মায়াবৃক্ষ

মায়াবৃক্ষ

“So comes snow after fire–and even dragons have their endings.” J.R.R. Tolkien (The Hobbit)

(শূন্য)

জঙ্গলের ভিতর অন্ধকার ঘনিয়েছে৷ একটা আকাশ-ছোঁয়া পপলার গাছের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে একটা বছর দশেকের বাচ্চা মেয়ে৷ দুটো হাত বুকের কাছে জড়ো৷ অস্ফুটস্বরে কিছু উচ্চারণ করার চেষ্টা করছে৷

জঙ্গলের ভিতর কোনও শব্দ নেই৷ গাছের পাতাগুলো পর্যন্ত কী এক আশঙ্কায় স্থির হয়ে আছে৷ একটা মন্ত্র পড়তে চাইছে মেয়েটা, অজানা কোনও মন্ত্র৷

আচমকা সেই অস্ফুট শব্দ ছাপিয়ে অন্য একটা শব্দ শোনা যায়৷ অজানা ভাষায় সুরেলা গান গাইছে কেউ৷ যে গাছটার সামনে মেয়েটা বসে ছিল, তার কাণ্ডটা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে দু-পাশে৷ কাণ্ডের ভিতর থেকে অন্ধকার মেখে বেরিয়ে আসছে কেউ৷ কয়েক লক্ষ বছর কাণ্ডের ভিতরেই ঘুমিয়ে ছিল সে৷ মানুষের মতো দেহ৷ নারীদেহ৷

ভারী মিষ্টি গানটা৷ হাঁটু গেড়ে বসে থাকা মেয়েটার ঘুম পায়, চোখ বুজে আসে৷ পরক্ষণে চোখ খুলেই ছিটকে সরে আসে৷ ওর মুখের ঠিক সামনেই দুটো বিরাট হলদে চোখ জ্বলজ্বল করছে৷

মেয়েটা কথা বলতে চায়, কিন্তু তার গলা বুজে গেছে এতক্ষণে৷ সেই মানুষের মতো প্রাণীটা ঝুঁকে পড়েছে ওর মুখের উপরে৷ হলদে জ্বলন্ত চোখে ওর মুখের দিকে চেয়ে গান গেয়ে চলেছে ক্রমাগত৷ এ গান অন্য কোনও জগতের, স্বর্গের কিংবা অজ্ঞাত কোনও নরকের৷

(এক)

দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই একটা চেনা গন্ধ নাকে এল অনীশের৷ মিষ্টি ফুলের গন্ধ৷ ঘরময় ছড়িয়ে রয়েছে৷ কাচের জানালা ভেদ করে মিহি শীতের রোদ চাদরের মতো এসে পড়ছে ঘরের ভিতর৷ সেই আলোতেই সবার আগে অনীশের চোখ পড়ল বিছানার উপর শুয়ে থাকা একটা বছর দশেকের বাচ্চা মেয়ের উপর৷ বুক অবধি চাদর টানা৷ মাথার পাশেই পড়ে আছে একটা গোলাপি রঙের খাতা৷

শর্মিলা এগিয়ে গিয়ে বসে মেয়েটার মাথার কাছে৷ মৃদু ঠেলা দেয়, ‘বীণা, এই বীণা, ওঠ৷’

চোখের উপর হাত ঘষতে ঘষতে উঠে বসে মেয়েটা৷ আধো-চোখে একবার মায়ের দিকে, একবার অনীশের দিকে তাকায়৷ অনীশ জানে বীণা কথা বলতে পারে না৷ তবে শুনতে পায়৷

—‘এখন থেকে অনিদাদা থাকবে আমাদের সঙ্গে, দেখ৷’ আঙুল তুলে অনীশকে দেখিয়ে দেয় শর্মিলা, ‘ওকে তোর আঁকাগুলো দেখা তো!’

বীণাকে খুব একটা উৎসাহিত দেখায় না৷ শর্মিলাই আগ বাড়িয়ে কাছে ডেকে নেয় অনীশকে, ‘লজ্জা কীসের? আয়,’

অনীশ কথা না বাড়িয়ে এসে বসে বিছানার উপরে৷ বাচ্চা মেয়েটা চোখ দিয়ে তাকে আর একবার জরিপ করে আঁকার খাতাটা তুলে দেয় হাতে, ‘খুলে দ্যাখ, কী সুন্দর আঁকতে পারে ও, তোকেও শিখিয়ে দেবে৷ কী রে, শেখাবি তো?’

মেয়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে শর্মিলা৷ বীণা একপাশে ঘাড় নেড়ে দেয়৷ অনীশ আঁকার খাতাটা উলটে দেখতে থাকে৷ এইটুকু মেয়ের ভারী চমৎকার আঁকার হাত! তবে মানুষজন খুব একটা বেশি আঁকেনি৷ বেশিরভাগই রূপকথার চরিত্র৷ লম্বাটে ধরনের চেহারা, ডাগর চোখ, ফিনফিনে লম্বা হাত এবং সমস্ত চরিত্রই মেয়ে৷

আর কয়েকটা পাতা উলটে অনীশ দেখল, কিছু অদ্ভুতুড়ে গাছপালার ছবিও আঁকা আছে তাতে৷ কোনও রূপকথার বই দেখে এঁকেছে কি? ডায়েরিটা বন্ধ করে আগের জায়গাতেই রেখে দিল, চাপা গলায় বলল, ‘বাঃ৷ খুব সুন্দর৷’

—‘তুমি একটু এখানে বসো৷ আমি জগদীশের সঙ্গে কথা বলে আসি, কেমন?’ কথাটা বলে উঠে চলে গেল শর্মিলা৷ অনীশ চেয়ে দেখল বীণা এখনও অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে৷

—‘কী?’ ধরা গলাতেই প্রশ্ন করল অনীশ৷ এক মুহূর্তের জন্যে যেন থতমত খেয়ে গেল মেয়েটা৷ তারপর আঁকার খাতাটা বুকে চেপে ধরে শুয়ে পড়ল পাশ ফিরে৷

অনীশের বয়স সতেরো বছর ছ-মাস আঠেরো দিন৷ তবে এক ঝলক দেখলে স্বাভাবিকের থেকে বেশ খানিকটা বাচ্চা দেখায়৷ চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা৷ টিকালো নাক৷ ছিপছিপে চেহারা৷ কুচকুচে কালো মাথার চুল ভ্রু স্পর্শ করে থাকে সবসময়৷

মেয়েটা পাশ ফিরে শুয়ে পড়তে অনীশ বিছানা থেকে উঠে কাচের জানলার দিকে এগিয়ে যায়৷ এ জানালা দিয়ে তাকালে ঘন পাইন গাছের আকাশছোঁয়া জঙ্গল ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না৷ কোথায় গিয়ে জঙ্গল শেষ হয়েছে কে জানে! বেশিক্ষণ একটানা সেই জঙ্গলের দিকে চেয়ে থাকলে বুকের ভিতরটা কেমন ছমছম করে ওঠে৷ মনে হয় এই বুঝি দুটো চিরপাইন গাছের পিলারের ফাঁক দিয়ে কিছু একটা ছুটে বেরিয়ে আসবে৷

একটা অন্ধকার ফাঁকে চোখ রাখে অনীশ৷ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে সেইদিকে৷ তবে চোখ ফেরানোর আগেই দৃষ্টি থেমে যায়৷ বাইরে নয়, ভিতরে৷ কাচের আধ-টানা জানলাটায় ঘরের ভিতরের দিকের প্রতিচ্ছবি পড়েছে৷ সেই প্রতিচ্ছবিতে অনীশ দেখে বীণা সাপের মতো মাথা তুলে একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে৷ কোনও কারণে ওর জঙ্গলের দিকে চেয়ে থাকাটা কৌতূহলী করে তুলেছে বীণাকে৷ ব্যাপার কী?

(দুই)

টেবিলের উপর রাখা গ্লাস থেকে খানিকটা জল খেয়ে চেয়ারের উপরে এসে বসে একটা কুশন কোলের উপরে টেনে নেয় শর্মিলা৷ জগদীশ এতক্ষণ হেলান দিয়ে বসে ছিল৷ শর্মিলার ছোট ভাই জগদীশ৷ অনীশকে সে-ই এনেছে এখানে৷ শর্মিলাকে দেখে সোজা হয়ে বসে জগদীশ, ‘কেমন দেখলে ওকে?’

—‘খুব একটা ট্রমাটাইজড আছে বলে তো মনে হল না৷ কথা বলছে৷’

ঠোঁটের নীচে করুণ হাসল জগদীশ, ‘ওকে দেখে ওরকম মনে হয়৷ ভিতরে ভিতরে ভেঙে গিয়েছে অনেকটা, এইটুকু বয়সের একটা ছেলে৷’ শর্মিলার মাথাও নেমে আসে নীচের দিকে, ‘দিদি যে কেন এরকম করল, আমি আজও কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না৷ ছেলেটার বাকি জীবনটা নষ্ট করে দিয়ে গেল৷’

‘ডাক্তারবাবু বলেছেন, অনিকে ওর মা-বাবার ব্যাপারে কিছু না বলতে৷ নতুন করে জীবনটা শুরু করুক এখানে৷ আপাতত যা ভালো লাগছে তাই করুক, তাছাড়া কিছু ওষুধ লিখে দিয়েছেন৷ খুব বেশি ছটফট করলে…’

কথাগুলো কানে ঢুকছিল না শর্মিলার৷ রুমেলার মুখটা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে তার৷ বিয়ের পর থেকেই একটু একটু করে দিদিকে চোখের সামনে পালটে যেতে দেখেছিল৷ সমৃদ্ধর অত্যাধিক মাতলামো, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন কোনওদিন মানিয়ে নিতে পারেনি সে৷ মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিল দিন দিন৷ মানসিক অবসাদের জন্য কিছুদিন ধরেই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হচ্ছিল৷ সেই অবসাদ থেকেই হয়তো গাড়ি নিয়ে খাদে ঝাঁপ দিয়ে…

পরদিন কাগজে খবরটা দেখে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল শর্মিলা৷ সুইসাইড নোট পাওয়া গিয়েছিল, সমৃদ্ধকে লেখা, ‘ভালো থেকো নিজেকে নিয়ে৷ ছেলেটাকে মানুষ করার ক্ষমতা তোমার নেই জানি৷ ওকে পারলে ওর মাসির কাছে রেখে এসো৷’

খাদের প্রায় কয়েকশো মিটার নীচে গিয়ে পড়েছিল গাড়িটা৷ সেটাকে আর উদ্ধার করা যায়নি৷ প্রাথমিক শোকটা কেটে যেতে, শর্মিলার মনে পড়েছিল অনীশের কথা৷ মাতাল বাবার কাছে আর যা-ই হোক মানুষ তো হতে পারবে না, ঠিক করে নিজের কাছে এনে রাখবে৷ বীণা এখানে সারাদিন খেলার সঙ্গী পায় না৷ যদিও অনীশ ওর থেকে প্রায় বছর সাতেকের বড়, তাও ভাব হয়ে গেলে বীণার মনটাও খুশি হবে অন্তত৷

জগদীশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠতে যাচ্ছিল, থেমে গিয়ে বলে, ‘ইয়ে, সুজয়দাকে দেখছি না, গিয়েছেন কোথাও?’

—‘আর বলিস না, আবার সেই মিসিং কেস৷’

—‘মিসিং?’ অবাক হয় জগদীশ, ‘এইটুকু হিল স্টেশনেও ক্রাইম-টাইম হয়?’

—‘অন্য কিছু হয় না তেমন৷ তবে এই ব্যাপারটা ভারী অদ্ভুত৷ এই শীতের সময়টা প্রতি বছরই দু-একজন করে লোক মিসিং হয়ে যায়৷ বডি পাওয়া যায় না৷ কী হয়, কোথায় যায়, কেউ জানে না৷’

—‘প্রতি বছর?’

—‘ইচ অ্যান্ড এভরি ইয়ার৷ এখানে লোকজন মেরে-কেটে হাজারখানেকের বেশি হবে না৷ বেশিরভাগই কাঠুরে, জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে বেপাত্তা হয়ে যায় একদম৷’

—‘স্ট্রেঞ্জ!’

ভুরু দুটো কোঁচকায় জগদীশের৷ খাজিয়ারে আগেও বহুবার এসেছে৷ জঙ্গলে ঘেরা একটা ছোট্ট হিলস্টেশন৷ সারাবছর আকাশ পরিষ্কার থাকে৷ মাঝে মধ্যেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামে৷ খোলা মাঠের উপরে গিয়ে বসলে দমকা হাওয়ার ঝাপটা এসে লুকোচুরি খেলে চারপাশে৷ মাঝে মাঝে বহু দূর থেকে পাহাড়ের টানেল চিরে-আসা রেলগাড়ির আওয়াজ খেলনার মতো কানে আসে৷ এই শহরের লাগোয়া জঙ্গলেই রেঞ্জারের কাজ করে সুজয়৷ জগদীশ সুজয়ের মুখেই শুনেছে, এই জঙ্গলকে ঘিরে এখানকার পাহাড়ি বাসিন্দাদের মধ্যে বিচিত্র সব উপকথা চালু আছে৷ তারা বিশ্বাস করে এই জঙ্গলের কথা নাকি বৌদ্ধধর্মের প্রাচীন গ্রন্থেও লেখা আছে৷ জঙ্গলের গভীরে এমন আশ্চর্য সব প্রাণী আছে যা আজ অবধি মানুষের চোখে ধরা দেয়নি৷ ট্রেনে আসতে আসতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলে, সেই সব লোককথা অকারণেই জগদীশের মনের ভিতরে ছোটাছুটি করতে থাকে৷ সত্যি ভীষণ ঘন জঙ্গল৷ সারাক্ষণ কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকে ভিতরটা৷ সেখানে অজ্ঞাত কোনও প্রাণী যদি থেকেও থাকে, তাকে দ্যাখে কার সাধ্যি?

বেরোনোর আগে একবার ভেতরের ঘরে ঢুকে আসে জগদীশ৷ দরজা খুলতেই দেখে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বাগানের দিকে চেয়ে আছে অনীশ৷ তার পিঠে হাত রেখে শান্ত গলায় বলে, ‘তোকে কী বলেছিলাম মনে আছে তো? এখানে বাড়ির ভেতরে যত খুশি ঘোর৷ যেখানে খুশি যা৷ শুধু একা একা জঙ্গলের দিকে ভুলেও নয়৷’

—‘কেন? কী আছে জঙ্গলে?’

ভেবে দেখে জগদীশ৷ একটা সতেরো বছরের ছেলেকে ভয় দেখিয়ে আটকে রাখা যাবে না৷ তাতে কৌতূহল আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে৷ মাথা নামিয়ে এনে বলে, ‘কী আর থাকবে? সাপ, পোকা-মাকড় আছে৷ এসব বুনো পোকা-মাকড় একবার কামড়ে দিলে, এসব জায়গায় আর রক্ষা থাকবে না৷’

—‘আচ্ছা যাব না৷’

হঠাৎ জগদীশের জামাটা ধরে তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে অনীশ বলে, ‘এই মেয়েটা এমন অদ্ভুত কেন বলো তো? কী হয়েছে ওর?’ জগদীশের মাথা হেট হয়ে আসে৷ ফিসফিসে গলায় বলে, ‘ইনোপেরাবল ব্রেন টিউমার৷ পারলে ওর সঙ্গে একটু বন্ধুত্ব করে নিস৷’

অনীশের মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়৷ বীণার দিকে ঘুরে তাকায় সে৷ আঁকার খাতাটা বুকের কাছে ধরে এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা৷ মুখ ফিরিয়ে আবার জঙ্গলের দিকে চায় অনীশ৷ একটু আগেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল তার৷ মনে হচ্ছিল, জঙ্গলের গাছের ফাঁক থেকে কে যেন তাকিয়ে আছে ওর দিকে৷ কাউকে দেখতে পায়নি, অথচ মন বলছিল একজোড়া চোখ একদৃষ্টে লক্ষ করে চলেছে ওকে৷ কী আছে জঙ্গলে?

(তিন)

চোখ খুলতেই একটা হালকা নীলচে রেখা এসে লাগল অনীশের চোখে৷ অনেকটা ভোরের প্রথম আলোর মতো৷ সে মনে করে দেখার চেষ্টা করল, কাল রাতে তো রোজকার মতো দোতলায় নিজের ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিল৷ অথচ এখন দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গল থেকে দূরে শুকনো মাটির উপর৷

পায়ের থেকে মিটার দশেক দূরেই একটা খাদ শুরু হয়েছে৷ খাদের ভিতর থেকে কালচে ধোঁয়া উঠে আসছে উপরে৷

তবে কি রাতে ঘুমের ঘোরেই এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে? চারিদিকটা একবার ভালো করে দেখার চেষ্টা করল সে৷ কুয়াশায় কিছু স্পষ্ট করে বোঝা যায় না৷ চোখে পড়ল, খাদের একেবারে ধারে এক মাঝবয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন৷ তার সারা শরীর কালচে কাপড়ে ঢাকা৷ যেন মমি করার জন্য কাপড়ে জড়িয়ে রাখা একটা দেহকে খাদের ধারে পুতুলের মতো দাঁড় করিয়ে গিয়েছে কেউ৷

মানুষটা একদৃষ্টে চেয়ে আছে খাদের অতল গভীরে৷ পিছন থেকে মহিলাকে চেনা লাগল অনীশের৷ আর কিছু না ভেবে সেদিকে এগিয়ে গেল৷

একটা মিহি রিনরিনে শব্দ ভেসে আসছে খাদের অতল থেকে৷ যেন অনেক অদৃশ্য মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছে৷ সুরেলা গলায় সমবেত-স্বরে একটা গান গাইছে তারা৷ সেই সুর খাদের দেওয়াল বেয়ে কুয়াশার মতো উঠে আসছে উপরে৷

কিছুটা কাছে আসতেই পিছন থেকে মহিলাকে চিনতে পারল অনীশ – মা৷ খাদের একেবারে ধারে দাঁড়িয়ে ভেতরে কী যেন দেখছে৷ আর এক ইঞ্চি সামনে এগোলেই গিয়ে পড়বে খাদের ভিতর৷

অনীশ আতঙ্কিত-স্বরে চিৎকার করে উঠল, ‘মা! মা আর এগিও না…’ কোনও হেলদোল নেই৷ ছুটে গিয়ে মায়ের পিঠে হাত রাখল অনীশ৷ চাপা গলায় ডাকল, ‘মা, তুমি তো…’

মহিলার নিথর শরীরে একটা শিহরন খেলে গেল৷ কোথা থেকে পোড়া গন্ধ আসছে, ডিজেল পোড়া গন্ধ৷ ধীরে ধীরে মুখ ফেরাল মানুষটা৷ অনীশের মনটা নেচে উঠল৷ মনে হল বহু বছর হয়ে গেছে মায়ের মুখটা দেখেনি৷ কিন্তু সেই মুখের দিকে চেয়ে বুকের ভিতর হিমেল পরশ বয়ে গেল অনীশের৷ মহিলার মুখের চামড়া আর মানুষের মতো নেই৷ ঠিক যেন একটা গাছের বাকল-ওঠা কাণ্ডের উপর মানুষের মুখ খোদাই করে বসাতে চেয়েছে কেউ৷ ঠোঁটের ফাঁকে জিভটা উধাও, চোখের মণির জায়গায় দুটো অন্ধকার কোটর৷ হাতগুলো ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে গাছের শুকনো ডালপালায়৷ খাদের নীচ থেকে শুনতে পাওয়া সেই শব্দটা মায়ের জিভবিহীন মুখের থেকে তীব্রস্বরে বেরিয়ে এল৷

ছিটকে পিছিয়ে এল অনীশ৷ মনে হল, খাদের ধারের রাস্তা দিয়ে সজোরে একটা গাড়ি আসছে৷ উচ্চস্বরে হর্ন বাজাচ্ছে গাড়িটা৷ শেষ চিৎকার করে এসে পড়েছে ওর গায়ের উপর৷

চিৎকার করে উঠল অনীশ৷ সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল৷ স্বপ্ন দেখছিল? এই ডিসেম্বরের ঠান্ডাতেও শরীর ঘামে ভিজে গেছে ওর৷ পায়ের দিকে বারান্দার জানালাটা খোলা৷ সেখান দিয়ে জঙ্গলের বুনো হাওয়া ভেসে আসছে ক্রমাগত৷ পর্দাটা এলোপাথাড়ি উড়ছে৷

এখানে এসে থেকে দুটো দিন কেটেছে অনীশের৷ মানিয়ে নিতে তেমন অসুবিধা হয়নি৷ তবে সারাক্ষণই একটা চাপা অস্বস্তি যেন ঘিরে থাকে ওকে৷ জঙ্গলের দিকে চোখ চলে যায় বারবার৷ মনে হয়, ওর ভিতর থেকে কে যেন ক্রমাগত তাকিয়ে আছে ওর দিকে৷ রাতে শুতে গিয়ে চারিদিকের সব শব্দ কমে এলে বাতাসে মৃদু গুনগুন শুনতে পায়৷

প্রথমদিন রাত ঘুম ভেঙে গিয়েছিল৷ মনে হচ্ছিল, কে যেন ঘরের ভিতরে ছিল এতক্ষণ৷ ও জেগে উঠতেই সে লুকিয়ে পড়েছে৷ ঘরের চারদিকটা খুঁজেও দেখেছিল অনীশ৷ কেউ নেই৷

কত রাতে হবে? দেওয়ালে ঝুলন্ত ঘড়ির দিকে তাকায় অনীশ৷ তিনটে বাজছে৷ সেভাবেই শুয়ে থাকে কিছুক্ষণ৷ মানে কী স্বপ্নটার? ডাক্তারবাবু বলেছেন মায়ের কথা বেশি না ভাবতে৷ অনীশ তো তেমন একটা ভাবেও না৷ তবু মা যেন বারবার ফিরে আসতে চাইছে ওর কাছে৷

মনে পড়ে যায়, একদিন রাতে এরকম দুঃস্বপ্ন দেখে উঠে বসেছিল অনীশ৷ মা ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল, ‘আচ্ছা অনি, তোর কখনও আফশোস হয় না?’

—‘কীসের আফশোস?’

—‘এই যে তুই আমার ছেলে হয়ে জন্মেছিস, তোর বাবার ছেলে হয়ে জন্মেছিস৷ অন্য মা-বাবা পেলে তোর জীবনটা আর একটু সহজ হত৷ না রে?’

অনীশ তখন অতশত বুঝত না৷ সে ঠোঁট উলটে বলেছিল, ‘পাইনি যখন, তখন আর ভেবে কী হবে? এই দিয়েই চালিয়ে নেব৷’

মা অল্প হেসে ওকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বলেছিল, ‘দেখিস, যা-ই হয়ে যাক, তোর বাবা যত খারাপই হোক, আমি সবসময় তোর কাছে থাকব৷’

মা কথা রাখেনি৷ অনীশ এতদিনে বুঝেছে, মায়ের জীবনে নানান সমস্যা চলছিল৷ বাবার দিক থেকে, অফিস-কাছারির দিক থেকে, সবরকমভাবে অত্যাচারিত হতে হতে একসময় আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি৷

আচ্ছা, খাদে ঝাঁপ মারার আগেও একবার অনীশের কথা কি মনে হয়নি মায়ের? মায়ের মুখটা এখন খুব মনে পড়ে অনীশের৷ একমাস আগেও বিছানায় পাশ ফিরলে দেখতে পেত মা-কে৷

পাশের টেবিলে রাখা ছিল গ্লাসটা৷ ঠোঁটের কাছে এনে সবে চুমুক দিতে যাবে, তার আগেই থমকে গেল৷ এই ঘরের লাগোয়া একটা ছোট বারান্দা আছে৷ সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে জঙ্গল থেকে বয়ে আসা হাওয়া গায়ে লাগে৷ আপাতত বারান্দার আলো নেভানো৷

এইমাত্র সেখান থেকে মৃদু একটা শব্দ এসেছে৷ যেন ধাতব কিছু একটা বারান্দার রেলিংয়ে ঠোকা লেগে ‘ঠং’ করে শব্দ হয়েছে৷ সোজা হয়ে বসল অনীশ৷ সে খুব-একটা ভীতু নয়, তাও জঙ্গল থেকে ভেসে আসা হাওয়ায় কীসের জন্য একটা গন্ধ লেগে আছে, সেই গন্ধটাই বারবার সতর্ক করে দিচ্ছে ওকে৷ বারান্দার দিকে চেয়ে নীচু গলায় ডাক দিল, ‘কে ওখানে?’

কোনও উত্তর এল না৷ কেবল আগের মতোই বুনো হাওয়া ঢিমে তালে বয়ে যেতে লাগল৷ একটা ভাবনা এসে চেপে ধরল ওকে৷ মনে হল, জানালার অন্ধকার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কেউ তাকিয়ে আছে ওর দিকে৷ এতদিন জঙ্গলের গাছপালার আড়ালে ঢাকা পড়ে ছিল, এখন বারান্দার অন্ধকার ঢেকে রেখেছে তাকে৷

আবার শুতে গিয়েও পারল না৷ অস্বস্তিটা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে৷ জঙ্গলের গাছপালার দুলুনিতে হাওয়ার সঙ্গে একটা সুরেলা শব্দ ভেসে আসছে৷ ঝিঁঝি ডাকছে একটানা৷ আর কোনও জীবিত প্রাণীর শব্দ নেই৷ ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে এল অনীশ৷ এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে৷ মুখ থেকে আবার বেরিয়ে এল প্রশ্নটা, ‘কে আছে ওখানে?’

ওপাশ থেকে কোনও উত্তর এল না৷ জঙ্গলের ভেতর থেকে কোনও অজানা প্রাণী শিস দেওয়ার মতো শব্দে ডেকে উঠল৷

দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল অনীশ৷ অন্ধকারে ঢেকে চারপাশ কিছুই দেখা যায় না৷ তাও অবচেতন মন বলে দিল, এই বারান্দায় ও একা নয়৷ উলটোদিকে রেলিং ধরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে৷ খুব মৃদু শব্দে নিঃশ্বাস পড়ছে তার৷ আগন্তুক রোগা এবং খুব মৃদু কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর৷

অনীশের মনে হল, ওর কাছে যদি টর্চ থাকত তাহলেও জ্বালানোর মতো সাহস পেত না৷ কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে?’

কয়েক সেকেন্ড উত্তর এল না৷ তারপর আচমকাই নৈঃশব্দ্য ভেঙে একটা মৃদু নারীকণ্ঠ ভেসে এল, ‘আমি,’

—‘নিজের কাছে তো সবাই আমি৷ তুমি কে?’

আবার সেই থেমে থেমে উত্তর, যেন প্রত্যেকটা শব্দ মেপে মেপে উচ্চারণ করছে মানুষটা, ‘আ… আমার নাম ইভা৷ এই জঙ্গলেই থাকি৷’

—‘জঙ্গলে মানুষ থাকে নাকি?’ অনীশ সন্দেহের গলায় বলল৷

—‘না৷ মানুষ থাকে না, আমি থাকি৷’

ধোঁয়ার মতো একটা ভয় চেপে ধরল অনীশকে৷ পিছনের রেলিং-এ সেঁটে দাঁড়াল সে৷ ইভার করুণ গলা কানে এল তার, ‘আ… আমাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিও না প্লিজ! আমার খুব বিপদ, ওরা আমাকে ধরতে পারলে…’

অনীশ এবার বাধা দেয়, ‘ওরা মানে? ওরা কারা?’

—‘ওই জঙ্গলের ভিতরে যারা থাকে,’

—‘সে কী! এই তো বললে তুমিই জঙ্গলের ভিতরে থাকো৷’

—‘শুধু আমি থাকি না৷’

এতক্ষণে ব্যাপার কিছুটা বুঝতে পারে অনীশ৷ তবে সমস্তটা তার বিশ্বাস হয় না৷ ইভা কোনওভাবে কার্নিস বেয়ে বারান্দায় এসে উঠেছে৷ রোজই এই বারান্দায় এসে বসে থাকে? গেস্ট কেউ না এলে ঘরটা তো ফাঁকাই থাকে৷ তার মানে, একটা কথা অনীশের মাথায় গেঁথে গিয়েছে৷ উলটো দিকের মানুষটা ওকে ভয় দেখাতে আসেনি৷ সে নিজেই কাউকে একটা ভয় পাচ্ছে৷

—‘ঠিক আছে৷ থাকো বসে৷’

ফিরতে যাচ্ছিল অনীশ, ইভা পিছু ডেকে বলে, ‘বলছি তুমিও একটু বসো-না এখানে৷’

—‘কেন?’

—‘এমনি, আসলে জঙ্গলে কথা বলার লোক নেই তো!’

এতক্ষণে কিছুটা সাহস পেয়েছে অনীশ, বাঁকা সুরে বলে, ‘হুহ, কথা না ছাই৷ ভিতরে গিয়ে কাউকে যাতে না ডাকি সেইজন্য বসিয়ে রাখছ, আমি কিছু বুঝি না নাকি?’ গলা একটু নরম করে অনীশ বলে, ‘তোমার ভয়ের কিছু নেই৷ খামোখা তাড়াতে যাব কেন? তাছাড়া বাড়িটা আমার নয়, আমিও এখানে থাকতে এসেছি৷’

—‘কেন? তোমার নিজের বাড়ি নেই?’

—‘ছিল৷ এখন আর নেই৷’

—‘কেন?’

ইভার অতিরিক্ত আগ্রহে অনীশ প্রথমে খানিকটা রেগে যায়৷ তারপর অবাক হয়ে বলে, ‘আরে অদ্ভুত তো৷ বাড়ি কি মানুষের চিরকাল থেকে যায় নাকি? তাছাড়া তুমিই বা নিজের বাড়ি ছেড়ে এত রাতে এখানে কী করছ?’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে ইভা, ‘আমার বাড়ি নেই৷’

—‘সে কী! তাহলে থাকো কোথায়?’

—‘কোথাও থাকি না,’ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল ইভা, চুপ করে গেল, ‘এত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না৷ ভয় লাগছে বলে একটু লুকিয়েছি এখানে, ভয় কেটে গেলে চলে যাব, ব্যস৷’

অনীশ ঠায় বসে থাকল কিছুক্ষণ৷ তারপর আকাশের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমার মা বলত, কারও সঙ্গে কথা বললে ভয় কেটে যায়৷ তুমি চাও তো আমার সঙ্গে কথা বলতে পারো৷’

—‘বলত মানে? মা নেই নাকি?’

অনীশ চোখ না সরিয়েই ঘাড় নাড়ায়, ‘তোমার যেমন বাড়ি নেই, আমার তেমন মা নেই৷ বাড়ির মতো মা-ও সবসময় থাকে না৷’

—‘কোথায় গিয়েছে?’

অনীশ চাপা হাসি হাসে, ‘সুইসাইড করেছে৷ সুইসাইড মানে…’

—‘জানি৷’

ঠান্ডাটা বেড়ে উঠেছে এতক্ষণে৷ কনকনে হাওয়ার ধাক্কা এসে লাগল ওদের মুখে৷ ভয় কাটানোর উপায়টা নিয়েই যেন এতক্ষণ ভাবছিল ইভা, গলা-খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, তুমি ঘুমোওনি কেন আজ?’

—‘ঘুমিয়েছিলাম৷ একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল৷’

—‘কী স্বপ্ন?’

—‘তেমন কিছু না৷ মায়ের জন্য মনখারাপ করছিল৷ ডাক্তারবাবু মায়ের কথা ভাবতে বারণ করেছেন৷ আচ্ছা তুমিই বলো, বারণ করলেই ভাবা বন্ধ হয়ে যায়?’

সময় নিয়ে কী যেন ভাবে ইভা, বলে, ‘চাইলে আমাকে বলতে পারো৷ আমি কাউকে বলব না৷’

অনীশ অবজ্ঞার হাসি হাসে, ‘ধুর, অচেনা লোককে এসব কথা বলা যায় নাকি? তোমাকে দেখতে কেমন তাই জানি না৷’

—‘দেখতে চাইলেই দেখাতে পারি৷’

অনীশের কৌতূহল বেড়ে ওঠে৷ ইভার গলার স্বর অস্বাভাবিকরকম মিষ্টি৷ অনীশ বলে, ‘দাঁড়াও আলো জ্বালছি৷’

—‘উঁহুঁ, আলো লাগবে না৷’

কয়েকটা নিস্তব্ধ মুহূর্ত কেটে যায়৷ রাতের হাওয়া এখন জোরে বইতে শুরু করেছে৷ শিরশিরানি ভাব মিশে আছে তাতে৷ জঙ্গলের গাছগুলোর মাথার উপর দিয়ে একটা হাওয়ার স্রোত সমুদ্রের অতিকায় ঢেউয়ের মতো এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে চলে যাচ্ছে৷ গাছগুলো সেই ঢেউয়ে মিশে দুই দিগন্ত স্পর্শ করতে চাইছে৷

হঠাৎ শনশন শব্দের মধ্যে অনীশ শুনতে পায় তার ঠিক পাশ থেকে একটা সুরেলা স্বর ভেসে আসছে৷ মৃদুকণ্ঠে একটা গান গাইছে মেয়েটা৷ অপার্থিব কোনও গান৷ অনীশের মনে হল, একমাত্র স্বর্গের অপ্সরা ছাড়া আর কারও পক্ষে এমন গান গাওয়া সম্ভব নয়৷ বিমূঢ়ের মতো চেয়ে রইল সে৷

গান গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃদু একটা আলোর বৃত্ত ফুটতে শুরু করেছে মানুষটার আঙুলের ডগায়৷ যেন একটা জোনাকি পোকা একটু একটু করে আকারে বড় হচ্ছে৷ সবজে রঙের একটা আভা বেড়ে উঠছে সেই সঙ্গে৷ অনীশ সম্মোহিতের মতো সে-দিকে তাকিয়ে দেখল, সেই আলোর আভা গিয়ে পড়েছে একটা প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা মানুষের উপর৷ হ্যাঁ, মানুষই বটে৷ একটা মেয়ে৷ বয়সে অনীশের মতোই হবে৷ কিন্তু মুখের দিকে একবার তাকালে বোঝা যায়, স্বাভাবিক মানুষ সে নয়৷

বীণার খাতায় আঁকা সেই সবজে রূপকথার মানুষ যেন অবিকল৷ একে দেখেই কি ছবিগুলো এঁকেছে বীণা?

মেয়েটার চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের বড়৷ ঘন নীল চোখের মণির উপর সবজে আভা জ্বলজ্বলে পাথরের মতো ঠিকরে বেরোচ্ছে৷ টিকালো নাক, কুচকুচে কালো একমাথা চুল৷ চামড়া এত মসৃণ যে সবুজ আলো পিছলে যাচ্ছে তার উপরে পড়ে৷ সরু কোমরের পাশে একটা ধারালো ছুরি গাঁথা আছে৷ কিচেন নাইফ৷ চুরি করা নাকি?

এমন অদ্ভুত সুন্দর অথচ অলৌকিক চেহারা কোনও মানুষের হতে পারে না৷ এখনও উঁচুস্বরে গানটা গেয়ে চলেছে মেয়েটা৷ যেন ওই গান গেয়েই আঙুলের ডগায় আলোটা জ্বেলে রেখেছে৷

দু-জনেই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল৷ অবাক হয়ে মেয়েটার সবুজে ভরা চোখ দু-টোর দিকে চেয়ে রইল অনীশ৷ ইভা কিন্তু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নেই৷ একটা নাচের ছন্দে অজান্তেই যেন একটু একটু দুলে চলেছে সে৷

অনীশের মনে হল, ইভার গলার স্বর আর চোখ দুটো যেন সম্মোহিত করে ফেলছে তাকে৷ নিজের অজান্তেই কয়েক পা এগিয়ে গেল অনীশ৷ কাঁপাকাঁপা ঠোঁটে জিজ্ঞেস করল, ‘কে তুমি?’

—‘আমি ইভা৷ আমি…’

মেয়েটাও এক পা এগিয়ে এসেছে ওর দিকে, তার অস্থির চোখের মণিটা অনীশের মুখের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷

ইভা একটা হাত ওর কাঁধের উপর রাখল৷ কী মসৃণ স্পর্শ মেয়েটার! যেন ঠান্ডা মোম গলে পড়েছে ওর কাঁধে, ‘কে তুমি? বলো?’ অনীশ অজান্তেই উচ্চারণ করল প্রশ্নটা৷

—‘আমি… আমি…’ কী একটা কথা বলতে গিয়েও সে পারল না৷ ভেতর থেকে দরজা ধাক্কা দেওয়ার একটা শব্দ ভেসে এসেছে৷

—‘অনীশ, তুই চেঁচিয়ে উঠেছিলি কেন?’

মাসি৷ অনীশ গলা তুলে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, মেয়েটা হঠাৎ এগিয়ে এসে ওর মুখ চেপে ধরল, মোমের মতো হাতের স্পর্শটা ওর মুখটাকে বন্ধ করে দিয়েছে, ‘চুপ৷ একটাও শব্দ করবি না৷’

বাইরে থেকে আরও দু-তিন বার ডাকল মাসি৷ তারপর পায়ের আওয়াজ দূরে চলে গেল৷

অনীশের কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে মেয়েটা বলল, ‘তুই ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়৷ আমি এখানে বসে থাকব৷’

—‘কেন? আমি শুয়ে পড়ব কেন?’

—‘আঃ, যা বলছি তাই কর৷’ হঠাৎ করেই মেয়েটার অসহায় ভাবটা মিলিয়ে গিয়ে একটা রুক্ষতা বেরিয়ে এসেছে৷ তুমিটা তুইতে নেমে এসেছে৷ চোখ দু-টোয় এখন একটা লালচে রং মিশতে শুরু করেছে৷

ভয় লাগল অনীশের৷ তাও কাঁধ ঝাঁকিয়ে একটু পিছিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, মাসি বলছিল, এখান থেকে নাকি মাঝে মাঝে কিছু লোক গায়েব হয়ে যায়৷ কারা ধরে নিয়ে যায় তুই জানিস?’

ইভা মাথা নাড়ে, ‘জানি৷ ওদের থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছি৷’

—‘কেমন দেখতে ওদের?’

ইভা উত্তর দিল না৷ তার হাতের আলোটা নিভে আসছে৷ জঙ্গলের দিকে চোখ হারিয়ে গেছে তার৷ অনীশ অন্ধকারের বুক চিরে ফিসফিসে গলা শুনতে পেল, ‘আমি রোজ রাতে আসি এখানে৷ তুই চাইলে যা খুশি মন খুলে বলতে পারিস আমাকে৷ শুধু আমি যে রাতে এখানে এসে লুকিয়ে থাকি, সে কথা তুই কাউকে বলতে পারবি না৷ মনে থাকবে?’

—‘থাকবে৷ আচ্ছা মন খুলে একটা প্রশ্ন করি তাহলে?’

—‘কী?’

—‘তুই এত ভালো গান শিখলি কী করে?’

অন্ধকারেও অনীশ বুঝতে পারে ইভা হাসছে৷ হাসিটা গলায় মেখেই সে উত্তর দেয়, ‘পরে একদিন বলে দেব৷ আজ যা, ঘুমিয়ে পড়৷’

অনীশ আর কথা বাড়ায় না৷ আজ রাতে যা ঘটল তাতে মনে হচ্ছে একটু আগের স্বপ্নটা এখনও শেষ হয়নি৷ হয়তো এক্ষুনি চোখ খুলে দেখবে শোবার ঘরের বিছানাতে শুয়ে৷ ইভাকে সে স্বপ্নে কল্পনা করেছে মাত্র৷ গায়ে একটা চিমটি কাটল অনীশ৷ মেয়েটার গানের মধ্যে কী যেন একটা ছিল, মনটা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে৷

—‘আচ্ছা বেশ৷ আমি যাচ্ছি৷’

বিছানায় শুয়ে অনীশের মনে পরপর প্রশ্ন ভেসে আসতে লাগল৷ ইভা মেয়েটা কে? উদ্দেশ্য কী তার? রোজ এখানে এসে বসে থাকে? তাহলে বীণা ছাড়া কেউ জানতে পারেনি কেন এতদিন? আর বীণাই বা জানল কেমন করে? কার হাত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে মেয়েটা? জঙ্গলে সে ছাড়া আর কে থাকে? এরা এখানে এলই বা কী করে?

এতগুলো প্রশ্ন সতেরো বছরের অপরিণত মাথাটাকে ভারাক্রান্ত করে তুলল৷ ঘুমের মধ্যে অনীশের অবচেতন মন বলল, ইভা বাইরের বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারের মধ্যে থেকে ওর দিকে আগের মতোই তাকিয়ে আছে৷ কিছু একটা উদ্দেশ্য আছে তার৷ এই সমস্ত ঘটনার সঙ্গে, মেয়েটার সঙ্গে কি কোনও যোগ আছে অনীশের? উত্তেজনা আর ভয় কেটে গিয়ে একটা শান্তি আর নিরাপত্তার আরাম আঁকড়ে ধরে ঘুম পাড়িয়ে দিল ওকে৷

(চার)

খাজিয়ারে পরের তিনটে দিন খারাপ কাটল না অনীশের৷ সারাদিন অন্য কোনও কাজ নেই৷ বীণার সঙ্গে এই ক-দিনে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে৷ ওকে হাতে ধরে ছবি আঁকা শেখায় বাচ্চা মেয়েটা৷ মানুষ আঁকার আগ্রহ একেবারেই নেই তার৷ বারবার ওই একই মুখ ইভা৷

অনীশ নিজেও এখন ইভার মুখ আঁকতে পারে৷ প্রথম দিন তাকে ইভার গলা আর হাত আঁকতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল বীণা৷ অনীশ তার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়েছিল৷ তবে জঙ্গলে যাওয়ার অনুমতি অনেক চেষ্টা করেও পায়নি অনীশ৷

এই তিন দিন ইভাও রোজ রাতে এসে বসেছে বাইরের বারান্দায়৷ কোনও কোনও দিন অনীশের সঙ্গে কথা হয়েছে তার৷ ইভা কখনও ঘুমায় না, সর্বক্ষণ সজাগ হয়ে জঙ্গলের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবতে থাকে৷ অনীশের ইদানীং মনে হয় পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া আরও কোনও উদ্দেশ্য আছে ইভার, সেটা কাউকে খুলে বলে না৷

দু-দিন মাঝরাতে আবার সেই স্বপ্নটা দেখে উঠে বসেছে অনীশ৷ দ্যাখে, ইভা ওর মুখের উপরে ঝুঁকে চেয়ে আছে, ‘আবার স্বপ্ন দেখছিলি?’

—‘আমার ভয় লাগে খুব,’

—‘কীসের ভয়?’

—‘ওই যে জঙ্গলে যে-সব লোকগুলো হারিয়ে যায়, আমাকেও যদি…’ অভয় দিয়ে অনীশের হাতের উপরে হাত রাখে ইভা, ‘ভয়ের কিছু নেই, আমি আছি৷’

—‘আর যদি…’

—‘চুপ, ঘুমোনোর চেষ্টা কর৷ আমি জেগে আছি৷’ কথাটা বলে কোমরের ছুরিটা খুলে অনীশের বালিশের পাশে রাখে ইভা৷

কী একটা আছে ইভার গলার স্বরে৷ মানুষ নয় বলেই হয়তো… চাইলেই সে স্বর মানুষের মনকে শান্ত করে দিতে পারে, ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে৷

পঞ্চম দিন বুকের কাছে বালিশের মতো কিছুর চাপ লাগতে ঘুম ভাঙল অনীশের৷ ধড়ফড় করে উঠে বসল সে৷ সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে৷ রাতের জমাট অন্ধকার এখনও শুয়ে রয়েছে ঘরের মেঝেতে৷ অনীশ অনুভব করল, কেউ একটা এসে শুয়েছে ওর বুকের কাছে, ও একটু পিছিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কে?’

উত্তর এল না৷ মানুষটার মুখের উপর হাত রেখে অনীশ বুঝতে পারল উত্তর আসার কথাও নয়৷ বীণা এসে শুয়েছে ওর কাছে৷ ছোট নাইট-ল্যাম্পের আলো ওর মুখের উপরে এসে পড়েছে৷ মুখ দেখে বোঝা যায়, কোনও কারণে ভয় পেয়েছে সে৷ কাঁচুমাচু মুখে চেয়ে আছে অনীশের দিকে৷

—‘ভয় পেয়েছিস, না রে? কিছু দেখেছিস জঙ্গলে?’

উপরে নীচে মাথা নাড়ায় বীণা৷ অনীশ তার গায়ের উপরে একটা হাত রাখে৷ মুখ বাড়িয়ে একবার দেখে নেয়৷ সম্ভবত বারান্দা ফাঁকা৷ ভোর হওয়ার আগেই চলে যায় ইভা৷

—‘ভয় পেলে জানবি দাদা কাছে-পিঠেই কোথাও আছে৷ বুঝলি?’ বীণা আবার উপর-নীচে মাথা নাড়ে৷ তারপর চোখ বুজে দাদার আরও কাছে ঘেঁষে আসে৷

—‘ভয় পাস না, আমার মা বলত ভয় পেলে…’ কথাটা শেষ করতে পারে না অনীশ৷ ভয় কাটানোর এই উপায়টা কাজে লাগবে না বীণার৷ হঠাৎ কী মনে হতে পকেট থেকে একটা সবুজ চাকতি বের করে বীণার হাতে দেয় অনীশ, ‘এইটা তুই রাখ৷ এটা কাছে থাকলে আর ভয় করবে না৷’

জিনিসটা হাতে নিয়ে বীণা দ্যাখে সেটা একটা ক্যারাম বোর্ডের স্ট্রাইকার৷ সে অস্ফুট শব্দ করে ইশারায় জিজ্ঞেস করে সেটা কী৷ অনীশ সোজা হয়ে শুতে শুতে বলে, ‘আমার মা ছোটবেলায় ক্যারাম কিনে দিয়েছিল আমাকে৷ জানিস তো ক্যারাম বোর্ডে স্ট্রাইকার সব থেকে শক্তিশালী৷ তোর ভয়গুলো হল সাদাকালো গুটি, এদিকে তোর হাতে রয়েছে স্ট্রাইকার৷ এটা দিয়ে সব ভয়কে দূরে সরিয়ে দিতে পারবি তুই৷’

কী যেন ভেবে আবার বলে অনীশ, ‘ডাক্তারবাবু বলেছেন, মায়ের সব চিহ্ন ফেলে দিতে৷ শুধু এইটা লুকিয়ে রেখে দিয়েছিলাম৷ কেউ বুঝতেও পারেনি ওটা মায়ের চিহ্ন, তুই রেখে দে বরং৷ আর ভয় করবে না৷’

সবুজ স্ট্রাইকারটা নিয়ে হাসিমুখে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রাখে বীণা৷ অনীশ হাতটা ওর গা থেকে সরিয়ে নিয়েছিল৷ এবার ও নিজেই দাদাকে এক হাতে জড়িয়ে মাথা গুঁজে শুয়ে পড়ে৷

সকালে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বসতেই অনীশ দেখল বীণা ওকে ডাকছে৷ পায়ের কাছের জানলা দিয়ে বাইরে দেখে সবে ভোরের আলো ফুটেছে৷ কাল অনীশের কাছেই শুয়েছিল বীণা৷ কিন্তু এই সময়েই কি উঠে পড়ে? তা ছাড়া ওকে ডাকছেই বা কেন?

বীণার চোখে-মুখে চাপা সতর্কতা খেলা করছে৷ অনীশের জামার একটা প্রান্ত ধরে টানছে৷ সে বুঝল, ওকে কোথাও একটা নিয়ে যেতে চায় বীণা৷ ‘কী রে? কোথায় যাবি এত সকালে? মাসি বলেছে…’

মুখ থেকে চাপা শব্দ বের হল একটা৷ অনীশের মনে হল কাল রাতে ওর ভয় কমিয়ে দেওয়ার জন্য ওকে কিছু একটা উপহার দিতে চায় বীণা৷ সম্ভবত কিছু একটা দেখাতে চায়৷

ঠোঁটের উপরে আঙুল রেখে ওকে চুপ করতে বলল বীণা, তারপর জামার ভিতর থেকে সেই ছোট আঁকার খাতাটা বের করে তার বিশেষ একটা পাতা খুলে মেলে ধরল ওর চোখের সামনে৷

অনীশ সেদিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল৷ নতুন একটা গাছের ছবি একেছে বীণা৷ তবে সাধারণ গাছ নয়৷ গাছের কাণ্ডটাই যেন বিরাট একটা গুহার প্রবেশপথ৷ মাথাটা গিয়ে মিশেছে আকাশের বুকে৷ সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, গাছের ডাল-পালার মধ্যে চুল বেঁধে ঝুলে আছে কিছু মানুষ৷ যেন ফলের বদলে জীবন্ত মানুষ জন্ম দেয় গাছটা৷

‘কী এঁকেছিস এটা?’ স্তম্ভিত হয়ে জিজ্ঞেস করে অনীশ৷ এইটুকু বয়সের একটা মেয়ের মাথায় এমন কিম্ভুত ভাবনা-চিন্তার উদয় হওয়া সহজ কথা নয়৷ উত্তর না দিয়ে আবার অনীশের জামায় টান দিল বীণা৷ সে কথা বলে বোঝাতে পারবে না৷ তবে কিছু একটা দেখাতে চায়৷

অনীশ আর আপত্তি করল না৷ এগিয়ে গেল ঘরের দরজার দিকে৷ প্রথম দিন ইভাকে দেখার পর দম বন্ধ করা রহস্যের ভাবটা আবার ওর মনের ভিতর ফিরে এসেছে৷

দোতলা থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে একতলায় চলে এল বীণা৷ এখানে বড় প্যাসেজটা পেরিয়ে গেলেই বিরাট লাইব্রেরির দরজাটা চোখে পড়ে৷ দু-জনে কাঠের দরজা ঠেলে তার ভিতরে ঢুকে এল৷

মোট দু-টো ঘর নিয়ে লাইব্রেরি৷ তার তিন দিকের দেওয়াল জুড়ে জানালা৷ সেখান থেকে আলো ঢুকে ভরিয়ে রেখেছে দেওয়াল ভর্তি বইয়ের তাকগুলো৷ অনীশ একসঙ্গে এত বই আগে কখনও দেখেনি৷ নতুন, ঝকঝকে মলাট থেকে শুরু করে আদ্যিকালের একেবারে পুঁথি হয়ে যাওয়া বই অবধি সব আছে এখানে৷

জামার নীচের দিকে আবার টান পড়তে চটক ভাঙল অনীশের, একটা বিশেষ তাকের দিকে তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে বীণা৷ অনীশ সে-দিকে এগিয়ে যেতে তাকটার একেবারের উপরের র‌্যাকে একটা নতুন গোছের মোটা বই দেখিয়ে সেটা নামাতে ইশারা করল বীণা৷

র‌্যাকটা অনীশের হাতের নাগালেরও বাইরে৷ কোনওরকমে ল্যাং বাড়িয়ে নীচে নামিয়ে আনল বইটা৷ গল্পের বই বলেই মনে হচ্ছে৷ অনীশ সেটা উলটে-পালটে দেখতে যাচ্ছিল, তার আগেই বীণা ছোঁ মেরে কেড়ে নিল তার হাত থেকে৷

বইটা খুলতেই কিন্তু অবাক হয়ে গেল অনীশ৷ উপরের বইটা নকল৷ একটা পিচবোর্ডের বাক্সের ভিতরে ছোট একটা ফাঁক৷ তার ভিতরে অন্য একটা বই রাখা আছে৷ সেই বইটা একেবারে শতছিন্ন৷ পাতাগুলো হলদে ঝুরঝুরে হয়ে গেছে৷ দ্রুত পাতাগুলো উলটে একটা জায়গায় থেমে গেল বীণা৷ তারপর সেটা তুলে দিল অনীশের হাতে৷

ইশারায় তাকে পড়তে বলল জায়গাটা৷

অনীশ তাকিয়ে দেখল, ভিতরের লেখাগুলো বাংলায়৷ তবে, সেকেলে জাতের বাংলায়৷ কাছেই একটা টেবিল খুঁজে নিয়ে পড়তে শুরু করল সে৷ বীণা আঁকার খাতাটা সামনে রেখে একমনে তাকিয়ে রইল৷

বৌদ্ধ পুরাণের এক গাছের ব্যাপারে লেখা আছে সেখানে৷ এই গাছকে ঘিরে জড়িয়ে আছে এক আশ্চর্য গল্প৷ পুরাকালে দেবতা ইন্দ্র তার স্ত্রী বেসান্তরার জন্য এক মায়াবি জঙ্গল আর জঙ্গলের লাগোয়া কুটির তৈরি করেন৷ বেসান্তরা তাঁর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সেই কুটিরে সুখে বসবাস করতে থাকেন৷ কিন্তু একদিন এক বিপদ এসে উপস্থিত হয়৷ বেসান্তরা জঙ্গলে ফল তুলতে গেলে, জঙ্গলে বসবাসকারী কিছু সাধু তাঁকে আক্রমণ করে৷ বেসান্তরা কোনওরকমে পালিয়ে বাঁচেন৷ ইন্দ্র বুঝতে পারেন, জঙ্গলের সাধুদের আটকানোর জন্য কিছু ব্যবস্থা করতে হবে তাঁকে৷

ভেবে-চিন্তে ইন্দ্রের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে৷ তিনি জাদুবলে নারিফোন নামে একধরনের অলৌকিক গাছ সৃষ্টি করেন জঙ্গলে৷ এ গাছের শাখাপ্রশাখা থেকে ফুল-ফলের বদলে জন্মায় মানুষ৷ সতেরো কিংবা আঠেরো বছর বয়সী কিশোরীর দল৷ গাছমানুষ৷ স্বর্গের অপ্সরাদের মতো অপরূপ সৌন্দর্য তাদের৷

জন্মানোর পর থেকে গাছেই থাকে তারা৷ মিহি মন-ভোলানো সুরে গাইতে আর নাচতে পারে৷ জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো সাধুসন্তদের নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করাই এদের কাজ৷

কিছুদিন পর বেসন্তরা জঙ্গল ছেড়ে চলে যান৷ কিন্তু গাছ আর গাছ থেকে জন্মানো মেয়েরা থেকে যায়৷ তবে কিছু একটা কারণে দেবতারা মন্ত্রবলে ঘুম পাড়িয়ে দেন নারিফোন গাছকে৷ সেই অলৌকিক গাছ জঙ্গলেরই কোথাও ঘুমন্ত অবস্থায় রয়ে যায়৷

বইটার সঙ্গে লাগোয়া নারিফোনের একটা ছবিও দেওয়া আছে৷ পরের পাতা ওলটাতে গিয়েই থেমে গেল অনীশ৷ বইটা এই পাতাতেই শেষ৷ এরপরেও বেশ কিছু পাতা ছিল বটে, কিন্তু সেগুলো কেউ ছিঁড়ে নিয়েছে৷

মুখ তুলে কিছুক্ষণ থম মেরে থাকে অনীশ৷ বইয়ে লেখা গাছ-মানুষের বিবরণের সঙ্গে ইভার আশ্চর্য মিল৷ যদি ইভা গাছ-মানুষ হয়ে থাকে তাহলে এই জঙ্গলেরই কোথাও আছে সেই আশ্চর্য গাছ৷

অনীশের বুকের ভিতরে এতক্ষণে একটা চাপা উত্তেজনার স্রোত বইতে শুরু করেছে৷ মেয়েটা গাছ-মানুষ হলে কার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে? সেই সাধুসন্তদের কেউ? কিন্তু জঙ্গলের ভিতরে সন্ন্যাসীর দল থাকে বলে তো শোনেনি সে৷ কে তাড়া করছে তাকে? আর সব থেকে বড় কথা অনীশের সঙ্গে কী দরকার মেয়েটার?

বীণার হাত থেকে আঁকার খাতাটা নিয়ে দ্রুত উলটে দেখতে থাকে অনীশ, আর কিছু চোখে পড়ে না তার, ‘এই গাছ তুই দেখেছিস?’

মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করে অনীশ৷ বীণা কিছু একটা বলার চেষ্টা করে, কিন্তু তার মুখে ভাষা ফোটে না৷

দরজার কাছে পায়ের আওয়াজ শুনে তাকায় অনীশ৷ মেসোমশাই এসে দাঁড়িয়েছেন সেখানে৷ হাতে ছোট শটগানজাতীয় বন্দুক, অনীশের হাতের বইটার দিকে একবার চেয়েই চোখ সরিয়ে নিলেন তিনি, এগিয়ে এসে বললেন, ‘বাঃ বইপত্রে আগ্রহ আছে দেখছি, বেশ বেশ!’

—‘আচ্ছা মেসো, জঙ্গলের সব জায়গা তুমি চেনো?’

—‘ধুর পাগল, এত বড় জঙ্গল, তার সব জায়গা চেনা যায় নাকি?’

বইতে দেখা মোটা কাণ্ডের নারিফোন গাছটার কথা মনে পড়ে যায় অনীশের, মুখ তুলে বলে, ‘আচ্ছা মেসো, এ জঙ্গলে বড় গাছ আছে?’ ‘সে কী রে! এ জঙ্গলে ছোট গাছই তো নেই বরঞ্চ৷’

—‘না না৷ ওসব না, যেখানে…’ একটা বাঁকা হাসি খেলে যায় মুখে, বীণার আঁকার খাতাটা দেখিয়ে বলে, কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারে না৷

—‘এর মধ্যেই তোর মাথাটা খেয়েছে মনে হচ্ছে৷ ওরকম গাছ এ জঙ্গলে কোথাও একটা আছে শুনেছি৷ কিন্তু আমি নিজে চোখে দেখিনি, দ্যাখার কথাও নয়৷’

—‘কেন?’

—‘কারণ স্বাভাবিক অবস্থায় সে গাছ দেখতে আলাদা কিছু নয়৷ কেবল গুঁড়িটা অন্য গাছের থেকে আকারে একটু বড়৷ কেউ গাছকে জাগিয়ে তুললে তখন তার আসল রূপ দেখা যায়৷’

—‘জাগিয়ে তুললে মানে?’

সুজয় হাসে, অনীশের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘এসব জায়গায় ওরকম অনেক ফোকলোর থাকে৷ তবে লোকে বলে, দেবতারা কোনও গোপন মন্ত্রে সে গাছকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন৷ সেই মন্ত্র আবার যতক্ষণ না উচ্চারণ হচ্ছে ততক্ষণ সে গাছ আর জাগবে না৷ জঙ্গলের ভিতরে স্বাভাবিক চিরজীবী গাছ হয়েই থেকে যাবে৷ তাতে ফলও ধরবে না৷’

—‘আর একবার জেগে গেলে আর ঘুম পাড়ানো যাবে না তাকে?’

—‘যাবে, গাছকে মন্ত্র পড়ে যে জাগিয়েছে, সে যদি কোনওভাবে মারা যায়, তাহলে গাছ আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে৷’ নীচু হয়ে শটগানটা অনীশের হাতে তুলে দেয় সুজয়, ফিসফিস করে বলে, ‘যাবি নাকি একবার নারিফোন খুঁজতে?’

আনন্দের মাঝেও একটা কথা খেয়াল হয় অনীশের৷ এটুকু সে বুঝতে পারে, এ শহরে বীণা আর সে নিজে ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না ইভাকে৷ তবে কি বীণাই মন্ত্র পড়ে জাগিয়েছে নারিফোনকে? কিন্তু বীণা সে মন্ত্র জানল কোথা থেকে?

উত্তরটা খেলে যায় অনীশের মাথায়৷ বইয়ের শেষ ক-টা পাতা ছেঁড়া ছিল, সেখানেই হয়তো লেখা ছিল মন্ত্রটা৷ বীণা নিজেই নারিফোনকে জাগানোর পরে ছিঁড়ে নিয়েছে পাতা ক-টা৷ কিন্তু রেখেছে কোথায়?

—‘যাব,’ খুশি হয়ে বলে অনীশ, ‘বোনও চলুক আমাদের সঙ্গে৷’

—‘কী রে, তুই যাবি নাকি?’

বীণা খুশি হয়ে ঘাড় নাড়ে৷

বাড়ি থেকে বেরোনোর ঠিক আগে, একবার জঙ্গলের দিকে তাকায় অনীশ৷ আবার সেই পুরোনো অনুভূতিটা ফিরে আসে ওর বুকের ভিতরে৷ কিন্তু কৌতূহলের বদলে একটা ভয় এসে চেপে ধরে ওকে৷ যেন আগের চোখ দু-টো নয়, অন্য দু-টো নতুন চোখ চেয়ে আছে ওর দিকে এবং সে চোখের দৃষ্টিতে একটা হিংস্র ভাব৷

(পাঁচ)

বীণার হাতটা ধরে ছিল অনীশ৷ তবে বীণা মাঝে মাঝেই হাত ছেড়ে জঙ্গলের ভিতরের দিকে ছুটে যেতে চাইছে৷ অনীশের উপর কড়া নির্দেশ৷ যাই হয়ে যাক না কেন, সুজয়ের দৃষ্টির বাইরে যেন না যায় ওরা৷

অনীশের ভিতরে ভিতরে খানিকটা ভয়ই করছে৷ মনের ভিতরে কে যেন বলে চলেছে, সবুজ পাতার আড়াল থেকে কেউ একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওদের দিকে৷ মাঝে মধ্যেই ফিরে তাকাচ্ছে, গাছের মাথা, কাণ্ডের ফাঁক দিয়ে গিয়ে আটকে যাচ্ছে ওর চোখ৷ নাঃ, কেউ নেই৷

—‘এই জঙ্গলের একটা মজা কী জানিস? সারাবছর জঙ্গলের ভিতর থেকে একটা আওয়াজ শোনা যায়, মানুষের গলার স্বরের মতো৷ তবে বিকট, ভয়ংকর আওয়াজ৷ দূর থেকে সে ক্ষীণ আওয়াজ শুনেই লোকের পিলে চমকে যায়৷’

—‘কারা করে আওয়াজ?’ অনীশ জিজ্ঞেস করে৷

সুজয় হেসে বলে, ‘কারা আর করবে, কোনও গাছের কাণ্ড হয়তো এমন ভাবে তৈরি হয়েছে, যে হাওয়া দিলে সেখান থেকে ওরকম ভূতুড়ে আওয়াজ ওঠে৷ তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হল…’ সামনে থেকে একটা গাছের ডাল সরাতে সরাতে সুজয় বলে, ‘শীতকালে ব্যাপারটা পালটে যায়৷ ডিসেম্বর মাসেও জঙ্গল থেকে একটা আওয়াজ আসে, সেটাও গানের সুরের মতো, কিন্তু মিষ্টি৷ যেন জঙ্গলের ভিতরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মজলিস বসেছে৷ তবে গলার আওয়াজটা মেয়েলি৷ কেন যে হয়!’

—‘আর ওই সময়েই লোকে উধাও হয়ে যায় জঙ্গলে ঢুকে?’

একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বীণার হাতটা ধরে সুজয়, তারপর কী যেন ভেবে বলে, ‘ব্যাপারটা ঠিক তা নয়, এ জঙ্গলে প্রায় সারাবছরই দু-একজন করে লোক উধাও হতে থাকে৷ তবে ওই ডিসেম্বর নাগাদ যারা উধাও হয় তাদের আর বডি পাওয়া যায় না৷ জঙ্গলের ভিতর থেকে যেন উবে যায় তারা৷’

—‘আর বাকিদের?’

সুজয় উত্তর দেয় না৷ তার একটা কারণও আছে অবশ্য৷ জঙ্গলের ভিতরের দিক থেকে একটা চাপা শব্দ শোনা গেছে৷ শব্দটা ভারী৷ কিন্তু পায়ের আওয়াজ নয়, বোঝা যায় সেটা আসছে কোন জীবিত প্রাণীর স্বরযন্ত্র থেকে৷ ক্ষীণ, তাও যেন একটা অশুভ সংকেত আছে তাতে৷

বীণা কান খাড়া করে তাকিয়েছে সেদিকে৷ শটগান সামনে তুলে ধরে বীণাকে আড়াল করে সেদিকে এগিয়ে যায় সুজয়৷ অপরিচিত শব্দের তীব্রতা বেড়ে ওঠে৷ খানিক দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে৷

একটা বছর কুড়ির মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলের ভিতরে৷ সমস্ত শরীরে সূক্ষ্ম পাতার মতো পোশাক৷ নাচের ভঙ্গি ছড়িয়ে পড়ছে অঙ্গে অঙ্গে৷ গুনগুন করে সুরেলা গানটা গাইতে গাইতে নাচছে সে৷ মেয়েটাকে চিনতে পারল অনীশ — ইভা৷ তাকে ডাকতে গিয়েও থেমে যায় অনীশ৷

হঠাৎ পায়ের শব্দে সুজয়কে দেখতে পেয়ে, গান থামিয়ে তার দিকে অবাক হয়ে চাইল ইভা৷ ধীরে ধীরে একটা হাত তুলে হাতছানি দিয়ে ডাকল কাছে৷ অনীশ চেয়ে দেখল সুজয়ের চোখের মণির রঙ বদলে গেছে৷ এই অপ্সরার ঢলঢলে রূপ আর মায়াময় কণ্ঠের জাদু যেন সম্মোহিত করেছে তাকে৷ সে এক-পা এক-পা করে এগিয়ে যায় মেয়েটার দিকে৷

অনীশের মন বলে ওঠে, ইভা নিজের মধ্যে নেই৷ কিছু একটা বদলে গেছে ওর মধ্যে৷ অশুভ কোনও ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে শরীরের মুর্ছনায়৷

—‘মেসো যেও না ওদিকে৷’ চিৎকার করে ওঠে অনীশ৷ কিন্তু সে শব্দ কানে যায় না সুজয়ের৷ তার কানে কেবল ধ্বনিত হচ্ছে ওই অপরূপ কিশোরীর মৃত্যুময় সঙ্গীতের আস্কারা৷

—‘মেসো তোমাকে ও…’

কয়েক মুহূর্তের জন্যে থেমে গিয়েছিল সুজয়৷ একটু যেন চেতনা ফিরেছে তার৷ পিছন ফিরতে যায় সে, সঙ্গে সঙ্গে সেই তিলোত্তমা কিশোরীর মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে জিভটা, নিকশ কালো শুঁড়ের মতো একটা জিভ৷ প্রায় পাঁচ মিটার দূরে ছিটকে বেরিয়ে এসে সুজয়ের গলা বুক ঘাড়ে স্পর্শ করতে থাকে সেটা৷ অনীশ ভয়ার্ত চোখে চেয়ে দেখে ইভার চোখ দুটো ঘন হলুদ হয়ে গেছে৷ তার মসৃণ চামড়া ভেদ করে শরীরে সমস্ত শিরা-উপশিরা বীভৎসভাবে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে৷ যেন শিরা নয়, গাছের মোটা শিকড় দিয়ে তৈরি হয়েছে তার শরীর৷

সুজয় আরও এগিয়ে যাচ্ছিল সেদিকে৷ বীণা ছুটে গিয়ে তার জামার পেছন দিকটা খামচে ধরল৷ ইভার হলদে চোখ নেমে এল বীণার দিকে৷ সঙ্গে সঙ্গে হাতের রাইফেলের বাঁট দিয়ে মেয়ের মাথায় সজোরে একটা বাড়ি মারল সুজয়, ‘আহ! বিরক্ত করিস না আমাকে৷ দেখছিস না? ও ডাকছে আমাকে?’

চাপা শব্দ করে মাটিতে ছিটকে পড়ল বীণা৷ মাথা ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল তার, অনীশের দিকে চেয়েই পিছু হাঁটতে শুরু করেছে সুজয়৷ তার নিজের চোখেও ঘন হলদে রং ফুটতে শুরু করেছে, ঠোঁটের কোণে চাপা পৈশাচিক হাসি খেলা করছে, অনীশের দিকে চেয়ে সে বলল, ‘তোরা বাড়ি যা, আমার একটু দেরি হবে৷’

পিছোতে গিয়ে হঠাৎ মাটিতে পড়ে গেল সুজয়৷ ইভার গান এতক্ষণে থেমে গিয়েছে৷ বুকে হেঁটে সুজয়ের দিকে এগিয়ে এল সে৷ কীসের একটা লোভ চিকচিক করছে তার সমস্ত শরীর জুড়ে৷ সুজয়ের গলার কাছে এসে একবার তার মুখের উপরে হাত বুলিয়ে নিল৷

তারপর সে যা করল তাতে অনীশের বুকের ভিতরের সমস্ত রক্ত গলে জল হয়ে গেল৷ দু-হাতে নিজের মাথার চুল দু-দিক থেকে চেপে ধরে টানতে লাগল ইভা৷ সেই টানে তার মাথার দু-দিক থেকে মুখমণ্ডল দু-ফাঁক হয়ে সরে গেল৷ ঠিক যেন একটা কাপড়ের মুখোশ পরে ছিল সে এতক্ষণ৷ সেই মুখোশ দু-দিকে খসে পড়ে এখন হিলহিলে সাপের মতো বিকট আকৃতির একটা মুখ বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে৷ দুটো প্রায় অদৃশ্য কিন্তু হলদে চোখ আছে সেখানে৷ মুখের ভিতর থেকে জিভটা বেরিয়ে এল কিছুটা, ক্রমশ এগিয়ে গেল সুজয়ের মুখের কাছে৷

—‘ইভা৷’ চিৎকার করে উঠল অনীশ৷ প্রাণীটা ফিরেও তাকাল না ওর দিকে৷ কিন্তু থেমে গেল জিভটা৷ আরও একটা শব্দ ভেসে আসছে৷ অনীশ চেয়ে দেখল মাটিতে পড়ে থাকা বীণার একটা হাত উঠে এসেছে উপরে৷ কপাল থেকে নামা রক্ত মুখ ভাসিয়ে দিচ্ছে তার৷ কিন্তু তার মধ্যেও উঠে আসা হাতটা ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করেছে৷ একটা বিশেষ ছন্দে আন্দোলিত হচ্ছে বীণার হাতটা৷ মিষ্টি গানের সুর…

মুখ তুলে আকাশের দিকে চেয়ে তীব্র হিসহিসে একটা শব্দ করে উঠল প্রাণীটা৷ তারপর মাটির উপর দিয়ে কালো সর্পিল বিদ্যুৎরেখার মতো হারিয়ে গেল জঙ্গলের ভিতরে৷

এতক্ষণ সুজয়ের চোখ খোলাই ছিল৷ প্রাণীটা মিলিয়ে যেতেই তার চোখে আবার রং ফিরে এল৷ হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইল সে৷

—‘বীণা!’ এক দৌড়ে সেদিকে এগিয়ে গেল অনীশ৷ জঙ্গলের একটা গাছের গুড়ির উপরে মুখ গুঁজে পড়ে আছে মেয়েটা৷ বুকের স্পন্দন হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ৷

(ছয়)

বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ থেকে উসখুস করছিল অনীশ৷ ঘুম আসছে না কিছুতেই৷ মাথার ভেতর হাজারও চিন্তা জড়ো হয়ে আসছে৷ কাল থেকে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে বীণা৷ ডাক্তার বলেছেন, যে কোনও সময় খারাপ খবরের জন্য তৈরি থাকতে৷ মাসি, মেসো দু-জনেই হাসপাতালে৷ এত বড় বাড়িটায় অনীশ একা৷

কয়েকবার এপাশ-ওপাশ করে শেষে উলটো হয়ে শোয়ার চেষ্টা করতেই মনে হল, ওর ডানদিকের দেয়ালের গায়ে কিছু একটা নড়ে উঠছে৷ মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করতেই দুটো জ্বলজ্বলে চোখ দেখতে পেয়ে মুহূর্তের জন্যে চমকে উঠল অনীশ৷ ইভা৷ ব্যাপারটা বুঝতে কিন্তু আর ভয় পেল না অনীশ, বরঞ্চ অদম্য রাগে তার কপালের শিরা দপদপ করে উঠল, ‘তুই? তোর জন্য বীণা…’

—‘কী করেছি আমি?’

—‘তুই মিথ্যেবাদী৷ এই জঙ্গলে তুই ছাড়া আর কেউ নেই৷ তুই মেসোকে ওইভাবে…’ ছুটে গিয়ে ইভাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে অনীশ৷ কিন্তু পারে না৷ মনে হয় ওর শরীরটা অসম্ভব ভারী হয়ে উঠেছে৷ মেয়েটা চাইলেই অনীশের শরীর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, ‘উঠিস না এখন৷ অদ্ভুত একটা রাত আজ তাই না রে?’

ইভার গলা উদাস শোনায়৷ বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছে সে৷ অনীশ আবার উঠতে যায় বিছানা থেকে৷ ব্যর্থ হয়৷

—‘কী চাস তুই? এই মানুষগুলো কী ক্ষতি করেছে তোর?’

ইভা উত্তর দেয় না৷ তার মায়াময় কণ্ঠ যেন অন্য কোনও জগৎ থেকে ভেসে আসছে, ‘একদিন বলছিলি মনে আছে, তোর কোনওদিন কোনও বন্ধু ছিল না…’

অনীশ আস্ফালনের চেষ্টা করতে থাকে৷ ইভা বলেই চলে, ‘আমার ছিল, একটাই বন্ধু৷ রোজ বিকেল হলে সবাইকে লুকিয়ে আমার কাছে চলে আসত ও৷ দু-জনে খেলতাম সন্ধে পর্যন্ত৷ আমার এই পৃথিবীতে ও ছাড়া আর কেউ ছিল না৷’

—‘আর আজ তোর জন্য সে মরতে বসেছে৷’

হুট করেই অনীশের মুখের সামনে চলে আসে সে, ‘এখন আমার একটা নতুন বন্ধু হয়েছে৷’

—‘আমি? আমি ঘৃণা করি তোকে৷’

আনমনেই একটা গান গেয়ে চলেছে ইভা৷ সুরটা চেনা লাগে না অনীশের৷ ইভার একটা আঙুল তার কপাল আর মুখের উপরে ঘুরে বেড়াতে থাকে৷ যেন মুখের উপরে হাত বুলিয়ে তাকে ভালো করে বোঝার চেষ্টা করছে৷ সবজে চোখের মণি জ্বলে উঠছে বারবার৷ অনীশ অস্বস্তিতে ছটফট করতে থাকে৷

—‘চল ঘুরে আসি একটু, জঙ্গল জেগে উঠেছে আজ৷’

অনীশের হাত ধরে একটা টান দেয় ইভা৷ অনীশ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও বিফল হয়৷

—‘ছেড়ে দে আমাকে৷’

—‘তোর খুব জঙ্গল দেখতে ইচ্ছা করে, না রে? চল, একটা জায়গা দেখিয়ে আনি তোকে৷’

হাত ধরে টেনে বারান্দার রেলিং-এর কাছে এনে দাঁড় করায় তাকে ইভা৷ দমকা হাওয়ার স্রোত ওদের ঠেলে ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে চাইছে এখন৷ হঠাৎই হেসে ফেলে অনীশ, একটা ভাবনা মাথায় আসতে মনটা হালকা হয়ে গেছে তার, ইভা অবাক হয়ে তার দিকে চায়৷

—‘এই তুই হাসছিস কেন?’

—‘বীণা ছাড়া কেউ তোকে দেখতে পায়নি৷ মানে বীণাই নারিফোনকে জাগিয়েছে৷ এখন বীণা যদি মরে যায় তাহলে তুইও থাকবি না৷’

অপ্রত্যাশিত বাঁকা হাসি হাসে ইভা, ‘তোর কষ্ট হবে না?’

—‘কষ্ট! আনন্দ হবে আমার,’ হো হো করে হেসে ওঠে অনীশ৷

—‘বেশ, আমারও আজ একটু আনন্দ হোক৷’ ইভার মুখ লাল হয়ে ওঠে৷ বড় করে একটা নিশ্বাস নেয় সে৷ তারপর আচমকাই সজোরে ধাক্কা মারে অনীশের পিঠে৷ অনীশ টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গ্রিলের ওপারে৷ ইভার হাতের চাপে বারান্দা থেকে বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে আসে সে৷ উপর থেকে ইভার সুরেলা গলা শুনতে পায়, ‘আজ আমার শেষ আনন্দের দিন’

কানের পাশ দিয়ে শনশন করে হাওয়া বইছে৷ কিন্তু মুখ থেকে চেষ্টা করে কোনও শব্দ বের করতে পারে না৷ অনীশ বুঝতে পারে, শরীরটা মাটির দিকে নেমে আসছে৷ আর কয়েক মিটার নীচে নামলেই… চোখ বন্ধ করে ফেলে সে৷

হাওয়াতেই এক সেকেন্ডের জন্য থেমে যায় অনীশের শরীরটা৷ পিঠে আবার সেই মোমের মতো হাতটা এসে পড়েছে৷ মাটি ছেড়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে ওর শরীর৷ ওর ঠিক পাশেই ওর মতোই হাওয়ায় ভেসে রয়েছে ইভা৷ তার আঙুলের ডগায় সবজে আলোটা আবার জ্বলতে শুরু করেছে৷ হাওয়ার উন্মাদ বেগের শব্দ ছাপিয়ে আবার গানের সুর কানে আসে৷ অবাক হয়ে যায় অনীশ, ‘কী চাস তুই?’

মোহময় হাসি ছড়িয়ে পড়ে ইভার মুখে, ‘বলেছিলাম না একটা জায়গা দেখাব তোকে, বলেছিলাম না আজ একটা সুন্দর মায়াবী রাত?’

এখন আর নীচের দিকে নয়, মাটি থেকে মিটার পঞ্চাশেক উঁচুতে শূন্যে ভাসতে ভাসতে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে চলেছে ওরা৷ ওদের ঘিরে রেখেছে সেই সবজে আলোর আবছা বৃত্ত৷

জঙ্গলের মাথার উপর বিরাট গোল চাঁদ উঠেছে আজ৷ গাছপালার স্রোতের মধ্যে দিয়ে সেদিকেই যেন উড়িয়ে নিয়ে চলেছে ওকে ইভা৷

কয়েক সেকেন্ড পরেই অনীশ দেখল, এক অদ্ভুত নৈসর্গিক দৃশ্য ফুটে উঠেছে ওর পায়ের তলায়৷ ঘন অন্ধকারে ঢাকা মহীরুহের জঙ্গল যেন লম্বা লম্বা পাতা আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে বারবার স্পর্শ করতে চাইছে ওর পা৷ অন্ধকারের ভিতরেও জঙ্গলের ঢাকা পড়া মাটির উপর থেকে রাশি রাশি জংলি জানোয়ার যেন হাঁ করে উপরে তাকিয়ে চেয়ে আছে ওর দিকে৷

চাঁদের পাশ দিয়ে কয়েকটা বাদুড় উড়ে গেল৷ জঙ্গলের গভীরতম প্রান্ত থেকে অচেনা কোনও প্রাণী আকাশ বিদীর্ণ করে শিস দিয়ে উঠল৷ কয়েক মুহূর্তের জন্য রোজ রাতের সেই ভয়ঙ্কর স্বপ্ন, আত্মহত্যা, নারিফোন গাছ, মা, বীণার রক্তাক্ত মুখের কথা ভুলে গেল অনীশ৷ এক অপার্থিব স্বপ্ন যেন কোনও রূপকথার দেশে বয়ে এনেছে ওকে৷ গুনগুন গানের সুর এখন আরও সুরেলা হয়েছে৷ মনে হল, এভাবে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ঘুমিয়ে পড়বে৷

পাশ ফিরে তাকাতে সে দেখল, ইভা এখনও ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে৷ ও অবাক হয়ে সম্মোহিতের মতো জিজ্ঞেস করল, ‘কী চাস তুই? কী চাস আমার থেকে?’

ইভা বিরক্ত হয়৷ ওর চোখে চোখ রেখে বলে, ‘জানিস, সব প্রশ্নের উত্তর প্রশ্ন করে পাওয়া যায় না?’

—‘তাহলে?’

দুটো ভাসমান শরীর ধীরে ধীরে একটা জেগে থাকা উঁচু সিডার মাথার ওপরে নেমে আসে৷ অন্য গাছগুলোকে ছাড়িয়ে এই গাছের ডাল খানিকটা যেন আকাশের দিকে আঙুল বাড়িয়েছে৷

একটা মোটা ডালের উপরে বসে পড়ে দু-জনে৷ এখানে হওয়ার স্রোত কিছুটা কমে গেলেও কনকনে ঠান্ডা অনীশের হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে৷ হাওয়ার স্রোতে ইভার চুলগুলো উড়তে শুরু করেছে৷ সমস্ত শরীর থেকে একটা সবুজ আভা বেরিয়ে আলোর আবছা বৃত্ত রচনা করে রেখেছে ওদের চারপাশে৷

গাছের ডালটা শক্ত করে ধরে অনীশ, এখান থেকে পড়ে গেলে বাঁচার আশা নেই৷ নাকি মেয়েটা বাঁচিয়ে নেবে ওকে?

ইভা গাছের একটা ডালে হেলান দিয়ে বসে৷ গুনগুন স্বরটা থেমেছে এতক্ষণে, ‘আমরা এখানে এসে বসতাম একসময়, জানিস? মগডালে৷ আমি আর… এখান থেকে গোটা জঙ্গল দেখা যায়৷’

দূরে বৃক্ষরাজির উপর এসে পড়া জ্যোৎস্নার চাদরের দিকে চেয়ে বলে ইভা, ‘আজও রোজ রাত হলে এখানে এসে বসি আমি, মনে হয় একটু পরেই নীচে খসখস আওয়াজ হবে, ও এসে আমাকে ডাকবে, ‘ইভা, ইভা’!’

—‘কে?’

অনীশের দিকে চোখ ফিরিয়ে মিষ্টি করে হাসে ইভা, ‘কেন তুই ডাকবি না? তুই আমার বন্ধু নোস?’

অনীশ কিছু উত্তর দিতে যাচ্ছিল, থেমে যায়, নীচের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমার এখনও বিশ্বাস হয় না তুই মেসোকে ওইভাবে…’

—‘আজ থেকে দশ দিন আগে আমার মতো কেউ থাকতে পারে বলেই বিশ্বাস হত না তোর৷’

—‘তুই সত্যি করে বল, জঙ্গলের মধ্যে ওটা তুই ছিলি না? তুই বীণার কোনও ক্ষতি করিসনি?’

ডালের উপরেই কিছুটা সরে আসে ইভা, ‘করেছি৷ এই জঙ্গলে যতগুলো মানুষ মারা গিয়েছে, তাদের সবাইকে আমি একা মেরে ফেলেছি৷’ বড় করে নিঃশ্বাস নেয় ইভা, ‘চিন্তা করিস না, আমি চলে যাব এখান থেকে৷’

আর কোনও উত্তর দেয় না অনীশ৷ সে-ও ডালের একটা দিকে হেলান দিয়ে বসে৷ চোখ থেকে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে নামে তার৷ থুতনিটা ভিজে যায়৷ অল্প চাঁদের আলোতেও সেটা দেখতে পায় ইভা, ওর দিকে সরে এসে কাঁধে একটা হাত রাখে, ‘মায়ের জন্য কষ্ট হয়, তাই না?’

কাঁধ ঝাঁকায় অনীশ, ‘মায়ের সুইসাইড নোটটা বাবাকে লেখা ছিল৷ আমাকে কিছু বলে যায়নি৷’

—‘কেন? তুই কী শুনতে চাইছিলি?’

—‘আমার মা খুব সাহসী ছিল, লড়াই করতে পারত, একা৷ কোনওদিন কোনও সমস্যাকে ভয় পায়নি৷ শেষে ঠিক কোন কারণে…’

—‘লড়াই করতে পারি বলেই কি লড়াই করে যেতে হয় সবসময়? যে লড়াই লড়তে গিয়ে আরও কয়েকটা মানুষের ক্ষতি হয় সেটা করে লাভ কী?’ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে অনীশ, ইভার উলটোদিকে চেয়ে মুখ আড়াল করে বলে, ‘সবাই চলে যায় কেন বলতো? মা, তুই, বীণা— যাদের আমি ভালোবাসি৷’

অনীশের থুতনি থেকে জলটা মুছে দেয় ইভা, ‘মানুষ তো কোথাও যেতে পারে না রে৷ আমাদের মতো, মানুষকে তো কোনও উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয় না৷ আকাশের বুকে ছেঁড়া মেঘের মতো ঘুরে বেড়ায়৷ তবে হ্যাঁ…’

হাতের চাপে অনীশকে আর একটু কাছে টেনে নেয় ইভা, ‘মাঝে মাঝে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যায় বটে, তবে চিহ্ন রেখে যায়৷ মানুষ চিহ্ন না রেখে কোথাও যেতে পারে না৷’

অনীশ কাঁধ ঝাঁকায়, ‘ধুর ডাক্তারবাবু বলেছে মায়ের কোনও চিহ্ন আমার আশপাশে না রাখতে৷’

অনীশের মুখটা তুলে ধরে ইভা, ‘তা কী করে হয়? তোর মায়ের সব থেকে বড় চিহ্ন তুই নিজে৷’

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে অনীশ, তারপর ভেজা গলায় বলে, ‘ধুর, এসব ভালো লাগছে না আমার৷’

—‘তাহলে?’

আচমকাই সরে এসে ইভার কাঁধে মাথা রাখে অনীশ৷ প্রথম হকচকিয়ে যায় ইভা৷ তারপর হেসে ফেলে৷ চাপাস্বরে বলে, ‘আচ্ছা শোন, কাল বেলা ঠিক এগারোটার সময় খুব মন দিয়ে কান পাতলে জঙ্গল থেকে একটা শব্দ শুনতে পাবি৷ অনেকটা গানের মতো৷ সেটা খেয়াল করে জঙ্গলের ভিতরে চলে আসবি৷’

—‘তুই থাকবি তো?’ চোখ বন্ধ করেই জিজ্ঞেস করে অনীশ৷

—‘থাকব, চিন্তা করিস না৷’

—‘করব না, একটা গান শোনা৷’

কয়েক পলক চুপ করে থাকে ইভা৷ ওদের ঘিরে হাওয়ার চলাচল আগের থেকে কমে এসেছে৷ জঙ্গলের বুক থেকে ভেসে আসা রাতচরা প্রাণীদের শব্দ এক নৈসর্গিক তান তুলেছে৷ তাতে গলা মিলিয়েই একটা অচেনা সুরে গান ধরে ইভা৷

অদ্ভুত একটা ম্যাজিক ঘটে তাতে৷ আলো জ্বলে না, হাওয়ার বেগ পালটায় না৷ কেবল চোখে জলের বাষ্প নিয়ে অনেকদিন পর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে অনীশ৷

(সাত)

তীব্র শব্দেই ঘুম ভাঙে অনীশের৷ তবে জঙ্গল থেকে ভেসে আসা নয়৷ একতলা থেকে৷ একরাশ লোক সেখান জড়ো হয়েছে কোনও কারণে৷ কান্নার শব্দ আসছে৷ মাসির বিলাপ শুনতে পায় অনীশ৷

মুহূর্তে বিছানা ছেড়ে মাটিতে নেমে আসে৷ সিঁড়ি বেয়ে একতলায় নেমেই সে থমকে যায়৷ একটা সাদা গদির উপরে শুয়ে আছে বীণা৷ বারবার মেয়ের মৃতদেহের উপরে আছড়ে পড়ছে শর্মিলা৷ কখনও তেজ হারিয়ে তার শরীরটাও নিথর হয়ে যাচ্ছে৷

অনীশকে দেখতে পেয়ে জগদীশ এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল, ‘বীণা তোকে…’

কথাটা শোনে না অনীশ৷ জগদীশের হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে সে চলে গেল অনেকটা দূরে৷

‘কোথায় যাচ্ছিস তুই? জঙ্গলের দিকে যাস না,’ কিন্তু ওকে বাধা দেওয়ার কারও কোনও গরজ নেই আর৷ জগদীশ হাল ছেড়ে দেয়৷

সমস্ত মুখ লাল হয়ে উঠেছে অনীশের৷ বীণা মারা গিয়েছে৷ মানে ইভাও আর নেই কোথাও৷ অনীশের মনে হল আর কিছুর পরোয়া করে না ও৷ আজ যে-ভাবেই হোক ওকে জানতে হবে কেন মরতে হল বীণাকে৷ কেন ইভা সেদিন জঙ্গলের ভিতরে ওভাবে…

জঙ্গলে পা রাখার আগেই একটা শব্দ শুনতে পেয়েছে অনীশ৷ একটা গানের সুর৷ দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে সেটা লক্ষ করেই জঙ্গলের ভিতরের দিকে ছুটতে থাকে৷ পিছনে বীণার মৃতদেহকে ঘিরে বিলাপের শব্দ কমে আসছে৷ খানিক দূর আসতেই কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে গেল অনীশ৷ ওর সামনেই একটা গাছের গোড়ায় লম্বাটে কিছু পড়ে আছে৷ মানুষের শরীর কি?

ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল অনীশ৷ জিনিসটার কাছাকাছি পৌঁছেই বুঝতে পারল ব্যাপারটা৷ মানুষ নয়, মানুষের খোলস৷ একটা কিশোরী মেয়ের দেহের খোলস৷ সে খোলসটা এতক্ষণ যে পরে ছিল, তার গলা গাছের ফাঁক থেকেই গানের সুরের মতো শোনা যাচ্ছে৷

পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় সে৷ জঙ্গলের একটা বিশেষ জায়গায় কয়েকটা গাছের পাতা জমাট বেঁধে কী যেন আড়াল করে রেখেছে৷ একটা পাতা সরিয়ে সেখানে চোখ রাখতেই তার পা কেঁপে যায়৷ ওর সামনেই একটা কয়েক গজের উন্মুক্ত জায়গা৷ তার একদিকের কোণে দাঁড়িয়ে আছে সেদিনের সেই বিকটাকার খয়েরি সাপের মতো স্যাঁতস্যাঁতে একটা প্রাণী৷ সরীসৃপ হলেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে সে৷

অনীশের পা কেঁপে যাওয়ায় একটা আওয়াজ হয়েছিল৷ মুহূর্তে প্রাণীটা ফিরে তাকাল ওর দিকে৷ অনীশ অবাক হয়ে দেখল প্রাণীটার খুদে প্রায় অদৃশ্য সাপের মতো চোখ দুটো পালটে গেল কিশোরীর মোহময় চোখে৷ যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য সে ভুলে গিয়েছে, মানুষের খোলসটা গায়ে নেই৷

পরমুহূর্তে সেটা খেয়াল হতেই তীব্র শিস-ধ্বনি বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে৷ এক অপার্থিব সুরেলা অথচ ভয়ংকর শব্দ করে প্রাণীটা বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে এসে দাঁড়াল ওর চোখের সামনে৷

উন্মাদের মতো জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে দৌড়োতে শুরু করল অনীশ৷ ওর পিছনে সেই ভয়াবহ ডাকটা বেড়ে উঠেছে৷ মনে হল, একটু একটু করে নিজের মাথার উপরে নিয়ন্ত্রণ হারাবে ও৷ সমস্ত চেতনা অন্য কারও দখলে চলে যাবে৷ জঙ্গলের গাছগুলো আরও বেশি করে ঘেঁষে এল ওর দিকে৷ মাটির উপরে আছড়ে পড়ল অনীশ৷ মাথাটা সজোরে ঠুকে গেল জঙ্গলের মাটিতে৷

চোখ তুলে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল, সেই কুৎসিত প্রাণীটা এগিয়ে আসছে ওর দিকে৷ তার অন্ধকার মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা শব্দ আরও তীব্র হয়েছে, আরও৷ অনীশ বুঝল, মৃত্যু পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে৷

ঠিক এই সময়ে একটা ঝোড়ো হাওয়ার দাপট আচমকাই যেন উড়িয়ে নিল অনীশের শরীরটাকে৷ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে শুনতে পেল, শনশনে হাওয়া ওর কানের পাশ দিয়ে বইছে, সেই সঙ্গে ওই বিকট শব্দটা ঢেকে দিয়ে বেজে চলেছে একটা চেনা গান৷

চোখ খুলতেই চেনা মুখ দেখতে পেল অনীশ৷ ইভার সবুজ চোখের মণিদুটো ওর মুখের উপরে স্থির হয়ে আছে৷

‘‘তুই! কিন্তু তুই তো…’

উত্তর না দিয়ে শূন্যে ভেসে একটা গাছের ভাঁজ হওয়া মোটা ডালের উপরে ওকে শুইয়ে দিল ইভা৷

সতর্ক চোখে দেখে নিল চারপাশ৷ নাঃ, বিপদ আপাতত কেটে গেছে৷ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘চুপ, কোনও কথা নয়, ওরা আশপাশেই আছে৷’

কথাটা অনীশের কানে যায় না, সে উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বলে, ‘কিন্তু বীণা তো মারা গিয়েছে৷ ও যদি নারিফোনকে জাগিয়ে থাকে তাহলে তুই বেঁচে আছিস কী করে?’

ডালের উপরে বসেই নিজের বুকের কাছটা চেপে ধরে ইভা, সেই জায়গাটা লাল হয়ে আছে, দম নিতে নিতে বলে, ‘আছি, কারণ বীণা নারিফোনকে জাগায়নি৷’

—‘তাহলে কে জাগিয়েছিল?’

—‘তোর মা৷ আজ থেকে তিরিশ বছর আগে৷’

উত্তরটা মাথায় ঢুকতে কিছুটা সময় নেয় অনীশের, প্রায় কয়েক মিনিট পরে প্রশ্ন করে সে, ‘কিন্তু বীণার যদি কোনও ক্ষমতা না থাকে তাহলে ও মেসোমশাইকে বাঁচাল কী করে?’

—‘বীণা বাঁচায়নি৷’ ইভার বুকের যন্ত্রণাটা বেড়ে ওঠে, একটু আগেই অনীশকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণীটা আক্রমণ করেছিল তাকে৷ গলার স্বর আরও ক্ষীণ হয়ে আসে ইভার, ‘নিম্ফ যাকে আক্রমণ করে তার মাথার উপরে আর নিয়ন্ত্রণ থাকে না কারও৷ ফলে ঘটনার কথা সে কিছু মনেও থাকে না৷ কিন্তু যে তাকে বাঁচাচ্ছে তার কথা মনে রাখতে পারে৷ আমি চাইনি আমার কথা তোরা দু-জন ছাড়া কেউ জেনে যাক, তাই গাছের আড়াল থেকে ওর শরীরটা ব্যবহার করেছিলাম আমি৷’

ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় নেয় অনীশ, ইভা যে মানুষের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার প্রমাণ ও আগেও পেয়েছে৷

—‘মানে সেদিন যে গানটা মেসোকে বাঁচিয়েছিল সেটা তুই গাইছিলিস?’ উত্তরের আশা না করে আবার প্রশ্ন করে অনীশ, ‘কিন্তু মা-ও তো মারা গিয়েছে৷’

হঠাৎ করেই তার মুখের কাছে মুখ আনে ইভা, তারপর চাপা ফিসফিসে গলায় বলে, ‘যা বলছি মন দিয়ে শোন৷ আজ থেকে তিরিশ বছর আগে একটা পুরোনো ডায়েরি খুঁজে পায় তোর মা, সেই ডায়েরির পিছনের পাতায় জঙ্গলের মধ্যে একটা গাছের হদিশ আর একটা মন্ত্র লেখা ছিল৷ জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে সেই গাছ খুঁজে বের করে বাচ্চা মেয়েটা৷ খেলার ছলে মন্ত্রটা পড়ে গাছটাকে জাগিয়ে তোলে সে৷ তবে রুমি একটা কথা জানত না— গাছকে একবার জাগিয়ে তুললে প্রতিবছর শীতের সময় একবার করে ফল দেয় সে৷ সেই ফল মানুষে পরিণত হয় বটে, কিন্তু গাছের বন্ধন ছেড়ে বেরোতে পারে না৷ তার জন্য দরকার হয় আর একটা জীবিত মানুষের৷ জঙ্গলের ভিতরে কাঠ কাটতে আসা কাঠুরেদের গান গেয়ে টেনে আনে সে৷ তারপর কাছে এলে সেই কাঠুরেকে টেনে নিয়ে যায় গাছের কাণ্ডের ভিতরে৷ কাঠুরে কিন্তু মরে না৷ তার হৃৎপিণ্ড, শরীর জেগে থাকে৷ সেই জীবন্ত শরীরের প্রাণশক্তিটুকু ব্যবহার করে নিম্ফরা৷’

—‘নিম্ফ মানে?’

—‘আমরা, নারিফোন গাছ থেকে যারা জন্মায়৷ কিন্তু শুধু গাছের বন্ধন ছেড়ে বেরোলেই হবে না৷ নিম্ফরা বুঝতে পারে যত বেশি মানুষকে তারা বশ করতে পারবে তত বেশি জীবনশক্তি পাবে৷ একটার পর একটা মানুষকে বশ করতে শুরু করে ওরা৷ নরলোভী হিংস্র হয়ে ওঠে৷ আজ তুই যাকে দেখলি সেও আমার মতোই নিম্ফ, কেবল ওদের ভিতরটাও বদলে গিয়েছে৷ লোভে হিংস্র হয়ে গেছে ওরা৷’

—‘তাহলে তুই বদলাসনি কেন?’

ইভা হাসে৷ গাছের পাতা বেয়ে নেমে আসা একটা জোনাকির উপরে স্থির হয়ে যায় ওর চোখ, ‘কারণ তোর মা৷ রুমি৷ এ পৃথিবীতে চোখ মেলার পর আমি কাউকে চিনতাম না৷ গোটা জঙ্গলটাকে কেবল ভয় পেতাম৷ তোর মা ছাড়া আর কোনও বন্ধু ছিল না আমার৷ আমাকে জঙ্গল চেনায় রুমি৷ রোজ বিকেলে পায়ে হেঁটে এই গাছটার কাছে চলে আসত৷ সন্ধে অবধি আমরা দু-জনে খেলা করতাম৷ তারপর ও বাড়ি ফিরে গেলে আমি সারারাত জঙ্গল থেকে তাকিয়ে থাকতাম ওর ঘরের দিকে, ও মাঝে মাঝে বারান্দায় এসে দাঁড়াত৷ আমার আর কোনও বন্ধু ছিল না৷’

স্থির দৃষ্টিতে ইভার দিকে চেয়ে থাকে অনীশ৷ একটা পুরোনো প্রশ্ন ফুটে ওঠে ওর মাথার ভিতরে, ‘কিন্তু আমার মা-ও তো মারা গিয়েছে, তাহলে…’ অনীশের দুই কাঁধে দুটো হাত রাখে ইভা, কঠিন গলায় বলে, ‘তোকে একটা কাজ করতে হবে৷ কঠিন, ভীষণ কঠিন কাজ৷ পারবি তো?’

—‘কী?’

ইভা কিছু বলার আগেই দুলে ওঠে গাছটা৷ আবার সেই চেনা শিসের শব্দ ভেসে আসে কাছ থেকে৷ গাছের দুলুনিতে দু-জনেই নেমে আসে মাটির উপর৷ অনীশ অনুভব করে ইভার মোমের মতো হাতটা কোথায় যেন টেনে নিয়ে চলেছে ওকে৷ পিছনের বিকট শব্দের থেকে দূরে৷ কিন্তু যে কোনও দিকে নয়, যেন একটা নির্দিষ্ট দিকে ছুটে চলেছে ওকে নিয়ে৷ জঙ্গলের বুনো গন্ধ অনীশের মাথায় ভিতরে ঝিমঝিমে ব্যথা ধরিয়ে দেয়৷ নিজেকে হালকা মনে হয়, কোথায় নিয়ে চলেছে ওকে ইভা?

কতক্ষণ কেটে গিয়েছে জানে না৷ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল কি? চোখ খুলে অনীশ দেখে ওর ঠিক পাশেই বসে আছে ইভা৷ বারবার ঠেলা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করছে ওকে৷ খুব ক্ষীণ, তাও অনীশের কানে আসে৷ ওদের চারদিক থেকে গোল করে ঘিরে সেই শিসের শব্দ এগিয়ে আসছে, ওদেরকে ঘিরে ফেলেছে নিম্ফরা৷

—‘ওরা…’ আতঙ্কের স্রোত অনীশের পা চেপে ধরে৷

—‘উঁহুঁ, ভয়ের কিছু নেই৷ আয়, একটা জিনিস দেখাই৷’ অনীশের হাত ধরে টান দেয় ইভা৷

অনীশ উঠে পড়ে৷ আর কিছুক্ষণ পরেই ওদের গোল করে ঘিরে ধরবে নিম্ফরা, এদের আটকানোর কোনও উপায় নেই? অনীশ প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা, নারিফোনকে যেমন জাগানো যায়, তেমন ঘুম পাড়ানো যায় না কোনওভাবে?’

—‘যায়৷’

—‘কীভাবে?’

—‘যে মন্ত্রটা পড়ে জাগাতে হয়, সেটা দিয়ে৷’

মনে মনে একটা হিসেব করতে চায় অনীশ, কিন্তু মেলে না, ‘কিন্তু সেই মন্ত্রটা তো হারিয়ে গেছে৷ আচ্ছা, মা ডায়েরির শেষ পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলল কেন? ওখানেই তো লেখা ছিল মন্ত্রটা৷’

—‘রুমি ছেঁড়েনি ওগুলো৷’

—‘তাহলে?’

—‘আমি ছিঁড়েছিলাম৷’

—‘কিন্তু কেন?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে অনীশ৷

নরম হাসি ফোটে ইভার মুখে, ‘নারিফোন ঘুমিয়ে পড়লে আবার সব নিম্ফরা ঘুমিয়ে পড়বে৷ সেইসঙ্গে, আমিও৷’

সামনের দিকে এগোতে এগোতে বলে ইভা, ‘রুমিকে আমি কোনওদিন জানতে দিইনি বাকি নিম্ফদের ব্যাপারে৷ ওর বয়স একটু বাড়তে ও চলে গেল এখান থেকে৷ এই জেগে থাকার নেশাটাও পেয়ে বসল আমাকে৷ বলেছিলাম না এতগুলো মানুষের মৃত্যু শুধু…’

ওদের ঘিরে শিসের শব্দ আরও কাছে এগিয়ে এসেছে৷ হঠাৎ একটা মোটা কাণ্ডের লম্বাটে গাছের সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ইভা৷ দুটো হাত মাটির উপরে রেখে, অজ্ঞাত কোনও রীতিতে প্রণাম করে গাছটাকে৷

অনীশ তাকিয়ে দেখে সেই সরু গাছের কাণ্ডটা দু-দিকে খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে৷ যেন কাণ্ডটা দরজার মতো খুলে দিচ্ছে অন্য কোনও জগতের প্রবেশ পথ৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অনীশ স্তম্ভিত চোখে চেয়ে দেখল ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিরাট গাছের কাণ্ড৷ আদিম বিলুপ্ত কোনও দৈত্যাকৃতি বৃক্ষ যেন মহাপ্রলয়ের পর মাটি ফুঁড়ে আবার ফিরে এসেছে পৃথিবীর বুকে৷ উপরে তাকিয়ে সে দেখল গাছের মাথাটা গিয়ে মিশেছে আকাশের গায়ে৷ বিস্তৃত ডালপালার গোপন শিরা দিয়ে স্বর্গ থেকেই জীবন-রস শোষণ করে নিচ্ছে সে৷ একটা মিহি সাদাটে কুয়াশা প্রদক্ষিণ করছে গাছটাকে৷ গাছের ডালে মাঝে মধ্যে আলোর বিন্দু ফুটে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে৷

মাটি থেকে উঠে গাছের কাণ্ডের উপর একটা হাত রাখল ইভা৷ সঙ্গে সঙ্গে কাণ্ডর একটা দিক পাথরের স্ল্যাবের মতো সরে গিয়ে অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা সংকীর্ণ একটা গুহামুখ উন্মুক্ত করে দিল৷ কুয়াশাটা সেই জায়গাতে কিছুটা ঘন হয়েছে৷ ভিতর থেকে একটা সবুজ আভা বেরিয়ে আসছে৷

অনীশ মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেল সেইদিকে৷ কয়েক-পা হেঁটে কুয়াশাটা পেরিয়ে যেতেই মনে হল, এক অদ্ভুত দৃশ্যের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে৷

গুহার ভিতরে একরাশ বটের ঝুরির মতো শাখা ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে গিয়েছে উপর থেকে নীচ অবধি৷ সেই ঝুরির ফাঁকে ফাঁকে দপদপ করে জ্বলছে একদলা মাংসপিণ্ড৷ ভালো করে তাকিয়ে অনীশ বুঝতে পারল মানুষের হৃদপিণ্ড৷ এই হতভাগ্য মানুষগুলোর শরীর থেকে প্রাণ শোষণ করে নিয়েই বেঁচে থাকে নিম্ফরা৷ ওই হৃৎপিণ্ডই এদের জীবনীশক্তি৷

আর একটু এগিয়ে আসতেই থমকে যায় অনীশ৷ হাত দিয়ে আবার একটা ইশারা করেছে ইভা৷ সেই ইশারাতেই ধীরে ধীরে দু-পাশে ফাঁক হয়ে যায় ঝুরিগুলো৷ গাছের কাণ্ডের একটা ফাঁকা অংশ দৃশ্যমান হয়ে পড়ে তাতে৷

কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে অনীশের৷ সেই পাথরের মতো ফাঁকা জায়গাটায় কিছু মিশে আছে যেন৷ খেয়াল করলে বোঝা যায়, একটা আস্ত মানুষের শরীর, শ্যাওলার স্তর এসে গাছের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছে মানুষটাকে৷ শরীরের কয়েকটা জায়গা ক্ষয়ে গিয়েছে যেন মানবদেহটাকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়েছে গাছটা৷ কেবল তার হৃৎপিণ্ডটা বারবার নড়ে উঠছে৷ সে জীবন্ত৷

—‘রুমি আত্মহত্যা করেনি৷’ পিছন থেকে ঠান্ডা গলার আওয়াজ শুনতে পায় অনীশ, ‘তবে ওর একটা রোগ ধরা পড়ে, মারণরোগ৷ ওর জীবন আর বেশিদিনের ছিল না, সেটা বুঝতে পেরেই আবার নারিফোনের কাছে ফিরে আসে ও৷’

—‘কিন্তু কেন?’ পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করে অনীশ৷

—‘রুমি জানত, নিজের ছেলের কাছে সারাজীবন থাকতে পারবে না৷ কিন্তু ছোটবেলার সেই ফেলে যাওয়া বন্ধুটাকে তো বাঁচাতে পারবে, তারও আর কোথাও কেউ নেই৷ এত বছর একা এই গহীন জঙ্গলের মধ্যে নারিফোনের শরীরে মিশে থাকলে রোগ ওর শরীরকে ক্ষয় করতে পারবে না, আমিও বেঁচে থাকব বহুকাল৷’

—‘মা!’ অনীশের মুখ দিয়ে অন্য কোনও শব্দ বেরোয় না৷ সে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে অর্ধেক উদ্ভিদে পরিণত হওয়া মানুষটার মৃত মুখের দিকে৷ সেই স্বপ্নটা, অবিকল সেই স্বপ্নের মতো দেখাচ্ছে মুখটা৷ তবে আর সেটাকে ভয় লাগছে না অনীশের৷

কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়েছিল মনে নেই৷ পিছন থেকে একটা হাত পিঠে এসে পড়ায় হুঁশ ফেরে অনীশের, কোমর থেকে বের করে ছুরিটা ওর দিকে এগিয়ে দেয় ইভা, ‘তুই জানিস কী করতে হবে৷’

পিছিয়ে আসে অনীশ, ‘কিন্তু আমি মাকে…’

জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে প্রাণীগুলো৷ শিসের শব্দে ভরে উঠেছে জঙ্গলের চারপাশ৷

—‘সময় নেই, তাড়াতাড়ি কর৷’

—‘কিন্তু মায়ের মতো তুইও হারিয়ে যাবি তাহলে৷ তুই তো সাহসী, তুই লড়াই করতে পারিস৷ আমার মতো দুর্বল নোস৷ তুই…’ অনীশের গলার স্বরে বাষ্প মিশে গেছে৷

এগিয়ে এসে সজোরে তাকে জড়িয়ে ধরে ইভা, ‘লড়াই করতে পারি বলেই কি লড়াই করতে হয় সবসময়? আমি খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি রে, এতগুলো মৃত্যুর দায় বইতে বইতে, এতগুলো বছর ধরে লড়াই করতে করতে, আমার ঘুম দরকার এখন৷ ভীষণ লম্বা একটা ঘুম৷’

—‘আর ফিরে আসবি না কোনওদিন?’ ছলছলে চোখে ইভার দিকে তাকায় অনীশ৷ আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দৈত্যাকৃতি সাপের দল এসে পড়বে ওদের উপরে৷

—‘আসব, আবার কয়েক লক্ষ বছর পর মন্ত্রটা কারও হাতে পড়লে সবার আগে আমিই জেগে উঠব৷’

—‘কিন্তু ততদিন তো আমি থাকব না৷’

—‘মানুষ কোথাও চলে যায় না অনীশ৷ ওই ক্ষমতা মানুষের নেই৷’ আচমকা কুয়াশা ভেদ করে আসা কালচে ফণার ছোবলে ছিটকে পড়ে ইভা৷ একটা সাপ ছিটকে এগিয়ে আসে অনীশের দিকে, কিন্তু ছোবল মারার আগেই ধাক্কা লাগে তার মুখে৷ ইভা ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওর গায়ের উপর৷ চোখের উপরে আঘাত করে চলেছে ক্রমাগত৷ মুখ থেকে চাপা চিৎকার বেরিয়ে আসছে৷ অনীশ বুঝতে পারে, ইভা নিম্ফদের মনোযোগ নিজের দিকে টেনে আনতে চাইছে৷ আর বেশি সময় নেই৷ সাপগুলো মাটির উপরে আছড়ে ফেলেছে ইভাকে৷ পরপর ছোবল পড়তে শুরু করেছে তার যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরের উপরে৷ তা-ও মুখ থেকে হুংকার বেরিয়ে আসছে তার৷ সে চিৎকারের তীব্রতা কমে আসছে প্রতি ছোবলের সঙ্গে৷ তার মৃতপ্রায় মুখের দিকে শেষ একবার চেয়ে নেয় অনীশ৷

আর দেরি করে না৷ শিসের শব্দ তার সমস্ত চেতনাকে ঢেকে ফেলেছিল এতক্ষণ৷ ইভার শেষ চিৎকারটা ওর হুশ ফিরিয়ে দিয়ে যায়৷ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কয়েকটা প্রাণী এগিয়ে আসে ওর দিকে৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফণা পিছিয়ে ছোবল মারতে উদ্যত হয়৷

শরীরের সমস্ত জোর একত্র করে কয়েক-পা দৌড়ে আসে অনীশ৷ তারপর জীবন্ত হৃৎপিণ্ডের মধ্যে ছুরিটা আমূলে বসিয়ে দেয়৷ একটা ধাতব তরঙ্গ সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বিশালাকার ধারণ করে ছড়িয়ে পড়ে জঙ্গল জুড়ে, তীব্র শিসের আর্তনাদ৷

ছিটকে মাটিতে এসে পড়েছিল অনীশ৷ চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার৷ কিন্তু কানে জঙ্গলের পাখির ডাক, আর হাওয়ার শনশন ছাড়া অন্য কোনও শব্দ আসে না৷

জঙ্গলের নরম মাটির উপরেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে সে৷ অর্ধন্মিলিত চোখে চেয়ে দেখে আকাশের বুকে সাদা মেঘের দল ঝুলে রয়েছে৷ সেগুলোকে মাথার বালিশ করেই যেন দাঁড়িয়ে আছে একঝাক সরু সরু পপলার আর পাইন গাছের সারি৷ ওর চারপাশটা খাঁ খাঁ করছে৷

অনীশের শরীর ঝিমিয়ে আসে, জ্ঞান হারায় সে৷

(আট)

এরপর দিন সাতেক কেটে গিয়েছে৷ বীণা কথা বলতে পারত না৷ এ বাড়ির কোথাও বাচ্চা মেয়েটার গলার আওয়াজ শোনা যেত না৷ আজও শোনা যায় না৷ তাও কী যেন একটা পালটে গিয়েছে এ বাড়ির পরিবেশে৷ শর্মিলা এখনও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মাঝে মাঝে৷ ব্ল্যাক আউট হয়ে যায়৷ রোজ দু-বেলা ডাক্তার এসে দেখে যায় তাকে৷

অনীশ ঘর থেকে বেরোয় না৷ জঙ্গলের প্রতি আর বিশেষ টান নেই তার৷ কেবল রাতের দিকটা রোজ বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে বসে থাকে সে৷ কিছুক্ষণ পরে আবার ঘরে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়ে৷

আজ বিকেলের দিকে ঘরের দরজায় পায়ের আওয়াজ শুনে ক্লান্ত চোখ তুলে তাকাল সে৷ জগদীশ এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে৷ বীণার মৃত্যুর পর থেকে অনীশের সঙ্গে ভালো করে কথা হয়নি জগদীশের৷

জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে অনীশের দিকে এগিয়ে আসে জগদীশ, ‘কেমন আছিস এখন?’

—‘ভালো?’ মুখ ফিরিয়ে উত্তর দেয় অনীশ৷

বিছানায় তার পাশে এসে বসে পড়ে জগদীশ৷ নরম গলায় বলে, ‘এভাবে একা একা থাকলে কি ঠিক হবে কিছু? মেসো-মাসির এমনিতেই এই অবস্থা তার উপরে তুই যদি এরকম একঘরে হয়ে থাকিস…’

—‘ঠিক হয়ে যাবে৷’ প্রসঙ্গটা পালটাতে চায় অনীশ, ‘আমি পরে কথা বলব এখন ভালো লাগছে না৷’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জগদীশ, ‘আচ্ছা বেশ, ভালো কথা৷ সেদিন তোকে বলতে যাচ্ছিলাম, তুই তো জঙ্গলের দিকে পালিয়ে গেলি৷ বীণা তোর জন্য একটা জিনিস দিয়ে গিয়েছে আমাকে৷’

কথাটা বলে পকেট থেকে চৌকো মতো কিছু বের করে আনে জগদীশ, তারপর বলে, ‘ওর পেনসিল-বক্স৷ ও তোকে আঁকা শিখিয়েছিল৷ তাই তোকে দিয়ে গিয়েছে এটা৷’

মোমরঙের ছোপ লাগা পেনসিল-বক্সটা অনীশের সামনে রেখে উঠে পড়ে জগদীশ৷ বেরিয়ে যায় ঘর থেকে৷

বাক্সটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই ডুকরে কেঁদে ফেলে অনীশ৷ দু-হাতে আঁকড়ে ধরে জিনিসটা৷ কয়েকবার হাত বোলায় তার উপরে৷ তারপর কাঁপা কাঁপা হাতেই খুলে ফেলে ডালাটা৷ সেই সবুজ স্ট্রাইকারটা রাখা আছে তার ভিতরে৷ মায়ের শেষ চিহ্ন অনীশকে আবার ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছে বীণা৷ অনীশ বাক্সটা সজোরে ছুঁড়ে মারে উলটো দিকের দেওয়ালে৷ মাটিতে পড়ে বাক্সের ডালাটা খুলে যায়৷ সেদিকে একবার চেয়ে মুখ ফেরাতে গিয়ে থেমে যায় অনীশ৷ বাক্সের ভিতরে রং-পেনসিল ছাড়াও কিছু একটা আছে৷ কয়েকটা পুরোনো কাগজ৷

দ্রুত বিছানা থেকে উঠে গিয়ে কাগজগুলো হাতে তুলে নেয় অনীশ৷ অজান্তেই তার চোখ থেকে জলের বিন্দুগুলো মিলিয়ে আসতে থাকে৷

(নয়)

জঙ্গলের একটা লম্বাটে গাছের সামনে হাঁটু মুড়ে বসেছে একটা বছর সতেরোর ছেলে৷ হাঁটুর ফাঁকে পড়ে আছে কয়েকটা হলদে হয়ে যাওয়া কাগজ৷ মাঝে মাঝে সেটা দেখেই বিড়বিড় করে কী যেন বলে চলেছে৷ হাওয়ার বেগ থমকে আছে জঙ্গলের এই জায়গাটায়৷ গাছের পাতাগুলো স্থির৷ অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ঘিরে রেখেছে চতুর্দিক৷ সন্ধে হয়ে আসছে ধীরে ধীরে৷ তাও পোকা-মাকড়ের ঐকতান শোনা যাচ্ছে না এখনও৷ একসময় বিড়বিড় থামিয়ে সামনে মুখ তুলে তাকাল ছেলেটা৷ ওর সামনের লম্বাটে গাছটার শরীর এতক্ষণে পালটে গিয়েছে৷ অন্ধকারের ভিতরে গাছের কাণ্ডের দিক থেকে সড়সড় শব্দ ভেসে এসেছে৷ দুটো হলদে চোখ জেগে উঠেছে সেই অন্ধকারের ভিতর৷ আর একটা গান, একটা মিষ্টি সুরের গান৷

“Faithless is he that says farewell when the road darkens.” – J.R.R. Tolkien (The Fellowship of the Ring)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *