মায়ামৃগ

মায়ামৃগ

এই কাহিনীটি আমার নিজস্ব নয়; অর্থাৎ মস্তিষ্কের মধ্যে ধুম বিশেষ সহযোগে ইহার উৎপত্তি হয় নাই। তাই সর্বাগ্রে নিজের সমস্ত দাবি-দাওয়া তুলিয়া লওয়া উচিত বিবেচনা করিতেছি।

যে হঠাৎ-লব্ধ বন্ধুটির মুখে এ কাহিনী শুনিয়াছিলাম, তিনি নিজের চারিধারে এমন একটি দুর্ভেদ্য রহস্যের জাল রচনা করিয়া রাখিয়াছিলেন যে তাঁহার গল্পকে ছাপাইয়া তাঁহার নিজের সম্বন্ধেই একটা প্রবল কৌতুহল আমার মনে রহিয়া গিয়াছে। মাত্র দুইবার তাঁহাকে দেখিয়াছিলাম, তারপর তিনি সহসা অন্তর্হিত হইয়া গেলেন। জানি না, এখন তিনি কোথায়। হয়তো শ্যামদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে দুরারোহ গিরিসঙ্কটের মধ্যে সেই অদ্ভুত মায়ামৃগের অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছেন। তবে নিশ্চয়ভাবে বলিতে পারি না; শুনিয়াছি বড় বড় শিকারীদের কথা একটু লবণ সহযোগে গ্রহণ করিতে হয়।

এই কাহিনী আমি যেমনটি শুনিয়াছিলাম ঠিক তেমনটিই লিপিবদ্ধ করিব। কয়েক স্থানে বুঝিতে পারি নাই, সুতরাং কাহাকেও বুঝাইতে পারিব না। ভরসা শুধু এই, যাঁহারা ইহা পড়িবেন তাঁহারা সকলেই আমা-অপেক্ষা অধিক বুদ্ধিমান, বুঝিবার মতো ইঙ্গিত কিছু থাকিলে তাঁহারা নিশ্চয় বুঝিয়া লইবেন, এবং কাহিনীটি যদি নিছক আষাঢ়ে গল্পই হয়, তাহা হইলেও তাঁহাদের ধরিয়া ফেলিতে বিলম্ব হইবে না। আমি কেবল মাছি-মারা ভাবে অবিকল পুনরাবৃত্তি করিয়া খালাস।

গত শীতকালে একদিন দুপুরবেলা হঠাৎ খেয়াল হইল পক্ষিশিকারে বাহির হইব। বড়দিনের ছুটি যাইতেছে, শীতও বেশ কন্‌কনে। বৎসরের মধ্যে ঠিক এই সময়টাতে কেন জানি না, পক্ষিজাতির উপর নিদারুণ জিঘাংসা জাগিয়া উঠে।

সঙ্গী পাইলাম না; একাই বাইসিকেল আরোহণে বাহির হইয়া পড়িলাম। শহরের চার-পাঁচ মাইলের মধ্যে একটি প্রকাণ্ড বন আছে, শস্যপুষ্ট নানাজাতীয় পক্ষী এই সময় তাহাতে ভিড় করিয়া থাকে।

সারা দুপুরটা জঙ্গলের মধ্যে মন্দ কাটিল না। কয়েকটা পাখিও জোগাড় হইল। কিন্তু অপরাহ্নে বাড়ি ফিরিবার কথা যখন স্মরণ হইল তখন দেখি, অজ্ঞাতে শিকারের সন্ধানে ঘুরিতে ঘুরিতে অনেক দূর আসিয়া পড়িয়াছি—প্রায় বারো মাইল। শরীরও বেশ ক্লান্ত হইয়াছে এবং পাকস্থলী অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে নিজের রিক্ততা ঘোষণা করিতে আরম্ভ করিয়াছে।

শীঘ্র বাড়ি পৌঁছিতে হইবে। বন হইতে পাকা সড়কে উঠিয়া গৃহাভিমুখে বাইসিকেল চালাইলাম। গৈরিক ধূলায় সমাচ্ছন্ন পথ, দু’-ধারে কখনও অড়রের ঘনপল্লব ক্ষেত, কখনও নিসিন্দের ঝাড়; কখনও বা ধুম-চন্দ্রাতপে ঢাকা ক্ষুদ্র দু’-একটা বস্তি।

যথাসম্ভব দ্রুতবেগে চলিয়াছি; আলো থাকিতে থাকিতে বাড়ি পৌঁছিতে পারিলেই ভাল; কারণ বাইসিকেলের বাতি আনিতে ভুলিয়া গিয়াছি।

দিনের আলো ক্রমে নিবিয়া আসিতে লাগিল। গো-ক্ষুর ধূলায় শীত-সন্ধ্যার অবসন্ন দীপ্তি আরও নিষ্প্রভ হইয়া গেল। এই আধা-আলো-অন্ধকারের ভিতর দিয়া নিষ্করুণ দীর্ঘ পথটা মৃত সর্পের মতো পড়িয়া আছে মনে হইল।

চার-পাঁচ মাইল অতিক্রম করিবার পর দেখিলাম হাত দুটা শীতের হাওয়ায় অসাড় হইয়া আসিতেছে; বাইসিকেলের হ্যান্ডেল ধরিয়া আছি কিনা টের পাইতেছি না। দু’-একবার ক্ষুদ্র ইটের টুকরায় ঠোকর খাইয়া পড়ি-পড়ি হইয়া বাঁচিয়া গেলাম। রাস্তার উপর কোথায় কি বিঘ্ন আছে, আর ভাল দেখিতে পাইতেছি না।

আরও কিছু দূর গিয়া বাইসিকেল হইতে নামিতে হইল দ্বিচক্রযানে আরোহণ আর নিরাপদ নয়; এই স্থানে বাইসিকেল হইতে আছাড় খাইলে অবস্থা আরও সঙ্গীন হইয়া উঠিবে।

এইবার সমস্ত চেতনাকে অবসন্ন করিয়া নিজের অবস্থাটা পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম হইল। পৌষ মাসের অন্ধকার রাত্রে ক্ষুধার্ত ক্লান্ত দেহ লইয়া গৃহ হইতে ছয়-সাত মাইল দূরে পথের মাঝখানে দাঁড়াইয়া আছি। কোথাও জনপ্রাণী নাই; সঙ্গীর মধ্যে কয়েকটা মৃত পক্ষী, একটা ভারী বন্দুক এবং ততোধিক ভারী অকর্মণ্য দ্বিচক্রযান। এইগুলিকে বহন করিয়া বাড়ি পৌঁছিতে হইবে। পথ পরিচিত বটে, কিন্তু অন্ধকারে দিগ্‌ভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম নয়। নিজের অবস্থার কথা চিন্তা করিয়া নৈরাশ্যে হাত-পা যেন শিথিল হইয়া গেল।

কিন্তু তবু দাঁড়াইয়া থাকিলে চলিবে না। দিল্লি দূর অস্ত! যেমন করিয়া হোক বাড়ি পৌঁছানো চাই! বাইসিকেল ঠেলিয়া হাঁটিতে আরম্ভ করিলাম। এই দুঃসময়েও কবির বাক্য মনে পড়িয়া গেল—

ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,

এখনি, অন্ধ, বন্ধ, ক’রো না পাখা।

কবির বিহঙ্গের অবস্থা আমার অপেক্ষাও শোচনীয় হইয়াছিল বলিয়া মনে হইল না।

বোধ হয় এক ঘণ্টা এইভাবে চলিলাম। শীতে ক্ষুধায় ক্লান্তিতে শরীর অবশ হইয়া গিয়াছিল, মনটাও সেই সঙ্গে কেমন যেন আচ্ছন্ন ও সাড়হীন হইয়া পড়িয়াছিল। হঠাৎ সচেতন হইয়া মনে হইল, পথ হারাইয়া ফেলিয়াছি; কারণ পায়ের নীচে পাকা রাস্তার কঠিন প্রস্তরময় স্পর্শ আর পাইতেছি না,—হয় কাঁচা পথে নামিয়া আসিয়াছি, নয়তো অজ্ঞাতসারেই মাঠের মাঝখানে উপস্থিত হইয়াছি। সভয়ে দাঁড়াইয়া পড়িলাম। রন্ধ্রহীন অন্ধকারে পৃথিবীর সমস্ত দৃশ্য লেপিয়া মুছিয়া একাকার হইয়া আছে—কোনও দিকে দৃষ্টি চলে না। কেবল ঊর্ধ্বে নক্ষত্রগুলা শিকারী জন্তুর নিষ্করুণ চক্ষুর মতো আমার পানে নির্নিমেষ লুব্ধতায় তাকাইয়া আছে।

এই নূতন বিপৎপাতের ধাক্কাটা সামলাইয়া লইয়া ভাবিলাম, যেদিকে হোক চলিতে যখন হইবেই তখন সামনে চলাই ভাল; পিছু ফিরিলে হয়তো আবার জঙ্গলের দিকেই চলিয়া যাইব! এটা যদি কাঁচা রাস্তাই হয় তবে ইহার প্রান্তে নিশ্চয় লোকালয় আছে। একটা মানুষের সাক্ষাৎ পাইলে আর ভাবনা নাই।

লোকালয় ও মানুষের সাক্ষাৎকার যে একেবারে আসন্ন হইয়া পড়িয়াছে তাহা তখনও বুঝিতে পারি নাই।

দু’-পা অগ্রসর হইয়াছি এমন সময় চোখের উপর একটা তীব্র আলোক জ্বলিয়া উঠিল এবং আলোকের পশ্চাৎ হইতে কড়া সুরে প্রশ্ন আসিল, ‘কে! কৌন হ্যায়?’

আলোকের অসহ্য রূঢ়তা হইতে অনভ্যস্ত চক্ষুকে বাঁচাইবার জন্য একটা হাত আপনা হইতে মুখের সম্মুখে আসিয়া আড়াল করিয়া দাঁড়াইল; তখন আরও কড়া হুকুম আসিল, ‘হাত নামাও। কে তুমি?’

হাত নামাইলাম; কিন্তু কি বলিয়া নিজের পরিচয় দিব ভাবিয়া পাইলাম না, দু’বার ‘আমি—আমি’ বলিয়া থামিয়া গেলাম।

আলোকধারী আরও কাছে আসিয়া আমাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিল। এতক্ষণে আমার চক্ষুও আলোকে অভ্যস্ত হইয়াছিল; দেখিলাম আলোকটা যত তীব্র মনে করিয়াছিলাম তত তীব্র নয়—একটা সাধারণ বৈদ্যুতিক টর্চ। আলোকধারীকেও আবছায়াভাবে দেখিতে পাইলাম, সে বাঁ-হাতে টর্চ ধরিয়াছে এবং ডান হাতে কি একটা জিনিস আমার দিকে নির্দেশ করিয়া আছে।

আলোকধারী আবার কথা কহিল, এবার সুর বেশ নরম। বলিল, ‘আপনি বাঙালী দেখছি। এ সময়ে এখানে কি করে এলেন?’

এই প্রশ্নটা আমার মনেও এতক্ষণ চাপা ছিল, পরিস্ফুট হইতে পায় নাই। আমি বলিলাম, ‘আপনিও তো বাঙালী;—এখানে কি করছেন?’

‘সে কথা পরে হবে। আপনি কেন এখানে এসেছেন আগে বলুন।’ আবার সর একটু কড়া।

ক্ষীণস্বরে বলিলাম, ‘কাছেই জঙ্গল আছে, সেখানে শিকার করতে গিয়েছিলাম, ফিরতে রাত হয়ে গেল——পথ হারিয়ে ফেলেছি।’

‘আপনার বাড়ি কোথায়?

‘মুঙ্গের, এখান থেকে চার-পাঁচ মাইল হবে।’

‘নাম কি?’

নাম বলিলাম। মনে হইল যেন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া উকিলের জেরার উত্তর দিতেছি।

কিছুক্ষণ আর কোনও প্রশ্ন হইল না। লক্ষ্য করিলাম, প্রশ্নকর্তার উদ্যত ডান হাতখানা পকেটের দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল। টর্চের আলোও আমার মুখ হইতে নামিয়া মাটির উপর একটা উজ্জ্বল চক্র সৃজন করিল।

‘আপনি নিশ্চয় বাড়ি ফিরতে চান?’

সাগ্রহে বলিলাম, ‘সে কথা আর বলতে! তবে একটা আলো না পেলে—’ প্রচ্ছন্ন অনুরোধটা অসমাপ্ত রাখিয়া দিলাম।

কিছুক্ষণ কোনও জবাব নাই। তারপর হঠাৎ তিনি বলিলেন, ‘আসুন আমার সঙ্গে। আপনি শিকারী; আমি শিকারীর ব্যথা বুঝি। বোধ হয় খুব খিদে পেয়েছে, ক্লান্তও হয়েছেন; এক পেয়ালা গরম চা বোধ করি মন্দ লাগবে না। আমি কাছেই থাকি।—আসুন।’

গরম চায়ের নামে সর্বাঙ্গ আনন্দে শিহরিয়া উঠিল। দ্বিরুক্তি না করিয়া বলিলাম, ‘চলুন।’

দুই জন পাশাপাশি চলিলাম। টর্চের রশ্মি অগ্রবর্তী হইয়া আমাদের পথ দেখাইয়া লইয়া চলিল।

বেশী দূর যাইতে হইল না, বিশ কদম যাইতে-না-যাইতে একটি ভগ্ন জরাজীর্ণ বাড়ির উপর আলো পড়িল। বাড়ি বলিলাম বটে, কিন্তু বস্তুত সেটা একটা ইট-কাঠের স্তূপ। চারিদিকে খসিয়া-পড়া ইট ছড়ানো রহিয়াছে; যেটুকু দাঁড়াইয়া আছে তাহাও জঙ্গলে, কাঁটাগাছে এমনভাবে আচ্ছন্ন যে সেখানে বাঘ লুকাইয়া থাকিলেও বিস্ময়ের কিছু নাই। একটা তরুণ অশত্থগাছ সম্মুখের ছাদহীন দালানের ভিত্তি ফাটাইয়া মাথা তুলিয়াছে এবং ভিতরে প্রবেশের পথ ঘন পল্লবে অন্তরাল করিয়া রাখিয়াছে।

বাড়িখানা সত্তর-আশী বছর আগে হয়তো কোনও স্থানীয় জমিদারের বাসভবন ছিল, তারপর বহুকাল পরিত্যক্ত থাকিয়া প্রকৃতির প্রকোপে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হইয়াছে। ভিতরে বাসোপযোগী ঘর দু-একখানা এখনও খাড়া থাকিতে পারে, কিন্তু বাহির হইতে তাহা অনুমান করিবার উপায় নাই।

বাড়ির সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সঙ্গী বলিলেন, ‘বাইসিকেল এখানে রাখুন।’—বলিয়া ভিতরে প্রবেশের উপক্রম করিলেন।

আমি আর বিস্ময় চাপিয়া রাখিতে পারিলাম না, বলিলাম, ‘আপনি এই বাড়িতে থাকেন?’

‘হ্যাঁ। আসুন।’

তাঁহার কণ্ঠস্বর পরিষ্কার বুঝাইয়া দিল যে অযথা কৌতূহল তিনি পছন্দ করেন না। আর প্রশ্ন করিলাম না, দেয়ালের গায়ে বাইসিকেল হেলাইয়া রাখিয়া তাঁহার অনুগামী হইলাম। তবু মনের মধ্যে নানা উত্তেজিত প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারিতে লাগিল। বিহারের এক প্রান্তে শহর—লোকালয় হইতে বহুদূরে একটি ভাঙা বাড়ির মধ্যে এই বাঙালী ভদ্রলোকটি কি করিতেছেন? কে ইনি! এই অজ্ঞাতবাসের অর্থ কি?

নানাপ্রকার ভাবিতে ভাবিতে তাঁহার সঙ্গে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিলাম। অভ্যন্তরের পথ কিন্তু অতিশয় কুটিল ও বিঘ্নসঙ্কুল। সদর দ্বারের অশত্থগাছ উত্তীর্ণ হইয়া দেখিলাম একটা দেয়াল ধ্বসিয়া পড়িয়া সম্মুখে দুর্লঙ্ঘ্য বাধার সৃষ্টি করিয়াছে; তাহাকে এড়াইয়া আরও কিছুদূর যাইবার পর দেখা গেল, একটা প্রকাণ্ড শালের কড়ি বক্রভাবে প্রাচীর হইতে অবতীর্ণ হইয়া মাঝখানে আগড় হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। পদে পদে কাঁটাগাছ বস্ত্র আকর্ষণ করিয়া ধরিতে লাগিল; যেন আমাদের ভিতরে যাইতে দিবার ইচ্ছা কাহারও নাই।

যাহোক, অনেক ঘুরিয়া ফিরিয়া অবশেষে এক দরজার সম্মুখে আসিয়া আমার সঙ্গী দাঁড়াইলেন। দেখিলাম দরজায় তালা লাগানো।

তালা খুলিয়া তিনি মরিচা-ধরা ভারী দরজা উদঘাটিত করিয়া দিলেন, তারপর আমাকে ভিতরে প্রবেশ করিতে ইঙ্গিত করিলেন। অন্ধকার গহ্বরের মতো ঘর দেখিয়া সহসা প্রবেশ করিতে ভয় হয়। কিন্তু চক্রব্যুহের এতটা পথ নিরাপত্তিতে আসিয়াছি, তাহার মুখ হইতে ফিরিব কি বলিয়া? বুকের ভিতর অজানা আশঙ্কায় দুরু দুরু করিয়া উঠিল—এই অজ্ঞাতকুলশীল সঙ্গীটি কেমন লোক? কোথায় আমাকে লইয়া চলিয়াছেন?

কণ্ঠের মধ্যে একটা কঠিন বস্তু গলাধঃকরণ করিয়া চৌকাঠ পার হইলাম। তিনিও ভিতরে আসিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। টর্চের আলো একবার চারিদিকে ঘুরিয়া নিবিয়া গেল।

রুদ্ধশ্বাসে অনুভব করিলাম, তিনি আমার পাশ হইতে সরিয়া গিয়া কি একটা জিনিস লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছেন। পরক্ষণেই দেশলাইয়ের কাঠি জ্বলিয়া উঠিল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল ল্যাম্পের আলোয় ঘর ভরিয়া গেল।

এতক্ষণে আমার আবছায়া সঙ্গীকে স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম। মধ্যমাকৃতি লোকটি রোগা, কিংবা মোটা কোনটাই বলা চলে না, মুখের গড়নও নিতান্ত সাধারণ,—কেবল চোখের দৃষ্টি অতিশয় গভীর, মনে হয় যেন সে-দৃষ্টির নিকট হইতে কিছুই লুকান চলিবে না। চোয়ালের হাড় দৃঢ় ও পরিপুষ্ট, গোঁফ-দাড়ি কামান—বয়স বোধ হয় চল্লিশের কাছাকাছি। পরিধানে একটা চেক-কাটা রেশমের লুঙ্গি ও পাঁশুটে রঙের মোটা কোট-সোয়েটার। তাঁহার চেহারা ও বেশভূষা দেখিয়া সহসা তাঁহার জাতি নির্ণয় করা কঠিন হইয়া পড়ে।

তাঁহার গম্ভীব সপ্রশ্ন চোখদুটি আমার মুখের উপর রাখিয়া অধরে একটু হাসির ভঙ্গিমা করিয়া তিনি বলিলেন, ‘স্বাগত। বন্দুক রাখুন।’

বন্দুক কাঁধেই ঝোলান ছিল; পাখির থলেটাও সঙ্গে আনিয়াছিলাম। সেগুলা নামাইতে নামাইতে ঘরের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। ঘরের মাঝখানে একটা প্যাকিং বাক্সকে কাত করিয়া টেবিলে পরিণত করা হইয়াছে, তাহার উপর কেরোসিন ল্যাম্প রক্ষিত। ল্যাম্পের আলোয় দেখা গেল, ঘরটি মাঝারি আয়তনের, এক কোণে পুরুভাবে খড় পাতা রহিয়াছে, ইহাই বোধ হয় বর্তমান গৃহস্বামীর শয্যা। ইহা ছাড়া ঘরে আর কোনও আসবাব নাই। ঘরের লবণ-জর্জরিত দেওয়ালগুলি যেন আপনার নিরাভরণ দীনতার কথা স্মরণ করিয়াই ক্লেদসিক্ত হইয়া উঠিয়াছে।

বন্দুক দেয়ালে হেলাইয়া রাখিলে গৃহস্বামী বলিলেন, ‘আপনার ওটা কি বন্দুক?’

বলিলাম, ‘সাধারণ শ্যট্‌-গ্যন্‌। খাঁটি দেশী জিনিস কিন্তু; এখানকারই তৈরি।’

তিনি আসিয়া বন্দুকটা তুলিয়া লইলেন। তাঁহার বন্দুক ধরার ভঙ্গি দেখিয়াই বুঝিলাম আগ্নেয়াস্ত্র-চালনায় তিনি অনভ্যস্ত নন। বন্দুকের ঘাড় ভাঙিয়া নলের ভিতর দিয়া দৃষ্টি চালাইয়া তিনি বলিলেন, ‘মন্দ জিনিস নয়তো। পঁচাত্তর গজ পর্যন্ত পরিষ্কার পাল্লা মারবে। একটু বেশী ভারী—তা ক্ষতি কী?—কই, কি পাখি মেরেছেন দেখি?’

তিনি নিজেই থলে আজাড় করিয়া পাখিগুলি বাহির করিলেন। তারপর আনন্দে বলিয়া উঠিলেন, ‘বাঃ, এ যে তিতির আর বন-পায়রা দেখছি। দুটো হরিয়ালও পেয়েছেন;—এইদিকে অনেক হরিয়াল পাওয়া যায়—আমি দেখেছি।’

দেখিলাম অকৃত্রিম শিশুসুলভ আনন্দে তাঁহার মুখ ভরিয়া গিয়াছে। এতক্ষণ আমাদের মাঝখানে যে একটা অস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবধান ছিল তাহা যেন অকস্মাৎ লুপ্ত হইয়া গেল।

পাখিগুলিকে সস্নেহে নাড়িয়া-চাড়িয়া অবশেষে তিনি সোজা হইয়া দাঁড়াইলেন, একটু লজ্জিত স্বরে বলিলেন, ‘চায়ের আশ্বাস দিয়ে আপনাকে এনে কেবল পাখিই দেখছি। আসুন, চায়ের ব্যবস্থা করি। আপনি বসুন; কিন্তু বসতে দেব কোথায়? —একটু অপেক্ষা করুন।’ তিনি দ্রুতপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গিয়া পরক্ষণেই দুটি ছোট মজবুত-গোছের প্যাকিং কেস লইয়া ফিরিয়া আসিলেন, একটিকে টেবিলের পাশে বসাইয়া এদিক-ওদিক চাহিয়া শয্যার দিকে গেলেন, সেখান হইতে একটা সাদা লোমশ আসন আনিয়া বাক্সের উপর বিছাইয়া দিয়া বলিলেন, ‘এবার বসুন।’

সাদা আস্তরণটা আমার কৌতুহল আকৃষ্ট করিয়াছিল, সেটা হাতে লইয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, কোনও জন্তুর চামড়া, ধবধবে সাদা রেশমের মতো মোলায়েম দীর্ঘ লোমে ঢাকা চামড়াটি; দেখিলেই লোভ হয়। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কিসের চামড়া?’

তিনি বলিলেন, ‘হরিণের।’

বিস্মিতভাবে বলিলাম, ‘হরিণের! কিন্তু—সাদা হরিণ?’

তিনি একটু হাসিলেন, ‘হ্যাঁ—সাদা হরিণ।’

সাদা হরিণের কথা কোথাও শুনি নাই, কিন্তু, কে জানে, থাকিতেও পারে। প্রশ্ন করিলাম, ‘কোথায় পেলেন? উত্তরমেরুর হরিণ নাকি?’

তিনি মাথা নাড়িলেন, ‘না, অতদূরের নয়, শ্যামদেশের। ওর এটা মজার ইতিহাস আছে।—কিন্তু আপনি বসুন’, বলিয়া অতিথি-সৎকারের আয়োজন করিতে লাগিলেন।

দেখা গেল তাঁহার প্যাকিং বাক্সটি কেবল টেবিল নয়, তাঁহার ভাঁড়ারও বটে। তাহার ভিতর হইতে একটি স্টোভ বাহির করিয়া তিনি জ্বালিতে প্রবৃত্ত হইলেন। চায়ের কৌটা, চিনির মোড়ক, জমানো দুধের টিন ও দুটি কলাই-করা মগ বাহির করিয়া পাশে রাখিলেন। তারপর একটি অ্যালুমিনিয়ামের ঘটিতে জল লইয়া স্টোভে চড়াইয়া দিলেন।

তাঁহার ক্ষিপ্র নিপুণ কার্যতৎপরতা দেখিতে দেখিতে আমি বলিলাম, ‘আচ্ছা, আপনি যে একজন পাকা শিকারী তা তো বুঝতে পারছি, আপনার নাম কি?’

তাঁহার প্রফুল্ল মুখ একটু গম্ভীর হইল, বলিলেন, ‘আমার নাম শুনে আপনার লাভ কি?’

‘কিছুই না। তবু কৌতূহল হয় না কি?’

‘তা বটে। মনে করুন আমার নাম-প্রমথেশ রুদ্র।’

বুঝিলাম, আসল নামটা বলিলেন না। কিছুক্ষণ নীরবে কাটিল।

তারপর সসঙ্কোচে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আপনি একলা এই ভাঙা বাড়িতে কেন রয়েছেন এ প্রশ্ন করাও ধৃষ্টতা হবে কি?’

তিনি উত্তর দিলেন না, যেন আমার প্রশ্ন শুনিতে পান নাই এমনিভাবে স্টোভে পাম্প করিতে লাগিলেন; মনে হইল তাঁহার চোখের উপর একটা অদৃশ্য পর্দা নামিয়া আসিয়াছে।

ক্ৰমে চায়ের জল স্টোভের উপর ঝিঝিপোকার মতো শব্দ করিতে আরম্ভ করিল।

তিনি সহজভাবে বলিলেন, ‘চায়ের জলও গরম হয়ে এল। কিন্তু শুধু চা খাবেন? আমার ঘরে এমন কিছু নেই যা-দিয়ে অতিথিসেবা করতে পারি। কাল রাত্রে তৈরি খানকয়েক শুকনো রুটি আছে, কিন্তু সে বোধ হয় আপনার গলা দিয়ে নামবে না।’

আমি বলিলাম, ‘ক্ষিদের সময় গলা দিয়ে নামে না এমন কঠিন বস্তু পৃথিবীতে কমই আছে। কিন্তু তা ছাড়াও ঐ পাখিগুলা তো রয়েছে। ওগুলার সৎকার করলে হয় না?’

‘ওগুলা আপনি বাড়ি নিয়ে যাবেন না?’

‘বাড়ি নিয়ে গিয়েও তো খেতেই হবে! তবে এখানে খেতে দোষ কি? পাখিগুলা একজন যথার্থ শিকারীর পেটে গিয়ে ধন্য হত।’

তিনি হাসিলেন, ‘মন্দ কথা নয়। পাখির স্বাদ ভুলেই গেছি।’ তাঁহার মুখে একটা বিচিত্র হাসি খেলিয়া গেল; যেন পাখির স্বাদ ভুলিয়া যাওয়ার মধ্যে একটা মিষ্ট কৌতুক লুক্কায়িত আছে। হাসিটি আত্মগত, আমাকে দেখাইবার ইচ্ছা বোধ হয় তাঁহার ছিল না; তাই ক্ষণেক পরে সচকিত হইয়া বলিলেন, ‘তাহলে ওগুলাকে ছাড়িয়ে ফেলা যাক—কি বলেন? নরম মাংস, আধ ঘন্টার মধ্যেই তৈরি হয়ে যাবে।’

তিনি অভ্যস্ত ক্ষিপ্রতার সহিত পাখি ছাড়াইতে লাগিলেন। আমি তাঁহার পানে তাকাইয়া বসিয়া রহিলাম। সেই পুরাতন প্রশ্নই মনে জাগিতে লাগিল—কে ইনি? লোকচক্ষুর আড়ালে লুকাইয়া শুকনা রুটি খাইয়া জীবনযাপন করিতেছেন কেন?

এক সময় তিনি সহাস্যে মুখ তুলিয়া বলিলেন, ‘আজ একটু শীত আছে। চামড়াটা বেশ গরম মনে হচ্ছে তো?’

‘চমৎকার! আচ্ছা, আপনি অনেক দেশ ঘুরেছেন—না?’

‘হ্যাঁ।’

‘প্রশ্ন করতে সাহস হয় না, তবে সম্ভবত শিকারের জন্যেই দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন?’

‘তা বলতে পারেন।’

যিনি নিজের সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলে অপ্রসন্ন হইয়া উঠেন তাঁহার সহিত অন্য কথা বলাই ভাল। তাই ইচ্ছা করিয়া শিকারের আলোচনাই আরম্ভ করিলাম, বিশেষত সাদা চামড়াটা সম্বন্ধে বেশ একটু কৌতুহলও জাগিয়াছিল।

বলিলাম, ‘শ্যামদেশে সাদা হরিণ পাওয়া যায়? কিন্তু কোথাও পড়িনি তো?’

তিনি মুখ তুলিয়া বলিলেন, ‘না পড়বারই কথা। ও হরিণ আর কেউ চোখে দেখেনি। চোখে দেখার জিনিস ও নয়।’

‘কি রকম?’

‘পৃথিবীতে যত রকম আশ্চর্য জীব আছে—ঐ হরিণ তার মধ্যে একটি। প্রকৃতির সৃষ্টিতে এর তুলনা নেই।’

‘কি ব্যাপার বলুন তো? অবশ্য সাদা হরিণ খুবই অসাধারণ, কিন্তু—’

‘আপনি কেবল সাদা চামড়টা দেখছেন। আমি কিন্তু ওকে দেখেছি সম্পূর্ণ অন্য রূপে—অর্থাৎ দেখিনি বললেই হয়।’

‘আপনি যে ধাঁধা লাগিয়ে দিলেন। কিছুই বুঝতে পারছি না।’

তিনি একটু ইতস্তত করিয়া শেষে বলিলেন, ‘অদৃশ্য প্রাণীর কথা কখনও শুনেছেন?’

‘অদৃশ্য প্রাণী! সে কি?’

‘হ্যাঁ—যাদের চোখে দেখা যায় না, চোখের সামনে যারা মরীচিকার মতো মিলিয়ে যায়। শ্যামদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে দুর্ভেদ্য পাহাড়ে ঘেরা এক উপত্যকায় আমি তাদের দেখেছি,—বিশ্বাস করছেন না? আমারও মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, তখন ওই চামড়াটা স্পর্শ করে দেখি।’

‘বড় কৌতূহল হচ্ছে; সব কথা আমায় বলবেন কি?’

তিনি একটু খামখেয়ালি হাসি হাসিলেন, বলিলেন, ‘বেশ;—চায়ের জল হয়ে গেছে, মাংসটা চড়িয়ে দিয়ে এই অদ্ভুত গল্প আরম্ভ করা যাবে। সময় কাটাবার পক্ষে মন্দ হবে না।’

চায়ের পাত্র সম্মুখে লইয়া দু’জনে মুখোমুখি বসিলাম। এক চুমুক পান করিতেই মনে হইল শরীরের ভিতর দিয়া অত্যন্ত সুখকর উত্তাপের একটা প্রবাহ বহিয়া গেল।

বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কেমন চা?’

বলিলাম, ‘চা নয়—নির্জলা অমৃত। এবার গল্প আরম্ভ করুন।’

তিনি কিছুক্ষণ শুন্যের পানে তাকাইয়া রহিলেন। ক্রমে তাঁহার চক্ষু স্মৃতিচ্ছায়ায় আবিষ্ট হইল। তিনি থামিয়া থামিয়া অসংলগ্নভাবে বলিতে আরম্ভ করিলেন।

‘গত বছর এই সময়—কিছুদিন আগেই হবে; হ্যাঁ, নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি। আমি আর আমার এক বন্ধু পাকেচক্রে পড়ে বর্মার জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে পড়েছিলুম।

‘বন্ধুটির নাম জঙ-বাহাদুর—নেপালী ক্ষত্রিয়। আমাদের লট্‌বহরের মধ্যে ছিল দুটি কম্বল আর দুটি রাইফেল। হঠাৎ একদিন মাঝরাত্রে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল তাই বেশী কিছু সঙ্গে নিতে পারিনি।

‘অফুরন্ত পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে পথঘাট সব গুলিয়ে গিয়েছিল। যেখানে মাসান্তে মানুষের মুখ দেখা যায় না, এবং শিকারের পশ্চাদ্ধাবন করা বা শিকারী জন্তুর দ্বারা পশ্চাদ্ধাবিত হওয়াই পা-চালানোর একমাত্র লক্ষ্য, সেখানে স্থান-কাল ঠিক রাখা শক্ত। আমরা শুধু পূর্বদিকটাকে সামনে রেখে আর-সব শ্রীভগবানের হাতে সমর্পণ করে দিয়ে চলেছিলুম। কোথায় গিয়ে এ যাত্রা শেষ হবে তার কোনও ঠিকানা ছিল না।

‘একদিন একটা প্রকাণ্ড নদী বেতের ডোঙায় করে পার হয়ে গেলুম। জানতেও পারলুম না যে বর্মাকে পিছনে ফেলে আর এক রাজ্যে ঢুকে পড়েছি। জানতে অবশ্য পেরেছিলুম—কয়েক দিন পরে।

‘মেকং নদীর নাম নিশ্চয় জানেন। সেই মেকং নদী আমরা পার হলুম এমন জায়গায় যেখানে তিনটি রাজ্যের সীমানা এসে মিশেছে—পশ্চিমে বর্মা, দক্ষিণে শ্যামদেশ, আর পূর্বে ফরাসী-শাসিত আনাম। এ সব খবর কিন্তু পার হবার সময় কিছুই জানতাম না।

‘মেকং পার হয়ে আমরা নদীর ধার ঘেঁষে দক্ষিণ মুখে চললুম। এদিকে পাহাড় জঙ্গল ওরই মধ্যে কম, মাঝে মাঝে দুই-একটা গ্রাম আছে। শিকারও প্রচুর। খাদ্যের অভাব নেই। জঙ-বাহাদুর এ দেশের ভাষা কিছু কিছু বোঝে, তাই রাত্রিকালে গ্রামে কোনও গৃহস্থের কুটিরে আশ্রয় নেবার সুবিধা হয়—দুর্জয় শীতে মাথা রাখবার জায়গা পাই।

‘বড় শহর বা গ্রাম আমরা যথাসাধ্য এড়িয়ে যেতুম। তবু একদিন ধরা পড়ে গেলুম। দুপুরবেলা দু’জনে একটা পাথুরে গিরিসঙ্কটের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ বাঁ-দিক থেকে কর্কশ আওয়াজে চম্‌কে উঠে দেখি, একটা লোক পাথরের চাঙড়ের আড়াল থেকে রাইফেল উঁচিয়ে আমাদের লক্ষ্য করে আছে। দিশী লোক—নাক চ্যাপ্টা, থ্যাবড়া মুখ কিন্তু তার পরিধানে সিপাহীর ইউনিফর্ম; গায়ে খাকি পোষাক, মাথায় জরির কাজ করা গোল টুপি, গায়ে পটি আর অ্যামুনিশন বুট।

‘বুঝতে বাকী রহিল না যে বিপদে পড়েছি। সিপাহী সেই অবস্থাতেই বাঁশী বাজালে; দেখতে দেখতে আরও দু’জন এসে উপস্থিত হল। তখন তারা আমাদের সামনে রেখে মার্চ করিয়ে নিয়ে চলল।

‘কাছেই তাদের ঘাঁটি। সেখানকার অফিসার আমাদের খানাতল্লাস করলেন, অনেক প্রশ্ন করলেন যার একটাও বুঝতে পারলুম না, তারপর বন্দুক আর টোটা বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে চার জন সিপাহীর জিম্মায় দিয়ে আমাদের রওনা করে দিলেন।

মাইল তিনেক যাবার পর দেখলুম এক শহরে এসে পৌঁছেছি। নদীর ধারেই শহরটি—খুব বড় নয়, কিন্তু ছবির মতো দেখতে।

‘সিপাহীরা নদীর কিনারায় একটা বড় বাংলোয় আমাদের নিয়ে হাজির করলে। এখানে শহরের সবচেয়ে বড় কর্মচারী থাকেন।

‘যথাসময়ে আমরা তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। দেখলুম তিনি একজন ফৌজী অফিসার—জাতিতে ফরাসী—বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ, তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি, গায়ের রং বহুকাল গরম দেশে থেকে তামাটে হয়ে গেছে।

‘তিনি ইংরেজী কিছু কিছু বলতে পারেন। আমার সঙ্গে প্রথমেই তাঁর খুব ভাব হয়ে গেল। ফরাসীদের মতো এমন মিশুক জাত আর আমি দেখিনি, সাদা-কালোর প্রভেদ তাদের মনে নেই। এঁর নাম কাপ্তেন দু’বোয়া। অল্পকালের মধ্যেই তিনি আমাদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ শুরু করে দিলেন। তাঁরই মুখে প্রথম জানতে পারলুম, আমরা আনাম দেশে এসে পড়েছি, নদীর ওপারে ঐ পর্বত-বন্ধুর দেশটা শ্যামরাজ্য। মেকং নদীর এই দুই রাজ্যের সীমান্ত রচনা করে বয়ে গেছে।

‘আমরা কোথা থেকে আসছি, কি উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি, এ সব প্রশ্নও তিনি করলেন। যথাসাধ্য সত্য উত্তর দিলুম। বললুম, প্রাচ্যদেশ পদব্রজে ভ্রমণ করবার অভিপ্রায়েই ব্রিটিশ রাজ্য থেকে বেরিয়েছি, পাসপোর্ট নেওয়া যে দরকার তা জানতুম না। তবে শিকার এবং দেশ-বিদেশ দেখা ছাড়া আমাদের কোনও অসাধু উদ্দেশ্য নেই।

‘নানাবিধ গল্প করতে করতে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেল। এইবার কাপ্তেন দু’বোয়া ফরাসী শিষ্টতার চরম করলেন, আমাদের নৈশ ভোজনের নিমন্ত্রণ জানালেন। শুধু তাই নয়, রাত্রে তাঁর বাড়িতে আমাদের শয়নের ব্যবস্থা হল। রাজপুরুষের এই অযাচিত সহৃদয়তা আমাদের পক্ষে যেমন অভাবনীয় তেমনিই অস্বস্তিকর।

‘রাত্রে আহারে বসে কাপ্তেন হঠাৎ এক সময় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা ব্রিটিশ ফৌজি-রাইফেল কোথায় পেলেন?’

বললুম, ‘আর্মি স্টোর থেকে মাঝে মাঝে পুরনো বন্দুক বিক্রী হয়, তাই কিনেছি।’

‘কাপ্তেন আর কিছু বললেন না।

‘অনেক রাত্রি পর্যন্ত গল্পগুজব হল। তারপর কাপ্তেন নিজে এসে আমাদের শোবার ঘরের দোর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন। অনেক দিন পরে নরম বিছানায় শয়ন করলুম।

‘কিন্তু তবু ভাল ঘুম হল না। শেষরাত্রির দিকে জঙ-বাহাদুর আমার গা ঠেলে চুপি চুপি বললে, ‘চলুন—পালাই।’

আমি বললুম, ‘আপত্তি নেই। কিন্তু দরজায় শাস্ত্রী পাহারা দিচ্ছে যে।’

‘জঙ্গ-বাহাদুর দরজা ফাঁক করে একবার উঁকি মেরে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।

‘ভোর হতে না হতে কাপ্তেন সাহেব নিজে এসে আমাদের ডেকে তুললেন। তারপর সুমিষ্ট স্বরে সুপ্রভাত জ্ঞাপন করে আমাদের নদীর ধারে বাঁধাঘাটে নিয়ে গেলেন।

‘দেখলুম, কিনারায় একটি ছোট বেতের ডোঙা বাঁধা রয়েছে, আর ঘাটের শানের উপর বারো জন রাইফেলধারী সিপাহী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

‘কাপ্তেন আমাদের করমর্দন করে বললেন, ‘আপনাদের সঙ্গ-সুখ পেয়ে আমার একটা দিন বড় আনন্দে কেটেছে। কিন্তু এবার আপনাদের যেতে হবে।’

‘পরপারের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘শ্যামরাজ্যের ঐ অংশটা বড় অনুর্বর, এক-শ মাইলের মধ্যে লোকালয় নেই। আপনাদের সঙ্গে খাবার দিয়েছি। রাইফেলও দিলাম, আর পাঁচটা কার্তুজ। এরই সাহায্যে আশা করি, আপনারা নির্বিঘ্নে লোকালয়ে পৌঁছতে পারবেন।—বঁ ভোয়াজ।’

‘আমি আপত্তি করতে গেলুম, তিনি হেসে বললেন, ‘ডোঙায় উঠুন। নদীর এপারে নামবার চেষ্টা করবেন না, তাহলে—’ সৈন্যদের দিকে হাত নেড়ে দেখালেন।

‘ডোঙায় গিয়ে উঠলুম, বারো জন সৈনিক বন্দুক তুলে আমাদের দিকে লক্ষ্য করে রইল।

‘তীর থেকে বিশ গজ দূরে ডোঙা যাবার পর আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ‘আমাদের অপরাধ কি তাও জানতে পারব না?’

‘তিনি ঘাট থেকে ভাঙা ভাঙা ইংরাজীতে বললেন, ‘আনামে ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্থান নেই।’

এই পর্যন্ত বলিয়া প্রমথেশ রুদ্র থামিলেন। তাঁহার মুখে ধীরে ধীরে একটি অদ্ভুত হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি বলিলেন, ‘একেই বলে দৈব বিড়ম্বনা। কাপ্তেন দু’বোয়া আমাদের হাতে মিলিটারি বন্দুক দেখে আমাদের ইংরেজের গোয়েন্দা মনে করেছিলেন।’

আমি বলিলাম ‘কিন্তু ইংলণ্ড আর ফ্রান্সে তো এখন বন্ধুত্ব চলছে।’

‘হুঁ—একেবারে গলাগলি ভাব। কিন্তু ওরা আজ পর্যন্ত কখনও পরস্পরকে বিশ্বাস করেনি এবং যতদিন চন্দ্রসূর্য থাকবে ততদিন করবে না। ওরা শুধু দুটো আলাদা জাত নয়, মানব-সভ্যতার দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শের প্রতীক। কিন্তু সে যাক—’ বলিয়া আবার গল্প আরম্ভ করিলেন।

‘যতক্ষণ নদী পার হলুম, সিপাহীরা বন্দুক উঁচিয়ে রইল। বুঝলাম, দুটি মাত্র পথ আছে—হয় পরপার, নয় পরলোক। তৃতীয় পন্থা নেই।

‘পরপারেই গিয়ে নামলুম। তারপর বন্দুক আর খাবারের হ্যাভারস্যাক্‌ কাঁধে ফেলে শ্যামদেশের লোকালয়ের সন্ধানে রওনা হয়ে পড়া গেল।

‘প্রায় নদীর কিনারা থেকেই পাহাড় আরম্ভ হয়েছে। আনাম-রাজ্য এবং মেকং নদী পিছনে রেখে চড়াই উঠতে আরম্ভ করলুম। পাহাড়ের পথ বন্ধুর দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু আমরা পথশ্রমে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলুম; এই পার্বত্য ভূমি যত শীঘ্র সম্ভব পার হবার জন্যে সজোরে পা চালিয়ে দিলুম।

‘দুপুরবেলা নাগাদ এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছলুম যেখান থেকে চারিদিকে অগণ্য নীরস পাহাড় ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না—গাছপালা পর্যন্ত নেই, কেবল পাথর আর পাথর।

‘বিলক্ষণ ক্ষিদে পেয়েছিল। খাবারের ঝুলি নামিয়ে দু’জনে খেতে বসলুম। ঝুলি খুলে দেখি, তাজা খাবার কিছু নেই, কেবল কতকগুলা টিনের কৌটা। যাহোক, যে-অবস্থায় পড়েছি তাতে টিনে-বন্ধ চালানি খাবারই বা ক’জন পায়?

‘কিন্তু টিনের লেবেল দেখে চক্ষুস্থির হয়ে গেল—Corned beef—গো-মাংস! পরস্পর মুখের দিকে তাকালুম। জঙ-বাহাদুর খাঁটি হিন্দু, কিছুক্ষণ মূর্তির মতো স্থির হয়ে বসে রইল, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল।

‘কোনও কথা হল না, দু’জনে আবার চলতে আরম্ভ করলুম। অখাদ্য টিনগুলা পিছনে পড়ে রইল।

‘তারপর আমাদের যে দুর্গতির অভিযান আরম্ভ হল তার বিস্তৃত বর্ণনা দিয়ে আপনাকে দুঃখ দেব না। আকাশে একটা পাখি নেই, মাটিতে অন্য জন্তু তো দূরের কথা, একটা গিরগিটি পর্যন্ত দেখতে পেলুম না। তৃষ্ণায় টাক্‌রা শুকিয়ে গেল কিন্তু জল নেই।

‘প্রথম দিনটা এক দানা খাদ্য বা এক ফোঁটা জল পেটে গেল না। রাত্রি কাটালুম খোলা আকাশের নীচে কম্বল মুড়ি দিয়ে। দ্বিতীয় দিন বেলা তিন প্রহরে একটা জন্তু দেখতে পেলুম, কিন্তু এত দূরে যে, সেটা কি জন্তু তা চেনা গেল না। কিন্তু আমাদের অবস্থা তখন এমন যে, মা ভগবতী ছাড়া কিছুতেই আপত্তি নেই। প্রায় তিন-শ গজ দূর থেকে তার উপর গুলি চালালুম—কিন্তু লাগল না। মোট পাঁচটি কার্তুজ ছিল, একটি গেল।

‘সেদিন সন্ধ্যার সময় জল পেলুম। একটা পাথরের ফাটল দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল চুঁইয়ে পড়ছে, আধ ঘণ্টায় এক গণ্ডুষ জল ধরা যায়। জঙ-বাহাদুরের মুখ ঝামার মতো কালো হয়ে গিয়েছিল, আমার মুখও যে অনুরূপ বর্ণ ধারণ করেছিল তাতে সন্দেহ ছিল না। শরীরের রক্ত তরল বস্তুর অভাবে গাঢ় হয়ে আসছিল; সেদিন জল না পেলে বোধ হয় বাঁচতুম না।

‘কিন্তু তবু শুধু জল খেয়ে বেঁচে থাকা যায় না। শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছিল, মাথাও বোধ হয় আর ধাতস্থ ছিল না। তৃতীয় দিনের ঘটনাগুলা একটানা দুঃস্বপ্নের মতো মনে আছে। একটা লালচে রঙের খরগোশ দেখতে পেয়ে তারই পিছনে তাড়া করেছিলুম—দিগ্বিদিক্‌ জ্ঞান ছিল না। খরগোশটা আমাদের সঙ্গে যেন খেলা করছিল; একেবারে পালিয়েও যাচ্ছিল না, আবার বন্দুকের পাল্লার মধ্যেও ধরা দিচ্ছিল না। তার পিছনে দুটো কার্তুজ খরচ করলুম; কিন্তু চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে, হাতও কাঁপছে, খরগোশটা মারতে পারলুম না।

‘সন্ধ্যেবেলা একটা লম্বা বাঁধের মতো পাহাড়ের পিঠের উপর খরগোশ মিলিয়ে গেল। দেহে তখন আর শক্তি নেই, বন্দুকটা অসহ্য ভারী বোধ হচ্ছে; তবু আমরাও সেখানে উঠলুম। বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়ে চলছি না, একটা অন্ধ আবেগের ঝোঁকেই খরগোশের পশ্চাদ্ধাবন করেছি। পাহাড়ের উপর উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা ঘুরে গেল, একটা সবুজ রঙের আলো চোখের সামনে ঝিলিক্‌ মেরে উঠল; তারপর সব অন্ধকার হয়ে গেল।

‘যখন মূর্ছা ভাঙল তখন রোদ উঠেছে। জঙ-বাহাদুর তখনও আমার পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আর—আর সামনেই ঠিক পাহাড়ের কোলে যত দূর দৃষ্টি যায় একটি সবুজ ঘাসে-ভরা উপত্যকা। তার বুক চিরে জরির ফিতের মতো একটি সরু পার্বত্য নদী বয়ে গেছে।

‘কিছুক্ষণ পরে জঙ-বাহাদুরের জ্ঞান হল। তখন দু’জনে দু’জনকে অবলম্বন করে টলতে টলতে পাহাড় থেকে নেমে সেই নদীর ধারে গিয়ে উপস্থিত হলুম।

‘তৃষ্ণা নিবারণ হল। আকণ্ঠ জল খেয়ে ঘাসের ওপর অনেকক্ষণ পড়ে রইলুম। আপনি এখনি চায়ের সঙ্গে অমৃতের তুলনা করছিলেন; আমরা সেদিন যে-জল খেয়েছিলুম, অমৃতও বোধ করি তার কাছে বিস্বাদ।

‘কিন্তু সে যাক-তৃষ্ণানিবারণের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুধার ভাবনা এসে জুটেছিল। তাকে মেটাই কি দিয়ে?

‘আমাদের উপত্যকার চারিদিকে তাকালুম, কিন্তু কোথাও একটি প্রাণী নেই। এখানে-ওখানে কয়েকটা গাছ যেন দলবদ্ধ হয়ে জন্মেছে, হয়তো কোন গাছে ফল ফলেছে এই আশায় উঠে বললুম—‘জঙ-বাহাদুর, চল দেখি, যদি গাছে কিছু পাই।’

‘গাছে কিন্তু ফল-ফলবার সময় নয়। একটা কুলের মতো কাঁটাওয়ালা গাছে ছয়টি ছোট ছোট কাঁচা ফল পেলুম। তৎক্ষণাৎ দু’জনে ভাগাভাগি করে উদরসাৎ করলুম। দারুণ টক্‌—কিন্তু তবু খাদ্য তো!

‘আরও ফলের সন্ধানে অন্য একটা ঝোপের দিকে চলেছি, জঙ-বাহাদুর পাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে চিৎকার করে উঠল,—ঐ—ঐ দেখুন!

‘ঘাড় ফিরিয়ে দেখি—আশ্চর্য দৃশ্য! সাদা ধবধবে একপাল হরিণ নির্ভয়ে মন্থর পদে নদীর দিকে চলেছে। সকলের আগে একটা শৃঙ্গধর মদ্দা হরিণ, তার পিছেন গুটি আট-দশ হরিণী। আমাদের কাছ থেকে প্রায় এক-শ গজ দূরে তারা যাচ্ছে।

‘কিন্তু এ দৃশ্য দেখলুম মুহূর্ত কালের জন্যে। জঙ-বাহাদুরের চিৎকার বোধ হয় তাদের কানে গিয়েছিল—তারা একসঙ্গে ঘাড় ফিরিয়ে আমাদের দিকে চাইল। তারপর এক অদ্ভুত ব্যাপার হল। হরিণগুলা দেখতে দেখতে আমাদের চোখের সামনে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

‘হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলুম; তারপর চোখ রগড়ে আবার দেখলুম। কিছু নেই—রৌদ্রোজ্জ্বল উপত্যকা একেবারে শূন্য।

‘ভয় হল। এ কি ভৌতিক উপত্যকা? না আমরাই ক্ষুধার মত্ততায় কাল্পনিক জীবজন্তু দেখতে আরম্ভ করেছি? মরুভূমিতে শুনেছি ক্ষুধা-তৃষ্ণায় উন্মাদ পান্থ মৃত্যুর আগে এমনি মায়ামূর্তি দেখে থাকে। তবে কি আমাদেরও মৃত্যু আসন্ন!

‘জঙ-বাহাদুরের দিকে চেয়ে দেখলুম, তার চোখে দুটো পাগলের মতো বিস্ফারিত। সে ত্রাস-কম্পিত স্বরে বলে উঠল—‘এ আমরা কোথায় এসেছি!’—তার ঘাড়ের রোঁয়া খাড়া হয়ে উঠল।

‘দু’জনে একসঙ্গে ভয়ে দিশাহারা চলে চলবে না! আমি জঙ-বাহাদুরকে সাহস দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলুম—কিন্তু বোঝাব কি? নিজেরই তখন ধাত ছেড়ে আসছে!

‘একটা ঘন ঝোপের মধ্যে গিয়ে বসলুম। খাবার খোঁজবার উদ্যমও আর ছিল না; অবসন্নভাবে নদীর দিকে তাকিয়ে রইলুম।

‘আধ ঘন্টা এইভাবে কেটে যাবার পর হঠাৎ একটা শব্দ শুনে চমকে উঠলুম; ঠিক মনে হল একপাল হরিণ ক্ষুরের শব্দ করে আমাদের পাশ দিয়ে দ্রুত ছুটে চলে গেল। পরক্ষণেই পিছন দিকে ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘের চিৎকার যেন বাতাসকে চিরে ছিন্নভিন্ন করে দিলে। ফিরে দেখি, প্রায় পঞ্চাশ গজ দুরে প্রকাণ্ড দুটো ধূসর রঙের নেকড়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তারা আর একবার চিৎকার করে উঠল—শিকার ফস্কে যাওয়ার ব্যর্থ গর্জন। তারপর অনিচ্ছাভরে বিপরীত মুখে চলে গেল।

‘অনেক দূর পর্যন্ত তাদের দেখতে পেলুম। এবার নূতন রকমের ধোঁকা লাগল। তাই তো! নেকড়ে দুটো তো মিলিয়ে গেল না! তবে তো আমাদের চোখের ভ্রান্তি নয়! অথচ হরিণগুলা অমন কর্পূরের মতো উবে গেল কেন? আর, এখনই যে ক্ষুরের আওয়াজ শুনতে পেলুম সেটাই বা কি?

‘ক্রমে বেলা দুপুর হল। শরীর নেতিয়ে পড়ছে, মাথা ঝিমঝিম করছে। উপত্যকায় পৌঁছানোর প্রথম উত্তেজনা কেটে গিয়ে তিন দিনের অনশন আর ক্লান্তি দেহকে আক্রমণ করেছে। হয়তো এইভাবে নিস্তেজ হতে হতে ক্রমে তৈলহীন প্রদীপের মতো নিবে যাবে।

‘নিবে যেতুমও, যদি না এই সময় একটি পরম বিস্ময়কর ইন্দ্রজাল আমাদের চৈতন্যকে নাড়া দিয়ে জাগিয়ে তুলত। অসাড়ভাবে নদীর দিকেই তাকিয়েছিলুম, সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছিল। এই সময় দেখলুম নদীর কিনারায় যেন অস্পষ্টভাবে কি নড়ছে। গ্রীষ্মের দুপুরে তপ্ত বালির চড়ার ওপর যেমন বাষ্পের ছায়াকুণ্ডলী উঠতে থাকে, অনেকটা সেই রকম। ক্রমে সেগুলো যেন আরও স্থূল আকার ধারণ করলে। তারপর ধীরে ধীরে একদল সাদা হরিণ আমাদের চোখের সামনে মূর্তি পরিগ্রহ করে দাঁড়াল।

‘মুগ্ধ অবিশ্বাসভরে চেয়ে রইলুম। এও কি সম্ভব? এরা কি সত্যিই শরীর-ধারী? তাদের দেখে অবিশ্বাস করবার উপায় নেই; সাদা রোমশ গায়ে সূর্যের আলো পিছলে পড়ছে। নিশ্চিন্ত অসঙ্কোচে তারা নদীতে মুখ ডুবিয়ে জল খাচ্ছে, নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে খেলা করছে,—কেউ বা নদীর ধারের কচি ঘাস ছিঁড়ে তৃপ্তিভরে চিবচ্ছে।

‘জঙ-বাহাদুরের কখন রাইফেল তুলে নিয়েছিল তা জানতে পারিনি, এত তন্ময় হয়ে দেখছিলুম। হঠাৎ কানের পাশে গুলির আওয়াজ শুনে লাফিয়ে উঠলুম; দেখি জঙ-বাহাদুরের হাতে রাইফেলের নল কম্পাসের কাঁটার মতো দুলছে। সে রাইফেল ফেলে দিয়ে বললে, ‘পারলাম না, ওরা মায়াবী।’

‘হরিণের দল তখন আবার অদৃশ্য হয়ে গেছে।

‘এতক্ষণে এই অদ্ভুত হরিণের রহস্য যেন কতক বুঝতে পারলুম। ওরা অশরীরী নয়, সাধারণ জীবের মতো ওদেরও দেহ আছে, কিন্তু কোনও কারণে ভয় পেলেই ওরা অদৃশ্য হয়ে যায়। খানিকক্ষণ আগে ওদের নেকড়ে তাড়া করেছিল, তখন ওদেরই অদৃশ্য পদধ্বনি আমরা শুনেছিলুম। প্রকৃতির বিধান বিচিত্র! এই পাহাড়-ঘেরা ছোট উপত্যকাটিতে ওরা অনাদি কাল থেকে আছে; সঙ্গে সঙ্গে হিংস্র জন্তুরাও আছে। তাদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার আর কোনও অস্ত্র ওদের নেই, তাই শত্রু দেখলেই ওরা অদৃশ্য হয়ে যায়।’

বক্তা আবার থামিলেন। সেই গুঢ়ার্থ হাসি আবার তাঁহার মুখে খেলিয়া গেল।

আমি মোহাচ্ছন্নের মতো শুনিতেছিলাম। অলৌকিক রূপকথাকে বাস্তব আবহাওয়ার মাঝখানে স্থাপন করিলে যেমন শুনিতে হয়, গল্পটা সেইরূপ মনে হইতেছিল; বলিলাম, ‘কিন্তু একি সম্ভব? অর্থাৎ বিজ্ঞানের দিক দিয়ে অপ্রাকৃত নয় কি?’

তিনি বলিলেন, ‘দেখুন, বিজ্ঞান এখনও সৃষ্টি-সমুদ্রের কিনারায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তীরের উপলখণ্ড কুড়িয়ে ঝুলি ভরছে—সমুদ্রে ডুব দিতে পারেনি। তা ছাড়া, অপ্রাকৃতই বা কি করে বলি? ক্যামিলিয়ন নামে একটা জন্তু আছে, সে ইচ্ছামত নিজের রং বদলাতে পারে। প্রকৃতি আত্মরক্ষার জন্য তাকে এই ক্ষমতা দিয়েছেন। বেশী দূর যাবার দরকার নেই, আজ যে আপনি হরিয়াল মেরেছেন তাদের কথাই ধরুন না। হরিয়াল একবার গাছে বসলে আর তাদের দেখতে পান কি?’

বলিলাম, ‘তা পাই না বটে। গাছের পাতার সঙ্গে তাদের গায়ের রং মিশে যায়।’

তিনি বলিলেন, ‘তবেই দেখুন, সেও তো এক রকম অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। এই হরিণের অদৃশ্য হওয়া বড়জোর তার চেয়ে এক ধাপ উঁচুতে।’

‘তারপর বলুন।’

‘ব্যাপারটা মোটামুটি রকম বুঝে নিয়ে জঙ-বাহাদুরকে বললুম, ‘ভয় নেই জঙ-বাহাদুর, ওরা মায়াবী নয়! বরং আমাদের বেঁচে থাকবার একমাত্র উপায়।’

‘একটি মাত্র কার্তুজ তখন অবশিষ্ট আছে—এই নিরুদ্দেশ যাত্রাপথের শেষ পাথেয়। এটি যদি ফস্কায় তাহলে অনশনে মৃত্যু কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।

‘টোটা রাইফেলে পুরে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে বসে রইলুম—হয়তো তারা আবার এখানে আসবে জল খেতে। কিন্তু যদি না আসে? দু’বার এইখানেই ভয় পেয়েছে—না আসতেও পারে।

‘দিন ক্রমে ফুরিয়ে এল; সূর্য পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল। জঙ-বাহাদুর কেমন যেন নিঝুম তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে বসে আছে; আমি প্রাণপণ শক্তিতে নিরাশা আর অবসাদকে দূরে ঠেলে রেখে প্রতীক্ষা করছি।

‘নদীর জলের ঝক্‌ঝকে রূপালী রং মলিন হয়ে এল, কিন্তু হরিণের দেখা নেই। নিরাশাকে আর ঠেকিয়ে রাখতে পারছি না। তারা সত্যিই পালিয়েছে, আর আসবে না।

কিন্তু প্রকৃতির বিধানে একটা সামঞ্জস্য আছে,—এমার্সন যাকে Law of compensation বলেছেন। এক দিক দিয়ে প্রকৃতি যদি কিছু কম দিয়ে ফেলেন, অন্য দিক দিয়ে অমনি তা পূরণ করে দেন। এই হরিণগুলোকে তিনি বুদ্ধি কম দিয়েছেন বলেই বোধ হয় এমন অপরূপ আত্মরক্ষার উপায় ক্ষতিপূরণ-স্বরূপ দান করেছেন। অন্ধকার হতে আর দেরি নেই এমন সময় তারা আবার ঠিক সেই জায়গায় এসে আবির্ভূত হল।

‘তাদের দেখে আমার বুক ভীষণভাবে ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। তারা আগের মতোই দলবদ্ধ হয়ে এসে—তেমনই স্বচ্ছন্দ মনে ঘাস খাচ্ছে—খেলা করছে। আমি রাইফেলটা তুলে নিলাম। পাল্লা বড়জোর পঁচাত্তর গজ, রাইফেলের পক্ষে কিছুই নয়; তবু হাত কাঁপছে, কিছুতেই ভুলতে পারছি না এই শেষ কার্তুজ—

‘নিজের রাইফেলের আওয়াজে নিজেই চমকে উঠলুম। একটা হরিণ খাড়া উঁচু দিকে লাফিয়ে উঠ্‌ল—তারপর আবার সমস্ত দল ছায়াবাজির মতো মিলিয়ে গেল।

‘শেষ কার্তুজও ব্যর্থ হল! পক্ষাঘাতগ্রস্ত অসাড় মন নিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলুম। তারপর আস্তে আস্তে চেতনা ফিরে এল। মনে হল যেখানে হরিণগুলো দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে একগুচ্ছ লম্বা ঘাস আপনা-আপনি নড়ছে।

‘কি হল! তবে কি—? ধুঁকতে ধুঁকতে দু’জনে সেখানে গেলুম।

‘বাতাস বইছে না, কিন্তু তবু ঘাসগুলো নড়ছে—যেন কোনও অদৃশ্য শক্তি তাদের নাড়াচ্ছে। ক্রমে ঘাসের আন্দোলন কমে এল। তারপর ছায়ার মতো আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল—চারিটি হরিণের ক্ষুর।

‘মরেছে! মরেছে।’—জঙ-বাহাদুর ভাঙা গলায় চিৎকার করে উঠল। আমি তখন পাগলের মতো ঘাসের উপর নৃত্য শুরু করে দিয়েছি। একটা নিরীহ ভীরু প্রাণীকে হত্যা করে এমন উৎকট আনন্দ কখনও অনুভব করিনি।

‘পনর মিনিটের মধ্যে মৃত হরিণের দেহটি পরিপূর্ণ দেখা গেল। মৃত্যু এসে তার প্রকৃত স্বরূপ আমাদের চোখের সামনে প্রকট করে দিলে।….

‘তারই চামড়ার উপর আপনি আজ বসে আছেন।’

তাঁহার গল্প হঠাৎ শেষ হইয়া গেল।

আমি বললাম, ‘তারপর?’

তিনি বললেন, ‘তারপর আর কি—শূল্য মাংস খেয়ে প্রাণ বাঁচালুম। সাত দিন পরে সেই উপত্যকার গণ্ডী পার হয়ে লোকালয়ে পৌঁছলাম। তারপর দু’মাস একাদিক্রমে হেঁটে একদিন ব্যাঙ্কক শহরে পদার্পণ করা গেল। সেখান থেকে জঙ-বাহাদুর চীনের জাহাজে চড়ল; আর আমি—; মাংসটা বোধ হয় তৈরি হয়ে গেছে।’

আহার শেষ করিয়া যখন এই ভাঙা বাড়ি হইতে বাহির হইলাম তখন রাত্রি দশটা বাজিয়া গিয়াছে।

বন্ধু আমার সঙ্গে চলিলেন। টর্চ জ্বালিলেন না, অন্ধকার আমার বাইকের একটা হাতল ধরিয়া পথ দেখাইয়া লইয়া চলিলেন।

প্রায় দশ মিনিট নীরবে চলিয়াছি। কোন্‌ দিকে চলিয়াছি তাহার ঠিকানা নাই; মনে হইতেছে যে-পথে আসিয়াছিলাম সে পথে ফিরিতেছি না।

হঠাৎ বন্ধু বলিলেন, ‘আজ সন্ধ্যাটা আমার ভাল কাট্‌ল।’

আমি বলিলাম, ‘আপনার—না আমার?’

‘আমার। মাসখানেকের মধ্যে মন খুলে কথা কইবার সুযোগ পাইনি।’

আরও পনর মিনিট নিঃশব্দে চলিলাম। তারপর তিনি আমার হাতে টর্চ দিয়া বলিলেন, ‘পাকা রাস্তায় পৌঁছে গেছেন, এখান থেকে সহজেই বাড়ি ফিরতে পারবেন। এবার বিদায়। আর বোধ হয় আমাদের দেখা হবে না।’

আমি বলিলাম, ‘সে কি! আমি আবার আসব। অন্তত আপনার টর্চটা ফেরত দিতে হবে তো।’

‘আসার দরকার নেই। এলেও আমার আস্তানা খুঁজে পাবেন না। টর্চ আপনার কাছেই থাক—একটা সন্ধ্যার স্মৃতিচিহ্ন-স্বরূপ। আমি দু’চার দিনের মধ্যেই চলে যাব।’

‘কোথায় যাবেন?’

তিনি একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, ‘তা জানি না। হয়তো আবার শ্যামদেশে যাব। এবার একটা জীবন্ত হরিণ ধরে আনবার চেষ্টা করব—কি বলেন?’

‘বেশ তো। কিন্তু—আর আমাদের দেখা হবে না?’

‘সম্ভব নয়। আচ্ছা—বিদায়।’

‘বিদায়। দুর্দিনের বন্ধু—নমস্কার।’

কিছুক্ষণ অন্ধকারে দাঁড়াইয়া থাকিয়া টর্চ জ্বালিলাম—দেখিলাম, তিনি নিঃশব্দে চলিয়া গিয়াছেন।

কিন্তু তাঁহার ভবিষ্যদ্বাণী সফল হইল না, আর একবার দেখা হইল। দিন-সাতেক পরে একদিন রাত্রি সাতটার ট্রেনে আমার এক আত্মীয়কে তুলিয়া দিতে স্টেশনে গিয়াছি—অকস্মাৎ তাঁহার সঙ্গে মুখোমুখি হইয়া গেল।

‘একি! আপনি!’

তাঁহার মাথায় একটা কান-ঢাকা টুপি; গায়ে সেই সোয়েটার ও লুঙ্গি। একটু হাসিয়া বলিলেন, ‘যাচ্ছি।’

এই সময় ঘন্টা বাজিল। স্টেশনে ভীড় ছিল; একজন তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রী প্রকাণ্ড পোঁটলাসুদ্ধ পিছন হইতে আমাকে ধাক্কা মারিল। তাল সামলাইয়া ফিরিয়া দেখি—বন্ধু নাই।

বিস্মিতভাবে এদিক-ওদিক তাকাইতেছি—দেখি আমাদের শশাঙ্কবাবু আসিতেছেন। পুলিশের ডি-এস্‌-পি হইলেও লোকটি মিশুক। পরিচয় ছিল, এড়াইতে পারিলাম না; জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি খবর? আপনি কোথায় চলেছেন?’

‘যাব না কোথাও। স্টেশনে বেড়াতে এসেছি।’—বলিয়া মৃদু হাস্যে তিনি অন্য দিকে চলিয়া গেলেন।

গাড়ি ছাড়িবার সময় হইয়া গিয়াছিল। তবু বন্ধুকে চারিদিকে খুঁজিলাম; কিন্তু এই দুই মিনিটের মধ্যে তিনি তাঁহার মায়ামৃগের মতোই এমন অদৃশ্য হইয়াছিলেন যে, আর তাঁহাকে খুঁজিয়া পাইলাম না।

তারপর হইতে এই এক বৎসরের মধ্যে তাঁহাকে দেখি নাই; আর কখনও দেখিব কিনা জানি না।

গল্প-সাহিত্যের আইন-কানুন অনুসারে এ কাহিনী বোধ হয় বহুপূর্বেই শেষ হইয়া যাওয়া উচিত ছিল। বস্তুত মায়া-হরিণের কাহিনী লিপিবদ্ধ করিতে বসিয়া দেখিতেছি, ‘ধান ভানিতে শিবের গীতই’ বেশী গাহিয়াছি; গল্পের চেয়ে গল্পের বক্তার কথাই বেশী বলিয়াছি। আমি প্রথিতযশা কথা-শিল্পী নই, এইটুকুই যা রক্ষা, নহিলে লজ্জা রাখিবার আর স্থান থাকিত না।

যাহোক, আইন-ভঙ্গ যখন হইয়াই গিয়াছে তখন আর একটু বলিব।

এই কাহিনী লেখা সমাপ্ত করিবার পর একটি চিঠি পাইয়াছি, সেই চিঠিখানি উপসংহার-স্বরূপ এই সঙ্গে যোগ করিয়া দিব।

প্রীতিনিলয়েষু,

আমাকে বোধ হয় ভোলেন নাই। শ্যামদেশে গিয়াছিলাম, কিন্তু সে হরিণ ধরিয়া আনিতে পারি নাই। বন্দী-দশায় উহারা বাঁচে না-খাইয়া মরিয়া যায়।

ইতি

শ্রী প্রমথেশ রুদ্র

চিঠিতে তারিখ বা ঠিকানা নাই। পোস্ট-অফিসের মোহরও এমন অস্পষ্ট যে কিছু পড়া যায় না।

২৮ পৌষ ১৩৪৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *