চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

মায়ার খেলা, মায়ের খেলা

মায়ার খেলা, মায়ের খেলা

এই দুনিয়ায় মা ছাড়া আমাদের আর কে আছে! ভাষাহীন পশুর কণ্ঠেও মা ডাক। অতি স্পষ্ট সে ডাক। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। এ সব প্রাচীন পৃথিবীর কথা। একালে অচল। দশটি মাস মাতৃগর্ভে বসবাস করেছি। অজ্ঞান অবস্থায় সেবা নিয়েছি। বাল্যে বাঁদরামি করে জীবন অতিষ্ঠ করেছি। যৌবনে প্রবৃত্তির স্রোতে ভাসতে ভাসতে দূর থেকে দূরে চলে যাব, এই তো নিয়ম। তখন আর বৃদ্ধা মাতার খোঁজ কে রাখে! বুড়ি মা! বড় বকবক করে। খিটখিটে। অসহ্য! ঈশ্বর কবে যে তুমি বুড়িকে নেবে!

মা জানে, মায়ের কী বরাত! তবু নারীকে মা হতে হয়। সৃষ্টিকর্তার এই বিধান। নইলে সৃষ্টি যে লোপাট হয়ে যায়! পশুর বোধবুদ্ধি মানুষের চেয়ে কম। মাতৃত্বের আকাঙ্খা থাকে কিনা জানা নেই। অমোঘ জৈব নিয়মে মা হতে হয়। মা হওয়ার পর তার অন্য চেহারা। যে কুকুরটি সামান্য কিছু খাবার প্রত্যাশায় আমাদের বাড়িতে নিত্য আসাযাওয়া করত, একদিন আমাদের কয়লার ঘরে তার তিনটি বাচ্চা হল। আমরা জানি না কখন তার বাচ্চা হয়েছে। রাতের দিকে তাকে বিদায় করার জন্যে খুব হইচই হচ্ছে। অন্ধকার কয়লার ঘরে গেড়ে শুয়ে আছে। কিছুতেই উঠছে না। অসহিষ্ণু অধিকার-সচেতন, স্বার্থপর মানুষ, যে আর্ত কোনও মানুষকে ঘরের দরজা খুলে দিতে কুণ্ঠিত, অন্ধকার কয়লা ঘরে সে কেমন করে একটা রাস্তার কুকুরকে সহ্য করবে। ঠ্যাঙা, লাঠি, শাবল যাবতীয় হাতিয়ার বেরিয়ে পড়ল। রোজ যে বাড়ি থেকে খাদ্য পায়, সেই বাড়ির প্রতিটি মানুষের প্রতি এই ব্রাত্য কুকুরের অসীম আনুগত্য। কুকুর তো আর মানুষ নয়, যে উপকারীর হাড় দিয়ে চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাবে! কুকুরকে খোঁচনো হচ্ছে, সে ফ্যালফ্যাল করে সকলের মুখের দিকে সজল চোখে তাকাচ্ছে। আধো আলো আধো অন্ধকারে তেমন বোঝা যাচ্ছে না, রহস্যটা কী? মানুষের সংসারে সবাই তো আর শুধুই প্রেমিক, প্রেমিকা, কী ঘাতক নয়। মাও আছে। যিনি আঁতুড়ে সন্তান কোলে একমাস বসে এসেছেন। তিনি শেষে আবিস্কার করলেন, পপি মা হয়েছে। তিনটি নবজাতককে বুকের আশ্রয়ে রেখে শীত আগলাচ্ছে। উচ্ছেদকারীরা হতাশ হয়ে ফিরে গেল। মানব-মাতা সেই পৌষের শীতরাতে এগিয়ে এলেন সারমেয়-মাতার তদারকিতে। দুজনেই দুজনকে বোঝে। সন্তান যখন ভূমিষ্ঠ হতে চায় তার কী বেদনা। মানুষের চারপাশে আরও অনেক মানুষ, অভিজ্ঞ ডাক্তার। ব্যয়বহুল নার্সিংহোম। বেওয়ারিশ একটি কুকুরের কে আছে। ওপরে আকাশ, নীচে জমি। চতুষ্পদ একটি খোলে জীবন নামক বস্তুটির ধুকপুকানি। যিনি সৃষ্টিকর্তা একমাত্র তিনিই রক্ষক। তিনিই সংহারক। কুকুরের জন্যে চটের আচ্ছাদন এল। বাচ্চা ছেড়ে নড়ার উপায় নেই বলে নিজের ভাগের দুধ এসে গেল। মধ্যরাতে তাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল কাল তোর জন্যে আরও বেশি ভাত নেব। এই সময়টায় বড় খিদে পায় রে। মানুষেরও পায়, তোদেরও পায়। মানুষ বলতে পারে, তোরা বলতে পারিস না।

দুজনের, দুই মায়ের এই নিভৃত আলাপন বাতাস শুনে গেল। শুনল নিশুতি বাগানের গাছপালা। আর হয়তো শুনলেন তিনি, যাঁর অস্তিত্ব সর্বত্র। যিনি এক হাতে জন্মের বীজ ছড়াচ্ছেন, আবার অন্য হাতে শুষ্ক প্রাণ-কুসুম তুলে তুলে ডালিতে রাখছেন। যাঁর সৃষ্টিতে গরল আছে, অমৃত আছে। রক্ষক আছে, ভক্ষক আছে। মাতৃস্তন আছে, পুতনার স্তনও আছে। পাশে পাশে একই সঙ্গে ঘুরছে বন্ধু আর শত্রু। বিশ্ব জুড়ে চলেছে বিচিত্র খেলা। যার যে খেলাই হোক, মায়ের খেলারই জয় জয়কার। ঘাতক, তুমি কত মারবে? বিরূপ প্রকৃতি তোমার ঝড়-ঝঞ্ঝা-প্লাবন ভূমিকম্প, সৃষ্টিকে নি:শ্বেষে ধ্বংস করে দিতে পারবে কী। হলাহলের শক্তির চেয়ে অমৃতের শক্তি অনেক বেশি। দয়ার কাছে নিষ্ঠুরতা পরাভূত। মানুষকে চেষ্টা করে নিষ্ঠুর হতে হয়। উত্তেজক পদার্থ খেয়ে স্বাভাবিক হৃদয়বৃত্তিকে আচ্ছন্ন করতে হয়। বুকে ছুরি বসাবার আগে হাত কাঁপে। ঠেলে ফেলে দেবার সময় বুক কাঁপে। হাত ধরে টেনে তোলার সময় বিবেক স্তম্ভিত হয় না। আগুন-লাগা ঘর থেকে সন্তানকে উদ্ধারের সময় মায়ের চেতনা থাকে না। নিজের নিরাপত্তার বোধ ঘুমিয়ে পড়ে। স্রষ্টার সৃষ্টিচেতনার কাছে নিতান্তই ম্লান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিরোশিমা, নাগাসাকির ওপর আনবিক বোমা, স্মৃতিতে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। মৃত্যুর কালো স্লেট মুছে মুছে জীবন অনবরতই খইয়ের অক্ষরে সৃষ্টির কথা লিখে চলেছে। তা যদি না হত, পৃথিবী এতদিন কবরে ছেয়ে যেত। সংখ্যালঘু ঘাতকের দল সব মানুষের চিতা জ্বেলে সোল্লাসে নৃত্য করত।

আমি একবার এক হুলোর পাল্লায় পড়েছিলুম। ঠিক আমি পড়িনি, পড়েছিল আমার সেই মিনি, যেটাকে আমি বর্ষার সকালে উদ্ধার করেছিলাম একটা বাগান থেকে। এইটুকু একটা বাচ্চা। জলে ভিজে ঘাসের মধ্যে পড়েছিল তুলোর তালের মতো। ঠান্ডায় চোখ দুটো বুজে গেছে। কোনও এক নিষ্ঠুর কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষ বাচ্চাটিকে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল, নিজের সুখ বিপন্ন হবে ভেবে। অতি ক্ষুদ্র প্রাণী। তার সুখে বিরাট একটা খাবলা মারার ক্ষমতা নেই। অসাবধানে রাখা এক টুকরো মাছ কোনদিনও হয়তো খেয়ে ফেলতে পারত। মধ্যবিত্তের এক চুমুক দুধের আধ চুমুক হয়তো তুলে নিত। মানুষের ধারণা, পৃথিবীটা তার বাপের সম্পত্তি। তার সুখ-হরণকারী কোনও প্রাণীর বাঁচার অধিকার নেই। অথচ বোকা মানুষ জানে না, সে যখন শীতের লেপের তলায় পরম সোহাগে সুখের স্বপ্নে বিভোর, তখন হয় তো লিভারের এক কোণে ক্যানসারের মৃদু চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে। তেইশে ডিসেম্বর যে মানুষ লেপের তলায় আমার-আমার করছে, পরের বছর তেইশে ডিসেম্বর সে শেষ শয্যায় কাতরাচ্ছে, আর বলছে সব তোমার-তোমার। এক টুকরো মাছ খেয়েছিল বলে বেড়াল কুপিয়েছিল। কাপে এক ইঞ্চি দুধ কম হয়েছিল বলে আগুন জ্বালিয়েছিল। এখন সব খাদ্যবস্তু চোখের সামনে দিয়ে ঘুরে যায়, কিছু করার উপায় নেই। অতৃপ্ত বাসনা নাচাতে চায় দেহ, যন্ত্রণা রাশ টেনে রেখেছে। যে চোখে লালসা নাচত, সে চোখে মৃত্যুর ছায়া। যার নিজের জীবন এত ঠুনকো, সে অন্য জীবন সম্পর্কে এত উদাস কেন।

পৃথিবীর যেমন নিয়ম, এক মানুষ মারতে চায়, আবার আর এক মানুষ বাঁচাতে চায়। সেই বেড়ালছানাটি ক্রমে সাদা ধবধবে, সুন্দরী এক পুষির চেহারা নিল। যিনি মারতে চেয়েছিলেন, তিনি জানতেন না কী সৌন্দর্য লুকোনো ছিল ওই সৃষ্টিতে। মানুষের সমাজে যেমন মাস্তান আছে, বেড়ালের সমাজেও সেই রকম মাস্তান আছে। একদিন দুপুরে আচমকা ভীষণ ঝটাপটি। মার মার করে তেড়ে যাওয়া হল। পেল্লায় এক হুলো বাঘের মতো মুখ, পুষিটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে গেল। ঈশ্বরের যেমন বিধান। স্বজাতির হাতে স্বজাতি ধ্বংস। একদিকে হুলো তক্কেতক্কে ঘোরে আর একদিকে আমরা। পুষির গলায় বিশ বাইশ গজ লম্বা শাড়ির পাড় বাধা। বাইরে যাওয়ার পথ বন্ধ, ঘোরাফেরা ওই বিশ-বাইশ গজ বৃত্তের ভেতর। মাঝে মাঝে মাপা বৃত্তের পরিধি ছোট হয়ে যায়। চেয়ার পায়ায় জড়িয়ে মড়িয়ে পাড়টাকে এতটুকু করে গলা টান করে বেকায়দায় বসে থাকে। জীবনকে প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে আগলে রাখতে গিয়ে আমাদের হিমসিম অবস্থা। এত সতর্কার মধ্যে একদিন হুলো এসে বাঁধা বেড়ালকে খাবলে দিয়ে গেল। মারার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়, এত ত্বরিত তার আসা-যাওয়া। চিতাবাঘের মতো চলনবলন।

এইবার ঘটনা চরমে উঠল। রাতে বিছানায় পুষি আমার কোলের কাছে শুয়ে আরামে ঘড়ঘড় করে। ভাবে মশারির ঘেরাটোপে বেশ নিরাপদে আছে। এ ভুল একদিন ভেঙে গেল। মাঝরাতে অন্ধকার ঘরে মশারির ভেতর শুম্ভ-নিশুম্ভের লড়াই চলছে। প্রথমে ভাবলুম ডাকাত পড়েছে। মশারির একটা পাশ ছিঁড়ে ঘাড়ে লোটাচ্ছে। ব্যাপারটা কী? অন্ধকারে চোখ ধাতস্থ হলে বুঝতে পারলুম, মশারির ভেতর দুটো বেড়াল। একটা সেই হুলো। অন্ধকারে পেটাতে গিয়ে ভুল হয়ে গেল। চিতাবাঘের মতো হুলো ক্ষিপ্রগতিতে জানালা গলে পালাল, মার খেয়ে মরল পুষি। পরের দিন সমস্ত জানালায় জাল লাগিয়ে দিলুম। খরচ নেহাত কম হল না। তবু তৃপ্তি, পুষি এখন হুলোর আক্রমণ থেকে নিরাপদ।

জানালার প্রবেশ পথ বন্ধ হলেও হুলো একদিন ফাঁক পেয়ে দরজা গলে কোন সময় ঢুকে পড়ল। কেউই আমরা লক্ষ্য করিনি। ঢুকে খাটের তলায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। তখন প্রায় রাত এগারোটা। এই সুযোগ। এবার ব্যাটাকে বেধড়ক ধোলাই লাগাতে হবে। পালাবার সমস্ত পথ বন্ধ করে দেওয়া হল। লাঠিসোঁটা, ঝাঁটা, ডান্ডা, সব বেরিয়ে পড়ল। আজ হুলো নিধন হবে। সারা বাড়ি তোলপাড়। প্রথমে শুরু হল খোঁচানো। খোঁচা খেয়ে বেরিয়ে এল। দু-চার ঘা ঘাড়ে পড়ল। প্রাণভয়ে ছোটাছুটি। একবার এদিকে যায়, একবার ওদিকে। আমাদের উল্লাস দেখে কে? বাইসন শিকারী গুহামানবের মতো হুলো, লাফ মেরে জানালায় উঠল। গলে পালাতে চাইছে। জালে পথ বন্ধ। খুঁচিয়ে ধপাস করে মেঝেতে ফেলা হল। গুটিসুটি মেরে পালাতে চাইছে। চারপাশে উদ্যত লাঠি। ক্ষুদ্র শত্রু। প্রবল আক্রমণকারী। মারমার চিৎকার। বাতাসে লাঠিতে লাঠি ঠেকে যাচ্ছে। বেড়াল এবার প্রাণভয়ে একলাফে দরজার পাল্লার ওপর উঠে প্রাণভয়ে ঝুলতে লাগল। লাঠির খোঁচায় আবার তাকে মেঝেতে ফেলা হল। এবার আর সে পালাবার চেষ্টা করল না। সোজা এসে আমার পায়ে পড়ল। নড়েও চড়েও না। করুণ চোখ দুটো একবার মাত্র আমার দিকে তুলে নীচে নামিয়ে নিল। সে চোখে জল। যেন বলতে চাইছে, মারলে মারো, রাখলে রাখো, হাত থেকে লাঠি পড়ে গেল। নিজের চোখেও জল এসে গেছে।

সংসারে যিনি মা, তিনি অবশেষে এগিয়ে এলেন। সেই মারত্মক হুলো যে সুরে ডেকে উঠল, তাতে স্পষ্ট মা ধ্বনি। হুলোকে বোঝানো হল পুষিকে আর কোনও দিন মারবে না। তারপর তাকে দুধ দেওয়া হল। ভয়ে খেতে চাইছে না। আমাদের ওপর হুকুম হল, তোমরা জল্লাদরা সব সরে যাও। আমরা সরে যেতেই হুলো চকচক করে দুধ খেতে শুরু করল।

সেই হুলো পরিবারেরই একজন হয়ে উঠল। সকাল সন্ধে তার মা, মা ডাক। নিজের মা কোথায় তার ঠিক নেই। মা খুঁজে পেল মানুষের শরীরে। শেষে এমন পোষ মানাল, একদিন ম্যাও ম্যাও করতে করতে আমার পেছন-পেছন দোকানে চলল। লোকে অবাক। এ আবার কী রে বাবা। কুকুর নয়, বেড়াল চলেছে পেছন-পেছন।

কোনও এক রাতে, পাহাড়ি নদীর ধারে নির্জন এক আশ্রমে বসে আছি। মহাপুরুষ বললেন, কিছু শুনতে পাচ্ছ?

মাঝেমধ্যে নদীর কুলুকুলু ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। চারপাশে অসীম প্রশান্তি। বড় বড় তারা মাথার ওপর ধকধক করছে। বললুম, নদীর কুলুকুলু।

তোমার এখন মৃত্যুর কথা মনে হচ্ছে, না সৃষ্টির কথা।

মৃত্যু নয় ধ্বংস নয়, মনে হচ্ছে প্রাণতরঙ্গ বয়ে চলেছে, কুলুকুলু করে। মনে হচ্ছে মমতা মাখানো দুটি হাত নিভৃতে বসে বসে নিজের খেয়ালে একের পর এক সৃষ্টি করে চলেছে। অন্ধকার আকাশে যাঁর মুখের ছায়া, তিনি রুদ্র নন, গৌরী। যে পৃথিবীর ঘাস এত সবুজ, আকাশ এত নীল, সে পৃথিবী তো প্রেমিকের সৃষ্টি।

সর্বত্রই পূর্ণতার পরিকল্পনা। বছর যেই শেষ হল, বনভূমি সেজে উঠল নবীন সাজে। এক রাতেই রিক্তপত্র গাছে বিনবিন করে নতুন পত্রোদগম। কোথাও কোনও বার্ধক্যের চিহ্ন নেই। এখানে ক্ষয়, ক্ষয় নয়। রূপান্তর মাত্র। সৃষ্টির পুনর্বিন্যাস। যাকে আমরা ধ্বংস বলে মনে করি, প্রকারান্তরে তা সৃষ্টিরই খেলা। প্লাবন না হলে ভূমি পলি-সঞ্জীবিত হবে না। হিমবাহ ভেঙে না পড়লে নদী ধারা পাবে না। বজ্রের ধমকে ফসলের ক্ষেতে নাইট্রোজেন নামবে। জীবের মৃত্যু হল অন্য জীবের ধারণ ব্যবস্থা। আমি মরব, তুমি মরবে, মানুষ কিন্তু মরবে না। বিশালের বিশাল ব্যবস্থা। সৃষ্টি একাধারে জনক-জননী, জায়াপতি, তনয়-তনয়া। কখনও চপল, কখন গম্ভীর, কখনও বিশালের চেয়েও বিশাল, কখনও বালুকণার চেয়েও ক্ষুদ্র। হিমালয়, আল্পস, কী পামিরের বিস্তার দেখলে বুক কেঁপে যাবে। মহাসমুদ্রে মোচার খোলায় ভাসিয়ে দিলে হৃৎদস্পন্দন থেমে যাবে। মহাকাশে বেলুনে বেঁধে ছেড়ে দিলে নিজেকে মনে হবে কীটস্য কীট। নীচে পড়ে আছে তাসের ঘরবাড়ি। কীটের অহমিকা। ক্ষুদ্র পাখি পাশ দিয়ে উড়ে যেতে যেতে বলবে—কী হে মানব। কোথায় গেল তোমার বিশাল আস্ফালন। সংসারের চাতালে দাঁড়িয়ে কর্কশ হুঙ্কার। সমুদ্রতটে বিশাল ঝাউয়ের তলায় দাঁড়িয়ে অনুভব করা যায়, সৃষ্টিতে মানুষ তুমি বড় ক্ষুদ্র। তুমি এভারেষ্ট নও, প্রশান্ত মহাসাগর নও, তুমি হাজার হাজার বছরের প্রাচীন বনভূমির সুবিশাল গর্জন-গাছ নও, এমনকি তুমি ক্ষুদ্র পাখির উদার মুক্তির আনন্দও দেহসীমা দিয়ে ধরতে পার না। তুমি তাহলে সৃষ্টির কোন প্রয়োজনে এসেছ?

 জেনে রাখো, তুমি হলে সাক্ষী-পুরুষ। তুমি অনুভব করবে বলেই সৃষ্টির নাভিপদ্ম থেকে উঠেছ শতদলের মতো। কোটি কোটি জোড়া চোখ দিয়ে দেখেও দেখার শেষ নেই। তোমাকে মন দেওয়া হয়েছে সূক্ষ্ম অনুভূতি ধরার জন্য। অনুভবে তুমি বিশাল সুক্ষ্মতায় তুমি বিশাল। তুমি কখনও পিতা, কখনও ভ্রাতা, কখনও সন্তান, কখনও বন্ধু।

 সেই মহাপুরুষ বলেছিলেন, চল্লিশ পেরলে বুঝবে সংসার যেমন মায়ার খেলা, তেমনি মায়ের খেলা। নিজের স্ত্রীতে যেদিন মাতৃদর্শন হবে, সেদিন বুঝবে প্রেমের আসল চেহারা কী। মহামায়া মহাকালী নিজের কোলে শিবকে ফেলে সন্তান-স্নেহে স্তন্যপান করাচ্ছেন। সৃষ্টির মুহূর্তে কাম। আমি বহু হতে চাই। পর মুহূর্তেই আমি ধারক, আমি পালক। যিনি কন্যা, তিনিই জায়া, তিনিই জননী। সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কণ্ঠে একই মা ডাক। জীবজগতের সমস্ত প্রাণীকন্ঠে সেই এক নাম মা। আমি ধারণ করে রেখেছি, তাই তোমাদের জীবন-উল্লাস। আমি ঘাতকের মা, পাতকের মা, সাধকের মা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *