মায়াবনবিহারিণী হরিণী

মায়াবনবিহারিণী হরিণী

প্রেমে পড়লেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।

তাঁর প্রথম প্রেম।

আইনস্টাইনের বয়েস সবে ষোলো। তিনি সুইত্জারল্যান্ডে।

তাঁর প্রথম প্রেমিকা বয়েসে দু’ বছরের বড়।

নাম মেরি। মেরি উইনটেলার।

ক’জন জানি আমরা আইনস্টাইনের প্রথম প্রেমের গল্প? এই গল্পের নায়ক এক সম্পূর্ণ অপরিচিত আইনস্টাইন। আসুন সেই গল্পের মধ্যে।

১৮৯৫ সালের ২৬ অক্টোবর।

ষোলো বছরের অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হিসেবে ভরতি হলেন আরাউ অঞ্চলের একটি স্কুলের টেকনিকাল বিভাগে। জুরিখের পলিটেকনিকে ভরতি হতে এই পড়াশোনার দরকার। জুরিখের পশ্চিমে— বিশ মাইল দূরে আরাউ। আরও একবার বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন আইনস্টাইন।

কিন্তু বাড়ি থেকে দূরে এক বাড়ি খুঁজে পেলেন তিনি উইনটেলার পরিবারের আশ্রয়ে।

এই বাড়ির গৃহিণীর নাম আর আইনস্টাইনের মায়ের নাম এক, একজন পলিন আইনস্টাইন, অন্যজন পলিন উইনটেলার। ষোলো বছরের অ্যালবার্টকে মাতৃস্নেহে নিজের সংসারে ডেকে নিলেন পলিন।

পলিনের স্বামী অধ্যাপক জস (Jost) উইনটেলার আরাউ স্কুলেরই শিক্ষক। তিনি দুটি বিষয় পড়ান— গ্রিক আর ইতিহাস। আইনস্টাইন আর উইনটেলার পরিবার ক্রমেই হয়ে উঠল খুব ঘনিষ্ঠ।

অ্যালবার্টের বোন মায়া বিয়ে করল জস আর পলিনের ছেলে পলকে।

আর অ্যালবার্ট প্রেমে পড়ল এঁদের মেয়ে মেরির— প্রথম প্রেম। মেরিরা তিন বোন। সবচেয়ে সুন্দরী মেরি।

কেমন ছিল অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের প্রথম প্রেম? এক কথায়, মধুর রসে পূর্ণ, রোম্যান্টিক প্রেম।

কীভাবে জানা গেল এই কথা?

মেরিকে লেখা আইনস্টাইনের একটি চিঠি থেকে। চিঠিটা পাওয়া গেছে— ষোলো বছরের অ্যালবার্টের প্রথম প্রেমপত্র— মেরিকে লিখছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন—

Many, many thanks for your charming little letter, which made me endlessly happy. It is so wonderful to be able to press to one’s heart such a bit of paper which two so dear little eyes have lovelingly beheld and on which the dainty little hands have charmingly glided back and forth. I was now made to realize to the fullest extent, my little angel, the meaning of homesickness and pining. But love brings much happiness— much more so than pining brings pain. Only now do I realize how indispensible my dear little sunshine has become to my happiness… You mean more to my soul than the whole world did before.

অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের কলম থেকে বিশুদ্ধ রোম্যান্টিক প্রেমের প্রথম উচ্চারণ— স্বতন্ত্র এর মূল্য।

মেরির কাছ থেকে একটি প্রেমপত্র পেয়েছেন অ্যালবার্ট। তারই উত্তরে এই চিঠি। এই চিঠি পেয়ে তিনি কৃতজ্ঞ এবং অন্তহীনভাবে খুশি।

প্রেমপত্রের টুকরো কাগজটি বুকের ওপর হৃদয়ের কাছে ধরে রাখলেন অ্যালবার্ট। এই কাগজটির দিকেই তো প্রেমপূর্ণ দুটি চোখ দিয়ে তাকিয়ে চিঠি লিখেছে প্রিয়তমা মেরি। এই কাগজের ওপর দিয়েই আগে-পিছনে বারবার ঘোরাফেরা করেছে তার দুটি সুগঠিত হাত— তাই তো কাগজটিকে অনেকক্ষণ হৃদয়ের কাছে ধরে রেখেছেন অ্যালবার্ট। হে আমার ছোট্ট পরী, আমি এতদিনে, এইবার, গভীরভাবে বুঝতে পারলাম বাড়ির জন্যে মনকেমনের কষ্ট কাকে বলে। লিখছেন অ্যালবার্ট, কিন্তু মেরি, প্রেম নিয়ে আসে অনেক বেশি সুখ। এই সুখ মন-কেমনের কষ্টকে ছাপিয়ে যায়। এক সময়ে সারা ভুবনের মূল্য আমার কাছে যা ছিল, তার চেয়ে এখন অনেক বেশি আমার কাছে মেরি তোমার মূল্য। আমার আত্মার কাছে তুমি সারা বিশ্বজগতের চেয়েও বেশি!

এই চিঠি এক সম্পূর্ণ অপরিচিত অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। মনে হয় এ-লেখা কোনও বিজ্ঞানীর নয়। কোনও রোম্যান্টিক কবির। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মধ্যে এই দ্বৈতসত্তা সারাজীবন প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বিজ্ঞানী, কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি কল্পনাপ্রবণ দার্শনিক। আইনস্টাইনের এই দ্বৈতসত্তাকে সম্ভবত প্রথম লক্ষ করেন তাঁর স্কুলের বন্ধু হান্স বাইল্যান্ড।

বাইল্যান্ড লিখেছেন, ‘He was one of those split personalities who knows how to protect, with a prickly exterior, the delicate realm of their intense emotional life.’ আইনস্টাইনের অন্তরটি ছিল তীব্র আবেগপ্রবণ। তাঁর জীবনের অন্তরমহলও চালিত হত তীব্র আবেগের দ্বারা। তিনি ছিলেন সেইসব মানুষের একজন যারা বাইরের কণ্টকিত কাঠিন্যের আবরণে আগলে রাখেন ভিতরের কমনীয়তা। আইনস্টাইন যখন তাঁর বেহালায় বাজাতেন মোত্সার্টের সোনাটা তখন তাঁর অন্তরের এই কোমল লাবণ্য প্রকাশিত হত।

মেরি কেমন চোখে দেখেছিল ষোলো বছরের অ্যালবার্টের প্রেমকে? এ-প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে মেরি নিজেই— We loved each other fervently, but it was a complete ideal love. আমরা পরস্পরকে ভালবেসেছিলাম গাঢ় উষ্ণতার সঙ্গে কিন্তু আমাদের প্রেম ছিল সম্পূর্ণভাবে আদর্শ। অর্থাৎ এই প্রেম ছিল রোম্যান্টিক। শারীরিক নয়। মেরি অ্যালবার্টকে আদর করে কী নামে ডাকত? অ্যালবার্ট ছিল এই মেয়ের ‘clever darling curlyhead’। কখনও বা ‘the great dear philosopher.’

কিন্তু মেরি ক্রমশই বুঝতে পারছিল, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এক অসামান্য প্রতিভা। তার বোধবুদ্ধি জ্ঞান— এসবের নাগাল পাওয়া মেরির পক্ষে সম্ভব নয়।

সুতরাং তার মনে ভয় ঢুকল— সম্ভব কি অ্যালবার্টের পক্ষে মেরিকে চিরদিন ভালবাসা? অ্যালবার্টের জীবনসঙ্গিনী হওয়ার যোগ্যতা সে কী করে অর্জন করবে?

মেরি অ্যালবার্টকে লিখল, I am an insignificant silly little sweetheart that knows nothing and understands nothing.

মেরির এই স্বীকারোক্তি যতই সত্য হোক, অপ্রস্তুত অ্যালবার্ট মেরিকে তিরস্কার করে লিখলেন, নিজেকে কখনও এইভাবে ছোট করে দেখো না।

মেরি অ্যালবার্টের কাছে জানতে চাইল, আমার কাছে থাকতে থাকতে তোমার ধৈর্যের অভাব হবে না তো? আমি তোমার তুলনায় নিতান্তই সাধারণ, সব ব্যাপারেই দুর্বল। আমাকে মেনে নেওয়ার জন্যে যে ধৈর্যের প্রয়োজন, তা কি তোমার আছে?

উত্তরে অ্যালবার্ট জানালেন, And as to whether I will be patient? What other choice do I have with my beloved, naughty little angel? The more so since little angels are always weak… and you are, after all, and should be, my littel angel. আমি ধৈর্যবান হয়ে তোমার সঙ্গে থাকতে পারব কিনা তুমি জানতে চেয়েছ। আমার প্রিয়তমা, আমার ছোট্ট দুষ্টু পরি, ধৈর্য না ধরে কী উপায় আছে আমার? তুমি যে দুর্বল আমি তো তা জানি। কারণ ছোট্ট পরিরা দুর্বল হয়। যাই হোক, যাই ঘটুক, তুমি চিরদিন আমার ছোট্ট পরিই থাকবে। এই চিঠি পড়ে কে বলবে আইনস্টাইন মেরির চেয়ে দু’বছরের ছোট।

কিন্তু মেরি কল্পনাও করতে পারেনি যে এই সময়ে আইনস্টাইনের মন চলে যাচ্ছে ভিন্ন পথে। এখন থেকেই অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের প্রোজ্জ্বল প্রতিভা ক্রমশ প্রকাশিত হতে শুরু করল। এক নতুন আত্মবোধ ও আত্মবিশ্বাসে উত্তীর্ণ হলেন অ্যালবার্ট। তিনি নিজেই লিখলেন, তিনি হতে চান গণিতের শিক্ষক এবং পদার্থ বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ। এই সময়ে মেরিকে একটি চিঠিতে হঠাৎ জানালেন আইনস্টাইন, আর তিনি মেরিকে চিঠি লিখতে চান না। মেরির মনে হল, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন মেরির কাছ থেকে আর যেন কিছু পাবার আশা করেন না। গভীর বেদনার সঙ্গে মেরি লিখলেন—

My love I do not quite understand— you write that you do not quite want to correspond with me any more, but why not, sweetheart? I could never describe, because there are no words for it, how blissful I feel ever since the dear soul of yours has come to live and weave in my soul. All I can say is that I love you for all eternity, sweetheart, and may God preserve and protect you.

কী অসহায় বেদনাদীর্ণ এই চিঠি!

প্রিয়তম, আমি সত্যি বুঝতে পারছি না কেন তুমি আমাকে আর চিঠি লিখতে চাও না। কী এমন হল? তোমার আত্মা আমার আত্মার মধ্যে যতদিন শুরু করেছে বসবাস, যতদিন তোমার অন্তরের বুনন মিশেছে আমার অন্তরবুননের সঙ্গে, আমি বর্ণনা করে তোমাকে বোঝাতে পারব না, ততদিন আমি রয়েছি অপূর্ব স্বর্গীয় অনুভূতির মধ্যে! তুমি আমার সেই স্বর্গসুখ ভেঙে দেবে? কেন? আমার শুধু এইটুকু বলার আছে যে, তোমার প্রতি আমার প্রেম চিরায়ত, কোনওদিন ফুরিয়ে যাবে না। ঈশ্বর তোমাকে ভাল রাখুন, তোমাকে আগলে রাখুন সকল বিপদ থেকে।

মেরির এই চিঠির তাড়াতাড়ি উত্তর দিলেন না অ্যালবার্ট। এইভাবে তাকে বুঝিয়ে দিলেন, যে পথে রচিত হতে চলেছে তাঁর বিপুল ভবিষ্যৎ সেই পথে মেরির আর তেমন প্রয়োজন নেই অ্যালবার্টের জীবনে। অসহায় মেরি চিঠি লিখল অ্যালবার্টের মা পলিনকে। পলিন কি অ্যালবার্টের মনের খবর জানেন? সাহায্য করতে পারেন মেরিকে? অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে ফিরিয়ে আনতে পারেন মেরির কাছে? কী লিখলেন মেরিকে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মা? লিখলেন, রাস্কেলটাকে বদলে দিয়েছে তার লেখাপড়া। আর লিখলেন, আমি অ্যালবার্টকে বলব। কিন্তু লাভ হবে কী?

মা পলিনের কাছেও অ্যালবার্ট আইনস্টাইন যেন এক অপরিচিত মানুষ। এই অ্যালবার্টকে কি পলিন জানেন?

পলিনের মনে হয়, অ্যালবার্ট আপাতভাবে ভীষণ অলস হয়ে গেছে। তার মধ্যে কমে গেছে বাহ্যিক ব্যস্ততা। তার পুত্রটি ডুবে আছে ধ্যানে, ভাবনায়, মগ্নতায়। এই ছেলেকে তিনি বোঝেন না। মেরিকে তিনি লিখলেন, The rascal has become frightfully lazy. ছোঁড়াটা মারাত্মক কুঁড়ে হয়ে গেছে!

ঠিক এই সময়ে মেরির মাকে অ্যালবার্ট লিখলেন আশ্চর্য কয়েকটি কথা। এই কথাগুলির মধ্যে ধরা আছে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের ভবিষ্যৎ জীবনের বীজ। আইনস্টাইন কী লিখেছিলেন? লিখেছিলেন—

I will find my destiny in the stars!

নির্ভুল এই ভবিষ্যৎবাণীর মধ্যে একাকার হয়ে আছেন এক কবি ও বিজ্ঞানী, এক রোম্যান্টিক কল্পনাপ্রবণ মানুষ ও এক দার্শনিক। যেন এক নতুন অপরিচিত অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম হল এই ভবিষ্যত্বাণীর মধ্যে। যে-মানুষটির সঙ্গে ভবিষ্যতের চলার পথ নির্ধারণ করবে এই বিশ্বভুবনের সঙ্গে তাঁর একাত্মতার, তাঁর মানসবন্ধনের বোধ। আইনস্টাইন বললেন, আমি খুঁজে পাব আমার ভাগ্য, আমার ভবিষ্যৎ, আকাশভরা সূর্য তারার মাঝে। সেইখানেই জাগরিত আমার চরম বিস্ময়, আমার সমস্ত জীবনের সন্ধান। বুঝিয়ে দিলেন ওই একটি কথার মধ্যে— এই মহাজাগতিক এষণার মধ্যে কোথায় মেরি? তার জায়গাটুকু আমার জীবনে লুপ্ত প্রায়। আমার এই অনন্ত মানস অভিযানে মেরির বন্ধন আমাকে কাটাতেই হবে। এক হৃদয়স্পর্শী চিঠি লিখলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন— যে চিঠিটি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমসাহিত্যে স্থান পাওয়ার যোগ্য। এই চিঠির মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের অন্তর্দ্বন্দ্ব। তিনি ছেড়ে যাচ্ছেন মেরিকে। জেনেশুনে তিনি কষ্ট দিচ্ছেন এই মেয়েটিকে। কিন্তু মেরিকে নিয়ে থাকলে যে তাঁর ভবিষ্যৎ রচিত হবে না। অ্যালবার্টের স্বীকারোক্তিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখছেন, এবার আমাকেও কষ্ট পেতে হবে। যে-কষ্ট আমি মেরিকে দিচ্ছি তার কিছুটা আমিও পাচ্ছি। আমি কি এই কষ্ট তাকে দিলাম দুটি কারণে? এক, আমি কি স্বার্থপর? তার কথা ভাবলাম না? দুই, তার কোমল প্রকৃতিও আমি সবটা বুঝতে পারিনি? Now I myself have to taste some of the pain that I brought upon the dear girl through my thoughtlessness and ignorance of her delicate nature.

কিন্তু কেন এমন করলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন? কেন এই নিষ্ঠুরতা? তিনি পরিষ্কার জানাচ্ছেন, strenuous intellectual work and looking at God’s nature are the reconcilling, fortifying, yet relentless strict angels that shall lead me through all my life’s troubles. আইনস্টাইনের জীবনে যেন আর লিটল এঞ্জেল-এর প্রয়োজন নেই। এখন ডাক এসেছে কর্মযজ্ঞের, যাকে তিনি বলছেন relentlessly strict angels. সেই ডাকে সাড়া দিতে মেরির হাত ছাড়তেই হল অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে।

কিন্তু মেরির হাত ছাড়লেও নারীর হাত ছাড়লেন না আইনস্টাইন। ১৮৮৯ সাল। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কুড়ি। তাঁর জীবনে এল নতুন প্রেমিকা। নাম, মিলেভা।

জুরিখে ফিজিক্সের ক্লাস-মেট। বিয়েও করলেন তাঁকে। দুটি ছেলে হল তাঁদের। কিন্তু বিয়ে টিকল না। শেষ হল ডিভোর্সে। পরে আর একবার বিয়েও হল আইনস্টাইনের। কিন্তু সংসারের সুখ পেলেন কি? তিনি তাঁর এক পরম বিজ্ঞানী বন্ধুকে সেকথা জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন— You are happily married all your life. I tried twice but failed miserably both times. বিয়ে আর বিজ্ঞানকে মেলাতে পারেননি আইনস্টাইন। কিন্তু জীবনের শেষ তিরিশ বছর কাটালেন বিশ্বের ফোর্সগুলির মেলবন্ধনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *