মায়াবন্দরের ঐরাবত
সমুদ্রের বুকে একটা দ্বীপ৷ সেই দ্বীপে নিবিড় বন-জঙ্গল, একটাও মানুষ নেই সেখানে৷ জঙ্গলের কিনারায়, বেলাভূমিতে সোনালিরুপোলি বালি, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় শিং-ওয়ালা দুটি হরিণ, আর একটা বাচ্চা হরিণ তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছে৷
এরকম একটা দৃশ্য নিজের চোখে দেখলেও যেন বিশ্বাস হয় না৷ আমাদের দেশে সত্যিই কি কোথাও এমন জায়গা আছে? এ যেন অতীত কালের কোনো ছবি, কিংবা স্বপ্নের মতন৷
কিন্তু পোর্টব্লেয়ার থেকে রঙ্গত যাবার সময় আমি সত্যিই এরকম একটা দ্বীপ দেখেছিলুম৷
আমরা যাচ্ছিলুম একটা মোটর লঞ্চে৷ এটা সাধারণ যাত্রীবাহী লঞ্চ নয়৷ এই লঞ্চ থেকে ডুবুরি নামিয়ে সমুদ্রের ঝিনুক তোলা হয়৷ সমুদ্রের ঝিনুক তোলার কথা শুনলেই মুক্তোর কথা মনে পড়ে৷ এখানকার সামুদ্রিক ঝিনুকে অবশ্য মুক্তো পাওয়া যায় না৷ পাওয়া গেলেও কদাচিৎ একটা-দুটো৷ তবে এখানকার ঝিনুকে মাদার অফ পার্ল নামে আরেকরকম দামি জিনিস পাওয়া যায়, যা দিয়ে গলার হারের লকেট হয়, আরও অনেক কাজে লাগে৷
এই লঞ্চের মালিকের নাম শচীন কুণ্ডু৷ তিনি আমার এক বন্ধুর কাকা হন৷ আসবার সময় আমার সেই বন্ধুর কাছ থেকে একটা চিঠি এনেছিলুম, সেই জন্য এখানে খুব খাতির-যত্ন পাচ্ছি৷ শচীনবাবুর দুই ছেলে, বাদল আর শংকর, এর মধ্যে শংকর প্রায় আমারই সমবয়েসি৷
এখন অবশ্য আমরা ঝিনুক তুলতে যাচ্ছি না৷ যাচ্ছি রঙ্গত নামে আর একটা দ্বীপে নেমন্তন্ন খেতে৷
এখানকার সমুদ্রের জল একেবারে ঘন নীল রঙের৷ এমনই নীল যে মনে হয় কলম ডোবালেই এই জল দিয়ে লেখা যায়৷ মাঝে মাঝেই ছোট ছোট দ্বীপ দেখা যাচ্ছে! অনেক দ্বীপেরই কোনো নাম নেই৷ মানুষ-জন বা পশুও নেই, শুধু আছে গাছ আর পাথর৷ সেই সব নির্জন দ্বীপের দৃশ্য বড় সুন্দর৷
হঠাৎ সেই একটা দ্বীপের প্রান্তে তিনটি হরিণ দেখে আমি আনন্দে বিস্ময়ে একেবারে লাফিয়ে উঠলুম৷ কী অপূর্ব একখানা ছবি!
বড় হরিণ দুটো লঞ্চের আওয়াজ পেয়েই আমাদের দিকে তাকিয়েছিল৷ সরল কৌতূহল মাখানো তাদের কাজল-টানা চোখ৷ প্রায় এক-দেড় মিনিট তারা স্থির ভাবে তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ পেছন ফিরে দুটি লাফ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের নিমেষে৷ বাচ্চা হরিণটা একটু ভাবাচ্যাকা খেয়ে একবার ডানদিকে, একবার বাঁদিকে ছুটে তারপর সে-ও মিলিয়ে গেল বনে৷
আমার সঙ্গে ক্যামেরা নেই৷ কিন্তু বাদলের কাঁধে ক্যামেরা ঝুলছে, তাও সে এমন মুগ্ধ হয়ে হরিণগুলোকে দেখছিল যে ছবি তোলার কথা ভুলেই গেছে৷ শংকর চেঁচিয়ে বলল, ক্যামেরা, ক্যামেরাটা আমায় দে৷? কিন্তু ততক্ষণে হরিণগুলো মিলিয়ে গেছে৷
আমি জিজ্ঞেস করলুম, শংকর, এই দ্বীপটার নাম কী? এখানে নামা যায় না?
শংকর ম্যাপ বার করে দেখল এখানে দ্বীপের সংখ্যা দুশোর বেশি৷ অধিকাংশ দ্বীপেরই নাম দেওয়া হয়নি, শুধু ম্যাপে নম্বর লেখা আছে৷ শংকর এই দ্বীপটা খুঁজে বার করে বলল, এটা বেশি বড় নয়৷ মিডল আন্দামান থেকে অনেকটা দূরে আছে, হ্যাঁ, এখানে নামা যেতে পারে৷
মিডল আন্দামানেই জঙ্গলের মধ্যে জারোয়া নামে আদিবাসীরা থাকে, সেখানে ভয়ের ব্যাপার আছে৷ এ ছাড়া আন্দামানের আর কোথাও কোনো ভয় নেই৷ এক একটা দ্বীপে এত ঘন জঙ্গল, কিন্তু তার মধ্যে বাঘ-ভালুকের মতো কোনো হিংস্র প্রাণী নেই, বিষাক্ত সাপও নেই৷ এখানকার জঙ্গলে আছে শুধু হরিণ আর ছোট ছোট শুয়োর৷
আমরা তো আর শিকার করতে আসিনি, তাই আমাদের সঙ্গে বন্দুক-পিস্তল কিছু নেই৷ বাদল আর শংকর দু’জনেই বলল, বন্দুক-টন্দুক ছাড়াই এই জঙ্গল নির্ভয়ে ঘোরা যায়৷ ওরা আগে অনেকবার নেমেছে৷
শংকরই উৎসাহ করে বলল, চল না যদি হরিণের ছবি তোলা যায়! দ্বীপটা তো ছোট, হাতের কাছে একটা বাচ্চা হরিণ পেলে তাকে ধরে নিয়ে আসব৷
লঞ্চের সারেং-ও বললেন, হ্যাঁ, যান না, ঘুরে আসুন৷ বেলা তো বেশি হয়নি৷
শংকর, বাদল আর আমি লঞ্চ থেকে নেমে বালির ওপরে দাঁড়িয়ে আগে জঙ্গলটাকে ভালো করে দেখলুম, প্রথমে বড় বড় ঝোপের মতন গাছ, এগুলোর নাম ম্যানগ্রোভ৷ তারপরেই বিরাট বিরাট গাছের সারি৷ এগুলোর নাম জানি না৷ বনের ভেতরটা যেন কালো হয়ে আছে৷
বালির ওপর ছড়িয়ে আছে নানা রকমের ঝিনুক৷ শংকর আর বাদলের নজর সেই দিকে৷ ওরা ঝিনুকগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে দেখতে লাগল, কয়েকটা পকেটেও ভরে নিল৷ আমার আগ্রহ হরিণ সম্পর্কেই বেশি৷
আস্তে আস্তে আমরা জঙ্গলের মধ্যে এগোলুম৷ কাদা-টাদা নেই, বেশ পরিষ্কার পাথুরে মাটি৷ দু’হাত দিয়ে গাছের ডাল সরিয়ে সরিয়ে যেতে যেতে মনে হল, আমরাই যেন এই দ্বীপের অভিযাত্রী৷
খানিকটা ভেতরে যাবার পর জঙ্গলটা বেশ অন্ধকার হয়ে গেল৷ অথচ আজ একটা রোদ ঝকঝকে দিন৷ এই সব অঞ্চলে প্রায় রোজই বৃষ্টি হয়, কিন্তু আজ আকাশে মেঘ নেই৷ কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে সেই রোদ ঢোকার রাস্তাই পায় না৷ এক একটা জায়গায় সরু করে রোদ পড়েছে, সেই জায়গাগুলোয় যেন আলো-ছায়ায় চৌখুপি কাটা হয়েছে৷
শংকর বলল, এই রকম আলোতে তো ছবি তোলা যাবে না৷ আমার ক্যামেরায় ফ্ল্যাশও নেই৷
বাদল বলল, কিসের ছবি তুলবি? হরিণ যদি আমাদের তিন হাত দূরেও দাঁড়িয়ে থাকে তাও তো দেখতে পাবো না!
আরও খানিকটা যাবার পর লক্ষ করলুম, অনেকগুলো গাছের ডাল ভাঙা৷ দু’একটা বেশ বড় গাছ উপড়ে পড়ে গেছে মাটিতে৷ কোনো কোনো গাছ দেখলে মনে হয়, কেউ যেন তাদের মাঝখানটা মুচড়ে ভেঙে দিয়েছে৷
আমি জিজ্ঞেস করলুম, এখানে এরকম ভাবে গাছ কে ভাঙল?
শংকর বলল, এ নিশ্চয় ঘূর্ণিঝড়ের কাণ্ড৷ এখানকার ঘূর্ণিঝড় তো দেখোনি, মানুষ পর্যন্ত উড়িয়ে নেয়৷
প্রায় আধঘণ্টা ঘোরাঘুরি করেও আমরা কোনো হরিণের সন্ধান পেলুম না৷ ওদের যে আর দেখতে পাবার কোনো আশা নেই, তাও বুঝে গেছি৷
জঙ্গলের মধ্যে হাওয়ার একটা শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছিল সব সময়৷ কিন্তু সেই শব্দ ছাড়িয়েও আরও একটা কিসের—শব্দ পাচ্ছি৷ গাছের ডাল মড় মড় করে ভেঙে যাচ্ছে দূরে কোথাও৷ কিন্তু এখন তো ঘূর্ণিঝড় নেই৷
একটা জায়গায় ত্যারছা ভাবে রোদ পড়েছে, সেইখানে দাঁড়িয়ে আমরা চারিদিকটা দেখতে লাগলুম৷
হঠাৎ বাদল বলল, ওটা কী দুলছে?
আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেদিকে ফিরে তাকালুম৷ সত্যিই যেন একটা বড় গাছের ডালের নীচ থেকে কী যেন একটা জিনিস দুলছে, অজগর সাপের মতন মোটা৷ কিন্তু ওটা কি সাপ? ওর মাথা কই?
তারপর দেখলুম, সেই গাছের ডাল থেকে দুটো সাদা মতন ডান্ডা বেরিয়ে এসেছে৷ ও দুটো কী? ওরকম কি গাছের ডাল হয়? তারপর শুনতে পেলুম দুটো বিকট ফোঁস ফোঁস আওয়াজ৷
শংকর চেঁচিয়ে উঠল, হাতি!
আমরা এমনই বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলুম প্রথমটায় নড়তেই পারিনি৷ সত্যিই, আমাদের থেকে বারো হাত দূরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল দাঁতাল হাতি৷ হাতিটা তাকিয়ে আছে আমাদেরই দিকে৷
তারপরই আমরা দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটলুম৷ খানিকটা গিয়েই আছাড় খেলুম একবার৷ আবার উঠেই দৌড়, শংকর আর বাদল যে কোন দিকে ছড়িয়ে পড়ল কে জানে! খালি মনে হচ্ছে, এই বুঝি হাতিটা পেছন থেকে শুঁড় দিয়ে আমায় তুলে নেবে৷
একসময় গাছের ফাঁক দিয়ে দূরে সমুদ্র দেখতে পেয়ে প্রাণে যেন নতুন আশা এল৷ প্রচণ্ড জোরে ছুটে বালির ওপর গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লুম৷ আমাদের লঞ্চটা সেখান থেকে একটু দূরে৷ আমি দেখলুম বাদল আর শংকরও আর এক দিক থেকে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল৷
আমি উঠে দাঁড়িয়ে একবার পেছন ফিরে তাকালুম৷ হাতিটা কিন্তু আমাদের তাড়া করে আসেনি৷ তাড়া করলে সে অনায়াসে আমাদের তিনজনের একজনকে ধরে ফেলতে পারত৷
লঞ্চে উঠে আমরা তিনজনে একসঙ্গে বলে উঠলুম, শিগগির চালান৷
সারেং অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?
আমরা বললুম, হাতি! মস্ত বড় হাতি!
সারেং হা-হা করে হেসে উঠে বললেন, হাতি? এইটুকু একটা দ্বীপে হাতি? আপনাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
লঞ্চের একজন খালাসি দাঁড়িয়েছিল সারেং-এর পাশে৷ সে বললে, হতে পারে, স্যার! তাহলে নিশ্চয়ই রায়বাবুদের হাতি!
খালাসিটা বেশ বুড়ো৷ সে এখানকার পুরোনো লোক৷ আমরা সবাই মিলে তার দিকে তাকাতেই সে বলল, লঞ্চ স্টার্ট দিন, স্যার৷ তারপর আমি বলছি সব৷
সারেং লঞ্চটাকে পার থেকে একটু সরিয়ে এনে বললেন, হাতি থাকলেও এখানে আর ভয়ের কী আছে? হাতি তো আর সাঁতরে এসে আমাদের অ্যাটাক করবে না৷ রায়বাবুদের হাতিটা কী ব্যাপার, শুনি?
খালাসি যা বলল, তা অবশ্য বেশ বিশ্বাসযোগ্য৷ এরকম একটা ঘটনা শংকর আর বাদলও শুনেছে আগে৷ শুধু হাতির ব্যাপারটা জানত না৷
একসময় বার্মা থেকে একটি ব্যবসায়ী এই আন্দামানে এসে বিরাট ভাবে কাঠের ব্যবসা শুরু করেন৷ অনেকগুলো দ্বীপে তাঁরা কুঠি-বাড়ি বানিয়ে ছিলেন, মায়াবন্দর নামে নিজস্ব একটা বন্দরও তৈরি করেছিলেন৷ আর জঙ্গলের কাঠ বয়ে আনবার সুবিধের জন্য তাঁরা পশ্চিমবাংলা থেকে নিয়ে এসেছিলেন তিরিশ- চল্লিশটা হাতি৷ জলপাইগুড়ি আর কুচবিহারের জঙ্গল থেকে ধরে সেই হাতিগুলোকে জাহাজে করে আনা হয়েছিল আন্দামানে৷ তার আগে এখানকার লোক কখনো হাতি দেখেইনি৷
কয়েক বছর বাদে রায়বাবুদের ব্যবসার খুব ক্ষতি হতে শুরু করে৷ ওঁদের পরিবারে কে যেন মারা যায় হঠাৎ৷ সেই জন্য ওঁরা দুম করে একদিন সব ব্যবসা তুলে দিলেন একেবারে৷ জিনিসপত্র, বাড়ি-টাড়ি সব বিক্রি হয়ে গেল৷ কিন্তু অতগুলো হাতি কে কিনবে? হাতিগুলোকে জাহাজে করে পশ্চিমবাংলায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতেও অনেক খরচ৷ অন্য কাঠের ব্যবসায়ীরা কয়েকটা করে হাতি কিনে নিল প্রায় জলের দামে, তারপরেও যে কয়েকটা হাতি বাকি ছিল, রায়বাবুরা সেগুলোকে ছেড়ে দিলেন জঙ্গলে৷
পোষা হাতি আবার জংলি হাতি হয়ে গেল!
এ সব বেশ কিছুদিন আগের কথা৷ কিন্তু হাতিরা অনেকদিন বাঁচে৷ সেই কয়েকটা হাতি এখনো রয়ে গেছে এখানকার জঙ্গলে৷ মাঝে মাঝে তারা সাঁতার কেটে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে চলে যায়৷
আমি জিজ্ঞেস করলুম, হাতিরা সাঁতার জানে?
বাদল বলল, মানুষ ছাড়া সব জন্তুই তো জন্ম থেকে সাঁতার জানে৷ কিন্তু এখানকার সমুদ্রে বড় বড় হাঙর আছে অনেক, মাঝে মাঝে তিমি চলে আসে, কুমিরও দেখেছে কেউ কেউ৷
হাতির সঙ্গে হাঙরের কিংবা তিমির লড়াইটা কী রকম হবে, আমি তা কল্পনা করবার চেষ্টা করলুম৷
খালাসিটা হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল, ওই দেখুন!
মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখলুম, সেই দ্বীপটির বেলাভূমিতে এসে দাঁড়িয়েছে হাতিটা৷ এত বড় দাঁতাল হাতি আমি আগে দেখিনি৷ কান দুটো কুলোর মতন, আর দাঁত দুটো পাঞ্জাবি মুলোর চেয়েও অনেক বড়৷ হাতিটা শুঁড় তুলে মাথা উঁচু করে আমাদের দেখছে৷
শংকর ক্যামেরা বাগিয়ে খচ খচ করে ছবি তুলতে লাগল৷ সারেং বললেন, লঞ্চটা আরও কাছে নিয়ে যাব? খালাসি বলল, না, স্যার৷ অত ঝুঁকি নেবার দরকার নেই৷ একলা হাতি সাধারণত ক্ষ্যাপা হয়৷ যদি জলে নেমে আসে?
হাতিটা দু’বার ডেকে উঠল খুব জোরে৷ তার শরীরটা দুলছে৷ যেন এক্ষুনি জলে নামবে!
বেশিক্ষণ হাতিটাকে দেখা গেল না, তখনই ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নেমে গেল৷ আমরা লঞ্চটা নিয়ে দ্বীপের চারপাশে ঘুরে এলুম একবার৷ কিন্তু হাতিটা আবার জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে৷
শংকর বলল, বাবাঃ, অতবড় হাতি, আমাদের একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, ওর পায়ের ধাক্কা খেলেই আমরা চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যেতুম৷
বাদল বলল, হাতিটা এখনো পোষা না জংলি, কে জানে!
সারেং সাহেব বললেন, এতকাল জঙ্গলে আছে, জংলিই হয়ে গেছে আবার৷ আপনারা খুব জোর বেঁচে গেছেন৷
আর দেরি করা যায় না, আমরা চলে গেলুম রঙ্গতে৷ সেখানকার একজন ইঞ্জিনিয়ারের বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন, ভদ্রালোকের নাম সুখেন্দু চক্রবর্তী৷ তাঁকে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা বললুম৷
তিনি বললেন, ওরকম বুনো হাতি তো রয়েছেই কয়েকটা৷ এই রঙ্গতেই মাসকয়েক আগে কী কাণ্ড হয়েছিল৷ এখানে এক ভদ্রলোক রাত্তিরবেলা ঘুমিয়ে ছিলেন, মাঝরাত্তিরে তাঁর বাড়ি ভেঙে একটা বিরাট দাঁতাল হাতি ঢুকে পড়ল! ভদ্রলোক ঘুম ভেঙে দেখেন, তাঁর সামনে একটা ঐরাবত দাঁড়িয়ে! ভাবুন তো কাণ্ডটা! ভয়েই তো ভদ্রলোক অজ্ঞান৷ হাতিটা কিন্তু বাড়ির কোনো লোকের ক্ষতি করেনি৷ ভুল করে বোধহয় বাড়ি ভেঙে ঢুকে পড়েছিল৷
শংকর বলল, কী ডেঞ্জারাস ব্যাপার! বাড়ি ভেঙে হাতি ঢুকে পড়ে?
সুখেন্দুবাবু বললেন, রঙ্গত একটা ছোট্ট শহর, দু’পা গেলেই তো ঘন জঙ্গল৷ আন্দামানে তো শিকার করা নিষেধ, কেউ তাই বুনো হাতি দেখলে গুলি করে মারতে পারে না, আগুন-টাগুন জ্বেলে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়৷
রঙ্গত থেকে আমরা চলে এলুম মায়াবন্দরে৷ এই জায়গাটা খুব সুন্দর৷ এইখানেই রায়বাবুদের ব্যবসার মূল কেন্দ্র ছিল৷ এখনো অনেক ভাঙা বাড়ি পড়ে আছে৷
সমুদ্রের ধারেই একটা চমৎকার সরকারি বাংলো৷ আমরা সেখানে রাতটা কাটিয়ে দেব ঠিক করলুম৷
বাংলোর চৌকিদার বেশ বুড়ো৷ সে পুরোনো কালের অনেক গল্প জানে৷ সাহেবদের আমলে সে ছিল পোর্টব্লেয়ারে৷ তারপর রায়বাবুদের কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে সে এই মায়াবন্দরে চলে আসে৷ কথায় কথায় সে বলল, এখান থেকেই হাতিগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ কাছেই যে জঙ্গল, সেখানে কয়েকটা হাতিকে রেখে দিয়ে আসা হয়েছিল৷ তার মধ্যে একটা বাচ্চা হাতি ছিল, তার তখন সবে মাত্র ছোট ছোট দাঁত বেরিয়েছে৷ সেই বাচ্চা হাতিটা প্রায়ই জঙ্গল ছেড়ে চলে আসত এই মায়াবন্দরে৷ এমনভাবে ডাকত, ঠিক যেন মনে হত কাঁদছে৷
শংকর বলল, তাহলে সেই বাচ্চা হাতিটাই এখন ওই মস্ত বড় দাঁতাল হাতি হয়েছে৷
বুড়ো চৌকিদার বলল, বাচ্চা হাতিটা এসে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়তে চাইত বলে একবার জ্বলন্ত মশাল দিয়ে তার কপালে খুব জোরে মেরে ছিল কয়েকজন লোক৷ তারপর থেকে হাতিটা আর এখানে আসেনি৷
কথাগুলো শুনে আমার একটু কষ্ট হল৷ আহারে, একটা বাচ্চা হাতি, মানুষের কাছাকাছি থাকতে চায় বলে বারবার ফিরে আসত, আর তাকে অমন নিষ্ঠুর ভাবে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে! ওই যে দ্বীপে বিশাল হাতিটা আমাদের দিকে চেয়ে দু’বার ডেকে উঠেছিল, ও কি কিছু বলতে চেয়েছিল? হাতিদেরও তো নিজস্ব ভাষা আছে৷ ও বোধহয় বলতে চেয়েছিল, তোমরা আমাকে নিয়ে যাও! আমাকে সঙ্গে নিয়ে চল!
সেদিন আমরা ঘুমোতে গেলুম অনেক রাত্রে! ভোর হবার আগেই ঘুম ভেঙে গেল৷ দূরে কারা যেন চ্যাঁচামেচি করছে৷ আমরা তিনজনে বারান্দায় ছুটে এসে ডাকলুম, চৌকিদার, চৌকিদার৷
চৌকিদার জেগে উঠেছে অনেক আগেই৷ সে গেটের কাছে হাতে একটা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমাদের ডাক শুনে কাছে এসে বলল, হল্লা শুনে ঘুম ভেঙে গেছে, বাবু! প্রথমে আমি ভাবলুম, ধানক্ষেতে হরিণের পাল এসেছে বুঝি৷ এরকম মাঝে মাঝে আসে, তখন চাষিরা হরিণ মারতে যায়৷ তারপর এগিয়ে শুনলুম, আজ আবার একটা হাতি এসেছে৷ মস্ত বড় হাতি৷ লোকজন মশাল নিয়ে তাড়া করে গেছে৷
শংকর বললে, চল আমরা দেখে আসি৷
কোনোরকমে গায়ে একটা জামা গলিয়ে ছুটলুম আমরা তিনজনে৷ কিন্তু বেশি দূর যাওয়া হল না, দেখলুম যে লোকজন ফিরে আসছে৷ তাদের মুখে শুনলুম, হাতিটা প্রকাণ্ড বড় ছিল, কিন্তু নিরীহ৷ যদি তেড়ে আসত তাহলে দশ-বারোজন মানুষকে মেরে ফেলতে পারত অনায়াসে৷ কিন্তু তা করেনি৷ মশাল নিয়ে ভয় দেখাতেই পালিয়ে গেছে৷ কোথায় যে পালাল, বোঝা গেল না৷ কেউ বলল জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে, কেউ বলল সমুদ্রের জলে নেমে গেছে৷
দুপুরে যে দ্বীপটায় আমরা দাঁতাল হাতিটাকে দেখেছিলুম, সেই দ্বীপটা এখান থেকে অনেক দূরে৷ তবু যেন আমার মনে হল, অতখানি সমুদ্র পেরিয়ে সেই হাতিটাই চলে এসেছিল এখানে৷ ও নিশ্চয়ই একলা একলা জঙ্গলে থাকতে চায় না৷ ও মানুষ ভালোবাসে৷ কিন্তু মানুষেরা ওকে চায় না!
—