মারে মোসাদ রাখে কে

মারে মোসাদ রাখে কে

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮। সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাস। ভরা দুপুরবেলা। একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে কয়েক জন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে ঘোরাঘুরি করছে। ওরা আসলে মোসাদ এজেন্ট। অল্পক্ষণের মধ্যেই অ্যাপার্টমেন্টের পার্কিং লটে এসে দাঁড়াল একটা রুপোলি রঙের পাজেরো গাড়ি। গাড়ির মধ্যে বসে আছে এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। মুখে চাপ কিন্তু নিখুঁত ভাবে ছাঁটা দাড়ি। উচ্চতা গড়পড়তা। পরনে কালো রঙের দামি একটা স্যুট।

লোকটা গাড়ি থেকে নামা মাত্রই অতিমাত্রায় সক্রিয়তা দেখা দিল মোসাদের এজেন্টদের মধ্যে। সিরিয়ার দামাস্কাস থেকে ইসরায়েলের তেল আভিভ অবধি ট্রান্সমিট হয়ে গেল একটা বাক্য, ‘আওয়ার ম্যান হ্যাজ অ্যারাইভড অ্যান্ড হি ইজ অ্যালোন।’

কার কথা বলছিল মোসাদের এজেন্টরা? কী-ই বা করছিল সে দামাস্কাসে?

ওই ব্যক্তির নাম ছিল ইমাদ ফয়েজ মুঘানিয়া। হিজবুল্লাহ নামক জঙ্গি সংগঠনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিল ইমাদ। নিজে প্রতিষ্ঠা করেছিল লেবানন’জ ইসলামিক জেহাদ অর্গানাইজেশন।

১৫ নভেম্বর, ২০০১ সাল। আমেরিকার এফবিআই-এর পক্ষ থেকে জারি করা হল বিশ্বের মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসবাদীদের নামের একটি তালিকা। ২২ জন কুখ্যাত আতঙ্কবাদী, ২২টা নাম। এই তালিকায় প্রথম নামটা ছিল ইমাদ মুঘানিয়ার। ৯/১১-এর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার হামলা হওয়ার আগে অবধি এই ইমাদই ছিল সবথেকে বেশি সংখ্যক আমেরিকান নাগরিকের মৃত্যুর কারণ। ইমাদের মাথার দাম হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ভাবার মতো বিষয়ই বটে। কিন্তু কেন এ হেন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল ইমাদের নামের ওপরে? কী এমন কাজ করেছিল সে?

উলটো দিক থেকে উত্তরটা খুঁজলে হয়তো সহজ হবে। কী এমন কাজ করেনি ইমাদ? তালিকাটা দীর্ঘ—

১৯৮৩

-বেইরুটের মার্কিন দূতাবাসে বোমা বিস্ফোরণ। তেষট্টি জনের মৃত্যু ঘটে। আহত হয়েছিল বহু মানুষ।

-বেইরুটের মার্কিন মেরিন ব্যারাকে বোমা বিস্ফোরণ। নিহতের সংখ্যা ছিল ৩০০ জন।

-লেবাননের ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)-এর হেডকোয়ার্টার্সে বোমা বিস্ফোরণ। নিহত হয়েছিল ৬০ জন।

১৯৮৪

-আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বেইরুটের প্রেসিডেন্ট ম্যালকম এইচ কেরকে হত্যার অপরাধ।

-লেবাননে নিযুক্ত সিআইএ-এর স্টেশন চিফ বিল বাকলেকে অপহরণ এবং হত্যার অপরাধ।

১৯৮৫

ইসরায়েল এবং লেবাননের সীমান্তে আইডিএফ-এর কনভয়ে হামলা, যার ফলে ৮ জনের মৃত্যু হয়।

— টিডব্লিউএ ৮৪৭ ফ্লাইট হাইজ্যাকিং।

১৯৮৮

— কর্নেল উইলিয়াম হিগিন্সকে অপহরণ এবং হত্যার ষড়যন্ত্র।

১৯৯২

আর্জেন্টিনায় অবস্থিত ইসরায়েলি দূতাবাসে বোমা বিস্ফোরণ। ২৯ জনের মৃত্যু ঘটে।

১৯৯৫

বুয়েনাস এয়ার্সে জিউইশ কমিউনিটি সেন্টারে বোমা বিস্ফোরণ। নিহতের সংখ্যা ছিল ৮৬ জন।

১৯৯৬

সৌদি আরবের খোবারের খোবার টাওয়ার্স-এ বোমা বিস্ফোরণের মাস্টারমাইন্ড।

আমেরিকা, ইসরায়েল সহ বিশ্বের নানা দেশের অগণিত সামরিক এবং অসামরিক ব্যক্তির রক্তে নিজের হাত রাঙিয়ে ফেলেছিল ইমাদ। একজন কট্টর সন্ত্রাসবাদী রূপে ক্রমশ নিজের ছায়াকে বড় করতে থাকা মুঘানিয়াকে দমন করা কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠছিল আমেরিকা কিংবা ইসরায়েলের মতো দেশের ইন্টেলিজেন্স সংস্থাগুলির কাছে।

কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিল ইমাদ। ‘তাকে ধরা যায় না, তাকে মারা যায় না,’ এ কথাই চালু হয়ে গিয়েছিল সিআইএ আর মোসাদের করিডরে। যেন এক ভূত— ‘আ গোস্ট!’

ইমাদকে ধরতে না পারার একটা বড় কারণ ছিল সে মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে অবাধে বিচরণ করত এবং কোথাও একটানা বেশি দিন থাকত না। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কাছে ইমাদের কুকীর্তির একটা দীর্ঘ তালিকা থাকলেও আসল জিনিসটাই ছিল না— তার হুলিয়া। ইমাদ মুঘানিয়াকে কেমন দেখতে কিংবা তার স্বভাব সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। কিছুতেই খুঁজে বের করা সম্ভব হচ্ছিল না তার লুকিয়ে থাকার জায়গাগুলোকে। কিচ্ছু জানতে পারছিল না এজেন্সিগুলি।

১৯৮২ সাল। ইসরায়েল আর লেবাননের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধল। হিজবুল্লাহর জন্ম হল। হিজবুল্লাহকে অস্ত্রশস্ত্র জোগান দেওয়ার পুরো কাজটা করেছিল ইরান’স রেভোলিউশনারি গার্ডস। প্রশিক্ষকের কাজটাও তারাই সেরেছিল। হিজবুল্লাহ নামক এই সংগঠনটিকে তৈরি করার একটাই উদ্দেশ্য ছিল—- ইসরায়েলকে ধ্বংস করে দেওয়া এবং নিজের জন্মের প্রথম মুহূর্ত থেকেই আঘাত হানা আরম্ভ করে দিয়েছিল। বাস্তবে ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দের মধ্যে ইরানের হয়ে ছদ্ম যুদ্ধ চালাতে আরম্ভ করল এই সংগঠন। ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছিল আয়েতোল্লা খোমেইনির আদর্শে চলা হিজবুল্লাহ।

ওদিকে লেবাননে জমি হারাচ্ছিল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও। একটা সময়ে প্রায় ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেওয়া হয় পিএলও-কে। নিজেদের প্রাণ রক্ষা করার জন্য পিএলও-এর নেতা স্থানীয়রা টিউনিশিয়াতে পালিয়ে যাচ্ছিল। ইমাদ নিজে পিএলও-এর সঙ্গে যুক্ত ছিল, ইয়াসের আরফাতের দলে একজন নির্ভরযোগ্য স্নাইপার হিসাবে কাজ করত। লেবাননে পিএলও মুছে গেলেও কিন্তু সে লেবানন ছেড়ে পালানোর পথে হাঁটেনি। আর এখান থেকেই ইমাদ মুঘানিয়ার রাজনৈতিক কেরিয়ারে একটা বিরাট পালাবদল আসে। লেবাননে পিএলও-এর বিভিন্ন গোপন আস্তানার খবর তার কাছে ছিল। সেখানকার বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের ভাণ্ডারের খবর ইমাদ দিয়েছিল হিজবুল্লাহকে। এরপর ওকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের ত্রাসে পরিণত হয়েছিল ইমাদ মুঘানিয়া।

বহু জায়গায়, বিভিন্ন হামলায় এবং ষড়যন্ত্রে ইমাদের নাম জড়িয়েছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তার নামে ফাইল বানিয়েছে একাধিক ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ইমাদ মুঘানিয়া নামটির পাশে বিবরণের জায়গাটা হয় ফাঁকা রাখা হয়েছে নয়তো একটি ফাইলে লেখা ইমাদের বিবরণের সঙ্গে অন্য ফাইলে লিখিত বিবরণ মেলেনি। একটি রিপোর্টে লেখা হল যে, ইমাদ হিজবুল্লাহর লিডার শেখ মুহম্মদ হুসেন ফদলল্লাহর অঙ্গরক্ষী ছিল। আবার অন্য একটি ফাইলে বলা হয়েছিল, ইমাদ মুঘানিয়া হিজবুল্লাহর অপারেশনস চিফ। হিজবুল্লাহ পার্টির অনেক নেতা টিভিতে সাক্ষাৎকার দিত, অনেক নেতার ভাষণও দেখা যেত। সেই সব কথায় মূলত ইসরায়েলকে ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকিভরা বার্তাই থাকত। কিন্তু ইমাদকে কখনো এ ধরনের কোনো সাক্ষাৎকার বা ভাষণ দিতে দেখা যায়নি। অন্তরালে থাকা ইমাদ নিজের পরিচয় জানান দিত নিজের নাশকতামূলক কাজের দ্বারা। একের পর এক বীভৎস আক্রমণের ফলে মাত্র এক দশকের মধ্যেই ইমাদকে এফবিআই, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কিংবা মোসাদ মারাত্মক একজন সন্ত্রাসবাদী রূপে গণ্য করতে শুরু করে দিয়েছিল।

পাশ্চাত্যের কোনো ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কাছেই ইমাদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য ছিল না। যেটুকু জানা গিয়েছিল তা হল, নিজের এক তুতো বোনের সঙ্গে ইমাদের বিয়ে হয়েছিল। তার স্ত্রীর নাম ছিল শাদা বদর আল-দীন। শাদা এবং ইমাদের তিন সন্তান; ফাতিমা, মুস্তফা এবং জিহাদ। ইমাদের বাবার নাম ছিল ফয়েজ। প্রাথমিক ভাবে কিছু রিপোর্টে ইমাদকে লেবাননের এক বিখ্যাত লেখক তথা রাজনৈতিক বোদ্ধা জাভেদ মুঘানিয়ার ছেলে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। পরে এটা ভুল তথ্য বলে প্রমাণিত হয়। এমনই ছিল ইমাদ, এমনই ছিল তাকে ঘিরে থাকা কিংবদন্তী। আর তাই ইমাদকে বলা হত, ‘হিজবুল্লাহ’জ ফ্যান্টম! ‘

এই চলমান অশরীরীকে ঘিরে বাড়তে থাকা অস্বস্তির ফলে এফবিআই, সিআইএ-এর মতো এজেন্সিগুলি মোসাদের দ্বারস্থ হল। তারা জানত যে, পারলে একমাত্র মোসাদই করে দেখাতে পারে। বাইরের এজেন্সিগুলির সঙ্গে হওয়া কথামতো ইমাদের একটা প্রোফাইল বানাতে আরম্ভ করে দিল মোসাদ।

কী লেখা হল সেখানে?

— ইমাদ একা একা থাকতে পছন্দ করে।

-ইমাদ একজন অনন্য সাধারণ প্রতিভাবান মিলিটারি ট্যাকটিসিয়ান।

-মনের দিকে থেকে বেশ সংবেদনশীল মানুষ ইমাদ।

— ইমাদ সহজে কাউকে বিশ্বাস করে না।

-অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেট সম্পর্কে ইমাদের ব্যুৎপত্তি অসাধারণ।

আটের দশক থেকেই সিআইএ, ফ্রেঞ্চ সিক্রেট সার্ভিস এবং মোসাদ ইমাদকে ধরার বা গুপ্তহত্যা করার বহুবার চেষ্টা করেছিল। যেমন ১৯৮৩ সালে মার্কিন দূতাবাসে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর পর থেকেই হিজবুল্লাহ সিআইএ-এর রাডারে চলে আসে। ১৯৮৫ সালে সিআইএ ডিরেক্টর উইলিয়াম কেসি সৌদি আরবের সহায়তায় হিজবুল্লাহ নেতা মুহম্মদ হুসেন ফদলল্লাহর ওপরে একটি গাড়িবোমা বিস্ফোরণ ঘটান। নিশানায় ছিল ইমাদ মুঘানিয়াও। কিন্তু এদের কিছু হয় না। ৮০ জন সাধারণ নাগরিক নিহত হয়। নিহতের তালিকায় অবশ্য ইমাদের এক ভাইও ছিল। এরপরেও একাধিক বার ইমাদকে মারার পরিকল্পনা করা হয় এবং প্রতি বারেই বেঁচে যায় সে। ২০০২ সালে জেএসওসি (জয়েন্ট স্পেশাল অপারেশনস কম্যান্ডো)-এর উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের সঙ্গে ইসরায়েলি মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের চিফের মিটিং হয়। বিষয় ছিল ইমাদ মুঘানিয়ার গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা।

ইমাদ ছিল শিকারি বিড়াল। বিড়ালকে নিয়ে ইংরাজিতে একটা প্রবাদ খুব চলে— ‘দ্য ক্যাট হ্যাজ নাইন লাইভস— থ্রি ফর প্লেয়িং, থ্রি ফর স্ট্রেয়িং, থ্রি ফর স্টেয়িং।’ বারংবার অকৃতকার্য হওয়ার পর মোসাদ-কর্তারা ইমাদ মুঘানিয়াকে নাম দিয়েছিল, ‘আ টেররিস্ট উইদ নাইন লাইভস।’ অর্থাৎ, এমন একজন সন্ত্রাসবাদী যার কাছে ৯টা জীবন আছে।

কিন্তু এত গোপনীয়তা, একই লোকের রিপোর্টে এত রকমের ফেরবদল কীভাবে সম্ভব হচ্ছিল তা খুঁজে বের করতে কোনো কসুর বাকি রাখেনি মোসাদ। লেবাননের সঙ্গে দ্বিতীয় বার যুদ্ধের পর এমন কিছু প্যালেস্টাইনকে মোসাদ নিজেদের এজেন্ট হিসাবে নিযুক্ত করে রেখেছিল, যারা হিজবুল্লাহ সংগঠনকে ঘৃণা করত। তাদের লেবাননেই রিক্রুট করে রাখা হয়েছিল। এমনই একজন এজেন্টের এক দূরসম্পর্কের বোন থাকত ‘তায়র ডিব্বা’ গ্রামে। এই তায়র ডিব্বা গ্রামেরই ছেলে ছিল ইমাদ। আর ইমাদকে নিয়ে সেখানে অনেক কথা চলবে এটাই ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। মেয়েটি জানত না যে, তার তুতো সম্পর্কের ওই ভাই একজন মোসাদ এজেন্ট। একদিন এ কথা-সে কথা বলতে বলতেই মুখ ফসকে সে বলে ফেলে, ‘কিছু দিন আগেই ইমাদ ইউরোপ গিয়েছিল। আর ইউরোপ থেকে ফেরার পর তো ওর মুখটাই পুরো পালটে গেছে। চেনাই যাচ্ছে না!’ ওই মোসাদ এজেন্ট অস্ফুট স্বরে তখন একটাই কথা স্বগতোক্তি করে বলেছিল, ‘প্লাস্টিক সার্জারি!’

এই দুটো শব্দকে সম্বল করেই আবার নতুন দিশা দেখতে আরম্ভ করে দিল মোসাদ। সামনে এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। ইউরোপের সমস্ত প্লাস্টিক সার্জারির ক্লিনিক চেলে ফেলার কাজটা সহজ নয় এ কথা আর কে না জানে? সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে থাকা অগুনতি মোসাদ এজেন্টদের কাছে একটাই মেসেজ পাঠিয়ে দেওয়া হল— ‘নিজের এলাকার মধ্যে যেখানে যত প্লাস্টিক সার্জারি ক্লিনিক আছে তার বিস্তৃত বিবরণ জমা দাও!’ কাজ হতে লাগল যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। অবশেষে খবরও মিলল। সংবাদ এল জার্মানির বার্লিন শহরের এজেন্ট জানাল ইমাদ একবার নয় ৮ বার প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছিল। আর সব ক’টাই করিয়েছিল (তৎকালীন) পূর্ব জার্মানির একটি ক্লিনিক থেকে। এই ক্লিনিক আগে ইস্ট জার্মানির স্টাসি (পূর্ব জার্মানির সিক্রেট পুলিশ ‘স্টেট সিকিউরিটি সার্ভিস’) চালাত। নিজেদের এজেন্টদের মুখের আদল প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে বদলে ফেলে বিভিন্ন অপারেশনে পাঠানোর জন্যই স্টাসি এই ক্লিনিকটিকে ব্যবহার করত।

মোসাদের তরফ থেকে ওই ক্লিনিকে যোগাযোগ করা হল। কিন্তু পেশাগত গোপনীয়তার কথা বলে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ কথা বলতে রাজি হল না। সবই তো ঠিক ছিল, কিন্তু ক্লিনিক অথোরিটি এই কথা ভুলে গিয়েছিল যে, মোসাদ হল ইসরায়েলের এজেন্সি। আর ইসরায়েল যখন কাউকে লক্ষ্য হিসাবে বেছে নেয় তখন স্বয়ং যমরাজও তাকে রক্ষা করতে পারে না। সবারই একটা বিক্রয়মূল্য থাকে, ক্লিনিকের কর্তৃপক্ষেরও ছিল। সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে ইমাদের ফাইল কিনে নিল মোসাদ। সেই ফাইলে পাওয়া গেল ইমাদের ৩৪টা সাম্প্রতিক ছবি। ফটোগুলোকে অ্যানালিসিস করে ফেলল মোসাদের টিম। তৈরি হয়ে গেল রিপোর্ট।

কী বলা হল রিপোর্টে?

-ইমাদ মুঘানিয়ার চোয়াল আর থুতনিতে অপারেশন করা হয়েছে।

-সামনের দিকের বেশ কয়েকটা দাঁত তুলে তাদের জায়গায় কৃত্রিম দাঁত বসানো হয়েছে।

-চোখের আকৃতিতে বদল এনেছে সার্জেন্ট।

-আগে চুলের রঙ ছিল কালো, শেষ অপারেশনের পর সব চুল ধূসর করে দেওয়া হয়েছে।

-ইমাদ চশমা ব্যবহার করত। লেসিক সার্জারি হয়েছে। এখন চশমার বদলে ব্যবহার করে কন্টাক্ট লেন্স।

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে, আটের দশক থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা এজেন্সি ইমাদের যেসব ছবি নিজেদের সংগ্রহে রেখেছিল, তাদের সঙ্গে ইমাদের এখনকার চেহারা আর মিলবে না। ইমাদের খোলনলচে বদলে ফেলা হয়েছিল।

এবার আসরে নামে সিআইএ। মোসাদের গোয়েন্দাদের সঙ্গে কথাবার্তার পর তারা বিশেষ আইইডি বিস্ফোরক ব্যবহার করার প্রস্তুতি নিতে থাকে। পরবর্তীকালে খবরে প্রকাশ পেয়েছিল যে, ইমাদকে মারার জন্য সিআইএ ২৫টি বোমা তৈরি করে ট্রায়াল দিয়েছিল। এমন ভাবেই সেই বোমা তৈরি করা হয়েছিল যাতে বিস্ফোরণের মাত্রা ভয়ানক হলেও বিস্ফোরণ-স্থলের ২০ ফুট দূরে থাকা কোনো ব্যক্তির ক্ষতি যেন না হয়।

মোসাদের চিফ সেই সময়ে মির ডাগান। উনি ইসরায়েলের কিডন নামক সংস্থাকে এই অপারেশনে আনার সুপারিশ করেন।

কিডন কী?

ইসরায়েলের এই সংস্থার প্রধান কাজই হল ইসরায়েল রাষ্ট্রের শত্রুদের গুপ্ত ভাবে হত্যা করা। কিডনের সম্পর্কে বিশেষ কিছুই বাইরে আসে না। বলা হয় যে, আইডিএফ-এর প্রাক্তনীদের নিয়েই কাজ করে কিডন। অপারেশন ‘রাথ অব গড’-এর সময়ে কিডনের ভূমিকাই ছিল অগ্রগণ্য।

কিডন, মোসাদ আর সিআইএ, এই তিনটি ফলা ইমাদকে নির্মূল করার জন্য লেগে পড়ল। নিজেদের ফিল্ড ওয়ার্ক থেকে মোসাদ প্রাথমিক ভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, পশ্চিমের কোনো দেশে ইমাদকে নিকেশ করা মোটেই সহজ কাজ নয়। কারণ ইউরোপের কোনো দেশেই ইমাদ খুব দরকার না পড়লে ভ্রমণ করে না। তার বেশিরভাগ সময়টাই কাটে সিরিয়া এবং ইরানে। অর্থাৎ অপারেশন সারতে হবে মিডল ইস্টেরই কোনো দেশে। মোসাদ লেবানন, তিউনিসিয়ার মতো মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে এর আগেও কাজ করেছিল। কিন্তু এই দেশগুলোর তুলনায় ইরান বা সিরিয়ার মতো দেশগুলো ছিল অনেক বেশি বিপজ্জনক এদের গুপ্তচর সংস্থাগুলি ছিল যথেষ্ট উন্নত এবং এদের সামরিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে গেলেও দু’ বার ভাবতে হত প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রকে। তাই মির ডাগান বুঝেছিলেন, একটা ফেইলড মিশন মানে ইমাদ হাতছাড়া তো হবেই, তাছাড়াও যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকবে। আবার অন্য দিকে সফল হতে পারলে ইসরায়েল নিজের শত্রুদের তথা সন্ত্রাসবাদীদের বুক কাঁপিয়ে দেবে।

এরপরে টানা রেইকি চলল ইমাদ মুঘানিয়ার ট্রাভেল প্যাটার্ন নিয়ে। সেখান থেকেই বেরিয়ে এল নতুন সূত্র। মোসাদ অনুমান করল যে, ১২ ফেব্রুয়ারি ইমাদ দামাস্কাসে যাবে। সেখানে ইরানিয়ান রেভোলিউশন-এর বর্ষপূর্তির উৎসব পালন হওয়ার কথা ছিল। কেবল ইমাদ নয়, ইরান এবং সিরিয়ার উচ্চপদস্থ সামরিক আধিকারিকদেরও উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু পাকা খবর ছিল না, এটা ছিল অনুমান মাত্র। মোসাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল এই অনুমানের সত্য হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ।

আরও গভীর তদন্ত চালানো হল। সিআইএ সহ বেশ কয়েকটি বিদেশি ইন্টেলিজেন্স সংস্থার সাহায্য নিয়ে নিজেদের সামনে কিছু প্রশ্ন সাজাল মোসাদ।

-মোসাদ কি সত্যিই ১২ ফেব্রুয়ারি দামাস্কাসে যাবে?

-যদি যায়, তবে কোন পরিচয়পত্র ব্যবহার করতে পারে?

-কী গাড়ি ব্যবহার করবে ইমাদ?

-কোথায় গিয়ে উঠবে ইমাদ?

-কে বা কারা ইমাদের সঙ্গী হবে?

-ইরান এবং সিরিয়ান অধিকর্তাদের সঙ্গে ইমাদ কখন দেখা করতে যাবে?

-সিরিয়ান গভর্নমেন্ট এবং হিজবুল্লাহ কি ইমাদের এই ট্রিপ সম্পর্কে অবহিত?

নিজেদের অপারেশনের সাফল্যের জন্য এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তরের প্রয়োজন ছিল মোসাদের। ভিন্ন ভিন্ন ইরানি এবং লেবানিজ তথ্যসূত্র থেকে মোসাদ এই খবর পাকা করে ফেলে যে, ১২ ফেব্রুয়ারি ইমাদ দামাস্কাসে যাচ্ছে। ব্যস! কিডনের এজেন্টরা বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ হয়ে সিরিয়ায় গিয়ে পৌঁছায়। মোসাদের একটি স্পেশাল টিম স্মাগলিং-এর মাধ্যমে দরকারি বিস্ফোরক পৌঁছে দেয় দামাস্কাসে। ঠিক ছিল ইরানিয়ান রেভোলিউশনের বর্ষপূর্তি করার জায়গার কাছেই কোথাও শেষ করে দেওয়া হবে ইমাদ মুঘানিয়াকে।

শেষ মুহূর্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর পায় মোসাদ। মোসাদের এক গুপ্তচর জানতে পারে যে, ইমাদ যখনই দামাস্কাসে যায়, তখনই সে একজন সুন্দরী মহিলার সঙ্গে দেখা করে। সেই মহিলা আসলে ইমাদের রক্ষিতা।

আরও তথ্য মিলল। মোসাদ, কিডন, সিআইএ-এর এজেন্টরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে গেল ইমাদের গোপন প্রেমের কথা জানতে পেরে। না, কোনো কেচ্ছা ছড়ানোর জন্য নয়, ইমাদকে এই দুনিয়ার ইতিহাস-কাহিনিতে স্থান করেদেওয়ার এত বড় সুযোগ যে এভাবে মিলবে তা যে তারা ভাবেনি।

ইমাদের রক্ষিতা; বয়স ত্রিশ বছর। নাম নিহাদ হায়দার। অসাধারণ রূপবতী। সিরিয়ার নাগরিক। নিজের রক্ষিতার সঙ্গে ইমাদ নির্দিষ্ট একটি বিল্ডিংয়েই দেখা করত এবং সেই বিল্ডিংয়ের মালিক ছিল সিরিয়ান প্রেসিডেন্টের এক খুড়তুতো ভাই, রামি মাক্লফ। মোসাদ জেনে গিয়েছিল যে, ইমাদ নিজের রক্ষিতার সঙ্গে দেখা করতে একলাই যায়। নিজের জীবনের হাজার ঝুঁকির কথা খুব ভালো ভাবে জানলেও ওই সময়ে ইমাদ সঙ্গে কোনো বডিগার্ড রাখে না।

১১ ফেব্রুয়ারি কিডনের হিট টিমের ৩ জন মেম্বার আলাদা আলাদা পথে গিয়ে পৌঁছাল দামাস্কাসে। ইউরোপের বিস্তীর্ণ দূরত্ব অতিক্রম করে এরা সিরিয়ায় পৌঁছেছিল, যাতে কেউ এদের কোনো ভাবেই সন্দেহ না করতে পারে। এদের একত্রিত হওয়ার পরে এরা মোসাদের এজেন্টদের সঙ্গে দেখা করে। মোসাদের এজেন্টরা আবার বেইরুটের পথে সিরিয়ায় প্রবেশ করেছিল। মোসাদের এজেন্টরা কিডন-এজেন্টদের নিয়ে গিয়ে একটি গ্যারাজে তোলে। সেখানেই রাতের থাকার আয়োজন করা হয়েছিল। এই গ্যারাজের মধ্যে কিলিং টিমের জন্য একটি গাড়ি এবং দরকারি বিস্ফোরকের ব্যবস্থা করাই ছিল। কিডনের হিট টিমের ওই তিন সৈন্য সারা রাত জেগে বোমাটাকে ঠিক জায়গায় লাগায়। ‘ঠিক জায়গা’ বলতে ভাড়ার যে এসইউভি গাড়িটা কিডন টিম ব্যবহার করছিল, তারই স্পেয়ার টায়ারে বোমাটাকে লুকোনো হয়েছিল। অপর দিকে মোসাদের আরেকটি টিম ইমাদের রক্ষিতার অ্যাপার্টমেন্টের চারপাশে মোতায়েন হয়ে তীক্ষ্ণ নজর বজায় রেখেছিল।

১২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে যেই না ইমাদের গাড়ি গিয়ে ওই বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে থামল, তখনই সতর্ক হয়ে উঠল মোসাদ, কিডন এবং সিআইএ-এর টিম। সতর্কবার্তা গেল তেল আভিভে— ‘আওয়ার ম্যান হ্যাজ অ্যারাইভড অ্যান্ড হি ইজ অ্যালোন।’ ইমাদ যতক্ষণ নিজের প্রেমিকার সঙ্গে ছিল ততক্ষণ চুপচাপ অপেক্ষা করল গুপ্ত হন্তারকরা। বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে ইমাদ বাইরে বেরিয়ে আসে। নিজের গাড়িতে চেপে সে রওনা দেয় নিজের পরবর্তী গন্তব্যস্থলের দিকে। মোসাদ, কিডন এবং সিআইএ-এর টিম মেম্বাররা তাকে অনুসরণ করতে থাকে।

মোসাদ টিমের কাছে পাকা খবর ছিল যে, ইমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল ক সোসা। সেখানেই তার সঙ্গে ইরানের আধিকারিকদের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। নিজেদের অনুমান সত্যি হতে দেখে কিডন টিম গাড়িবোমাটিকে মাহমুদ আল ফাক্কানি রোডের পাশের একটি পার্কিং লটে নিয়ে গিয়ে রাখে।

রাত পৌনে দশটা নাগাদ ইমাদ ওই পার্কিং লটে পৌঁছায়। মিটিংয়ে যাওয়ার আগে সে নিজের গাড়ি পার্ক করে কিডনের রাখা গাড়ির দুটো গাড়ি পরেই। গাড়ি পার্ক করে যেই না ইমাদ দরজা খুলে বেরোতে যায়, তখনই মোসাদ, সিআইএ এবং কিডন এজেন্টরা রিমোট কন্ট্রোলড ব্লাস্ট ঘটায়। ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে কফ্র সোসা এলাকা। হিজবুল্লাহ পার্টির ‘নম্বর টু’ ইমাদ মুঘানিয়া, ‘দ্য গোস্ট’ ইমাদ মুঘানিয়ার কাহিনির ‘দি এন্ড’ হয় এভাবেই।

ইমাদের মৃত্যুতে প্রচণ্ড ভয়ানক ধাক্কা খেয়েছিল হিজবুল্লাহর নাশকতামূলক কাজকর্ম। সিরিয়ার নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর তৈরি করে তোলার ক্ষেত্রেও ইমাদ মুঘানিয়া সিরিয়ার সরকারকে সমানে সাহায্য করে চলেছিল। তাই পিছিয়ে গেল সেই প্রকল্পও। বিড়ালের ৯টা প্রাণ থাকলেও সবথেকে বলশালী শিকারির সামনে পড়লে সে প্রাণ খোয়ায়। ইমাদকেও প্রাণ দিতে হয়েছিল। কারণ যখন মারে মোসাদ, তখন রাখে কে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *