মায়ামাধুরী – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
মুঙ্গেরে গঙ্গার ধারে বহুদিনের একটি পুরোনো বাড়ি পঞ্চাশ বছর আগেও দেখা যেত। গঙ্গার ভাঙনে এখন সেই বাড়ির আর কোনো অস্তিত্বই নেই। বিরাজের দাদামশাই জামালপুরের স্টেশনমাস্টার ছিলেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর খুব কম দামে এই বাড়িটি তিনি কিনে নেন। সেই সময় এদেশে বাঙালিদের আধিপত্য ছিল খুব। বহু বাঙালির বাস ছিল ভাগলপুর, জামালপুর, মুঙ্গের প্রভৃতি অঞ্চলে। আর জলহাওয়াও ছিল খুব ভালো। যে বাড়িটি দাদামশাই কিনলেন সে বাড়ির মালিক ছিলেন বেহালা অঞ্চলের এক বিত্তবান বাঙালি। তাঁর দুই ছেলে প্রবাসী হওয়ায় তিনি এখানকার পাট চুকিয়ে কলকাতাতেই পাকাপাকিভাবে থাকা শুরু করলেন। মুঙ্গেরের এই বাড়িটা তাই পরিত্যক্ত হয়ে রইল।
বিরাজের দাদামশাই বাড়িটি জলের দামে মাত্র তিন হাজার টাকায় কিনেছিলেন। বাড়িটির একটি নামও ছিল—মায়ামাধুরী। কেন যে এই বাড়ির নাম এমন হয়েছিল তা কে জানে? দাদামশাই কিন্তু বাড়ি কেনার পর এই নামই বহাল রেখেছিলেন। কেন না নামটি তাঁর মনে ধরেছিল।
বাড়ি কেনার পর বিরাজরা মাত্র একবারই এসেছিল এই বাড়িতে। বিরাজের বয়স তখন চোদ্দো কি পনেরো। বাড়িটি দোতলা। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এর চারদিক। বাড়ির পিছনে বাগান। সেই বাগানে আম, জাম, কাঁঠাল—সহ বেশ কিছু ফুলের গাছ। টগর, কামিনি, গন্ধরাজ, চাঁপা ইত্যাদি। বাড়িটি ছিল বিরাজের মনের মতো। হাওড়া শিবপুরের ছেলে ও। এই সুন্দর পরিবেশে গঙ্গাতীরের শোভা সৌন্দর্যে মন তার একেবারেই মজে গেল। যাই হোক, প্রায় দিন পনেরো ছিল ওরা। তারপর একসময় চলে যেতেই হল। বাবার অফিস, নিজের স্কুল, পড়াশোনা এসব তো বজায় রাখতেই হবে। তাই অনেক আনন্দে মন ভরিয়ে আবার ফিরে এল স্বভূমে।
এরপর বেশ কতকগুলো বছর কোথা দিয়ে যেন কেটে গেল। দাদু—দিদার সঙ্গে চিঠিপত্রেই যা কুশল বিনিময় হত। বিরাজের মা বারবার বলতেন, ‘তোমাদের বয়স হয়েছে। আর ওখানে না থেকে বাড়ি বিক্রি করে চলে এসো এখানে।’
দাদামশাই অবশ্য মায়ের কথা জানতেন না। গঙ্গার ধারে অমন একটি বাড়ির মোহ ছেড়ে কি আসা যায়? তবে হঠাৎই একদিন মায়ের অসুখের খবর পেয়ে দু—জনেই এসে হাজির হলেন শিবপুরে। বাড়ি অবশ্য একেবারে ফাঁকা রেখে আসেননি। বনমালী নামে স্থানীয় একজন লোককে বাড়ি দেখাশোনার ভার দিয়ে তবেই এসেছিলেন। তবে এই আসাই তাঁদের শেষ আসা। কয়েকদিন পরে মা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেও সামান্য একটু জ্বর ভোগের পর দাদু—দিদা দু—জনেই প্রয়াত হলেন। মৃত্যুর আগে মেয়ের হাতে সিন্দুকের চাবি দিয়ে দিদা বলে গেলেন, ‘তোকে তো যা দেওয়ার দিয়েইছি। এ ছাড়াও আরও কিছু গয়নাপত্তর আছে আমার। কিছু ফিক্সড ডিপোজিট আর ব্যাংকের পাস বই আছে তোর ছেলের নামে নমিনি করা। ওগুলো যাতে নষ্ট না হয় তা দেখিস। নগদ কিছু টাকাও আছে। আর পারলে বাড়িটা বিক্রি করে দিস।’
দাদু—দিদার মৃত্যুর পর কাজকর্ম সব মিটে গেলে বিরাজ একদিন গোরা নামে ওর এক বন্ধুকে নিয়ে শিয়ালদা থেকে আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসে রওনা হল জামালপুরের দিকে। ঝাঁঝার কাছে তুফান মেলে সেবার ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর থেকে দিল্লির গাড়ি আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস খুবই গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন হয়। সেইসময় অবশ্য রিজার্ভেশন সিস্টেম চালু হয়নি। আর ট্রেনে এখনকার মতো এত ভিড়ভাট্টাও হত না। তাই ট্রেনে উঠে দুজনে দুটো মুখোমুখি বাক্স দখল করে যাত্রা শুরু করল।
দেশে তখন সরকার ছিল। রেলে প্রশাসন বলে একটা ব্যাপার ছিল। রেল কর্মচারীরাও ছিল সৎ। কাজে ফাঁকি দিত না। তাই পরদিন বেলা দশটা নাগাদ নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন এসে থামল জামালপুরে।
জামালপুর স্টেশনের পাশেই ভীষণদর্শন কালীপাহাড়। ঘন অরণ্যে ভরা। বাঘ, ভালুকেরও উপদ্রব ছিল খুব। পনেরো বছর বয়সে বিরাজ প্রথম এসেছিল এখানে। এখন ওর বাইশ বছর বয়স। গোরারও তাই। দু—জনেই কলেজ পড়ুয়া যুবক। এখানকার প্রকৃতি দেখে বুক কেঁপে উঠলেও ভালো লাগল খুব।
ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে এসে একটা দোকানে বসে চা পর্বটা সেরে নিল ওরা। তারপর একটা টমটম গাড়ি ভাড়া করে চলে এল গঙ্গার ধারে। এদিকে বসতি তখন খুবই কম। তবু দু—চারজনকে জিজ্ঞাসা করে মায়ামাধুরীতে হাজির হল ওরা। কিন্তু এসে দেখল দরজায় তালা। যদিও বাড়ি চিনতে ভুল হয়নি বিরাজের। পুরোনো দিনের সেই স্মৃতি কি ভোলা যায়? কিন্তু দরজায় তালা কেন? বনমালী নামে একজনের তো থাকার কথা।
বিরাজ বলল, ‘সর্বনাশ! আমার কাছে তো আলাদা কোনো চাবি নেই। এখন ঘরে ঢুকব কী করে?’
গোরা বলল, ‘একটু ওয়েট কর না। লোকটা হয়তো কোথাও গিয়েছে কিছু কেনাকাটা করতে।’
কিন্তু না। প্রায় চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করার পরও যখন কেউ এল না, তখন ওরা তালা ভাঙার জন্য ইট—পাথর কিছু খুঁজতে লাগল। এমন সময় হঠাৎই কোথা থেকে যেন একটা চাবির গোছা ঝনাৎ করে পড়ল ওদের পায়ের কাছে। দেখল এক তরুণী চাবিটা এদের দিকে ছুড়ে দিয়েই হনহন করে উধাও হয়ে গেল। তরুণী যে কে, এই চাবি কী করে এল তার কাছে কিছুই ভেবে পেল না বিরাজ।
যাইহোক, ওরা তালা খুলে ভিতরে ঢুকল। ঘর—দোরের অবস্থা দেখে বুঝল বহুদিন ঝাঁটপাট পড়েনি এখানে। বনমালী তাহলে গেল কোথায়? দাদু—দিদা বিদায় নেওয়ার পর সেকি তার দায়িত্ব পালন করেনি?
কেউ কিছু করুক না করুক এখন নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে। ওরা দোতলার একটা ঘরের তালা খুলে নিজেদের মালপত্তর রেখে কীভাবে কী করা যায় তাই নিয়ে চিন্তা করতে লাগল।
বিরাজ বলল, ‘তুই একটু বোস গোরা, আমি বাইরে বেরিয়ে দেখি এখানকার কাজকর্ম করে দেওয়ার জন্য কাউকে পাওয়া যায় কিনা। অমনি বনমালীর ব্যাপারেও একটু খোঁজখবর নিয়ে আসি।’
বিরাজ বাইরে এসে দেখল, একজন বয়স্কা মহিলা এই বাড়ির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন। বিরাজকে দেখে বললেন, এ বাড়ির কর্তা গিন্নি ফিরে এসেছেন বুঝি? তুমি ওঁদের কে হও?’
বিরাজ বলল, ‘আমি ওঁদের একমাত্র নাতি। আমার দাদু—দিদা দু—জনেই একমাস আগে গত হয়েছেন। তা ওঁরা বনমালী নামে একজনকে রেখে গিয়েছিলেন, সেই লোকটা গেছে কোথায় বলতে পারেন?
‘সে এক রাত ওই বাড়িতে থেকেই পালিয়েছে বাবা। ওই পোড়ো ভূতের বাড়িতে কেউ বাস করতে পারে? ও যেই ওদের অস্তিত্ব টের পেয়েছে অমনি ঘরের চাবি ওই ওদিকের গোয়ালাদের বাড়িতে দিয়ে ওর দেশের বাড়ি মিথিলায় চলে গেছে। তা বাবা, তোমরা চাবি পেলে কার কাছে?’
‘কোথা থেকে যেন এক মেয়ে এসে চাবিটা ছুড়ে দিয়ে চলে গেল।’
বুঝেছি, বাসনা এসেছিল। খুব ভালো মেয়ে। তা বাবা, তুমি একা এসেছ না সঙ্গে আর কেউ আছে?’
‘আমার এক বন্ধুও আছে সঙ্গে।’
‘এই ভূতের বাড়িতে তোমরা থাকতে পারবে?’
বিরাজ বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘ভূতের বাড়ি! কই একথা আগে কখনও শুনিনি তো? তা ছাড়া আমার দাদু—দিদা প্রায় আট—দশ বছর কাটিয়ে গেলেন এই বাড়িতে। তাঁদের মুখেও তো শুনিনি কিছু। কখনও কোনোরকম ভয় পাননি ওরা।’
‘কী করে পাবেন? ওঁরা যে নিত্য পুজোপাঠ করতেন, হোম যাগ করতেন। তাই কিছু টের পাননি। এর আগে যে মালিক ছিলেন পেসাদবাবু। তিনি অবশ্য বছরে একবার কি দু—বার আসতেন। দু—তিন মাস থাকতেন। তোমার দাদু—দিদা যেমন বনমালীকে রেখেছিলেন তিনিও তেমনি প্রভুদের নামে মিশ্র পরিবারের এক ব্রাহ্মণকে রেখেছিলেন এ বাড়ির বিগ্রহের সেবা পুজার জন্য। কী সুন্দর দেখতে তাকে। তা হঠাৎ একদিন কী যে ভাব এল তার মনে, ওই বাগানের কোণে যে চাঁপা গাছটা আছে তারই ডালে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল।’
বিরাজ চমকে উঠল, ‘সেকি! সুইসাইড করল?’
‘মনে হয় বাবুর দুই মেয়ে মায়া ও মাধুরীকে নিয়েই গোলমাল।’
বিরাজ বলল, ‘বুঝেছি, ওদের নামেই তাহলে এই বাড়ির নাম। কিন্তু আমরা তো জানতাম ওই বাবুর দুই ছেলে প্রবাসী হওয়ায় উনি মনের দুঃখে বাড়ি বেচে দেন আমার দাদামশাইকে। ওনার মেয়েদের কথা শুনিনি তো!’
‘হ্যাঁ, ওনার দুই ছেলে দুই মেয়ে।’
বিরাজ বলল, ‘থাক, আপনি এক কাজ করুন, আমরা দু—বন্ধুতে এসেছি। আপনি কি আমাদের জন্য এমন একজন লোকের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন যে আমাদের রান্না থেকে জল তোলা বা অন্য সব কাজ করে দেবে?’
বলতে বলতেই দেখা গেল সেই তরুণী হনহন করে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।
মহিলা বললেন, ‘ওই তো বাসনা। বনমালী ওদের ঘরেই চাবি রেখে গিয়েছিল।’
বাসনা কাছে এলে মহিলা বললেন, ‘জানিস তো এ বাড়ির কত্তাবাবা ও কত্তামা দু—জনেরই স্বর্গগত হয়েছেন।’
বাসনা বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘তাই!’
‘হ্যাঁ, ইনি ওঁদের নাতি। দেখ না কাউকে পাস কিনা যে ওদের একটু রেঁধে বেড়ে দেবে।’
বাসনা বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ দেখছি। একটু আগে আমি ওদের দেখতে পেয়ে চাবি দিয়ে গেলুম। আমি ভাবলাম কত্তামা—রা বোধ হয় পরে আসবেন।’ বলে বিরাজকে বলল, ‘আপনি ঘরে যান। আমি কাউকে না কাউকে পাঠাচ্ছি।’
বিরাজ এবার নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরে এল।
এইটুকু সময়ের মধ্যে গোরা বেশ গুছিয়ে নিয়েছে ওদের শোবার ঘরটাকে।
বিরাজ এসে বলল, ‘আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। সব ব্যবস্থা পাকা।’
গোরা বলল, ‘সত্যি বিরাজ, তুই খুব ভাগ্যবান। তোদের এই বাড়িটা যেন প্রকৃতির এক স্বর্গোদ্যানে। সামনেই বয়ে চলেছেন মা গঙ্গা। আমাদের হাওড়া কলকাতার মতো ঘোলা জলের নয়। পরিষ্কার নীল জল। আমরা যে কদিন এখানে আছি সে কদিন রোজ ওই গঙ্গায় স্নান করব। আর একটা অনুরোধ, তোরা যেন ভুলেও কখনো এই বাড়িটাকে বেচে দিস না। আমরাই বন্ধুরা মিলে যখন ইচ্ছে তখন এই বাড়িতে আসা—যাওয়া করব। তা ছাড়া বাড়ির লোকদের নিয়ে চেঞ্জেও আসব মাঝে মাঝে।’
গোরার কথা শুনে বিরাজ বলল, ‘এই বাড়ি বিক্রি করার বাসনা আমারও নেই রে।’
‘তা তোদের সেই বনমালীর কোনো খবর পেলি?’
বিরাজ গোরাকে আর সত্যি কথাটা বলল না। কারণ, যদি ও কোনো কারণে ভয় পায় তাই। তবু বলল, ‘ও বোধহয় এ বাড়িতে আর ফিরবে নারে। হঠাৎ ওর দেশ থেকে একটা তার আসায় ও সেই যে গেছে আর ফেরেনি। যাওয়ার সময় বুদ্ধি করে চাবিটা এখানকার এক গোয়ালার বাড়িতে দিয়ে গেছে। আর বলে গেছে, ও যদি দেশ থেকে না ফেরে তাহলে চাবিটা যেন কত্তাবাবু, কত্তামা এলে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।’
‘বুঝেছি। তখন যে মেয়েটা এসে চাবি দিয়ে গেল সে তাহলে ওই গোয়ালাদেরই মেয়ে।’
‘হ্যাঁ, ওর নাম বাসনা। ওই আমাদের কাজের লোকের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।’
বিরাজের কথা শেষ হওয়ামাত্র নীচের দরজায় টক টক শব্দ। ওরা ওপর থেকে নীচে এসেই দেখল বাসনা এখানকার এক এদেশীয় মহিলাকে নিয়ে অপেক্ষা করছে। মহিলার গায়ের রং মাজা কালো। বয়স খুবই কম। চব্বিশ—পঁচিশের বেশি নয়। বিবাহিতা।
বিরাজ বাসনার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই দিদিটাই বুছি আমাদের কাজ কবে দেবে?’
বাসনা বলল, ‘হ্যাঁ, এ হল লছমিদিদি। খুব ভালো মেয়ে। তবে অভাবী খুব। আপনারা দিনে একটাকা কবে ওকে দেবেন, কেমন? আর আপনাদের রাতের খাওয়ার ব্যবস্থাটা ও বিকেলের মধ্যেই করে দিয়ে চলে যাবে।’
বিরাজ বলল ‘আমাদের এখানে এতগুলো ঘর, উনি ইচ্ছে করলে এখানেও থাকতে পারেন। আমরা যে কদিন এখানে আছি, সে কদিনের জন্য নয়, বরাবরের জন্যই। ওনাকে ঘরছাড়া দিতে হবে না।’
বাসনা হেসে বলল, ‘সে পরের কথা। তা ছাড়া আপনারা দু—জন যুবপুরুষ যেখানে আছেন সেখানে একা কোনো মেয়ে কখনো থাকতে পারে? বিশেষ করে রাতের বেলা?’
বিরাজ বলল ‘না না থাকাটা ঠিক হবে না। আমি অবশ্য ওদিকটা ভেবে দেখিনি।’ তারপর লছমিকে বলল, ‘লছমিদিদি, তুমি একটু ভাঁড়ার ঘর, রান্নাঘরে ঢুকে দেখো আমাদের কাজে লাগে এমন কোনো কিছু পাও কিনা।’ বলে নীচের সব ঘরেরই দরজার তালা খুলে দিল।
বাসনা বলল, ‘আমি তাহলে আসি?’
বিরাজ বলল, ‘আসুন। আবার দেখা হবে।’
লছমিদিদি সব দেখেশুনে বলল, ‘সামান্য কয়েক মুঠো চাল ছাড়া ঘরে কিছুই নেই গো দাদাবাবু। তবে স্টোভ জ্বালানোর মতো কেরোসিন আছে অনেকটা। তুমি এখানকার কিছুই চিনবে না। তুমি যদি আমাকে ট্যাকা দাও তো আমিই সব কিনে আনতে পারি।’
বিরাজ বলল, ‘ক—টাকা দেব বলো?’
‘দশটা ট্যাকা দেও না।’
বিরাজ টাকা দিলে লছমিদিদি দুটো ব্যাগ নিয়ে দোকান বাজার করতে চলে গেল।
লছমিদিদি চলে যাওয়ার একটু পরেই বাসনা এসে হাজির। মেয়েটিকে প্রথম দেখার পরেই দারুণ ভালো লেগেছে বিরাজের। যেন সাক্ষাৎ দেবী প্রতিমা। আর তেমনই মিষ্টি চোখ—মুখের আকর্ষণ।
বাসনা হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘অতিথিদের এখনও চা সেবা হয়নি নিশ্চয়ই? হবেই বা কী করে? ঘরে তো কিছুই নেই। তা আসুন না আমাদের বাড়িতে, চা করে খাওয়াব।’
এমন প্রস্তাব অবহেলা করার নয়। তাই দু—জনেই চলল বাসনাদের বাড়িতে চা খেতে।
মায়ামাধুরী থেকে বাসনাদের বাড়ি বেশ কিছুটা তফাতে। ওরা যেতে বাসনার মা ওদের দু—জনকে পুরোনো ভাঙাচোরা বাড়ির দাওয়ায় বসিয়ে খুব যত্ন করে চা—মুড়ি খাওয়াল। ওদের জমি—জিরেত সব দেখাল। তারপর বলল, ‘যদি দুধের দরকার হয় তো বোলো, আমার মেয়ে গিয়ে দিয়ে আসবে।’
বিরাজ বলল, ‘চায়ের জন্য দুধ তো লাগবেই। মাস খানেকের মতো আছি। এখানকার খাঁটি দুধ পেলে শরীর, স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে।’
গোরা বলল, ‘আমি অবশ্যই অতদিন থাকব না। চার—পাঁচদিন থেকেই চলে যাব। আমার বোনের বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে। তবে আমার বন্ধুটি থেকে যাবে। কেন না ওর অনেক কাজ এখানে। সবকিছু গুছিয়ে, গাছিয়ে যাকে হোক বাড়িতে বসিয়ে তবেই যাবে ও।
গোরার কথা শেষ হতেই বাসনার মা একবার তাকিয়ে দেখল বাসনার দিকে। বাসনাও একবার মাকে দেখল। এই দেখাদেখির ব্যাপারটা অবশ্য নজর এড়াল না বিরাজের। মনে একটু ভয়ও হল। কী ভাগ্যিস কোনো ভৌতিক ঘটনার কথা কিছু বলে বসেনি এরা।
চা—পর্ব শেষ হলে ওরা দু—জনে ফিরে এল মায়ামাধুরীতে।
ওরা যাওয়ার একটু পরেই লছমিদিদি এল। অনেক কিছু কিছু। যাইহোক, অভ্যস্ত হাতে বেশ তৎপরতার সঙ্গে গুছিয়ে নিল সবকিছু। বলল, ‘ভাত, ডাল একটা তরকারি বানিয়ে দিচ্ছি। তোমরা ততক্ষণে গঙ্গায় গিয়ে চানটান করে এসো।
গোরা বলল, ‘তোমাদের এখানে খাট্টা দই পাওয়া যায় না?’
‘কেন পাওয়া যাবে না। ওই একটু এগিয়ে বাজারে গেলেই পাবে।’
‘ঠিক আছে, তুমি ততক্ষণ রান্না করো, আমি চট করে একটু দই নিয়ে আসি।’
লছমিদিদি বলল, ‘তোমাদের খাওয়াদাওয়া মিটলে আমি সব ঘরগুলো ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে দেব।’
‘দুপুরে তুমিও আমাদের সঙ্গে খাবে কিন্তু।’
‘সে তো খাবই। না হলে আর কোথায় খাব বলো।’
গোরা বাজারে গেলে বিরাজ বলল, ‘ঘরে তোমার কে কে আছে লছমিদিদি?’
‘আমার সোয়ামি আছে, ছেলেমেয়ে আছে। ওরা অবশ্য কেউই থাকে না আমার কাছে। ছেলেমেয়ে দুটো খুবই ছোটো। সীতাকুণ্ডের আশ্রমে জানকীমাতার কাছে মানুষ হচ্ছে ওরা। আর সোয়ামি দু—বছর আগে অসমে কাজ করতে গিয়ে আর ফেরেনি। আমি শুধু স্বামীর ভিটেটুকু আগলে পড়ে আছি।’
‘সত্যিই তুমি খুব ভালো মেয়ে। তা দিদি, আমাদের এই বাড়িতে তুমিই থেকে যাও না। তোমার ঘরটা কাউকে ভাড়া দিয়ে দাও।’
লছমিদিদি যেন একটু ভয় পেয়ে বলল, ‘এ বাড়িতে একা থাকলে, আমার খুব ভয় করবে দাদাবাবু।’
‘কেন? কীসের ভয়?’
‘এ বাড়ির অনেক বদনাম আছে। তোমাদের কত্তাবাবা—কত্তামা যে কী করে ছিলেন তা আমরা ভেবে পাই না। ওনারা তো একজনকে রেখেও গিয়েছিলেন। তা মাত্র একরাত থেকেই ভয়ে পালিয়েছে সে।’
‘কিন্তু ভয়টা কীসের?’
‘এ বাড়ির এক বামুনঠাকুর বাগানের চাঁপা গাছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলেছিল। তারপরে ওই দুই দিদির একজন বিষ খেল আর একজন সাপকাটি হয়ে মরল। ওদের আত্মারা এই বাড়ির টান ছেড়ে কোথাও যেতে পারেনি। মাঝে মাঝেই একে ওকে তাকে দেখা দেয়। রাত বিরেতে বাড়িতে উপদ্রব করে।’
ব্যাপারটা খুবই রহস্যময় মনে হল বিরাজের কাছে। ওর দাদু—দিদা এই বাড়িতে কত বছর বাস করলেন, ওরাও তো সেবার এসে প্রায় দিন পনেরোর মতো থেকে গেল, কই কোনো কিছুই তো টের পায়নি ওরা। বাগানে সাজি হাতে ফুল তুলেছে, কেউ ওদের কোনো ভয়ও দেখায়নি। অথচ দাদু—দিদা এখান থেকে চলে যাওয়ার পরই যত সব উদ্ভট গল্প। নিশ্চয়ই কেউ জলের দামে বাড়িটা কিনবে বলে এইসব রটাচ্ছে।
বিরাজ বলল, ‘ঠিক আছে। আমরা তো রয়েছি। এখন এ বাড়িতে, দেখাই যাক না কিছু হয় কী না হয়।’
‘তোমরাও কিন্তু এখানে থাকতে পারবে না দাদাবাবু। আজকের রাতটুকু থাকো, তেমন কিছু হলে অন্য কোথাও চলে যেও।’
বিরাজ বলল, ‘যদি তেমন কিছু হয় তাহলে তাই যাব। তবে এসব গল্প যেন আমার বন্ধুটির কাছে কোরো না।’
বিরাজ আর কথা না বলে বাড়ির বাইরে এসে পায়চারি করতে লাগল। ওর সবকিছুই কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে শুনল ব্রাহ্মণ যুবক প্রভুদেবের উদবন্ধনে আত্মহত্যার কথা। পরে শুনল আগের মালিকের ছেলে ছাড়াও দুই মেয়ের কথা। তাদের নাম মায়া ও মাধুরী। এখন লছমিদিদির মুখে শুনল ওই মেয়েদের একজনের বিষ খেয়ে মরার কথা, অপরজনের সাপকাটি হয়ে। হয়তো সত্যসত্যই এমন কিছু হয়েছে। তা এসব কথা কি দাদু—দিদা জানতেন না? কে জানে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে এই বাড়িতে।
একটু পরেই গোরাকে আসতে দেখা গেল কাঁচা শালপাতার ঠোঙায় দই নিয়ে। গোরার মুখ কেমন যেন গম্ভীর।
বিরাজ বলল, ‘দই পেয়েছিস।’
‘দেখতেই তো পাচ্ছিস শালপাতার ঠোঙায় দই আছে।’
‘চল, তাহলে এবার গঙ্গায় গিয়ে স্নানটা করে আসি।’
গোরা কোনো সাড়াশব্দ করল না। তবে চটপট স্নানের জন্য তৈরি হল।
ওরা দু—জনে অনেকক্ষণ ধরে গঙ্গায় স্নান করল কিন্তু গোরার মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হল না। কেমন যেন নিষ্প্রভ হয়ে রইল সে।
বিরাজ বলল, ‘হঠাৎ তুই এমন মিইয়ে গেলি কেন রে? কী হয়েছে তোর?’
গোরা বলল, ‘তুই কিন্তু আমার কাছে অনেক কিছুই গোপন করেছিস।’
‘কী ব্যাপারে বল তো?’
‘তোদের এই বাড়িতে ভূতের উপদ্রব হয়। রাতে কেউ থাকতে পারে না।’
‘ও সব মতলবি লোকেদের রটনা। তা যদি হয় তাহলে আমার দাদু—দিদা দীর্ঘদিন এই বাড়িতে বাস করলেন কী করে?’
‘সে কথা তাঁরাই বলতে পারতেন। এখন তো তাঁরা নেই, তাই স্থানীয় লোকেরা যা বলেন সেটাই বিশ্বাস করতে হয়। আমি কিন্তু আর এক মুহূর্তও এখানে থাকব না। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর সোজা চলে যাব জামালপুর। তারপর রাতের গাড়িতে বাড়ি।’
‘এটাই কি তোর সিদ্ধান্ত?’
‘হ্যাঁ। বাজারে না গেলে জানতেই পারতাম না এ বাড়ির গুপ্তকথা।’
বিরাজ বলল, ‘বেশ তো, যা ভালো বুঝিস কর। অযথা তোকে থাকতে বলে বিপদে ফেলব না। ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে যা তুই।’
এরপর দু—জনে ঘরে এসে দুপুরের খাওয়া সেরে নিল। ডাল, ভাত আর চিনি মাখিয়ে খাট্টা দই। খাওয়াদাওয়ার পর খুব ব্যস্ততার সঙ্গে গোরা ওর ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিল। তারপর বিরাজের কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, ‘কিছু মনে করিস না ভাই। ওইসবে আমার দারুণ ভয়, তাই বিদায় নিচ্ছি।’
বিরাজ হেসে বলল, ‘কিছুই মনে করব না। মন যখন চাইছে না তখন না থাকাই ভালো। তাছাড়া তুই না এলেও আমাকে তো আসতেই হত। হয়তো মা—ও আসতেন সঙ্গে। তবে সাবধানে যাস কিন্তু।’
গোরা বিদায় নিলে লছমিদিদি বলল, ‘ওই দাদাবাবু চলে গেল?’
‘হ্যাঁ। বাজারে কারা যেন ওকে ভূতের ভয় দেখিয়েছে তাই।’
‘তুমি কী করবে?’
‘আমি আমাদের বাড়ি ছেড়ে যাবই বা কোথায়? আমি থাকব। তুমি শুধু আমার জন্য খানচারেক রুটি করে দিয়ে চলে যাও। ডাল, তরকারি যা আছে তাতেই আমার রাতের খাওয়া হয়ে যাবে।’
এরপর সারাটা দুপুর, বিকেল পূর্ণ বিশ্রাম নিয়ে সন্ধের মুখে লছমিদিদিকে বিদায় দিয়ে গঙ্গার ঘাটে এসে বসল বিরাজ। এখানকার গঙ্গার শোভা সৌন্দর্য দেখে ও এমনই মোহিত হয়ে গেল যে ওর মনের মধ্যে কোনো আতঙ্কই স্থান পেল না।
সন্ধে উত্তীর্ণ হলে ও বাজারে গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে রাতে রুটির সঙ্গে খাবার জন্য একটু মিষ্টি কিনে ঘরে ফিরল। ঘরে তো ফিরল। কিন্তু ঘর যে অন্ধকার। এখানে আলোর ব্যবস্থা কী হবে সে ব্যাপারে ওর খেয়াল ছিল না। ও যখন কী করবে ভাবছে ঠিক তখনই একটা হ্যারিকেন নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল বাসনা। বলল, ‘আমি জানতাম এমনই হবে। তাই আলো নিয়ে এলাম আপনার জন্য। তা আপনার বন্ধুটি শুনলাম বিদায় নিয়েছেন।’
‘হ্যাঁ। লোকে যা ভয় দেখিয়েছে। আর কখনও থাকে?’
‘যাইহোক, আপনি না ভয় পেলেই হল। আমি চলে গেলে বাইরের দরজাটায় খিল দিয়ে আসবেন। কারও ডাকে সাড়া দেবেন না। দরজা খুলবেন না।’
বাসনা চলে গেলে বিরাজ টর্চের আলোয় দরজার কাছ পর্যন্ত এসে খিল দিয়ে গেল। এত বড়ো বাড়িতে এই ভয়ংকর নির্জনে একা থাকতে একটু যে ভয় করল না ওর তা নয়, তবু কী আর করা যাবে? থাকতে তো হবেই। শুধু তো রাতটুকু। তারপর ওর মনের মতো মেয়ে বাসনার সঙ্গ নিয়ে কয়েকটা দিন বেশ ভালোভাবেই কাটিয়ে দিতে পারবে।
সে রাতে বেশ কিছুক্ষণ শরৎবাবুর একটা বই পড়ে কাটাল ও। তারপর খেয়েদেয়ে উপরে এসে আলোর শিখাটা একটু কমিয়ে শুয়ে পড়ল টান হয়ে। শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে বাসনার কথা ভাবতে লাগল। মনে মনে এও ঠিক করল ওর দিক থেকে যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে ওকেই ওর জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেছে নেবে।
খুব ভোরে অজস্র পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙল বিরাজের। আকাশ তখনও ভালোভাবে ফর্সা হয়নি। হ্যারিকেন নিভিয়ে ও টর্চ না জ্বেলেই বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তারপর গঙ্গার দিকে তাকাতেই মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল ওর। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে বাইরের দরজা খুলতেই দেখল বাসনা ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। বলল, ‘কী মহাশয়, কাল রাতে ভূতেরা আপনাকে গলা টিপে মেরে ফেলেনি তো?’
‘মোটেই না। সত্যি, যা ভয় দেখাল সবাই। মাঝখান থেকে আমার বন্ধুটি ভয় পেয়ে পালাল।’
‘এখন তাহলে যাওয়া হচ্ছে কোথায়?’
‘ওই একটু গঙ্গার ধার থেকে ঘুরে আসি। তুমি আসবে আমার সঙ্গে?’
বাসনা হেসে গড়িয়ে বলল, ‘আমার কাজ নেই বুঝি? আমি শুধু দেখতে এলাম আপনি কতটা ভয় পেয়েছেন।’ বলেই দ্রুত উধাও হয়ে গেল।
বিরাজ এরপর সূর্য ওঠার সময় পর্যন্ত গঙ্গার ধারে বসে থেকে যখন ঘরে ফিরল তখন দেখল, লছমিদিদি চারদিক ঝাঁটপাট দিয়ে স্টোভ নিয়ে বসে আছে।
বিরাজ যেতেই বলল, ‘ওদিকে ঘড়া ভরতি জল আছে। ওই জল খাবে। দুধ এলেই চায়ের জল বসাব। তা হ্যাঁ দাদাবাবু, কাল রাতে কোনো ভয়টয় পাওনি তো?’
‘না। কীসের ভয়?’
‘ওই যে সবাই যা বলে।’
এইসব কথার মধ্যেই বাসনা এল দুধ নিয়ে। বলল, ‘লছমিদিদি আমিও একটু চা খাব গো।’
বিরাজ বলল, ‘তা তো খাবে। কিন্তু তখন তুমি ওইভাবে পালালে কেন?’
বাসনা যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল, ‘আমি। আমি তো এই আসছি।’
‘আপনি স্বপ্ন দেখেছেন।’
‘মোটেই না। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়েই দেখি তুমি।’
বাসনা একটু সময় চুপ করে থেকে বলল, ‘তবু ভালো যে রাতের অন্ধকারে আমাকে দেখেননি। কাল থেকে অত ভোরে না উঠে একটু বেলা করে উঠবেন কিন্তু।’
বিরাজ এবার বেশ বুঝতে পারল এ বাড়ির ব্যাপারস্যাপার নিয়ে যা রটনা তা মিথ্যে নয়। যাইহোক, ব্যাপারটা ও ভুলে যাবারই চেষ্টা করল।
চা—পর্ব শেষ হলে বাসনা বলল, ‘একটু পরে আসুন না আমাদের বাড়ি। ভালো ঘিয়ের হালুয়া খাওয়াব। আর মাছ, মাংস খেতে চাইলে লছমিদিদিকে টাকা দিন, ও এনে দেবে।’
লছমিদিদি বলল, ‘ও পাড়ার হাসিম বলছিল, বাবু যদি মোরগা খায় তো নিয়ে যা। বারো আনা দাম লাগবে।’
বিরাজ বলল, ‘বেশ তো, তাই হোক না।’ তারপর বাসনাকে বলল, ‘একটা গোটা মুরগির মাংস তো আমরা দু—জনে খেয়ে শেষ করতে পারব না, তুমিও যোগ দাও না আমাদের সঙ্গে? গ্র্যান্ড পিকনিক একটা হয়ে যাবে তাহলে।’
বাসনা হেসে বলল, ‘আমার আপত্তি নেই। এখন আপনি আসুন আমাদের বাড়ি। অমনি মাকেও বলে আসি। আমার মা কিন্তু আপনাকে খুব ভালো চোখে দেখেছেন।’
‘তাই বুঝি?’
‘হ্যাঁ। বলছিলেন ছেলেটা খুব ভালো রে। বড়ো ঘরের ছেলে কিন্তু কোনো দেমাক নেই।’
বিরাজের মন ভরে গেল একথা শুনে। মনে মনে ভাবল, বাসনাকে ঘিরে ওর মনোবাসনা হয়তো পূর্ণও হতে পারে। গোরাটা চলে গিয়ে ভালোই হয়েছে। সবসময় বাসনাকে ওর খুব কাছে পেতে কোনো অসুবিধেই হবে না আর।
বাসনাদের ঘরে এলে ওর মা খুব আদরযত্ন করলেন বিরাজকে। ভালো ঘিয়ের হালুয়া আর পরোটা খেতে দিলেন। তারপর চা।
বিরাজ বলল, ‘আপনি জানেন কিনা জানি না। ভূতের ভয়ে আমার বন্ধুটি কালই বিদায় নিয়েছে এখান থেকে। লছমিদিদি একটা মুরগি আনতে গেছে। আপনার বাসনা কিন্তু আজ আমাদের ওখানেই খাবে।’
মা বললেন, ‘বেশ তো বাবা, ওর মন যদি চায় তো যাক না। তা ছাড়া আর কদিনই বা আমার মেয়ে হয়ে থাকবে ও? বড়ো হয়েছে। এবার তো কারও না কারও ঘর করতে চলে যাবে। ওর ভাগ্যে যে কোনো মহাপুরুষ আছেন তা কে জানে?’
বিরাজ একবার বাসনার মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘ওর ভালোই হবে, দেখবেন।’
‘তোমার কথাই যেন সত্যি হয় বাবা।’
এরপর ওরা দু—জনে যখন মায়ামাধুরীতে ফিরে এল তখন দেখল লছমিদিদি কাকে যেন নিয়ে এসে মুরগি কেটে ছাড়াতে দিয়েছে।
বাসনাও এবার লছমিদিদির সঙ্গে রান্নার কাজে হাত লাগল। আর সেই অবসরে বিরাজ সিন্দুকের চাবি নিয়ে দোতলার একটি ঘরে গিয়ে ব্যাংকের কাগজপত্তর ইত্যাদি দেখতে লাগল। গয়নার বাক্স খুলে গয়নাও পেল অনেকগুলো। চুড়ি, বালা, হার—বেশ কয়েক ভরির।
বিরাজ যখন এইসব নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখনই একটা ট্রেতে করে চা বিস্কুট নিয়ে উপরে এল বাসনা। দেখেই বলল, ‘ও বাবা! এতসব কোথায় ছিল? কার এগুলো?’
‘আমার দিদার।’ তারপর একটু হেসে বলল, ‘তুমি রাজি থাকলে তোমারও হতে পারে।’ বাসনা লজ্জায় রাঙা মুখে ‘ধ্যাৎ’ বলে উধাও হয়ে গেল।
ওর লজ্জা দেখেই বিরাজের মনে হল বাসনা ওর দিক থেকে ডাক পেলে না করবে না।
অনেক পরে বিরাজ গঙ্গায় গেল স্নান করতে। ফিরে এসে পেট ভরে মাংস—ভাত খেল। কী সুন্দর রান্না। দারুণ তৃপ্তি হল খেয়ে।
খাওয়াদাওয়ার পর বাসনা চলে গেল ওদের বাড়িতে।
বিরাজের দিবানিদ্রা হয় না। তাই শুয়ে শুয়ে শুধুই এপাশ—ওপাশ করতে লাগল।
বিকেল হতেই বাসনা আবার এল। বলল, ‘চলুন আপনাকে আমাদের এখানকার কেল্লা দেখিয়ে আনি।’
সামনেই কেল্লা। স্পষ্ট দেখা যায়।
বিরাজ বলল, ‘চলো তবে।’
ওরা নীচে এলে লছমিদিদি ওদের চা করে খাওয়াল।
বাসনা বেশ সাজগোছ করেই এসেছিল। বিরাজও পোশাক পরিবর্তন করে অনেক আনন্দ নিয়ে চলল কেল্লা দেখতে। শুধু কেল্লা দেখা নয়, সন্ধ্যায় গঙ্গার তীরে বসে সূর্যাস্তও দেখল দু—জনে।
অনেক পরে ওরা আবার ফিরে এল মায়ামাধুরীতে।
বাসনা আর ভিতরে ঢুকল না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ‘শুনুন, আর কিন্তু একদম বাইরে বেরোবেন না। লছমিদিদি চলে গেলে দরজায় খিল দিয়ে উপরের ঘরেই থাকবেন। দিদিকে বলবেন খাবারটা আপনার ঘরেই দিয়ে আসতে। আর একটা কথা, কেউ হাজার ডাকাডাকি করলেও বাইরে বেরোবেন না। সাঁড়া দেবেন না। এমনকী আমি এলেও না।’
বাসনার কথা শুনে এবার আমার গা ছমছম করে উঠল।
বাসনা আবার বলল, ‘আজকের রাত্রিটা দেখুন। তেমন বুঝলে কাল থেকে আমাদের ঘরেই আপনার থাকার ব্যবস্থা করে দেব। বাবা কয়েকদিনের জন্য দেওঘরে গেছেন, আমাদের ঘরও ফাঁকা।’
বাসনা চলে গেলে লছমিদিদি বিরাজের রাতের খাবার গোটা চারেক রুটি আর সকালের মাংস উপরের ঘরে রেখে এল। আগের দিনের মিষ্টি তো ছিলই ঘরে। বাসনার কথামতো লছমিদিদিকে বিদায় দিয়ে উঠোনের দরজার খিল এঁটে দোতলায় শোবার ঘরে চলে এলে বিরাজ।
হ্যারিকেনের আলোয় অনেক রাত পর্যন্ত বই পড়ে একসময় খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে শুয়ে পড়ল বিরাজ। বাসনার সঙ্গে আজকের বিকেল থেকে সন্ধে পর্যন্ত কাটিয়ে দারুণ আনন্দ পেয়েছে ও। তাই ওর কথা ভাবতে ভাবতেই এক আশ্চর্য মধুরিমায় ভরে উঠল মন—প্রাণ।
রাত তখন কত তা কে জানে? হঠাৎই মেয়ে গলার এক সুললিত কণ্ঠের গানের সুরে ঘুমটা ভেঙে গেল বিরাজের। গানের সুর তো ভেসে আসছে বাগানের দিক থেকে। এত রাতে বাগানে এসে গান গায় কে?
বিরাজ আর থাকতে পারল না। পা টিপে টিপে বারান্দায় এসে বাগানের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল এক পরমাসুন্দরী কন্যা তার রূপের ছটায় বাগান আলো করে নানা ফুলে গাঁথা মালা নিয়ে গান গেয়ে গেয়ে এদিকসেদিক ঘুরছে। কোনো মেয়ের এত রূপ বিরাজ এর আগে আর কখনো দেখেনি। ওর মনে হল, এখনই বাগান গিয়ে ওর সামনে দাঁড়ায়। আরও কাছ থেকে গান শোনে। বাগান তো ওদেরই। তাই ওখানে যাওয়ার অধিকারও ওর আছে।
ও যখন বাগানে যাওয়ার কথা চিন্তা করছে তখনই একটা খিলখিল হাসির শব্দে পিছু ফিরে তাকাল। দেখল নীচে নামার সিঁড়ির কাছে আর এক রূপবর্তী মোহিনী মূর্তিতে ওর দিকে তাকিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছে।
বিরাজ বলল, ‘কে তুমি!,’
মোহিনী বলল, ‘আমি সেই।’
‘বাগানে গান গাইছে কে?’
‘কেউ তো না। কেউ নেই ওখানে।’
বিরাজ বাগানের দিকে তাকিয়ে দেখল সত্যিই সেখানে কারও কোনো অস্তিত্ব নেই। আবার পিছু ফিরে দেখল মোহিনীও উধাও। চোখের পলকে গেল কোথায় মোহিনী!
বাগানের ভিতর থেকে মোহিনীর সুরেলা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘আমি এ—খা—নে।’
বিরাজ বাগানে দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেল মোহিনীকে। একটি শ্বেত রঙ্গনের ডাল ধরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা মোহিনী হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে। ও ক্ষণবিলম্বও না করে তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নীচে। কিন্তু কোথায় মোহিনী? কেউ তো নেই।
এবার ও নিজের ভুল বুঝতে পারল। বাসনা ওকে বারবার বলেছিল কারও ডাকে সাড়া না দিতে। কিন্তু সেই ভুলই সে করে বসল। ওর সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তখন। জীবনে এই প্রথম ওর প্রেতাত্মা দর্শন। তাই আর বাগানে না থেকে ঘরের দিকেই পা বাড়াল।
হঠাৎ সুললিত কণ্ঠের এক মধুর স্তোত্রপাঠ কানে আসতেই থমকে দাঁড়াল বিরাজ। নানাবিধ সুগন্ধি ফুলের সুবাসে চারদিক তখন ম—ম করছে। ও দেখল এক দিব্যপুরুষ হাসি হাসি মুখ করে এগিয়ে আসছেন ওর দিকে। তাঁর গলায় পরমাসুন্দরীর হাতের সেই পুষ্পমাল্য। জ্যোতিষ্মান দিব্যপুরুষ কাছে এলে বিরাজ তাঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কে? এই বাগানে কেন?
দিব্যপুরুষ বললেন, ‘আমার এবং ওই যুবতির আশ্রয়স্থল এখানেই। এই বাগানের সর্বত্র আমরা সূক্ষ্মশরীরে ঘুরে বেড়াই। যারা আমাদের অস্তিত্বকে মর্যাদা দেয় আমরা তাদের দেখা দিই না। তোমার দাদু—দিদা আমাদের অস্তিত্বের কথা জানতেন। ওঁরা অত্যন্ত শুদ্ধাচারী ছিলেন। সন্ধ্যা সমাগমে তোমার দাদু এখানেই ঘাসের ওপর বসে গীতাপাঠ করতেন। দিদা গঙ্গাজল ছড়িয়ে দিয়ে ধূপধুনো দিতেন। ওঁরা নেই। অনাচারী কাউকে আমরা সহ্য করতে পারি না। তাই মাঝে মাঝে আমাদের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটিয়ে তাদের ভয় দেখাই। কারণও আছে। অযথা কারও প্রাণহানি হোক এটা আমরা চাই না। এই বাড়ির পরমায়ু বেশিদিন নয়। সে কথা জানানোর জন্যই তোমাকেও দেখা দিলাম। এখন থেকে এ বাড়ির মায়া ত্যাগ কর। যত শীঘ্র সম্ভব এখান থেকে চলে যাও।’
কথা শেষ হতেই দিব্যমূর্তিও মিলিয়ে গেলেন।
বিরাজ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। আঁধারের আবছা ভাব কেটে গিয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠছে তখন।
এরপর ঘরে এসে চোখেমুখে একটু জল দিয়েই বাসনাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল বিরাজ।
এত ভোরে ওকে এইভাবে আসতে দেখে বাসনা ও মা দু—জনেই এগিয়ে এল ওর দিকে।
বাসনা বলল, ‘কী হল আপনার? এত ভোরে আমি না ঘর থেকে বেরোতে বারণ করেছিলাম। নিশ্চয়ই কোনো ভয়ের ব্যাপার হয়েছে?’
বিরাজ বলল, ‘তেমন কিছু নয়। আগে আমাকে এক কাপ চা খাওয়াও তো দেখি।’
সঙ্গে সঙ্গে চায়ের ব্যবস্থা হল।
চা খেতে খেতেই বিরাজ রাতের ঘটনার কথা প্রকাশ করল ওদের কাছে। তারপর বাসনার মাকে বলল, ‘আজ আর লছমিদিদির রান্না নয়, এ বাড়িতেই দুপুরের অতিথি হব আমি। আপনার হাতের রান্নাই খাব আমি আজ।’
বাসনার মা বলল, ‘এ তো খুবই আনন্দের কথা বাবা।’
বিরাজ এবার অসংকোচ বলল, ‘একটু বেলায় এখানকার পোস্ট অফিসে গিয়ে বাড়িতে একটা তার করে দিয়ে আসব। আপনাদের অমত না থাকলে আমার মা বাবা দুজনেই এসে আশীর্বাদ করে যাবেন বাসনাকে।’
আনন্দে অভিভূত বাসনার মা আঁচলের খুঁটে চোখের জল মুছলেন।
বাসনাও প্রথমে ওর মাকে পরে গলায় আঁচল দিয়ে বিরাজকে প্রণাম করল।