মরিচমারির জঙ্গলে
মারীচমারির জঙ্গলের মাথায় তখন রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠেছে। যতদূর চোখ যায়, এই উঁচু টিলাটার নীচের পৃথিবী ঝিমঝিমে অন্ধকারে ডুবে আছে। শুধু আকাশের দিকে তাকালে দেখতে পাচ্ছি আলোর বন্যা। জঙ্গলের গাছগুলোর ওপরের দিকটা আলোকিত হয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু গাছের ঘনত্বের জন্যই হয়তো সেই আলো মাটিতে এসে পৌঁছয়নি। আমাদের রিসর্টটার সামনের লনটা দিয়ে হেঁটে খানিকটা গেলেই খাড়া খাদ নেমে গেছে টিলার গা বেয়ে। যদিও পাহাড়ের মতো নয়, তবু উচ্চতা খুব কমও নয়। আজ সকালে আমরা দুই বন্ধুতে এখানে এসে পৌঁছেছি। এরকম দুম করে সপ্তাহের মাঝখানে অফিস কামাই করে চলে আসার কারণ আজকের রাত্রিটা উপভোগ করা। আজ ফাল্গুনী পূর্ণিমা। আজকের রাতে নাকি মারীচমারি সবচেয়ে মোহময় হয়ে ওঠে। সপ্তাহের মধ্যে এসে পড়ায় এখানে পর্যটকও প্রায় নেই বললেই চলে। আমাদের রিসর্টে শুধু আমি, আমার বন্ধু সুমিত আর আমাদের পাশের ঘরে হেমেনবাবু। এই খোট্টার দেশে একজন ছা-পোষা ভেতো বাঙালির দেখা পেয়ে আমরা বেশ অবাকই হলাম। সত্যি বলতে বাঙালিরা এখনও সেভাবে মারীচমারির খবর জানে না। আমরা জেনেছি আমাদের অফিসের দারোয়ান শিউশরণের মুখ থেকে। শিউশরণ আশেপাশের কোনও এক গ্রামের বাসিন্দা। এখানকার নানা গালগল্প শোনায় প্রায়ই। সেসব ছেঁকে নিয়ে সারপদার্থ যেটুকু পেয়েছি, তাতে এখানে আসার জন্য আমরা উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম।
হেমেনবাবু শুনলাম কলকাতার সরকারি অফিসের কেরানি। একা মানুষ, বিয়ে-থা করেননি। প্রায়ই এভাবে বেরিয়ে পড়েন একা একা। আজ দুপুরে খেতে গিয়ে ওঁর সঙ্গে আলাপ হল। আমরা ঠিকই করেছিলাম আজ রাতে ডিনারের পর মারীচমারির জঙ্গলের আশপাশটা একটু ঘুরে দেখব। পূর্ণিমা রাতে সাদা জ্যোৎস্নায় কী অপরূপ রূপ নেবে মারীচমারি, তা ভেবেই আমাদের শিহরণ জাগছিল। খেতে বসে আমাদের এই আলোচনা শুনে প্রায় যেচেই আলাপ করলেন হেমেনবাবু। উদ্দেশ্য রাতের অভিযানে আমাদের সঙ্গ নেওয়া। এর আগেও প্রায় বার পাঁচেক পূর্ণিমায় মারীচমারি এসেছেন হেমেনবাবু। কিন্তু একা হওয়ায় কোনও বারই সাহস করে উঠতে পারেননি জঙ্গলে ঢোকার। জ্যোৎস্না রাত্রিতে রিসর্টের আশেপাশে ঘোরাফেরা করেই ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তাই এবার আমার আর সুমিতের কথোপকথন শুনতে পেয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সঙ্গী জোটার আশায়। আর আমরা তো এক পা বাড়িয়েই ছিলাম। তখনই ঠিক করে ফেললাম রাত ঠিক দশটার মধ্যে ডিনার করে আমরা বেরিয়ে পড়ব মারীচমারির পূর্ণিমা উপভোগ করতে।
আমাদের ফূর্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন রিসর্টের ম্যানেজার রামখেলন। রিসর্টের বারান্দা থেকে জঙ্গলের মাথায় গোল চাঁদটা যেইমাত্র আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকতে শুরু করল, যে যার ঘরের দরজায় তালা দিয়ে আমরা তিন অভিযাত্রী বাঙালি সন্তান গুটিগুটি হাঁটা শুরু করলাম বাইরে বেরনোর গেটের দিকে। রাত ন-টার মধ্যেই ডিনার সেরে রেডি হয়ে বসেছিলাম আমরা। হেমেনবাবু একটু দেরি করলেন বেরোতে। তাড়াতাড়ি বেরোতে যাব, বাধা দিলেন ম্যানেজার। ‘কাঁহা যা রহে হ্যায় সাহাব?” আমি একটু বিরক্ত হলেও ওঁকে পুরো ব্যাপারটা জানালাম। শুনে ওঁর মুখে যে ভয় মেশানো বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল, সেটা আমাদের বেশ অবাক করল। এবার ওঁর কথা থেকে যা আবিষ্কার করলাম, সেটা অনেকবার শুনেছি শিউশরণের মুখে
মারীচমারির জঙ্গল একটা সময়ে বেশ ভয়ের কারণ ছিল স্থানীয় মানুষের কাছে। এই জঙ্গলে বাস ছিল এক কুখ্যাত ডাকাতের। শিবা ডাকাত। সে তার দলবল নিয়ে ওত পেতে থাকত। জঙ্গলের আশপাশ দিয়ে কাউকে যেতে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে শুধু লুটই করত না, তার মুণ্ডুটা কেটে নিয়ে যেত। শোনা যায় জঙ্গলের কোনও এক গভীরে সেই ডাকাতের প্রতিষ্ঠিত এক মন্দির আছে। সেখানে রয়েছে মা মারীচমারির পাথরের মূর্তি, যার নামেই জঙ্গলের নাম। শিবা ডাকাত নিজের হাতে পাথর কুঁদে তৈরি করেছিল দেবীর মূর্তি। স্থানীয় লোকেরা বলে, শিবা ডাকাত দেবীকে সত্যিকারের মুণ্ডমালা পরাত। মাসে বারোটার বেশি মানুষ সে খুন করত না। কারণ দেবীর মুণ্ডমালা তৈরি করতে বারোটা মাথা লাগত। প্ৰতি পূর্ণিমায় দেবীর মালা পালটে দিত সে। শোনা যায়, এই দেবীর বাহন হল নেকড়ে প্রতি ফাল্গুনী পূর্ণিমায় নাকি জেগে উঠত সে। তার জন্য মানুষের টাটকা রক্ত এনে দিত শিবা। সেই রক্তে স্নান করাত দেবীর বাহনকে। স্নান করে, রক্ত পান করে একবছরের জন্য আবার পাথরে পরিণত হত নেকড়ে।
ফাল্গুনী পূর্ণিমার চাঁদ যখন মাঝ আকাশের দিকে যায়, দেবীর মন্দিরের চূড়ায় সরাসরি সেই জ্যোৎস্না পড়ে। তখনই জেগে ওঠে সেই নেকড়ে। এসব কাজ শিবা একা করতেই পছন্দ করত। তার দলের লোকদের উপস্থিতিও সে মেনে নিত না এই সময়। শিবার ভয়ে তখন লোকে এ পথ দিয়ে যাতায়াতই ছেড়ে দিয়েছিল। ফলে দেবী ও তার বাহনের সেবা শিবার কাছে চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল। লোকে বলে, একবার ফাল্গুনী পূর্ণিমায় মানুষ জোগাড় করতে পারেনি শিবা। নেকড়ে নাকি তাকেই হত্যা করে নিজের রক্ততৃষ্ণা মিটিয়েছিল। আজও কখনও কোনও পথভোলা পথিক মারীচমারির জঙ্গলে ফাল্গুনী পূর্ণিমায় একা হারিয়ে গেলে তাঁর আর ঘরে ফেরা হয় না। নেকড়ের হাতে মৃত্যু হয় তাঁর। অথচ সারা বছর এই জঙ্গলে নেকড়ে কেন, শেয়াল অবধি সেভাবে দেখা যায় না।
এসব শুনতে শিহরণ জাগে ঠিকই, কিন্তু যতই রোমাঞ্চকর হোক না কেন, বিশ্বাসযোগ্য নয়! আমি ম্যানেজারের কথা শুনে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, হেমেনবাবুও আমার পাশে দাঁড়ানো, হঠাৎ সুমিতের হেঁড়ে গলার গান ভেসে আসতেই হাঁ করে দেখলাম, ম্যানেজারকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ও কখন যেন হেঁটে চলেছে সামনের দিকে আর দূর থেকে শোনা যাচ্ছে ‘এই ফাগুনী পূর্ণিমা রাতে চল পলায়ে যাই।’ কেন যেন বেদম হাসি পেয়ে গেল। মুখটা আড়াল করে শুধু বললাম ‘আমরা বেশিদূর যাব না, এই একটু কাছেই…’ এর পর ম্যানেজার আর বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেননি। শুধু আমার মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বয়স্ক লোকটি বললেন ‘আপনা খয়াল রাখনা বেটা।’ বলে নিজের গলা থেকে একটা লাল কারে বাঁধা তাবিজ খুলে পরিয়ে দিলেন আমার গলায়। অজানা অচেনা মানুষটার জন্য একধরনের মায়া হল মনে।
গল্পগুলো ভুলভাল সন্দেহ নেই, কিন্তু জঙ্গলের রাস্তায় ঢোকার মুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের তিনজনেরই বাক্যি হরে গিয়েছিল। পরিবেশের অবদান নিঃসন্দেহে। গা ছমছমে নিঃশব্দ পথ, চাঁদের আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। কতক্ষণ হাঁটছি জানি না। এ রাস্তায় ঢোকার আগে অবধি সুমিতের হেঁড়ে গলার গান শুনছিলাম। কিন্তু মিনিট পনেরো হল ওর মুখে কথাটি নেই। কোথাও কোনও শব্দ নেই। এমনকি ঝিঁঝিঁ পোকারাও বোধহয় ডাকতে ভুলে গেছে। এত শুনশান নীরবতায় আমরা শহরের মানুষ অভ্যস্ত নই। শব্দ বলতে মাঝে মাঝে হেমেনবাবুর নাক টানার শব্দ। ভদ্রলোক ক্রনিক অ্যালার্জির পেশেন্ট। কথা নেই বার্তা নেই নাক টানা শুরু হয়ে যায়। খানিকক্ষণ হাঁটার পর হেমেনবাবু বলে উঠলেন, “একটা গন্ধ পাচ্ছেন মশাই? একটা পচা গন্ধ?”
আমি আর সুমিত দাঁড়িয়ে বার বার নাক টেনে শুঁকতে লাগলাম। কিন্তু কোথায় কী! তেমন কোনও গন্ধই তো পেলাম না। হেমেনবাবু ততক্ষণে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছেন। আমি আর সুমিত যে দাঁড়িয়ে পড়েছি, তাতে যেন তাঁর কিছুই যায় আসে না। আমি সুমিতকে টানতে টানতে কিছুটা এগিয়ে এলাম। একটা ফোঁস ফোঁস শব্দে টের পেলাম হেমেনবাবু নাক টেনে টেনে হয় সর্দি পরিষ্কার করার চেষ্টা করছেন, নয়ত… নয়ত কোনও গন্ধ শুঁকছেন।
“কী করছেন বলুন তো?” আমি একটু কড়া গলায় প্রশ্নটা করলাম। উনি চমকে উঠে আমার দিকে চাইলেন। তারপর করুণ স্বরে বললেন, “মাইরি বলছি, এখানেই ধারে কাছে কোথাও মন্দিরটা আছে। আমি মানুষ-পচা গন্ধ পাচ্ছি। দেবীর মুণ্ডমালা বদলানোর সময় হয়ে গেছে।”
ওঁর বাহুতে চেপে বসা আমার আঙুলগুলো আলগা হয়ে গেল। কী সব বলছেন উনি? বুঝতে পারছি গল্পটা ওঁর মনে সাংঘাতিক প্রভাব ফেলেছে। ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে চলেছি। আচমকা একটা বীভৎস পচা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে এল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে আশেপাশে কোনও বড়োসড়ো জন্তু মরে পচেছে। বড়োসড়ো কথাটা মাথায় আসতেই কেমন গুটিয়ে গেলাম। তাহলে কি হেমেনবাবুর কথাই ঠিক? মানুষ-পচা গন্ধ এটা? মুহূর্তের মধ্যে মন থেকে সরিয়ে ফেললাম চিন্তাটা। হেমেনবাবুর কথা শুনে আমিও দুর্বল হয়ে পড়ছি নাকি? নিশ্চয়ই জঙ্গলের ভেতরে কোনও গরু, মোষ মরেছে। এতে আর আশ্চর্য কী! কিন্তু অন্তত মিনিট সাতেক আগেই হেমেনবাবু বলেছেন উনি গন্ধ পাচ্ছেন। অথচ তখন কোনও গন্ধই ছিল না। আমি বা সুমিত গন্ধ পাইনি। কী জানি, কোনও কোনও মানুষের ইন্দ্রিয় একটু বেশিই স্পর্শকাতর হয়। এসব ভেবে মনকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করছি, হঠাৎ একটা শব্দে তাকিয়ে দেখি সুমিত প্রচণ্ড জোরে দৌড়ে বাঁপাশের গাছপালাগুলো পেরিয়ে আরও ভেতরের দিকে ঢুকে গেল। আমি চিৎকার করে ডাকলাম “সুমিত, কোথায় যাচ্ছিস? আরে, কী হল কী?”
কোনও উত্তর এল না। নিস্তব্ধ জঙ্গলের গাছেদের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আমার কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার কাছেই ফিরে এল। আমি হতবাক হয়ে সামনের দিকে চাইলাম হেমেনবাবুর খোঁজে। আরে, হেমেনবাবুই বা গেলেন কোথায়? জঙ্গলের জ্যোৎস্নায় ধোয়া গাছের পাতার আলোছায়ার মধ্যিখানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই প্রথম মনে হল, ম্যানেজারের কথা না-শুনে আসা ঠিক হয়নি। তার উপরে হেমেনবাবুর পিছন পিছন কথায় কথায় এত ভেতরে ঢুকে পড়েছি যে ওঁকে ছাড়া বেরোতে পারব কিনা বুঝতে পারছি না।
নিঝুম জঙ্গলে একটা পাতা নড়ারও শব্দ নেই। শুধু নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকটুকু কানে আসছে যেন। কাঁপা গলায় ডাকলাম, “সুমিত, হেমেনবাবু, কোথায় আপনারা? আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে লাভ নেই”, শুকনো গলায় একটু হাসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু হাসিটা ঠিকমতো ফুটল না। ওপাশ থেকে কোনও প্রত্যুত্তর এল না। বার বার মনে হচ্ছিল এই বুঝি সুমিত হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল ঝোপের আড়াল থেকে। কিন্তু না। এইভাবে আরও বেশ কিছুক্ষণ কাটল। এবার এখান থেকে ফেরার উদ্যোগ নিতে হয়। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত বারোটা পাঁচ বেজে বন্ধ হয়ে গেছে। সেকেন্ডের কাঁটাটা স্থির হয়ে আছে। এতক্ষণ ঘড়ির দিকে তাকাইনি, তাই এখন ক-টা বাজতে পারে সে সম্পর্কে কোনও ধারণা পাচ্ছি না। যেভাবেই হোক এখান থেকে বেরিয়ে রিসর্টে খবর দিতে হবে। হেমেনবাবু আর সুমিতকে খোঁজার জন্য লোকজন নিয়ে আসা দরকার। কিন্তু রাস্তা খুঁজতে গিয়ে যদি পথ হারিয়ে ফেলি? যদিও শুনেছি এই জঙ্গলে তেমন হিংস্র জন্তুর ভয় নেই, তবু রাতবিরেতে একা জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়াটা খুব আনন্দের অনুভূতি বয়ে আনবে না।
কোনোরকমে মনে সাহস সঞ্চয় করে পিছন ঘুরলাম আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আঁতকে উঠে পিছিয়ে এলাম। কখন যেন সুমিত নিঃশব্দে এসে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। বনজ্যোৎস্নার আলোয় ওর চোখে ঝিলিক দেওয়া কৌতুকটাও চোখে পড়ছে। কিন্তু ওর চেহারায় কিছু একটা পরিবর্তন ঘটেছে, সেটা ধরেও ধরতে পারছি না। আর তার সময়ও নেই। আমি দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলাম, “পেয়েছিস কি? ইয়ার্কি হচ্ছে? রাতবিরেতে জঙ্গলে মজা করছিস? এক্ষুনি ফিরব চল।” বলেই ওর হাত ধরে মারলাম এক টান। টানটা মেরেই আবার হাঁ করে তাকালাম। আমার টানে রোগা প্যাঁটকা সুমিত একচুলও নড়েনি। বলা ভালো ওর হাতটাও নড়েনি। পাথরের প্রাচীরের মতো স্থির অচঞ্চল দাঁড়িয়ে হাসছে। কিন্তু কেমন যেন কেঁপে উঠল ওর শরীরটা। হঠাৎ যেন আমার চোখে ধরা পড়ে গেল ওর পরিবর্তনটা। সুমিতের শরীরটা আর রোগা নেই। পেশীবহুল বিশাল চেহারা ওর জামাকাপড়ের ভেতর থেকে ফুটে বেরোচ্ছে। আমার চোখের সামনে আরও কিছু পরিবর্তন হতে লাগল ওর শরীরে। হাতের উন্মুক্ত অংশে দেখা দিল গাঢ় বাদামি লোম। মুখের হাসিটা এখন বিলুপ্ত। চোখদুটো যেন ধকধক করে জ্বলছে। আমার চোখের সামনে ওর দেহটা বেঁকে যাচ্ছে ধনুকের মতো। মাথাটা ক্রমশ ঝুঁকে পড়ছে মাটির দিকে। কিন্তু জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি মুহূর্তের জন্যও সরেনি আমার চোখ থেকে। আমার গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠল।
ওয়্যারউলফ! প্রচুর বিদেশি ফিল্ম দেখার সুবাদে সুমিতের পরিবর্তনটা চিনতে আমার দেরি হয়নি। কিন্তু সুমিত? গত আটমাস ধরে আমাদের অফিসে কাজ করছে সুমিত। তার মধ্যেই গোটা তিনেক জায়গায় ওর সঙ্গে বেড়াতে গেছি আমি। কিন্তু এরকম অদ্ভুত দৃশ্যের সাক্ষী হইনি কক্ষনো। নড়বার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। নিজের চোখের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি। ফিল্মে দেখা একরকম, আর বাস্তবে চোখের সামনে এ দৃশ্য যে কতটা অস্বস্তি তৈরি করে, তা না দেখলে বোঝানো সম্ভব নয়। ছুঁচলো মুখটা আকাশের দিকে তুলে রুপোর থালার মতো চাঁদটাকে একবার দেখে নিল…
সুমিত- সুমিত? একে কি আর সুমিত বলা যায়? এখন সম্পূর্ণ একটা পূর্ণবয়স্ক নেকড়েতে পরিণত সে। চাঁদটাকে দেখেই মুখ উঁচু করে রক্ত জল করা এক হুংকার ছাড়ল প্রাণীটা। হুংকারের শব্দে হঠাৎ সম্বিত ফিরে এল আমার। পালাতে হবে… এটা মাথায় আসতেই দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্যের মতো ছুট দিলাম। ছুটতে ছুটতে কোথায় চলেছি জানি না। নেকড়ের হাতে প্রাণ খোয়ানোর কোনও ইচ্ছে নেই আপাতত। তাই অন্তত রাতটুকু গা-ঢাকা দিয়েই থাকতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ দৌড়নোর পর থামলাম। আর দম নেই। আর এক পা-ও দৌড়লে আমার হৃৎপিণ্ড ফেটে যাবে। ধপ করে বসে পড়লাম মাটির ওপর। বহুদূর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে ক্রুদ্ধ নেকড়ের চিৎকার। চিৎকার শুনে মনে হচ্ছে নেকড়েটা আমার ধারে কাছে অন্তত নেই। এখন যদি আমার সামনে এসেও দাঁড়ায় ওটা, আমার পালাবার শক্তি নেই। মনে প্রাণে মা কালীকে স্মরণ করছি। বিপদে না পড়লে ভগবানের শরনাপন্ন হই না আমি। তাই আমার প্রার্থনায় আদৌ কোনও জোর আছে কিনা জানি না। তবে কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার পিছনের ঝোপের আড়াল থেকে একটা চেনা শব্দ পেয়ে প্রাণে জল এল। হেমেনবাবু। ওঁকে দেখতে পাচ্ছি না বটে, কিন্তু ওঁর নাক টানার শব্দ কানে আসছে। আমি পাগলের মতো ডেকে উঠলাম, “হেমেনবাবু! আপনি কোথায়? আমাকে বাঁচান।”
খসখসে গলায় উত্তর এল, “ভয় পাবেন না মশাই। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এদিকে আসুন।” দেহটাকে কোনওক্রমে টেনে নিয়ে ঝোপগুলোর পিছনে গিয়ে দেখি হেমেনবাবু ঝোপের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে কী যেন করছেন। ওঁর পিঠের অংশটুকু শুধু উঁচু হয়ে রয়েছে। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বলে উঠলাম, “কী করছেন হেমেনবাবু? এখন এসবের সময় নেই। আপনি জানেন না আমরা কতখানি বিপদে পড়েছি।” আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ঠোঁটে একটা আঙুল চেপে ধরা গলায় বলে উঠলেন হেমেনবাবু, “শ্ শ্ শ, একদম কথা নয়। দেখছেন না, মন্দিরের চূড়ায় চাঁদের আলো সরাসরি এসে পড়েছে? সময় হয়ে গেছে। এখানেই রেখেছিলাম ওটা। এক্ষুনি পেয়ে যাব।” বলে আবার ঝোপের মধ্যে কি যেন খুঁজতে শুরু করলেন।
হেমেনবাবুর কথার বিন্দুবিসর্গ উদ্ধার করতে না পারলেও অসহায়ের মতো ইতিউতি চোখ চালাতে শুরু করলাম। না জানি কোথায় নিঃশব্দে বিপদ এসে থাবা গেড়ে বসে আছে। এদিক ওদিক তাকাতেই হেমেনবাবুর কথা কিছুটা স্পষ্ট হল। আমার ঠিক ডান পাশে একটা মন্দিরের ভগ্নস্তুপ। প্রায় পুরোটাই ভাঙাচোরা, শুধু ত্রিকোণাকার চূড়ার মাথায় একটা বিরাট ত্রিশূল সোজা উঠে গেছে আকাশের দিকে। এই মুহূর্তে চাঁদ ঠিক মন্দিরের উপরের আকাশে এবং চাঁদ থেকে একটা অপার্থিব আলোর রশ্মি নেমে এসেছে ত্রিশূলের মাথায়। কোন ধাতু ব্যবহৃত হয়েছিল ত্রিশূল বানাতে জানি না, কিন্তু চাঁদের আলোয় এত বছর বাদেও ওটা ঝকঝক করছে। মনে পড়ে গেল শিউশরণ আর ম্যানেজার রামখেলনের মুখে শোনা একই গল্প। এখন আর গল্প বলা যায় না, অন্তত নিজের চোখে দেখার পর। প্রতি ফাগুনী পূর্ণিমায় চাঁদ যখন মাঝ আকাশে ওঠে, তখনই জেগে ওঠে দেবী মারীচমারির বাহন নেকড়ে। আমি নিজে দেখেছি তাকে জাগতে, আমার বন্ধুর মধ্যে। সুমিতের কথা মনে পরাতে একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। আবার হেমেনবাবুর কথা মনে পড়তেই ঘুরে তাকালাম যেদিকে উনি ছিলেন। আবার চমকে উঠলাম। হেমেনবাবুর মুখ, পাঞ্জাবি, দুই হাত, ধুতি সব ধুলোমাটিতে মাখামাখি। আর হাতে একটা বিশাল খাঁড়া। খাঁড়াটা দেখে আমি প্রায় টলে পড়ে যাচ্ছিলাম। বিশাল মাপের ভারী খাঁড়া উনি যে কী করে অমন অনায়াসে এক হাতে মাথার উপর তুলে দাঁড়িয়ে আছেন, তা উনিই জানেন। অথচ ওঁকে দেখে মনেই হচ্ছে না কোনও কষ্ট হচ্ছে। হাসিমুখে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। “এটাই খুঁজছিলাম। আর কোনও ভয় নেই।”
আমি তখনও হাঁ করে চেয়ে আছি দেখে আবার বললেন, “কিচ্ছু বুঝতে পারছেন না তো? পারার কথাও না। চলুন হাঁটতে হাঁটতে বলি।” বলেই হাঁটা শুরু করলেন। আমিও উপায় না দেখে ওঁর পিছু নিলাম। খাঁড়াটা দেখে আমার মনেও একটু আশ্বাস জেগেছে। কিছু না হোক অন্তত আক্রমণ করলে যুঝতে পারব নেকড়েটার সঙ্গে। কিন্তু খাঁড়াটা যে ওখানে ঝোপের নীচে মাটিতে পুঁতে রাখা ছিল, সেটা হেমেনবাবু জানলেন কী করে? হেমেনবাবু খাঁড়ার ভোঁতা দিকটা কাঁধের উপর রেখে দুলকি চালে হাঁটা শুরু করেছেন। দেখে মনে হচ্ছে উনি হাতের তালুর মতো চেনেন এ জঙ্গলকে। আমি ওঁকে অনুসরণ করলাম।
“জানেন মশাই, এই আপনার বন্ধু সুমিতবাবু, লোক সুবিধার না। উনি এর আগেও এসেছেন এখানে।”
লোকটা বলে কী! সুমিত তো নিজেই শিউশরণের কথা শুনে এত উৎসাহ দেখাল এখানে আসতে! একবারও তো মনে হল না জায়গাটা ওর চেনা। হেমেনবাবু বলে চলেছেন, “শিবা ডাকাত মরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারীচমারির মন্দিরে পুজো বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মায়ের বাহনের মধ্যে যে রক্ততৃষ্ণা সে জাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, তার উপশম হল না। প্রতি ফাল্গুনী পূর্ণিমায় জেগে উঠত সেই নেকড়ে। কিন্তু এ জঙ্গলে সে মানুষ কোথায় পাবে? বছরের পর বছর এখানে মানুষের অভাবে উপোসী রইল সে। যত উপোস, তত বেশি হিংস্র হয়ে উঠল মায়ের বাহন। বহুদিন গেল। আস্তে আস্তে মানুষের মধ্যেকার ভয় কমতে শুরু করল। একজন দু’জন করে আবার যাতায়াত করতে শুরু করল এ জঙ্গল দিয়ে। কখনও কখনও না জেনেই ফাল্গুনী পূর্ণিমাতেও। বহুকাল পর আবার পেট ও মন ভরল নেকড়ের। কিন্তু দু-চার বার এমন হতেই আবার মানুষের মনে ভয় ঢুকে গেল। মুখে মুখে নানারকম ভীতিপ্রদ কাহিনি প্রচার হল। আবার ঢোকা বন্ধ হল জঙ্গলে। ঠিক এই সময়েই যাতায়াত শুরু করলেন আপনার বন্ধু সুমিতবাবু। সব দেখেশুনে গেলেন। তারপর এক রাতে সাগরেদদের নিয়ে এসে ঢুকলেন এই জঙ্গলে। মায়ের মন্দির অপবিত্র করে প্রবেশ করলেন ভেতরে। মায়ের মূর্তি চুরিরই ইচ্ছে ছিল মূর্তিচোরদের। কিন্তু মূর্তির ওজন সম্পর্কে ধারণা ছিল না বোধহয় ওদের। চারজনের পক্ষে সম্ভব হল না মাকে নিয়ে যাওয়া। কিছু না পেয়ে নিয়ে গেল মায়ের বাহনকে। এটা ছিল সুমিতবাবুর জীবনের সেরা ভুল। প্রতি বছর ফাল্গুনী পূর্ণিমায় ফিরে ফিরে আসতে হল ওকে। সঙ্গে নিয়ে আসতেন কোনও না কোনও সঙ্গী। রাতের এক সময় জঙ্গলে ঘুরতে আসার নামে ঢুকে নিজের সঙ্গীকে খুন করে রক্তে স্নান করে নিজের নেশা পূরণ করে সে। গত পাঁচ বছর ধরে এই চলছে। আজ ওর শিকার হতে চলেছেন আপনি। ম্যানেজারবাবুর দেওয়া মাদুলিটা আপনাকে এখনও পর্যন্ত রক্ষা করেছে। সেইজন্যই একটু আগে আপনি যখন ওকে ছুঁয়েছিলেন, কেঁপে উঠেছিল প্রাণীটা।” আমার চোয়াল বিস্ময়ে ভয়ে ঝুলে পড়েছে।
“কিন্তু আপনি… আপনি এত কিছু…” কথা শেষ হল না আমার। ঘুরে দাঁড়ালেন হেমেনবাবু। আরে, এ কী দেখছি? আমার চোখ কি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, নাকি আমি কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছি? কোন এক ভোজবাজিতে হেমেনবাবুর ক্লিন শেভড মুখে এখন এলোমেলো দাড়িগোঁফ। ঝাঁকড়া চুল ঢেকে ফেলেছে কপাল। কপালের উপর একটা সাদা ফেট্টি বাঁধা। তাতে চুলগুলো একটু উঁচু হওয়াতে কপালের ঠিক মধ্যিখানে তেল সিঁদুরের টিকা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কোথায় ধুতি পাঞ্জাবি কোথায় কি? তেল চকচকে খালি গায়ে খাটো কাপড় পরনে যে আমার সামনে খাঁড়া হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখেই মনের মধ্যে একটাই নাম জাগল ‘শিবা ডাকাত’। আমার হাঁটু কাঁপতে শুরু করল। আজ এই মায়াবী রাতে আর কী কী আছে কপালে কে জানে!
হেমেনবাবু, থুড়ি শিবা ডাকাত এগিয়ে এল আমার দিকে। তারপর গমগমে কণ্ঠে পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠল, “ভাবছেন কী মশাই? শিবা ডাকাত ছিল খাস বাংলাদেশের লোক। জীবিকার জন্য পড়ে ছিল এই রাজ্যে। তার আসল নাম ছিল হেমেন্দ্র মজুমদার। তাই বাঙালী হয়ে ছা-পোষা বাঙালীর ভূমিকায় অভিনয় করাটা কি খুব কঠিন? যাক গে এসব ছাড়ুন। অভিশপ্ত প্রাণীটাকে আজ রাতেই শেষ করতে হবে। যে তৃষ্ণা আমি জাগিয়েছিলাম ওর মধ্যে, সেই তৃষ্ণার অবসানও হবে আমারই হাতে। সেদিন যদি একটু সতর্ক হতাম, তাহলে নেকড়েটার সাধ্যি ছিল না আমাকে খুন করে। কিন্তু মায়ের পুজো মুণ্ডমালার অভাবে অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায় মনটা খুব বিক্ষিপ্ত ছিল। সেই সুযোগটাই নিয়েছিল শয়তানটা কিন্তু আর নয়। আজই ওর শেষ দিন। মা মারীচমারির খাঁড়া ছাড়া আর কিচ্ছুতেই মরবে না ও। প্রতি পূর্ণিমার মতো সেই রাতেও মায়ের খাঁড়াটা আমি লুকিয়েছিলাম? ঝোপের নীচের মাটির তলায়। ওখানেই থাকত ওটা বরাবর। মানুষ মারতে ওটাই ব্যবহার করতাম আমি। শুধু পূর্ণিমার পুজোর সময় মায়ের হাতে দিতাম ওটা। যাই হোক সময় আর বেশি নেই। একটা কাজ করতে হবে। আপনার? মাদুলির ভয়ে সামনে আসতে পারছে না শয়তানটা। ওটা খুলে ফেলতে হবে গলা থেকে। কোনও ভয় নেই আপনার। আমি আছি।” বলতে বলতেই এক হ্যাঁচকা টানে আমার গলা থেকে লাল সুতোয় বাঁধা মাদুলিটা ছিঁড়ে এনে দুরে ছুঁড়ে ফেলে দিল শিবা ডাকাত। অর্থাৎ শেষ বর্মটুকুও আর নেই আমার দেহে!
কয়েক মিনিট দু’জনেই মুখোমুখি স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর… একটা মৃদু সরসর শব্দ কানে এল আমার পিছন থেকে। আমি জানি সাক্ষাৎ মৃত্যুর মতো আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে সেই নেকড়ে। যে কোনও মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার গলার নলি ছিঁড়ে ফেলবে। তারপর সেই টাটকা গরম রক্তে স্নান করে নিজের তৃষ্ণা মেটাবে। আর পথ নেই। ঢোঁক গিলে চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম অন্তিম মুহূর্তের।
আমার সামনে শিবা ডাকাত তখন উপরের দিকে নাক তুলে শব্দ করে করে কিছু শুঁকছে। তারপর ফিসফিস করে বলে উঠল, “সময় হয়ে গেছে। শয়তান আমাদের খুব কাছে। খুব সাবধান রোহনবাবু।” বলতে না-বলতে একটা বিকট গর্জন করে পিছন থেকে আমার ঘাড়ে এসে পড়ল প্রাণীটা। মাটিতে পড়ে যেতে যেতে টের পেলাম প্রচণ্ড ভারী প্রাণীটার ধারালো নখগুলো বিঁধে যাচ্ছে আমার পিঠে। বুনো বোটকা গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে এল। ভয়ে আর যন্ত্রণায় জ্ঞান হারালাম আমি। চোখ বন্ধ হওয়ার ঠিক আগে দেখতে পেলাম শিবা ডাকাত তার মায়ের খাঁড়া দু’হাতে মাথার উপর তুলে ছুটে আসছে আমাদের দিকে।
*****
জ্ঞান ফেরার আশা নিয়ে জ্ঞান হারাইনি। তবু জ্ঞান ফিরল। তখন বেলা বেড়ে চারিদিকে প্রখর রোদ। আমি শুয়ে আছি রিসর্টের লনের বেঞ্চে। আমার চারিদিকে অন্তত জনা আটেক লোক। একটু সুস্থ হয়ে ম্যানেজারবাবুর কাছে জানলাম, সুমিতের গলাকাটা দেহ পাওয়া গেছে জঙ্গলের মধ্যে। কিন্তু মাথার কোনও সন্ধান মেলেনি এখনও। আমি মনে মনে ভাবলাম, আমি জানি কোথায় সুমিতের মাথা। মা মারীচমারির মন্দিরে ঢুকলেই দেখা যাবে মায়ের গলায় মুণ্ডমালা পরানো হয়েছে। কত বছর বাদে মায়ের উপাসক তার সাধ মিটিয়ে পুজো দিয়েছে! বাইরের পৃথিবীর জানার দরকার নেই এই সত্য। আমি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ম্যানেজারবাবুকে তাঁর মাদুলির জন্য ধন্যবাদ দিলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “হেমেনবাবু কোথায়?”
ম্যানেজারের কপাল কুঁচকে উঠল, “হেমেনবাবু কৌন?’ আমি অবাক হয়ে বললাম, “হেমেনবাবুকে চিনতে পারছেন না? আমাদের পাশের রুমে উঠেছেন। কাল রাতে আমাদের সঙ্গেই বেরোলেন তো!”
ম্যানেজারবাবু আরও অবাক হয়ে বললেন, “পর ইস নামকি কোই বোর্ডার হামারে রিসর্ট মে নেহি হ্যায় সাহাব। অউর আপকে বগলকে কামরা তো খালি হ্যায়। অব আপ লোগো কে ইলাবা ইয়াহা অউর কোই বোর্ডার নেহি হ্যায়। চাহে তো আপ হামারে রেজিস্ট্রার দেখ সাকতে হ্যায়। অউর কাল তো আপ কে সাথ সুমিতবাবু হি থে। তিসরা কোই নেহি থা।” আমার আর দেখার প্রয়োজন ছিল না। একটু সুস্থ হয়ে সেদিনই কলকাতায় ফিরেছিলাম। আর ওখানে নয়। কী জানি হয়তো এবার থেকে প্রতি রাতেই দুই শক্তিশালী প্রতিস্পর্ধী মেতে উঠবে রক্তের খেলায়! কিছু রহস্য রহস্য থাকাই ভালো।