মায়ার খেলা – ইন্দ্রমিত্র
রাত তখন দশটার কম হবে না। আলো-টালো নিবিয়ে আমি শুয়ে পড়েছি। দশটায় আমি শুয়ে পড়েছি কিন্তু ঘুমোতে-ঘুমোতে সেই প্রায় দুটো বেজে যাবে। বিছানায় চোখ বুজে ঘণ্টাচারেক সাধনা না করলে আমার ঘুম আসে না। ওষুধ খেতে হয়, তারপর শুয়ে-শুয়ে এক-দুই গুনতে হয় হাজার অবধি, তারপর কোনও-না-কোনও সুখের দৃশ্য চিন্তা করতে হয়। তারপর যদি ঘুম আসে। আমার সঙ্গে ঘুমের এত শত্রুতা কেন? একজন ডাক্তার বলেছেন—লিভার ঠিক না হলে ঘুম হবে না ভালরকম। আর একজন ডাক্তার বলেছেন—ঘুম ভাল রকম না হলে লিভার ঠিক হবে না।
কিন্তু গল্প আমার লিভার নিয়ে নয়, আমার ঘুম নিয়ে নয়, এমন কি আমাকে নিয়েও নয়। এই একটা মহং দোষ আমার, আসল কথা বলবার আগে গাদাখানেক আজে-বাজে কথা বলে ফেলি।
বাইরে থেকে কে যেন বিপুল বিক্রমে আমার দরজায় কড়া নাড়ল।
হাঁক দিলাম, ‘কে?’
সাড়া এল, ‘আমি, আমি মীনকেতন।’
মীনকেতনকে আপনারা চেনেন না। মীনকেতন আমার বাল্যবন্ধু। অনেক বন্ধু আমাকে ছেড়ে দিয়েছে, অনেক বন্ধু আমার শত্রু হয়েছে, কিন্তু মীনকেতনের কোনও পরিবর্তন নেই। মীনকেতুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব যেমন ছিল তেমনই আছে। মীনকেতনের আমি বন্ধু, আমি পরামর্শদাতা। আমার নিজস্ব বুদ্ধির ওপর আমার নিজের তেমন ভরসা নেই, কিন্তু মীনকেতনের অগাধ বিশ্বাস।
গল্প এই মীনকেতনকে নিয়ে।
এখানে মীনকেতনের চেহারার একটা বর্ণনা দিয়ে রাখলে বোধ করি মন্দ হয় না। মীনকেতন পাঁচ ফুট দু ইঞ্চি লম্বা অর্থাৎ বেঁটে। গায়ের রঙ মাঝারি। দাড়ি-গোঁফ কামানো। ভুরু-টুরু বাঙালির সচরাচর যেমন হয়ে থাকে, তেমনি। বিশেষত্ব আছে মীনকেতনের কপালে। মাথার সামনের দিকে দেড় ইঞ্চিটাক জুড়ে দিব্যি চকচকে টাক। অর্থাৎ কপালটি বেশ বৃহৎ। মাথার সামনের অবস্থা যাই হোক, পিছন দিকের কেশদাম বেশ ঝোঝুল্যমান।
যা অনুমান করছেন, তাই। মীনকেতন পদ্য লিখে থাকে। সব প্রেমের পদ্য। ওর বিস্তর পদ্য আমি শুনেছি এবং তার থেকে আমার এই ধারণা হয়েছে যে, কোনও সাধারণ বাঙালি পুরুষমানুষের বিয়ে হওয়া ভারী কঠিন। খুলে বলি। সব প্রেমের পদ্য মীনকেতন বাঙালি তরুণীকে মহীয়সী বানিয়ে রেখেছে। ওই প্রেমের পদ্যে এই কথাই বিশদ করে বলা আছে যে, বাঙালি তরুণী রূপে গুণে অতুলনীয়, তাদের ভুরুতে বিদ্যুৎ, চুলে মেঘ, কটাক্ষে পেনিসিলিন, কথাবার্তায় ফসফরাস। তাদের যোগ স্বামী কোথায় বঙ্গদেশে?
বাংলাদেশে পদ্যপাঠকের সংখ্যা অত্যন্ত অল্প। ভাগ্যিস অল্প।
মীনকেতনের গলা শোনা গেল, ‘কী রে, দরজা খুলবি না! আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব নাকি?’
ওঃ-হো, দরজা খুলিনি এখনও। বিছানা ছেড়ে উঠলাম। আলো জ্বালালাম। দরজা খুললাম।
মীনকেতন সটান এসে বসে পড়ল আমার বিছানায়। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘এক গ্লাস জল দিবি?’
দিলাম। নিজেও খেলাম এক গ্লাস। আজ আমার ঘুমের দফাটি গয়া। মীনকেতন এখন নিশ্চয়ই ওর প্রেমের উপাখ্যান শোনাতে আরম্ভ করবে; সে উপাখ্যান দু-দশ মিনিটে শেষ হবার কথা নয়। উপাখ্যানের সঙ্গে আবার স্বরচিত পদ্যও শোনাবে কি না কে জানে! যা হবার হক। মোগলের হাতে পড়েছ, খানা খেতেই হবে।
মীনকেতন বলল, ‘একটা দুঃসংবাদ আছে। না, ঠিক দুঃসংবাদ নয়, সুসংবাদও বলা যেতে পারে। উহুঁ, যতটা সুসংবাদ ততটাই দুঃসংবাদ। যেমন লাভ, তেমনি লোকসান।’
আমাকে নির্বাক দেখে মনকেতন আর একটু বিশদ হল, ‘হ্যাঁ, মায়ার কথা বলছি। তোর সেই পাঁচশো টাকার কথাটা মনে আছে তো?’
মনে আছে। মীনকেতন সংক্রান্ত কোন কথাটা আমার মনে নেই, শুনি?
মীনকেতন সম্পর্কে এখানে দু-চারটে কথা না বলে নিলে আর চলছে না। বাল্যে ও কৈশোরে মীনকেতন ছিল আমার নিত্য সঙ্গী। মীনকেতনের সে সময়ের বিত্তব কাহিনীও স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার যোগ্য। সেসব কথা এখানে বলবার সুবিধে হবে না।
এখন এই যৌবনে অদ্যাবধি মীনকেতন খুব কম শহিনীর নায়ক হয়নি। সমস্ত কাহিনা আদান্ত আমার চোখের সামনে ঘটেনি, ঘটা সম্ভব নয়। খানিক আমি নিজের চোখে দেখেছি, তানেকখানি আমি মীনকেতনের মুখে শুনেছি, খানিক আমি আর-পাঁচজনের মুখে জেনেছি।
যে-কথাটা আমি এতক্ষণ ধরে বলব বলব ভাবছি, সেটা এখন বলা যেতে পারে। মীনকেতন একজন প্রেমিক। জাত-প্রেমিকও বলা যেতে পারে। এবেলা-ওবেলা ও প্রেমে পড়ে। আগের কথা ছেড়ে দিচ্ছি, সাম্প্রতিক কালে লক্ষ্য করেছি যে, ডালহৌসি-স্কোয়ার অঞ্চলেই প্রেমের দেবতা বাণ মেরে মীনকেতনকে ঘায়েল করেন। কলকাতায় এত অঞ্চল থাকতে ডালহৌসি-স্কোয়ার কেন? তার একটা কারণ সম্ভবত এই যে, মীনকেতন আজকাল ওই অঞ্চলেই একটা আপিসে কেরানিগিরি করে। মীনকেতনের আপিসের নাম ঠিকানা? আজ্ঞে, মাপ করুন, ওটুকু আমাকে গোপন রাখতে দিন। মীনকেতনকে চাক্ষুষ দেখতে চান একবার? যে কোনওদিন (ছুটির দিন বাদে) বিকেল পাঁচটায় গির্জার সামনে বাসস্টপে চলে যাবেন, ওখানে মীনকেতনকে আবিষ্কার করতে আপনার একবিন্দু অসুবিধা হবে না।
মীনকেতন একাধারে কবি, প্রেমিক ও কেরানি। ত্রিবেণীসঙ্গম বোধ হয় একেই বলে। কিংবা ত্র্যহস্পর্শ।
মীনকেতন বুকপকেট থেকে এক খণ্ড চৌকো কাগজ বের করে আমার চোখের সামনে মেলে ধরল। কয়েকদিন আগে আমিই ওই কাগজে একটা সাংঘাতিক লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছি মীনকেতনকে। লিখেছি: মায়া যদি মীনকেতনকে বিয়ে করতে এক কথায় রাজি না হয় তো মীনকেতনকে আমি পাঁচশো টাকা দেব। বাজি।
মীনকেতনও অবশ্যি এক খণ্ড কাগজে উল্টো প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে: মায়া যদি এক কথায় ওকে বিয়ে করতে রাজি হয় ও আমাকে পাঁচশো টাকা দেবে।
কথা উঠতে পারে, আমি কেন খামকা এরকম পাঁচশো টাকার একটা বাজি রাখতে গেলাম? কেন, চাণক্য পণ্ডিত কি সকলকে বাজির থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে বলে যাননি?
ওসব কোনও কাজের কথা নয়। আমি তো কে, এই কলকাতার কত বড়-বড় মনুষ্য ফি-হপ্তায় মাঠে গিয়ে ঘোড়ার ওপর বাজি ধরেন। ঘোড়া-টোড়া নয়, আমি একটা সামান্য প্রেমের উপরেও বাজি ধরতে পারব না? বিশেষত, যে-প্রেমে, আমার বদ্ধমূল বিশ্বাস, মীনকেতনের সাফল্য অবশ্যম্ভাবী? মীনকেতন কেন, কলকাতায় কোন যুবক প্রেমে ব্যর্থ হয়েছে, শুনি? অন্যান্য যুবকের চেয়ে প্রেমে (এবং বিবাহের) পাত্র হিসেবে মীনকেতন কোন অংশে অবহেলার যোগ্য? সে ভদ্রলোকের ছেলে, বি-এ পাস, চাকরি করে।
শেষের একটা কথা আগেই বলে রাখি। বাজিতে আমি পাঁচশো টাকা হেরেছি। অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। মীনকেতন ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিককালে মীনকেতনই আমি যতদূর জানি একমাত্র যুবক, যে ব্যর্থপ্রেমিক। কলকাতার কোনও ব্যর্থপ্রেমিকের সঙ্গে যদি আপনার পরিচয় হয় তো জানবেন যে, তার নাম নিঃসন্দেহে মীনকেতন।
মাস আষ্টেক থেকে মীনকেতনের মুখে আমি অনবরত যে-মেয়েটির স্তব শুনেছি তার নাম মায়া। মায়া গুপ্ত। মাস আষ্টেক ধরে মীনকেতনের অবস্থা দেখে আমার প্রত্যয় হয়েছে যে, কবি-বাক্য মিথ্যে নয়—সংসার যথার্থই মায়াময়। না, মীনকেতনের মুখে মায়া ছাড়া আর কোনও কথা নেই। মায়া, মায়া, মায়া। কাগজ দুর্মূল্য, কিন্তু তাতে কী। মীনকেতন মায়ার ওপরে এই আট মাসে আট-বারং ছিয়ানব্বুইটা পদ্য বানিয়েছে। মায়ার নামে মীনকেতনের চোখ ছলছল করে, বুক ধড়ফড় করে, কান পিঁ-পিঁ করে। মীনকেতন এই আট মাসে প্রত্যেকদিন কমপক্ষে আটটি করে মাংসের শিঙাড়া খেয়েছে। কেননা, মাংসের শিঙাড়া মায়ার খুব ভালবাসার বস্তু।
আমি আর পারি না। মায়ার কথা শুনতে শুনতে আমার ঘুমের দশা আরও কাহিল হল। আমার লিভার আরও খারাপ হল। বিরক্ত হয়ে একদিন বলেছি, ‘তুই তো মায়া মায়া করে পাগল, মায়া তোর সঙ্গে তেমন কোনও কথা-টথা বলে?’
মনিকেতন বিগলিত হল। “বলে না আবার! আমার আপিসে আমার পাশের টেবিলেই বসে মায়া। কেমন মধুর গলায় বলে, ‘মীনকেতনবাবু, আমার এই লম্বা যোগটা একটু করে দেবেন।’ বড় বড় এক-একটা যোগ অঙ্ক আমি চোখের পলকে করে দিই।”
বললাম, ‘তাহলে তো যোগাযোগ হয়েই গেছে। তারপর আর কতখানি এগলি?’
‘শোন তাহলে। ছুটির পর রোজ আমি মায়ার সঙ্গে এক বাসে বাড়ি ফিরি।’
‘এক বাসে মানে? তোর ওই মায়াও কি শ্যামবাজারে থাকে?’
‘উঁহু। মায়া থাকে বালিগঞ্জে। তাতে কী! আমি ছুটির পরে ওই বালিগঞ্জ হয়েই শ্যামবাজারে আসি।’ মীনকেতন আর একটু বিশদ হল: ‘মায়ার সঙ্গে যে-বাসে বালিগঞ্জ যাই, সেই বাসেই শ্যামবাজারে আসি।’
‘বাস ভাড়া বাবদ বিস্তর খরচ হয় তো তোর। মায়ার বাস ভাড়াও তুইই ঘটা করে দিস নাকি আবার?’
‘বাঃ, দেবো না?’ মীনকেতন দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা। এ আর এমন কী খরচ। ধীরেন পাল নামে আমার এক খুড়তুতো ভাইয়ের বন্ধু গত পাঁচ বছর ধরে প্রতি মাসে নিয়মিত পাঁচবার কলকাতা টু আসানসোল ট্রেন ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করছে—স্রেফ প্রেমের জন্যে। বলে প্রেমের জন্যে এক-একজন মহামানব সাম্রাজ্য পর্যন্ত অকাতরে বিলিয়ে দেয়। সুন্দরী, তোমার গালের ওই তিলটির জন্যে আমি সমগ্র…’
‘হয়েছে, থাম। মায়ার খেলা অনেক দূর এগিয়েছে তাহলে?’
‘এগিয়েছে মানে! তারস্বরে এগিয়েছে। জানিস, আমার আপিসের সব যুবক আমাকে হিংসে করে?’
জানতাম না। জানলাম। আরও জানলাম যে, মায়ার সঙ্গে মীনকেতন চৌরঙ্গিপাড়ায় একাধিক রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে। কেবিনে বসে মুখোমুখি মাংসের শিঙাড়া খেয়েছে। মীনকেতন নানাবিধ গল্প শুনিয়েছে মায়াকে। মীনকেতনের মুখে গল্পটল্প শুনতে ভারী ভালবাসে মায়া, হেসে কুটিকুটি হয়। মায়ার দাদু একজন ডাক্তার। হার্টের রোগী সেজে মীনকেতন একদিন তার সঙ্গে পর্যন্ত আলাপ করে এসেছে। তবে ওই একদিনই। সেদিন ডাক্তারবাবু নাকি মীনকেতনকে বলে দিয়েছে—আপনার এ হার্টের ব্যামো এ-জীবনে সারবার নয়।
উপসংহারে মীনকেতন বলল, ‘অসাধারণ মেয়ে ওই মায়া। তোর কথাও সাতকাহন করে বলেছি ওকে। এই, আলাপ করবি?।’
‘না’
‘না কেন? চল না ভাই। অসাধারণ মেয়ে, অসাধারণ মেয়ে!’ মীনকেতন আমার দু হাত চেপে ধরল।
আমি কাঠখোট্টা টাইপের মানুষ। প্রেম-ট্রেম বিশেষ বুঝি না। আমার হার্টের কোনও দোষ নেই। দোষের মধ্যে লিভার খারাপ, ঘুম হয় না ঠিকমত। মায়ার সঙ্গে আলাপ করতে যাব কোন দুঃখে?
কিন্তু মীনকেতনকে কিছুতেই এড়াতে পারিনি। মীনকেতন আমার বাল্যবন্ধু। গেলাম। আলাপ করলাম। হ্যাঁ, চৌরঙ্গিপাড়ায়। রেস্টুরেন্টে। মীনকেতন যে-রকম বলেছিল, সে রকম ডাকসাইটে কিছু নয়। তবে বেশ শান্তশিষ্ট মেয়ে। আলাপী-সালাপী আছে। না, ও মীনকেতনের বউ হলে খারাপ কিছু হবে না।
মীনকেতন আর একদিন বলল, ‘যে-রকম শান্তশিষ্ট হয়ে বসে ছিল তোর সামনে, আসলে অমন শান্তশিষ্ট নয় কিন্তু। বুঝলি ভাই…’
‘বুঝেছি।’ মীনকেতনকে বললাম, ‘লেগে যা দুর্গা বলে। এবার তুই পেড়ে ফেল বিয়ের কথা।’
মীনকেতন কেমন চুপসে গেল। ‘বলব? বিয়ের কথা?’
আমি রেগে গিয়ে বললাম, ‘না, বিয়ের কথা বলবে কেন? অন্নপ্রাশনের কথা বল গিয়ে।’
মীনকেতন কী বুঝল কে জানে। বলল, ‘যাঃ!’
মোটের মাথায় মায়াকে বিয়ের কথা বলতে মীনকেতন কিছুতেই রাজি হয় না। মীনকেতনের ওই এক কথা, ‘মায়া রাজি হবে কেন? আমি কি মায়ার বর হওয়ার যোগ্য?’
আমার অসহ্য লাগল। বললাম, ‘না। মায়ার জন্যে সব রাজ্যপালেরা টোপর মাথায় দিয়ে বসে আছে।’
শেষ পর্যন্ত অনেক ধস্তাধস্তির পর মীনকেতন মায়াকে প্রাণের কথাটা বলতে রাজি হয়েছে। মায়া রাজি হলে মীনকেতন আমাকে পাঁচশো টাকা দেবে। মায়া রাজি না হলে আমি মীনকেতনকে পাঁচশো টাকা দেব।
কিন্তু যা ভাবিনি তাই হল। মীনকেতন বলল, “আমি তো ভাই তোতলা-টোতলা হয়ে বিতিকিচ্ছি করে ওই বিয়ের কথাটা বললাম। শুনে মায়া কী বলল জানিস? প্রথম তো কিছুই বলল না। খলখল করে হাসল, পনেরো মিনিট হাসল। তারপর, কী চালাক মেয়ে বাবা, আমাকে বলল, ‘এ-সব বুদ্ধি আপনাকে কে দিয়েছে?’ আমি ভাই তখন তোর নাম বলে দিয়েছি। এক গ্লাস জল দিবি?”
এক গ্লাস জল খেয়ে মীনকেতন আবার শুরু করল, “বাজির কথাটাও ওই সঙ্গে বলে দিয়েছি মায়াকে। মায়া হাসতে হাসতে বলল, ‘আপনাকে বোকা পেয়ে আপনার বন্ধু আপনার সঙ্গে একটু মজা করেছে। বিয়ের কথা আসে কিসে! আপনি আমার, ইয়ে, কী বলে, ইয়ে, বন্ধু।”
বন্ধু? রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল। বললাম, ‘মীনকেতন, তুই এবার খবর-কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিয়ে করবি। মায়ার চেয়ে ঢের-ঢের ভাল মেয়ের সঙ্গে যদি তোর বিয়ে না দিতে পারি তো তুই আমার নামে কুকুর পুষিস। মায়া? কিসের মায়া? ও শুধু মায়া নয়, মহামায়া। এ শুধু গুপ্ত নয়, গুপ্তঘাতক। আর মীনকেতন, খবরদার আর যদি প্রেমের লাইনে কখনও এগিয়েছিস তো আমি তোর কবিতার খাতা পুড়িয়ে দেব, তোর নাকে ঘুষি মারব।’
‘না ভাই, ওরকম বলিস না। সাদামাঠা বিয়ে আমি করব না। প্রেমের বিয়ে না হলে আবার বিয়ে কী! মায়া না হয় গেল, কিন্তু আর কেউ কি আসবে না?’
বললাম, ‘না, আসবে না। আমি কি মেরে ভাগাব। আর কোনও মায়া নয়।’
মীনকেতন গদগদ গলায় বলল, ‘না ভাই, ওরকম বলিস না। মায়া আমার বন্ধু।’
‘কিন্তু আমার শত্রু। আমি কোথায় ভেবেছি যে, সিরিয়াস কেস, মেয়েটার একটা হিল্লে হয়ে যাচ্ছে, আর মেয়েটা তোকে বলল কি না, আমি বোকা পেয়ে মজা করেছি তোর সঙ্গে। তুই বোকা বলে আমি তোর সঙ্গে ফর নাথিং মজা করব?’
‘যেতে দে ভাই, যেতে দে।’
‘না, আমি দেখে নেব।’
মীনকেতন একটু ইতস্তত করে বলল, ‘কিন্তু বাজির টাকাটা?’
‘ও, হ্যাঁ। কথার খেলাপ আমি করি না।’ পাঁচশো টাকার একটা চেক কেটে দিলাম মীনকেতনকে।
মীনকেতন হাসিমুখে বলল, ‘মাসখানেক একটু বাইরে ঘুরে আসি এই টাকায়। তাতে হয়তো হার্টের ব্যথাটা একটু কমবে। মায়াটা বড় দাগা দিয়েছে রে!’
মীনকেতন আমার বাল্যবন্ধু। মীনকেতনকে আমি মর্মে-মর্মে চিনি। হপ্তা খানেকের মধ্যেই মায়ায় দাগা বেমালুম ওর মন থেকে মিলিয়ে যাবে। তারপর আবার আর এক ছায়া দেখে দপ করে জ্বলে উঠবে মীনকেতন। আবার আমার ভোগান্তির একশেষ হবে। কান ঝালাপালা হবে।
কিন্তু মায়া মেয়েটা তো সাংঘাতিক। মীনকেতনকে বোকা পেয়ে দিব্যি একটু নাচিয়ে নিল। আবার আমাকেও একটু টিপ্পনী, কাটতে ছাড়েনি? আচ্ছা, পথে-ঘাটে কোথাও দেখা পেলে হয় একবার। কড়া করে একটু শুনিয়ে দেবে।
ঈশ্বর করুণাময়। আমাকে সুযোগ দেবার জন্যই মায়ার সঙ্গে তিনি—মানে ঈশ্বর—একদিন এসপ্ল্যানেড এলাকায় দেখা করিয়ে দিলেন। মায়াই হাত তুলে ছোট্ট একটুখানি নমস্কার করল: ‘ভাল আছেন?’
‘না।’
‘ও, সেই লিভারটা আবার ট্রাবল দিচ্ছে বুঝি? নাকি ঘুম একেবারেই হচ্ছে না?’
একটুখানি কেশে গলাটা সাফ করে নিয়ে বললাম, ‘ইয়ে দেখুন, একটা দরকারি কথা আছে আপনার সঙ্গে।’
হাসতে হাসতে বলল, ‘চলুন।’
আরে যাবে কোথায়! কিন্তু ভদ্রতা বজায় রেখে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে ঢুকতে হল। মুখোমুখি বসতেই মায়া বলল, ‘বলুন।’
বললাম, ‘ইয়ে, কথাটা কী! একটু কড়া কথা। আপনি এই ইয়ে কথাটা হল গিয়ে মীনকেতনকে…’
ভুরু টান করে মায়া বলল, ‘ও, এই কথা। বুঝেছি। সব কথা আপনাকে খুলে বলতে রাজি আছি। কিন্তু একটি শর্তে।’
খুব কড়া কথা বলা দরকার মেয়েটাকে। অথচ ভব্যতা বজায় রাখতে গিয়ে সে রকম কিছু বলাও যাচ্ছে না—এ যে কী বিষম যন্ত্রণা তা ভুক্তভোগীমাত্রেই জানেন। ওই যে, শুনলাম, একটা শর্তে সব কথা খোলাখুলি বলতে রাজি আছে ওতে একটু আশা হল। যাক গে, ব্যাপারটা ও-লাইনে নিয়ে গেলেই রয়ে-সয়ে দিব্যি দু-চার কথা শুনিয়ে দেওয়া যাবেখন। ওস্তাদি বের করে দিতে পারব।
বললাম, ‘শর্তটা বলুন। সব শর্তেই আমি রাজি। ব্যাপারটার একটা মীমাংসা না হলে আমার মানব জন্ম বৃথা।’
টেবিলে ছোট্ট একটা ঘুষি মারলাম। নাঃ, দিব্যি কথাটা বলা হয়েছে। বয় ঢুকল এমন সময়। মায়াই অর্ডার দিল। মাংসের শিঙাড়া। চা।
খেতে-খেতে মায়া বলল, ‘আপনি আগাগোড়া জানতে চান তাহলে ব্যাপারটা? যে-কোনও শর্তে রাজি?’
‘আলবত। মীনকেতন আমার বাল্যবন্ধু। তার একটা সিরিয়াস কেসের হিষ্ট্রি জানবার জন্যে আমি জান দিতে রাজি। না-শুনেই কথা দিচ্ছি, আমি আপনার শর্ত মানব। জানেন তো আমার কথার খেলাপ হয় না। না শুনেই শর্ত মেনে নিচ্ছি অর্থাৎ ব্ল্যাঙ্ক চেকে সই দিয়ে দিচ্ছি আপনাকে।’
আমি টেবিলে পুনরায় একটা ছোট্ট ঘুষি মারলাম।
মায়া চানচ দিয়ে চা নাড়তে-নাড়তে হিষ্ট্রি আউড়ে গেল। আর তারপর শর্তের নামে একটা খেলা দেখাল, মায়ার খেলা। আগে ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি, মায়ার শর্ত এমন সাংঘাতিক হতে পারে। না শুনেই যে-শর্ত আমি মানব বলে কথা দিয়েছি, সেই নিদারুণ শর্ত মানতে হল আমাকে।
সকলেই জানে, আমার কথার খেলাপ হয় না। বাল্যবন্ধুর উপকার করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আমাকে মায়ার সেই শর্তে বিয়ে করে ফেলতে হল ওই মায়াকেই। সংসার মায়াময়। মায়ার শর্ত, মায়ার খেলা।
হিস্ট্রির সবটা বলব না, কেবল একটা পয়েন্ট শুনে রাখুন। দামি পয়েন্ট। আলাপের সূত্রপাত থেকেই মীনকেতনকে মায়ার খুব ভাল লেগেছে, আর সেই থেকেই ঈশ্বরের কাছে মায়া দিবারাত্র প্রার্থনা করেছে, ‘হে ঈশ্বর, মীনকেতন যেন আমার বন্ধুর বর কিংবা বরের বন্ধু হয়।’
আমি জিজ্ঞেস করেছি, ‘কেন? বর নয় কেন?’
মায়া জবাব দিল, ‘ধ্যেৎ। বর হিসেবে মীনকেতনকে এক্কেবারে মানায় না। কিন্তু দেবর হিসেবে ও সুপার্ব, ওয়ান্ডারফুল! আমি মীনকেতনকে ‘ঠাকুরপো’ বলে ডাকব, কেমন?’
১৭ আগস্ট ১৯৫৮