মায়াবন্ধন

মায়াবন্ধন

এখন বর্ষাকালের মাঝামাঝি। গোটা ট্রেনপথটা আকাশের মুখভার ছিল। হাওড়ায় নেমে বাস ধরে শিউলি ব্রিজের ওপর আসতেই, গঙ্গার এলোপাতাড়ি হাওয়া চাঙ্গা করে দিল ওর মনটাকে। গত এক বছরের নানা দুঃখের ঘটনার মধ্যে এই দমকা বাতাসের স্মৃতিটাই যা একটু মধুর। বিয়ের পরের দিন শিউলি যখন কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে আসছিল, গাড়িতে সাজানো বাসি ফুলগুলোর মতো সেও গিয়েছিল এলিয়ে। দিবাকরের কাঁধে মাথা রেখে ঝিমোচ্ছিল। কলকাতায় ঢোকার আগে এই হাওয়াটাই ওর তন্দ্রা কাটিয়ে দেয়। সোজা হয়ে বসে গঙ্গার দিকে মুখ করে তিনবার নমস্কার ঠুকেছিল শিউলি। বাতাসের ভিতর লুকিয়ে ছিল নতুন জীবনের গন্ধ। বৃথা গেল সেই প্রণাম। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই বাপের বাড়ি বাঁশবেড়িয়ায় ফেরত আসতে হয়েছে। শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে যে দিন ঢাউস সুটকেস সমেত ট্যাক্সিতে ফিরছিল একা, গঙ্গার বাতাস ছিল থমকে। তারপর চার-পাঁচবার এসেছে কলকাতায়, কেনাকাটা, সিনেমা বা ভাইপো-ভাইঝিদের নিয়ে বেড়াতে আসা, প্রতিবারই গঙ্গার হাওয়া ফিরিয়ে দিয়েছে তার বিয়ের একমাত্র সুখস্মৃতি। অনেকদিন পর আজ আবার বিশেষ কাজে শিউলি কলকাতায় এল।

দুপুরের টাইম বলে বাসে ভিড় কম। সিট পেয়েছে শিউলি। বাসের যাত্রীরা কেউ কারও দিকে না তাকিয়ে নিজের মনে দুলতে দুলতে চলেছে। এরা বেশিরভাগ সংসারে থাকা মানুষ। নিজেদের সুখ-দুঃখ, নিত্যদিনের সমস্যা নিয়ে ভাবছে এখন। এদের মধ্যে শিউলির সমস্যাই সবচেয়ে গুরুতর, সে অনেক বেশি দুঃখী।… চিন্তাটা মাথায় আসতেই ছোটমাসির একটা কথা মনে পড়ে গেল। বলেছিল, সংসারে কোনও মানুষই পুরোপুরি সুখী নয়। কমবেশি দুঃখকষ্ট সকলেরই আছে। নিজের দুঃখটাকে সবসময় বড় করে দেখবি না।

কথাটায় নতুনত্ব কিছু নেই। খুবই কমন। তবু ওই উপদেশটাই সদ্য শ্বশুরবাড়ি ফেরত শিউলির ভাঙাচোরা মনটাকে এক জায়গায় জড়ো করে দিয়েছিল। বাকি সব আত্মীয়স্বজনের বিলাপ এবং মৌনতা দেখে মনে হচ্ছিল শিউলির বিয়ে ভাঙা আর মারা যাওয়া প্রায় এক মৃত্যুশোক তবু লোকে দেড় দিনে সামলে নেয়। শিউলি যেহেতু সশরীরে রইল বাপের বাড়ি, শোক থমথমে ভাবটা অনেকদিন ছিল পরিবারে। সময়ের সঙ্গে সেটা মিলিয়ে গিয়ে শিউলি আপাতত বাপের বাড়ির হঠাৎ মনে পড়া দুশ্চিন্তা, পাড়ার পুরনো খবর। বছর ঘুরে গেল এইভাবে। গ্র্যাজুয়েট শিউলি তেড়ে টিউশন পড়ায় এখন। বিয়ের আগে পড়াত না। বারণ ছিল বড়দার। বাবা মারা যাওয়ার পর বড়দা ফ্যামিলির হেড। পারিবারিক মুদিখানার ব্যাবসাটা মূলত সে-ই চালায়। এলাকায় বিত্তবান হিসেবে বাবার নাম ছিল। সেই ঠাট বজায়

রাখতেই দাদার মানা ছিল বাড়ির মেয়েদের কাজ করতে যাওয়ায়। বিজনেস আগের মতো চলে না। অলিগলিতে দোকান হয়ে গেছে। বড়দার সঙ্গে এখনও লেগে আছে সেজদা। মেজদা ইলেকট্রিক মিস্তিরি, ছোট ভাইয়ের ফোটো স্টুডিয়ো। সকলের বউবাচ্চা নিয়ে বাড়ি একেবারে হট্টমেলা। দোতলার একটা ছোট ঘর ছাড়া বাবার করে যাওয়া বাড়ির আর কিছুই বদলাতে পারেনি বড়দা। ফ্যামিলি মেম্বার বেড়ে গেছে ক্রমশ।

দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি আজও নেড়া। রেলিং, প্লাস্টার করে ওঠা যায়নি। দাদাদের ছেলেমেয়েগুলো দৌড়োদৌড়ি করে ওঠানামা করে, ভীষণ ভয় ভয় করে শিউলির। ওদের হাত-পা তো ভাঙবেই। দোষ পড়বে ভাগ্যতাড়িত শিউলির ঘাড়ে। মুখ ফুটে হয়তো কেউ কিছু বলবে না। বাড়ির বড়দের একবার মনে আসবেই, শিউলির কারণে প্লাস্টার, রেলিং হয়নি। বড়দা যখন ও দুটো করার তোড়জোড় করছে, তখনই এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় শিউলির জন্যে সম্বন্ধটা আনে। ছেলের বাড়িতে বিয়ের খুব তাড়া। বিরাট বড়লোক বাড়ি। গেঞ্জির ফ্যাক্টরি আছে ওদের। পাত্র বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে, বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বিজনেসের সমস্ত দায়িত্ব এখন ছেলের ওপর। পাছে এরকম লোভনীয় পাত্র হাতছাড়া হয়ে যায়, সেই আশঙ্কায় বড়দা পাত্রপক্ষের কথা মতো পনেরো দিনের মধ্যে বিয়ের জোগাড় শুরু করল। এ ব্যাপারে শিউলির দোষ কিছু কম নয়। দাদাকে সাবধান করেনি। সে তখন চার চাকার গাড়িওলা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার স্বপ্নে মশগুল। এ বাড়িতে একটা স্কুটারও নেই।

শিউলির দুই দিদির বিয়ে দিয়ে গেছে বাবা। ছোট বোনের বিয়ের দায়িত্ব বড়দার। আগের দুই বোনের বিয়ে শিউলির মতো বড়লোক ঘরে হয়নি। মৃত বাবাকে টেক্কা মারার জন্যেই হয়তো বড়দা হাতের সমস্ত টাকা এবং বেশ কিছু ধারবাকি করে শিউলির বিয়েটা দিয়ে দিল। যদিও ছেলের বাড়ি থেকে দাবিদাওয়া প্রায় কিছুই ছিল না। তবু পাত্রপক্ষের মানানসই জাঁকজমক তো একটু করতেই হয়। বিয়ে হয়েছিল ‘উৎসব’ বাড়িটা ভাড়া করে। বাঁশবেড়িয়ার সবচেয়ে বেশি ভাড়ার অনুষ্ঠান বাড়ি। নিমন্ত্রিতদের চোখে পড়ল না শিউলিদের দোতলায় ওঠার সিঁড়ির অসম্পূর্ণতা।

ঠিক দু’মাস দশ দিন স্বামীর ঘর করেছিল শিউলি। বিনা নোটিশে এক দুপুরে ফিরে এল বাপের বাড়ি। সঙ্গে বিয়েতে এ বাড়ি থেকে দেওয়া ভি আই পি সুটকেস। সেদিন সকালে দাদার দোকান থেকে দুটো বাটখারা হারিয়েছিল। সেই নিয়েই আক্ষেপ আলোচনা চলছিল বাড়িতে। শিউলিকে দেখে আলোচনার মোড় ঘুরে যায়। এতটা অশুভ সম্ভাবনার কথা অবশ্য কেউই ভাবেনি। সরল কৌতূহলে জানতে চেয়েছিল, কোনও খবর না দিয়েই চলে এলি! ব্যাগ দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ কিছুদিন থাকবি। ও বাড়িতে ঝগড়াটগড়া কিছু করে আসিসনি তো?

কোনও কথারই উত্তর দিতে ইচ্ছে করছিল না শিউলির। মনে হচ্ছিল দাদার দোকানের হারিয়ে যাওয়া বাটখারা দুটো যেন তার দু’ভ্রূর ওপর লুকিয়ে বসে আছে। কপালটা ভীষণ ভারী ভারী লাগছিল। সেই মাথা ধরা রোগটা আজও সারেনি। একটু বাড়ে কমে এই যা।

শিউলি যে চিরকালের জন্যে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে, এটা বাড়িতে বিশ্বাস না করার যথেষ্ট কারণ আছে। প্রথমত হাত ফাঁকা করে বিয়ে দেওয়ার পর কোন বাড়িতেই

বা বিশ্বাস করতে চায় মেয়ে ফেরত আসবে! দ্বিতীয় কারণটার জন্যে দায়ী শিউলি নিজে, বিয়ের পর থেকে ওই ক’টা দিন শিউলি শ্বশুরবাড়ির নামে কোনও কমপ্লেন ফোন করে বাড়িতে জানায়নি। অভিযোগ করার কোনও জায়গাও ছিল না। তারা মাথায় করে রাখত শিউলিকে। তার রান্নায়, ঘরকন্নার কাজে শাশুড়ি ছিল প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এইসব কথাই অষ্টমঙ্গলায় এসে শিউলি বড়মুখ করে বলে গিয়েছিল বাড়িতে। বরেরও গুণগান করেছিল খুব। বড় বড় দোকান, হোটেলে নিয়ে যাচ্ছে। জীবনে প্রথম হোটেলের ছাদে বাগান দেখেছে শিউলি। সেখানে বসে ডিনার করেছে। বর আবার হোটেলের রান্নার তেমন ভক্ত নয়। শিউলির তৈরি করে দেওয়া টিফিন ড্রাইভার এসে নিয়ে যায় অফিসে। বেয়ারা সাজিয়ে দেয় সেই খাবার। বরের অসুস্থতার কথাটা বাড়িতে চেপে গিয়েছিল। কেননা দিবাকরকে বিশ্বাস করেছিল সে। যৌনক্রীড়ায় অপারগ দিবাকর তাকে বুঝিয়েছিল, বিয়ের এক মাস আগের এক জটিল জ্বরে সাময়িকভাবে যৌন অক্ষম হয়ে পড়েছে। ডাক্তার বলেছে, আবার সেই শক্তি ফিরে আসবে।

একটা করে দিন যায়। দিবাকরের সুস্থতার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। রাতকে ভীষণ ভয় পেত দিবাকর। তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে গুটিয়ে পাকিয়ে শুয়ে পড়ত। সকাল হলেই ‘শিউলি’, ‘শিউলি’ বলে এমন চোখে হারানো হাঁকডাক শুরু করত, যেন ওর মা বা কাজের লোক দু’মাইলের মধ্যে নেই। সন্দেহ গাঢ় হতে লাগল শিউলির। মনে পড়ত কলেজের পর টিকে যাওয়া একমাত্র বান্ধবী সীমার কথা। বিয়ের যখন দেখাশোনা চলছে, সীমা বলেছিল, আমার কিন্তু কেমন একটু লাগছে, জানিস। অত বড়লোক, হুট করে তোকে পছন্দ করে নিল! দু’সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে। তোরা আর একটু খোঁজখবর নিলে পারতিস।

সীমার পরামর্শে তখন কান দেয়নি শিউলি। ভেবেছিল, এটা বুঝি সীমার হিংসে। শিউলির চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও সীমার এত ভাল সম্বন্ধ আসেনি। তাই হয়তো সহ্য হচ্ছে না। বিয়ের পর যত দিন যাচ্ছিল, সীমার সতর্কবার্তা মনে পড়ছিল বারংবার। প্রবল এক অনিশ্চয়তা শিউলিকে বাধ্যত নির্লজ্জ করে তুলল। একপ্রকার জোর করেই দিবাকরের শরীরী সান্নিধ্য চাইতে শুরু করল সে। অসহায়ভাবে নিজের অক্ষমতা ঢাকতে গিয়ে দিবাকর ধরা পড়ে যাচ্ছিল প্রতিবার। বলত, আর ক’টা দিন সবুর করো। আমাকে সুস্থ হতে দাও।

শোনেনি শিউলি। শুধু একটা মানুষের জন্যেই এতদিন সে আগলে রেখেছিল শরীর। বশে রেখেছিল নিজের কামনা। এই অবমাননা তার প্রাপ্য নয়। দিবাকরকে বলেছিল, চলো তোমার সেই ডাক্তারের কাছে। কী বলছেন আমি নিজের কানে শুনব।

মিথ্যে অজুহাত দিয়েছিল দিবাকর, ডাক্তার নাকি বিদেশে চলে গেছে। মাথা ঠান্ডা রেখে শিউলি বলেছিল, তা হলে কোনও স্পেশালিস্ট ডাক্তারের কাছে যাই, চলো।

অনেক করে বুঝিয়ে রাজি করানো গেল দিবাকরকে। এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, শিউলি কিন্তু ধৈর্য রেখে দু’বাড়ির কাউকেই কিছু বলেনি। আশা করেছিল, দিবাকর ভাল হয়ে যাবে। লজ্জাবশত ওর সমস্যাটা নিয়ে এতদিন হয়তো কোনও ডাক্তারের কাছে যায়নি। চিকিৎসা করতে গিয়ে জানা যাবে, রোগ খুব সামান্যই।

আশা পূরণ হল না শিউলির। কলকাতার এক নামী ডাক্তার দিবাকরকে দেখে নিয়ে

শিউলির সঙ্গে যখন আলাদা করে কথা বললেন, তখনই জানিয়ে দিলেন, দিবাকরের অক্ষমতা দীর্ঘদিনের। আরোগ্যের চান্স প্রায় নেই।

ডাক্তারদের মুখ থেকে উচ্চারিত ‘প্রায়’ কথাটা পৃথিবীর সবচেয়ে অনির্ভরযোগ্য শব্দ। শিউলি বুঝেছিল, যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে। কানে বাজছিল ছোটদের স্কুল ছুটির উল্লাস। কেন ওই শব্দটাই শুনতে পাচ্ছিল, জানে না। ভাইপো-ভাইঝিদের স্কুল ছুটির পর সে নিয়ে এসেছে, আওয়াজটা তার চেনা। ক্রমশ শব্দটা চলে গেল দূরে। গলায় আটকে থাকা কষ্ট নিয়ে সেই রাতেই প্যাকিং শুরু করে দিয়েছিল শিউলি। পায়ে ধরেছিল দিবাকর, তুমি যেয়ো না। বয়সকালে কে দেখবে আমায়? মা-বাবা তো চিরকাল থাকবে না।

অত রাগের মধ্যেও শিউলি অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল, তোমাকে দেখাশোনার জন্যই তা হলে বিয়েটা করেছিলে? একটা আয়া রাখলেই তো সমস্যা মিটে যেত। যেভাবে স্বামীকে…

আয়া আর বউয়ের মধ্যে অনেক তফাত শিউলি। স্ত্রী

কথা শেষ করতে দেয়নি শিউলি। ফুঁসে উঠেছিল, কাউকে নিজের স্ত্রী করে নেওয়ার সামর্থ্য তোমার নেই। কোন সাহসে বিয়েটা করেছিলে? একবারও মনে হয়নি, মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। বিয়ের বুদ্ধি কে দিয়েছিল তোমায়?’

আমার এক বন্ধু। বলেছিল, বউকে একটু স্বাধীনতা দিবি। পুরনো প্রেম থাকলে, নাক গলাবি না। তা হলেই দেখবি থেকে যাবে তোর কাছে। আমি তোমাকে সেই স্বাধীনতা দিতে চাই শিউলি। আমাকে ছেড়ো যেয়ো না।

দিবাকরের আকুলতা এতটুকু স্পর্শ করেনি শিউলিকে। সে একবার শুধু সেই শয়তানটার নাম জানতে চেয়েছিল, যার কুমন্ত্রণায় বিয়েটা করেছিল দিবাকর। যথারীতি নামটা দিবাকর বলেনি। আরও কয়েকবার জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলত। জানার মতো ধৈর্য তখন ছিল না শিউলির। মাথা ঠান্ডা হওয়ার পর থেকে শিউলি লোকটাকে খুঁজে যাচ্ছে, অগণন পুরুষের ভেতরে মিশে আছে সেই নোংরা স্বাধীনতা দিতে চাওয়া লোকটা।

দিবাকরের মা-বাবা-দিদি খুব করে অনুরোধ করেছিল শিউলিকে থেকে যাওয়ার জন্যে। শিউলি কারও কথা কানে নেয়নি। সব ক’টাকে ভণ্ড মনে হচ্ছিল। বাড়ি ফিরে দাদার সেই হারানো বাটখারা কপালে নিয়ে চলে গিয়েছিল মায়ের আড়ালে। মা বাড়ির সবাইকে জানায় ওর ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা। দাদারা ক’দিন খুব লাফালাফি করল। ঝগড়াঝাটি করে ফেরত আনল বিয়েতে দেওয়া খাট, আলমারি। গয়না, শাড়ি আগেই নিয়ে এসেছিল শিউলি। ধীরে ধীরে সে হয়ে গেল সংসারের গা-সওয়া দুশ্চিন্তা, পাড়ার বাসি খবর। বাঁশবেড়িয়ার যে জায়গাটায় শিউলিরা থাকে, সেখানে সতিন-দুঃখী পরিবার, কুমারী মা, যার সন্তান এখন কোথায়, তা নিয়ে নানা জল্পনা। পাড়ার মধ্যেই সংসার বদলে ফেলা বউ, এরকম অনেক খবরের ভিড়ে শিউলির ঘটনাটা লোকের প্রায় মনেই পড়ে না। তবু মা হামেশাই কানের কাছে গুনগুন করে যায়, আমি মরে গেলে তোকে এ বাড়িতে কেউ দেখবে না। যে যার নিজেরটা সামলাতে ব্যস্ত। বাড়িটা যেহেতু আমার নামে, তাই এখনও তোকে দেখছে।

শিউলি বলে, কথাগুলো আমায় বলছ কেন? দাদাদের বলো। আমাকে কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা ধরে আনতে বলছ?

মা দাদা-বউদিদের বলেছে। গুরুত্ব সহকারে সে কথা শুনে দেখছি, দেখব করে কিছুই করছে না তারা। দোষও দেওয়া যায় না, জড়িয়ে আছে সংসারের হাজারও ঝামেলায়। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, গান, আঁকা শেখা, আত্মীয় কুটুম্বিতা… শিউলি বাড়ি থাকাতে তাদের বরং সুবিধেই হয়েছে। ভাইপো ভাইঝিদের অনেককিছু দেখাশোনা করে সে। তারাও পিসির খুব নেওটা। শিউলি জানে, বড় হলে এরাই পিসিকে পুছবে না। বিনে পয়সার ঝিয়ের মতো সংসারের এক কোণে পড়ে থাকবে শিউলি।

দাদার উকিল বন্ধুর থেকে শিউলি জেনেছে, বিয়ের পর এক বছর না কাটলে ডিভোর্স চাওয়া যায় না। তাই এতদিন সে চুপচাপ ছিল। সরিয়ে রেখেছিল টিউশনি পড়ানোর বেশ কিছু টাকা। সেখান থেকে খরচ করে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়ে, ক্ষতিপূরণের এককালীন টাকা চেয়েছে। এর পরই যখন ভাবছিল নিজের বিয়ের জন্যে বিজ্ঞাপন দেবে কাগজে, নামমাত্র বিবাহ… তখনই সেনবউদি নতুন সম্বন্ধর কথা তুলল। সেনবউদির মেয়েকে পড়ায় শিউলি। বউদির পিসির ছেলের ডিভোর্স হয়ে গেছে। আবার বিয়ে খুব জরুরি। বাড়িতে বয়স্কা বিধবা মা। সরকারি চাকরি। আর কোনও ঝামেলা নেই। পাত্রী হিসেবে শিউলির কথা বলেছিল বউদি। দুর্ভাগ্যের ঘটনাও বলেছে। পিসি এবং তাঁর ছেলে রাজি। পাত্রী দেখতে চায়। বউদির মুখ থেকে কথাটা শোনার পর শিউলি মাথা নামিয়ে বলেছিল, দাদাকে বলুন আমার বড়দার সঙ্গে কথা বলতে।

বউদির হাজব্যান্ড দোকানে গিয়ে বড়দাকে বলেছেন পাত্রের কথা। দাদার কাছে এই প্রস্তাব, মেঘ না চাইতেই জল। পাত্রপক্ষ দেখে গেল শিউলিকে। পাত্রও এসেছিল। সব ঠিকঠাক। দিবাকর ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিলেই, দু’মাস পর শিউলির বিয়ে।

এবারও সীমা করে বসল আর এক মন্তব্য, এই লোকটার আগের বিয়ে কেন ভেঙেছে, খোঁজ নিয়েছিস?

না। সেনবউদি বলল, আগের বউটার মৃগী রোগ ছিল। রোগ লুকিয়ে বিয়ে দেয় মেয়ের বাড়ির লোক।

শিউলির কথা শুনে সীমা সন্তুষ্ট নয়। বলল, ভাল করে খোঁজখবর না নেওয়ার কারণে আগের বিয়েটায় ঠকেছিস। এবার সেই ভুলটা করিস না। দাদাদের দিয়ে খোঁজ নেওয়া, মেয়েটার সত্যিই মৃগী ছিল, নাকি শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে পালিয়েছে?

দাদারা কেমন খোঁজ নেবে শিউলি ভাল করেই জানে। নিজেদের কাজ থেকে ফুরসত পায় না। তা ছাড়া ফের একবার যখন চান্স পাওয়া গেছে, বোনকে ঘাড় থেকে নামানোর, পাত্রের কোনও কিছুই খারাপ লাগবে না। অগত্যা খবর যদি নিতেই হয়, যেতে হবে শিউলিকে। দ্বিতীয় বিয়ের জন্যে বাইরের লোক দিয়ে খবর আনানো খুব লজ্জার। শিউলির তো সীমার মতো ভাগ্য নয়, ওর বাড়ির অবস্থা বেশ ভাল। মা-বাবার একমাত্র সন্তান। কোনও পাত্রকেই পছন্দ হয় না। ঠিক করেছে বিয়েই করবে না। সময় কাটানোর জন্যে ছোটখাটো চাকরি নিয়েছে।

শিউলির এখনকার পাত্রের নাম শিশির মিত্র। দিবাকরের থেকে পাঁচ বছরের বড়। মাথায় চুল কম, গায়ের রং মাজা। ফোনে মাঝে মাঝে কথা হয়। রাতের দিকে বাড়িতে ফোন

করেন শিশির। পছন্দ, অপছন্দ জানতে চান। এ ছাড়াও কিছু এলোমেলো কথা হয়। সেইসব কথার ফাঁকে দু’দিন আগে শিউলি জানতে চেয়েছিল, শিশিরবাবুর আগের শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা। উনি বললেন, খোঁজ নেবে তো তোমার বাড়ির লোক? নেওয়াই স্বাভাবিক। পাত্রীর বাবার নাম ঠিকানা দিলেন, বাগমারি, রোড, মানিকতলা। শ্রীহরি বস্ত্রালয়ের পিছনের বাড়ি। শিউলি সীমাকে বলেছিল, যাবি আমার সঙ্গে?

রাজি হল না সীমা। বলল, বিয়ে ব্যাপারটা আমার কাছে দু’চক্ষের বিষ। বিয়ে করে ক’টা লোক সুখে আছে বলতে পারিস? বছর ঘুরতে না ঘুরতে মিঞা-বিবি এদিক ওদিক ছুকছুক করতে শুরু করে। কাচ্চাবাচ্চার কারণে একসঙ্গে থাকতে বাধ্য হয়। যত সব লোকদেখানি। বাচ্চারা বড় হয়ে প্রথমে বাবা-মাকেই দূর করে দেয়। ঢের দেখলাম। বিয়ে ফিয়ে ছাড়। একটা চাকরির চেষ্টা কর।

নিজেরটা চালাবার মতো চাকরি সহজে পাবে না শিউলি। সরকারি চাকরি পাওয়ার মতো ভাল স্টুডেন্ট সে নয়। কম্পিউটার ট্রেনিং নেই, প্রাইভেট কোম্পানিতে পাত্তা পাবে না। তা ছাড়া সংসার করার শখ তার পুতুল খেলার বয়েস থেকে। বড় হয়ে পুতুলদের মতোই নাইয়েছে, খাইয়েছে দাদাদের ছেলেমেয়েদের। এইভাবেই মনের মধ্যে লালিত হয়েছে তীব্র সন্তানাকাঙ্ক্ষা। বাচ্চাদের হইচই, সারল্যের মধ্যে জীবনের সম্পূর্ণতার স্বাদ পায় শিউলি। একা একা মানুষ হয়েছে বলে সীমা এটা ঠিক বোঝে না। সীমা রাজি হল না দেখে, শিউলি আজ বেরিয়ে পড়েছে শিশিরবাবুর আগের বিয়ের সুলুকসন্ধান নিতে। ঠিক করেছে, ও-বাড়িতে গিয়ে বলবে, আমি পাত্রীর মাসতুতো দিদি। বিয়ে থা-র ব্যাপার, বুঝতেই তো পারছেন, একটু খোঁজখবর না নিলে… মানিকতলা, মানিকতলা মোড় কন্ডাক্টরের হাঁকডাকে সংবিৎ ফিরল শিউলির। তাড়াতাড়ি নেমে আসে বাস থেকে। টিকিট বাসে উঠেই কেটে নিয়েছিল। কলকাতার এ দিকটায় সে আগে কখনও আসেনি। বাড়িটা খুঁজতে হবে। খুব বেশি ঘোরাঘুরি করতে হল না। বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকাতেই চোখে পড়ল শ্রীহরি বস্ত্রালয়। যার পিছনের বাড়ির দরজায় শিউলি এখন দাঁড়িয়ে। ডোরবেল টিপছে। ভিতর থেকে নারীকণ্ঠে কে? ডাক ভেসে এল। বন্ধ দরজার এপার থেকে পরিচয় বোঝাতে পারবে না বলে, শিউলি কোনও উত্তর দেয়নি। আবার ভীষণ ভারী হয়ে উঠেছে কপালটা। তার এক বছরের পুরনো রোগ। দাদার দোকানের হারিয়ে যাওয়া সেই বাটখারা দুটোর ওজন হঠাৎ যেন বেড়ে গেছে। খুলে গেল দরজা। শিউলির কাছাকাছি বয়সি একটা মেয়ে। এই কি সেই পাত্রী? চেহারায় বেশ একলা লাবণ্য আছে। শিউলি বলে, অমরেশবাবু বাড়ি আছেন?

বাবা তো এখন অফিসে। আপনি? স্বাভাবিক কৌতূহলে জানতে চায় মেয়েটি।

শিউলি বলে, আপনার মা আছেন নিশ্চয়ই। ওঁর সঙ্গে কথা বললেও আমার চলবে। দেবারতি ভাল করে একবার শিউলির হাত, কাঁধ দেখে নেয়। বুঝে নিতে চাইছে, কোনও সেলস গার্ল কি না। নিশ্চিন্ত হয়ে বলে, আপনি ভিতরে এসে বসুন।

মেয়েটির নাম শিশিরবাবুর থেকে জেনেছে শিউলি। ফোনে গল্প করতে করতে একদিন মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন। দেবারতির চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই, কোনও রোগ আছে। যেমন দিবাকরকে দেখেও মনে হত না।

আড়ম্বরহীন গোছানো বসার ঘর। সোফায় শিউলিকে বসতে বলে, মুখোমুখি বসল দেবারতি। বলল, মাকে যা বলার, আমাকে বলতে পারেন। খেয়েদেয়ে মা একটু শুয়েছে। বড় করে একটা ঢোঁক গিলল শিউলি। মেয়েটির সামনেই কি ওর ভাঙা বিয়ের আলোচনা করাটা ঠিক হবে? কিন্তু এতদূর উজিয়ে এসে পিছিয়ে যাওয়ারও কোনও মানে হয় না। সামান্য দ্বিধাগ্রস্তভাবে শিউলি বলতে শুরু করে, আমি আসলে এসেছি আমার ভাগনির সম্বন্ধর ব্যাপারে। মানে শিশির মিত্র…

আর বলতে হল না। কথা কেড়ে নিল দেবারতি। বলল, বুঝেছি। ওরা আবার বিয়ের ঠিক করছে।

অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে শিউলি। দেবারতি বলে, ভালই করেছে। আমিই শিশিরকে বলেছিলাম বিয়েটা করে নিতে। ওর মা খুবই অসুস্থ। রান্নাটুকুও করতে পারেন না। অন্য কাজের কথা তো ছেড়েই দিলাম। সংসারের সব কাজ কি কাজের লোক দিয়ে হয়! কিন্তু আপনি, মানে আপনি চলে এলেন কেন?

উপায় ছিল না। রোগটা ওষুধে চাপা দিয়ে বিয়েটা দিয়েছিল বাবা। ও বাড়ি গিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু হল, ঘনঘন ফিট হতে লাগলাম। কোথায় অসুস্থ শাশুড়িকে আমার দেখার কথা, উনিই আমার সেবা করতে লাগলেন। একদিন তো আনাজ কাটতে গিয়ে পড়ছিলাম বঁটিতে হুমড়ি খেয়ে। শাশুড়ি ঠিক সময় ধরে না নিলে, কী যে কাণ্ড হত…। আর একদিন রান্না করতে গিয়ে কাপড়ে আগুন লাগিয়ে বসলাম। সেদিন বাঁচাল শিশির। খুব ভেঙে পড়েছিল তারপর। বলত, কোনওদিন এমন অঘটন ঘটবে, হাজতবাস হবে আমার। লোকে বলবে, আমিই বউকে মেরেছি। কে দেখবে তখন আমার বুড়ি মাকে? আমি বুঝলাম ওর সমস্যাটা, ওকে ঠকানো ঠিক হয়নি। ও বাড়িতে একটা সুস্থ সবল বউ দরকার। আমি না চলে এলে, ও বিয়ে করতে পারবে না। তাই ফিরে এলাম।

কথা শেষ করে বড় করে শ্বাস ছাড়ল দেবারতি। তারপর জানতে চাইল, আপনি চা খাবেন? জল বসাই?

মাথা দু’পাশে নেড়ে না বলে শিউলি। মেয়েটা যা বলছে, সব কি সত্যি? আর একটা মেয়েকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে না তো?… ভাবনার মাঝে দেবারতি বলে ওঠে, আপনারা নির্দ্বিধায় ও বাড়িতে মেয়ে দিতে পারেন। শিশিরের মা খুব ভাল। শিশিরের মতো সজ্জন লোক হয় না। শুধু ওদের বাড়িটা একটু পুরনো। বাইরের কলতলায় শ্যাওলা জমে। অসাবধান হলেই পিছলে যাওয়ার চান্স আছে। ভাগনিকে বলবেন শ্যাওলাটা মাঝেমধ্যে ঘষে নিতে। আমার দু’-চারটে শাড়ি ও বাড়িতে পড়ে আছে, ফেরত পাঠাতে হবে না। প্লাস্টিকের মগ, বালতি কিছু যেন কেনে, লোকটা ঠকায় না। আর একটা রিকোয়েস্ট আছে আমার।

শিউলি জানতে চায়, কী?

দেবারতি বলে, ওদের বাড়ির বাগানে দুটো গাছ লাগিয়েছিলাম। আমি আর শিশির কিনে এনেছিলাম মৌলালির রথের মেলা থেকে। কামিনী আর স্থলপদ্ম। বাবা ক’দিন আগে দূর থেকে দেখে এসেছে। খুব ফুল হয়েছে কামিনী গাছটায়। আমিই ঠেলে পাঠিয়েছিলাম

বাবাকে। আপনার ভাগনিকে বলবেন, আমার স্মৃতি মুছতে গিয়ে গাছ দুটো যেন কেটে না ফেলে। কামিনী গাছটা কাটার কথা উঠলে, শাশুড়ি খুশিই হবেন। উনি বলতেন, ও-গাছ থাকলে নাকি সাপ আসে। যতসব কুসংস্কার।

সোফা ছেড়ে উঠে পড়েছে শিউলি। কথা থামিয়ে দেবারতি বলে ওঠে, সে কী, উঠে পড়লেন! আর একটু বসলে হত না?

না, ভাই। তোমাদের এদিকে অন্য একটা কাজ আছে। পরে একদিন আসব। বলে, দেবারতিদের ঘর ছেড়ে তড়িঘড়ি পায়ে বেরিয়ে আসে শিউলি। রাস্তায় এসে দেখে ফের আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে। কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার, শিউলির মাথাভার পুরোপুরি উধাও! রোগটা যেন কোনওদিন ছিলই না। হালকা পায়ে হাঁটতে থাকে শিউলি। রাস্তার দু’পাশে চোখ বোলায়। টেলিফোন বুথ খোঁজে।

পাওয়া গেল একটা। বুথে ঢুকে শিউলি এক বছরের পুরনো একটা নাম্বার ডায়াল করে। ও প্রান্তের ‘হ্যালো’ শুনে সে বলে, টিফিন খাওয়া হয়েছে?

কে? শিউলি! অপর প্রান্তের কণ্ঠে বিস্ময়।

গলাটা মনে আছে তা হলে! বলে শিউলি। খানিকটা অপ্রস্তুত এবং অপরাধী কণ্ঠে দিবাকর বলে, তোমার নোটিশ পেয়েছি। কাজের এত চাপ বেড়েছে, সই করে পাঠানো হয়ে উঠছে না। কাল-পরশুই পাঠিয়ে দেব। সেটেলমেন্ট ফর পার্মানেন্ট মেন্টেন্যান্সের চেকটাও দিয়ে দেব ওরই সঙ্গে।

ওসব এখন থাক। এখনও নিশ্চয়ই খাওনি, সেই আগের মতো।

দিবাকর বোধহয় ঢোঁক গিলল। বলল, এখন তো আর টিফিন আনি না। দেখি, বাইরে থেকে কিছু একটা আনিয়ে নেব এখন।

খেয়ে নাও। পরে আবার কথা বলব। বলে ফোন কেটে দেয় শিউলি। সে জানে, তার এই কণ্ঠস্বর কামিনী ফুলের গন্ধ হয়ে ছড়িয়ে পড়বে দিবাকরের কেবিনে। দেবারতির শ্বশুরবাড়িতে শিউলি সাপ হয়ে ঢুকবে না। তারা দুই বউ হয়তো বাঁধা গতের সংসার করতে পারল না। দুঃখ কষ্টের নিজস্ব যে একটা সংসার আছে। দু’জনে না হয় সেখানকার বাসিন্দা হয়েই থাকবে।

সানন্দা পুষ্পাঞ্জলি ২০০৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *