মার্কসের ইতিহাসচর্চায় বিপ্লবের ধারণা : একটি সম্ভাব্য রূপরেখা

মার্কসের ইতিহাসচর্চায় বিপ্লবের ভাবনা:  একটি সম্ভাব্য রূপরেখা
শৌভিক মুখোপাধ্যায়

এই প্রবন্ধে আমাদের প্রাথমিক প্রতিপাদ্য হল: ১) মার্কসের ইতিহাসচিন্তাকে তাঁর বিপ্লব সাধনার এক অবিচ্ছেদ্য অস্ত্র হিসাবে অনুধাবন করতে হবে; ২) মার্কস (এবং তাঁর সহযোদ্ধা এঙ্গেলস) মানবসমাজে বৈপ্লবিক রূপান্তরের যে সূত্রায়ণ করেছেন সেগুলি অজর, অমর, অব্যয়, অলঙ্ঘনীয় পরমকারণবাদ নয়, এগুলি ‘সংগ্রামের হাতিয়ার’, ফলত নিয়ত পরিবর্তনশীল। এই কারণে মার্কসের বস্তুবাদী ইতিহাসচর্চার সূত্রায়ণ (যাকে সাধারণত ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ বলা হয়ে থাকে, যদিও এই শব্দবন্ধটি মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলসের উদ্ভাবন) এক চলমান প্রক্রিয়া, যার ছোঁয়ায় ইতিহাস গবেষণাও ‘নব নব উন্মেষশালী’ পথ অবলম্বন করেছে। এরিখ হব্‌স্‌বম তাই বলেছেন যে, মার্কসবাদের সংস্পর্শে ইতিহাসচর্চার সাবালকত্ব প্রাপ্তি ঘটেছে।

এক আজীবন বিপ্লবী

মার্কসকে ১৭ মার্চ, ১৮৮৩-তে হাইগেটের সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ করবার মুহূর্তে সহযোগী এঙ্গেলস তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘কার্ল মার্কস প্রথমত এবং শেষ পর্যন্ত একজন বিপ্লবী। তাঁর জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদী সমাজ এবং যে রাষ্ট্রযন্ত্রকে সে সৃষ্টি করেছে তার মূলোৎপাটন করা। আধুনিক সর্বহারাশ্রেণির আত্মপরিচিতি ঘটাতে এবং মুক্তির দিশা দেখানোয় তিনিই ছিলেন পথপ্রদর্শক।’ মার্কসের সমাধিফলকে উৎকীর্ণ রয়েছে ফয়েরবাখের উপর রচিত একাদশ থিসিসের সেই বিখ্যাত উক্তি: ‘দার্শনিকেরা জগৎটাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করে গেছেন, মোদ্দা কথা হল পৃথিবীটাকে বদলানো দরকার।’

‘ধান ভানতে শিবের গীত’ বা সলতে পাকানোর গল্প

‘প্রথমত এবং শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী’ মার্কস আবার অনেকের মতোই বিপ্লবের সন্তান। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এরিখ হব্‌স্‌বমের ভাষায় ১৭৮৯-১৮৪৮ সময়কাল হল ‘বিপ্লবের যুগ’। এই সময়ে এক দিকে যেমন ফরাসি বিপ্লব পুরনো জমানাকে খতম করে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়েছে তেমনই ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে শিল্পপুঁজির বিকাশ সম্ভবপর করেছে। এই দুই রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিপ্লবের যুগল সম্মিলনে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে পশ্চিম ইউরোপের মানুষের প্রাত্যহিক জীবন ও বোধের জগতে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন ঘটছিল। ১৭৮৯-তে যেখানে সেনাবাহিনীর চাকরি ছাড়া মানুষ মূলত তাঁদের গ্রামের বাইরে খুব-একটা পা রাখত না, সেখানে ১৮৪৫ সালে শুধুমাত্র ইংল্যান্ডেই প্রায় ৪ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ রেলযাত্রা করছেন। ১৮১৪-তে যেখানে ফ্রান্সে সংবাদপত্রের গড় গ্রাহকের সংখ্যা ছিল সাকুল্যে পাঁচ হাজার, সেখানে ১৮৪৮-এ দুনিয়া জুড়ে হাজারের বেশি সংবাদপত্র মানুষকে দিনদুনিয়ার খবর দিচ্ছিল।

১৮৩০ সালের জুলাই মাসে ফ্রান্সে যখন বিপ্লব আরম্ভ হল মার্কস তখন ট্রিয়ের-এর ফ্রেডেরিখ উইলিয়াম জিমনাসিয়ামের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। এই কারণেই আমরা মনে করি এক অর্থে মার্কসও (জন্ম ১৮১৮ সালের ৫ মে, জার্মানির ট্রিয়ের শহরে) বিপ্লবের সন্তান। হয়তো এই ঘটনার ঘনঘটা তাঁকে বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার গভীর নির্জন কক্ষপথ থেকে চ্যুত করে বিপ্লবসাধনার বন্ধুর, বিপদসংকুল পথে নিক্ষেপ করেছিল। মার্কসের ধারণা এবং অবশ্যই তাঁর ইতিহাসচিন্তা এই সময়ের প্রেক্ষিতে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কীভাবে গড়ে উঠল তার বিবরণ যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যার মধ্যে দিয়ে আমরা তাঁর ইতিহাসচিন্তাকে বিশুদ্ধ তত্ত্বের বায়বীয় স্তর থেকে নামিয়ে একটা রক্তমাংসের অবয়ব দিতে চাইছি।

হেগেল ও তরুণ মার্কস : একটি ‘দ্বান্দ্বিক’ সম্পর্ক

১৮৩৬ সালে মার্কস যখন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, প্রাশিয়া সরকারের শিক্ষার ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন অল্টেনস্টাইন। ইনি উইলিয়াম ফন হুমবোল্ট অনুসৃত উদার ঐতিহ্যের শেষ প্রতিনিধি। সেই কারণে মার্কসের ছাত্রাবস্থায় প্রাশিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ছিল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বা সেন্সরশিপের আওতার বাইরে মুক্তচিন্তার পীঠস্থান। এই পরিবেশেই মার্কস বিরুদ্ধতার চাবুক হাতে তুলে নেবার শিক্ষা পেয়েছিলেন। ১৮৩৭-এ ফুসফুসের সমস্যায় অসুস্থতার কারণে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য স্ট্রালো-তে থাকার সময় রুমেলবার্গার হ্রদের ধারে চাঁদের আলোয় হেগেলের দর্শনের সাথে উনিশ বছরের তরুণ মার্কসের প্রথম মোলাকাত, প্রথমে যা ‘কিম্ভূত স্বর’ বলেই তাঁর মনে হয়েছিল। তবে মার্কস ক্রমশই পাক্কা হেগেলপন্থী হয়ে উঠলেন। পরবর্তীকালে মার্কসীয় তত্ত্বের উপর হেগেলীয় দর্শনের কতটা প্রভাব পড়েছে তাই নিয়ে মার্কসবেত্তাদের মধ্যে বিস্তর বিতণ্ডা রয়েছে। আমাদের সেই বিতর্কের মধ্যে প্রবেশের প্রয়োজন নেই। তবে মার্কসীয় তর্কপদ্ধতির অন্যন্যতা নিহিত আছে মূলত দু’টি বিষয়ের মধ্যে— প্রথমত দ্বন্দ্ববাদ বা dialectic* এবং দ্বিতীয়ত ইতিহাসচেতনায়।

মার্কস হেগেল থেকে দ্বান্দ্বিকতার সূত্র বা ধারণাটি পেয়েছিলেন যদিও তাকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তিত করে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে জাঁ পল সার্ত্র থেকে শুরু করে হার্বাট মার্কিউস-এর মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিন্তক-তাত্ত্বিকরা অনেকেই দেখিয়েছেন যে মার্কস হেগেলের ১৮০৭ সালে প্রকাশিত Phenomenology of Spirit গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট ‘প্রভু-ভৃত্য দ্বন্দ্ব’ (Herrschaft and Knechtschaft)-এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় (dialectics) এর অবতারণা করেছিলেন। অবশ্য এই বক্তব্য যথেষ্ট বিতর্কিত। বিতর্ক বাদ রেখে বলা যায় ধারণাটি চমকপ্রদ এবং মার্কসের বিপ্লব প্রচেষ্টা এবং ইতিহাসচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকের ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করে থাকতে পারে। প্রথমে অত্যন্ত মোটা দাগে ‘প্রভু-ভৃত্য’ দ্বন্দ্বের স্বরূপটিকে দেখে নেওয়া যাক। প্রভু হল সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যার কাছে স্বাধীনতা হল সবচেয়ে বেশি কাম্য। অন্যদিকে ভৃত্যের কাছে যেকোনও মূল্যে প্রাণধারণটাই লক্ষ্য, তার জন্যে অন্যের কাছে দাসত্ব স্বীকার করাটা অন্যায় নয়। দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় ভৃত্যের অস্তিত্ব ছাড়া প্রভুর অস্তিত্ব মূল্যহীন। এ ছাড়াও আরও একটা কারণে প্রভু ভৃত্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে, কারণ জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করে দাস। এক দিকে যখন ভৃত্যের শ্রমে উৎপন্ন জিনিসপত্রে মালিক বিলাসব্যসনে ব্যস্ত তখন বিলাসের প্রয়োজনীয় উপাদান উৎপাদন করবার মধ্য দিয়ে শ্রমপ্রক্রিয়ায় ভৃত্য/দাস আত্মসচেতন হয়ে উঠতে থাকে। দাসের আত্মসচেতনতা প্রভুর প্রতি আনুগত্যে চিড় ধরাতে শুরু করে। এই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া থেকেই একদিন প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক উলটে যায়। হেগেলের এই ‘প্রভু-ভৃত্য’ দ্বন্দ্বটি দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া অনুধাবন করবার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত থিসিস, অ্যান্টিথিসিস এবং সিন্থেসিস-এর ধারাবাহিকতা বুঝবার ক্ষেত্রে। মার্কস যখন কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-তে বলেন যে, পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট কলের মজুর পুঁজিবাদের কবরখনক হয়ে উঠবে তখন এই প্রতীতির পেছনে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি এবং বিশেষ করে ‘প্রভু-ভৃত্য দ্বন্দ্ব’-র প্রচ্ছন্ন ছায়া দেখতে পাওয়া যায়।

স্ট্রালোতে রুমেলবার্গার হ্রদের ধারে মার্কস যে হেগেলের ‘কিম্ভূত সুর’-এর মূর্ছনায় আচ্ছন্ন হতে হতে পরবর্তীকালে তাঁর তত্ত্ববিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘দ্বন্দ্ববাদ’কে আত্মস্থ করছিলেন তা-ই নয়, স্ট্রালোতেই স্প্রে নদীর ধারে এক শুঁড়িখানায় মার্কসের সাক্ষাৎ হল এক ঝাঁক তরুণ হেগেলপন্থীদের সাথে। এরা তখন হেগেলের মতামত ও তার পরিণতি নিয়ে তুমুল তর্কে মশগুল। এদের অনেকেই ইতিমধ্যে বাম দিকে ঝুঁকে পড়েছেন এবং হেগেলের রাষ্ট্রবাদ বা এককথায় প্রাশিয়ার সরকারের চাটুকারিতার তীব্র সমালোচকে পরিণত হয়েছেন। এদের সংস্পর্শে না এলে মার্কস তাঁর ভবিষ্যৎ অভীষ্ঠের সন্ধানে যাত্রা করতেন কি না সন্দেহ। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে— মার্কস তাঁর পুঁজি-তে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে আপাতদৃষ্টিতে যা দেখা যায়, সত্য অনেক ক্ষেত্রেই তার থেকে আলাদা, যেমন মজুরির আড়ালে লুকিয়ে থাকে মুনাফা। আর এই সত্যকে উদ্ঘাটন করবার জন্য প্রয়োজন নির্মোহ এবং নিষ্ঠুর তর্ক। সেদিন স্প্রে নদীর ধারে শুঁড়িখানায় তরুণ মার্কস এই হেগেলপন্থীদের সাথে ওই কূটতর্কে মাতছিলেন ঊর্ণা ছিন্ন করে সত্যের সন্ধানে। এই তরুণদের মধ্যে একজন এডোয়ার্ড গান্স। প্রাশিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাসের উপর তাঁর টীকাভাষ্য শোনবার জন্য দূরদূরান্ত থেকে ছাত্ররা আক্ষরিক অর্থে মশালের আলোয় সভাঘর ভরিয়ে তুলত। ‘গুরু’ হেগেল মনে করতেন ‘রাষ্ট্রই হল (এক্ষেত্রে প্রাশিয়া) ঈশ্বরের মূর্ত প্রতীক’। গান্স হেগেলের তত্ত্বের অন্তর্নিহিত সত্যকে অস্বীকার না করলেও রাজনৈতিক উদারবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পালটা যুক্তি দিলেন যে, ঈশ্বরের ইচ্ছা সাকার হয় বিরোধিতার মাধ্যমে, কারণ বিরোধিতা না থাকলে রাষ্ট্র অলস তন্দ্রায় ডুবে যাবে। এতে করে রাষ্ট্রবিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দেবে। এইভাবে তরুণ হেগেলপন্থীরা ক্রমেই হেগেল তত্ত্বের সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন। মার্কসও সেই ছোঁয়াচ এড়াতে পারেননি।

ভাববাদ থেকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ : তরুণ মার্কসের চিন্তার বিকাশ

এই সময়েই আর একটি ঘটনা ঘটল যা মার্কসকে বিশুদ্ধ তত্ত্বচিন্তার গজদন্তমিনার থেকে উৎখাত করল, যার সরাসরি প্রভাব পড়ল মার্কসের তত্ত্ববিশ্বে, তাঁর ইতিহাসচিন্তায়। ১৮৪০-এ চতুর্থ ফ্রেডেরিখ উইলিয়াম প্রাশিয়ার রাজা হলেন। প্রাথমিকভাবে মনে করা গিয়েছিল যে তিনি রাজনৈতিক সংস্কার অর্থাৎ গণতন্ত্রীকরণের রাস্তায় হাঁটবেন, কিন্তু মার্কসের ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্যি প্রমাণ করে সেই আশা অচিরেই মরীচিকায় রূপান্তরিত হল। বস্তুত ফ্রেডরিখের মধ্যে হেগেল যে যুক্তিবাদী রাষ্ট্রের পরাকাষ্ঠা দেখেছিলেন চতুর্থ ফ্রেডরিখ উইলিয়াম ছিলেন তার বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। তাঁর লক্ষ্য ছিল জার্মান অস্মিতার নামে জাঁকজমকপূর্ণ খ্রিস্টীয় রাজাদর্শ প্রতিষ্ঠা। এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ব্রুনো বাউয়ের-এর ধর্মতত্ত্বীয় ব্যাখ্যা চিন্তার জগতে বড়সড় পরিবর্তন নিয়ে এল। ১৮৪২ সালে তিনি লিখলেন Christianity exposed। এর মধ্যে ফ্রেডেরিখ উইলিয়ামের ধর্মীয় ভাবাবেগ তাড়িত প্রুশীয় রাষ্ট্রের সমালোচনার বীজ লুকিয়ে ছিল। স্বাভাবিক গতিতে এই বিরোধিতার জন্য ব্রুনোকে বার্লিন ছেড়ে বন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যেতে হয়। মার্কসের প্রতিভায় আকৃষ্ট হয়ে বাউয়ের মার্কসকে গবেষণা তাড়াতাড়ি শেষ করে তাঁর সাথে যোগ দেবার আমন্ত্রণ জানান। ইতিমধ্যে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী অল্টেনস্টাইন মারা গেলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন ফ্রেডেরিখ ফন আইশহর্ন। এতদিন ধরে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাধিকার দানের যে নীতি অনুসৃত হয়ে আসছিল তা এক লহমায় বদলে গেল। ব্রুনো বাউয়ের বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত হলেন। অন্যত্রও উদারনীতির পরিসর দ্রুত কমে এল। মেন্টরের প্রস্থানে মার্কসের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সমস্ত সম্ভাবনার ইতি ঘটল। বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার জগৎ থেকে মার্কস নিক্ষিপ্ত হলেন সাংবাদিকতার দুনিয়ায়, বিপ্লবসাধনায় এক পা এগোলেন।। এইসময় রাইনিশে ৎসাইটুং সংবাদপত্র প্রকাশ শুরু হলে পত্রিকার পরিচালকমণ্ডলীর মধ্যে কেউ কেউ মার্কসকে প্রথমে সাংবাদিক হিসাবে এই পত্রিকায় লেখার ব্যাপারে রাজি করান। দ্রুত তিনি ১৮৪২-এর অক্টোবর মাসে পত্রিকার প্রধান সম্পাদক পদে উন্নীত হন। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তত্ত্বের গজদন্তমিনার থেকে মার্কসকে নেমে আসতে হল ‘এস্টেটস’-এ বিভক্ত আইনসভায়, দুনিয়াদারির জগতে। বাস্তবের মাটিতে আছাড় খেয়ে হেগেলীয় রাজনৈতিক দর্শনের আদর্শ চুরমার হয়ে গেল।

১৮৪২-এর জানুয়ারিতে Deutsche Jahrbücher für Wissenschaft und Kunst-এ প্রকাশিত একটি চিঠিতে মার্কস প্রথম হেগেলের ভাববাদী দর্শনের প্রতিষেধক হিসাবে ফয়েরবাখ অনুসৃত বস্তুবাদী পদ্ধতি অনুসরণের ইঙ্গিত দিলেন। তিনি দেখালেন চিন্তা বিমূর্ত নয়, জীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত। ‘Luther as Arbiter between Strauss and Feuerbach’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে মার্কস এই সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন ‘অগ্নিবর্ষী পথ ছাড়া সত্য ও স্বাধীনতা প্রাপ্তি সম্ভব নয়’। শেষপর্যন্ত প্রাশিয়ার দারিদ্র নিয়ে মার্কসের তদন্তমূলক সাংবাদিকতা সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর হয়ে উঠলে রাশিয়ার জার-এর অভিযোগের অজুহাত দেখিয়ে মার্কসকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হল। এই ঘটনা মার্কসকে বিপ্লবের পথে আরও এগিয়ে দিল। রাইনিশে ৎসাইটুং বন্ধ করে দেওয়া হলে আপাতত দুনিয়াদারির অঙ্গন থেকে ছুটি নিয়ে ক্রয়েৎসনাখ-এ হবু শাশুড়ি ক্যারোলিন ফন ভেস্টফালেন-এর বাগানবাড়িতে পড়াশুনায় ডুবে গেলেন মার্কস। এখানেই দীর্ঘদিনের বাগদত্তা য়েনি-র সাথে তাঁর বিয়ে হল ১৮৪৩ সালের ১৯ জুন। দেশান্তরী হবার আগে সদ্যবিবাহিত মার্কস তখন তাঁর প্রুশীয় রাষ্ট্রের সাথে হালে-হওয়া সংঘাতের প্রেক্ষিতে হেগেলীয় রাষ্ট্রচিন্তাকে নতুন করে বিশ্লেষণ করছেন।

এই চর্চা (যার প্রকাশ ঘটেছে Critique of Hegel’s Philosophy of State-এ, রচনাকাল ১৮৪৩ সালের মার্চ থেকে আগস্ট মাস) মার্কসকে হেগেলীয় রাষ্ট্রতত্ত্বের বিরোধী করে তুলল। বামপন্থী নব্য হেগেলীয়দের সঙ্গেও একইসময় মার্কসের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে কারণ, এখানে মার্কস প্রমাণ করলেন প্রাশিয়া রাষ্ট্রের সঙ্গে হেগেলের সমঝোতা সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ প্রণোদিত নয়, সমস্যার মূল প্রোথিত আছে হেগেলের যুক্তিকাঠামোর মধ্যেই।

ফয়েরবাখ দেখিয়েছিলেন হেগেলের মতো দার্শনিকেরা ‘চিন্তা’ (Idea) বা ‘যুক্তি’কে ঈশ্বরপ্রতিম বানিয়ে তুলেছেন যার অনির্দেশ্য অঙ্গুলিহেলনে জগৎ চলছে। কিন্তু Essence of Christianity-তে তিনি মন্তব্য করলেন: ‘তর্কবাগীশ দার্শনিকরা প্রকৃতি, ধর্ম বা দর্শনকে বিশুদ্ধ চিন্তার অভিব্যক্তি হিসাবে দেখলেও নির্মোহ সত্যকে উপলব্ধি করতে হলে ‘বিধেয়’কে উদ্দেশ্যে রূপান্তরিত করতে হবে।’ মার্কস ফয়েরবাখের এই যুক্তিকে অনুসরণ করে দেখালেন ঈশ্বরের মতোই রাষ্ট্র সংহত পুরসমাজ কর্তৃক সৃষ্ট হলেও কর্তা/উদ্দেশ্য এবং কর্ম/বিধেয়-র মধ্যে বর্ণবিপর্যয় ঘটে গেছে। যুক্তিকাঠামোর এই গলদের কারণেই হেগেলের মূল প্রতিপাদ্য— ‘রাষ্ট্র’ সর্বজনীন (Universal) এবং বিশেষ (Particular)-এর মিলনের ফল এবং তাঁর নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের ওকালতি সংগতিপূর্ণ নয়। ‘Critique’-এ মার্কস হেগেলের রাষ্ট্র ও সংহত পুরসমাজের আন্তঃসম্পর্ক, তার গণতন্ত্র বা আমলাতন্ত্র ও ভোটদান সম্পর্কিত ধারণার অনুপুঙ্খ সমালোচনা করেছেন। মার্কস ফয়েরবাখের অনন্বয় (Alienation)–এর ধারণাকে ব্যবহার করে হেগেলের জনগণের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে আপত্তিকে নস্যাৎ করলেন। এই সময় থেকেই মার্কস গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক হয়ে ওঠেন। তরুণ মার্কস এই সময় থেকেই ফরাসি বিপ্লবের একনিষ্ঠ পাঠকও হয়ে ওঠেন। ফরাসি বিপ্লবের ঐতিহাসিকদের থেকেই তিনি শ্রেণিসংগ্রামের ধারণাটি রপ্ত করেন। লুসিও কলেত্তি-র মতো মার্কসবেত্তা আরও এগিয়ে বলছেন ‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের’ ধারণা তিনি রুশো-র কাছ থেকে পেয়েছিলেন।

ফয়েরবাখের পদ্ধতি দেখিয়েছিল মানুষই ঈশ্বরের ধারণার সৃষ্টিকর্তা হলেও অবস্থার বৈগুণ্যে (অনন্বয় জনিত) নিজেই কখন সেই সৃষ্টির দাসানুদাস হয়ে পড়েছে। মার্কস দেখালেন মানুষের দ্বারা সৃষ্ট হলেও একইভাবে রাষ্ট্রই এখন সংহত পুরসমাজের নিয়ন্তা হয়ে বসেছে, মানুষ রূপান্তরিত হয়েছে তার আজ্ঞাবহে। একমাত্র প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের মাধ্যমেই এই বিযুক্তির শাপমোচন সম্ভব।১০

১৮৪৩ থেকে ১৮৪৪-এর অন্ত পর্যন্ত এই পর্বে মার্কসের ব্যক্তিগত এবং চিন্তার জগতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটল। ১৮৪৩-এ মার্কস দেশান্তরী হলেন। এই পর্বে প্যারিসে প্রবাসজীবনে তাঁর এঙ্গেলসের সাথে সখ্য ও যৌথ গবেষণা/কাজকর্মের সূত্রপাত। এই সময়তেই তিনি ধ্রুপদি অর্থনীতির চর্চা শুরু করছেন যা তাকে অন্য জার্মান দার্শনিক/চিন্তকদের থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। এর পাশাপাশি এই সময়তেই ফ্রান্সে প্রভাবশালী/গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক ও সংগঠকদের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগের সূত্রপাত। এই সময়তে হেগেলের অদ্বৈত চিন্তার ধারণাকে ফয়েরবাখের অনন্বয়ের ধারণার মাধ্যমে অরূপ, মনোময় জগৎ থেকে রক্তমাংসের রূপময় লোকায়ত সমাজে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। এই প্রক্রিয়া মার্কসকে সরাসরি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের ধারণার কাছাকাছি নিয়ে আসছে যা একমাত্র সমাজতন্ত্রেই উপলব্ধি করা সম্ভব। মার্কস এইভাবে যত এক পা এক পা করে রাজনৈতিকভাবে চরমপন্থার দিকে যাত্রা করেছেন ততই তাঁর তত্ত্ববিশ্ব বস্তুবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

On the Jewish Question-এ মার্কস রাজনৈতিক অনন্বয়ের ধারণাকে আরও এক পা এগিয়ে দিলেন। সংহত পুরসমাজ এবং তার রাজনৈতিক প্রকাশ— রাষ্ট্রের মধ্যেই কেবল বৈগুণ্য ঘটেনি। সংহত পুরসমাজেও সম্পত্তি, ব্যক্তিস্বার্থের সংঘাত বর্তমান। তাই মানুষের অধিকার সংক্রান্ত সনদ অবশ্যই এক ক্রান্তিকারী পদক্ষেপ কিন্তু মানুষের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়। ফরাসি বিপ্লবের রাজনৈতিক মুক্তির দ্বৈততাকে মার্কস ব্যক্ত করেছেন এইভাবে: ১৭৯৩-এর ফরাসি সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে সম্পত্তির অধিকারকে সার্বজনীন করে দেওয়া হয়। সেই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে মার্কস লেখেন, ‘It lets every man find in other men not the realization but rather the limitation of his own freedom.’১১ আবার, ‘Civil society does not raise itself above its egoism through the concept of security. Rather, security is the guarantee of the egoism.’১২

মার্কস রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার এক ঐক্য চাইলেন, যার মূল কথা হল রাজনৈতিক শৃঙ্খল ভেঙে পুরসমাজকে স্বার্থান্বেষী যে-ভাবনা আচ্ছন্ন করে রাখে তার অবসান ঘটানো। ‘Toward the Critique of Hegel’s Philosophy of Law: Introduction’-এ মার্কস এই অভিযোগ করেছিলেন ফয়েরবাখ প্রকৃতি নিয়ে যতটা ভাবিত রাজনীতি নিয়ে (এককথায় বদল ঘটাতে) ততটা নয়। পরে এই অভিযোগই ফয়েরবাখের বিরুদ্ধে বিখ্যাত একাদশ থিসিসের পূর্ণাঙ্গ রূপ পরিগ্রহ করবে। মার্কস মন্তব্য করেছেন: ‘Thus the criticism of heaven turns into the criticism of the earth, the criticism of religion into the criticism of law and the criticism of theology into the criticism of politics.’১৩

এই প্রবন্ধ (১৮৪৩-৪৪) প্যারিসে বসে লেখা। এই প্রবন্ধেই প্রথম বার মার্কস প্রলেতারিয়েতের মধ্যে সর্বাঙ্গীণ মানবমুক্তির ভগীরথকে চিহ্নিত করলেন। আগেই দেখেছি ‘Critique of Hegel’s Philosophy of State’ প্রবন্ধে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, হেগেলের সাচ্চা রাষ্ট্রকে হাসিল করতে হলে আমলাতন্ত্র নয়, প্রয়োজন প্রকৃত গণতন্ত্র। আর এই প্রবন্ধে প্রথম বার তিনি স্পষ্ট করে দিলেন এই কাজ করবে খেটে-খাওয়া মজুর। মার্কসের তত্ত্ববিশ্বে এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের পিছনে অনেকগুলো কারণ ছিল— লোরেঞ্জ ফন স্টাইন এবং ফ্লোরা ত্রি্‌রস্তান-এর লেখায় তিনি শ্রমিকশ্রেণির সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছিলেন; প্যারিসে, প্রবাসে তখন তিনি ভয়ংকর অর্থকষ্টে কাটাচ্ছেন। এই সময় প্যারিসে বেশ কিছু সমাজতন্ত্রী শ্রমিকের সান্নিধ্যে সহমর্মিতার উষ্ণতা অনুভব করছিলেন। এক দিকে ফয়েরবাখের পদ্ধতি অনুসরণ করে সমাজ ও রাজনীতির কেন্দ্রে রক্তমাংসের মানুষকে নিয়ে এলেন; প্রকৃত মানবতা, আর অন্য দিকে হেগেলের রাজনৈতিক দর্শনকেও তিনি জুড়ে দিলেন। হেগেল আগেই দেখেছিলেন যে, দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় শিল্প-বাণিজ্য এক দিকে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে অপরিমেয় সম্পদের পুঞ্জীভবন ঘটিয়েছে আর তার অ্যান্টিথিসিস হিসাবে এক বিশ্বজনীন কাঙাল মজুর সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়েছে। এই শৃঙ্খলিত মজুরেরাই শৃঙ্খল মোচনের মাধ্যমে মানবমুক্তি ঘটাবে। দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় মার্কস প্যারিসের এই প্রবাসে ফয়েরবাখ এবং হেগেলের মধ্যে দ্বৈতাদ্বৈত সম্মিলন ঘটালেন, যা ১৮৪৪ থেকে ১৮৪৮-এ কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশের অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত মার্কসের পরিপূর্ণ বিকশিত চিন্তার অন্যতম স্তম্ভে পরিণত হল।

এই প্রবণতা আরও স্পষ্ট হল Economic & Philosophic Manuscripts of 1844-এ, যেখানে মার্কস, প্রুধোঁ এবং ফুরিয়ের-এর ‘স্থূল’ কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছেন। প্রুধোঁ-রা যেভাবে গরিবি লাঘব করবার জন্য সবাইকেই গরিব করতে চেয়েছেন তার বিরোধিতা করে Poverty of Philosophy–তে মার্কস সমাজতন্ত্রের ধারণাকে আরও বিকশিত করলেন। ফয়েরবাখের মানবতাবাদ এবং হেগেলের ডায়ালেকটিক ব্যবহার করে শ্রম, পুঁজি, সম্পত্তির মালিকানা এবং কমিউনিজ়ম সম্বন্ধে ১৮৪৪-এর গ্রীষ্মে মার্কস কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন। ১৯৩২ সালে এই পাণ্ডুলিপি প্রথম প্রকাশিত হয়। তারপর থেকে, বিশেষ করে পুঁজি-তে মার্কসের পূর্ণাঙ্গ চিন্তার ভিত্তি হিসাবে এই রচনার গুরুত্ব স্বীকৃত হয়ে আসছে। ‘অনন্বিত শ্রম’ অংশটিতে মার্কস দেখাচ্ছেন কীভাবে উৎপাদনের যন্ত্র, উৎপাদিত বস্তু এবং উৎপাদনের সামাজিক প্রক্রিয়া শ্রমিককে তার শ্রম থেকে বিযুক্ত করে দিয়েছে। এই বিযুক্তি মানুষকে অসম্পূর্ণ করে রেখেছে। ‘ব্যক্তি মালিকানা এবং কমিউনিজ়ম’ অংশটিতে মার্কস প্রুধোঁ এবং ফুরিয়ের-এর সম্পত্তি তাড়িত ‘স্থূল’ সমাজবাদের বিরোধিতা করে দেখাচ্ছেন অসম্পূর্ণ মানুষকে পূর্ণতা পেতে হলে এই বিযুক্তিকে এড়িয়ে নয়, পেরিয়ে যেতে হবে। চতুর্থ পাণ্ডুলিপিতে মার্কস হেগেলের Phenomenology of Spirit-এর নির্যাস তৈরি করেছেন। তৃতীয় পাণ্ডুলিপিতে মার্কস হেগেলের দ্বন্দ্ব প্রক্রিয়ার আলোচনায় মানুষকে তার নিজের কাজের দ্বান্দ্বিক ফসল হিসাবে উপলব্ধি করবার জন্য প্রশংসা করছেন। হেগেলের সমস্যা হচ্ছে দ্বন্দ্বকে কেবল একটি বিশুদ্ধ চিন্তাস্রোত হিসাবে চিহ্নিত করা। ফয়েরবাখের ‘মানবতাবাদ’কে কাজে লাগিয়ে মার্কস ‘পূর্ণাঙ্গ স্বাভাবিকতা’-র ধারণা তৈরি করেছেন যেখানে হেগেলের দ্বান্দ্বিক সত্য এবং ফয়েরবাখের ‘বস্তুবাদী’ সত্যের যুগল সম্মিলন/দ্বৈতাদ্বৈত ঘটেছে।

‘প্যারিস পাণ্ডুলিপি’তে মার্কস ব্যক্তিমালিকানা এবং শ্রমের বিযুক্তির দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের ধারণাকে আরও বিকশিত করলেন। Paris Vorwärts-এর জন্য লেখা ‘Critical Notes on The King of Prussia and Social Reform’-এ সাইলেশিয়া-তে বয়নশিল্পে জড়িত শ্রমিকদের ‘অভ্যুত্থান’ সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে মার্কস দেখাচ্ছেন রাষ্ট্র কেন সামাজিক সংকট সমস্যা সমাধানে অপারগ, কারণ সে নিজেই ব্যক্তিমালিকানা, শিল্প এবং সামাজিক শ্রেণিগুলির পারস্পরিক লুঠতরাজের থেকে আলাদা/স্বতন্ত্র/নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করতে পারে না।

Holy Family-তে ‘Critical Battle Against French Materialism’ অংশে মার্কস বলেছেন, ‘If man is formed by circumstances, then his circumstances must be made human. If man is by nature social and then he develops his true nature only in society & the power of his nature must be measured not by power of the single individual, but by the power of society.’১৪ ওই বইটিতেই মার্কস দাবি করেছেন ফরাসি এবং ইংরেজ বস্তুবাদীরা (যেমন ফুরিয়ের, বাবুফ এবং আওয়েন) সাম্যবাদের যৌক্তিক ভিত্তি হিসেবে বস্তুবাদ তথা যথার্থ মানবতাবাদের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।

German Ideology-তে (যা মার্কস এবং এঙ্গেলস যৌথভাবে নভেম্বর ১৮৪৫ থেকে অক্টোবর ১৮৪৬-এ লিখেছেন, যদিও এঙ্গেলস পরবর্তীকালে বলেছেন প্রথম অংশটি মার্কস আগেই লিখে ফেলেছিলেন) ফয়েরবাখের মানবতাবাদের প্রশংসা করলেও মার্কস তাঁর পদ্ধতির ত্রুটিগুলি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।১৫ ব্যক্তিমানুষ তো রবিনসন ক্রুশো নয়। বস্তুত এডওয়ার্ড হ্যালেট কার What is History-তে দেখান সমাজবদ্ধ মানুষের কারবার নিয়েই ইতিহাস, রবিনসন ক্রুশো-র নিঃসঙ্গ জীবনে ম্যান ফ্রাইডে-র অনুপ্রবেশ ঐতিহাসিক মুহূর্ত তৈরি করে, মার্কস তাই রক্তমাংসের মানুষকে তার সমাজ পরিবেশ ইতিহাস থেকে বিযুক্ত করবার বিরোধী।

‘বস্তুবাদী’ ইতিহাসের সন্ধানে মার্কস

১৮৪৫-এ তাঁর সুপরিচিত Theses on Feurbach-এ মার্কস বললেন ফয়েরবাখের সমস্যা হল তাঁর মতো বস্তুবাদীরা ভুলে যান যে মানুষকেই শেষপর্যন্ত নিজের পরিস্থিতি বদল করতে হয়। হেগেলের বিশুদ্ধ চিন্তার সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে মার্কস ফয়েরবাখের ‘মানবিক’ বস্তুবাদের আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি ফয়েরবাখের ‘মানুষ’ও আদর্শায়িত স্বপ্নকল্প, রক্ত-ঘাম মাখা বাস্তবের মানুষ নয়। মার্কস এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন ‘জীবনকে চেতনা নির্ধারণ করে না, চেতনা জীবনকে নির্ধারণ করে’। ফয়েরবাখের স্বপ্নকল্প মানুষকে বাস্তবের জীবনে প্রতিষ্ঠার দরকার, আর এই প্রয়োজন থেকেই মার্কসের (এঙ্গেলস সম্পর্কেও সমানভাবে প্রযোজ্য) পরবর্তী রচনাসম্ভারের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে ঐতিহাসিক ঘটনার আলোচনা। German Ideology, Communist Manifesto, Socialism: Utopian and Scientific-এর মতো একাধিক রচনায় মানবসমাজের ঐতিহাসিক বিবর্তনের কথা বারে বারে উঠে এসেছে। এমনকী পুঁজি-র প্রথম খণ্ডের বিষয়বস্তু মূলত পলিটিক্যাল ইকনমি সংক্রান্ত হলেও পুঁজির জন্মবৃত্তান্ত আলোচনায় বারে বারে ইতিহাসের অনুষঙ্গ উঠে এসেছে।

এই ইতিহাস সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি— যাকে বস্তুবাদী ইতিহাস (মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলস যাকে ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন) বলা হয়, ইতিহাস রচনার পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এল, German Ideology-তে এই ইতিহাস দর্শনের মূলসূত্রগুলির প্রথম পুর্ণাঙ্গ আলোচনা পাওয়া যায়।১৬ অন্যান্য প্রাণীদের মতো মানুষকে বেঁচে থাকার উপকরণ সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীদের থেকে মানুষের তফাত হল এই উপকরণ সে নিজেই বানায়।১৭ কাজেই ইতিহাসের মূল ভিত্তি হল উপকরণের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন। এই উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানুষ পরস্পরের সাথে এবং প্রকৃতির সাথে একটি নির্দিষ্ট বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এই বন্ধন বা সম্পর্কের চরিত্র একটি নির্দিষ্ট কালসীমানায় সমাজকেও একটি বিশেষ চরিত্র দান করে। মানুষ যেমন তার কাজ দিয়ে পারিপার্শ্বিকের উপর প্রভাব ফেলে তেমনই নিজে পারিপার্শ্বিক দ্বারা প্রভাবিত হয়।

১৮৪০-এর দশকে নৃতাত্ত্বিক তথ্য, প্রাচীন জনজাতির জীবন সম্পর্কে খুব-একটা তথ্য পাওয়া যেত না। তা সত্ত্বেও মার্কস এবং এঙ্গেলস মনে করতেন প্রাচীন জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে উৎপাদনে— উঞ্ছবৃত্তি, শিকার, পশুপালন, আদিম কৃষি বা তাঁত— বয়স বা লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন ছাড়া শ্রমবিভাজনের খুব প্রসার ঘটেনি। অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটল দাসব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটবার পর। এরপর থেকে শ্রম বিভাজন জটিল আকার ধারণ করল। পরবর্তী সমস্ত সমাজে অন্তত একটি শ্রেণি ছিল যারা সম্পত্তিহীন (প্রাচীন গ্রিস, রোম সমাজে দাস, সামন্ত সমাজে ভূমিদাস এবং পুঁজিবাদী সমাজে কলের মজুর)। এদের সাথে সম্পত্তির মালিক শ্রেণির (দাস-মালিক, অভিজাত ও কল-মালিক) সাথে ওই নিঃস্বদের স্বতঃই সংঘাত লেগে থেকেছে। (কমিউনিস্ট ইস্তাহার-এ গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য হল: ‘এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত সব সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস।’)

বস্তুবাদী ইতিহাসচর্চার ব্যাবহারিক উদ্দেশ্য ছিল বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের লড়াইয়ের রাস্তা বাতলে দেওয়া। এই লড়াই কেন প্রয়োজন? তরুণ মার্কসের নৈতিক উপলব্ধি ছিল মানুষ অসম্পূর্ণ (অসম্পূর্ণতার কারণ তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন শ্রমের বিযুক্তির মধ্যে)। শূন্যগর্ভ মানুষকে পরিপূর্ণ করবার ব্রতই তাঁকে সারাজীবন তাড়া করে বেড়িয়েছে। কিন্তু পথ কী? তারও আগে প্রশ্ন হল, শূন্যতার কারণ কী? ‘১৮৪৪-এর পাণ্ডুলিপি’তে তিনি দেখালেন পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শ্রমিক এবং তার শ্রম মানবিক উপাদান হারিয়ে কেবল মাত্র পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। দ্বান্দ্বিকতার সূত্র ধরে মার্কস প্রস্তাব করলেন এই যন্ত্র হয়ে যাওয়া মানুষই পারে ‘শূন্যকে পূর্ণ’ করার ব্রতকে সফল করতে। এটা মার্কসের মনোগত ধারণার প্রকাশ নয়, যৌক্তিক উপসংহার। রবীন্দ্রনাথের কথায় বললে ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে, মোদের ততই বাঁধন টুটবে।’ যেহেতু প্রোলেতারিয়েতের ‘শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার আর কিছু নেই,’ তাই তার অন্যকে শৃঙ্খলিত করবার প্রয়োজন/স্বার্থও নেই। আর তাই প্রোলেতারিয়েত মার্কসের চোখে নিজের মুক্তির সাথেই মানবমুক্তির ভগীরথ হয়ে ওঠে।১৮

মার্কসের তত্ত্ববিশ্বের ভাঙা-গড়া চলছিল ইউরোপের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। কমিউনিস্ট ইস্তাহার (১৮৪৮) রচনার পূর্ববর্তী এক দশক জুড়ে ইউরোপে এক দিকে শিল্পবিপ্লবের অকল্পনীয় অগ্রগতি ঘটছিল। অন্য দিকে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৮৪৪ থেকে খাদ্যসংকট শুরু হয়। ১৮৪৭-এ বাণিজ্যচক্রের বিপর্যয়ের ফলে ক্ষুধা নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে ওঠে। শিল্প-বাণিজ্যের বিকাশের ফলে সম্পদের পুঞ্জীভবন ঘটছিল মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে। তার পাশেই শিল্প শহরগুলির নোংরা ঘিঞ্জি গলির কোনায় জমে উঠেছিল পরিশ্রান্ত, নিরন্ন মানুষের ভিড়। পরিস্থিতির জাঁতাকলে পড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছিল। গরিব নিঃস্ব মানুষরা সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করছিলেন। এই পরিবেশেই ১৮৩০-১৮৪৮-এ সমাজবাদের স্লোগান কল্পরাজ্য থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ফ্রান্সে রাজনৈতিক আন্দোলনের দীর্ঘ ঐতিহ্যে লালিত হয়ে কয়েক জন সমাজতান্ত্রিক নেতা তত্ত্ব ও প্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন ফুরিয়ের, সাঁ সিমোঁ, ওগুস্ত ব্লাঁকি, লুই ব্লাঁ, এবং প্রুঁধো। এদের কয়েক জনের সঙ্গে মতের মিল হোক বা না-হোক মার্কসের প্যারিসে প্রবাসজীবনে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইংল্যান্ডে ফ্রান্সের মতো উত্তাল রাজনৈতিক আন্দোলনের ঐতিহ্য ছিল না। এখানে সমাজতান্ত্রিক চিন্তার বিকাশ ঘটেছিল রাজনৈতিক অর্থনীতির চর্চার মধ্যে দিয়ে। মার্কস নিজেই তাঁর অর্থনৈতিক চিন্তার উপর রিকার্ডো-র প্রভাব স্বীকার করেছেন। রিকার্ডো বলেছিলেন, জমির মালিকরা কৃষি উৎপাদনে বিন্দুমাত্র অবদান না রেখেও কেবলমাত্র মালিকানার সুবাদে ভাড়ার (rent) মাধ্যমে উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ করে। মার্কস এই সাদৃশ্য/উপমিতি ব্যবহার করে দেখালেন কলের মালিকও তাঁর পুঁজির সুবাদে (যা আসলে সামাজিক উদ্বৃত্ত) একইভাবে মুনাফা ভোগ করে। এর পাশাপাশি রবার্ট আওয়েন সমবায় গড়ে তুলে উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যক্তিমালিকানার অবসান ঘটানোর কথা বললেন। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে সেই টালমাটাল সময়ে পুঁজিবাদী সমাজের সমাজতন্ত্রী সমালোচনা গড়ে উঠেছিল মূলত তিনটি ধারায়। প্রথমত, পুঁজিবাদী অর্থনীতি, যার থেকেই এই দুঃখদুর্দশার উৎপত্তি, তার ব্যাখ্যা ও সমালোচনা। দ্বিতীয়ত, উদারবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শের সমালোচনা, কারণ তার ভিত্তি হল মানুষকে স্বার্থপর একক ব্যক্তি হিসাবে কল্পনা। তৃতীয়ত, কেউ কেউ মনে করলেন ন্যায্য সমাজ তৈরি হবে পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যে থেকেই। এই তিনটি ধারার ত্রিবেণি সংগম ঘটল মার্কসের চিন্তায়।

১৮৩০-এর দশকেই ইংল্যান্ডে শিল্পজাত পণ্যের বন্যায় জার্মানির কারিগরি শিল্পে সংকট দেখা দিলে বেশ কয়েকটি অভ্যুত্থান ঘটে। এই অভ্যুত্থানকারীরা দেশান্তরী হতে বাধ্য হলে League of Banned, League of the Just বা German Workers’ Educational Society-র মতন একাধিক সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। এই সংগঠনগুলি প্রাথমিকভাবে জার্মান কারিগরদের দ্বারা এবং তাদের জন্য তৈরি হলেও ক্রমেই শ্রমজীবী মানুষের মুখপাত্র হয়ে উঠতে থাকে।

কারিগরসুলভ মানসিকতা বজায় রাখায় প্রথমে মার্কস এদের সাথে নৈকট্য অনুভব না করলেও ১৮৪৬ থেকে দূরত্ব কমতে থাকে। মার্কস ততদিনে ফ্রান্স থেকে নির্বাসিত হয়ে ব্রাসেলসে রয়েছেন এবং এঙ্গেলসের সহযোগিতায় Correspondence Society তৈরি করে ফেলেছেন। যখন বিভিন্ন সংগঠনগুলির সংযুক্তির মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট লিগ আত্মপ্রকাশ করল তখন তাঁদের নির্বন্ধে মার্কস এবং এঙ্গেলস যৌথভাবে কমিউনিস্ট ইস্তাহার লিখবার দায়িত্ব নিলেন যেখানে এতদিন ধরে তিলে তিলে যে বস্তুবাদী ইতিহাসচিন্তা, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং বৈপ্লবিক রাজনীতি তাদের সুচারু সংশ্লেষ ঘটল।

উপসংহার

কমিউনিস্ট ইস্তাহার-এ বিপ্লবের জন্য নিখুঁত ধাপে ধাপে বিপ্লবের ছক পেশ করা হয়েছিল— প্রথমে বিপ্লবের মাধ্যমে সামন্ত্রতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে বুর্জোয়া গণতন্ত্র এবং ধনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। তারপর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বাতাবরণের মধ্যে শ্রমিকশ্রেণি নিজেদের সংগঠিত করবার মধ্য দিয়ে এই বুর্জোয়া পুঁজিবাদের অবসান ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সমাজ বিবর্তনের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে এই যে একটি সুচারু ছক তাঁরা তৈরি করেছিলেন, ১৮৪০-এর জার্মানিকে দেখে মার্কস কিন্তু তার সাফল্যে সন্দিহান হয়ে ওঠেন। সেখানে শ্রমিকশ্রেণির যে দ্রুত বিকাশ ঘটেছিল তাতে আসন্ন সমাজবিপ্লবকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের চৌহদ্দিতে আটকে রাখা সম্ভব/কাম্য কি না তাই নিয়ে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। বস্তুত কমিউনিস্ট ইস্তাহার-এই অনুমান করা হয়েছিল যে, জার্মান প্রোলেতারিয়েতের উন্নত অবস্থান ও পরিস্থিতির কারণে এখানে যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব অনুষ্ঠিত হবে, আগামী দিনে সেটিই সূচনা করবে প্রোলেতারীয় বিপ্লবের। জার্মানিতে ১৮৪৮-এর বিপ্লব প্রচেষ্টার মর্মান্তিক ব্যর্থতা জার্মান পুঁজিপতিদের অন্তঃসারশূন্যতা দেখিয়ে দেবার পর মার্কস বুর্জোয়া ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে দেওয়ালকে আরও নমনীয় করে দিলেন। ১৮৫০-এ কমিউনিস্ট লিগ-এ প্রদত্ত ভাষণে তিনি বললেন, ১৮৪৮-এর ব্যর্থতা জার্মান শ্রমিকদের কাঁধে যৌথ দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে— প্রথমত সামন্ততন্ত্রের অবসানে বুর্জোয়াদের সাহায্য করা এবং সেই বিপ্লব সম্পাদনের অব্যবহিত পরেই বুর্জোয়া পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সত্বর নেমে পড়বার জন্য একটি স্বাধীন রাজনৈতিক দলকে প্রস্তুত রাখা। যদিও তত্ত্বগতভাবে বিপ্লবের দু’টি স্তর পৃথক কিন্তু শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থে তাকে ছেদহীন প্রবহমান/নিরন্তর বিপ্লব (permanent revolution)-এ রূপান্তরিত করাটা বাঞ্ছনীয়।১৯ বস্তুত এই ধর্মসংকট মার্কসের সামনে অনেক আগেই দেখা দিয়েছে। ১৮৪৩-এ ‘Critique of Hegel’s Philosophy of Right’-এ হেগেলের সমালোচনা প্রসঙ্গে মার্কসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হল: সমাজ (বা রাজনৈতিক) পরিবর্তনের মুখ্য কাণ্ডারিকে সমাজের সব স্তরের মুখপাত্র হয়ে উঠতে হয়। একমাত্র তাহলেই তার দাবি সবার চাহিদায় রূপান্তরিত হয়।২০ তা না হলে সমাজ/রাষ্ট্র বিপ্লব সফল হয় না। এ ছাড়াও তিনি মন্তব্য করেছেন, সমাজের বর্তমান শাসক যখন সর্বস্তরের মানুষের চোখে শয়তানের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে তখনই সবাই তাকে সরানোর জন্য উদ্যোগী হয়।২১ এই দুই শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সমাজ/রাষ্ট্র বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে না। এই পর্যবেক্ষণ ছিল জার্মানির ভবিষ্যৎ বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে। এই প্রসঙ্গেই জার্মানির সাথে তুলনা টেনে মার্কস দেখিয়েছিলেন ফ্রান্সের বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল যেহেতু ফ্রান্সের অভিজাত এবং যাজক সম্প্রদায়ের মধ্যে শয়তানের মূর্ত প্রতীককে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছিল।২২ মার্কসের অভিমত ছিল জার্মানিতে এমন কোনও সর্বজনস্বীকৃত শয়তান বা কাণ্ডারি না থাকায় সেখানে আমূল পরিবর্তন হওয়া বাস্তবসম্মত নয়।২৩ বিপ্লবের জন্য অন্য রাস্তা গ্রহণ করতে হবে। মোদ্দা কথা হল, মার্কস বিপ্লবের অনিবার্যতার ধারণাকে প্রশ্রয় দেননি বা কোনও ইচ্ছাপূরণের অভিলাষ থেকে বিপ্লবের রাস্তায় পা বাড়াননি। আর তাঁর ইতিহাসচর্চা যেহেতু বিপ্লবসাধনার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত তাই ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রেও কোনও একটিই ধরাবাঁধা ছক মার্কস গ্রহণ করেননি। কথাগুলি কেবলমাত্র মার্কসের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, মার্কসের অনুপ্রেরণায় যাঁরা বিপ্লব সাধনা করেছেন তাঁরাও ইতিহাসের সৃজনশীল অনুশীলন করেছেন। একটি-দু’টি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে গোড়া থেকেই একটি প্রশ্ন তাড়া করে বেড়িয়েছে— রাশিয়ার মতো একটি পশ্চাদপদ দেশে কি আদৌ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব/কাম্য? রুশ সমাজতন্ত্রীদের/শ্রমিকশ্রেণির সামনে দু’টি রাস্তা খোলা ছিল— প্রথমত, ‘আইনসিদ্ধ মার্কসবাদী’ (Legal Marxist)-রা বলছিলেন বিপ্লবের প্রথম স্তরটি অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত শবরীর প্রতীক্ষা প্রয়োজন; আর দ্বিতীয়টি হল জার্মানির ক্ষেত্রে মার্কস যে দাওয়াই বাতলেছিলেন সেটি প্রয়োগ করা। রুশ সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে লেনিন সবার আগে এই দাওয়াই প্রয়োগ করেন ১৮৯৮-তে সাইবেরিয়াতে বসে লেখা ‘Tasks of Russian Social Democrats’ প্রবন্ধে। তাঁর অভিমত ছিল রুশ স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে অথবা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম— উভয় ক্ষেত্রেই সর্বহারার শ্রেণিসংগ্রামকেই হাতিয়ার করতে হবে। গণতন্ত্রের লড়াইয়ে বুর্জোয়াদের জোটসঙ্গী করতে হবে ঠিকই তবে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া, শিক্ষিত সমাজ বা অন্য কেউই সর্বহারার মতো ঐকান্তিক নয়, তাই গণতন্ত্রের জন্য লড়াই বা সামাজিক সাম্যের জন্য লড়াইতে সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে (The proletariat alone can be the vanguard fighter for political liberty and for democratic institutions)।২৪ অন্য একটি প্রসঙ্গে গ্রামশি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্রেও রকমফের দেখেছেন। Hegemony বা আধিপত্য সংক্রান্ত আলোচনায় তিনি দেখিয়েছেন, একটি ছক হল ধ্রুপদি ‘জ্যাকোবিন’ (জ্যাকোব্যাঁ) বিপ্লবের রাস্তা যেখানে কৃষকসমাজকে সংগঠিত করবার মধ্য দিয়ে সামন্ততন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে শেষ করে বুর্জোয়া ‘একাধিপত্য’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইতালির ক্ষেত্রে অবশ্য তেমনটা ঘটেনি। সেখানে উত্তরের শিল্পপতিরা দক্ষিণের জমির মালিকদের সাথে জোট বাঁধার ফলে মৌলিক কৃষি বিপ্লব সম্ভব না হওয়ায় এই ‘অসম্পূর্ণ’ বিপ্লবকে বর্ণনা করবার জন্য গ্রামশি ‘passive revolution’ বা ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লব’ বাক্যবন্ধটি ব্যবহার করেছেন। এই উদাহরণগুলি ইঙ্গিত দেয় যে, মার্কস বা তাঁর পরবর্তী পর্যায়ের মার্কসবাদীরা বিপ্লবের জন্য ধরাবাঁধা ছক ব্যবহার করেননি বা সব পরিস্থিতিতেই একই ব্যাখ্যা দেননি। বস্তুবাদী ইতিহাসচর্চার ধারা বিপ্লবসাধনার প্রয়োজনেই তাই সজীব ও গতিশীল থেকেছে, জড়বৎ স্থাণু হয়ে যায়নি।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

*‘অন্নদামঙ্গলের ঐতিহ্য লালিত বাঙালির dialectic বোঝা দুরূহ নও। দেবী যখন ঈশ্বরী পাটনীকে বলেন “কেবল আমরা সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ” তখন তিনি আপাতভাবে জানান স্বামীর সঙ্গে ঝগড়ার কথা, আসলে বলেন স্বামীর সাথে তাঁর অকল্পনীয় সখ্যের কথা। মার্কস বাস্তব জগৎকে প্রত্যক্ষ করেছেন এই মিলন আর সংঘাতের জতিলতার অন্তিম রূপ হিসাবে এবং অন্বেষণ করে গেছেন আপাত চেহারায় যা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় তার পেছনে লুকিয়ে থাকা আদতে চেহারাটি।… জীবনের প্রতিটি পর্ব আসলে এই সংঘাত ও নির্মাণের প্রকাশ।… এই ভাবনাকে মার্কস প্রসারিত করেছেন ইতিহাস চেতনার সন্নিবিষ্ট করে, তিনি দেখিয়েছেন সর্বকালে সকল চিন্তা, দর্শন সেযুগের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের প্রকাশ।’

১. Karl Marx, ‘Theses on Feuerbach’, in Karl Marx and Frederick Engels, Selected Works, Vol II (Foreign Languages Publishing House : Moscow, 1962). p. 405.

২. E. J. Hobsbawm, The Age of Revolution. Europe 1789-1848 (Weidenfeld and Nicholson : London, 1962), pp. 25-26.

৩. এই প্রবন্ধের ক্ষুদ্র পরিসরে তৎকালীন সময় ও মার্কসের জীবনের মিথস্ক্রিয়ায় কীভাবে তাঁর চিন্তাধারা বদলে যাচ্ছিল তার সবিস্তার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে ঘটনাপ্রবাহ কীভাবে তাঁকে ক্রমশ বিপ্লবসাধনার রাস্তায় ঠেলে দিল সেটা অনুধাবন করা জরুরি, কারণ তাঁর বিপ্লবী কার্যকলাপের ধারাবাহিক বিস্তারের সাথে তাঁর ইতিহাসতত্ত্ব উদ্ভাবন ও প্রয়োগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলেই আমাদের বিশ্বাস। মার্কস নিজে মনে করতেন যে, কোনও একটি তত্ত্ব/ধারণাকে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত বা সামাজিক অভ্যাস থেকে বিযুক্ত করে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। C. Castroridis, The Imaginary Institution of Society. Creativity and Autonomy in the Social-Historical World. (Polity Press : London, Second edition, 1997)। এবং ৮০-র দশকে বিজ্ঞানের ইতিহাস ও দর্শন বিষয়ে ব্রুনো লাতুর বেশ কয়েকটি বিতর্কিত বই লেখেন। সেখানে তিনি বলার চেষ্টা করেন বিজ্ঞানের তথ্যও (যেমন আণবিক জগৎ, অণুর মধ্যে বিভিন্ন কণার অস্তিত্ব) কেবল Objective truths/নৈর্ব্যক্তিক সত্য নয়। এর পেছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের Network। যখন অনেকে একই রকমের ধারণা বা চিন্তার ভিত্তিতে গবেষণা শুরু করেন তখন তাঁদের ‘আবিষ্কৃত’ তথ্য বা জ্ঞান ওই ‘সম্পর্ক’র কল্যাণে মান্যতা পায়। মার্কস যেভাবে বস্তুবাদী ঐতিহাসিক ধারণার মূল উপাদানগুলিকে ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন তার মধ্যেও এই ধরনের Network গড়ে তোলার সাফল্য দেখতে পাওয়া যায়। চিন্তা বিমূর্ত নয়, কেবল চিন্তকের স্বকীয়তার উপর নির্ভরশীলও নয়। সমকালে অন্যান্য চিন্তার স্রোতে কখনও অনুকূলে, কখনও উজান বাইতে গিয়ে ‘সত্য’কে উপলব্ধি করা সম্ভব, যেটা মার্কসের ইতিহাস চেতনার উন্মেষ ও ক্রমবিকাশের মধ্যে ধরা পড়ে।

৪. আকাশবাণী কলকাতায় ৬ নভেম্বর কালীপূজা উপলক্ষে বিশেষ নিবেদন; ‘সংবাদ পরিক্রমা’; লেখক ভাস্কর দাশ।

৫. ‘But not only has the bourgeoisie forged the weapons that bring death to itself; it has also called into existence the men who are to wield those weapons—the modern working class—the proletarians.’ Karl Marx, The Communist Manifesto, Ed. Frederic L. Bender (W.W. Norton : New York, 1988). p. 61.

৬. এই সময়ে নিজের চিন্তার বিবর্তনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মার্কস দেখিয়েছেন রাইনিশে ৎসাইটুং-এর কার্যকাল কীভাবে তাঁকে দর্শনচর্চা থেকে রাজনৈতিক অর্থনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল: ‘In the year 1842-43 as editor of Rheinische Zeitung, I first found myself in the embarrassing position of having to discuss what is known as material interests. The deliberations of the Rheinische landtag on forest thefts and the division of landed property… and finally the debates on free trade and protective tarrifs caused me in the first instance to turn my attention to economic problems.’ Karl Marx, ‘Preface to A Contribution to the Critique of Political Economy’ in Lucio Colletti (ed.), Karl Marx, Early Writings (Pelican Books : London), p. 424.

৭. ‘There is no other road to truth and freedom, except that leading through the stream of fire [the Feuer-bach]’, Loyd D Easton & Kurt H. Guddat (eds), Writings of the young Marx on Philosophy and Society (Anchor Books : New York, 1967). p. 96.

৮. ‘The Speculative philosophers, Feuerbach charged, see nature, religion and philosophy itself as mere predicates of Idea but “we need only to convert the predicate into the subject to get at pure undisguised truth”.’ Easton and Guddat, Writings of the Young Marx, p. 11.

৯. ‘The actual relation (রাষ্ট্র বা state এবং পুরসমাজ বা Civil Society) is: that the lending of the content of the state is mediated in the individual by circumstances, caprice and personal choice of his station in life.’ কিন্তু ‘Actuality is not experienced as it is itself but as an other actuality. Common experience is not subject to the law of its own spirit but to an alien spirit.’ কারণ— ‘This fact, this actual relationship is expressed in speculation as appearance or phenomenon.’ Easton and Guddat, Writings of the Young Marx, p. 155. ছোটবেলায় কালিদাস রায়ের কবিতার সান্নিধ্যে বড় হওয়া বাঙালির পক্ষে ফয়েরবাখের ধর্মসংক্রান্ত চিন্তার দ্যোতনা বুঝতে অসুবিধে হয় না কারণ আমরা শিখেছি ‘মানুষই দেবতা গড়ে/ তাহারই কৃপার পরে/ করে দেবমহিমা নির্ভর. . .’; ‘চাঁদ সদাগর’।

১০. ‘In monarchy we have the people of the constitution. In democracy the constitution of the people. Democracy is the solution of the problem of all constitutions. In democracy the constitution is always based on its actual foundation, on actual man and the actual people, not only implicitly and in its essence, but in its existence & actuality.’ Easton and Guddat, Writings of the Young Marx, p. 173. হেগেল প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘Hegel proceeds from the state and makes man into the state subjectified. Democracy proceeds from man & makes the state into man objectified. Just as religion does not create man, but man creates religion, so the constitution does not create the people, but the people create the constitution.’ Easton and Guddat, Writings of the Young Marx, p. 173-174. গণতন্ত্রের পক্ষে সুষ্পষ্ট রায় দিয়ে মার্কস লিখলেন, ‘Man does not exist for the law, but the law exists for the man. In democracy there is pure human existence, which in other forms of state man is the particular juridical existence. This is the basic uniqueness of democracy.’ Easton and Guddat, Writings of the Young Marx, p. 174.

১১. Easton and Guddat, Writings of the Young Marx, p. 236.

১২. Easton and Guddat, Writings of the Young Marx, p. 237.

১৩. Easton and Guddat, Writings of the Young Marx, p. 251.

১৪. Easton and Guddat, Writings of the Young Marx, pp. 94-95.

১৫. ‘Feuerbach admittedly has a great advantage over the “pure” materialist beacuse he realizes that man too is “sensuous object”, but he sees man only as “sensuous object” not as “sensuous activity”, because he remains in the realm of theory and does not view men in their given social connection, not under their existing conditions of life which have made them what they are, he never arrives at the really existing notier men, but stops at the abstraction “Man”.’ Easton and Guddat, Writings of the Young Marx, p. 418.

১৬. ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে নিজেদের তফাত বোঝাতে গিয়ে German Ideology-তে তাঁরা বলেন— ‘The premises from which we begin are not arbitrary ones, they are not dogmas but actual premises from which abstraction can only be made in the imagination. They are the real individuals, their actions, and their material conditions of life, those which they find existing as well as those which they produce through their actions. These premises can be substantiated in a purely empirical way.’ Easton and Guddat, Writings of the Young Marx, p. 409.

১৭. ‘The first premise of all human history, of course, is the existence of living human individuals. (The first historical act of these individuals, the act by which they distinguish themselves from animals is not the fact that they think but the fact that they begin to produce their means of subsistence.) The first fact to be established, then, is the physical organization of these individuals and their consequent relationship to the rest of nature…. (These relationships affect not only the original and natural organization of men, especially as to race, but also his entire further development or non-development up to the present.) All historiography must proceed from these natural bases and their modification in the course of history through the actions of men.’ Easton and Guddat, Writings of the Young Marx, p. 409.

১৮. ‘…a class in civil society which is not a class of civil society, a class which has radical chains, which is the dissolution of all classes… [whose] sufferings are universal and which does not claim a particular redress because… wrong in general [has been perpetrated on it]… which is in short what that total loss of humanity and which can only redeem itself by a total of redemption humanity. This dissolution of society as a particular class, in proletariat.’ Karl Marx, ‘Wages of labour’ in Tom Bottomore (ed), Early Writings of Karl Marx (Watts : London, 1963), p. 69.

১৯. ‘While the democratic petty bourgeoisie wants to end the revolution as rapidly as possible… our interest and task consist in making the revolution permanent until all the more or less possessing classes are removed from authority, until the union of proletarians not only in one country…’ মার্কস এই দীর্ঘ আবেদন শেষ করছেন এই বলে, ‘Their fighting slogan must be “permanent revolution”.’ E H Carr, The Bolshevik Revolution 1917-1923, vol I (The Macmillan Company : New York, 1950), p. 25.

২০. ‘No class of civil society can play this role without awakening a moment of enthusiasm in itself and in the masses; a moment in which this class fraternizes and fuses with society in general, becomes identified with it and is experienced and acknowledged as its universal representative.’ Marx, ‘Preface’ in ‘A Contribution to the Critique of Hegel’s Philosophy of Right. Introduction’, in Colletti (ed.), Early Writings, p. 254.

২১. ‘If the revolution of a people and the emancipation of a particular class [Klasse] of civil society are to coincide… then all the deficiencies of society must be concentrated in another class… one particular sphere of society must appear as the notorious crime of the whole of society so that the liberation of this sphere appears as universal self liberation.’ Karl Marx, ‘A Contribution to the Critique of Hegel’s Philosophy of Right. Introduction’, in Colletti (ed), Early Writings p. 254.

২২. ‘The negative general significance of the French nobility and the French clergy determined the positive general significance of the class which stood nearest to and opposed to them—the bourgeoisie.’ Marx, ‘A Contribution to the Critique of Hegel’s Philosophy of Right. Introduction’, in Colletti (ed.), Early Writings, p. 254.

২৩. ‘But in Germany every particular class lacks not only the consistency, acuteness, courage and ruthlessness which would stamp it as the negative representative of society; equally, all classes lack that breadth of spirit which identifies itself, if only for a moment, with the spirit of the people, that genius which can raise material force to the level of political power, that revolutionary boldness which flings into the face of its adversary the defiant words: I am nothing and I should be everything. The main feature of German morality and honour, not only in individuals but in classes, is that modest egoism which asserts its narrowness and allows that narrowness to be used against it.’ Marx, ‘A Contribution to the Critique of Hegel’s Philosophy of Right. Introduction’, in Colletti (ed.), Early Writings, pp. 254-55.

২৪. ‘We said above that all socialists in Russia should become Social-Democrats. Now we add: all true and consistent democrats in Russia should become Social-Democrats.’ V. I. Lenin, Collected Works, Vol 2 (Foreign Languages Publishing House: Moscow, 1960), p. 336.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *