মায়া – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
দু’বছর আগের কথা বলি৷ এখনো অল্প অল্প যেন মনে পড়ে৷ সব ভুল হয়ে যায়৷ কি করে এলাম এখানে! বগুলা থেকে রাস্তা চলে গেল সিঁদরানির দিকে৷ চলি সেই রাস্তা ধরেই৷ রাঁধুনী বামুনের চাকরিটুকু ছিল অনেক দিনের, আজ তা গেল৷
যাক, তাতে কোনো দুঃখু নেই৷ দুঃখু এই, অবিচারে চাকরিটা গেল৷ ঘি চুরি আমি করিনি, কে করেচে আমি জানিও না, অথচ বাবুদের বিচারে আমি দোষী সাব্যস্ত হলাম৷ শান্তিপাড়া, সর্ষে, বেজেরডাঙা পার হতে বেলা দুপুর ঘুরে গেল৷ খিদেও বেশ পেয়েচে৷ জোয়ান বয়স, হাতে সামান্য কিছু পয়সা থাকলেও খাবার-দোকান এ পর্যন্ত এ-সব অজ পাড়াগাঁয়ে চোখে পড়ল না৷
রাস্তার এক জায়গায় ভারি চমৎকার একটা পুকুর৷ স্নান করতে আমি চিরকালই ভালোবাসি৷ পুকুরের ভাঙা ঘাটে কাপড় নামিয়ে রেখে জলে নামলাম৷ জলে অনেক পানা শেওলা, সেগুলো সরিয়ে পরিষ্কার জলে প্রাণভরে ডুব দিলাম৷ বৈশাখের শেষ, গরমও বেশ পড়েচে, স্নান করে সত্যি ভারি তৃপ্তি হল৷ পুকুরের ধারে একটা তেঁতুলগাছের ডালে ভিজেকাপড় রোদে দিলাম৷ শরীর ঠাণ্ডা হল কিন্তু পেট সমানে জ্বলচে৷ এ সময়ে কোনো বনের ফল নেই? চোখে তো পড়ে না, যেদিকে চাই৷
এমন সময় একজন বুড়ো লোক পুকুরটাতে নাইতে আসচে দেখা গেল৷ আমাকে দেখে বল্লে—বাড়ি কোথায়?
আমি বল্লাম—আমি গরিব ব্রাহ্মণ, চাকরি খুঁজে বেড়াচ্চি৷ আপাতত বড় খিদে পেয়েচে, খাব কোথায়, আপনি কি সন্ধান দিতে পারেন?
বুড়ো লোকটি বল্লে—রোসো, নেয়ে নি—সব ঠিক করে দিচ্চি৷
স্নান সেরে উঠে লোকটি আমাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের মধ্যে ঢুকে জঙ্গলে ঘেরা একটা পুরোনো বাড়িতে ঢুকলো৷ বল্লে—আমার নাম নিবারণ চক্রবর্তী৷ এ বাড়ি আমার, কিন্তু আমি এখানে থাকিনে৷ কলকাতায় আমার ছেলেরা ব্যবসা করে, শ্যামবাজারে ওদের বাসা৷ এত বড় বাড়ি পড়ে আছে আর সেখানে মাত্র তিনখানা ঘরে আমরা থাকি৷ কি কষ্ট বলো দিকি! আমি মাসে মাসে একবার আসি, বাড়ি দেখাশুনো করি৷ ছেলেরা ম্যালেরিয়ার ভয়ে আসতে চায় না৷ মস্ত বড় বাগান আছে বাড়ির পেছনে৷ তাতে সব-রকম ফলের গাছ আছে—বারো ভূতে খায়৷ তুমি এখানে থাকবে?
বল্লাম—থাকতে পারি৷
—কি কাজ করতে?
—রাঁধুনীর কাজ৷
—যে ক’দিন এখানে আছি, সে ক’দিন এখানে রাঁধো, দুজনে খাই৷
—খুব ভালো৷
আমি রাজী হয়ে যেতে লোকটা হঠাৎ যেন ভারী খুশি হল৷ আমার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলে তখনি৷ খাওয়া-দাওয়ার পরে আমাকে একটা পুরোনো মাদুর আর একটা মোটা তাকিয়া বালিশ দিয়ে বল্লে—বিশ্রাম করো৷
পথ হেঁটে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম৷ ঘুমিয়ে যখন উঠলাম, বেলা তখন নেই৷ রাঙা রোদ বড় বড় গাছপালার উঁচু ডালে৷ এরি মধ্যে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে শেয়ালের ডাক শুরু হল৷ আমি বাড়ির বাইরে গিয়ে এদিক-ওদিক খানিকটা ঘুরে বেড়ালাম৷ যেদিকে চাই, সেদিকেই পুরোনো আম-কাঁঠালের বন আর জঙ্গল৷ কোনো লোকের বাড়ি নজরে পড়লো না৷ জঙ্গলের মধ্যে একস্থানে কেবল একটা ভাঙা দেউল দেখতে পেলাম৷ তার মধ্যে উঁকি মেরে দেখি, শুধু চামচিকের আড্ডা৷
ফিরে এসে দেখি, বুড়ো নিবারণ চক্কত্তি বসে তামাক খাচ্চে৷ আমায় বল্লে—চা করতে জানো? একটু চা করো৷ চিঁড়ে ভাজো৷ তেল-নুন মেখে কাঁচালঙ্কা দিয়ে খাওয়া যাবে৷
সন্ধ্যার পর বল্লে—ভাত চড়িয়ে দাও৷ সরু আতপ আছে, গাওয়া ঘি আছে, আলুভাতে ভাত,—ব্যস!
—যে আজ্ঞে৷
—তোমার জন্যে ঝিঙের একটা তরকারি করে নিয়ো৷ ঝিঙে আছে রান্নাঘরের পেছনে৷ আলো হাতে নিয়ে তুলে আনো এইবেলা৷ আর একটা কথা—রান্নাঘরে সর্বদা আলো জ্বেলে রাখবে৷
—তা তো রাখতেই হবে, অন্ধকারে কি রান্না করা যায়?
—হ্যাঁ, তাই বলচি৷
মস্ত বড় বাড়ি৷ ওপরে নীচে বোধ হয় চোদ্দ-পনেরোখানা ঘর৷ এছাড়া টানা বারান্দা৷ দু-চারখানা ছাড়া অন্য সব ঘরে তালা দেওয়া৷ রান্নাঘরের সামনে মস্ত বড় লম্বা রোয়াক, রোয়াকের ও-মুড়োয় চার-পাঁচটা নারকোল গাছ আর একটা বাতাবি লেবুর গাছ৷ ঝিঙে তুলতে হোলে এই লম্বা রোয়াকের ও-মুড়োয় গিয়ে আমায় উঠোনে নামতে হবে, তারপর ঘুরে রান্নাঘরের পেছনদিকে যেতে হবে৷ তখনো সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়নি, আলোর দরকার নেই ভেবে আমি এমনি শুধু হাতেই ঝিঙে তুলতে গেলাম৷
বাবাঃ, কি আগাছার জঙ্গল রান্নাঘরের পেছনে! বুনো ঝিঙে গাছ, যাকে এঁটো গাছ বলে৷ অর্থাৎ এমনি বীজ পড়ে যে গাছ হয় তাই৷ অনেক ঝিঙে ফলেচে দেখে বেছে বেছে কচি ঝিঙে তুলতে লাগলাম৷ হঠাৎ আমার চোখে পড়লো, একটি বউ-মতো কে মেয়েছেলে আমার সামনাসামনি হাতদশেক দূরে ঝোপের মধ্যে নীচু হয়ে আধঘোমটা দিয়ে আমারই মতো ঝিঙে তুলচে৷ দুবার আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তারপর পেছন ফিরে সাত-আটটা কচি ঝিঙে তুলে নিয়ে চলে আসবার সময় আর একবার চেয়ে দেখলাম৷ দেখি, বউটি তখনো ঝিঙে তুলচে৷
নিবারণ চক্কত্তি বল্লে—ঝিঙে পেলে?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, অনেক ঝিঙে হয়ে আছে৷ আরো একজন কে তুলছিল৷
নিবারণ বিস্ময়ের সুরে বল্লে—কোথায়?
—ওই রান্নাঘরের পেছনে৷ বেশি জঙ্গলের দিকে৷
—পুরুষমানুষ?
—না, একটি বউ৷
নিবারণ চক্কত্তির মুখ কেমন হয়ে গেল৷ বল্লে—কোথায় বউ? চলো দিকি দেখি!
আমি ওকে সঙ্গে করে রান্নাঘরের পেছনে দেখতে গিয়ে দেখি, কিছুই না৷
নিবারণ বল্লে—কৈ বউ?
—ওই তো ওখানে ছিল, ওই ঝোপটার কাছে৷
—হুঁ:, যত সব! চলো, চলো৷ দিনদুপুরে বউ দেখলে অমনি!
আমি একটু আশ্চর্য হলাম৷ যদি একজন পাড়াগাঁয়ের বউ-ঝি দুটো জংলী ঝিঙে তুলতে এসেই থাকে, তবে তাতে খাপ্পা হবার কি আছে ভেবে পাই নে৷ তাছাড়া আজ না হয় উনি এখানে আছেন, কাল যখন কলকাতায় চলে যাবেন, তখন বুনো ঝিঙে কে চৌকি দেবে?
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর চক্কত্তি-বুড়ো আবার সেই ঝিঙে-চুরির কথা তুললে৷ বল্লে—আলো নিয়ে যাওনি কেন ঝিঙে তুলতে? তোমায় আমি আলো হাতে নিয়ে যেতে বলেছিলাম, মনে আছে? কেন তা যাওনি?
আমি বুঝলাম না কি তাতে দোষ হল! বুড়োটা খিটখিটে ধরনের৷ বিনা আলোতে যখন সব আমি দেখতে পাচ্ছি, এমন কি ঝিঙে-চুরি-করা বউকে পর্যন্ত—তখন আলো না নিয়ে গিয়ে দোষ করেচি কি?
বুড়ো বল্লে—না না, সন্ধ্যার পর সর্বদা আলো কাছে রাখবে৷
—কেন?
—তাই বলচি৷ তোমার বয়স কত?
—সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ হবে৷
—অনেক কম বয়স আমাদের চেয়ে৷ আমার এই তেষট্টি৷ যা বলি কান পেতে শুনো৷
—আজ্ঞে নিশ্চয়!
রাত্রে শুয়ে আছি, ওপরের ঘরে কিসের যেন ঘটঘট শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল৷ জিনিসপত্র টানাটানির শব্দ৷ কে বা কারা যেন বাক্স-বিছানা এখান থেকে ওখানে সরাচ্চে৷ ভারী জিনিস সরাচ্চে৷ বুড়ো কাল সকালে চলে যাবে কলকাতায়, তাই বোধ হয় জিনিসপত্র গোছাচ্ছে৷ কিন্তু এত রাত্তিরে?
বাবাঃ, কি বাতিকগ্রস্ত মানুষ!
সকালে উঠে বুড়োকে বলতেই বুড়ো অবাক হয়ে বল্লে—আমি?
—হ্যাঁ, অনেক রাতে৷
—ও! হ্যাঁ—না—হুঁ—ঠিক৷
—আমাকে বল্লেই হোত আমি গুছিয়ে দিতাম!
চক্কত্তি-বুড়ো আর কিছু না বলে চুপ করে গেল৷ বেলা নটার মধ্যে আমি ডাল-ভাত আর ঝিঙে ভাজা রান্না করলাম৷ খেয়ে-দেয়ে পোঁটলা বেঁধে সে রওনা হল কলকাতায়৷ যাবার সময় বার বার বলে গেল—নিজের ঘরের লোকের মতো থেকো ঠাকুর৷ পেয়ারা আছে, আম-কাঁঠাল আছে, উৎকৃষ্ট পেঁপে আছে, তরিতরকারি পোঁতো, আমার খাস-জমি পড়ে আছে তিন বিঘে৷ ভদ্রাসন হল দেড় বিঘের ওপর৷ লোক-অভাবে জঙ্গল হয়ে পড়ে আছে৷ খাটো, তরকারি উৎপন্ন করো, খাও, বেচো—তোমার নিজের বাড়ি ভাববে৷ দেখাশুনো করো, থাকো৷ ভাবনা নেই৷ আর একটা কথা—
—কি?
চক্কত্তি-বুড়ো অকারণে সুর খাটো করে বল্লে—কত লোকে ভাঙচি দেবে৷ কারো কথা শুনো না যেন৷ বাড়ি দেখাশুনো যেমন করবে, নিজের মতো থাকবে, কোনো কথায় কান দেবে না, গাছের ফল-ফুলুরি তুমিই খাবে৷ দুটো ঘর খোলা রইলো তোমার জন্যে৷
বুড়ো চলে গেল৷ আমাকে যেন আকাশে তুলে দিয়ে গেল৷ আরে, এত বড় বাড়ির বড় বড় দুখানা ঘর আমার ব্যবহারের জন্য রয়েচে—তাছাড়া বারান্দা, রান্নাঘর, রোয়াক তো আছেই৷ বাড়িতে পাতকুয়ো, জলের কষ্ট নেই৷ শুকনো কাঠ যথেষ্ট, কাঠের কষ্ট নেই৷ দশটা টাকা আগাম দিয়ে গিয়েচে বুড়ো, প্রায় আধ-মণটাক সরু আতপ চালও আছে৷ গাছ-ভরা আম-কঁঠাল৷ এ যেন ভগবানের দান আকাশ থেকে পড়ল হঠাৎ৷
বিকেলের দিকে তেল-নুন কিনব বলে মুদির দোকান খুঁজতে বেরুলাম৷ বাপ রে, কি বন-জঙ্গল গাঁখানার ভেতরে! আর এদের যেখানে বাড়ি, তার সীমানায় কি কোনো লোকালয় নেই? জঙ্গল ভেঙে সুঁড়িপথ ধরে আধ মাইল যাবার পর একজন লোকের সঙ্গে দেখা হল৷ সেও তেল কিনতে যাচ্ছে, হাতে তেলের ভাঁড়৷ আমায় দেখে বল্লে—বাড়ি কোথায়?
—এখানে আছি নিবারণ চক্কত্তির বাড়ি৷
—নিবারণ চক্কত্তি? কেন?
—দেখাশুনো করি৷ কাল এসেচি৷
—ও বাড়িতে থাকতে পারবে না৷
—কেন?
—এই বলে দিলাম৷ দেখে নিয়ো৷ কত লোক ও বাড়িতে এল গেল৷ ওরা নিজেরাই থাকতে পারে না, তা অন্য লোক! ও-বাড়ির ছেলে-বউয়েরা কস্মিনকালে ও-বাড়িতে আসে না—
—কেন?
—তা কি জানি! ও বড় ভয়ানক বাড়ি৷ তুমি বিদেশী লোক, খুব সাবধান৷
আর কিছু না বলে লোকটা চলে গেল৷ আমি দোকান খুঁজে জিনিস কিনে বাড়ি ফিরলাম৷ তখন বিকেল গড়িয়ে গিয়ে সন্ধ্যা নামচে৷ দূর থেকে জঙ্গলের মধ্যেকার পুরোনো উঁচু দোতলা বাড়িখানা দেখে আমার বুকের ভেতরটা ছাঁৎ করে উঠল৷ সত্যি, বাড়িখানার চেহারা কি রকম যেন! ও যেন একটা জীবন্ত জীব, আমার মতো ক্ষুদ্র লোককে যেন গিলে ফেলবার জন্য হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসচে৷ অমনতর ওর চেহারা কেন?
কিছু না৷ লোকটা আমার মন খারাপ করার জন্য দায়ী৷ আমি যখন তেল-নুন কিনতে যাই তখন আমার মনে দিব্যি ফুর্তি ছিল—হঠাৎ এমন হওয়ার কারণ হচ্ছে ওই লোকটার ভয় দেখানো কথাবার্তা৷ গায়ে পড়ে অত হিত করবার দরকার কি ছিল বাপু তোমার? চক্কত্তি-বুড়ো তো বলেই গিয়েছে, কত লোক কত কথা বলবে, কারো কথায় কান দিয়ো না৷
কিছু না, গাছপালার ফল-ফুলুরি গাঁয়ের লোক চুরি করে খায় কিনা৷ বাড়িতে একজন পাহারাদার বসালে লুঠপাট করে খাওয়ার ব্যাঘাত হয়, সেইজন্যেই ভয় দেখানো৷ যেমন ওই বউটি কাল সন্ধ্যাবেলা ঝিঙে চুরি করছিলো৷
অনেকদিন এমন আরামে থাকিনি৷ বিনা-খাটুনিতে পয়সা রোজগারের এমন সুযোগ জীবনে কখনো ঘটেনি৷ নিজের জন্য শুধু দুটো রান্না—মিটে গেল কাজ! সকাল সকাল রান্না সেরে নিয়ে নীচের বড় রোয়াকে বসে আপনমনে গান গাইতে লাগলাম৷ এত বড় বাড়ির আমিই মালিক৷ কারো কিছু বলবার নেই আমাকে৷ যা খুশি করব৷
হঠাৎ ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গেলাম৷ দোতলার নালির মুখ দিয়ে পড়তে লাগলো জল, যেমন ওপরের বারান্দাতে কেউ হাত-পা ধুলে জল পড়ে—বেশ মোটা ধারে জল পড়তে লাগলো৷ তখনি আমি উঠে রোয়াকের ধারে দাঁড়িয়ে দোতলার বারান্দার দিকে চেয়ে দেখলাম৷ তখনো জল পড়চে—সমানে মোটা ধারায়৷ ওপরের সিঁড়ির দরজায় তালা দেওয়া৷ চাবি চক্কত্তিমশায় নিয়ে গিয়েচেন, সুতরাং দোতলায় যাবার কোনো উপায় আমার নেই৷ এ জল কোথা থেকে পড়চে?
মিনিট দশেক পড়ার পর জলের ধারা বন্ধ হয়ে গেল৷ আমার মনে হল, চক্কত্তিমশায় বোধ হয় কোনো কলসী বা ঘড়াতে জল রেখে গিয়েছিলেন ওপরের বারান্দাতে, সেই কলসী কি-ভাবে উল্টে পড়ে গিয়ে থাকবে৷ নিশ্চয় তাই৷ তা ছাড়া জল আসবে কোথা থেকে?
একটু পরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম৷ আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে ঘুম জড়িয়ে এল৷ অনেক রাত্রে একবার ঘুম ভেঙে গেল, জানলা দিয়ে সুন্দর জ্যোৎস্না এসে পড়েচে বিছানায়৷ কি একটা ফুলের গন্ধও আসচে৷ বেশ সুবাস ফুলের৷
কি ফুল?
ঘুমের ঘোরেই ভাবচি, এমন কোনো সুগন্ধওয়ালা ফুল তো বাড়ির কাছাকাছি দেখিনি!
তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম৷ ও কি! জানলার সামনে দিয়ে একটি বউ চলে গেল রোয়াক বেয়ে৷ হ্যাঁ স্পষ্ট দেখেচি—ভুল হবার নয়৷ আমি তখুনি উঠে দরজা খুলে রোয়াকে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ রোয়াকে দাঁড়াতে দুটো জিনিস আমার কাছে স্পষ্ট হল৷ প্রথম সেই ফুলের সুবাসটা রোয়াকে অনেকখানি ঘন, ঐ বউটি যেন এই সুবাস ছড়িয়ে দিয়ে গেল এই কতক্ষণ! না, কোনো ফুলের সুবাস নয়৷ এ কিসের সুবাস, তা আমার মাথায় আসচে না৷
কেমন একরকম যেন লাগচে! একরকম নেশার মতো! কেন আমি বাইরে এসেচি? ও! কে একটি বউ রোয়াক বেয়ে খানিক আগে চলে গিয়েছিল—সে-ই ছড়িয়ে গিয়েচে এই তীব্র সুবাস৷ কিন্তু কোনো দিকে নেই তো সে! গেল কোথায়?
সে-রাত্রে সেই পর্যন্ত৷ কতক্ষণ পরে ঘরে এসে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম৷ সকালে উঠে মনে হল, সব স্বপ্ন৷ মনটা বেশ হালকা হয়ে গেল৷ কাজ-কর্মে ভালো করে মন দিলাম৷ বনজঙ্গল কেটে কিভাবে তরি-তরকারির আবাদ করব, সেই আলোচনা করতে লাগলাম মনের মধ্যে৷
একটা অসুবিধে এখানে থাকবার—বড্ড নির্জনে থাকতে হয়৷ কাছাকাছি যদি একঘর লোকও থাকত, তবে এ কষ্ট হোত না—কথা বলবার একটা লোক নেই, এই হল মহাকষ্ট৷
সেদিন দুপুরে এক ঘটনা ঘটলো৷
আমি ভাত নামিয়ে হাঁড়ি রাখতে যাচ্ছি, এমন সময় দোতলার বারান্দাতে অনেক লোক যেন একসঙ্গে হেসে উঠল৷ সে কি ভীষণ অট্টহাসি! আমার গা যেন দোল দিয়ে উঠল সে হাসি শুনে৷ খিলখিল করে হাসি নয়—খলখল করে হাসি৷ আকাশ-বাতাস থমথমিয়ে উঠল সে হাসির শব্দে৷
ভাত ফেলে রেখে দৌড়ে গেলাম৷ রোয়াকে গিয়ে ওপরের দিকে দেখি, কিছুই না৷ নিচের জানলা যেমন বন্ধ, ওপরের ঘরে সারবন্দি জানলা তেমনি বন্ধ৷ হাসির লহর তখন থেমে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েচে৷
ব্যাপার কি? কোনো বদমাইশ লোকের দল ওপরে আড্ডা বেঁধেছে? ওপরের সিঁড়ির মুখে গিয়ে দেখি দরজায় তেমনি কুলুপ ঝুলচে৷
আমার ভয় হয়নি৷ কেননা দিনমান, চারিদিকে সূর্যের আলো৷ এ সময়ে মনের মধ্যে কোনো ভূতের সংস্কার থাকে না৷ এই হাসিই যদি আমি রাত্রে শুনতাম, তবে বোধ হয় ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতাম, চাবি দিয়ে দাঁত খুলতে হোত৷
রান্নাঘরে ফিরে এসে ভাতের ফেন গেলে ঝিঙের তরকারি চাপিয়ে দিই৷ প্রচুর ঝিঙে জঙ্গলে ফলেচে, যত ইচ্ছে তুলে নিয়ে যাও৷ আমারই বাড়ি, আমারই ঝিঙে-লতা৷ মালিক হওয়ার এ একটা মাদকতা আছে, তা কাল থেকে বুঝচি৷ আমার মতো গরিব বামুনের জীবনে এমন জিনিস এই প্রথম৷
কান পেতে রইলাম ওপরের ঘরের কোনো শব্দ আসে কিনা শুনতে৷ ছুঁচ পড়বার শব্দও পেলাম না৷ খেয়েদেয়ে নিজের মনে বিছানায় গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েচি—ঘুমের ঘোরে শুনচি, ঘরের মধ্যে অনেক লোক কথাবার্তা বলচে, হাসচে৷ ঘুমের মধ্যেও আমি ওদের কথাবার্তা যেন শুনচি, যেমন কোনো বিয়েবাড়িতে ঘর-ভর্তি লোকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লে লোকজনের গলার শব্দ ঘুমের মধ্যেও পাওয়া যায়! হয়তো সবটাই আমার মনের ভুল৷ মনের সেই যে ভাব হয়েছিল হাসি শুনে, তারই ফল৷
এরপর ন’দিন আর কোনো কিছু ঘটেনি৷
মানুষের মনের অভ্যাস, অপ্রীতিকর জিনিসগুলো তাড়াতাড়ি দিব্যি ভুলে যেতে চায়, পারেও ভুলে যেতে৷ আমি নিজের মনকে বোঝালুম, ওসব কিছু না, কি শুনতে কি শুনেচি, বউ দেখা চোখের ভুল, হাসি শোনাও কানের ভুল৷ সব ভুল৷
এ ন’দিনে আমার শরীর বেশ সেরে উঠলো৷ খাই-দাই আর শুধু ঘুমুই৷ কাজকর্ম কিছু নেই—কেমন একরকমের কুঁড়েমি পেয়ে বসেছে আমাকে৷ আমি সাধারণত খুব খাটিয়ে লোক, শুয়ে বসে থাকতে ভালোবাসিনে—কিন্তু অনেকদিন ধরে অতিরিক্ত খাটুনির ফলে কেমন একরকমের অবসাদ এসে গিয়েছে, শুধুই আরাম করতে ইচ্ছা হয়৷
ন’দিনের দিন বিকেলে মনে হল রান্নাঘরের পেছনে সেই ঝিঙের জঙ্গলটা কেটে একটু পরিষ্কার করি, ঝিঙের লতাগুলো বাঁচিয়ে অবশ্য৷ ওখানে ঝালের চারা পুঁতব, আর একটা চালকুমড়োর এঁটো লতা হয়েচে ওই জঙ্গলের মধ্যে, সেটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে রান্নাঘরের ছাদে উঠিয়ে দেব৷ এ বাড়িতে কাজ করে সুখ আছে কারণ দা, কোদাল, কাস্তে, নিড়েন, শাবল, কুড়ুল সব মজুত আছে—ঘরের কোণে একটা হাত-করাত ইস্তক৷
অল্পক্ষণ মাত্র কাজ করেচি—আধ ঘণ্টাও হবে না৷
হঠাৎ দেখি, সেই বউটি ঝিঙে তুলতে এসেচে৷ নীচু হয়ে ঝোপের মধ্যে ঝিঙে তুলচে৷
সঙ্গে সঙ্গে দোতলার ঘরগুলোর মধ্যে এক মহা-কলরব উপস্থিত হল৷ অনেকগুলো লোক—আন্দাজ জনপঞ্চাশেক, একসঙ্গে যেন হই-হই করে উঠল—সব দরজা জানলা যেন একটা ঝড়ের ঝাপটা লেগে একসঙ্গে খুলে গেল৷
বন কাটা ফেলে আমি ওপরদিকে চেয়ে দেখলাম৷ সামনের রোয়াকে এসে দাঁড়ালাম—কৈ, একটা দরজা-জানলার কপাটও খোলেনি দোতলায়! যেমন তেমনি আছে!
ব্যাপার কি? বাড়িটার মৃগী রোগ আছে নাকি? মাঝে মাঝে এমন বিকট চিৎকার ওঠে কেন? এবার তো ভুল হবার কোনো কথা নয়—সম্পূর্ণ সুস্থ মনে কাজ করতে করতে এ চিৎকার আমি শুনেচি এইমাত্র৷ এখন আবার চারিদিক নিঃশব্দ, কোনো দিকে কোনো শব্দ নেই৷
সেই বউটি আবার ঝিঙে তুলতে এসেচে এই গোলমালের মধ্যে! দৌড়ে গেলাম রান্নাঘরের পেছনে৷ সেখানেও কেউ নেই৷
সেদিন রাত্রে এক ঘটনা ঘটলো৷ ভারি মজার ঘটনা বটে৷
খেয়েদেয়ে সবে শুয়েচি, সামান্য তন্দ্রা এসেচে—এমন সময় কিসের শব্দে তন্দ্রা ছুটে গেল৷ চেয়ে দেখি, আমার বিছানার চারিপাশে অনেক লোক জড়ো হয়েচে—তাদের সবারই মাথায় লাল পাগড়ি, হাতে ছোট ছোট লাঠি—আশ্চর্যের বিষয়, সকলেরই মুখ দেখতে একরকম৷ একই লোক যেন পঞ্চাশটি হয়েচে, এইরকম মনে হয় প্রথমটা৷ বহু আরশিতে যেন একটা মুখই দেখচি৷
কে যেন বলে উঠল—আমাদের মধ্যে আজ কে যেন এসেচে!
একজন তার উত্তর দিলে—এখানে একজন পৃথিবীর লোকের বাড়ি আছে অনেক দিন থেকে৷ আমি দেখিনি বাড়িটা, তবে শুনেচি৷ যারা দেখতে জানে, তারা বলে, সেই বাড়ির মধ্যে একটা লোক রয়েচে৷
—সব মিথ্যে৷ কোথায় বাড়ি?
—আমরা কেউ দেখিনি৷
—তবে এসো, আমরা নাচ আরম্ভ করি৷
বাপ রে বাপ! কথায় বলে ভূতের নেত্য! শুনেই এসেছিলাম এতদিন, এইবার স্বচক্ষে দেখলাম৷ সে কি কাণ্ড! অতগুলো লোক একসঙ্গে লাঠি বাজিয়ে এক তাণ্ডব নৃত্য শুরু করে দিলে, আমার দেহের মধ্যে দিয়ে কতবার যে এল গেল! তার সঙ্গে সঙ্গে বিকট চিৎকার আর হল্লা!
আমার বিছানার বা আমার কোনো অংশ তারা স্পর্শ করলো না৷ আমি যে সেখানে আছি, তাও যেন তারা জানে না৷ ওদের হুঙ্কার আর ভৈরব নৃত্যে আমি জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলাম৷
যখন জ্ঞান হল, তখন শেষ-রাত্রের জ্যোৎস্না খোলা জানলা দিয়ে এসে বিছানায় পড়েচে৷ সেই ফুলের অতি মৃদু সুবাস ঘরের ঠাণ্ডা বাতাসে৷ আমি আধ-অচেতন ভাবে জানলার বাইরে জ্যোৎস্নামাখা গাছপালার দিকে চেয়ে রইলাম৷
কতক্ষণ পরে জানি না, ভোর হয়ে গেল৷
বিছানা ছেড়ে উঠে দেখি, ঘুমের কোনো ব্যাঘাত হয়নি৷ সুনিদ্রা হোলে শরীর যেমন ঝরঝরে আর সুস্থ হয়, তেমনি বোধ করচি৷
তবে সে ভূতের নাচ কে দেখেছিল? সে নাচ কি তবে ভুল? খেয়েদেয়ে পরম আরামে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখেচি?
তাই যদি হয়, তবে এই শেষ-রাত্রের ঠাণ্ডা বাতাসে যে ফুলের সুবাস পেয়েচি, তা কোথা থেকে এল? সেই বউটি যখন চলাফেরা করে তখনি অমন সুবাস ছড়ায় বাতাসে৷ সুবাসটা ভুল হতে পারে না৷ এখনো সে-গন্ধ আমার নাকে লেগে রয়েচে৷
কোনো অজানা বন-ফুলের সুবাস হয়তো! তাই হবে৷
তেল কিনতে গিয়েচি দোকানে, দোকানী বল্লে—কি রকম আছো? বলি, কিছু দেখচো নাকি?
—না৷
—শুনচো কিছু?
—না৷
—তুমি দেখচি সাধু লোক! তুক-তাক জানো নাকি? ভূতের মন্তর?
—তেল দাও, চলে যাই৷ ওসব বাজে কথা৷
—আচ্ছা, একটা মেয়েকে ওখানে কোনো দিন দ্যাখোনি? বউ-মতো? কোনো গন্ধ পাওনি?
—কিসের গন্ধ?
—কোনো ফুলের সুগন্ধ?
—না৷
—খুব বেঁচে গিয়েচ তুমি৷ তোমার আগে যারা ওখানে থাকত, তারা সবাই একটি বউকে দেখত ওখানে প্রায়ই৷ এমন হোত শেষে, ও বাড়ি ছেড়ে তারা নড়তে চাইত না৷ তারপর রোগা হয়ে দিন দিন শুকিয়ে শেষ পর্যন্ত মারা যেত৷ দুটি লোকের এই রকম হয়েচে এ পর্যন্ত৷ বাড়িতে ভূতের আড্ডা৷ ভূতে লোককে পাগল করে দেয়৷ তাদের কাণ্ডজ্ঞান থাকে না, এমন ভালো লাগে এ বাড়ি—না খেয়ে, না দেয়ে ওখানে পড়ে থাকে—ছেড়ে যেতে চায় না৷ তুমি দেখচি ভূতের মন্তর জানো৷ আমরা তো ও-বাড়ির ত্রিসীমানায় যাইনে৷ মাথা খারাপ করে দেয় সাধারণ মানুষের৷
তেল নিয়ে চলে এলাম৷ ভাবতে ভাবতে এলাম, মাথা খারাপ হওয়ার সূত্রপাত আমারও হল নাকি? বাড়ির সীমানায় পা না দিতেই আমারও মনে হল, নাঃ, সব ভুল৷ পরম সুখে আছি৷ এ ছেড়ে কোথায় যাব? বেশ আছি, খাসা আছি, তোফা খাসা আছি৷
সেই থেকে আজ দু’বছর পড়ে আছি এ বাড়িতে৷ চক্কত্তিমশায় মাইনেটাইনে কিছুই দেয় না, তাতে আমার কিছু আসে যায় না৷ বাড়ি দেখাশুনো করি, বেগুন-কলা বেচি, দিনরাত ওঁদের নৃত্য দেখি, ওঁদের মধ্যেই বাস করি—এক-পা যাইনে বাড়ি ছেড়ে৷