিল MEGA Studien, no. 2, 1994 এবং MEGA Studien, no. 1, 1995-এ।

৯. এই বক্তব্যের জন্য দেখুন Michael, Kraetke, ‘The MEGA project and the End of Marxism’, http://www.slideshare.net/LeftStreamed/the-mega-project-and-the-end-of-marxism

১০. এই বক্তব্যের জন্য Musto ‘The Rediscovery of Karl Marx’ দ্রষ্টব্য। আরও দেখুন, ‘A Marx for the Left Today: Interview with Marcello Musto. Vesa Oittinen and Andrey Maidansky’ http://marxismocritico.com/2013/04/10/a-marx-for-the-left-today

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *