মায়ামুকুর

মায়ামুকুর

‘কাজটা ভাই খেটে খুটে তোমায় দিতেই হবে তুলে।’ বললেন বড়ো শরিক জনসন।

‘কুড়ি তারিখের মধ্যে? ওই মোটা মোটা কুড়িখানা লেজার?’— ছোটো শরিক বার্টনের কণ্ঠে হতাশার সুর, ‘সময়টা বড়োই অল্প যে স্যার!’

‘উপায় কী, বলো! কোর্ট তো সময় দিলে না আর! খাটো একটু। এই তো খাটবার বয়স হে তোমার। ভবিষ্যৎ গড়ে তোলবার সময়ই তো এই!’— জনসনের কথার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এই যে, উক্ত কুড়িখানা মোটা মোটা লেজারের ভিতর থেকে উদারস্পুন বুড়োর জালিয়াতির অকাট্য প্রমাণ যদি বার্টন খুঁজে বার করতে না-পারে, এ-কোম্পানিতে তার আর বিশেষ কিছু উন্নতির আশা থাকবে না।

হোয়াইট অ্যান্ড উদারস্পুন। খুব জোর ব্যাবসা চলছিল ওদের। হঠাৎ, এই কয়েক বছরের মধ্যেই সব আলো নিবে গেল একে একে। ব্যাবসা গুটিয়ে ফেলবার তোড়জোড় চলছে, এমন সময় এক নগণ্য অংশীদার কোর্টে দিলে নালিশ ঠুকে। তার বলার কথা এই যে, ম্যানেজিং ডিরেক্টর উদারস্পুন দেদার টাকা আত্মসাৎ করেছে কোম্পানির, সেই কারণেই বর্তমানের এই ভগ্নদশা।

কোর্ট থেকে তল্লাশ চালিয়ে সব হিসাবের খাতাই আটকে ফেলা হল। এখন সেইসব ঘাঁটাঘাঁটি করে উদারস্পুনের অপরাধের প্রমাণ যদি পাওয়া যায়, সাজা হবে বুড়োটার। আর তা যদি না পাওয়া যায়, তার খালাস কেউ খণ্ডাতে পারবে না।

জনসন অ্যান্ড জনসন— এরা হল বনেদি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। এদের উপরেই রিপোর্ট দেবার ভার চাপিয়েছে কোর্ট। দুই বড়ো কর্তা, জনসনেরা দুই ভাই, দুইজনই আয়েশি লোক। বেশি খাটতে নারাজ বলেই হালে এই ছোকরা বার্টনকে টেনে নিয়েছেন দুই-আনার অংশীদার করে। স্বভাবতই এই হিমালয়-প্রমাণ বোঝা তাঁরা ওর ঘাড়েই চাপালেন।

কাজটা যে কী প্রকাণ্ড, তা অনুধাবন করার সঙ্গে সঙ্গেই হৃৎকম্প শুরু হল বার্টনের। কুড়িখানা ইয়া-মোটা খাতা, সময় মাত্র পনেরো দিন। প্রত্যেকখানা খাতার প্রতি পৃষ্ঠার প্রতিটা অঙ্ক তাকে দেখতে হবে, মেলাতে হবে, সংগতি-অসংগতি বিচার করতে হবে, তারপর যোগ দিতে হবে। উঃ! এমন জানলে সে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হত কি না, সন্দেহ আছে।

যাহোক, হয়ে যখন বসেছে, তখন কার্যকালে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা তো আর চলে না! আখের নষ্ট হবে, সে তো এক কথা আছেই। কিন্তু বার্টনের কাছে তার চেয়েও বড়ো কথা এই যে, নিজের উপর শ্রদ্ধাটাই তার নষ্ট হয়ে যাবে এতে। তার চেয়ে বড়ো সর্বনাশ তো একটা উদ্যমশীল যুবার পক্ষে কিছুই হতে পারে না।

অতএব কুড়িখানা লেজার গাড়িতে চাপিয়ে সে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে গেল। টেবিলের নীচে সারিবন্দি করে তাদের সাজিয়ে রেখে এক নম্বর খাতাকে তুলে নিল টেবিলে। আরম্ভ হয়ে গেল মৃত্যুপণ সংগ্রাম। ‘পেরে উঠলাম না’ বলে লোক হাসাবে না বার্টন। যাক প্রাণ, ফার্মের মান সে রাখবে।

এ যেন একরকম মৃগয়া। বিশখানা লেজারের নিবিড় জঙ্গলে কোনখানে সে ধূর্ত শিকার ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে, বার করতে হবে খুঁজে খুঁজে। কাজে যতই ডুবে যায় বার্টন, ততই বেড়ে ওঠে তার উত্তেজনা। আফ্রিকার অরণ্যে সিংহ বা সুন্দরবনে বেঙ্গল টাইগার মারতে যায় যারা, তারাই সাধারণত পেয়ে থাকে এ-ধরনের উত্তেজনার আস্বাদ।

শুধু অফিসের কয় ঘণ্টার খাটুনিতে এ কাজের আর্ধেকও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তোলা যাবে না। বিকাল পাঁচটায় অফিস থেকে এসে আটটা পর্যন্ত মাথাটাকে বিশ্রাম দেয় বার্টন। ওরই মধ্যে খাওয়া-দাওয়া, অবশ্যকরণীয় সবকিছু কাজকর্ম সেরে নিতে হয় তাকে। তারপর শুরু হয় তার নৈশ অফিস। টানা পাঁচ ঘণ্টা খাটুনি আবার। রাত একটায় খাতা রেখে সে ওঠে, টলতে টলতে গিয়ে বিছানায় পড়ে, সকাল আটটা পর্যন্ত ঘুম। তারপর কোনোরকমে প্রাতরাশটি সেরে নিয়ে আবার অফিসে ছুট, গাড়িতে লেজারের গাদা।

এই হাড়ভাঙা খাটুনি দিন তিনেক খাটবার পরেই সে আবিষ্কার করে ফেলল উদারস্পুনের প্রথম গলদ। উৎসাহে সব ক্লান্তির কথা ভুলে গেল সে। ধূর্ত উদারস্পুন পাপের প্রমাণগুলো সযত্নে লুকোবারই চেষ্টা করেছে কিন্তু হিসাব যারা বোঝে, অমন কারচুপিতে তাদের ভোলানো যায় না। বার্টন হন্যে হয়ে উঠেছে, রক্তের গন্ধে হাঙরের মতো।

কিন্তু মাথাটা বড়ো বেয়াড়া গাইছে। ব্যথা-বেদনা কিছু নয়, একটা ভার-বোধ শুধু। আর মাঝে মাঝে চোখে ঝাপসা দেখা। বার্টন ভাবে, একটা ডাক্তার দেখালে কেমন হয়! কোনো ট্যাবলেট যদি সে ব্যবস্থা করে, বা কোনো টনিকের কথা বলে দেয়! এই উপসর্গগুলো চলে গেলেই বার্টন খুশি।

ব্যারাম তো তার কিছু নয়, পরিশ্রমটাই শুধু অতিরিক্ত হচ্ছে। দৈহিক হলে তবু বাঁচোয়া ছিল, এ-পরিশ্রম ছিল মস্তিষ্কের। ওই মস্তিষ্কটাকে সতেজ রাখার একটা ওষুধ যদি কেউ দেয়!

ডাক্তার সিনক্লেয়ারের সঙ্গে একটু পরিচয় আছে বার্টনের, তাঁর কাছেই সে গেল। সব শুনে তিনি বললেন, ‘ওষুধে কিছুই হবে না, তোমায় বিশ্রাম নিতে হবে। দৈনিক বারো ঘণ্টা আঁক কষব, অথচ মাথা বিগড়োবে না, এমনটা কোনোমতেই হতে পারে না। বাঁচতে চাও তো কাজকর্ম বন্ধ করে গলফ খেল গিয়ে।’

বার্টন ফিরে এল বিরক্ত হয়ে। এসব ডাক্তারের কি জ্ঞানগম্যি কিছু নেই? বিশখানা লেজার তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করার ভার নিয়ে যে বসে আছে, তাকে দেয় বিশ্রাম করার ব্যবস্থা? তাহলে তো, বাঘের তাড়া খেয়ে যে লোক প্রাণপণে ছুটছে, তাকেও ওরা বলতে পারে, ‘বাপু হে! তোমার এখন যা দরকার, তা হল পরিপূর্ণ বিশ্রাম, আর ছুটলে তোমার হার্ট বন্ধ হয়ে যাবে!’

ওষুধের চিন্তা বিসর্জন দিয়ে সে অতঃপর বীরবিক্রমে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল আবার। দু-খানা লেজার সে দেখে ফেলেছে, উদারস্পুনের কারচুপি একটা একটা করে ধরা পড়ছে তার চোখে, সযত্নে সে নোট নিচ্ছে সে-সবের। এ-সবের উপরে ভিত্তি করেই তো রিপোর্ট লিখতে হবে ওকে!

তিনখানা লেজার শেষ হল যেদিন, আবার ডাক্তার সিনক্লেয়ারের কাছে যেতে হল বার্টনকে। ঘোর অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেতে হল। মাথা খাড়া করে বসতে পারছে না আর। চোখ মুছতে হচ্ছে মহুর্মুহুঃ। ‘একটা কিছু ব্যবস্থা করো হে ডাক্তার, দোহাই তোমার।’

কিছু ওষুধ ডাক্তার দিলেন বটে, কিন্তু আগের চাইতেও কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বিদায় দিলেন ওকে, ‘এভাবে চালালে তুমি পাগল হয়ে যাবে, বলে দিচ্ছি—’

বার্টন জবাব দিয়ে এল, ‘হই পাগল হব, কাজটা আমায় তুলতেই হবে কুড়ি তারিখের আগে। সে-তারিখের আগে যদি পাগল না-হই, তাহলেই আমি খুশি।’

যথারীতি আটটার সময় এসে টেবিলে বসেছে বার্টন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে চলেছে। রাত বারোটা নাগাদ মাথার ভিতরে যেন দাপাদাপি শুরু হয়ে গেল। কিছুতেই সোজা হয়ে বসে থাকতে না-পেরে সে চেয়ারের ডান দিকে কাত হয়ে সেই দিকেই মুখ ফেরাল।

ডানদিকে দেয়ালের গায়ে আর একখানা টেবিল। নানা টুকিটাকি জিনিসই আছে তাতে, কিন্তু দেখবার মতো বস্তু একটাই, সেটি হচ্ছে মস্ত একখানা আয়না। উঁচুতে দুই ফুটের বেশি নয়, কিন্তু চওড়াতে পুরো তিন ফুট ফ্রেমটা রুপোর, সেটাও অন্তত তিন ইঞ্চির মতো চওড়া হবে।

কিন্তু আয়নাখানার বৈশিষ্ট্য হল ওর কাচ। দেখলেই মনে হবে কাচখানা বুঝি বাইরের দিকে ঠেলে বেরুতে চাইছে। তারই জন্যই বোধ হয় এ-কাচের প্রতিফলন ক্ষমতা খুব বেশি, কোনো আধুনিক আয়নার কাচে অমন পরিষ্কারভাবে কোনো ছবি ফুটে উঠতে বার্টন তো দেখেনি।

এ-আয়না যে প্রাচীনকালের, এটা নিলামওয়ালাও বলে দিয়েছিল। অবশ্য নিলাম ডাকতে বার্টন যায়নি, গিয়েছিল ওর এক বন্ধু। কিনে এনে বার্টনকে ওটা দেয়। আয়নার প্রয়োজনে নয়, বন্ধুর উপহার হিসেবেই বার্টন ওটাকে নিজের বসবার ঘরে ঠাঁই দিয়েছে।

রাত্রে আলো জ্বাললে যে-জিনিসটার ছায়া স্বভাবতই এসে পড়ে এই আয়নায়, তা হল জানালার পর্দা। কিন্তু আজ—

ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত মস্তিষ্ককে দুই মিনিট একটু জিরিয়ে নেবার সুযোগ দেবে বলে ডানদিকে কাত হয়ে যখন বার্টন ঘুরে বসেছে, তখন আয়নার দিকে তাকিয়ে সবিস্ময়ে সে লক্ষ করল যে, পর্দার ছায়া আজ পড়েনি ওর উপর।

পড়েনি বলে যে কাচ একেবারে পরিষ্কার, তাও তো নয়! কী যেন ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে ঘুরছে আয়নার ভিতরে। বার্টনের হঠাৎ মনে হল জানালার পর্দাতেই আগুন লেগেছে বুঝি। চট করে মুখটা ঘোরাল সেইদিকে। কিন্তু না তো! পর্দায় আগুন লাগেনি তো!

তবে ও ধোঁয়া কীসের? ওই যা ঘুরছে আয়নার ভিতরে? খুবই আশ্চর্য ব্যাপার তো! বার্টনের একবার সন্দেহ হল যে, সব জিনিসটাই তার দৃষ্টিবিভ্রম! ধোঁয়া আয়নায় নয়, ধোঁয়া তার মাথার ভিতরে।

কিন্তু সে অনুমানও তো সত্য বলে ধারণা করা যাচ্ছে না। ধোঁয়াগুলো সারা আয়নায় ছড়িয়ে ছিল, ক্রমে এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হতে লাগল। না, একটা নয়, দুটো জায়গায়। খুব কাছাকাছি দুটো জায়গায়। ক্রমে আকার নিতে লাগল সেই দুই জায়গার জমাটবাঁধা ধোঁয়া।

কী জিনিস ও দুটো? চোখ?

হাঁ, চোখই বটে। দুটো-চোখ। ডাগর ডাগর কালো কালো দুটো চোখ। সে চোখের পাতা কী ভারি! কী সূক্ষ্ম, সুবঙ্কিম দু-টি ভ্রূ তাদের উপরে! আর কপাল? কপালটা এত উঁচু যে বেমানান বলেই মনে হতে পারত, যদি মুখখানা নারীমুখ বলে নিঃসন্দেহ হওয়া যেত।

কিন্তু ছবিটা আবার ঝাপসা হয়ে আসে যে!

ক্ষণিক বিশ্রামের ফলেই বার্টনের মস্তিষ্ক আবার সজীব সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তার ফলেই অতীন্দ্রিয় অনুভূতির দ্বার গিয়েছে রুদ্ধ হয়ে। অন্তত তা ছাড়া এর আর কোনো ব্যাখ্যা এই মুহূর্তে মনে এল না বার্টনের।

না, আয়নাতে কোনোকিছু চিহ্ন নেই আর ক্ষণপূর্বের সেই রহস্যময় আবির্ভাবের। মসৃণ চকচকে কাচে ওদিককার জানালার পর্দাটাই প্রতিফলিত হচ্ছে আবার।

পরের দিন ডাক্তার সিনক্লেয়ারকে এই ব্যাপারটা জানানো দরকার মনে করল বার্টন। তার অতিরিক্ত মানসিক শ্রমের সঙ্গে এই ম্যাজিক দেখার কোনো সম্পর্ক আবিষ্কার করেন কি না ডাক্তার— এইটাই তার দেখবার জিনিস।

ব্যাপারখানা শুনে ডাক্তার তো রীতিমতো চমৎকৃত। তিনি বার্টনের ফ্ল্যাটে চলেই এলেন রহস্যময় আয়নাটা দেখবার জন্য!

সযত্ন পর্যবেক্ষণের ফলে আয়নার পিছনদিকে রুপোর ফ্রেমের উপরে তিনি দু-টি দাগ দেখতে পেলেন। একটি হল লাটিন ভাষায় তিনটি শব্দ ‘স্যাংক × প্যাল’, অন্যটি বল্লমের ডগার মতো তিনটি চিহ্ন। প্রথমটাতে বোঝায় পবিত্র প্রসাদ অর্থাৎ পোপের প্রাসাদ— ‘হলিরুড’, দ্বিতীয়টা ফ্রান্সের রাজপ্রতীক, তিন লিলি।

ডাক্তারকে এরপর দেখা গেল দোনোমনা। মাথার অসুখ সরাবার জন্য বার্টনের শ্রমবিরতি যে একান্ত আবশ্যক, তা তিনি এখনও জোর দিয়েই বলছেন। কিন্তু তাঁর ভাব দেখে বার্টনের সন্দেহ হল, এ-পরামর্শ সে অগ্রাহ্য করলেই ডাক্তার খুশি হবেন। অবসন্ন মস্তিষ্কই অবাস্তব চিত্র দর্শনের অনুকূল। যে-চিত্রের প্রথম রেখাপাত আজ বার্টন দেখেছে, তার পরিণতি কী হয়, জানবার জন্য ডাক্তারের অসীম আগ্রহ।

ডাক্তারের কৌতূহল যাতে চরিতার্থ হবে, সেই কাজই বার্টন করে যাচ্ছে, অর্থাৎ মস্তিষ্ককে খাটিয়ে যাচ্ছে অতিরিক্তের চেয়েও বেশি পরিমাণে। ডাক্তারের গরজে নয়, গরজটা তার নিজেরই। কুড়ি তারিখ ঘনিয়ে এসেছে, লেজার এখনও দশখানাই বাকি। উদারস্পুন বুড়োর কুকীর্তির প্রমাণ ইতিমধ্যেই সে ভুরিভুরি পেয়েছে অবশ্য, কিন্তু তা বলে বাকি দশখানা বই তো না-দেখে সে পারবে না! তন্নতন্ন করে পারীক্ষা করতে হবে ওগুলিও। তাতে আসবে ক্লান্তি, ক্লান্তি সৃষ্টি করবে আয়নার বুকে অলীক ছবি।

যেদিনই অবসাদটা বেশি আসে, সেদিনই আয়নার ছবি ফুটে ওঠে তার চোখের সামনে। ক্রমেই সে-ছবি বড়ো হচ্ছে। বিশদ, বিচিত্র হচ্ছে নব নব অংশের যোজনায়। আগে ছিল একখানিমাত্র মুখ, এখন দেখা দিয়েছে অনেকগুলি। শুধু মুখ নয়, পরিপূর্ণ অবয়ব। বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। চমকলাগানো অভিনয়ে ব্যাপৃত।

আগের মুখখানি নারীমুখ কি না, প্রথম রাতে সন্দেহ ছিল বার্টনের। সে-সন্দেহ ঘুচে গিয়েছে। নারীরই মুখ নিশ্চয়, মহীয়সী কোনো নারীর। উঁচু কপাল তাঁর মুখশ্রীকে শক্তি আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞায় মণ্ডিত করেছে। মাথায় সোনালি চুলের উপর রেশমি টুপি, তাতে মুক্তোর ঝালর লাগানো। কালো ভেলভেটের পোশাকের উপর ঠিক বুকের গোড়ায় একটা জ্বলজ্বলে হিরে, আর বসনাভ্যন্তরে সোনার একটা ক্রুশ ।

এই মূর্তির বাঁয়ে এক দীর্ঘদেহ সুবেশ পুরুষ দাঁড়িয়ে, উপবিষ্টা মহিলা কাতর অনুনয়ের দৃষ্টিতে ওই পুরুষের দিকেই তাকিয়ে আছেন। আর মহিলার পায়ের তলায় উপুড় হয়ে প্রায় শুয়ে পড়েছে বেঁটেখাটো দাড়িওয়ালা একটি লোক। তার বাঁ-হাতে ছোট্ট ছুরি একখানা, আর ডানহাত দিয়ে সে শক্ত করে চেপে ধরেছে মহিলাটির পোশাকের প্রান্ত। আশ্রয়! নিশ্চয়ই সে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি চায় মহিলার কাছে। শক্ত করে ওই যে পোশাক চেপে ধরা, ওর মানেই হল প্রাণভয়ে শরণ নেওয়া।

প্রাণের ভয় তার সত্যিই আছে। ছবি দেখে তাই মনে হয় বার্টনের। পশ্চাৎপটে অনেকগুলি আবছা মুখ, অনেকগুলি অস্পষ্ট দেহের জটপাকানো আনাগোনা। তাদের হাত যখন নড়ছে, তখন বড়ো বড়ো ছোরা আর তরোয়াল দেখা যাচ্ছে তাতে।

ব্যাপারটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাল কুড়ি তারিখের আগের রাত্রে। প্রাণপণ করে শেষ করেছে বার্টন। কিন্তু প্রাণ বুঝি সত্যিই যায়। মাথা তার ফেটে যেতে চাইছে। চোখ ফেটে রক্তই বা বুঝি বেরোয়! সে যে কেন অজ্ঞান হয়ে পড়ছে না এখনও, এ ভেবে নিজেই সে আশ্চর্য মনে করছে।

টেবিলের উপর রিপোর্ট লেখা রয়েছে। অফিসে খবর দেওয়া আছে, বার্টন যে-অবস্থায়ই থাকুক, যে-কেউ একজন এলেই রিপোর্ট নিয়ে যেতে পারবে।

নিশ্চিন্দি এখন বার্টন। মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে সে। পরে উন্মাদ হতে হয় যদি তো হবে। সে-আশঙ্কা মাথায় নিয়েই সে মাথা খাটিয়েছে এত। যা হয় হবে, আজ নিশ্চিন্দি।

 নিশ্চিন্দি হয়ে সে এইবার আয়নার দিকে তাকাল। জ্বলজ্বল করছে আয়নাখানা, আলোর মালায় ঝলমল রঙ্গমঞ্চের মতো। রঙ্গমঞ্চের অভিনয়ের মতো জীবন্ত অভিনয় হচ্ছে সেখানে। এক ভয়াবহ বিয়োগান্ত নাটকের অভিনয়। বার্টনের চোখের সামনেই একটা হত্যাকাণ্ড চলছে।

মহিলাটিকে টেনে তুলে জোর করে ধরে রেখেছেন তাঁর পাশের লম্বা পুরুষটি। মহিলাটির পায়ের কাছে উবুড় হয়ে পড়েছিল যে লোকটি, তাকেও টেনে তুলেছে অনেকগুলি লোক। এইসব লোকেরই অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি এতদিন আয়নার ভিতর পশ্চাৎপটে মাঝে মাঝে দেখেছে বার্টন। আজ এরা সমুখে এগিয়ে এসেছে। জ্যান্ত মানুষ এরা আজ, আবছা ছবি নয়। ভূশায়ী লোকটাকে টেনে তুলে তাকে ছোরার ঘা মারছে এরা সবাই। ক্রমাগত মেরেই চলেছে। রক্ত ছুটছে লোকটার সারা দেহ থেকে। ধারায় নয়, ছুটছে ফোয়ারায়। লোকটা পড়ে গেল। তবু তাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে ঘাতকেরা। মহিলাটি করছেন আর্তনাদ। দীর্ঘদেহ পুরুষ তাঁকে তখনও ধরে রেখেছেন।

আর কিছু দেখতে পেল না বার্টন। অজ্ঞান হয়ে সে চেয়ার থেকে পড়ে গেল।

জ্ঞান হল কয়েক দিন পরে, ডাক্তার সিনক্লেয়ারের নার্সিং হোমে।

আরও কয়েক দিন পরে সে ডাক্তারকে বলল তার শেষ রজনীর অভিজ্ঞতার কথা।

আরও কয়েক দিন যায়। ডাক্তার এসে একদিন বললেন, ‘ও সম্বন্ধে কিছু পড়াশোনা করেছি আমি। রুপোর আয়নাখানি স্কট রানি মেরির ছিল একদিন। থাকত তাঁরই ঘরে। সেই ঘরেই তাঁর প্রিয় পারিষদ রিজিয়োকে হত্যা করে স্কটল্যান্ডের ব্যারনেরা। আয়নায় সেই সব ছবি ধরা পড়ে। সে-ছবি ভৌতিক আয়না এখনও বুকে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে কাউকে হয়তো দেখায়।

ছবির মহিলাটিই রানি মেরি, আর তাঁর পাশের দীর্ঘদেহ পুরুষটি লর্ড ডানলি, রানির স্বামী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *