মারডালো
একটা সাইকেল তিনজন আরোহী। কলকাতায় অতি ব্যস্ত এক রাজপথ। পিক আওয়ার্স। লগবগ, লগবগ করে চলেছে। আমরা কয়েকজন ছাপোষা আধমরা বাঙালি পেছনে আসছি শেয়ার ট্যাকসিতে, টিনে-ঠাসা সার্ডিন মাছের মতো। এক সহযাত্রী বললেন, ‘দেখেছেন মশাই। কাণ্ডটা দেখছেন। যেকোনও মুহূর্তে তিনটেই মায়ের ভোগে চলে যাবে।’
সহযাত্রীদের মধ্যে আর একজন ছিলেন, তাঁর আধুনিক জগতের জ্ঞান আমাদের চেয়েও অনেক বেশি। তিনি বললেন, ‘কিস্যু হবে না মশাই। এরা মায়ের ভোগে যায় না। মায়ের ভোগে পাঠায়। এরা হল মাস্তান! একালের প্রিন্স চামিং।’ ‘আহা! মাস্তান হওয়ার কী কষ্ট! এইভাবে, এই বুঝি মরলুম, এই বুঝি মরলুম, করতে করতে কতদূর হবে কে জানে!’
আমরা সাধারণ মানুষ মনে করি, মাস্তান হওয়া বুঝি খুব সহজ ব্যাপার। মাথায় ঝুমকো চুল, চোয়াড়ে মুখ, ঢোকা চোখ, কোমরে চওড়া বেল্ট , সাদা চুস্ত প্যান্ট, ক্যাটকেটে হলুদ বা লাল জামা, উঁচু হিল জুতো মেরে নিজেকে সাজালেই বুঝি মাস্তান হওয়া যায়। চল বে! হট বে! বললেই বুঝি মাস্তান হওয়া যায়। আজ্ঞে না। মাস্তান হতে গেলে অনেক কিছু করতে হয়।
যেমন? যেমন পাইলট হতে গেলে, আকাশে ওড়ার একটা নির্দিষ্ট ঘন্টার রেকর্ড দেখাতে হয়! ফ্লাইট আওয়ার্স। তবেই সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। ডাক্তার হতে গেলে হাসপাতালে হাউস স্টাফ হয়ে থাকতে হয় বেশ কিছু দিন! সেই রকম স্বীকৃত মাস্তান হতে গেলে, রেকর্ড দেখাতে হয়! চালাকি নাকি। একটা এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এম. এল. এ. যাকে স্যালুট করেন। পুলিশের বড়কর্তা হাতজোড় করেন। শিল্পপতি ভেট পাঠান। কুঁচো ব্যাবসাদার পায়ের কাছে ইঁদুরের মতো চিকচিক করে। এই সন্মান কী এমনি এমনি পাওয়া যায়! কসরত করতে হয়। কুস্তিগির কত কসরত করেন! সেলসম্যানকে প্রতি মাসে একটা ‘সেলস রিটার্ন দেখাতে হয়! মাস্তানকেও সেইরকম কাজ দেখাতে হয়। ইন্টার ন্যাশন্যাল মাফিয়া স্ট্যান্ডার্ডকে একটু খাটো করে তৈরি হয়েছে দেশীয় স্ট্যান্ডার্ড। সেই স্তরে উঠলে তবেই বলা হবে, আগমার্ক মাস্তান। তখনই তাকে দেওয়া হবে একটি এলাকার শাসনভার। সেকালে ছিল জমিদারি। জমিদারি উচ্ছেদের পর শূন্যতা তো থাকতে পারে না, এসে গেল মাস্তানরাজ। কুমার বাহাদুরের পরই, হাতকাটা নুলো, কানকাটা হুলো, বেঁটে বঙ্কা, গুগলু। আগে ছিল, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, নমস্য। এই পথ ছাড়ো, পথ ছাড়ো, স্যার যাচ্ছেন। দোকানে গেছেন, মালিক টাট থেকে উঠে এসে প্রণাম করছেন। অন্যান্য ক্রেতারা বলছেন, ‘গদাই, স্যারকে আগে ছেড়ে দাও। আগে ছেড়ে দাও! পাড়ায় একজন ঈশান স্কলার আছেন, তাঁর কী খাতির! কী সন্মান! পুরোনো শ্লোক তখনও বেঁচে ছিল—রাজা শুধু স্বদেশেই পূজিত। বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে। গুণের ডেফিনিশন হঠাৎ বদলে গেল। এখন মাস্তান ছাড়া সবাই হরিদাস পাল।
এই ভাবমূর্তি তৈরি করার জন্য মাস্তানদের দুটো জিনিস করতে হয়েছে, অপেক্ষা ও সাধনা। দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্যে অপেক্ষা। তারপর সাধনা। আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যে কঠোর সাধনা ও ত্যাগ! আমরা যে হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছা খুলে গুগলুদাকে হাতজোড় করছি, সে কী অমনি! এর জন্যে গুগলুকে কত স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে একটা করে খুন। সপ্তাতে অন্তত একবার করে পাড়া ওলটপালট! বেপাড়ায় হানা। মাসে অন্তত এক পিপে করে ধান্যেশ্বরী সেবন। সব সময় মুখে যেন মালের গন্ধ লেগে থাকে। তাতে লিভারের বারোটা বাজে বাজুক। গুগলু মরতে ভয় পায় না, মারতেও ভয় পায় না। গুগলুকে সব সময় চমকাতে হয়। খুন ছাড়াও রোজই একজন-না-একজনকে উসকে দিতে হয়। মাস্তান হল একালের সমাজের সার্জেন। সার্জেনের ছুরি যদি ছুটি নিয়ে বাকসোবন্দি হয়ে থাকে তাহলে সার্জেন বলে তাঁকে কেউ মানবে! যাঁর যা কাজ। মাস্তান আসলে ডেন্টিস্ট-কাম-সার্জেন! দাঁত ফেলার দরকার হলে পয়সা খরচ করে ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়ার দরকার কি? গুগলুর ক্যাম্পে গিয়ে বলো, ‘আবে! গুগলু।’ ব্যস, এক ঘুষি থোবনায়। সামনের ছটা খুলে পড়ে গেল! তাছাড়া মাস্তান হলো গুরু। দীক্ষাগুরু মহাপুরুষকে বলা হয়, ভবরোগ বৈদ্যম! ভবরোগ হরণ করেন। মাস্তানও সেইরকম মেজাজে থাকলে ভাগ্যবানকে মায়ের ভোগে পাঠিয়ে ভবরোগ হরণ করে। বেঁচে থাকার বিশ্রী যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়। মাস্তান শাস্ত্রসম্মত মহাপুরুষ। কেন? ভোগী রাতে ঘুমোয়। যোগী জাগেন রাতে। মাস্তান রাতে ঘুমোয় না। যোগী। তিনি জলযোগ করেন। সেবার কাছে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। নানারকম সেবা। কারণ সেবা, নারীসেবা, সমাজসেবা। সেবাই তাঁর ধর্ম। শাস্ত্র বলেন, বহতা নদী, রমতা সাধু। মাস্তান রমতা সাধু; এক জায়গায় বেশি দিন থাকার উপায় যাতে না থাকে, সে ব্যবস্থা তিনি নিজের জীবনসাধনায় করে ফেলেন। মাঝে-মাঝে তাঁকে নির্জন সাধনার জন্যে, আত্মবিশ্বাস জাগাবার জন্যে চারদেওয়ালের অন্তরালে, জেলে যেতে হয়। ফিরে আসেন নতুন শক্তি ও পরিকল্পনা নিয়ে। তাঁর ভাবমূর্তি তখন আরও উজ্জ্বল হয়। আগে আমরা সসম্ভ্রমে বলতুম বিলেতফেরত সার্জেন। চাকরির দরখাস্তে লিখতুম, সেভনইয়ারস একসপিরিয়েন্স। সেই রকম যে যতবার জেল খেটে আসবে সে তত বড়, তত মাননীয় মাস্তান।
থিওরি নিয়ে পলিটিসিয়ান হওয়া যায়। মাস্তানদের জীবন হল প্র্যাকটিক্যাল। একমাত্র মাস্তানরাই বলতে পারে, আমার জীবনই আমার বাণী। এরা পুরোপুরি বৈদান্তিক। এদের চোখে মানুষের জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। গীতার কৃষ্ণ যেমন বলেছেন, ন জায়তে ম্রিয়তে বা কশ্চিৎ। সবই হল দৃষ্টিবিভ্রম। সমাজে এদের পুণ্য আবির্ভাবের ফলেই আজ শঙ্করাচার্য সত্য—জীবন যে পদ্মপত্রে জলের মতো টলটলে, তা আমরা বুঝতে শিখেছি—নলিনীদলগত জলমিব তরলং। এই আছি এই নেই আর কি! মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের ঠুনকো সব সেন্টিমেন্ট, প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, কর্তব্য, আদর্শ—এই সব থার্ডক্লাস আবর্জনা এদের স্টেনলেস, সুপারক্রোম হৃদয়কে আক্রমণ করতে পারেনি। কে মরল, কোন পরিবার পথে বসল, ভাবার দরকার নেই। বিশ্বরূপ দর্শনের পর অর্জুন যেন আবার ফিরে এলেন। গোটা পাড়াটাকে কুরুক্ষেত্র বানাবার জন্যে। কৃষ্ণ অ্যাতোখানি একটা হাঁ বের করে অজুর্নকে বলেছিলেন, এই দ্যাখো সখা পানমশলার মতো আমি জীবজগৎকে অষ্টপ্রহর চিবিয়ে যাচ্ছি। আর মাঝে মাঝে টুথপিক দিয়ে দাঁত খুঁচিয়ে টুকরো টাকরা সব বের করে দিচ্ছি। যে কারণে পানমশালা এককালের ক্রোড়পতি ব্যবসাদার আর চিত্রপ্রযোজক পরিচালকদের এত প্রিয়। শ্রীকৃষ্ণের মুখনি:সৃত, চর্বিত জীবন -পাক। যে কারণে তেলে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, ব্রিজে ভেজাল, বাড়ি তৈরির মশলা, রান্নার মশলা, সবেতেই ভেজাল। আর সিনেমা! টাইটেলে, মঙ্গল ভবন, অমঙ্গল করেই, সাড়ে তিনঘন্টা ধরে, এই ধিনিক ধিনিক ধুমসি নাচ তো, পর মুহূর্তেই ঢিসুম ঢিসুম। আজকাল জজসায়েবের এজলাসেই মার্ডার। বনের বেদান্ত ঘরে। সমাজকো বদল ডালোর বদলে মারডালো। দুনিয়াটা হল সেলসম্যানের দুনিয়া। কোটা ফুলফিল। এক মাস্তানের কোটা ওয়ানডাউন যাচ্ছিল। হঠাৎ দম করে পাড়ার একটা কুকুর মেরে ফেললে। কী ব্যাপার! কুকুর তো মানুষই, কেবল ভাষাটা নেই! কোটা ফুলফিল হয়ে গেল।