মারাত্মক ঘড়ি – প্রমথনাথ বিশী
পিন্টুদের বাড়িতে মস্ত একটা গোল দেওয়াল ঘড়ি ছিল। বাইরের ঘরে দেওয়ালের অনেকটা জুড়ে ঘড়িটা কায়েমি অধিকার করে বিরাজ করে। ঘড়িটা যে কতদিনের পুরোনো সে ইতিহাস গবেষণার বিষয়। এ বাড়িতে তার প্রথম আবির্ভাব এখন কিংবদন্তি, সে কিংবদন্তিও আবার নানা রকম। পিন্টু বন্ধুদের কাছে বলে বাবার ঠাকুরদা সাহেববাড়ির নিলামে ঘড়িটা কিনেছিলেন। পিন্টুর কাকারা বার লাইব্রেরিতে গল্প করেন যে বাবার প্রপিতামহ একটা ডুবোজাহাজের মাল নিলাম হতে দেখে নামমাত্র মূল্যে ঘড়িটা কিনে এনেছিলেন। এ থেকেই বুঝতে পারা যাবে যে ঘড়িটার খ্যাতি অনেক দূর ছড়িয়েছে। পিন্টুর বন্ধুমহল জানে, পিন্টুর দুই কাকাই ব্যারিস্টার, কাজেই বার লাইব্রেরির সভ্যগণও জানেন আর আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব তো অবশ্যই জানে। যাই হোক ঘড়িটার বয়স যে অন্তত দেড়শো বছর এ বিষয়ে সকলে একমত। কিন্তু মজা হচ্ছে এই যে ঘড়ির মধ্যে যে কোম্পানির নাম লিখিত ছিল তা অনেকদিন মুছে গেলেও ঘড়িটা কখনো অচল হয়নি। সপ্তাহে একবার করে দম দিতে হত, যেমন সব দেওয়াল ঘড়িতে দিতে হয়। ওই দমটুকুর ওপর নির্ভর করে বশংবদ ঘড়িটা আজ তিন—চার পুরুষ সময় জ্ঞাপন করে আসছে পিন্টুদের বাড়িতে।
চন্দ্র সূর্য যেমন আকাশের নিত্য বস্তু, ঘড়িটাও তাই। চন্দ্র সূর্য বলা বোধ করি ঠিক হল না, কারণ তারা আকাশে নড়েচড়ে বেড়ায়; গ্রহ উপগ্রহ বলাও ঠিক হবে না, ঘড়িটার অচল অটল অবস্থা দেখে নক্ষত্র বলাই উচিত। তবে ঘড়ি না নড়লেও তার কাঁটা দুটোর কখনো নড়তে ভুল হয় না। দামি দামি হালফ্যাশনের হাতঘড়িগুলোতেও কখনো কখনো দু—এক মিনিটের তারতম্য ঘটলেও ওই পুরোনো বুড়ো ঘড়িটা সময় নির্দেশে কখনো ভুল করে না। আরও মজা হচ্ছে এই যে ঘড়িটা কখনো মেরামত হয়েছে এমন কেউ জানে না। পিন্টুর কাকার বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলতেন ঘড়িটা বামুনের গোরু, খায় কম—দুধ দেয় বেশি। তবে এহেন ঘড়িটা পিন্টুদের বাড়ির একটি দর্শনীয় ঐশ্বর্য। পিন্টুর কাকাদের বন্ধুরা ওটা কোন কোম্পানির তৈরি আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছেন। তাঁরা বলেন, জানতে পারলে সেই কোম্পানি থেকে ঘড়ি কিনি। কিন্তু জানবার উপায় কী? ভিতরে এক সময়ে নিশ্চয় কোম্পানির নাম লেখা ছিল, বর্তমানে তা সম্পূর্ণ লুপ্ত। আতস কাচ দিয়ে এমন কী মাইক্রোস্কোপ লাগিয়ে পাঠোদ্ধার করবার চেষ্টা করেও তাঁরা সফল হননি। তাঁরা বলাবলি করতেন, ও ঘড়িটা স্বয়ম্ভু। হয় আকাশ থেকে পড়েছে নয় সমুদ্র থেকে উঠেছে।
এখন এই ঘড়িটা সম্বন্ধে আর একটা কিংবদন্তি প্রচলিত ছিল, যা নাকি ভারি রহস্যময়। আর যা কিছু রহস্যময়, আধুনিক বৈজ্ঞানিক মন তাকে সংক্ষেপে ‘গাঁজা’ বলে উড়িয়ে দিতে অভ্যস্ত। কিংবদন্তিটা রহস্যময় আর বড়ো মারাত্মক। বাড়িতে কারও মৃত্যু হবার ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা আগে ঘড়িটা নাকি আপনিই থেমে যায়। অবশ্য পিন্টুর বাবা, কাকা প্রভৃতি এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেননি, তবে শোনা যায় যে পিন্টুর ঠাকুরমার মৃত্যুর আগে ওইভাবে ঘড়িটা থেমে গিয়েছিল। কিন্তু তার দুই ব্যারিস্টার কাকা স্বাভাবিক ব্যাখ্যা দিয়ে ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেন, বলেন যে মা—র মৃত্যু ঘটেছিল বিরানব্বই বছর বয়সে, তাঁর অসুখের চিকিৎসা ও সেবা নিয়ে সকলে ব্যস্ত ছিল, কাজেই সময়মতো ঘড়িটাতে দম না দেওয়াতে থেমে গিয়েছিল। এর মধ্যে আর রহস্যের কি থাকতে পারে? কিন্তু হঠাৎ একদিন এমন একটা দলিল আবিষ্কৃত হল যাকে অত সহজে ব্যাখ্যা করে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
পিন্টুর বাবা একদিন পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটছিলেন। এমন সময়ে একখানা জীর্ণ কাগজ তাঁর চোখে পড়ল। বাজে কাগজ বলে সেটা যখন ফেলে দিতে যাবেন, হঠাৎ নীচে স্বাক্ষর দেখলেন রামজয় শর্মা। রামজয় শর্মা তাঁর পিতামহ, কাজেই পিন্টুর প্রপিতামহ। কৌতূহলী হয়ে কাগজখানা তুলে নিয়ে পড়লেন যে তাতে লেখা আছে ‘দেওয়াল ঘড়িটা দেখছি বড়োই অদ্ভুত। কোনোদিন থামে না, পরশু সকালে উঠে দেখি তার কাঁটা দুটো অচল হয়ে রয়েছে। ভাবলাম সময়মতো দম দেওয়া হয়নি, তাই এই অবস্থা। তখন তাড়াতাড়ি দম দিলাম, ঘড়ি চলতে আরম্ভ করল। তারপরে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই বাবা হঠাৎ সন্ন্যাস রোগে মারা গেলেন। তখনও মনে কোনো সন্দেহ হয়নি। কিন্তু আবার পাঁচ ছয় বছর পরে হঠাৎ একদিন দেখি ঘড়িটা সন্ধ্যাবেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাবার মৃত্যুর আগে যে বন্ধ হয়েছিল সে কথা তখন মনে হয়নি। কিন্তু তারপরে যখন চব্বিশ ঘণ্টা না যেতেই দাদা তেতলার ছাদ থেকে পা ফসকে পড়ে মারা গেলেন তখন চমকে উঠলাম। একই বাড়িতে কয়েক বছরের মধ্যে দু—জনের মৃত্যু হল আর ঠিক তার চব্বিশ ঘণ্টা আগে দু—দু—বার ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেল এ কী কাকতালীয় না আর কিছু? ভাবছি ঘড়িটা বেচে দেব।’ নীচে নাম স্বাক্ষর রামজয় শর্মা। শোনা যায় যে ঘড়িটা বেচবার তিনি চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু অত্যন্ত পুরোনো বলে কেউ কেনেনি। অগত্যা যেখানকার ঘড়ি সেখানেই রয়ে গেল।
পিন্টুর বাবা এই কাগজপত্র নিয়ে তাঁর ভাইদের দেখালেন। তাঁরা ব্যারিস্টার, দলিল দস্তাবেজ পড়া আর তার ভুল বের করা তাঁদের ব্যবসা। কাজেই ওই কাগজখণ্ডের লেখাগুলোকে আইনের ফাঁকে উড়িয়ে দিলেন। সর্বোপরি বললেন যে ঠাকুরদা মশাইয়ের আফিং খাওয়া অভ্যেস ছিল, তাছাড়া ঠিক সেই সময়ে বঙ্কিমের বঙ্গদর্শনে কমলাকান্তের দপ্তর বেরোচ্ছে। তিনি এক নূতন কমলাকান্ত লিখে গিয়েছেন। স্রেফ গাঁজা। কিন্তু পিন্টুর বাবা আইনজীবী নন। পেশাতে ইস্কুল মাস্টার। তাঁর মন থেকে খটকা দূর হল না। দুই ভাই তাঁকে বোঝালেন—দাদা তোমার মন কুসংস্কারে পূর্ণ, তাই ওইরকম ভাবছ। আচ্ছা এবার আমরা লক্ষ্য রাখলাম, দেখি ঘড়ি ব্যাটা কেমন করে থামে। আর যদি না থামে, তখনই তাকে মেরামত করতে দিয়ে আসব। ব্যাপারটা ওইখানেই মিটে গেল।
হঠাৎ বছরখানেক পরে একদিন দুপুরবেলা দেখা গেল ঘরটা কেমন যেন অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ। তখন পিন্টুর বড়োকাকা বসে সংবাদপত্র পড়ছিলেন, তিনি চমকে তাকিয়ে দেখলেন ঘড়িটা থেমে গিয়েছে। অজ্ঞাতসারে তাঁর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ভাবলেন—এ ব্যাটা থামল কেন? সবে কালকে আমি নিজের হাতে দম দিয়েছি। এখানে বলে রাখা আবশ্যক যে দাদার কুসংস্কারের প্রতিকারার্থে দম দেবার ভার দুই ব্যারিস্টার ভাই স্বহস্তে গ্রহণ করেছিল। তিনি তখনই ঘড়িটা খুলে নিয়ে মোটরে করে ঘড়ি মেরামতি দোকানে গিয়ে দিয়ে এলেন। দাদা সমস্ত শুনে বললেন, ঘড়ি না হয় সরালে, বাড়ির প্রাণীগুলো তো বাড়িতেই থাকল। ছোটো ভাই বলল, দাদা তোমার ওই ইস্কুল মাস্টারি মনোভাব ছাড়ো তো। পরদিন খুব ভোরবেলা গিয়ে ঘড়িটা নিয়ে এলেন। দোকানির সঙ্গে সেইরকম কথাই ছিল। দোকানি মেরামতি বলে কিছু নিল না, বলল বাবু আপনার ঘড়ি ঠিকই ছিল, একটু হাত দিতেই চলতে শুরু করল। ওর জন্য আর কী নেব? তিনি ঘড়ি নিয়ে সগৌরবে বাড়ি ফিরে এসে দেখলেন যে একটা শোরগোল পড়ে গিয়েছে। বাড়ির দু—পুরুষের পোষা বুড়ো কাকাতুয়াটি মারা গিয়েছে। পিন্টুর বাবা বলে উঠলেন, দেখলে তো রসিক, ঘড়ির সতর্কবাণী ঠিক হল কিনা। রসিক অর্থাৎ পিন্টুর বড়োকাকা বললেন, কাকাতুয়াটা কি বাড়ির অধিবাসীদের একজন? আর তাছাড়া ওর যা বয়স হয়েছিল আমাদের প্রতি দয়ামায়া থাকলে ওর আগেই মরা উচিত ছিল। বসে বসে কেবল ছোলা ছাতু ধ্বংস করা। পিন্টুর বাবা বললেন, বল কি রসিক? ও অবশ্যই বাড়ির অধিবাসীদের একজন। আজ দু—পুরুষ এ বাড়িতে আছে, অধিবাসী ছাড়া আর কি? ও বাড়ির মস্ত পাহারা ছিল। অন্য বাড়ির কুকুর, বেড়াল, দুরন্ত ছেলেগুলো এসে উপদ্রব করতে সাহস করত না। যাক, কী আর হবে, বলে তিনি কাকাতুয়াটির সৎকারের ব্যবস্থা করলেন। ঘড়িটা যথাস্থানে সন্নিবেশিত হয়ে আবার টিকটিক করতে লাগল।
ঘড়িটা টিকটিক করতে করতে চলেছে, আর দিন মাস বছরগুলো চলেছে সেই সঙ্গে নিঃশব্দে। এমন বছর কয়েক গেল। পিন্টুর বয়স তখন বছর পনেরো হবে। ঘড়ি সম্বন্ধে সমস্ত কিংবদন্তি সে তখন জানে। মাঠে খেলতে গেলে বন্ধুরা শুধায়, কিরে তোদের ঘড়ি চলছে, না আর কেউ টাসবে তোদের বাড়িতে? সে বলে, ব্যাটার আর থামবার উপায় নেই। বড়োকাকা এমনি দম দিয়েছেন যে চলতেই হবে। বন্ধুরা চাপা গলায় বলে, কিসের দম? গাঁজার না আলুর? শুনতে পেলে পিন্টু বেজায় রাগ করত, হয়তো সেদিন না খেলেই ফিরে আসত।
সেদিনটার কথা তার বেশ মনে পড়ে। পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে, মাথায় নানারকম প্ল্যান, সর্বপ্রথম সিনেমায় যাবে। পরীক্ষার অজুহাতে অনেকদিন সিনেমা দেখা বন্ধ। সকালবেলাতেই টিকিট কিনে এনেছিল। সাড়ে ছ—টায় শো আরম্ভ। দাদা বলে দিয়েছে ঠিক ছ—টায় সময় বেরুবে, এক মিনিট আগে নয়। সে ভিতরে গিয়ে কোনোরকমে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। দাদার হাতঘড়িটা টেবিলের ওপরে ছিল, চেয়ে দেখল তাতে ছ—টা বেজেছে। কোনোরকমে জুতো পায়ে দিয়ে রওয়ানা হবার উদ্দেশ্যে বাইরের ঘরে আসতেই নজর পড়ল দেওয়াল ঘড়িটার দিকে। এ কী! এ যে ছ—টার কাছে এসে কাঁটা থেমে গিয়েছে! কান পেতে শুনল সত্যি থেমে গিয়েছে। না হচ্ছে শব্দ, না নড়ছে কাঁটা। কেমন অজানা ভয়ে তার সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। সে একখানা চেয়ারে বসে পড়ে মূঢ়ের মতো তাকিয়ে রইল ঘড়িটার দিকে। এমন সময়ে তার কাকারা কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরে এসে ঘরে ঢুকলেন। পিন্টুকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে, শুধালেন— কী রে, তোর না সিনেমায় যাওয়ার কথা ছিল? এখনও বসে আছিস। দাদা বাড়িতে না থাকলেই তোকে আর পেরে উঠবার উপায় থাকে না। আসুন দাদা কাশী থেকে ফিরে। তখন একটা রীতিমতো ব্যবস্থা করতে হবে। নে ওঠ এখন, যাবি তো যা।
পিন্টু কিছু না বলে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ঘড়িটা।
ঘড়িটা কাঁটা ছ—টার কাছে অচল দেখে দু—জনে সমস্বরে বলে উঠলেন, তাই তো, ঘড়িটা থেমে গেছে দেখছি। এই বলে তাঁরাও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ঘড়িটার দিকে।
ভোর রাতে টেলিগ্রাম এল পিন্টুর মা সন্ধ্যাবেলায় হঠাৎ মারা গিয়েছেন কাশীধামে।
বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা না মিললেও সংস্কার তার দাবি ছাড়ে না, কাজেই বাড়িতে একটা ভয়ের আবহাওয়া কায়েম হয়ে বসল। সবাই যেন ফিসফিস করে কথা বলে, পায়ের শব্দও কম। কিংবা এমনও হতে পারে সবাই আগের মতো কথাবার্তা বলছে এবং চলাফেরা করছে, কেবল মনে হচ্ছে আগের মতো নয়। পিন্টুর বড়ো কাকা রসিক দাদা কাশী থেকে ফিরে এলে তাকে বলল, দাদা এই অলক্ষুণে ঘড়িটা বিদেয় করে দিই। তিনি সংক্ষেপে বললেন, মন্দ নয়।
রসিক পরদিন গিয়ে ঘড়িটা এক পুরোনো ঘড়ির দোকানে দিয়ে এল। বলল, যা হয় কিছু দাম দিয়ে এটা নিয়ে নিন।
দোকানি বলল, এসব পুরোনো ঘড়ি আজকাল কেউ কিনতে চায় না, তবে রেখে দিচ্ছি যদি কেউ নেয় আমাদের কমিশন কেটে নিয়ে দাম আপনাকে দিয়ে আসব।
ঘড়িটা বাড়ি থেকে বিদেয় হতে সকলেরই মন বেশ হালকা হল। ক্রমে আবার সহজ ভাব ফিরে এল বাড়িতে। রসিকের ছোটো ভাই হরিশ আমুদে লোক। সে তো রীতিমতো একটা ঘড়ি বিদায় উৎসবের আয়োজন করল, খাওয়াদাওয়া গান—বাজনার কিছুরই অভাব হল না। মনের ওপর থেকে ওই ঘড়ির ভারটা নেমে গিয়ে সকলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মাঝে মাঝে রসিক গিয়ে খোঁজ করে আসত ঘড়িটা কেউ নিল কিনা। দোকানি প্রত্যেকবার ওই একই কথা বলত, পুরোনো ঘড়ি কেউ নিতে চায় না। তবে বিক্রি হওয়া মাত্র কমিশন বাদে দাম পাবেন। রসিক একবার প্রস্তাব করেছিল তুমিই না হয় কিছু দাম ধরে দিয়ে ঘড়িটা নিয়ে নাও। সে বলল, বাবু, আমরা তো কিনি না, বিক্রি করি। আপনি ব্যস্ত হবেন না, বাড়ি যান।
ঘড়িটা যে এখনও সশরীরে বহাল আছে সেটা ভালো লাগত না পিন্টুদের বাড়ির কারোরই। পিন্টু একদিন সাহস করে বলল, কাকা ওটাকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দাও না, আর তা যদি না পারো আমাকে দাও হাতুড়ি মেরে গুঁড়ো করে দিই, বালাই যাক। বলা বাহুল্য তার কোনো প্রস্তাব কেউ কানে তুলল না।
বছর দুই পরে একদিন সেই ঘড়ির দোকানি রিকশা করে এসে উপস্থিত, কোলের ওপর ঘড়িটা। ঘড়িটা দেখে পিন্টুর বাবা কাকা প্রভৃতি বাড়ির সকলে চমকে উঠল।
রসিক শুধাল, কী হল হে!
দোকানি বলল, ঘড়িটা ফিরিয়ে দিতে এলাম। আজ তিন বছর হয়ে গেল কেউ নিল না, খামাকা জায়গা জুড়ে আছে। তাছাড়া ঘড়িটা বড়োই বেয়াড়া। আজ আনব বলে খুলতে গিয়ে দেখি দশটা বেজে বন্ধ হয়ে আছে। ভাবলাম চালিয়ে নিয়ে যাই। পুরো দম দিলাম, কিন্তু যেখানকার কাঁটা সেখানেই রয়ে গেল। এ ঘড়ি কোন খদ্দেরে নেবে বাবু? আপনাদের জিনিস আপনারাই রাখুন—এই বলে সে ঘড়িটা ফরাশের ওপরে নামিয়ে দিল।
তখন ঘরের মধ্যে পিন্টুর বাবা আর দুই কাকা ছিল। তারা সব ব্যাপার দেখে পাথর হয়ে গিয়েছিল। দোকানিকে রিকশা ভাড়া দেওয়া বা সময়োচিত দুটো কথা বলা হয়ে উঠল না। দোকানিও ভাড়ার প্রত্যাশা না করে ফিরে রওনা হল। এমন সময়ে হঠাৎ রসিকের সংবিৎ হল। সে শুধাল, ওহে ঘড়িটা যে দশটায় বন্ধ হয়েছে, সেটা দিন দশটা কি রাত দশটা বলতে পার?
লোকটা বলল, সে তো খেয়াল করিনি বাবু। দেওয়ালে কত ঘড়ি ঝুলছে, কোনটার দিকে তাকাব। তবে এটাকে ফিরিয়ে দেব বলে দম দিতে গিয়ে দেখি দশটায় বন্ধ হয়ে আছে। রাত কি দিন কেমন করে জানব। এই বলে সে উত্তরের প্রত্যাশা না করে চলে গেল। তিনজনই সমস্বরে বলে উঠল, রাত দশটা না দিন দশটা।
মুখে না বললেও তিনজনের ভাবনাই এক সূত্রে চলছিল। রাত দশটা হলে আর ঘণ্টা দশেক সময় আছে, দিন দশটা হলে কিছু বেশি। সেদিন রবিবার ছিল, আপিস আদালত না থাকায় তিনজনে বসে গল্প করছিল, বেলা তখন বারোটা। তিনজনেরই মনে ওই একই চিন্তা। ঘড়ি থেমে গেলে চব্বিশ ঘণ্টা মাত্র সময় পাওয়া যায়। ঘড়িটা রাতে থেমেছে না দিনে থেমেছে স্থির করতে না পারায় সময়ের মেয়াদও সেই পরিমাণে কমে এসেছে। তিনজনেই মনে মনে ভাবছিল এবারে না জানি কার পালা। ঘড়ির মস্ত কাচে ঢাকা গোলকখানা অন্তর্যামীর তৃতীয় নেত্রের মতো রহস্যময় দৃষ্টিতে তাদের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে রইল। নিস্তব্ধ ঘরে তিনজনের নিশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শোনা যেতে লাগল।
কতক্ষণের মেয়াদ? কার পালা?