মায়াবী মোটিভ

মায়াবী মোটিভ

রহস্য নেই বলেই একে রহস্য-গল্প বলব না। রহস্য সৃষ্টিও করব না। শুধু এক গোয়েন্দার কাহিনি বলব। সরকারি গোয়েন্দা। এই কলকাতারই।

বিশ্ববন্ধু ব্যানার্জি মুচিপাড়া থানার ওসি ভদ্রলোক মাঝবয়সী। সুগঠিত দেহ। রোগা নন, মোটাও নন। দোহারা চেহারা বলতে যা বোঝায়। কানের পাশে এবং মাথার পেছনের চুলে সাদা রং ধরেছে। মুখটি ভারি। কিন্তু পায়ভারি নন। কথা মন দিয়ে শোনেন, নীরবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন, সাধ্যমতো উপকার করার চেষ্টা করেন। এ হেন সমাজহিতৈষী আদর্শ দারোগার প্রয়োজন প্রতিটি থানায়।

আমি গিয়েছিলাম একটা বড় রেফারেন্স নিয়ে আমার ভাইপোর একটি উপকারের আশায়। কিন্তু পরিচয় দেবার পর দেখলাম, রেফারেন্সের প্রয়োজন ছিল না। উনি আমাকে চেনেন।

বললেন, আপনি তো গল্প লেখেন?

কোলের ওপর দু-হাত জড়ো করে মৃদু হেসে বললাম–লিখি। আপনাদের নিয়ে।

কিন্তু কি জানেন মৃগাঙ্কবাবু, মাঝে-মাঝে দু-একটা বাংলা গল্প পড়ে দেখেছি আপনারা ছেলে ভুলোনো গল্প লেখেন। যেমন, অমুক ডিটেকটিভ অমুক জায়গা থেকে একটা জিনিস কুড়িয়ে পেয়ে ঝট করে পকেটে রেখে দিল–সেইটাই নাকি একটা বড় প্রমাণ। কিন্তু সেটা সেইখানেই পাওয়া গিয়েছে, তার কি প্রমাণ? আপনাদের সখের গোয়েন্দা তা নিয়ে মাথা ঘামায় না।

মানছি। বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের এত দুর্গতি এই কারণেই। আমরা কিছু না জেনেই লিখি। মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স পড়ি না, ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের পাতা ওল্টাই না, ফরেন্সিক সায়ান্স ল্যাবরেটরির দরজা মাড়াই না। অথচ লিখি।

বিশ্ববন্ধুবাবু বললেন–বিলেত আমেরিকার সব গল্পই কি এদেশে খাপ খায়? টেকনিক আলাদা, সমাজ আলাদা, আমরা আলাদা।

সেইজন্যেই আমি বিশ্বাস করি আপনাদের সঙ্গে না মিশে গোয়েন্দা গল্প লেখা উচিত নয়। শুধু কাহিনির জন্য নয়, আপনাদের না জেনে, আপনাদের স্বভাব চরিত্র না বুঝে, আপনাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল না হয়ে যে গল্প লেখা হয়–তা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না কিছুতেই। তা ছাড়া সরকারি এই গোয়েন্দামাত্রই মূর্খ আর সখের গোয়েন্দারা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ট্র্যাডিশন ভাঙবার জন্যে আমি আপনাদের গৌরবময় দিকটা তুলে ধরবার উদ্দেশ্যে সম্প্রতি এক-আধটা গল্প লিখেছি। ইন্ডিয়ান পুলিশ জার্নাল, ওয়ার্ল্ড ডিটেকটিভ এজেন্সির মান্থলি বুলেটিন আর স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের একজন সুদক্ষ পুলিশ অফিসার আমাকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন।

বিশ্ববন্ধুবাবু টেবিলের ওপর দু-হাত রেখে ঘাড় কাত করে একমনে শুনছিলেন। আমি থামতেই বললেন–আমিও আপনাকে একটা স্টোরি বলে হেল্প করতে পারি। জাল চেকের কেস। আমি তদন্ত করেছিলাম, সঙ্গে স্বপন ছিল–স্বপন চৌধুরী–এখন এ-সি-ডি-ডি-ওয়ান।

ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের যে দুজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, স্বপন চৌধুরি তাঁদের একজন। শুনে আগ্রহান্বিত হলাম। মুখে আর কিছু বললাম না। শুধু ঘাড় বেঁকিয়ে চোখ কুঁচকে তাকালাম।

বিশ্ববন্ধুবাবু বৈঠকি সুরে বললেন–স্বপন তখন আমার মতোই সাব-ইন্সপেক্টর। দুজনেই আছি ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে। এমন সময়ে লন্ডন ব্যাঙ্কে চব্বিশ হাজার টাকার একটা চেক ভাঙানো হল। বেয়ারার চেক। সইটা জাল। জালিয়াত টাকা নিয়ে চলে যাবার সাতদিন পর জানা গেল সইটা জাল।

আমি বললাম–লন্ডন ব্যাঙ্ক? বলেন কি! এত বড় ব্যাঙ্কেও জাল সই ধরা পড়ে না? কোন ব্র্যাঞ্চ? চৌরঙ্গী রোড?

না। নেতাজি সুভাষ রোড। সইটা যে জাল, ব্যাঙ্কের কেউ ধরতে পারেনি। যার নামে অ্যাকাউন্ট, তিনি টিম্বার মার্চেন্ট। পাণ্ডু থেকে ওয়াগনে কাঠ এনে কলকাতায় কাঠের দোকানে চালান দেন। দিন সাতেক পরে অ্যাকসিডেন্ট্যালি তিনি ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্ট দেখতে গিয়ে দেখলেন, চব্বিশ হাজার টাকা নগদে তোলা হয়েছে। অথচ উনি জানতেন এরকম কোনও টাকা তোলা হয়নি। চেক নাম্বার মিলিয়ে চেক বইয়ের কাউন্টার পার্ট দেখতে গিয়ে দেখলেন–কাউন্টার পার্টই নেই। তার পরেরটাও নেই। মোট দুটো চেক ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে চেক বই থেকে।

একদম ভেতর থেকে?

হ্যাঁ।–ওভাবে চেক বার করে নিলে কারও পক্ষে ধরা সম্ভব নয়। টিম্বার মার্চেন্ট ভদ্রলোকও জীবনে ধরতে পারতেন না যদি না চব্বিশ হাজার টাকা খোয়া যেত। যাক, যথাসময়ে আমরা হাজির হলাম। জানেন তো, তদন্তের শুরুতে সবাইকে সন্দেহ করতে হয়। কাউকে সাধু পুরুষ বলে মনে-মনে। ছেড়ে দেওয়াটাও অন্যায়। প্রাথমিক তদন্তে আমরা জেরা কনসেনট্রেট করলাম সেই সব লোকদের ওপর যারা টিম্বার মার্চেন্টের চেক সরানোর সুযোগ পেয়েছে।

এরকম লোক পেলাম একজনকেই। টিম্বার মার্চেন্টের তিনি পি-এ। বয়স খুব একটা নয়। বছর পঁয়ত্রিশ। সুশ্রী। শ্যামবর্ণ। চোখে চৌকো ফ্রেমের বাহারি চশমা। খুব চটপটে। মিষ্টভাষী। মিশুকে এবং অতিশয় কাজের লোক। ইকনমিক্সে এম-এ।

টিম্বার মার্চেন্ট ভদ্রলোকের নাম কুঞ্জবিহারী গড়াই। লেখা-পড়া বলা বাহুল্য কম করেছেন, কিন্তু টাকা করেছেন প্রচুর। জঙ্গলের ইজারা নিয়ে বসে বসে টাকা রোজগার তো–টাকার ওপর মায়া মমতা তাই একটু কম। চেক বইটা যে সযত্নে লুকিয়ে রাখতে হয়, সে খেয়ালও ছিল না। রেখে দিতেন নিজের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের বাঁদিকের ড্রয়ারে। কস্মিনকালেও ড্রয়ারে তালা দিতেন না। বিশ বছরের কাঠের কারবারে কখনও বিশটা পয়সাও খোয়া যায়নি ড্রয়ার থেকে চেক হারাবার প্রশ্নই ওঠে না।

পি-এ ছোকরার নাম প্রদ্যোৎ পাল। অল্প শিক্ষিত মালিকের প্রায় সব কাজ সে একাই করত। চেক লেখা, হিসেব রাখা–সব। চেক কে নিতে পারে, এই হাইপোথিসিস ধরে এগোতে গিয়ে পেলাম প্রদ্যোৎ পালকে। হাইপোথিসিস মানে, একটা কিছু অনুমান করে নিয়ে তদন্ত শুরু করতে হয়– নিশ্চয় তা জানেন।

প্রদ্যোৎ ছোকরাকে যত জিগ্যেস করি, চেক দুটো সে নিল কখন, ততই সে নাকে কেঁদে বলতে লাগল–আমি সাতে নেই, পাঁচে নেই, কেন স্যার আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন? সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না দেখে থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগ করলাম।

আমি সকৌতুকে বললাম–থার্ড ডিগ্রি কিন্তু একটা সায়ান্স বললেও চলে। ঠিক মতো অ্যাপ্লাই করতে পারলে সুফল ফলাবেই।

থার্ড ডিগ্রি মানে যে কচুয়া ধোলাই, সুধী পাঠককে নিশ্চয় আর তা ব্যাখ্যা করতে হবে না।

বিশ্ববন্ধুবাবু গম্ভীর মুখে বললেন–থার্ড ডিগ্রি সায়ান্স নয়। তবে যে যাই বলুক না কেন, থার্ড ডিগ্রি পৃথিবীর সব দেশেই আছে। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলেই থার্ড ডিগ্রি দাওয়াই ছাড়ে সব মিঞাই।

ইট ইঝ অ্যান আর্ট। আমি কিন্তু থার্ড ডিগ্রির স্বপক্ষে লেগে রইলাম নাছোড়বান্দার মতো। আসলে আমি মনে মনে বিশ্বাস করি, মারের মতো ওষুধ আর নেই। শক্তের ভক্ত প্রত্যেকেই!

বিশ্ববন্ধুবাবু বললেন, থার্ড ডিগ্রি অনেক রকমের আছে। ধরুন চোখের ওপর স্পট লাইট ফেলে জেরা করা। ঘর অন্ধকার করে প্রদ্যোৎ পালকে গোল হয়ে ঘিরে বসে এইভাবে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে গেলাম। কিন্তু পেট থেকে একটা কথাও বার করতে পারলাম না। মাথার ওপর টপটপ করে জলের ফোঁটা ফেললাম এক নাগাড়ে–তবুও মনোবল শিথিল হল না। শেষকালে টেবিলের ওপর হাত উপুড় করে রাখতে বললাম। আঙুলের নখের ডগায় জ্বলন্ত সিগারেটের ভেঁকা দিলাম। কোনও মানুষ তিন সেকেন্ডের বেশি সহ্য করতে পারে না। এক ছোকরা একটা মেয়েকে কিডন্যাপ করে লুকিয়ে রেখেছিল। বিস্তর আড়ং ধোলাই দেওয়ার পরেও যখন ঠিকানাটা কিছুতেই বার করা গেল না–তখন নখের ডগায় সিগারেট ধরলাম–দু-সেকেন্ডের মাথায় সে বললে–বলছি স্যার। কিন্তু প্রদ্যোৎ পালকে এই ট্রিটমেন্টেও নোয়াতে পারলাম না। তখন সন্দেহ হল, ছোকরা হয়তো সত্যিই নির্দোষ অথবা রাম র্দুদে।

 ছেড়ে দিলাম প্রদ্যোৎ পালকে। ব্যাঙ্ককে জানিয়ে দেওয়া হল, আর একটা চেক ভাঙাতে আসামী আসতে পারে। চেকের নাম্বার মুখস্থ করে রাখল কাউন্টার কর্মচারীরা।

মাস কয়েক কেউ এল না। আমরাও হাল ছেড়ে দিলাম। এরকম কত কেই শেষ পর্যন্ত আনসলভড় থেকে যায়। এ কেসেরও সুরাহা কখনোই সম্ভব নয়। কোনও ব্লু নেই। ধরব কাকে?

সুতরাং আমি স্বপন কেসের কথা ভুলে গেলাম। টিম্বার মার্চেন্ট কুঞ্জবিহারীবাবুও টাকার শোক ভুলে গেলেন। প্রদ্যোৎ পালও আমাদের আতংক কাটিয়ে উঠল।

ঠিক এই সময়ে এন এস বসু রোডের লন্ডন ব্যাঙ্কে আবার এসে পৌঁছল ছত্রিশ হাজার টাকার একটা বেয়ারার চেক। এত মাস পরে কাউন্টার ক্লার্কদের মনে রাখার কথা নয় চেক নাম্বারটা। রোজ অমন কত চেক আসছে। কিন্তু দৈবক্রমে যার হাতে চেকটা ভাঙাবার জন্যে এগিয়ে দেওয়া হল–সেই ভদ্রলোকের হঠাৎ কীভাবে জানি মনে পড়ে গেল নাম্বারটা।

কিন্তু চমকে উঠলেন না। ভাবান্তর দেখালেন না। স্বাভাবিকভাবে যেমন সবাইকে বলেন, সেই ভাবেই বললেন–আপনার সই?

চেক যিনি এনেছিলেন, তিনি রীতিমতো সুদর্শন পুরুষ। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স। গায়ে টেরিলিনের দামি স্যুট, পায়ে বাটা কোম্পানির সবচেয়ে দামি জুতো, হাতে হিরের আংটি, মুখে পাইপ। পাক্কা সাহেব বললেই চলে।

প্রশ্ন শুনে নীরবে ঘাড় হেলিয়ে জানালেন–হ্যাঁ।

পেছনে আর একটা সই করুন। খুব সহজভাবেই বললেন কাউন্টারের ভদ্রলোক। সবাইকেই বলেন। কিন্তু এঁকে বলার পর যেই দেখলেন কলম বার করে ঘাড় হেঁট করে সই করছেন দিশি সাহেবটি, অমনি চোখের ইঙ্গিতে দূরের দারোয়ানকে জানালেন গেট বন্ধ করতে।

কিন্তু জ্ঞানপাপী যে, তার চোখে সব দিকেই থাকে। কাউন্টার থেকে চোখের নির্দেশ কোন দিকে গেল, চোখের কোণ দিয়ে তা দেখেই দিশি সাহেব সই না করেই দৌড় দিলেন দরজার দিকে।

কিন্তু এইখানেই লন্ডন ব্যাঙ্কের চরম এফিসিয়েন্সির পরিচয় পাওয়া গেল। মাস কয়েক আগে জাল সই যারা ধরতে পারেনি তারাই চক্ষের পলকে দেখিয়ে দিলে জালিয়াতকে কীভাবে ধরতে হয়। মুহূর্তের মধ্যে বেজে উঠল অ্যালার্ম বেল–এক সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল সবকটা দরজা। ধরা পড়ল দিশি সাহেব।

কিন্তু চেকটা তখন তার হাতে নেই। গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে। আমরা খবর পেয়ে দৌড়ে গেলাম। গিরে তার তম্বি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। পরিচয় শুনে আরো অবাক হলাম। ভদ্রলোক নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ের কনট্রোলার অফ ওয়াগ। হেডকোয়ার্টার পাণ্ডুতে। পরিচয়পত্র পকেটেই ছিল। নাম, হীরকরণ মুখার্জি।

সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের পর্যন্ত সন্দেহ হল–এ কাকে ধরতে কাকে ধরে বসল ব্যাঙ্কের দারোয়ান? হীরকবরণও হম্বিতম্বি করে বললেন–হোয়াট ননসেন্স। কে না কে চেক জাল করেছে তার আমি জানি কী? আমাকে কেন আটকাচ্ছেন?

কুণ্ঠিত গলায় স্বপন বললে–খুবই অন্যায় হয়েছে। কিন্তু আপনি কেন আজ ব্যাঙ্কে এসেছিলেন?

চেক ভাঙাতে নিশ্চয় নয়।

তবে?

বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে।

ব্যাঙ্কে কাজ করেন?

হ্যাঁ। বিল ডিপার্টমেন্টে।

নাম?

জিগ্যেস করবেন তো? করুন না।–দোয়েল দত্ত।

তৎক্ষণাৎ খবর গেল বিল ডিপার্টমেন্টে। সত্যিই দোয়েল দত্ত নামে এক ভদ্রলোক কাজ করেন সেখানে। কেরাণীর কাজ। সেকশন ইনচার্জও নন। তলব পেয়ে এলেন আমাদের সামনে। মাথায় প্রায় সবটুকু টাক দখল করেছে–বয়স সেইজন্যেই বেশি মনে হয়। ফর্সা। পুরু ঠোঁট। নেয়াপাতি ভুড়ি আছে। নিশ্চিন্ত, তৃপ্ত মুখচ্ছবি। সেই মুহূর্তে ঈষৎ উদ্বিগ্ন পুলিশের সামনে আসায়। চেক জালিয়াৎ ধরা পড়েছে। ব্যাঙ্কের সবাই জেনে গিয়েছিল–ইনিও জেনেছেন।

ঘরে ঢুকেই স্বভাবতই আগে কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্যে চাইলেন হীরকবরণ মুখার্জির দিকে। ক্ষণেক পিট পিট করে চেয়ে যেন কুয়াশার মুখ দিয়ে অনেক দিন আগেকার চেনা মুখ আবিষ্কার করলেন।

বললেন অবাক কণ্ঠে হীরক না?

কনট্রোলার অফ ওয়াগ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আমাদের দিকে চাইলেন। দোয়েল দত্তর প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দরকার আছে বলেও মনে করলেন না।

আমি বললাম দোয়েল দত্তকে–বসুন।

হীরকবরণ আর আমাদের দিকে পর্যায়ক্রমে চেয়ে বসে পড়লেন দোয়েল দত্ত। ভদ্রলোক শান্তিপ্রিয়। তাই অস্বস্তি পেয়ে বসেছে লক্ষ্য করলাম।

এঁকে চেনেন দেখছি। কি সূত্রে চেনেন?–আমার প্রশ্ন।

ক্লাস ফ্রেন্ড। আরামবাগে একসঙ্গে পড়তাম। এক ক্লাশে।

স্কুল ফ্রেন্ড?

আজ্ঞে।

কত বছর আগে?

ত প্রায় বিশ বছর।

আপনি এখন কোথায় থাকেন?

বেলেঘাটায়।

আর উনি কোথায় থাকেন?

তা তো জানি না।

হীরকবরণ মুখার্জি কথা বলতে গেলেন। হাতের ইঙ্গিতে নিরস্ত করলাম।

কেন জানেন না? আপনার বন্ধুতো। বিশ বছরের বন্ধু।

দেখুন, বিশ বছর আগে এক ক্লাশে পড়েছি বলেই বিশ বছর পরে কে কোথায় থাকে জেনে রাখতে হবে তার কোনও মানে নেই।–দোয়েল দত্ত নিজেকে কোণঠাসা মনে করে নিয়ে কাটা-কাটা গলায় বললেন।

আমি সুর নরম করে বললাম ঠিক। কিন্তু আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য হল আপনাদের মধ্যে বন্ধুত্বটা কোন পর্যায়ে তা আবিষ্কার করা।

কথাটা শুনেই চাবুক খাওয়ার মতো চমকে উঠলেন দোয়েল দত্ত। চোখের তারা দুটো আকারে বড় হয়ে গেল প্রশ্নের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝে।

তা হলে আপনি কি বলতে চাইছেন জাল চেকের ব্যাপারে আমার হাত আছে।

আমি কিছু বললাম না।

দোয়েল দত্ত ঈষৎ তীব্র কণ্ঠে বললেন–জানেন বিশ বছরের মধ্যে হীরক আমার কাছে এসেছে বড় জোর দুবার?

খবরটা আগ্রহের সঞ্চার করল আমাদের মনে।

দুবার? মাত্র?

আজ্ঞে হ্যাঁ,–দোয়েল দত্তর স্নায়ু যে মোটেই শক্ত নয়, রেগে ওঠা দেখে তা বুঝলাম–যখন ওর চাকরি ছিল না আর আমার চাকরি হয়েছিল এইখানে–তখন একবার। তারপর যখন রেলে কি একটা বড় চাকরি পেয়ে চলে গেল–তখন আর একবার।

হীরকবরণ মুখার্জি এতক্ষণ কথা বলার সুযোগ না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। এবার হাত তুলে যেই কথা বলতে গেছেন, আমি বললাম–আপনি এখন কথা বলবেন না। শুনতে দিন–দোয়েলবাবু, শেষবার হীরকবাবু যখন এসেছিলেন, সেটা কত বছর আগে?

মনে মনে হিসেব করে নিয়ে দোয়েল দত্ত বললেন–প্রায় সতেরো আঠারো বছর আগে।

আশ্চর্য! এত বছর পরে দেখেও চিনতে পারলেন?

চিনতে একটু অসুবিধে হয়েছিল। কেননা, হীরক কখনও সুট-টাই পরত না।

এখন পরেন, বড় চাকরি করেন বলে–খুবই বড়।–শেষ শব্দ দুটোয় যে অহেতুক মোচড় দিইনি, হীরকবাবুর মুখে তার প্রতিক্রিয়া দেখেই বুঝলাম।

উষ্ণকণ্ঠে বললেন হীরকবরণ মুখার্জি আজ্ঞে হ্যাঁ, খুবই বড়। আপনার চাকরির চাইতেও বড়। ট্রাঙ্ককলে জানলেই পারেন!

জানব–যথাসময়ে। আপাতত শুধু বলুন, যে বন্ধুর সঙ্গে আঠারো বছর যোগাযোগ রাখেননি, আজ কেন তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন।

এমনি।

কোনও কাজ না নিয়ে?

কাজ নিয়ে কেউ আড়–মারতে আসে না।

আপনার মতো বড় অফিসার অফিস টাইমে একজন কেরাণী বন্ধুর সঙ্গে আঠারো বছর পরে আড্ডা মারতে এসেছেন–আশ্চর্য নয় কি? দোয়েলবাবু আপনাকে কেরাণী বলছি বলে কিছু মনে করবেন না। কিন্তু আপনারও কি খটকা লাগছে না পদমর্যাদায় স্ফীত যে বন্ধু আঠারো বছর আপনার ছায়া মাড়ায়নি মর্যাদার হানি ঘটবে বলে, আজ সে হঠাৎ আড্ডা মারতে এল কেন?

দোয়েল দত্ত চতুর ব্যক্তি। বুঝলেন, জল কোন দিকে গড়িয়েছে। তিনি সন্দেহমুক্ত। কিন্তু হীরকবরণ জড়াতে চাইছেন আঁকে!

তাই ঈষৎ কঠিন কণ্ঠে বললেন–হ্যাঁ লেগেছে।

গতবারও যদি ধরা পড়তেন, একই সাফাই গাইতেন হীরকবাবু, তাই না? অ্যালিবি রেডি করেই এসেছিলেন।

গতবার ধরা পড়তাম মানে? হোয়াট দি হেল ইউ মীন?

আই মীন ইউ আর এ পাক্কা ক্রিমিন্যাল, মিঃ হীরকবরণ মুখার্জি, চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম আমি।–চব্বিশ হাজার টাকার চেকে সই জাল করে ভাঙিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো বুকের পাটা যার-তার থাকে না।

মুখ লাল হয়ে গেল কনট্রোলার অফ ওয়াগসের।–স্পিক প্রপারলি। আপনার মতো পেটি পুলিশ অফিসারের তক্তা নড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে জানবেন।

বিনীতকণ্ঠে বললাম–জানলাম। আপনিও জানুন, এই মুহূর্ত থেকে আপনি আনডার অ্যারেস্ট। রেডিওগ্রাম পাঠাচ্ছি পাণ্ডুতে। জবাব এলে তারপর দেখা যাবে।

রেডিওগ্রামের জবাব আসতে সাত আট দিন দেরি হবে ভাবিনি। বসেও থাকিনি। সমানে জেরা করে গিয়েছি কন্ট্রোলার অফ ওয়াগকে।

প্রথম দিনের কথা বলা যাক।

একরাত পুলিশ হাজতে থেকে মুখটা একটু শুকিয়ে গেলেও মেজাজটা একটু গরম হয়েছে দেখলাম হীরকবরণ মুখার্জির। তেল শুকায় সব মিঞারই লক-আপে রাত্রিবাস করলে। পাঁচরকম থার্ডক্লাস ক্রিমিন্যাল, প্রজাদের গন্ধ এবং উদ্বেগ-ভদ্রসন্তানরা সইতে পারে না।

কিন্তু হীরকবরণ মুখার্জির ধাত খুব কড়া। খুব বেশি টসকাননি।

টেবিলের সামনে থেকে ইচ্ছে করে সব চেয়ার সরিয়ে নিয়েছিলাম। দাঁড়িয়ে রইলেন হীরকবরণ। তীব্র চোখ পর্যায়ক্রমে চাইতে লাগলেন আমার আর স্বপনের দিকে। আমরাও টেবিলের ওপর আঙুল দিয়ে টকটক করতে নিরীক্ষণ করলাম তার মুখচ্ছবি। দেখলাম, হীরকবরণের চোখে একটা চাপা তীক্ষ্ণতা আছে। না রাগলে তা প্রকাশ পায় না। এ জাতীয় তীক্ষ্ণ বাজপাখির চোখের দিকে চাইলে দেখা যায়।

বললাম–ভালো আছেন?

ডেকেছেন কেন?

রেগে আছেন মনে হচ্ছে?

সমুদ্র দেখেছেন?

কি কথার কি জবাব। সাবধানে বললাম–দেখেছি। আপনি

আমি নিজে সমুদ্র। এমনিতে শান্ত-ঝড় উঠলে ভয়ংকর। আমার রাগের নমুনা যথা সময়ে টের পাবেন। প্রেসিডেন্ট অফ ইন্ডিয়া আমার কলেজ ফ্রেন্ড খেয়াল রাখবেন।

রাখলাম। এখন যা জিগ্যেস করব তার জবাব দিন। আপনার অফিস পাণ্ডুতে। কলকাতায় এসেছিলেন কেন?

বলব না।

বললে আপনার ভালো হত না?

সেটা আমি বুঝব। আমার প্রেস্টিজ আমার কাছে।

ও। প্রেস্টিজ যাবার ভয়ে বলবেন না কার কাছে এসেছিলেন?

হীরকবরণ জবাব দিলেন না।

স্বপন বললে–কোথায় উঠেছিলেন?

বলব না।

স্বপন খুব কম কথা বলে। এই জবাবের পর একটি কথাও বলল না। দাঁড়িয়ে উঠে আমাকে বললে–চলো বিশুদা। হোটেলগুলোয় ঘুরে আসি। হীরকবরণ সামান্য ভুরু কুঁচকোলেন। আমি বললাম–চলুন আপনার ফটো নেওয়া যাক।

পুলিশ ফটোগ্রাফার তৎক্ষণাৎ হীরকবরণের ছবি তুলে খানকয়েক এনলার্জমেন্ট দিয়ে গেল টেবিলে। জিপ নিয়ে আমি আর স্বপন বেরিয়ে পড়লাম। কলকাতা আর হাওড়ার সবকটা প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রেণির হোটেলে গিয়ে ছবি দেখালাম। রদ্দিমার্কা হোটেলগুলো বাদ দিলাম–কেননা হীরকবরণ মুখার্জির মতো চালিয়াৎ লোক এসব হোটেলে যাবে না অনেক খোঁজবার পর হাওড়ার একটা হোটেলে ফটো দেখেই চিনে ফেললেন ম্যানেজার। হোটেল রেজিস্টার খুলে দেখালেন, হীরকবরণ সেখানে নিজের নাম লিখিয়েছে প্রবাসজীবন হালদার।

ম্যানেজার অবশ্য হলফ করে বললেন, ছবিটা প্রবাসজীবনেরই। আরও বললেন, মাস কয়েক আগে ভদ্রলোক হোটেলে উঠেছিলেন। দিন কয়েক ছিলেন।

হোটেল-বাস সাঙ্গ করে চলে যাওয়ার সময়ে সব হোটেল রেজিস্টারে লিখতে হয় কোথায় যাওয়া হচ্ছে। প্রবাসজীবন সেই ঘরে লিখেছিল–বেলঘরিয়া।

ফটোর পেছনে হোটেল ম্যানেজারকে দিয়ে লিখিয়ে নিলাম, এঁর নাম প্রবাসজীবন হালদার। অমুকদিন থেকে অমুকদিন পর্যন্ত এই হোটেলে ছিলেন। যাওয়ার সময়ে বেলঘরিয়ায় যাচ্ছি লিখে গিয়েছিলেন। হোটেলের সীল দিয়ে সই করে দিলেন ম্যানেজার।

অফিসে এসে হীরকবরণকে দেখালাম লেখাটা। যেন অদৃশ্য হাতে একটা চড় খেলেন ভদ্রলোক। মুখ লাল হয়ে গেল। ভালো খেয়ে দেয়ে এমনিতেই লাল-লাল চেহারা। তার ওপর মিথ্যে ধরা পড়ে যাওয়ার লাঞ্ছনা। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে ছেড়ে দিয়ে বললেন–হ্যাঁ, আমার ছবি, আমারই ছদ্মনাম, তাতে হয়েছে কী?

ছদ্মনাম নিলেন কেন?

আমার খুশি। ভারতীয় সংবিধানে নতুন নাম নেওয়ার বিরুদ্ধে কোনও বিধান আছে কি?

আমার জানা নেই। শুধু এইটুকু জানি চোর-বাটপাররা নাম ভঁড়ায়, সাধু-সত্যবানরা নয়–বেলঘরিয়ায় গিয়েছিলেন কার কাছে?

যাইনি। একটা কিছু লিখতে হয়, তাই লিখেছিলাম।

আমি চোখ পাকিয়ে চেয়ে রইলাম, হীরকবরণ ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি দুলিয়ে চেয়ে রইলেন। কম কথার মানুষ স্বপন ততক্ষণে ফের আঙুল দিয়ে টরেটক্কা বাজিয়ে চলেছে টেবিলের ওপর। যেন সংকেতে বলতে চাইছে, বিশুদা, এ-বড় শক্ত চাই। এ ভাঙবে তবু মচকাবে না। চেক ওর, জাল সইটাও ওর, আগের টাকাও এ নিয়েছে কিন্তু প্রমাণ নেই, এভিডেন্স নেই, ব্লু নেই। রেডিওগ্রামের জবাব আসার পর যখন শুনবে হ্যাঁ, ইনিই দোর্দণ্ডপ্রতাপ কনট্রোলার অফ ওয়াগ, তখন মানে মানে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া পথ পাবে না, বিশুদা, এ বড় শক্ত চাই।

হালে পানি না পেলে শেষ পর্যন্ত থার্ড ডিগ্রির শরণাপন্ন হতে হয়। স্বীকার করছি কাজটার মধ্যে খুব বীরত্ব নেই। কিন্তু রেজাল্ট নিয়ে আমাদের দরকার। একটা লোক কুকর্ম করেছে বুঝতে পারছি, হাতেনাতে ধরেও ফেলেছি, অথচ সাজা দেওয়া যাবে না প্রমাণের অভাবে হাসতে হাসতে হারিয়ে যাবে জনঅরণ্যের মধ্যে। আরও কতজনের সর্বনাশ করবে–ভাবা যায় না। এইজন্যেই জানবেন থার্ড ডিগ্রির হেল্প নিতে হয়। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্যে, অপরাধীকে অপরাধ কবুল করানোর জন্যে অশাস্ত্রীয় যদি কিছু করি তো জানবেন সেটা মহৎ উদ্দেশ্যেই করা–নিজের স্বার্থে নয়।

কিন্তু হীরকবরণ সবকটা পরীক্ষায় পাস করে গেলেন। মানে কোনওরকমেই তাঁকে কবুল করানো গেল না। সাত দিন হয়ে গেছে। রেডিওগ্রামের জবাব তখনও আসেনি। আমরা বেদম হয়ে পড়েছি। রাত হয়েছে। আমার চেয়ারের বাঁ-ধারে মেঝের ওপর উপুড় হয়ে বসে আছেন হীরকবরণ। এককথায় তখন তার জর্জরিত অবস্থা বললেই চলে। চুপসে গেছেন। মুখের সে চেকনাই আর নেই। চোখের চাপা তীক্ষ্ণতাও নেই। আমার চেয়ারের ডানদিকে দাঁড়িয়েছিল স্বপন।

বলল–বিশুদা, তাহলে লকআপ পাশ লিখে একে সেন্ট্রাল লকআপে পাঠানো যাক?

তাই করো–বললাম আমি।

স্বপন কিন্তু লকআপ পাশ না লিখে টেলিফোন রিসিভার তুলে নিল। শুনলাম অপারেটরকে বলছে–মিসিং স্কোয়াড দিন। শুনলাম বটে, কিন্তু মিসিং স্কোয়াড কেন চাইছে, তা ভাবলাম না। জিগ্যেস করলাম না। হাতের কেসের সঙ্গে মিসিং স্কোয়াডের যে কোনও সম্বন্ধ থাকতে পারে, তা কল্পনাতেও আনতে পারিনি। আমি কেন, নাটের গুরু স্বয়ং হীরকবরণও তিলমাত্র সন্দেহ করেননি– আঁচ করতেও পারেননি কম কথার মানুষ স্বপন চৌধুরী, ভবিষ্যতের এ-সি-ডি-ডি (ওয়ান) স্বপন চৌধুরী কোন লাইনে যাচ্ছে, কি মোক্ষম প্যাঁচে ঘায়েল করতে যাচ্ছে বোবা হীরকবরণকে। নিঝুম হয়ে হীরকবরণ তখন মেঝের পানে চেয়ে ভাবছিলেন বোধহয় ওঁর দুর্দৈবের কথা। আর ভাবছিলাম মোগল আমল হলে এত প্রমাণ-টমাণের কেউ ধার ধারত না। হাতির তলায় ফেলে হীরকবরণের বুকের ওপর হাতির একটা পা চালিয়ে দিলেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসত স্বীকারোক্তি। স্বপন তখন ফিনিশিং টাচ দিচ্ছে টেলিফোনে। ওস্তাদের মার শেষ রাত্রেই হয়। কথাটা যে কত বড় সত্যি, স্বপনের কেদানি দেখে সেদিন বুঝলাম। হয়তো গোড়া থেকেই আঁচ করে রেখেছিল, কোন লাইনে ল্যাং মারবে হীরকবরণকে–কিন্তু ইচ্ছে করেই বলেনি এতক্ষণ। হীরকরণের হিরে চকচকে চেহারায় কালি না পড়া পর্যন্ত, মনোবল ভেঙে না যাওয়া পর্যন্ত চুপ করে থেকেছে। তারপর সময় বুঝে ছেড়েছে তুরুপের তাস। রিয়্যাল ডিটেকটিভ একেই বলে। স্রেফ ঝোঁপ বুঝে কোপ মারা, বুদ্ধির খেলায় হারিয়ে দেওয়া, নাটক সৃষ্টি করে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে আচম্বিতে অতর্কিতে অপরাধীর মন ভেঙে চুরমার করে দেওয়া।

দেহে মনে আমিও তখন অবসন্ন। তাই অন্যমনস্ক ভাবে শুনলাম স্বপন বলছে–হ্যালো মিসিং স্কোয়াড? তারপর শুনলাম একটা চেহারার ডেসক্রিপশন বলে গেল। কিছুক্ষণ কান পেতে শুনল। সবশেষে রিসিভার নামিয়ে রেখে চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললে–দাও, লকআপ পাশটা লিখে ফেলি।

লিখতে লিখতে মাথা নীচু করে বললে–বাদলবাবু, বেঙ্গল কেবিনে ওয়াইফকেও বলে আসেননি?

ঘরের মধ্যে আমি আর হীরকবরণ ছাড়া বাদলবাবু বলে কেউ নেই। কিন্তু বাদলবাবু নামটা শুনে হীরকবরণের গায়ের ওপর যেন এক গামলা গরম জল ঢেলে দেওয়া হল। তিড়বিড়িয়ে লাফিয়ে উঠেই ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখে চেয়ে রইলেন স্বপনের পানে।

স্বপন লেখা থামিয়ে খুব সহজভাবে মুখ তুলে বলল–আসবার সময়ে বলে এলেই পারতেন। ভাবনা চিন্তা হয়তো!

হীরকবরণের মুখের চেহারা তখন আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। ঠোঁটের পাশে চামড়া কাঁপছে থিরথির করে, চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে বাইরে–মুখের কোথাও আর সেই অনমনীয় দৃপ্ত মনোভাবের তিলমাত্র ছায়া নেই। নকআউট করেছে স্বপন। মিডল উইকেট ডাউন।

ঢোঁক গিলে স্বপনকে বললেন হীরকবরণ–স্যার, একটু পাশের ঘরে আসবেন? উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বললে–চলুন। আমাকে চোখের ইঙ্গিতে বসতে বলে হীরকবরণকে নিয়ে গেল পাশের ঘরে। পরে শুনলাম, কী হয়েছিল সেখানে। সটান স্বপনের দু-পা জড়িয়ে ধরেছিলেন হীরকবরণ। বলেছিলেন– আমি সব বলব স্যার কিন্তু দয়া করে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবেন না। বন্ধুর মতো সঙ্গে চলুন। সব ফিরিয়ে দেব। কিন্তু বাড়ির লোকের সামনে, পাড়াপড়শির সামনে হাতকড়াটা লাগাবেন না।

নিজে থেকেই সব কবুল করে বললেন হীরকবরণ। বাদলবাবু–এই ছদ্মনামটি এবং হ্যারিসন রোডের বেঙ্গল কেবিনের নাম শুনেই হীরকবরণ ধরে নিয়েছিলেন–স্বপন চৌধুরী সারাদিন এত কম কথা বলেছে সব জানে বলে। সুতরাং মান বাঁচাতে প্রাণ খুলে কথা বলাই ভালো।

জিপে হীরকবরণকে বসালাম আমার আর স্বপনের মাঝখানে। কিন্তু সাবধান থাকার আর দরকার ছিল না। হীরকবরণ তখন সব টাকা ফিরিয়ে দিয়ে ইজ্জত বাঁচাতে চান। নিজেই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন হ্যারিসন রোডের বেঙ্গল কেবিন হোটেলে। ফ্যামিলি হোটেল। আগে এগিয়ে দিলাম হীরকবরণকে। ম্যানেজার গোল কাউন্টারের সামনে বসে আলপিন দিয়ে দাঁত খুঁটছিলেন। যেন কাঠকয়লা দিয়ে তৈরি একটা ফ্রানকেন্সটাইন মূর্তি। যেমন বিরাট মুখ, তেমনি বিরাট চেহারা। হীরকবরণকে দেখেই আলপিন নামিয়ে হাঁ-হাঁ করে উঠলেন–আচ্ছা বেআক্কেলে লোক তো মশাই আপনি। কোথায় ডুব দিয়েছিলেন? ওয়াইফকেও তো বলে যাবেন? থানা-পুলিশ পর্যন্ত হয়ে গেল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। পেছন ফিরে আমাদের দেখে নিয়ে ক্লিষ্ট কণ্ঠে বললেন হীরকবরণ–ওরা কোথায়?

কোথায় আবার বাড়িতে। এই তো আজ সকাল কাঁদতে কাঁদতে বেলঘরে গেল। বলিহারি যাই আপনার আক্কেলকে। আমাদের গুডউইল পর্যন্ত টাইট করে ছেড়েছেন মশায়। আজ পর্যন্ত ওঙ্কার মিত্তিরের হোটেলে পুলিশ ঢোকেনি কখনো–আপনার কৃপায়–

এই পর্যন্ত শুনেই অন্তরাল থেকে সামনে এসে দাঁড়ালাম আমি আর স্বপন। স্বপনের হাতে আইডেনটিটি কার্ড। তৎক্ষণাৎ বাকি কথাটা কোৎ করে যেন গিলে নিয়ে চক্ষের নিমেষে হেঁ-হে করে হেসে বললেন ওঙ্কার মিত্তির–আসা হোক! আসা হোক! কী সৌভাগ্য! পেয়েছেন তাহলে বাদলবাবুকে।

পেয়েছি।–অল্পকথার মানুষ স্বপন অল্প কথাতে বললে–হোটেল রেজিস্টার বার করুন।

কাষ্ঠহাসি মিলিয়ে গেল ওঙ্কার মিত্তিরের চারকোল ফেস থেকে। বিনা বাক্যব্যয়ে কাউন্টারের কোণ থেকে রেজিস্টার টেনে নিয়ে এগিয়ে দিল স্বপনের দিকে।

খাতায় লেখা হীরকবরণ মুখার্জির আর এক নাম–বাদল ভৌমিক। এসেছেন সপরিবারে। স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং ছেলেকে নিয়ে। আজ সকালেই তারা চোখের জল মুছতে মুছতে গেছেন বেলঘরিয়ায়–হীরকবাবুর পৈত্রিক ভিটেতে।

মনে পড়ল হাওড়ার হোটেলে রেজিস্টারেও হীরকবরণ লিখেছিলেন বেলঘরিয়ায় যাচ্ছি। এই একটা ব্যাপারে তিনি মিথ্যার আশ্রয় নেননি। বিপদের আশংকা নেই জেনেই নেননি। ভয় আসল ওই নামকে নিয়ে। ওই জন্যে দু-হোটেলে লিখেছেন দুটো নাম।

স্বপন বের কর হীরকবরণের আর একটা ফটোগ্রাফ। পেছনে ওঙ্কার মিত্তিরকে দিয়ে হোটেলের রবার স্ট্যাম্প মারিয়ে সই করিয়ে নিল যে ফটো যার তিনি বাদল ভৌমিক নামে অমুক তারিখ থেকে অমুক তারিখ পর্যন্ত বেঙ্গল কেবিনে থেকে রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়েছিলেন। মিসিং স্কোয়াডে খবর দেওয়া হয়েছিল। রেডিওতে অ্যানাউন্সমেন্ট হয়েছিল, হাসপাতালে খোঁজ নেওয়া হয়েছিল।

ঠিক এই অনুমানটি করেছিল স্বপন–দি পুলিশ ডিটেকটিভ। যে লোক কলকাতার বাইরে থেকে এসে একবার হোটেলে উঠেছে, সে নিশ্চয় এবারও হোটেলে উঠেছে। এই কদিন যদি একজন বোর্ডার উধাও হয়ে গিয়ে থাকে, মাথা বাঁচাবার জন্যে ম্যানেজার মিসিং স্কোয়াডের শরণাপন্ন হবেই। সুতরাং…

সেই রাতেই জিপ হাঁকিয়ে গেলাম বেলঘরিয়ায়। হীরকবরণের বাড়ি দেখে তাক লেগে গেল। ভালো কথা, রুটিন জেরার সময় হীরকবরণ বলেছিলেন, তার বাবা নেই, বউ নেই, কেউ নেই। বউ যে আছে ওঙ্কার মিত্তিরের কাছে শুনে এসেছিলাম। বাড়িতে ঢুকে দেখলাম, বাবাও আছেন। সত্তর বছরের বৃদ্ধ। হীরকবরণ তার একমাত্র সন্তান। পুত্রগর্বে গর্বিত। আজকালকার বাজারে এরকম একটা চাকরি করা ভাগ্যের ব্যাপার। হীরকবরণ বাড়িতে কম কথা বলেন। ব্যক্তিত্ব রাখেন। এমনকি পিতৃদেবও অকারণে কথা বলেন না ছেলের সঙ্গে। মেয়ে, ছেলে, বউও মুখ তুলে কথা বলেন না তার সামনে। পাড়াপড়শি সম্মান করে। সবাই জানে তিনি কৃতি পুরুষ। জীবন সংগ্রামে বিজয়ী পুরুষ।

আমরা কথা রেখেছিলাম, হ্যান্ডকাফ দিইনি। এমনকী বাপকেও সব কথা বলিনি–সেই মুহূর্তে। কিন্তু অত রাতে পুলিশ জিপে ছেলেকে আধমরা চেহারায় ফিরতে দেখে বুঝলেন অভাবনীয় কিছু ঘটেছে। তারপর যখন ছেলে শোবার ঘরে ঢুকে দেওয়ালের সিন্দুক খুলে বার করল থরে থরে সাজানো আনকোরা সোনার গয়না–তার তখন আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না।

লিস্ট করলাম গয়নার।

গয়নার সঙ্গেই ছিল সব ক্যাশমেমো। দাম ফেলে যোগ করলাম। মোট চোদ্দ হাজার। আর পাওয়া গেল খানকয়েক ফুলস্ক্যাপ কাগজ। তাতে প্রায় দুশো বার কুঞ্জবিহারী গড়াইয়ের নামটা সই করা। মস্ক করেছেন হীরকবরণ।

এই পর্যন্ত যখন এগিয়েছি, বাড়িতে তখন চাপা কান্না শুরু হয়ে গেছে। বাড়িশুদ্ধ লোক জানত, হীরকবরণ এত গয়না কিনেছেন বিবাহযোগ্য দুই মেয়ের জন্যে, সেই মেয়ে দুটিই রাঙা চোখে কাঁদতে কাঁদতে এসে গায়ের বারোমেসে গয়না পর্যন্ত খুলতে আরম্ভ করল–যাতে বাবা ছাড়া পায়। বছর কুড়ি-বাইশ বয়স হবে মেয়ে দুটির। মার্জিত মুখশ্রী। কিন্তু ভয়ে উদ্বেগে উৎকণ্ঠায় মাথার ঠিক নেই। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে একটার পর একটা চুড়ি খুলে নামিয়ে রাখতে লাগল আমার আর স্বপনের পায়ের কাছে। পুলিশের কাজ করলেও আমরা মানুষ। ঘরসংসার করি। ভেতরে বিচলিত হলেও অবিচল থাকতে হল বাইরে।

কিন্তু বাধা দিলেন হীরকবরণ নিজেই।

বললেন–ও গয়না আমার টাকায় কেনা। চোদ্দো হাজারের হিসেব এই গয়নায় দিলাম।

বাকি দশ হাজার?–অনেক কষ্টে নীরস গলায় জিগ্যেস করলাম আমি।

তাও আছে। আসুন।

নীচে নেমে এলাম। বৃদ্ধ সুনীলবরণ, হীরকবরণের বাবা হাত জড়িয়ে ধরলেন স্বপনের আর আমার। কেলেঙ্কারী যেন না হয়–ওই তাঁর একমাত্র ছেলে। সচ্চরিত্র, শিক্ষিত, দায়িত্বসম্পন্ন। এতবড় ফ্যামিলি রয়েছে ওর মাথার ওপর। হীরক আজ রাতে ফিরবে তো?

কথা দিতে পারলাম না। জিপে ওঠালাম হীরকবরণকে। একটা ঠিকানা দিলেন উনি। জায়গাটা বেলঘরিয়াতেই অ্যাডভোকেটের বাড়ি।

বললেন–দশহাজার টাকার জমি কিনব ঠিক করেছিলাম। টাকাটা গচ্ছিত রেখেছিলাম অ্যাডভোকেটের কাছে। জমির দালালকে বলা ছিল সেরকম জমি পেলেই যেন দেখা করে ওঁর সঙ্গে।

অ্যাডভোকেটের নাম মুক্তারামবাবু। প্রবীণ, বিচক্ষণ, হুঁশিয়ার। প্রথম কথাতেই প্রকাশ পেল তাঁর চরিত্রে সদাসতর্ক বৈশিষ্ট্য। বেরিয়ে এলেন খালি গায়ে। ব্রাহ্মণ। চওড়া বুকে সাদা পৈতে। মুখে বুদ্ধির ছাপ। তীক্ষ্ণ চোখে দেখলেন আমাকে আর স্বপনকে।

টাকা চাইলেন হীরকবরণবাবু। মুক্তারামবাবু আঙুলে পৈতে জড়াতে জড়াতে কঠোর গলায় বললেন–তার আগে বলুন এরা কে?

আমার বন্ধু। জমির খোঁজ পাওয়া গেছে। তাই–

শুনেছি বাজপাখির চোখ মানুষের চোখের তিনগুণ বেশি শক্তিশালী হয়। নিমেষের মধ্যে জ্বলে ওঠা মুক্তারামবাবুর চোখে সেই শ্যেনদৃষ্টিই প্রত্যক্ষ করলাম। হীরকবরণের কলজে পর্যন্ত যেন এফোঁড় ওফেঁড় হয়ে গেল সেই চাহনিতে। ইস্পাতের ছুরির মতো ধারালো হাসি হেসে বললেন চিবিয়ে চিবিয়ে–তাই এত রাতে এলেন টাকা নিতে। হীরকবাবু, আমি ক্রিমিন্যাল চরিয়ে খাই। এত বোকা আমাকে ঠাওরাবেন না। এরা কোত্থেকে আসছেন আমি জানি। আপনি দশহাজার টাকা যে সোজা পথে পাননি–সেটাও আঁচ করেছিলাম বলে ঝুটঝামেলায় যেতে চাইনি। টাকা রেখেছিলাম কিন্তু প্রত্যেকটা নোটের পেছনে আপনাকে দিয়ে ইনিসিয়াল করিয়ে নিয়েছিলাম। নিন আপনার টাকা।

সিন্দুক খুলে তৎক্ষণাৎ দশহাজার টাকা বার করে দিলেন মুক্তারামবাবু। প্রত্যেকটা নোটের পেছনে ছোট সই করে তারিখ দিয়েছেন হীরকবরণ। আমরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। সই করা অরিখ দেওয়া নোটগুলোই এখন হীরকরণের বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণ। লিকুইড কেকে এক নিমেষে সলিড গ্রাউন্ডে দাঁড় করিয়ে দিলেন হুঁশিয়ার, দূরদর্শী মুক্তারামবাবু। এখন হীরকরণ বলতে পারবেন না–এ নোট আমি নিইনি। নম্বরী নোট ব্যাঙ্কের হিসেবের সঙ্গেও মিলে যাবে।

মিলেও গেল। সন্তোষজনকভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল হীরকব্রণ মুখার্জির কুকীর্তি।

হীরকবরণকে নিয়ে যাওয়া হল টিম্বার মার্চেন্ট কুঞ্জবিহারী গড়াইয়ের সামনে। কনট্রোলার অফ ওয়াগনূসের অধঃপতনের কাহিনি শুনে ভদ্রলোক মনে হল মূৰ্ছা যাবেন। জীবনে তিনি এরকম একজন স্বনামধন্য অফিসারকে এত হীন কাজ করতে দেখেননি। হ্যাঁ ঘুষ-টুষ নেন অনেকেই হীরকবরণ মুখার্জি জীবনে একটা আধলাও কারো কাছে নেন নি–ঘুষ তো দূরের কথা–ধার পর্যন্ত নিতেন না। অফিসে ব্যবসায়ী মহলে তাই হীরকবরণ বলতে হীরের টুকরোই বোঝাত।

সেই হীরকবরণ তার চেকবই থেকে একটি চেক ছিঁড়ে নিয়েছেন, একথা তিনি বিশ্বাস করবেন কী করে? মাস কয়েক আগে উনি এসেছিলেন গড়াই মশাইয়ের অফিসে। প্রায় আসতেন কুঞ্জবিহারীবাবুও যেতেন। কন্ট্রোলার অফ ওয়াগকে খাতির করতে হত, হাতে রাখতে হত–তাতে ওয়াগন সহজে পাওয়া যেত, কাঠ চালান নইলে অসম্ভব এই ওয়াগন-আকালের দিনে।–বিশেষ করে ওই অঞ্চলে। কিন্তু হীরকবরণ পয়সা নেন না–তাই নতুন বছরে একটা ডায়েরি দিয়েছিলেন। দামি ডায়েরি। কাকে কটা ডায়েরি দেওয়া হল, সে হিসাব নিজে হাতে লিখে রাখেতেন কুঞ্জবিহারীবাবু–যাতে সামনে বছর ডাইরি দিয়ে আপ্যায়নে ভুল-ত্রুটি না হয়। সেই খাতা বার করে দেখালেন নাম লেখা রয়েছে হীরকবরণ মুখার্জির।

কিন্তু চেক দুখানা কীভাবে সরালেন হীরকবরণ; সেই পি-এ ছোকরাকে টাকা খাইয়ে কি? এ প্রশ্নের উত্তরে সত্যবাদী রূপে বিখ্যাত হীরকবরণ সত্যি কথাই বললেন।

ডাইরি হাতে নেওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত নাকি চেক চুরির কোনও প্ল্যান তার মাথায় ছিল না। এসেছিলেন কাজের কথা বলতে। সে কথা হয়েছে, ডায়েরিও পেয়েছেন নববর্ষের শুভেচ্ছাসহ, উঠে পড়লেই পারতেন–কিন্তু উঠলেন না। এদিকে খেতে যাবার সময় হয়েছে কুঞ্জবিহারী গড়াইয়ের। হীরকরণ মুখার্জিকে লাঞ্চের নেমন্তন্নও করলেন তিনি। দুজনে একদিন ভালোমন্দ খেলে ক্ষতি কি। কিন্তু হীরকবাবু গেলেন না। উৎকোচ-নির্লোভ বলেই বোধহয় গেলেন না। এই মনে করে কুঞ্জবিহারীবাবু বললেন–তাহলে আপনি একটু বসুন, আমি যাব আর আসব। সায় দিলেন হীরকবাবু। ঘর ফাঁকা হতেই উঠে গিয়ে দেখলেন ড্রয়ারে চাবি দেওয়া নেই। স্বপন জিগ্যেস করল–এই যে বললেন চেক চুরির কোনও প্ল্যান আপনার ছিল না–তাহলে ড্রয়ার দেখতে গেলেন কেন? হীরকবরণ বললেন–কি জানি কেন হঠাৎ মনে হল দেখিই না কি আছে ড্রয়ারে। প্রথম ড্রয়ারে পেলাম চেকবই। কি যে দুর্মতি হল, তৎক্ষণাৎ খান দুই চেক একেবারে গোড়া থেকে ছিঁড়ে বার করে নিলাম চেক বইয়ের ভেতর থেকে। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এলেন কুঞ্জবিহারীবাবু। চা খেয়ে অফিসে চলে এলাম। নেক্সট উইকে কলকাতা গিয়ে তুললাম চব্বিশ হাজার টাকা।

সব তো হল। কিন্তু মোটিভ কই? মোটিভ ছাড়া ক্রাইম সচরাচর হয় না। মোটিভ ছাড়া যারা ক্রাইম করে, তারা বিকৃত মস্তিষ্ক। জ্যাক দি রিপারের মতো উন্মাদ। ক্লেপটোম্যানিয়্যাকরা যেমন চুরি করে আনন্দ পায়–তেমনি আর কি! কিন্তু হীরকবরণ মুখার্জি সজ্জন। সুস্থমস্তিষ্ক এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত পুরুষ। তাঁর অভাব নেই, লোভ নেই। তা-সত্ত্বেও এতবড় অন্যায় কেন করলেন? মোটিভ কী?

এ কাহিনির সেইটাই সবচেয়ে মর্মান্তিক অংশ। হীরকবরণ মুখার্জি বিবেকবান সজ্জন পুরুষ–তাই বিবেকদংশন সহ্য করতে না পেরে এক অন্যায়কে ঢাকতে আর এক অন্যায় করে বসলেন। ক্ষণিকের ভুলে পদস্থলন তার হয়েছিল। জীবনে কখনো পাপ করেননি বলেই একটিমাত্র পাপের অনুতাপে তিনি জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলেন। তাই প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ আর একটি পাপের সঙ্গে পা বাড়ালেন।

মায়াবী মোটিভ একেই বলে।

হীরকবরণ মুখার্জির ডিপার্টমেন্টে রামতনু বলে একটি ছেলে কাজ করত। ছেলেটির দুনিয়ায় কেউ নেই–একটিমাত্র বোন ছাড়া। বোনটির বয়স যখন সতেরো, ঠিক তখন রামতনুকে বদলি হতে হল নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার রেলওয়েরই এমন একটা দুর্গম জায়গায় যেখানে অনুঢ়া বোনকে নিয়ে যাওয়া সেই মুহূর্তে সম্ভব নয়। রামতনুর মাইনেও এমন কিছু বেশি নয়। মেসে থেকে বাসাবাড়ি খুঁজতে হবে। তদ্দিনের জন্যে বোনটিকে কোথায় রাখা যায়?

হীরকবরণ মুখার্জিকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করত রামতনু। ধরল তাঁকেই। বলল–স্যার, বাসাবাড়ি না পাওয়া পর্যন্ত আপনার কাছে যদি সরোজিনীকে রাখেন, আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি।

হীরকবরণ রাজি হলেন। রামতনুকে স্নেহ করতেন তিনি। তিনি নিজেও পরোপকারী। সরোজিনী রইল তার কোয়ার্টারে। পাণ্ডুর কোয়ার্টারে তিনি ঠাকুর-চাকর নিয়ে একাই থাকতেন। বৃদ্ধ বাবার দেখাশুনার জন্যে এবং ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্যে স্ত্রীকে রেখেছিলেন বেলঘরিয়ায়।

মাস কয়েক পরে সরোজিনীর স্কুলে খবরটা প্রকাশ পেল। মেয়েদের চোখকে ধুলো দেওয়া যায় না এসব ব্যাপারে। বান্ধবীরাই ধরে ফেলল, সরোজিনী সন্তানসম্ভবা। হীরকরণ মুখার্জির দুর্দিন শুরু হল তখন থেকেই। রামতনু এল। সে-ও স্তম্ভিত। হীরকবরণ লজ্জায় অধোবদন। এদিকে কানাঘুসো আরম্ভ হয়েছে রেলওয়ে কোয়ার্টারে। তাই রামতনু আর সরোজিনীকে নিয়ে এলেন পুরীতে। প্রস্তাব করলেন গর্ভপাত করা হোক।

বেঁকে বসল সরোজিনী–রামতনুর ইচ্ছে সত্ত্বে। নিরুপায় হয়ে কলকাতায় এলেন হীরকবরণ। কালিঘাটে গিয়ে সরোজিনীর মাথায় সিঁদুর পরিয়ে দিয়ে বিয়ে করলেন। বাগবাজারে একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে তার থাকার ব্যবস্থা করলেন।

কিন্তু ওই পর্যন্তই। মুহূর্তের মোহে যে ভুল তিনি করেছিলেন, বিয়ের লাইসেন্স নিয়ে তাকে প্রলম্বিত করলেন। সরোজিনীর আর বাচ্চার খোঁজখবর নিতেন। কিন্তু সরোজিনীর ফ্ল্যাটে রাত্রিবাস করতেন না।

দিবারাত্র বিবেকের দংশন আর সইতে পারে না হীরকবরণ। সরোজিনী আর নিষ্পাপ শিশুটির ভবিষ্যতের একটা পাকাঁপোক্ত ব্যবস্থা করার সংকল্প নিলে মনে মনে। তাঁর অবর্তমানে দ্বিতীয় স্ত্রী আর পুত্রের যাতে খাওয়া পরার অভাব না থাকে, জীবিতকালে সেই ব্যবস্থা করে যাবেন ঠিক করলেন।

কিন্তু রোজগার তাঁর রবারের মতো নয় যে টানলে বড় হবে। উৎকোচ নিয়ে এতদিনের সুনাম আর শ্রদ্ধাকে বলি দিতে রাজী নন। তাই সব দিক বজায় রেখে কাকপক্ষীকে না জানতে দিয়ে প্রথম যে কাজে হাত দিলেন–তা নিয়েই এই গল্প।

গল্প শেষ করে বিশ্ববন্ধুবাবু হেসে বললেন–মৃগাঙ্কবাবু, এ গল্পের ডিটেকটিভ চমকে দেওয়ার মতো কোনও কু পায়নি–শুধু দেখিয়েছে উপস্থিত বুদ্ধির খেলা। কিন্তু সে সুযোগও সে পেত

-হীরকরণ কোনওদিনই ধরা পড়তেন না–যদি তিনি প্রফেশনার ক্রিমিন্যাল হতেন–তাহলে আর দ্বিতীয় বার ওই ব্যাঙ্কে তিনি আসতেন না। ওই একটি মাত্র ভুলের জন্যে তাঁকে শেষ পর্যন্ত জেলেই যেতে হল–পাঁচ বছরের জন্যে।

* উল্টোরথ পত্রিকায় প্রকাশিত। জুলাই-আগস্ট, ১৯৭৬।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *