মারি সিটনের একটি চিঠি
সত্যজিৎ রায়ের পূর্ণজীবনী লেখার প্রথম কৃতিত্ব বোধ হয় লন্ডননিবাসিনী এক ভদ্রমহিলার, নাম মারি সিটন১৩ [Marie Seton], বইটির নাম ‘পোর্ট্রেট অফ এ ডিরেক্টর— সত্যজিৎ রে’— প্রথম প্রকাশকাল ইংরেজি ১৯৭১। এই বই লেখার জন্য মারি সিটনকে মাসের পর মাস এদেশে থাকতে হয়েছে, সত্যজিৎ রায়ের ইউনিটের সঙ্গে ছবির লোকেশনে ঘুরতে হয়েছে, দিনের পর দিন সত্যজিতের ইন্টারভিউ নিতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, সত্যজিতের সঙ্গে যাঁরাই ঘনিষ্ঠ, তা আত্মীয়তার দিক দিয়েই হোক কি ছবি তোলার ব্যাপারেই হোক, তাঁদের সঙ্গে পর্যন্ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আলোচনা করেছেন মারি সিটন, খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তাঁর এই পরিশ্রমের ফসল হল ওপরের বইটি— সত্যজিতের ওপর তথ্যসমৃদ্ধ একটি বই। এত পরিশ্রম, এত অর্থব্যয় করে এমন একটি গ্রন্থ রচনা করা বোধ হয় আমাদের দেশে সম্ভব নয়, আমাদের সে উদ্যম নেই, সামর্থ্যও নেই।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, জাপানি চলচ্চিত্র পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার সম্বন্ধেও লিখেছেন এক বিদেশি, ডোনাল্ড রিচি (দ্য ফিলমস অফ আকিরা কুরোসাওয়া)। বইটি প্রকাশ হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস থেকে। হিচককের ওপর লিখেছিলেন ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক ও সমালোচক ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো।
‘মহানগর’কে জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার না দেবার জন্য যে চক্রান্ত হয়েছিল তা নিয়ে দিল্লির ইংরেজি কাগজ সেঞ্চুরিতে বিস্তর চিঠিপত্র এসেছিল এবং ছাপাও হয়েছিল। মারি সিটনও এ বিষয়ে একটা চিঠি ওই পত্রিকায় লিখেছিলেন। চিঠিটা পাঠকসমাজে কৌতূহল সৃষ্টি করবে ভেবেই নিচে ওটার যথাসম্ভব ভাবানুবাদ দেওয়া হল।
‘মহানগর’ নিয়ে আপনাদের কাগজে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে আমি তা আগ্রহের সঙ্গে পাঠ করছি। কিছুকাল ধরে লক্ষ্য করছি, সত্যজিতের ছবি নিয়ে এমন শোরগোল তোলা হচ্ছে যাতে তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করা যায়। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র ব্যাপারে এটা দেখেছি, আবার ‘অভিযান’-এও এটা লক্ষ্যণীয়। অথচ ‘অভিযান’ বা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-য় যে গভীর মানবিক বোধ আছে সে সম্বন্ধে সমালোচকরা আশ্চর্যরকম নিশ্চুপ।
আমি একথা বলছি না যে, ওই তিনটে ছবিই রায়ের মহৎ সৃষ্টি কিংবা দোষ-ত্রুটি হীন, কিন্তু যা আমাকে বিষণ্ণ করেছে তা হল বেশ কিছু লোক একজোট হয়ে বলতে চেয়েছেন, ওগুলো ছবিই হয়নি। তাঁদের বক্তব্য কিংবা তাঁরা প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর সত্যজিতের প্রতিভায় ভাঁটা পড়েছে। এমনকি কোনো চিত্র সমালোচক তাঁর প্রশংসা করলে তাঁকে পর্যন্ত বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়।
কলকাতা আর বোম্বেতে চলচ্চিত্র ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত কিছু মানুষ সত্যজিতের ছবি তোলা বন্ধ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। সন্দেহ নেই, ব্যাপারটা ঈর্ষা থেকেই সৃষ্টি। পৃথিবীর দশজন শ্রেষ্ঠ পরিচালকের মধ্যে সত্যজিৎ একজন, এটাই বোধ হয় ওঁদের উষ্মার কারণ। যেসব চিত্রব্যবসায়ী সত্যজিৎকে বিপাকে ফেলতে চান, তাঁরা এমন কিছু লোকের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন যাঁরা চলচ্চিত্রের কার্যকারিতা সম্বন্ধে কিছুই বোঝেন না। তবু গত কয়েক বছর ধরে সত্যজিৎকে ব্যর্থ প্রমাণ করার জন্য তাঁরা নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনেও নাকি এমন ঘটনা ঘটেছিল।
বিশ্ববরেণ্য একজন পরিচালককে অপদস্থ করার এই যে জঘন্য অভিযান, তা নিশ্চয়ই নোংরা ব্যাপার। বলা হচ্ছে, ‘মহানগর’ ছবিতে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বিরুদ্ধে দেখানো হয়েছে। কথাটা সত্যি নয়, কারণ একমাত্র ওই ছবিতেই মা ও মেয়ে দুটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান চরিত্রকে যথাযথভাবে দেখানো হয়েছে।
যাদের নাম কেউ কোনোদিন শোনেনি, তারা হঠাৎ এই নিয়ে হইচই শুরু করে দিল, যারা সিনেমার কিছু বোঝে না, তারা সরকারি মহলে এই নিয়ে ঝড় তুলল। আমার নিজের ধারণা, অহেতুক গোলমাল সৃষ্টি করে পুরস্কার কমিটিকে এমনভাবে বিভ্রান্ত করা হয়েছে যে শেষপর্যন্ত ‘মহানগর’কে তৃতীয় পুরস্কার দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
সত্যজিতের ছবির প্রশংসা করলে বিরোধীপক্ষরা সেই সমালোচককে ভয় দেখাতেও কসুর করেন না, এমনটিও লক্ষ্য করা গেছে। সত্যজিতের ছবির অর্থই হল বিদেশি মুদ্রার আমদানি এটা বিরোধীদের মাথায় ঢোকে না।
সত্যজিৎকে নিয়ে আমি একটা বই লিখেছি। বইটা প্রকাশ পেলে সত্যজিৎ-বিরোধীরা হয়তো ওটা ছিঁড়ে ফেলবেন। আমি আশা করি, সত্যজিৎকে খাটো করে দেখার এই অপচেষ্টা একদিন দূর হবেই। আমি বলছি না, সত্যজিতের সব ছবিই সমান সৃজনশীলতা দাবি করতে পারে, কিংবা সব ছবিই গুণগত বিচারে উৎকর্ষ।
‘মহানগর’ সম্বন্ধে আমার নিজস্ব অভিমত, সমসাময়িক পরিবেশে ওটা একটা অপূর্ব সংবেদনশীল ছবি। সংবেদনশীল এই কারণে যে, ওই ছবিতে একটি সর্বজনীন আবেদন আছে। সবকিছু বিবেচনা করে বলা যায় ‘মহানগর’ একটি বাস্তবধর্মী ছবি।
***
১৩. মারি সিটন (১৯১০—১৯৮৫) বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচক এবং জীবনীকার। বিংশ শতাব্দীর ছয় এবং সাতের দশকে তিনি তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় ভারতবর্ষে কাটান। জওহরলাল নেহরুর অনুরোধে ফিলম সোসাইটির দায়িত্ব নেন এবং চিদানন্দ দাশগুপ্ত ও বিজয়া মুলে-র সঙ্গে ফেডারেশন অফ ফিলম সোসাইটি’স অফ ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠা করেন। সত্যজিৎ রায়ের প্রথম জীবনী লেখার কৃতিত্ব সম্পূর্ণভাবে মারি সিটনের। এর আগে তিনি সের্গেই আইজেনস্টাইন, জওহরলাল নেহরু প্রমুখদের জীবনী রচনা করেছিলেন। সত্যজিতের জীবনী লেখার জন্য তিনি অধিকাংশ দিন সত্যজিতের লেক টেম্পল রোডের ফ্ল্যাট বা রামকৃষ্ণ মিশন গোলপার্কের অতিথি নিবাসে থাকতেন। ১৯৮৫-তে প্রয়াত হওয়ার ফলে মারি সিটনের লেখা বই ‘পোর্ট্রেট অব দ্য ডিরেক্টর সত্যজিৎ রায়’-এর পরিবর্ধিত সংস্করণ অসমাপ্ত থেকে যায়। সেই অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করেন প্রখ্যাত সত্যজিৎ গবেষক ইন্দ্রাণী মজুমদার।